বাংলা সারমর্ম (১৫) টি


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাঁদের হৃদয়।



সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে ভুলে ক্ষমতার লোভে কিছু মানুষের করায়ত্বের কারণে আধুনিক পৃথিবী আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। অথচ যে মহৎ মানুষগুলোর অন্তরে মানুষকে ভালোবাসা তথা দেশপ্রেমের এক সহজাত অনুভব, উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে আছে তারা আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত।
অধম রতন পেলে কি হবে ফল?
উপদেশে কখনও কি সাধু হয় খল?
ভালো মন্দ দোষগুণ আধারেতে ধরে,
ভুজঙ্গ অমৃত খেয়ে গরল উগরে
লবণ জলধি জল করিয়া ভক্ষণ
জলধর করে দেখ সুধা বরিষণ।
সুজনে সু-যশ গায় কু-যশ ঢাকিয়া
কুজনে কু-রব করে সু-রব নাশিয়া।



সুজন-কুজন অর্থাৎ ভালো-মন্দ মানুষ নিয়েই এ জগৎ সংসার। যারা সুজন তারা অন্যের মঙ্গল চিন্তা করে এবং ভালো দিকগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু যারা কুজন তারা সব সময় অন্যের অনিষ্ট করার চিন্তায় মগ্ন থাকে এবং অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়।
অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ;
আপনার ললাটের রতনপ্রদীপ
নাহি জানে, নাহি জানে সূর্যালোকলেশ।
তেমনি আঁধারে আছে এই অন্ধ দেশ।
হে দন্ড-বিধাতা রাজা- যে দীপ্ত রতন
পরায়ে দিয়েছ ভালে তাহার যতন
নাহি জানে, নাহি জানে তোমার আলোক।
নিত্য বহে আপনার অস্তিত্বের শোক,
জনমের গ্লানি। তব আদর্শ মহান
আপনার পরিমাপে করি খান-খান
রেখেছে ধূলিতে। প্রভু, হেরিতে তোমার
তুলিতে হয় মাথা ঊর্ধ্বপানে হায়।
সে এক তরণী লক্ষ লোকের নির্ভর
খন্ড- খন্ড- করি তারে তরিবে সাগর ?



শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা, ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশ আজ অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। নিজেদের সুবিশাল ঐতিহ্য ভুলে সবাই বিভেদের বেড়াজালে বন্দি। তবুও আশার বাণী, অতীত হারানো ঐতিহ্য চেতনায় বলীয়ান হয়ে এই দেশ ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য।
অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী।
সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী।।
ভুবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে।
পর্বত সলিল হয় রসনার রসে।।
মিথ্যার কাননে কবু ভ্রমে নাহি ভ্রমে।
অঙ্গীকার অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে।
অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর ?



প্রাণিকূলের মতো জীবনের অস্তিত্ব থাকলেই তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে তাকে হতে হবে নিরহংকার। যিনি কখনো মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবেন না, সেই সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন না। আর তাঁর বাক্য হবে শ্রুতিমধুর ও হৃদয়গ্রাহী।
আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি পাতার বন্ধনে।
সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবো মোরা ফুটবো গো,
অরুণ রবির সোনার আলো দু’হাত দিয়ে লুটবো গো।
নিত্য নবীন গৌরবে
ছড়িয়ে দেব সৌরভে,
আকাশ পানে তুলব মাথা, সকল বাঁধন টুটবো গো।
সাগর জলে পাল তুলে দে, কেউবা হবে নিরুদ্দেশ,
কলম্বসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবে নতুন দেশ।
জাগবে সারা বিশ্বময়।
এ বাঙালী নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি-সাহস আজও এদের হয় নি শেষ।



আজকের শিশুরাই নতুন পথের নবীন পথিক। এরা আজ নব উদ্যমে, নব নব অভিযানে সারা বিশ্বে সাড়া জাগাবে। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সৌরভ ছড়াবে। প্রমাণ করে দিবে বাঙালি অমিত তেজ, জ্ঞান-বুদ্ধিতে নিঃস্ব নয়, বরং বাঙালিরাই শ্রেষ্ঠ।
আমরা সিঁড়ি
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরে তাকাও না পিছনের দিকে।
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর, চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত অত্যাচারী পদধ্বনি।
তবু আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত,
আর, সম্রাট হুমায়ুনের মত
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।



বর্তমান সভ্যতার বিকাশের মূলে রয়েছে শ্রমজীবীদের অক্লান্ত শ্রম। অথচ এই শ্রমজীবীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে শোষক শ্রেণি। এমনকি শ্রমজীবীদের অবদানটুকুও তারা স্মরণ করে না। তাই শোষক শ্রেণিদের প্রতি শ্রমজীবীদের সতর্ক বাণী অচিরেই শোষকদের অত্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ পাবে, আর তখন তাদের  পতন অবশ্যম্ভাবী।
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত,
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান।
চলমান বেগে প্রাণ উচ্ছল
রে নবযুগের স্রষ্টাদল
জোর-কদম চলরে চল।



তারুণ্যে উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ ঘুণেধরা অতীতকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে সৃষ্টির উম্মাদনায় এগিয়ে যায়। তারা সৃষ্টি করবে নতুন জগৎ। এই প্রেরণায় বিপ্লবী হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়।
আমার গানের সবটুকু সুর সবটুকু আরাধনা
এই হৃদয়ের সব সৌরভ-বাসনার ব্যঞ্জনা
একাগ্র আর অকুণ্ঠ হয়ে বহু বাতায়ন দ্বারে
আঘাত হেনেছে, পেতেছে দুহাত দুরাশায় বারে বারে।
মেলেনি কিছুই।
বুঝেছি সেদিন মানুষ এমনই দীন,
এ মাটির কাছে আছে আমাদের এমনি অশেষ ঋণ।
অনাদি কালের বন্ধন আর বঞ্চনা একাসনে
চিরজীবনের শৃঙ্খলসম জড়ানো মানব-মনে।
তাই বেদনার বহ্নি ও প্রাণে মাধুর্যে সুনিবিড়,
ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তাই বাঁধিলাম নীড়।
তীক্ষ্ম নখর উদ্যত যার তারে ভালবাসিলাম
দুনয়নে যার হিংস্র আগুন আজো জপি তার নাম।



অজ্ঞতা ও হিংস্রতা এ পৃথিবীর মানবকূলকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবুও কিছু সংখ্যক মহৎ প্রাণের অধিকারীগণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত; কিন্তু তাঁদের শুনতে হয় বিবেকহীন মানুষের গঞ্জনা, সহ্য করতে হয় লাঞ্ছনা। তারপরও এই মহৎ প্রাণের অধিকারী সুমহান মানুষগুলো বিবেকহীন মানুষের কল্যাণের জন্য জীবনের বিনিময়ে অবিরাম কাজ করে যান।
আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই
সকলের সুখ সখা, সুখ শুধু তাই।
আমার একার আলো সে যে অন্ধকার,
যদি না সবারে অংশ দিতে আমি পাই।
সকলের সাথে বন্ধু, সকলের সাথে,
যাইব কাহারে বলো, ফেলিয়া পশ্চাতে।
একসাথে বাঁচি আর একসাথে মরি,
এসো বন্ধু, এ জীবন সুমধুর করি।



আত্মসুখ প্রকৃত সুখ নয়, প্রকৃত সুখ সমষ্টিগত। কেননা মানবকুল একে অন্যেআমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে-
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’-
সুন্দর হল সে।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা।
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।


মানুষ সুন্দরের পূজারী। কারণ সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে মানুষ পৃথিবীকে নতুন করে ভালোবাসে। তাই পৃথিবীর সৌন্দর্য ও ভালোবাসা সত্য এবং শ্রেষ্ঠ।
র সাথে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই সমষ্টিগতভাবে পরস্পরের সান্নিধ্যে জীবনকে সুখময় করে তোলার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সুখ নিহিত।
আমার একূল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।
যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনমভর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

সূত্রঃ কবিতা:-প্রতিদান; কবি:-জসীম উদ্দীন।



মহৎ ব্যক্তিগণ কখনো সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেন না। তাঁরা সব সময় অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন অন্যের কল্যাণের মাঝেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। তাই অন্যের দেওয়া আঘাত সহ্য করে যারা পরকে আপন করেন ভালোবাসা দিয়ে শত্রুর মন জয় করেন, তাদের  মধ্যেই মনুষ্যত্বের লক্ষণ প্রকাশিত হয়।
আমি চাই মহতের মহৎ পরাণ
মুকুতা-মাণিক্য-নিধি
আমারে দিও না বিধি
চাহিনে এ জগতে রাজত্ব সম্মান।
বাঞ্ছিত পরাণ পেলে
মেগে নেব মনুষ্যত্ব শ্রেষ্ঠ উপাদান
প্রাণের সাধক আমি, সাধনীয় প্রাণ।



একজন মননশীল হৃদয়বান মানুষের কাছে মহৎ প্রাণই কাম্য। ক্ষমতা, রাজত্ব বা সম্মান মহৎ প্রাণের নিকট কখনোই কাম্য নয়। তাই মহৎ প্রাণের অধিকারীগণ চান প্রকৃত মনুষ্যত্ব, যেখানে মনুষ্যত্বের বাঁধনে মানবজীবন হবে গৌরবম-মন্ডিত।
আমি যেন কোন এক বসন্তের রাতের জোনাকি,
অথবা দিনের শেষে কোন নীল আকাশের পাখি,
আমি যেন ছোট নদী বুকভরা ছোট ছোট ঢেউ,
সে নদীতে স্নান করে গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ।
আমি যেন কোন এক পথশ্রান্ত অচেনা পথিক,
দুদ- তাকিয়ে থাকি যে-আকাশ আলো ঝিকমিক,
আমি যেন কত বন, কত মেঘ, বালুতীর,
অথবা অনেক রাতে একমুঠো চাঁদের আবির।


সৌন্দর্যময় এ পৃথিবী সকল নৈসর্গিক উপাদানে সমৃদ্ধ। এই অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্তকাল ধরে কবিচিত্তে হিল্লোল তুলছে। এরই বহিঃপ্রকাশ কবির নানা অনুষঙ্গে।
আমি মরু-কবি গাহি সেই বেদে-বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্র সুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে।
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোন বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপ-মন্ডুক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে।
তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।


কবি সেই সব মানুষের বন্দনা করেছেন যারা যুগে যুগে নিয়ে আসে বিপ্লব, করেছেন আত্মত্যাগ। কিন্তু সংকীর্ণমনারা এদেরকে উচ্ছৃঙ্খল বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরাই নন্দিত, বন্দনীয় পূজনীয়।
আমি আলো এবং অন্ধকারকে চিনি
ফুল এবং পাখিকে চিনি
সামান্য স্তন্যপ্রায়ী থেকে
বহুভোজী বহু প্রাণী চিনি;
শ্রমে প্রেমে ক্রোধে প্রতিশোধে
মানুষের মত কেউ নয়।
গড়ে ওঠে অরণ্যভোগী লোকালয়
-মানুষের শ্রমে,
গড়ে ওঠে মধুকুঞ্জ বংশধারা
মানুষের প্রেমে কামে,
জ্বলে ওঠে দাবানল
-মানুষের ক্রোধে,
লোকালয় অরণ্য হয়
-মানুষের ঘৃণায়, প্রতিশোধে।


প্রাণিজগতের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। অরণ্যঘেরা পৃথিবীতে তিলে তিলে মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা। আবার মানুষের ক্রোধেই দাবানলের মতো জ্বলে পুড়ে সভ্যতার বিনাশ ঘটে।
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।


আঠারো বছর বয়সের ধর্মই হলো মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আঘাত-সংঘাতের মধ্যে রক্তশপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এ বয়সই অদম্য দুঃসাহসে সকল বাধা-বিপদকে পেরিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই সঙ্গে নব সৃষ্টির উল্লাসে মাতোয়ারা থাকে।
আসিতেছে শুভ দিন
দিনে দিনে বহু বাড়িতেছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
হাতুড়ি, শাবল, গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমাদের সেবিতে হইল যাহারা মজুর,মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।


দিনে দিনে শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। কিন্তু এই শ্রমজীবী মানুষ শোষিত, বঞ্চিত, ও অবহেলিত। তবে শ্রমজীবী মানুষদের যারা শোষণ করছে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। কেননা, শ্রমজীবীদের নব উত্থানের সূচনা আসন্ন।
ইচ্ছা করে মনে মনে
স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোক সনে
দেশে দেশান্তরে; উষ্ট্রদুগ্ধ করি পান
মরুতে মানুষ হই আরব সন্তান
দুর্দম স্বাধীন, তিব্বতের গিরিতটে
নির্লিপ্ত প্রস্তুরপুরী মাঝে, বৌদ্ধ মঠে
করি বিচরণ। দ্রাক্ষাপায়ী পারসিক
গোলাপ কাননবাসী তাতার নির্ভীক
অশ্বারূঢ়, শিষ্টাচারী সতেজ জাপান
প্রবীণ প্রাচীন চীন নিশি দিনমান
কর্ম-অনুরত,-সকলের ঘরে ঘরে
জন্মলাভ করে লই হেন ইচ্ছা করে।


পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই মানবজীবন সার্থক হয়ে ওঠে। তাই প্রকৃত মানবপ্রেমিকগণ পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মানুষকে অনুভব করেন আত্মীয় হিসেবে। আর এভাবেই প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্মলাভ করে নিজেকে বিশ্বসভ্যতার অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে চান।
ইসলাম বলে, সকলের তবে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
কারো আঁখি জলে কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বদ নসীব।
এ নহে বিধান ইসলামের।
ঈদ-উল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা তা কর দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক সবার।
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে
তৃষাতুরের হিসসা আছে ও- পেয়ালাতে
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার।


ইসলাম ধর্মে কোনো বিভেদ নেই, নেই কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্য, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি। তাই নিজের অর্জিত সম্পদ ঈদ-উল-ফিতরে দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কেননা ত্যাগের মধ্যেই মহানুভবতার পরিচয় নিহিত, ভোগে নয়। এসবই ইসলাম ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য বলে এ ধর্মকে শান্তি ও সাম্যের ধর্ম বলা হয়।
উড়িয়া মেঘের দেশে চিল কহে ডাকি;
কি কর চাতক ভায়া ধূলি মাঝে থাকি।
কোথায় উঠেছি চেয়ে দেখ একবার
এখানে আসিতে পার সাধ্য কি তোমার।
চাতক কহিছে, তবু নিচে দৃষ্টি তব,
গদা ভাব কার কিবা ছোঁ মারিয়া লব।
মেঘ বারি ভিন্ন অম্ল জল নাহি খাই,
তাই আমি নিচে থেকে ঊর্ধ্বমুখে চাই।


পৃথিবীতে উঁচু-নিচু নানা শ্রেণির মানুষ বাস করে। অর্থের দিক থেকে ধনী হলেও ক্ষুদ্রমনা মানুষ অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বড় মনের মানুষ আর্থিকভাবে গরীব হলেও সমাজের সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন।
এ জীবনে যে যাহারে প্রাণ ভরি ভালবাসিয়াছে
উচ্চ হোক তুচ্ছ হোক দূরে কিংবা থাক তাহা কাছে,
পাত্র বা অপাত্র হোক, প্রেমেই প্রেমের সার্থকতা;
বিশ্বজয়ী প্রেম কভু বিশ্ব মাঝে জানে না ব্যর্থতা।
প্রেমিকের অশ্রুজলে মন্দাকিনী চির-প্রবাহিত,
প্রণয়ীর দীর্ঘশ্বাসে স্বর্গে গিয়া হয় সে বঞ্চিত,
সত্যের নিষ্ফল-প্রেম স্বর্গে গিয়া হয় সে সফল,
নন্দন-মান্দারে রয় প্রণয়ের পরিমল।”


প্রেম সার্থকতা খুজে পায় প্রেমের মাঝেই। প্রেমে ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। প্রেমিকের অশ্রু আর প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস স্বর্গের উদ্যানে ফুল হয়ে ফোটে। মর্ত্যলোকে যে প্রেমকে নিস্ফল মনে হয়, তা সুশোভিত হয় স্বর্গের নন্দন কাননে।
এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সব তুচ্ছ ভয়
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দন্ডে গলে পরে
এই আত্ম-অবমান, অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নত শিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারংবার
মনুষ্য-মর্যাদা-গর্ব চির পরিহার
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে।


লোকনিন্দা, ক্ষমতা ও মৃত্যুর ভয় মানুষের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ব্যক্তিত্বকে আঘাত করে আত্মাকে দুর্বল করে ফেলে। সুতরাং স্বাধীনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে মনের ভেতরের সকল প্রতিকূলতাকে দূর করতে হবে।
এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা, এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে-
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথকুক্কুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার;
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে।


শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখের অবসান ঘটাতে হবে। শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে মনোবল জাগাতে হবে। ঐক্যবদ্ধ জনতার সামনে শোষক বা অত্যাচারী যত বড়ই ক্ষমতাবান হোক না কেন তার হীন কর্মের জন্য অপমানিত হবে এবং পরাজয় অনিবার্য।

একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে, দহিল হৃদয় মন সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
সেথা দেখি একজন পদ নাহি তার,
অমনি জুতার খেদ ঘুচিল আমার।
পরের দুঃখের কথা করিলে চিন্তন,
আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ?


নিজের জুতো নেই বলে ক্ষোভের কিছু নেই। কারণ যার পা নেই সেই দুঃখীজনের কথা ভাবলেই এ দুঃখবোধ স্থান পাবে না। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর অন্যের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-ক্ষোভ উপলব্ধি করার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।
একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক! রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্য-নক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশর ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; যুগ-যুগান্তর হতে
মহাকালযাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহূর্তের তব
শুভক্ষণে দিয়াছে সম্মান; তোমার সম্মুখ দিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি অনন্তের পানে-
সেথা তুমি এক যাত্রী অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়।


দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানবসভ্যতার সঙ্গে মানুষ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করে। প্রকৃতির সঙ্গেও রয়েছে মানুষের সুসম্পর্ক। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়। কিন্তু এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ সঙ্গীহীন।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।


নতুন প্রজন্মের জন্য পুরাতন প্রজন্মকে স্থান ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবী নানা সংকটে জর্জরিত। তাই সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সকল জীর্ণতা, ব্যর্থতা, গ্লানি দূর করে দিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে।
ওই যে লাউয়ের জাংলা পাতা ঘর দেখা যায় একটু দূরে
কৃষক বালা আসছে ফিরে পুকুর হতে কলসী পুরে।
ওই কুঁড়েঘর উহার মাঝেই যে চিরসুখ বিরাজ করে,
নাইরে সে সুখ অট্টালিকায়, নাইরে সে সুখ রাজার ঘরে।
কত গভীর তৃপ্তি যে লুকিয়ে আছে পল্লীপ্রাণে,
জানুক কেহ নাই- বা জানুক সে কথা মোর মনই জানে
মায়ের গোপন বিত্ত যা তার খোঁজ পেয়েছে ওরাই কিছু
মোদের মত তাই ওরা আর ছুটে নাকো মোহের পিছু।


সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের পল্লীগ্রাম। গ্রামের বধূদের পুকুর থেকে জল নিয়ে আসা এবং জীর্ণ কুটিরে বসবাসের মধ্যেও শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যায়। কিন্তু ধনিক শ্রেণির প্রচুর্যের মধ্যেও এ সুখ নেই। তাই শান্ত সিগ্ধ পল্লির মমতাময় জীবন ছেড়ে প্রাচুর্যের মোহের দিকে কেউ ধাবিত হয় না।
কতবার এল কত না দস্যু, কত না বার
ঠগে ঠগে হল আমাদের কত গ্রাম উজাড়
কত বুলবুলি খেল কত ধান-
কত মা গাইল বর্গীর গান-
তবু বেঁচে থাকে অমর প্রাণ-
এ জনতার-
কৃষাণ, কুমোর, জেলে, মাঝি, তাঁতি আর কামার,
অমর দেশের মাটিতে মানুষ তাদের প্রাণ-
মূঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।


বাঙালির ইতহাস রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। সুদীর্ঘকাল থেকে বাংলার বুকে নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়গ। তবু বাংলার সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষ বহিরাগত আক্রমণের মুখেও অব্যাহত রেখেছে জীবনধারা।
কবি, তবে ওঠে এসো- যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লয়ে সাথে, তবে তাই করো আজি দান।
বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা - সম্মুখে কষ্টের সংসার
বড়ই দরিদ্র, শূন্য বড় ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহস বিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্য-মাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।


জাতীয় জীবনে সুখ-দুঃখ, হতাশা-ব্যথর্তার গ্লানি মোচন করে জাতির পুনরুজ্জীবনে কবিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে জাতির সংকট উত্তরণে সাহস ও উৎসাহ যোগাবেন। একই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত জাতিকে দেখাবেন নবজীবনের সম্ভাবনা।
কহিল গভীর রাত্রে সংসার বিরাগী
‘গৃহ তেয়াগিব আমি ইষ্ট-দেব লাগি।
কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে!”                                        
দেবতা কহিলা, “আমি।” শুনিল না কানে।
সুপ্তিমগ্ন শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে।
কহিল, “কে তোরা, ওরে মায়ার ছলনা।”
দেবতা কহিলা, “আমি”। কেহ শুনিল না।
ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু!”
দেবতা কহিলা, “হেথা”। শুনিল না তবু।
স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি,
দেবতা কহিলা, “ফির”। শুনিল না বাণী।
দেবতা নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়,
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়!”


স্রষ্টার কাছে প্রিয় তাঁর সৃষ্টি। তাই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসলে তাঁকে পাওয়া যায়। তাই সংসার ধর্ম ত্যাগ করে কখনো স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে না। বরং গৃহে থেকেই স্রষ্টার সাধনা করা যায়।
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল
মাঠ ভারে দেই আমি কত শস্য ফল;
পর্বত দাঁড়ায়ে রহে কি জানি কি কাজ
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচারে কেন উঁচু নিচু,
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, “সব হলে সমভূমি পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গল ধারা?”


এ বিশ্বসংসারে সবাই একই রকম কর্তব্য পালন করে না। তাই বলে কাউকে ছোট বা অপ্রয়োজনীয় মনে করা যাবে না। বরং যে কেউ, যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন সবাইকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। কারণ সবকিছুরই একে অপরের প্রতি একটা যোগসূত্র আছে।

কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টের করব মোরা পরিহাস।
রিক্ত যারা সর্বহারা, সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,
গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।
আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি।
আমরা দুঃখের বক্রমুখের চক্র দেখে ভয় না করি।
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য,
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীলাকাশ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।।


মানবজীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী তেমনি সংগ্রামমুখর। এই সংগ্রামে সুখের সঙ্গে দুঃখ কষ্ট বিদ্যমান। তাই দুঃখের সময় হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। বরং সকল দুঃখ-কষ্ট, প্রতিকূলতা জয় করে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী চলিতেছে যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর,
‘যেতে আমি দেব না তোমায়।’ ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
‘যেতে নাহি দিব; যেতে নাহি দিব।’ সবে
কহে, ‘যেতে নাহি দিব।’ তৃণ ক্ষুদ্র অতি,
তাঁরেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে, ‘যেতে নাহি দিব।’
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,-
আঁধারে গ্রাস হতে কে টানিছে তারে,
কহিতেছে শতবার, ‘যেতে দিব নারে।’
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন, ‘যেতে নাহি দিব।’ হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।


এ পৃথিবীতে কোনো প্রাণীই চিরস্থায়ী নয়। তবু এ পৃথিবী থেকে কেউ যেমন চলে যেতে চায় না তেমনি সবাই সবাইকে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু সবাই ব্যর্থ। ইহকাল ছেড়ে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। এটাই জগতের বিধান।
কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায়,
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার, তারি সাথে হায়., জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা ছলে কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে, তোমার কি নেই দাঁত?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল, “তুইরে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরে গায়ে দংশি কেমন করে?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়,
তা’বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?


দুর্জন ব্যক্তিরা হীন কর্ম করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা মহান, প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী, তারা কখনো আঘাত পেলেও পাল্টা আঘাত করবে না। বরং শত দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনার মধ্যেও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন।
কে বলে তোমারে বন্ধু, অস্পৃশ্য অশুচি
শুচিতা ফিরিছে সাদা তোমারি পিছনে।
তুমি আছ, গৃহবাসে তাই আছে রুচি,
নইলে মানুষ বুঝি ফিরে যেত বনে।
শিশুজ্ঞানে সেবা তুমি করিতেছ সবে,
ঘুচাইছ রাত্রিদিন সর্ব ক্লেদ গ্লানি।
ঘৃণার নাহিক কিছু স্নেহের মানবে,
হে বন্ধু, তুমিই একা জেনেছ সে বাণী।
নির্বিচারে আবর্জনা বহু অহর্নিশ
নির্বিকার সদা শুচি তুমি গঙ্গাজল।
নীলকণ্ঠ করেছেন পৃত্বীবে নির্বিষ।
আর তুমি? তুমি তারে করেছ নির্মল।
এস বন্ধু, এস বীর, শক্তি দাও চিতে
কল্যাণের কর্ম করি লাঞ্ছনা সহিতে।


অস্পৃশ্য, অশুচি বলে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের অপবাদ দেয়া অন্যায়। তারা কাজ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে। তাদের নিকট থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে এবং আমাদের উচিত এই মেহনতি মানুষদের সম্মান করা।
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই, আকাশপাতাল জুড়ে
কে তুমি ফিরিছ বন জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিককে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।
ইচ্ছা-অন্ধ। আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ কায়া,
দেখিবে তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি,
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।


বিধাতাকে পাওয়ার জন্য মানুষ সংসার ত্যাগ করে বৈরাগী হতে চায়। কিন্তু স্রষ্টা তার সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজমান। তাই অন্তর্দৃষ্টি খুলে নিজেকে জানার মাধ্যমেই বিধাতাকে খুজে পাওয়া যায়।
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।


স্বর্গ ও নরক দূরে কোথাও নয়, মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। নিজের কর্মফলের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বর্গ ও নরকের ফল ভোগ করে। যারা বিবেকবর্জিত অন্যায় করে বেড়ায় তারা পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রণার ফল ভোগ করে। পক্ষান্তরে যারা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে তারা পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ লাভ করে।
ক্রন্দিছে নিখিল বন্দী, হে নবীন, মুক্ত কর তারে,
নিয়ে চল আলো অভিসারে।
পৃথিবীর অধিকার-বঞ্চিত যে ভিক্ষুকের দল-,
জীবনের বন্যাবেগে তাদের কর বিচঞ্চল। অসত্য অন্যায়
যত ডুবে থাক, সত্যের প্রসাদ
পিয়ে লভ অমৃতের স্বাদ।
অজস্র মৃত্যুরে লঙ্ঘি হে নবীন, চল অনায়াসে
মৃত্যুঞ্জয়ী জীবন-উল্লাসে।


এ পৃথিবীতে নবীনরাই মৃত্যুভয়কে জয় করে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে পারে। তাইতো শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে প্রতিবাদী হয়ে সংগ্রামের পথে যেতে হবে। মানবতার এ পথই চিরায়ত কল্যাণের পথ।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।
তোমার আদেশ, যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য জ্বলি উঠে খর খড়গ সম।
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।


ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও তা যেন সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। যদি হয় তাহলে সেখানে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এজন্য অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় না দেওয়াই উত্তম। কেননা, অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী দুজনেই সমঅপরাধী।
ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মান্ডের মাঝে
সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে;
পূরবের নব সূর্য, নিশীথের শশী
তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি।
আমার এ গান এও জগতের গানে
মিশে যায় নিখিলের মর্ম মাঝখানে;
শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর
সকলের মাঝে তার আপনার ঘর।
কিন্তু হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার।
ক্ষুদ্র রুদ্ধ দ্বারে শুধু একাকী তোমার।


তৃণলতা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তারও যোগসূত্র রয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সে সূর্য ও চাঁদের সঙ্গে সমগোত্রীয়। কবির সংগীতের সুরও মিশে যায় বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে। কিন্তু ভোগবিলাসীরা সম্পদকে একান্তভাবে নিজের মনে করে। যে কারণে তারা বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন।

খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
দুই তীরে দুই গ্রাম আছে জানাশোনা,
সকাল হইতে সন্ধ্যা করে আনাগোনা।
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব, কত সর্বনাশ,
নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস-
রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে!
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা!
শুধু হেথা দুই তীরে, কেবা জানে নাম,
দোঁহাপানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে-
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।


সভ্যতার উষালগ্ন থেকে পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিরাজমান। ফলে রক্ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ইতহাস, সা¤্রাজ্য রচিত হচ্ছে। অথচ বাংলার গ্রাম এ থেকে ব্যতিক্রম। নেই কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত বরং তাদের মধ্যে রয়েছে প্রীতির বন্ধন। এখানে কেউ খেয়া পার হয়ে যায় অথবা কেউ আসে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে সহজ সরল জীবনধারা বিরাজমান।
খোদা বলিবেন, হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধার অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের প্রভু,
আমরা তোমারে কেমনে খাওয়াব, সে কাজ কী হয় কভু?
বলিবেন খোদা-ক্ষুধিত বান্দা গিয়াছিল তব দ্বারে
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।


স্রষ্টার কাছে প্রিয় তার সৃষ্টি, আর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব  হলো মানুষ। মানুষ ইচ্ছে করলেও স্রষ্টা সরাসরি সেবা করতে পারে না। তাই মানুষের মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত তাদেরকে সেবা করলেই ¯স্রষ্টাকে সেবা করা হয়। বিনিময়ে ¯স্রষ্টা ক্ষুধার্তের সেবাকারীকে সমতুল্য সুখ দান করেন।

গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা জানি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে-ফলে।
বন্য-শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণ ধরা
যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।


যাদের কঠিন শ্রমে পৃথিবীর বুকে ফসল উৎপন্ন হয়েছে কবি তাদের জয়গান গেয়েছেন। শ্রমজীবীদের রক্ত ও ঘামেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তাদের শ্রমেই পৃথিবী অনুপম সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। তাই যে শ্রমজীবীরা জরা, মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদেরই জয়গান গাওয়া উচিত।
চাব না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন
হেরিব না দিক-
গণিব না দিনক্ষণ, করিব না বিতর্ক বিচার-
উদ্দাম পথিক।
মুহূর্তে করিব পান মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততা
উপকণ্ঠ ভরি –
খিন্ন শীর্ণ জীবনের শত লক্ষ ধিক্কার লাঞ্ছনা
উৎসর্জন করি।


যারা নব উদ্যমের পথিক তারা কখনো অতীতের মোহে আচ্ছন্ন হয় না, মানে না কোনো বাধা বন্ধন। বরং আত্মত্যাগের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে লাঞ্ছিত জীবনের পরিবর্তে সম্ভাবনাময় জীবনের লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যায়।

ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল,
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্তে নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
গড়ে যুগ যুগান্তর-অনন্ত মহান।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি, ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপপথে, ঘটায় প্রমাদ।
প্রিত করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
এ ধারায় স্বর্গসুখ নিত্য দেয় আনি।



ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা নিয়ে গড়ে ওঠে মহাদেশ, বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে মহাসাগর, তুচ্ছ মুহূর্ত নিয়ে যুগ যুগান্তর। আবার ছোট অপরাধ থেকেই সংঘটিত হয় বড় পাপ।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।


মানব সভ্যতায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নারীর কোন স্থান হয়নি। অথচ পুরুষের সকল কাজের শক্তি, সাহস ও প্রেরণার যোগানদাতা হচ্ছে নারী।
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখতে হলে
আগে তবে নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসর।


যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ সেই সাথে অনুশীলন। কেননা, জলে না নেমে যেমন সাঁতার শেখা যায় না, তেমনি আছাড় না খেলে হাঁটা যায় না। তাই হতাশ না হয়ে সকল দুঃখ কষ্ট সহ্য করে জয়ী হব এই মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই উচিত।
জাতিতে জাতিতে ধর্মে নিশিদিন হিংসা ও বিদ্বেষ
মানুষে করিছে ক্ষুদ্র, বিষাইছে বিশ্বের আকাশ,
মানবতা মহাধর্ম রোধ করি করিছে উল্লাস
বর্বরের হিংস্র নীতি, ঘৃণা দেয় বিকৃত নির্দেশ।
জাতি-ধর্ম-দেশ উর্ধ্বে ঘৃণা উর্ধ্বে পাচ্ছ যেই দেশ,
সেথায় সকলে এক, সেথায় মুক্ত সত্যের প্রকাশ,
মানবসভ্যতা সেই মুক্ত সত্য লভুক বিকাশ,
মহৎ সে মুক্তি-সংজ্ঞা মঙ্গল সে নির্বার অশেষ।
জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্র ন্যায় সকলি যে মানুষের তরে
মানুষ সবার উর্ধ্বে নহে কিছু তাহার অধিক।


মানুষের মধ্যে যে হিংসা বিদ্বেষ বিরাজমান তার মূল কারণ ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্য। অথচ যেখানে মানবধর্মই বড় ধর্ম, সেখানে জাতিগত বিভেদের কারণে মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত। তাই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ধর্মীয় সংঘাত পরিহার করে পৃথিবীর মঙ্গল নিশ্চিত করতে মানবতাকেই দেশকালের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।
জীবনে যত পূজা হলো না সারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
জীবনে আজো যারা রয়েছে পিছে
জানি হে, জানি তাও হয়নি মিছে
আমার অনাগত আমার অনাহত
তোমার বীণাতারে বাজিছে তারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।


এ বিশ্ব জগতে কোনো কর্মই তুচ্ছ বা মূল্যহীন নয়। আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কর্ম শুরু করে এর গুরুত্ব বিবেচনা না করে অসমাপ্ত রেখে দেই। কিন্তু এই অসমাপ্ত কাজের ভেতরেই হয়তো সুপ্ত আছে ভাবীকালের সম্ভাবনা। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় জীবনের জন্য অসমাপ্ত কাজের প্রতি হতাশ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
জীবন্ত ফুলের ঘ্রাণে,
দুপুরের মিহি ঘুম ছিঁড়ে কুঁড়ে গেল :
জেগে দেখি আমি
আমার ঘরেতে ওড়ে ছোট এক বুনো মৌমাছি,
ডানায় ডানায় যার সোঁদাগন্ধ অজানা বনের।
কেমন সুন্দর ওই উড়ন্ত মৌমাছি।
অশ্রান্ত করুণ ওর গুণগুণানিতে
কেঁপে ওঠে মাটির মসৃণতম গান,
আর দূর পাহাড়ের বন্ধুর বিষন্ন  প্রতিধ্বনি।
যেন আজ বাহিরের সমস্ত পৃথিবীর আর সমস্ত আকাশ
আমার ঘরের মাঝে তুলে নিয়ে এল
কোথাকার ছোট এক বুনো মৌমাছি।


ঘরের চারদেয়ালের কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে প্রকৃতির সান্নিধ্য যেমন পাওয়া যায় না তেমনি প্রকৃতিকে অনুভবও করা যায় না। এই কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে যদি কখনো লীলাময়ী প্রকৃতি মুক্তহস্তে সৌন্দর্য বিতরণ করে তাহলে আবার মানুষের হৃদয়ে অনির্বচনীয় ভাবের হিল্লোল তুলে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তা কখনো অস্বীকার করা যায় না।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।


মহাকালের প্রতীক তরীতে কেবল সোনার ফসলরূপ মহৎ সৃষ্টিকর্মের স্থান হয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তাকে অনিবার্যভাবে হতে হয় মহাকালের নিষ্ঠুর করাল গ্রাসের শিকার। অর্থাৎ এ নশ্বর পৃথিবীতে মহৎ কর্মের স্থান হলেও ব্যক্তি মানুষের স্থান নেই।
তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন-
সকল ক্ষমতা মম করহ ছেদন
দৃঢ় বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর! বীর্য দেহ সুখেরে সহিতে
সুখেরে কঠিন করি। বীর্য দেহ দুখে
যাহে দুঃখ আপনারে শান্তস্মিত মুখে
পারি উপেক্ষিতে। ভকতিরে বীর্য দেহ
কর্মে যাহে হয় সে সফল, প্রীতি স্নেহ
পুণ্যে উঠে ফুটে। বীর্য দেহ ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীন জ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে। বীর্য দেহ চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার উর্ধ্বে দিতে রাখি।
বীর্য দেহ তোমার চরণে পাতি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।


ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মনুষ্যত্ব ফুটে ওঠে। বৃক্ষ যেভাবে অপরের সুখের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়, মানুষের মনোভাব সেরূপ হতে হবে। এ জন্য কেউ আঘাত করলে আমরা যেন আঘাতকারীর প্রতি ক্রুদ্ধ না হই। এই মানবিক গুণাবলিকেই মানবজীবনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরি কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।


প্রিয়জন হারানোর যে ব্যথা তা প্রতিটি মানুষের জন্যই অত্যন্ত দুর্বিষহ। এই ব্যথা তার জন্য আরো বেশি তীব্র আরো বেশি মর্মান্তিক যার একাধিক স্বজন চলে গেছে না ফেরার দেশে এবং তাদের তিনি নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়েছেন। তাই মাটিই তার পরম ভালোবাসার স্থান। স্বজন হারানোর ব্যথায় শোকার্ত মানুষ তাই জীবিতদের আঁকড়ে ধরে দুঃখকে প্রশমিত করতে চান।
তোমার ন্যায়ের দন্ড- প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছ নিজে, প্রত্যেকের পরে
দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ।
সে গুরু সম্মান তব, সে দুরূহ কাজ
নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি
সবিনয়ে, তব কাজে যেন নাহি ডরি
কভু কারে।


ন্যায় এবং সত্যের ধারক পরম করুণাময় স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সঞ্চারিত করেছেন ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিবেকবোধ আর শাসন করার ক্ষমতা। বিনীত ব্যক্তি স্রষ্টা প্রদত্ত শক্তি এবং ক্ষমতা নির্ভীকচিত্তে, সঠিকভাবে প্রযোগ করতে চান। আর এ জন্য তিনি স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা করেন।
তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে
তুমি সর কারো ঠেলায়
কেউ-বা সরে তোমার চাপে।
তুমি ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি,
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুঁজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালমন্দ, যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।


পৃথিবীর কোনো মানুষই অর্থ-সম্পদ, মান মর্যাদায় সমান নয়। এই অমোঘ সত্য সবাইকে মানতে হবে, না হলে মানবজীবন দুঃখে পর্যবসিত হবে। জীবনে চলার পথে বহু বাধা-বিপত্তি মানবজীবনকে স্থবির করে দেয়। ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল মানব অস্তিত্বের সঙ্গে বিদ্যমান। তাই যারা দুঃখ, অমঙ্গল, ব্যর্থতাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে তাদের জীবনেই সার্থকতা নিহিত।
তোমাদেরি মাঝে আসে মাঝে মাঝে রাজার দুলাল ছেলে,
পরের দুঃখে কেঁদে কেঁদে যায় শত সুখ পায়ে ঠেলে।
কবি-আরাধ্য প্রকৃতির মাঝে কোথা আছে এর জুড়ি?
অবিচারে মেঘ ঢালে জল, তাও সমুদ্র হতে চুরি।
সৃষ্টির সুখে মহাখুশি যারা তারা নর নহে, জড়;
যারা চিরদিন কেঁদে কাটাইল, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, মিথ্যা রঙ্গিন সুখ;
সত্য সত্য সহস্রগুণ সত্য জীবের সুখ।


আবহমানকাল ধরে পৃথিবীতে অনেক মহৎ ব্যক্তির আগমন ঘটেছে যারা মানব সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। মানবকল্যাণের জন্য নিজের স্বার্থকে বলি দিয়ে পরার্থে জীবন বিলিয়ে দিয়েই তারা শান্তি পান। এ জন্য বলা হয়, পরের জন্য ত্যাগের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত সুখ নিহিত। এ সত্য তারা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন।
তোমাতে আমার পিতা-পিতামহগণ
জন্মেছিলে একদিন আমারি মতন।
তোমারি এ বায়ুতাপে তাহাদের দেহ
পুষেছিলে পুষিতেছ আমায় যেমন।
জন্মভূমি জননী আমার যেথা তুমি
তাহাদেরও সেই রূপ তুমি মাতৃভূমি।
তোমারি কোড়েতে মোর পিতামহগণ
নিদ্রিত আছেন সুখে জীবলীলা শেষে।
তাদের শোণিত অস্থি সকলি এখন
তোমার দেহের সঙ্গে গিয়েছে মা মিশে।
তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার
তোমাদের ধূলিতে কালে মিলাবে আবার।


আবহমান কাল ধরে পূর্বপুরুষগণ জন্ম ভূমির আলো বাতাসে বড় হয়ে আবার জন্মভূমির মাটিতেই মিশে গেছেন। তেমনি বর্তমান কালের মানুষও একদিন পূর্বপুরুষদের মতো জন্মভূমির মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে। এজন্যই প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ জন্মভূমির প্রতি কৃতজ্ঞ।
তোমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই-
কৃপা করে রেখেছ, নাথ,
অনেক ব্যবধান-
দুঃখ-সুখের অনেক বেড়া
ধন জন-মান।
আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
আভাসে দাও দেখা-
কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
রবির মৃদু রেখা।
শক্তি যারে দাও বহিতে
অসীম প্রেমের ভার
একেবারে সকল পর্দা
ঘুচায়ে দাও তার।


এ বিশ্বের সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন মহান ¯স্রষ্টা। তিনি সবার মধ্যেই অবস্থান করেন। আকার-ইঙ্গিতে তার পরিচয়ও দেন। কিন্তু ভক্তরা তা উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ ধন, জন, মান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য ভক্ত প্রার্থনা করেন, আকার-ইঙ্গিতে নয় বরং সকল বাধাকে অতিক্রম করে তিনি যেন ভক্তের সম্মুখে  নিজেকে প্রকাশ করেন।

থাকো স্বর্গে, হাস্যমুখে-করো সুধা পান
দেবগণ। স্বর্গে তোমাদের সুখস্থান,
মোরা পরবাসী। মর্ত্যভূমি স্বর্গ নহে,
সে যে মাতৃভূমি-তাই তার চক্ষে বহে
অশ্রুজলধারা, যদি দু’দিনের পরে
কেহ তারে ছেড়ে যায় দু’ দন্ডের তরে।
যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন,
যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন।
সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায়-
ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায়
জননীর। স্বর্গে তবে বহুক অমৃত,
মর্ত্যে থাক সুখে-দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত
প্রেমধারা অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্ণখন্ড-গুলি।


দেবতাদের বাসস্থান স্বর্গে রয়েছে অবারিত সুখ। অন্যদিকে পৃথিবীতে সুখ যেমন আছে তেমনি আছে দুঃখও। পৃথিবী তার সকল সন্তানকে প্রেম-ভালোবাসা আর স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। তাই স্বর্গ নয়, সুখ-দুঃখে ঘেরা মাতৃস্নেহ বিজড়িত এই সত্যলোকই মানুষের কাছে প্রিয়।
দন্ডিতের সাথে
দন্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তরে প্রাণ
কোন ব্যথা নাহি পায়, তার দন্ডে দান
প্রবলের অত্যাচার। যে দ- বেদনা
পুত্ররে না পার দিতে, সে কারেও দিও না।
যে তোমার পুত্র নহে, তারও পিতা আছে,
মহাঅপরাধী হবে তুমি তার কাছে।


বিচারকের আসনে যিনি বসেন, সুষ্ঠু ন্যায় বিচার সম্পাদন করাই তার দায়িত্ব। দোষীকে শাস্তি দিয়ে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনার মহান ব্রত তার। তবে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তাকে হতে হয় নিরপেক্ষ এবং সহানুভূতিশীল। যাকে শাস্তি প্রদান করা হলো তার দুঃখে যদি বিচারকের প্রাণ কাঁদে তবেই সে বিচার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে।
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নব সভ্যতা। হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন, পুণ্যছায়া রাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবার-ধান্যের মুষ্ঠি বল্কল-বসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন,
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব,
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব।
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার;
পরানে স্পর্শিতে চাইছিড়িঁয়া বন্ধন,
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।


নাগরিক সভ্যতা কেড়ে নিয়েছে মানুষের অরণ্য লালিত স্নিগ্ধ জীবনকে। ভোগ, বাসনায় পরিপূর্ণ নগরে আধুনিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকলেও নেই প্রাণের উচ্ছ্বাস। যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে মানবিকতা, সহমর্মিতা, জীবনের সৌন্দর্য। তাই মানুষ আজ সে আরণ্যক জীবন ফিরে পেতে চায়।
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।


পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য আর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন এমন একজন তরুণ নেতার যে সঠিক পথে সকল মানুষকে চালিত করতে পারবে। এ পৃথিবীর পথ নানা প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ। এই প্রতিকূল অবস্থায় মানুষ প্রতিনিয়ত পথ হারাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মানুষকে উত্তরণের জন্য সমগ্র বিশ্বের হাল ধরবে যে সাহসী তরুণ, তাকেই এখানে আহ্বান করা হয়েছে।
দুঃখী বলে, ‘বিধি নাই, নাহিক বিধাতা;
চক্রসম অন্ধ ধরা চলে।’
সুখী বলে,‘কোথা দুঃখ, অদৃষ্ট কোথায়?
ধরণী নরের পদতলে।’
জ্ঞানী বলে,-‘কার্য আছে, কারণ দুর্জ্ঞেয়;
এ জীবন প্রতীক্ষা কাতর।’
ভক্ত বলে,-‘ধরণীর মহারসে সদা
ক্রীড়ামত্ত রসিক শেখর।’
ঋষিবলে,-‘ধ্রুব তুমি, বরেণ্য ভূমান।’
কবি বলে,-‘তুমি শোভাময়।’
গৃহী আছি,-‘জীবনযুদ্ধে ডাকি হে কাতরে,
দয়াময় হও হে সদয়।’


বিচার বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, মন মানসিকতায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একে অপরের থেকে পৃথক। দুঃখী ব্যক্তির কাছে জীবন চির দুঃখময় আর সুখীর কাছে জীবন হলো চির সুখের। তেমনিভাবে জ্ঞানী তার কাজের দ্বারা, ভক্ত তার ভক্তি দ্বারা, ঋষি তার দর্শন দ্বারা জীবন ও জগৎকে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। গৃহী মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনযুুদ্ধে বিপর্যস্ত তাই সে স্রষ্টার কাছে করুণা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়।
দৈন্য যদি আসে আসুক, লজ্জা কিবা তাহে?
মাথা উঁচু রাখিস।
সুখের সাথী মুখের পানে যদি না চাহে
ধৈর্য ধরে থাকিস।
রুদ্ররূপে তীব্র দুঃখ যদি আসে নেমে,
বুক ফুলিয়ে দাঁড়াস।
আকাশ যদি বজ্র নিয়ে মাথায় পড়ে ভেঙে
র্ঊর্ধ্বে দু’হাত বাড়াস।


জীবনের চলার পথে দুঃখ, দারিদ্র্যের মতো নানা প্রতিবন্ধকতা এসে জীবনকে রুদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলা উচিত নয়। বরং সকল প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবেলা করার সাহস হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
দ্যাখ, মানুষের কষ্ট থাকে না, হয় দিনে লোক খাঁটি
সোনার ফসল ফলায় যখন পায়ের তলার মাটি
মাটিরই যদি না এ হেন মূল্য মানুষের দাম নেই?
এই সংসারে এই সোজা কথা সব আগে বোঝা চাই।
বিশ্বপিতার মহাকারবার এই দিন দুনিয়াটা,
মানুষই তাহার মহামূল্যধন, কর্ম তাহার খাটা;
তাঁরি নাম নিয়ে খাটিবে যে জন, অন্ন তো তার মুখে,
বিধাতার এই সাচ্চা বাচ্চা কখনো পড়ে না দুঃখে।
তবে যে একথায় দেখিবারে পাই গরিবের দুর্গতি,
অর্থ তাহার- চেনা না সে তার শক্তির সংহতি।


এ পৃথিবীতে প্রকৃত খাঁটি মানুষ মাটিতেও সোনা ফলাতে পারে। সে পরিশ্রম ও মেধা দ্বারা সকল দুঃখ, কষ্টকে লাঘব করতে পারে। কর্মব্যস্ততাই জীবনকে সফল করে আর অলসতা জীবনকে ব্যর্থ করে।
ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়া
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।
দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যৎ অন্ধ, মূঢ় মানবসকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার,
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ, পেয়ে তব বল।
বুঝিছে জীবনযুদ্ধে হায় অনির্বার
নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।


জীবনে চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে আশা মানুষকে সঞ্জীবিত করে। আশা আছে বলেই মানুষ তার ভবিষ্যতকে না জেনেও সেই পথেই অগ্রসর হয়, বর্তমানকে সাদরে গ্রহণ করে। অর্থাৎ সংসারচক্রে আশাই মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা।
ধান করো, ধান হবে, ধুলোর সংসারে এই মাটি
তাতে যে যেমন ইচ্ছা খাটি।
বসে যদি থাক তবু আগাছায় ধরে কিছু ফুল
হলদে-নীল তারি মধ্যে, রুক্ষ মাটি তবু নয় ভুল
ভুল থেকে সরে সরে অন্য কোন নিয়মের চলা,
কিছু না কিছুর খেলা, থেমে নেই হওয়ার শৃঙ্খলা,
সৃষ্টি মাটি এত মত।
তাইতো আরও বেশি ভাবি
ফলাবো না কেন তবে আশ্চর্যের জীবনের দাবি।


জগৎ ও জীবন চলমান। চলমান এই জীবনে মানুষ নিজ খুশি মতো পরিশ্রম করে এবং তার ফল লাভ করে। পরিশ্রম না করলেও জীবন পৃথিবীর নিয়মে চলতে থাকবে। কিন্তু পরিশ্রম করাটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ এর মাধ্যমেই জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে।
ধুপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধুপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝার অঙ্গ,
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা।
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।


পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত রূপ অরূপের লীলাখেলা চলছে। তাই সীমা অসীমের মাঝে হারিয়ে যেতে চায়, মূর্ত বিমূর্তের মাঝে মিশে যেতে চায়। অরূপ ঈশ্বর এবং রূপময় জগতের এই পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলমান।
নর কহে ধূলিকণা, তোর জন্ম মিছে,
চিরকাল পড়ে রলি চরণের নিচে।
ধূলিকণা কহে, ভাই, কেন কর ঘৃণা?
তোমার দেহের আমি পরিণাম কিনা।
মেঘ বলে সিন্ধু তব জনম বিফল
পিপাসায় দিতে নার এক বিন্দু জল।
সিন্ধু বলে পিতৃনিন্দা কর কোন মুখে?
তুমিও অপেয় হবে পড়িলে এ বুকে।


মানুষ যখন নিচু অবস্থান থেকে উঁচু অবস্থানে উন্নীত হয় তখন সে স্বভাবতই ভুলে যায় তার অতীতকে। এ ধরনের মানুষ তার অতীতকে স্বীকার তো করেই না বরং নানাভাবে তাকে অবহেলা করে। সে ভুলে যায় তার আপন অস্তিÍত্বকে, আপন উত্থানের শক্তিকে। এ ধরনের মানসিকতা কোনো সমাজেই কাম্য নয়।
নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ চন্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস।
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু-বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি কৃষি তন্তুজীবী স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার।
অদ্রিতলে শিলাখন্ড- দৃষ্টি অগোচরে
বহু অদ্রি-বার।
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজা, হে প্রিয়।
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে-
আত্মার আত্মীয়।


বিন্দু থেকেই সিন্ধুর সৃষ্টি। ঠিক তেমনিভাবে একটি সভ্যতা প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানের সম্মিলনে গড়ে ওঠে। তাই কোনো মানুষকে ছোট ভাবা বা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই মানবসমাজের প্রতিটি মানুষকে তাই সমানভাবে সম্মান, শ্রদ্ধা করতে হবে।
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল।
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান।
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজ সুরে অপরে মোহিত।
শস্য জন্মাইয়া নাহি খায় জলধরে
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।


তারাই মহৎ যারা অপরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেন। নদী, গাছপালা, মেঘ-বৃষ্টি, স্বর্ণ-রৌপ্য প্রভৃতি অপরের মঙ্গল সাধনের জন্য আত্মোৎসর্গ করে। যারা প্রকৃত ভালো মানুষ তারা এদের মতোই অপরের কল্যাণ কামনায়, অপরের সুখের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন।
নদীতীরে মাটি কাটে সাজাইতে পাঁজা
পশ্চিমী মজুর। তাহাদেরি ছোট মেয়ে
ঘাটে করে আনাগোনা, কত ঘষামাজা।
ঘটি-বাঁটি-থালা লয়ে আসে ধেয়ে ধেয়ে।
দিবসে শতেক বার পিতল-কঙ্কণ
পিতলের থালি পড়ে বাজে ঠন ঠন।
বড় ব্যস্ত সারাদিন। তারি ছোট ভাই,
নেড়ামাথা, কাদামাথা, গায়ে বস্ত্র নাই,
পোষা পাখিটির মতো পিছে পিছে এসে
বসি থাকে উচ্চ পাড়ে দিদির আদেশে,
স্থির ধৈর্যভরে। ভরা ঘট লয়ে সাথে,
বাম কক্ষে থালি, যায় বালা ডানহাতে
ধরি শিশু কর। জননীর প্রতিনিধি,
কর্মভারে অবনত অতি ছোট দিদি।


কাজে কর্মে, স্নেহের বাঁধনে, শাসনের আবেষ্টনে প্রতিটি মেয়েই তার মায়ের প্রতিনিধি।  সংসারের ছোট-বড় নানা কাজ সে মায়ের মতোই সয়ত্নে করার চেষ্টা করে। নিজের ছোট ভাইটিও তার মাতৃসুলভ স্নেহে সিক্ত। কেবল স্নেহ দিয়েই নয়, মায়ের মতো শাসন করেও সে তার ভাইটিকে  তার সংস্পর্শে রাখে।

নদী আর কালগতি একই সমান,
অস্থির প্রবাহ করে উভয়ে প্রয়াণ।
ধীরে ধীরে নীরব গমনে গত হয়;
কিবা ধনে, কিবা স্তবনে ক্ষণেক না রয়।
উভয়েই গত হলে আর নাহি ফিরে,
দুস্তর সাগর শেষে গ্রাসে উভয়েরে।
বিফলে বহে না নদী যথা নদী ভরা,
নানা শস্য শিরোরত্নে হাস্যময়ী ধরা।
কিন্তু কাল, সদাত্মা ক্ষেত্রে শোভাকর,
উপেক্ষায় রেখে যায় মরু ঘোরতর।



নদী এবং কাল নীরবে ধাবমান। নদী যেমন সাগরে পতিত হয় তেমনি কালও পতিত হয় মহাকালে। সেখান থেকে তাদের ফেরা কখনো সম্ভব নয়। নদী প্রবাহিত হওয়ার সময় শত বাধাকে উপেক্ষা করেও তার চারপাশকে শস্য-শ্যামল করে তোলে। কিন্তু সময়কে উপেক্ষা করলে মানুষ জীবনে কোনো কাজেই সফল হতে পারে না।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধু যারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মতো থাকবে পাছে পাছে।
বিশ্বজনে নিঃস্ব করে পবিত্রতা আনে,
সাধজকজনে নিস্তারিতে তার মতো কে জানে?
বিনামূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার,
বিশ্ব মাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর?
নিন্দুক, সে বেঁচে থাকুক বিশ্বহিতের তরে,
আমার আশা পূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।


নিন্দুক তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে সকলের কাছেই ঘৃণার পাত্র। তার কাজই হলো পরচর্চা করা, যার কারণে কোনো মানুষই তাকে পছন্দ করে না, তার সঙ্গ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এই নিন্দুকই পরচর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানুষের দোষ ত্রুটিগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে এবং এর ফলে মানুষ নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পায়। তাই প্রকৃতপক্ষে নিন্দুককে ঘৃণা করা উচিত নয়।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও।
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
সুখ সুখ করি কেঁদো না আর;
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।


কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটেনি। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। অন্যের কল্যাণসাধনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই মানুষ প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়। তাই নিজের কল্যাণ নয় পরের কল্যাণসাধনে মনোনিবেশ করতে হবে।
পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মত কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?
তোর নিজস্ব সর্বাঙ্গে তোর দিলেন ধাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুকু বাজে হলি, গৌরব কি বাড়ল তাতে?
আপনারে যে ভেঙ্গে চুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে
অলীক, ফাঁকি, মেকি সে জন নামটা তার কদিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে,
খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি না রে।


অন্যের অনুকরণ না করে নিজের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা আছে তা বিকশিত করার মাধ্যমেই গৌরব বৃদ্ধি পায়। তাই নিজের মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে স্বাভাবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটানোর মধ্যেই যথাযথ মর্যাদা নিহিত।
পাখিটা মরিল। কোন কালে যে, কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই।
নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘পাখি মরিয়াছে।’
ভাগিনাকে ঢাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কি কথা শুনি।’
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরো হইয়াছে।’
রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর লাফায়?’
ভাগিনা বলির, ‘আরে রাম।’
আর কি উড়ে?’‘না’।
‘আর কি গান গায়?’  না?’
‘দানা না পাইলে আর কি চেচাঁয়?’ ‘না’।
রাজা বলিলেন ‘একবার পাখিটাকে আন দেখি।’
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন। সে ‘হাঁ’ করিল না, ‘হুঁ’ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্ খস্ গজ্ গজ্ করিতে লাগিল।


জগতের নিয়ম এই যে, প্রতিটি প্রাণীই নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও গন্ডির বাহিরে যেতে চায় না। জোর করে কারো উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, প্রাণচাঞ্চল্যের অবসান ঘটে। প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের আনন্দের সঙ্গে সিদ্ধান্তের যোগসূত্র না ঘটলে জীবনে ব্যর্থতা ও মৃত্যু আসবে।
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি-তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশ-দেশান্তর মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে দুঃখ সয়ে. আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালো মন্দ সাথে।
সার্থ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।
সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করো নি।


জীবনকে জানতে হলে তার ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ সবটাকেই জানতে হয়। দুঃখ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাঙালি ধর্ম ও সমাজের নানা বাধার কারণে গৃহকোণে কূপমন্তুকের মতো সুখী জীবনযাপন করছে। তাই বাঙালি প্রাণহীন, নিস্তেজ। এ অবস্থা থেকে বাঙালির উত্তরণের জন্য তাকে ঘরের বাইরে আসতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে।

পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব, কত সর্বনাশ,
নতুন নতুন কত গড়ে ইতিহাস-
রক্ত প্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে।
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা-
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা
দোঁহা পানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে-
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।


ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত সভ্যতার বিনির্মাণ চলছে। জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পারস্পরিক ক্রিয়ায় এ পৃথিবী চলমান। এই নিয়ম পৃথিবীর সর্বত্রই কার্যকর।
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে
কে তুমি
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
কে তুমি
পেল না উত্তর।


জীবনের সৃষ্টি এবং ধ্বংস নানা রহস্যে আবৃত। কেউ জানে না এই সৃষ্টি এবং ধ্বংসের কারণ। আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি এই জিজ্ঞাসার উত্তর।
ফুটিয়াছে সরোবরে; কমল নিকর
ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর।
গুণ গুণ গুণ রবে কত মধুকরে,
কেমন পুলকে তারা মধুপান করে,
কিন্তু এরা হারাইবে এ দিন যখন;
আসিবে কি অলি আর করিতে গুঞ্জন
আশায় বঞ্চিত হলে আসিবে না আর,
আর না করিবে এই মধুর ঝংকার;
সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়,
অসমেয় হায় হায় কেহ কারো নয়।
কেবল ঈশ্বর এই বিশ্বপতি যিনি,
সকল সময়ের বন্ধু সকলের তিনি।


সুখ-দুঃখ মানুষের নিত্যসঙ্গী। সুখের সময় মানুষের শুভাকাক্ষ্ঙীর অভাব না হলেও দুঃখের দিনে এদের কারো ছায়াটাও দেখা যায় না। কিন্তু সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একজনই সবসময় পাশে থাকেন তিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা।
বহু মিশ্র প্রাণের সংসারে
সেই বাংলাদেশে শিল্পে, পালা-পার্বণের ঢাকে ঢোলে
আউল বাউল নাচে; পুণ্যাহের সানাই রঞ্জিত
রোদ্দুরে আকাশ-তলে দেখ কারা হাঁটে যায়, মাঝি
পাল তোলে, তাঁতি বোনে, খড়ে-ছাওয়া ঘরের আঙনে
মাঠে-ঘাটে শ্রমসঙ্গী নানা জাতি ধর্মের বসতি
চিরদিন-বাংলাদেশ।


নানা ধর্ম-বণ র্ও জাতির মিশ্রণে বাংলার জনপদ বৈচিত্র্যময়। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে লালন করে বাংলাদেশ যেন আজ অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ এক অভিন্ন সাংস্কতিক কেন্দ্র। বিভিন্ন পেশার মানুষের শ্রমে-ঘামে গড়ে ওঠা এই ছবি বাংলার চিরকালীন রূপ।
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।


মানুষ বহু অর্থ ব্যয় করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় পাহাড়, সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অথচ তার ঘরের পাশেই রয়েছে ধানের শীষের ওপর শিশির বিন্দুর মতো প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যময় রূপ। এই সৌন্দর্যকে উপভোগ না করে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো অর্থহীন।
বসুমতী কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়া খুঁড়ি করে পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শস্য দিলে কি তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কহে বসুমতি-
আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে।


পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত ফসল মানুষের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। পরিশ্রম ছাড়া মাটিতে ফসল জন্মালে মানুষের কৃতিত্ব ক্ষুন্ন হয়, এ গৌরব পৃথিবীর। তেমনিভাবে অন্যের দয়া আর করুণার মধ্য দিয়ে যে প্রাপ্তি, তাতে ব্যক্তির কোনো গৌরব নেই, গৌরব দাতার। আর মানুষের জন্য এই বিনাশ্রমে প্রাপ্তির চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু নেই।
বাড়ছে দাম
অবিরাম
চালের ডালের তেলের নূনের
হাঁড়ির বাড়ির গাড়ির ছনের।
আলু মাঙ্গা বালু মাঙ্গা,
কাপড় কিনতে লাগে দাঙ্গা,
উঠছে বাজার হু-হু করে সব কিছুর
আঁখের শাকের কাঠের পাটের আম লিচুর।
খাওয়ার জিনিস শোয়ার জিনিস
পরার জিনিস মরার জিনিস
কিছু ছোঁয়ার সাধ্যি নাই।
ঘাটতি কেবল যেদিক চাই।
অভাব শুধু নাই মানুষের
চাই কত মণ, চাই কত সের,
আন্ডা চাও বাচ্চা চাও
জোয়ানে বুড়ো-আসল ফাও
চাহিদা নাই মানুষগুলোর।
কেবলি তার পড়ছে বাজার।


মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এতে মানবজীবনে দুঃখ ও কষ্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য এই দ্রব্যাদি, সেই মানুষের মূল্যই কমে যাচ্ছে।
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তবু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারি এককোণ।
সে ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।


এ পৃথিবী যেমন আয়তনে বিশাল তেমনি এর রূপও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু তার বেশিরভাগই মানুষের অজানা। অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরকালের। তাই সে তার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে ভ্রমণকাহিনী পাঠ করে। এর মাধ্যমেই সে তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চায়, তার দীনতাকে ঘোচাতে চায়।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র
নানাভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়
পাঠ্য যে সব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে সন্দেহ নাই মাত্র।


বিশ্ব প্রকৃতিতে শিক্ষার নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে। মানুষ প্রতিনিয়ত নানাভাবে এই বিশ্বপ্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করছে। এই পাঠশালা থেকেই মানুষ জ্ঞান আহরণ করে তার জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করছে।
বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্ছনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।



বিপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজন সাহস, শক্তি আর মনের দৃঢ়তা। অনেক সময় দুঃখ, বঞ্চনায় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু করুণা শিক্ষা নয়, সৃষ্টিকর্তা যেন সকল পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সাহস আর শক্তি মানুষকে দেন এটাই হওয়া উচিত মানুষের প্রার্থনা।
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারংবার
তোমা অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা বর্ণ গন্ধময়। প্রদীপের মতো।
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়।


সংসারী মানুষ সংসারের মায়া-মমতা, বন্ধনের মধ্যে থেকেই ঈশ্বরের আরাধনা করতে চান। সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে তিনি বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করতে চান না। সংসারই তার কাছে তীর্থস্থান। এ সংসার তীর্থে থেকেই তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে চান।
ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো, পোষ মানা এ প্রাণ,
বোতাম-আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি, মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি, গৃহের প্রতি টান
তৈলঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা,
যেথায় ছোট বহরে বড়ো বাঙালি-সন্তান।
ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুঈন,
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
ছুটেছে ঘোড়া উড়েছে বালি, জীবন স্রোতে আকাশ ঢালি,
হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি চলেছি নিশিদিন
বরশা হাতে, ভরসা প্রাণে, সদাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধাহীন।


বাঙালি জাতি স্বভাবতই শান্তিপ্রিয়, অলস, কর্মহীন। এরা সর্বদা আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়, কিন্তু এর জন্য পরিশ্রম করে না। এ জীবনের চেয়ে আরব বেদুঈনের মতো সাহসী, কর্মঠ ও সংগ্রামী জীবন ভালো।
ভালবাসি এই সুন্দর ধরণীরে,
ভালবাসি তার সব ধূলিবালি মাটি,
আমার প্রাণের সকল অশ্রু নীরে
কেমন করিয়া লাগিল সোনার কাঠি।
অশ্রু-কণা মুক্তার মত জ্বলে
ভরিল হৃদয় আনন্দ কোলাহলে
আলোক আসিয়া হৃদয়ে বাজায় বাঁশী,
সুনীল গগন ভরিয়া উঠিল গানে,
সুন্দর লাগে নয়নে রবির হাসি,
গভীর লাগে নয়নে রবির হাসি,
গভীর হরষ উছসি উঠিছে প্রাণে,
যে দিকে তাকাই পুলকে সকল হিয়া
উঠে শাস্তির সংগীতে মুখরিয়া।


এই সুন্দর পৃথিবীর ধূলাবালি, মাটি, রূপ-রস সবকিছুকেই কবি ভালোবাসেন। প্রকৃতির অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে তাঁর মন পুলকিত হয়। শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি তাঁর হৃদয়ে শান্তির ধারা প্রবাহিত করে।
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে, এই পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের লেখা চিরতরঙ্গিত
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময়,
মানবের সুখে-দুঃখে গাহিয়া সঙ্গীত
যদি গো রচিতে পারি অমর আলয়।


মানুষ জানে সে অমর নয়। এই নির্মম সত্য জেনেও সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। মানুষ হৃদয়ের মাঝে চির অমরত্ব লাভ করতে চায়। পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে, মহৎ কীর্তি স্থাপন করার মাধ্যমেই কেবল মানুষ পারে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে।
মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন,
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,
সেই পথ লক্ষ্য করে, স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে,
আমরাও হব বরণীয়।
সময় সাগর তীরে, পদাঙ্ক অঙ্কিত করে,
আমরাও হব যে অমর
সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে, অন্য কোন জন পরে,
যশোদ্বারে আসিবে সত্বর।
করো না মানবগণ, বৃথা ক্ষয় এ জীবন,
সংসার সমরাঙ্গন মাঝে,
সংকল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা,
ব্রতী হয়ে নিজ নিজ কাজে।


এ পৃথিবীতে মহৎ ব্যক্তিগণ তাদের কীর্তির মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন। আমাদেরও উচিত তাদের পদাংক অনুসরণ করা। নশ্বর পৃথিবীতে বৃথা সময় নষ্ট না করে সাধনা ও কর্ম করা, তবেই জীবন সার্থক হবে।
মরুভূমির গোধূলির অনিশ্চয় অসীমে হারালো?
আকস্মাৎ বিভীষিকা সমুদ্রের তরঙ্গে তরঙ্গে
মূর্ছাহত বালুকণা জাগলো কি মৃত্যুর আহ্বান?
অন্ধকারে প্রেতদল পথপাশে অট্টহাসে কেন?
কঙ্কালের শ্বেত নগ্ন অস্তি-গহ্বরে
প্রাণঘাতী বীভৎস রাগিণী?
মৃত্যু-শঙ্কা মূর্চ্ছনা গ্লানি আচ্ছন্ন গগন,
মানুষের দুরাশার অভিযানে টানি দিল ছেদ?
অদৃশ্য আলোর দীপ্তি অজানিত কোন নভস্থলে
সহসা চমকি ওঠে উদ্ভাসিয়া অন্তরের ছায়া?
মরুভূমি পরপারে কোথা স্বর্ণদ্বীপ
প্রলোভন-সব রক্তে ছন্দে দেয় আনি;
তারি পানে উন্মীলিয়া সকল হৃদয়
গোধূলির অন্ধকারে তিমির রাত্রির বক্ষ ভেদি,
পথহীন প্রান্তরে নামহীন বিপদে উত্তরি,
অজ্ঞাত উষার পানে কারাভাঁর যাত্রা হল শুরু?


মানুষের জীবন নানা প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ। মরুভূমির পথে যাত্রার মতো তার জীবনের পথেও আছে নানা বাধা-বিঘ্ন, আছে মৃত্যুর ভয়। এতে মানুষের যাত্রা বার বার ভঙ্গ হয়। তারপরও নতুন ভোরের আশায় মানুষ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সেই অনিশ্চিত পথেই ধাবিত হয়।
মান দিও মা আমায় তুমি
চাইনে আমি মানকে-
বরে নেব আমি তোমার
নিবিড় নীরব দানকে।
গভীর রাতের অন্ধকারে
গ্রহ চন্দ্র তারকারে
যে তান দিয়ে হাসাইয়ে
হাসাতে বিশ্ব-প্রাণকে
প্রাণ আমার জাগাইয়ে
তোল গো সে তানকে-
আড়ম্বরে মত্ত যারা হৃদয়তে অন্ধ
বুঝিবে না তারা আমার নিরিবিলির আনন্দ
শুয়ে ধূলায় পথের পরে
তাকায়ে ওই নীলাম্বরে,
গাহিতে চাই আমি আমার
জগৎ-জোড়া গানকে-
মান দিও না আমায় তুমি
চাইনে আমি মানকে।



কবি কোনো মান, ধনসম্পদ আড়ম্বর চান না। বিশ্বপ্রকৃতির ছন্দকে, আনন্দকে তিনি নিজ হৃদয়ে উপলব্ধি করতে চান। তিনি চান গোটা মানব জাতির অন্তরের আনন্দকে, অন্তরের বাণীকে বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দিতে। এ কারণেই তিনি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছেন।
কাঁদিবার নহে শুধু বিশাল প্রাঙ্গণ।
রাবণের চিতাসম যদিও আমার
জ্বলিছে জ্বলুক প্রাণ, কেন এ ক্রন্দন?
অপরের দুঃখ-জ্বালা হবে মিটাইতে
হাসি-আবরণ টানি দুঃখ ভুলে যাও,
জীবনের সর্বস্ব, অশ্রু মুছাইতে
বাসনার স্তর ভাঙ্গি বিশ্বেরে ঢেলে দাও।
হায়. হায়, জন্মিয়া যদি না ফুটালে
একটি কুসুমকলি নয়ন কিরণে,
একটি জীবনব্যথা যদি না জুড়ালে
বুকভরা প্রেম ঢেলে বিফল জীবনে।
আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন-সাধনা।
জনম বিশ্বের তরে, পরার্থে কামনা।


নিজের দুঃখ, ব্যথা, নিজ স্বার্থে নিমগ্ন হয়ে থাকা মানবজীবনের লক্ষ্য নয়। যে জীবন অন্যের দুঃখ দূর করতে না পারে, অন্যের জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে না, সে জীবন ব্যর্থ। ভোগ-বিলাস, কামনা-বাসনা নয়, আত্মস্বার্থ সিদ্ধি নয়, ত্যাগের মহিমাই জীবনকে সার্থক করে তোলে।
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁদিতেছি ডরে।
সংসার বিদায় দিতে, আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে।
ওরে মূঢ়, জীবন-সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জনম মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে
তোমার ইচ্ছার উপর। মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিব আবার
মূহূর্তের চেনার মতো। জীবন আমার
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালোবাসি নিশ্চয়।


মৃত্যু অবধারিত জেনেও মানুষ মৃত্যুবরণ করতে চায় না। সে জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। মৃত্যু অজ্ঞাত বলেই মৃত্যু নিয়ে মানুষের এত ভয়, তার জীবনের প্রতি ভালোবাসা এত প্রবল। অথচ এই জন্মও তার নিকট এক সময় ছিল অজ্ঞাত। এই জন্ম-মৃত্যুর খেলা মানুষের হৃদয়কে শঙ্কিত করে, বেদনায় সিক্ত করে।
যাক বান ডেকে যাক বাইরে এবং ঘরে
আর নাচুক আকাশ শূন্য মাথার পরে,
আসুক জোরে হাওয়া;
এই আকাশ মাটি উঠুক কেঁপে কেঁপে,
শুধু ঝড় বয়ে যাক মরা জীবন ছেপে,
বিজলী দিয়ে হাওয়া।
আয় ভাইবোনেরা ভয় ভাবনাহীন
সেই বিজলী নিয়ে গড়ি নতুন দিন।
আয় অন্ধকারের বদ্ধ দুয়ার খুলে
বুনো হাওয়ার মত আয়রে দুলে দুলে
গেয়ে নতুন গান
যত আবর্জনা উড়িয়ে দেরে দূরে,
আজ মরা গাঙের বুকে নূতন সুরে
ছড়িয়ে দেরে প্রাণ।


কল্যাণের পথে যাত্রায় পদে পদে নানা বাধা আসে। এই বাধাকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে শক্তিকে রূপান্তরিত করে সবাই মিলে পৌঁছতে হবে সেই গন্তব্যে যেখানে আছে কল্যাণ, সমৃদ্ধি, মুক্তি।
যারে তুই ভাবিস ফণী
তারো মাথায় আছে মণি
বাজা তোর প্রেমের বাঁশি
ভবের বনে ভয় বা কারে?
সবাই যে তোর মায়ের ছেলে
রাখবি কারে, কারে ফেলে?
একই নায়ে সকল ভায়ে
যেতে হবে রে ওপারে।


মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে আছে প্রেম-ভালোবাসা। ভালোবাসার দৃষ্টিতেই সব মানুষকে দেখতে হবে। কেউ শত্রু, কেউ মিত্র এরকম না ভেবে সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসতে হবে। এটাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখ-দুঃখভার।
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে,
পারিস নে কত বার,- কই অন্ন কই
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ,
জানি মাগো, তোর হাতে সম্পূর্ণ সুখ,
যা-কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায়,
সব তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভূক,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক?


মানুষ এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে। তাই পৃথিবীর নিকট মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশী। কিন্তু এই পার্থিব জীবনে দুঃখ, বেদনা, অভাব অনেক সময় মানুষকে আকড়ে ধরে। তবুও মানুষ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে কোথায়ও যেতে চায় না।

যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেই খানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সব হারাদের মাঝে।
যখন তোমায় প্রণাম করি আমি
প্রণাম আমার কোনখানে যায় থামি
তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে
সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে।
অহঙ্কার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের
রক্তভূষণ দীনদরিদ্র সাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে।
ধনে মানে যেথায় আছে ভরি
সেথায় আমার সঙ্গ আশা করি
সঙ্গী হয়ে আছে যেথায় সঙ্গীহীনের ঘরে
সেথায় তোমার হৃদয় নামে, না যে
সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে।


বিধাতা নিরহংকার, অবহেলিত ও দীন-দুঃখীদের মাঝেই বিরাজ করেন। অহংকারী ও ঐশ্বর্যের মাঝে তাঁকে খুজে পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রভুর সান্নিধ্য পেতে হলে আগে সর্বহারা দুঃখী মানুষদের এবং তাঁর সকল সৃষ্টিকে ভালবাসতে হবে।
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে।
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
সর্বজন সর্বক্ষণ চলে সেই পথে
তৃণ গুল্ম সেথা নাহি জন্মে কোন মতে।
যে জাতি চলে না কভু, তারি পথ পরে
তন্ত্র-মন্ত্র-সংহিতায় চরণ না সরে।


গতিই জীবনের মূলকথা। স্রোতহীন নদী যেমন শৈবালের কারণে আরো মন্থর হয়ে যায় তেমনিভাবে গতিহীন জাতির হৃদয়ে নানা লোকাচার বাসা বাঁধে। এর ফলে সে জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং গতিময়তার মধ্যেই সভ্যতার উৎকর্ষ নিহিত।
রংহীন মিলহীন ভাষা এবং রাষ্ট্রে
বিভক্ত এ মানুষ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত
যুদ্ধ মারামারি হানাহানি সবই আছে জানি
তারপরও এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ
এতো প্রগতির পদক্ষেপ সভ্যতার
পদচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে সারা বিশ্বময়
ওরা বলছে আমরা মানুষ আছি এভাবে
জগত জুড়ে প্রীতির বন্ধন আর স্বভাবে।


ভাষা, বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনাচারের দিক থেকে পৃথিবীর এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র থেকে পৃথক। নানা কারণে একদেশ অন্য দেশের সাথে যুদ্ধ সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই মানুষই আবার সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে যে প্রীতির বন্ধন সেই বন্ধনই সভ্যতার উৎকর্ষের মূলমন্ত্র।
লক্ষ লক্ষ হা-ঘরে দুর্গত
ঘৃণ্য যম-দূত-সেনা এড়িয়ে সীমান্তপারে ছোটে,
পথে পথে অনশনে অন্তিম যন্ত্রণা রোগে ত্রাসে
সহস্রের অবসান, হন্তারক বারুদে বন্দুকে
মূর্ছিত-মৃতের দেহ বিদ্ধ করে, হত্যাব্যবসায়ী
বাংলাদেশ ধ্বংস-কাব্যে জানে না পৌঁছল জাহান্নামে
এ জন্মেই;
বাংলাদেশ অনন্ত অক্ষত মূর্তি জাগে।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল। সে অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। একদিকে নির্মম অত্যাচার অন্যদিকে অনাহার, রোগের যন্ত্রণায় মানুষের জীবন হয়ে পড়েছিল দুর্বিষহ। কষ্টসহিষ্ণু বাংলার এসব অগণিত মানুষের আত্মত্যাগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে।
শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া-অথই ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।


নানা ভুল-ভ্রান্তি, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলার কারণে জাতীয় জীবন আজ সংকটাপূর্ণ। জাতীয় নেতৃত্বের ভুলের কারণে সমগ্র জাতির জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জাতীয় নেতৃত্বের সচেতন ভূমিকা।
শ্বেত, পীত, কালো করিয়া, সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।
আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ।
তুমি বলো নাই। শুধু শ্বেত দ্বীপে
জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে
সাদা র’বে সবাকার টুটি টিপে, এ নহে তব বিধান।
সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান।


নানা বর্ণে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করলেও মর্যাদার দিক থেকে সবাই সমান। কিন্তু মানুষ নিজেদের স¦ার্থে বর্ণবাদ নামক বিভেদের দেয়াল তৈরি করে ¯্রষ্টাকে অপমান করছে।
শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,
কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?
সময় ছাড়িয়া দিয়া করে পন্ড শ্রম,
ফল চাহে, সেও অতি নির্বোধ অধম।
খেয়াতরী চলে গেলে বসে থাকে তীরে।
কিসে পার হবে, তরী না আসিলে ফিরে?


জীবন গঠনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো শৈশবকাল। এ সময় সদুপদেশ মেনে না চললে ভবিষ্যতে সাফল্য আসে না। সময়ের কাজ সময়ে করাও সফলতা অর্জনের অন্যতম চাবিকাঠি। সময়মত কোনো কাজ না করলে পরবর্তীতে অধিক পরিশ্রম করেও সে কাজে সাফল্য অর্জন করা যায়না।

সকাল বিকাল ইসটিশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি।
ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকেট কিনে,
ভাটির ট্রেনে কেউবা চড়ে, কেউবা উজান ট্রেনে।
সকাল বেলা কেউবা থাকে বসে,
কেউবা গাড়ি ফেল করে তার শেষ মিনিটের দোষে।
দিনরাত গড় গড় ঘড় ঘড়।
গাড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।
ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে
কভু পশ্চিমে কভু পুবে।


রেল স্টেশনে সব সময়ই মানুষের ভিড়। যাত্রীরা টিকিট কিনছে, ট্রেনে উঠছে, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে আবার কেউ একটুর জন্য ট্রেন মিস করছে, এসব রেল স্টেশনের চির পরিচিত দৃশ্য। এ দৃশ্যই কবির চোখে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দিয়েছে।
সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে
তার কোনো পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে
সে অন্তরময়।
অন্তর মিলালে পরে তার অন্তরের পরিচয়।
পাইনে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,
বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার।
চাষী ক্ষেত্রে চালাইছে হাল,
তাঁতী বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল,
বহুদুর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।
প্রতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে
সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।
জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।


মানুষের মনকে বুঝতে হলে থাকতে হয় অনুভূতিশীল হৃদয়। যারা সমাজের উঁচু স্তরে বাস করে তারা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু এই মানুষেরাই সমাজ সভ্যতার নিপুণ কারিগর। এই সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কবির কাব্যরচনা সার্থকতা লাভ করে।
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ-মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা।
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?
পুণ্য অত হবে না’ক সব করিলেও জড়।
মুক্তিকামী মহাসাধক, মুক্ত কর দেশ,
সবারই সে অন্ন যোগায়, নেইকো গর্ব লেশ।
ব্রত তাহার পরের হিত  সুখ নাহি চায় নিজে
রৌদ্র-দাহে তপ্ত তনু শুকায় মেঘে ভিজে।
আমার দেশের মাটির ছেলে, করি নমস্কার,
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সকল অহংকার।


কৃষকরাই আমাদের দেশের প্রাণ। তাদের চেয়ে বড় সাধক আর কেউ নেই। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কঠোর পরিশ্রম করে তারা আমাদের অন্নের যোগান দেয়। তাদের উদ্দেশ্য দেশ ও দশের কল্যাণসাধন। শ্রম, সাধনা, আর ত্যাগ-তিতিক্ষার মহান আদর্শকে ধারণ করে সকলের ঊর্ধ্বে তাদের অবস্থান।

সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি
সেই ঘর মরি খুঁজিয়া
দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি
সেই দেশ লব বুঝিয়া।
পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই
তার মাঝে মোর আছে যেই ঠাঁই,
কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই,
সন্ধান লব বুঝিয়া;
ঘরে ঘরে আছে পরম আত্মীয়,
তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।


বিশ্বমানবের চেতনা যার মধ্যে আছে তার কাছে কেবল নিজ দেশ নয় গোটা বিশ্বটাই যেন আপন। বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে উদ্দীপ্ত ব্যক্তির কাছে পৃথিবীর সব মানুষই আত্মার আত্মীয়, সব ঘরই তার আপন ঘর। তাই তাকে দেশে দেশে আত্মীয়ের সন্ধান করতে হয় না।

সবারে বাসরে ভাল
নইলে মনের কালি মুছবে না রে।
আজ তোর যাহা ভাল
ফুলের মত দে সবারে।
করে তুই আপন আসন,
হারালি যা ছিল আপন,
এবার তোর ভরা আপন
বিলিয়ে দে তুই যারে তারে।
যারে তুই ভাবিস ফণী
তারো মাথায় আছে মণি
বাজা তোর প্রেমের বাঁশি
ভবের বনে ভয় বা কারে?
সবাই যে তোর মায়ের ছেলে
রাখবি কারে, কারে ফেলে?
একই নায়ে সকল ভায়ে
যেতে হবে রে ওপারে।


মনের ক্ষুদ্রতা দূর করতে হলে সব মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষ হিসেবে সবাই সমান। প্রেম দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে মানুষের সাথে গড়ে তুলতে হবে মৈত্রীর বন্ধন। কোনো মানুষকে অবহেলা, অবজ্ঞা করা যাবে না।

সবারে বাসিব ভালো, করিব না আত্মপর ভেদ
সংসারে গড়িব এক নতুন সমাজ।
মানুষের সাথে কভু মানুষের রবে না বিচ্ছেদ-
সর্বত্র মৈত্রীর ভাব করিবে বিরাজ।
দেশে দেশে যুগে যুগে কত যুদ্ধ কত না সংঘাত
মানুষে মানুষে হলো কত হানাহানি।
এবার মোদের পুণ্যে সমুদিবে প্রেমের প্রভাত
সোল্লাসে গাহিবে সবে সৌহার্দ্যরে বাণী।


মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, বিচ্ছেদ, বিভেদের কারণেই যত যুদ্ধ, যত সংঘাত। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যদি প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয় তবে যুদ্ধ হানাহানি, রক্তপাত সব বন্ধ হবে। গোটা পৃথিবীর মানুষ বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলেই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
সন্ধ্যার আলো লেগেছে নয়নে, স্পন্দিত প্রাণমন,
চলিতে দীঘির কিনারে কাঁপিছে জানু গিরি তৃণবন।
ঘুমের নিভৃতে নিঃশ্বাস পড়ে, হংস ফিরিছে ঘরে।
শাবকেরা  তার ঘিরিয়া চলেছে, ডানা হতে জল ঝরে।
সহসা শুনিনু কর্ণ তুলিয়া হংস কহিছে ডাকি,
‘চক্ষুতে ধরা রেখেছে যে ধরি, আমারি মত সে পাখি,
মরাল সেজন মরণ রহিত রহে সে গগন পরে
পাখা ঝাড়িলে সে বৃষ্টি পড়ে গো, চাহিতে জ্যোৎ ঝরে।’
আগু বাড়ি যাই, শুনিবারে পাই- পদ্ম কহিছে সরে।
‘সৃজন পালন করে যে, আপনি আছে সে বৃন্ত ভরে।
আপনার ছাচে মোরে সে গড়েছে, ‘জগৎ’ যাহারে বলে
সে তো সেই মহাপদ্মের দলে হিমকণা টলটলে।’


প্রতিটি সৃষ্টিই নিজস্ব অনুভূতি দ্বারা স্রষ্টাকে কল্পনা করে থাকে। হাঁস ভাবে  স্রষ্টাতার মতো পাখি, তিঁনি ঠোট দিয়ে পৃথিবীতে ধরে রাখেন। পদ্ম ভাবে স্রষ্টা তার মতো ফুল, এবং তাঁর পাপড়িতে বিশ্বজগতকে টলটলে হিমকণার মতো আটকে রাখেন। মূলত প্রত্যেকেই নিজস্ব ধারণায় স্রষ্টাকে মূল্যায়ন করে।
সাগর পাড়ি দেব আমি নবীন সদাগর-
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।
আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাবে দূরের ঘাটে,
চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্ব জোড়া হাটে,
ময়ুরপঙ্খি বজরা আমার সাতখানা পাল তুলে
ঢেউয়ের দোলায় মরাল-সম চলবে দুলে দুলে।
সিন্ধু আমার বন্ধু হবে, রতন মানিক তার
আমার তরী বোঝাই দিতে আনবে উপহার।
দ্বীপে দ্বীপে আমার আশায় জাগবে বাতিঘর,
শুক্তি দিবে মুক্তা মালা, প্রবাল দেবে কর।
আমায় ঘিরে সিন্ধু শকুন করবে এসে ভিড়,
হাতছানিতে ডাকবে আমার নতুন দেশের তীর।


নবীন জীবনপথিক তার জীবন সাধনার ক্ষেত্রকে নিজ দেশেই সীমাবদ্ধ রাখে না। নিজ দেশকে উন্নত করার জন্য সে বিশ্বের সাথে স্বদেশের যোগাযোগ স্থাপন করে। প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন কৌশলে সে দেশের জন্য ঐশ্বর্যের সন্ধান করে।
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালবেসে।
জানি না তোর ধন-রতন আছে কিনা রাণীর মতন
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।
কোন বনেতে জানিনে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল.
কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে।


প্রতিটি মানুষের কাছেই তার জন্মভূমি অত্যন্ত প্রিয়। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য, অসীম ঐশ্বর্য আমাদের চোখ জুড়ায়, মন ভোলায়। এই অপরূপ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে আমাদের জীবন ধন্য। তাই এদেশের মাটির স্নেহের স্পর্শেই আমরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।
স্বাধীনতা স্পর্শমণি সবাই ভালবাসে,
সুখের আলো জ্বলে বুকে দুঃখের ছায়া নাশে।
স্বাধীনতা সোনার কাঠি খোদার সুধা দান,
স্পর্শে তাহার নেচে উঠে শূন্য দেহে প্রাণ।
মনুষ্যত্বের বান ডেকে যায় যাহার হৃদয়তলে,
বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায় ভীরু স্বাধীনতার বলে।


স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের কাছেই অাকাঙ্ক্ষার বস্তু। স্বাধীনতার স্পর্শমণি মানুষের জীবন থেকে দুঃখ দূর করে তাকে সুখের সুধা দান করে, জীবনকে করে তোলে আনন্দময়। স্বাধীনতাই মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তোলে। স্বাধীনতার বলেই ভীরু মানুষ বীরের মর্যাদা লাভ করে।

সৃজন লীলার প্রথম হতে প্রভু
ভাঙাগড়া চলছে অনুক্ষণ,
পাখি জনম, শাখি জনম হতে,
রাখছ কথা, শুনছ নিবেদন।
আজ কি হঠাৎ নিষ্ঠুর তুমি হবে?
কান্না শুনে নীরব হয়ে রবে?
এমন কভু হয় না, তোমার ভবে
মনে-মনে বলছে আমার মন।


সৃষ্টিজগতের শুরু থেকেই ভাঙা গড়ার খেলা চলে আসছে। স্রষ্টা তার সৃষ্ট ছোট-বড় সবার আবেদন, নিবেদন, প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে থাকেন। দয়াময় প্রভু কাউকেই হতাশ করেন না।
সৃষ্টির কথা ভাবে যারা আগে সংহারে করে ভয়,
যুগে যুগে সংহারের আঘাতে তাদের হয়েছে লয়।
কাঠ না পুড়ায়ে আগুন জ্বালাবে বলে কোন অজ্ঞান?
বনস্পতি ছায়া পাবে বীজ নাহি দিলে তার প্রাণ?
তলোয়ার রেখে খাপে এরা, ঘোড়া রাখিয়া আস্তাবলে
রণজয়ী হবে দন্তবিহীন বৈদান্তিকী ছলে!
প্রাণ-প্রবাহের প্রবল বন্যা বেয়ে খরস্রোতা নদী
ভেঙ্গেছে দুকূল; সাথে সাথে ফুল ফুটায়েছে নিরবধি।
জলীধর মহা-তৃষ্ণা জাগিয়েছে যে বিপুল নদীস্রোতে
সে কি দেখে, তাঁর স্রোতে কে ডুবিল, কে মরিল তার পথে?
মানে না বারণ, ভরা যৌবন শক্তি-প্রবাহ ধায়
আনন্দ তার মরণ-ছন্দে কূলে কূলে উথলায়।


জীবন ও প্রকৃতিতে ধ্বংস ও সৃষ্টির খেলা প্রতিনিয়ত চলমান। অন্ধকারকে, পুরাতনকে ভাঙতে না পারলে নতুনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই নবতর জীবন আস্বাদনের জন্য কুসংস্কার, ভ্রান্তির প্রাচীর ভেঙে ফেলে নবজীবনের পথে যাত্রা করতে হবে।
হউক সে মহাজ্ঞানী মহাধনবান,
অসীম ক্ষমতা তার অতুল সম্মান,
হউক বিভব তার সম সিন্ধু জল,
হউক প্রতিভার তার অক্ষুন্ন উজ্জ্বল।
হউক তার বাস রম্যহর্ম্য মাঝে,
থাকুক সে মণিময় মহামূল্য সাজে।
কিন্তু সে সাধে কি কভু জন্মভূমি হিত,
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ।
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর,
অতীব ঘৃণিত সে পাষন্ড বর্বর।


ধন, জ্ঞান, ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যে কোনোদিন দেশ, জাতির কথা চিন্তা করেনি সে সকলের কাছেই ঘৃণিত। অনেক কিছু থাকার পরও দেশের মানুষের কাছে সে অমানুষ বলেই বিবেচিত হয়। তাই সকলেরই উচিত নিজ সাধ্য অনুযায়ী দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করা।
হায় হায় জনমিয়া যদি না ফুটালে
একটি কুসুম নয়ন কিরণে
একটি জীবনব্যথা যদি না জুড়ালে
বুকভরা প্রেম ঢেলে বিফল জীবনে
আপনারে রাখিলে ব্যর্থ জীবন-সাধনা
জনম বিশ্বের তবে পরার্থে কামনা।


পরের কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যই পৃথিবীতে আসেনি। তাই অন্যের দুঃখ দূর করতে না পারলে মানব জীবন ব্যর্থ।
হাস্য শুধু আমার সখা! অশ্রু আমার কেহই নয়?
হাস্য করে অর্ধজীবন করেছি তো অপচয়।
চলে যারে সুখের রাজ্য, দুঃখের রাজ্য নেমে আয়,
গলা ধরে কাঁদতে শিখি গভীর সমবেদনায়।
সুখের সঙ্গ ছেড়ে করি দুঃখের সঙ্গে বসবাস,
ইহাই আমার ব্রত হউক, ইহাই আমার অভিলাষ।
যেথায় ক্লান্তি, যেথায় ব্যাধি, যন্ত্রণা ও অশ্রুজল,
ওরে তোরা হাতটি ধরে আমায় সেথায় নিয়ে চল।
পরের দুঃখে কাঁদতে শেখা- তাহাই শুধু চরম নয়,
মহৎ দেখে কাঁদতে জানা- তবেই কাঁদা ধন্য হয়।


সুখ নয়, দুঃখ-কান্নাই জীবনের চরম সত্য, কেননা বেশিরভাগ মানুষের জীবনই দুঃখময়। সেইসব দুখী মানুষের ব্যথার ভাগী হওয়া, তাদের দুঃখ দূর করার চেষ্টাই হওয়া উচিত জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। মহৎ ব্যক্তিরা দুখীর দুঃখে সমব্যথী হন, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তাই মহৎ ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
“হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”


প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও কবি হৃদয় বসন্তের সৌন্দর্যকে বরণ করে নিচ্ছে না। কোনো এক গভীর বেদনার কারণে কবি বসন্তের আগমনে উদাসীন। মানুষের হৃদয়ের গভীরে কোনো গোপন দুঃখবোধ থাকলে বাইরের সৌন্দর্য আনন্দ তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়।
হে বঙ্গ, ভান্ডরে তব বিবিধ রতন-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।


নিজ মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে যারা অন্য ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে বিখ্যাত হতে চান তারা কখনোই সফল হতে পারেন না। মাতৃভাষার মতো এত ঐশ্বর্য অন্য কোনো ভাষায় নেই। এ সত্যকে উপলব্ধি করে কবি বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন হলেন।
হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়-
এবার কঠিন কঠোর গদ্যে আনো
পদ-লালিত্য ঝংকার মুছে যাক,
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়-
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।


কাব্যের স্নিগ্ধতা নয়, গদ্যের কঠোরতাই জীবন সংগ্রামে প্রয়োজন। বঞ্চিত, নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের জীবনে তাই আজ গদ্যের কঠোরতাই কাম্য। ক্ষুধা আর দারিদ্র্য যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং বঞ্চনার অবসান ঘটানোই কবির প্রত্যাশা।
হে চির-দীপ্ত, সুপ্তি ভাঙাও
জাগার গানে,
তোমার শিখাটি উঠুক জ্বলিয়া
সবার প্রাণে।
ছায়া ফেলিয়াছে প্রলয়ের নিশা,
আঁধারে ধরণী হারায়েছে দিশা
তুমি দাও বুকে অমৃতের তৃষা
আলোর ধ্যানে।
ধ্বংস-তিলক আঁকে চক্রীরা
বিশ্ব-ভালে;
হৃদয়-ধর্ম বাঁধা পড়ি ফাঁদে
স্বার্থ-জালে,
মৃত্যু জ্বালিছে জীবন-মশাল,
চমকিছে মেঘে খর তরবার,
বাজুক তোমার মন্ত্র ভয়াল
বজ্র-তানে।


মানবসমাজের সর্বত্রই আজ দুষ্ট লোকের দৌরাত্ম্য। তারা নিজেদের স্বার্থে মানুষের শান্তিকে বিনষ্ট করে জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। এ পরিস্থিতিতে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন যিনি তার আলোয় সকলকে আলোকিত করবেন। তার নেতৃত্বেই মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে।
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম-নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বার বার,
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত মাঠ, স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি,
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটাতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।


গ্রামের মানুষের জীবন দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের জীবন বিপর্যস্ত। তাই কবি এমন এক মহামানবের প্রত্যাশা করছেন যিনি এই সকল গ্রামের অসহায় মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন।
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান
কণ্টক মুকুট শোভা, দিয়াছ তাপস,
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হল তরবার।
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্প তাপস,
অম্লান স্বর্গেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ।
শীর্ণ করপুট ভরি সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই হে বুভুক্ষু, তুমি
অগ্রে আসি, কর পান। শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক।


দারিদ্র্য নিষ্ঠুর হলেও তা মানবজীবনকে মহিমান্বিত করে তোলে। দারিদ্র্য মানুষের ভয়, লজ্জা, সংকোচ দূর করে স্পষ্টভাষী ও সাহসী করে তোলে। দারিদ্র্যের অভিশাপে জীবনের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয় এবং স্বপ্ন মরুভূমিতে রুপান্তরিত হয়।
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান।
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্র রোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান।


এ পৃথিবীতে মর্যাদার দিক থেকে সকল মানুষই সমান। কিন্তু যারা গরীব, দুঃখী মানুষদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তারা মূলত সৃষ্টিকর্তাকেই অপমান করে। সৃষ্টিকর্তার বিচারে একদিন তাদেরকেও অবহেলিত ও বঞ্চিতদের কাতারে দাঁড়াবে হবে।
হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরে আসি-
“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীর পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”


কবি তাঁর অতীতের বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে বর্তমানের প্রতি উদাসীন। তিনি কিছুতেই তাঁর অতীতকে ভুলতে পারছেন না। তাই বসন্তের আগমনে কবিমনে আনন্দের শিহরণ জাগেনি, বসন্তের প্রতি যেন তাঁর তীব্র বিমুখতা।
নদী আর কালগতি একই সমান
অস্থির প্রবাহে করে উভয়ে প্রয়াণ।
ধীরে ধীরে গমনে গত হয়
কিবা ধনে, কিবা স্তবনে ক্ষণেক না রয়।
উভয়েই গত হলে আর নাহি ফিরে
দুস্তর সাগর শেষে গ্রাসে উভয়েরে।
বিফলে বহে না নদী যথা নদী ভরা
নানা শস্য শিরোরত্নে হাস্যময়ী ধরা।
কিন্তু কাল, সদাত্মা ক্ষেত্রে শোভাকর
উপেক্ষায় রেখে যায় মরুর।


সময় ও নদীর স্রোত বহমান। প্রতি পদক্ষেপে সে শুধু গতই হয়, ফিরে আর আসে না। যাওয়ার পথে পৃথিবীকে শস্যসম্ভারে পরিপূর্ণ করে তোলে সে অবহেলায় সময় নষ্ট হলে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে মরুময়।
আমরা সিঁড়ি
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তা জানো
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।
তবু আমরা জানি
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাটের হুমায়ুনের মতো
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন॥


শ্রেণি বিভক্ত সমাজে নিম্ন শ্রেণির মানুষকে শোষণ করেই নিজেদের সমৃদ্ধির পথ পাড়ি দেয় শোষক শ্রেণি। বিনিময়ে উপেক্ষা আর নির্যার্তনের চিহ্ন বুকে নিয়ে দিন কাটাতে হয় শ্রমজীবী মানুষকে। শ্রমজীবীর ক্ষত চিহ্নকে লুকিয়ে রাখার যত চেষ্টাই করুক না কেন ইতিহাসের আমোঘ নিয়মে শোষকের পরাজয় অনিবার্য।
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান
তাজা জীবন্ত সে সব সৃষ্টি শ্রম-মহান
চলমান বেগে প্রাণ উচ্ছল।
রে সব যুগের স্রষ্টাদল
জোর-কদম চল্ রে চল্।


তারুণ্যের বিপ্লবস্পৃহা স্থানু নয়, চলমান। পচা অতীতকে পিছনে ফেলে যারা অগ্রসর হয় বিচিত্র সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, উচ্ছল প্রাণে তারা মুক্ত প্রাণের গান করে তারাই যুগ স্রষ্টা।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধু যারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মত থাকবে পাছে পাছে।
বিশ্বজনে নিঃস্ব করে, পবিত্রতা আনে,
সাধক জনে নিস্তারিতে তার মত কে জানে?
বিনামূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার,
বিশ্ব মাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর?
নিন্দুক সে বেঁচে থাকুক বিশ্ব-হিতের তরে,
আমার আশা পূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।


নিন্দুক তার অজান্তেই বিশ্ব মঙ্গলের জন্য কাজ করে যায়। স্বভাবসুলভ সমালোচনায় সে অন্যের ত্রুটি সংশোধনের সহায়তা করে। এতে মানুষের উপকারই হয়।
সবারে বাসিব ভাল, করিব না আত্মপর ভেদ
সংসারে গড়িব এক নতুন সমাজ।
মানুষের সাথে কভু মানুষের রবে না বিচ্ছেদ-
সর্বত্র মৈত্রীরভাব করিবে বিরাজ।
দেশে দেশে যুগে যুগে কত যুদ্ধ কত না সংঘাত
মানুষে মানুষে হল কত হানাহানি।
এবার মোদের পুণ্যের সমুদিবে প্রেমের প্রভাত
সোল্লাসে গাহিবে সবে সৌহার্দ্যরে বাণী।


আপন-পর ভেদাভেদ ঘুচিয়ে ভালোবাসার বন্ধনে বাধতে হবে সবাইকে। মৈত্রী আর সৌহাদ্যের বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। তবেই সম্ভব যুদ্ধ সংঘাত- হানাহানির বিপরীতে এক নতুন সমাজ গড়ে তোলা।
শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে
কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?
সময় ছাড়িয়া দিয়া করে পণ্ডশ্রম,
ফল কহে সেও অতি নির্বোধ অধম।
খেয়াতরী চলে গেলে বসে থাকে তীরে,
কিসে পার হবে তারা না আসিলে ফিরে॥


জীবনে সার্থকতা অর্জন করতে হলে শৈশব থেকেই সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ের সদ্ব্যবহার করতে শিখতে হয়। আলস্যে জীবন কাটালে ফল প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে না। যথা সময়ে কাজ না করলে হতাশাই সম্বল হয়।
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়াখুঁড়ি করে পাই শস্য কণা।
দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস-
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শস্য দিলে কি তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতি,
আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে।


অনুগ্রহের দান অপেক্ষা কষ্টার্জিত ফসল মানুষের গৌরবকে বৃদ্ধি করে। পরিশ্রম করেই মানুষের জীবনকে সুখময় এবং মনুষ্যত্বের মর্যাদাকে রক্ষা করতে হয়।
আসিতেছে শুভ দিন-
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি
তোমারে সেবিতে যারা পবিত্র আঙ্গে লাগাল ধুলি
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।


শ্রমই সভ্যতাকে অগ্রসর করেছে। অথচ সভ্যতাদর্পী মানুষ সেই শ্রমজীবীদের রক্ত-ঘামকে অবজ্ঞা করেছে নিষ্ঠুরভাবে। দিন বদলের সংগ্রামে দেবতুল্য সেই শ্রমিক শ্রেণির জীবনের জয়গানই সূচিত হবে।
স্বাধীনতা স্পর্শমণি সবাই ভালবাসে
সুখের আলো জ্বালে বুকে, দুঃখের ছায়া নাশে।
স্বাধীনতা সোনার কাঠি, খোদার সুধা দান
স্পর্শে তাহার নেচে উঠে শূন্য দেহে প্রাণ।
মনুষ্যত্বের বান ডেকে যায়, পশুর হৃদয়তলে
বুক ফুলায়ে দাঁড়ায় ভীরু স্বাধীনতার বলে।
দর্পভরে পদানত উচ্চ করে শির,
শক্তিহীনেও স্বাধীনতা আখ্যাদানে বীর।


স্বাধীনতা এমনই এক পরশ পাথর যার ছোঁয়াতে ভীরু কাপুরুষ-মৃতপ্রায় মানুষেরাও আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে ওঠে। সুখের সন্ধান মেলে আর মনুষ্যত্বের জয়গানে সার্থক হয় জন্ম। তাই এটি মানুষের পরম আকাঙ্ক্ষার ধন।
একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে
দহিল হৃদয় মম সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
দেখি সেথা এক জন পদ নাহি তার
অমনি জুতার খেদ ঘুচিল আমার।
পরের দুঃখের কথা করিলে চিন্তন
আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ।


ভোগসর্বস্ব মানুষ শুধু নিজের চিন্তায় মশগুল থাকে। মানুষ হিসেবে জুতার কষ্ট অমূলক মনে হয় যখন অপরের পা না থাকাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়।
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু ॥


সৌন্দর্য উপভোগের জন্য প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতির; অর্থ ও সময় ব্যয়ই নিয়ামক নয়। চোখ মেলে দেখতে পারলে ঘরের কাছেই পাওয়া যায় পরিচিত সৌন্দর্যের অফুরান উৎস।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।


জীবনের আবর্তনে পৌঢ়ত্বের বিদায় অনিবার্য তবু যৌবনের অভিষেকের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। জীবন বিনাশী জঞ্জাল সরানোর দায় আমাদের।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি ওঠে খরখড়া সম
তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।


বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমা প্রদর্শন দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অন্যায়কারী ও অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা উভয়কেই কঠোর হাতে শাস্তি প্রদান করতে হয়।
কতবার এল কত না দস্যু
কত না বার ঠগে ঠগে হল
আমাদের কত গ্রাম উজাড়
কত বুলবুলি খেল কত ধান
কত মা গাইল বর্গীর গান
তবু বেঁচে থাকে আমার প্রাণ
এ জনতার-
কৃষাণ, কুমোর, জেলে, মাঝি, তাঁতি আর কামার
আমার দেশের মাটিতে মানুষ তাদের প্রাণ
মূঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।


ঠগ, দস্যু আর বর্গীদের আক্রমণে আমাদের দেশের সম্পদ লুট হলেও ক্ষয় হয় নি জনতার জীবন শক্তি। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমে আর ফসলে সৃষ্টি হয়েছে অমরত্বের বীরত্ব গাঁথা।
হউক সে মহাজ্ঞানী মহা ধনবান
অসীম ক্ষমতা তার অতুল সম্মান
হউক বিভব তার সম সিন্ধু জল
হউক প্রতিভা তার অক্ষুণ্ন উজ্জ্বল
হউক তাহার বাস রম্য হর্ম্য মাঝে
থাকুক সে মণিময় মহামূল্য সাজে
হউক তাহার রূপ চন্দ্রের উপম
হউক বীরেন্দ্র সেই যেন সে রোস্তম
শত দাস তার সেবুক চরণ
করুক স্তাবকদল স্তব সংকীর্তন।
কিন্তু যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর
অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।


ধন, মান, যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি আর জ্ঞানের গৌরবে সমুজ্জ্বল হলেই তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায় না-যদি তার মধ্যে দেশপ্রেম না থাকে। দেশপ্রেম ছাড়া মানুষ পাষণ্ড ও বর্বর হিসেবেই ঘৃণার পাত্র।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র
নানাভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়
পাঠ্য যে সব পাতায় পাতায়,
শিখছি যে সব কৌতূহলে সন্দেহ নাই মাত্র।


বিদ্যায়তনের মতোই বিশ্বের সবকিছু থেকে জ্ঞান আহরণ করা যায়। প্রকৃতিই হচ্ছে প্রকৃত দীক্ষা গুরু, প্রতিটি মানুষই তার ছাত্র।
ধন্য আশা কুহকিনী! তোমার মায়ায়
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি
দাঁড়াইতে স্থিরভাবে চলিত না, হায়
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যৎ অন্ধ মূঢ় মানবসকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ, পেয়ে তব বল
যুঝিছে জীবন যুদ্ধে হায় অনিবার।
নাচায় পুতুল যেবা দক্ষ বাজিকরে
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।


আশারূপ ভেলাতেই ভবসংসার পাড়ি দেয় মানুষ। আশার ছলনায় পড়ে মানুষ পাগলের মতো চক্রাকারে সংসারের ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে ও জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সাহস যোগায়। তার প্রণোদনাতেই মানব জীবন প্রবাহমান থাকে।
ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে
সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে
পূরবের না সূর্য, নিশীথের শশী
তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি।
আমার এ গান এও জগতের গানে
মিশে যায় নিখিলের মর্ম মাঝখানে
শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর
সকলের মাঝে তার আপনার ঘর।
কিন্তু হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার
ক্ষুদ্র রুদ্ধ দ্বারে শুধু একাকী তোমার।
নাহি পড়ে সূর্যালোক, নাহি চাহে চাঁদ
নাহি তাহে নিখিলের নিত্য আশীর্বাদ।
সম্মুখে দাঁড়ালে মৃত্যু মুহূর্তেই হায়
পাংশুপাণ্ডু শীর্ণ ম্লান মিথ্যা হয়ে যায়।


ছোট্ট তৃণলতা বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে নিজেকে একাকার করে নিতে পারে। কবির গান প্রকৃতির সুরে একই তারে বাজে। কিন্তু বিলাসীর সম্পদ মোহ শুধু তার একক ভোগের, মৃত্যু এলে তা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]