বাংলা নাটক সিরাজউদ্দৌলা


নাটক সম্পর্কে আলোচনা
নাটকের সংজ্ঞা
নাটক হচ্ছে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা। ‘নাটক’ শব্দটির এসেছে ‘নট’ শব্দ থেকে। এ নটের অর্থ হলো নড়াচড়া করা, অঙ্গ চালনা করা। পক্ষান্তরে ইংরেজি ‘উৎধসধ’ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘উৎধবহ’ শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো ‘ঃড় ফড়’ বা ‘করা’। শব্দটির অর্থ হলো অ্যাকশন অর্থাৎ কোনো কিছু করে দেখানো। নাটক মানবজীবনের কথা বলে। নাটক মানুষ ও সমাজের বিচিত্র ঘটনার কথা বলে। নাটকের মাঝে মানুষ ও মানবসমাজ মূর্ত হয়। তাই নাটক মানুষের দর্পণ, সমাজের দর্পণ, মানব ভাগ্যের দর্পণ।
সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাটককে দৃশ্যকাব্য আখ্যা দিয়েছেন। নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাট্য-সাহিত্যকে কাব্য-সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁহাদের মতে কাব্য দুই প্রকার: দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্য। নাটক প্রধানত দৃশ্যকাব্য এবং ইহা সকল প্রকার কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাব্যেষু নাটক রস্যম। নাটক দৃশ্য করা ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গ মঞ্চের সমন্বয়ে গতিমান মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সন্মুখে মূর্ত করে তোলে। রঙ্গ মঞ্চের সাহায্য ব্যতীত নাটকীয় বিষয় পরিস্ফুট হয় না। নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ঊষরুধনবঃয উৎবি বলেন- “উৎবসরংঃযব ঈৎবধঃরড়হ ধহফ ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ড়ভ ষরভব রহ ঃবৎসং ড়ভ ঃযব ঃযবধঃৎব.”
বস্তুত: নাটক একটি প্রয়োগিক শিল্প যা রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত হয়। তাই স্থান, কাল, ঘটনা ও চরিত্রের সংহতি নাটকের একটি গুরুত্ব বিষয়। নাটকের আঙ্গিক ও গঠন কৌশলে ঐক্য থাকা প্রয়োজন। ঐক্যগুলো হলো
১ স্থানের ঐক্য (টহরঃু ড়ভ ঢ়ষধপব)
২ সময়ের ঐক্য (টহরঃু ড়ভ ঃরসব)
৩ ঘটনার ঐক্য (টহরঃু ড়ভ ধপঃরড়হ)
এ তিনটি ঐক্যের মিল সাধনে নাটক রচিত হয়। এখানে সময়ের ঐক্য বলতে বুঝানো হয়েছে যেকোনো একটি সময়ের পরিসরে ঘটে, স্থানের ঐক্য বলতে বুঝানো হয়েছে জীবনের একটি ঘটনা স্থানের মাঝে ঘটে। কোনো ঘটনা একটি স্থল ও সময়ের মাঝে ঘটে। আর এসব ঘটে একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে।
আসলে নাটক কোনো একক শিল্প নয়। নাটক যৌথ শিল্প। অর্থাৎ নাট্যকার, নির্দেশক অভিনেতা-অভিনেত্রী, মঞ্চ, সংগীত, আলোক প্রক্ষেপণ, দর্শক-শ্রোতা-ইত্যাদি মিলে নাটক। তবে নাটকের, নির্দেশনা, সংলাপ ও অভিনয় দক্ষতার আলোকে একটি নাটকের সার্থকতা নিরূপণ করা হয়।
একটি নাটকে কয়েকটি আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য থাকে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে নাট্যকার সফল ও সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে চায়। নাটকের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
১ প্রারম্ভ, ২. প্রবাহ
৩ উৎকর্ষ, ৪. গ্রন্থিমোচন
৫ পরিণতি
এ ছাড়া প্রতিটি নাটকে বিভিন্ন অঙ্ক ও দৃশ্য বিভাজন থাকে। প্রাচীন যুগে নাটক পাঁচ অঙ্ক বিশিষ্ট হতো। আর প্রতিটি অঙ্কে কয়েকটি দৃশ্য থাকত। আধুনিক যুগে এ সনাতন পদ্ধতি ভেঙে নানা বৈচিত্র্য এসেছে। এখন নাটকে পাঁচ অঙ্ক হয় না। দুই বা তিন অঙ্কের নাটক এ যুগে প্রাধান্য পেয়েছে। এ যুগে একাঙ্কিতা নামে এক ধরনের এক অঙ্কের নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। নাটক এখন মঞ্চের সীমানা পেরিয়ে বেতার ও টিভিতে স্থান করে নিয়েছে। নাটকের দৃশ্য ও চরিত্র কমে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে নাটকের প্রথাগত বিভাজন লোপ পেয়েছে। আজকাল নাটকে নানা প্রযুক্তিগত কৌশল ও অনেক অভিনব নাট্য বৃদ্ধির প্রয়োগ দেখা যায়।
নাটকের শ্রেণিবিভাগ
নাটকের বিষয়বস্তু ও জীবনবোধের আলোকে নাটককে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন ঐতিহাসিক নাটক, সামাজিক নাটক, রাজনৈতিক নাটক, রূপক নাটক, কাব্য নাটক, গীতি নাট্য ইত্যাদি।
ক. ঐতিহাসিক নাটক : ইতিহাস থেকে কোনো কাহিনি ঘটনা চরিত্র নিয়ে যদি কোনো নাটক রচনা করা হয়, তা হলে তাকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায়। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঘটনার বিকৃতি না ঘটিয়ে নব রূপ দান করেন। যেমন- মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ডি. এল রায়ের ‘শাহাজাহান’, মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘রক্তপদ্ম’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘মহাকবি আলাউল’ ইত্যাদি।
খ. সামাজিক নাটক : যে নাটক সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত হয় সে নাটককে সামাজিক নাটক বলা হয়। সামাজিক নাটক রচিত হয় সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, বিশ্বাস, সংস্কার, আচার-আচরণকে ভিত্তি করে। বাংলা নাট্য-সাহিত্যে সামাজিক নাটকের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আর সামাজিক নাটকের জনপ্রিয়তা ও অনেক বেশি। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’, ‘সধবার একাদশী’, গিরিশ চন্দ্র ঘোষের ‘হারানিধি’, ‘বলিদান’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিম’, সাইদ আহমদের ‘কালো বেলা’ ইত্যাদি।
গ. কাব্য নাটক : কাব্য ও নাটকের উভয়ের শর্ত পূরণ করে যে নাটক রচিত হয়, তাকে কাব্য নাটক বলা হয়। অর্থাৎ কাব্য গুণ ও নাট্যগুণের সমন্বয়ে রচিত হয় কাব্য নাটক। বাংলা সাহিত্যে এ ধারার সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ ‘বিসর্জন’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য নাটক। বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী তরঙ্গিনী’ ও ‘কাল সন্ধ্যা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুল’ দীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি উলে­খযোগ্য কাব্য নাটক।
ঘ. গীতি নাট্য : নাচ, গান ও নাটকএ তিন সুকুমার শিল্পের সমন্বিত রচনাকে গীতি নাট্য বলে। এখানে নাচের মাধ্যমে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর গানের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের খেলা’, ‘অচলায়তন’ ইত্যাদি এ পর্যায়ের নাটক।
ঙ. রূপক সাংকেতিক নাটক : যখন কোনো বাস্তব ঘটনা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করা যায় না, তখন রূপকের প্রয়োজন হয়। বিশেষ কোনো তত্ত¡ প্রকাশ বা অত্যন্ত গভীরতর কোনো তত্ত¡কে সত্য প্রকাশ করার জন্য নাট্যকার যখন রূপকের আশ্রয়ে নাটক রচনা করেন। তখন তাকে রূপক-সাংকেতিক নাটক বলে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’ ইত্যাদি রূপক সাংকেতিক নাটক।
নাটকের রসগত দিক থেকে নাটককে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এ জাতীয় নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে তীব্র বেদনায় ও বিরহে, এ নাটক বিয়োগান্ত । যেমনÑ
ক. ট্রাজেডি : ট্রাজেডি নাটকের মূলে থাকে ব্যক্তি ও আত্মার দ্ব›দ্ব, বিক্ষুব্ধ, তীব্র যন্ত্রণা ও হাহাকার। যেমন, ‘অদি পাউস’, ‘ম্যাকবেথ’, হ্যামলেট প্রভৃতি।
খ. কমেডি : এ নাটকের পরি সমাপ্তি আনন্দ বা মিলনে।
গ. মেলোভূমা : এক ধরনের অতি নাটক। এটিও বিয়োগান্ত নাটক।
ঘ. ট্রাজিকমেডি : এ নাটক ট্রাজেডি ধর্ম হাস্য রসের নাটক।
ঙ. প্রহসন : ব্যক্তি ও সমাজের অসঙ্গতি দেখানোর জন্য ব্যঙ্গ বিদ্রূপের নাটক।
বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পালাগান ও যাত্রা বাংলা নাটকের প্রাচীন উৎস। তবে আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটে ইংরেজি নাটকের প্রভাবে। আর এর সূত্রপাত ঘটে আঠার শতকে। একজন রুশ নাগরিকের হাতে বাংলা নাটকের সূচনা। তাঁর নাম হেরাসিম লেবেদেফ। তিনি মুনশী গোলকনাথ দাসের সহযোগিতায় ‘ঞযব ফরংমঁরং’ এবং ‘খড়াব রং ঃযব নবংঃ ফড়পঃড়ৎ’ নামে দুটো ইংরেজি প্রহসন বাংলায় অনুবাদ করেন। আর এগুলো কলিকাতায় মঞ্চায়ন হয় উনিশ শতকের মধ্য ভাগে। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে শেকসপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর ভাবানুবাদ, তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ এবং রাম নারায়ণের ‘কুলীন কুল সর্বস্ব’ বাংলা নাটকের প্রথম পর্যায়ের উলে­খযোগ্য নাটক।
আধুনিক বাংলা নাটকের জনক হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ ইত্যাদি তাঁর সার্থক নাটক। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ তাঁর দুটো সার্থক প্রহসন। সামাজিক নাটক প্রবর্তন করেন দীনবন্ধু মিত্র তাঁর রচিত ‘নীলদর্পণ’, ‘নবীন তপস্বিণী’ ‘সধবার একাদশী’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, ‘বসন্ত কুমারী’ এবং প্রহসন ‘এর উপায় কি’ ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের সার্থক নাটক।
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরুবিক্রম’, ‘সরেজনি’ ইত্যাদি নাটক এবং ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’, ‘হঠাৎ নবাব’, দায়ে পড়ে দারগ্রহ’ ইত্যাদি প্রহসন বিশেষ উলে­খযোগ্য।
এরপর বাংলা নাটকের হাল ধরেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অমৃতলাল বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল প্রমুখ প্রতিভাধর নাট্যকারগণ। তাঁদের প্রতিভায় বাংলা নাটক সাফল্যের প্রাপ্ত সীমায় পৌঁছে। আজ বাংলা নাটকের গতিধারাবহতা নদীর মতো গতিশীল।
বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সাতচলি­শ পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যে যারা সবচেয়ে তৎপর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন, আকবর উদ্দিন, ইব্রাহিম খাঁ,
নূরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, মুনীর চৌধুরী, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালীউল­াহ্, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, সাইদ আহমদের নাম উলে­খযোগ্য। উলি­খিত নাট্যকারগণ সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটক রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শাহাদাৎ হোসেনের ‘সরফরাজ খাঁ, ‘নবাব আলীবর্দ্দী’, ‘আনারকলি’; আকবর উদ্দিনের ‘নাদির শাহ’, ‘সিন্ধু বিজয়’; ইব্রাহিম খাঁর ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’ এ যুগের ঐতিহাসিক নাটক।
নূরুল মোমেনের ‘নমেসিস’, ‘নয়াখান্দান’, ‘রূপান্তর’; আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘রক্তপদ্ম’; ‘এপার ওপার’; মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’, ‘নষ্ট ছেলে’; ‘মানুষ’; ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’; ‘দণ্ডকারণ্য’; শওকত ওসমানের ‘আমলার মামলা’, ‘কাঁকর মণি’; সৈয়দ ওয়ালীউল­াহর ‘বহিপীর’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তরঙ্গতঙ্গ’; আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ইহুদীর মেয়ে’, ‘মায়াবী প্রহর’, ‘মরক্কোর যাদুকর’; আনিস চৌধুরীর ‘মানচিত্র’, ‘এ্যালবাম’ এবং সিকান্দার আবু জাফরের ‘মহাকবি আলাওল’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ইত্যাদি নাটক বাংলাদেশের নাট্য সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের বিষয়-প্রকরণ ও আঙ্গিক পরিচর্যা পরিবর্তিত হয়। এ পর্বের নাট্যকারগণ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিষয় করে প্রধানত নাটক রচনা করেছেন। সারা দেশে বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়মিত নাটক প্রদর্শন, নাটক ও মঞ্চ সম্পর্কিত পত্রপত্রিকা প্রকাশের ফলে একটি নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ সময়ে বেশ কিছু প্রতিভাবান নাট্যকার আবির্ভূত হন। তাঁরা রচনা করেন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ এবং দর্শক-নন্দিত নাটক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উলে­খযোগ্য নাটক হচ্ছেমমতাজ উদ্দীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘বর্ণচোর’, ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘প্রেম বিবাহ সুটকেস’, ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’; আব্দুল­াহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখনই সময়’, ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘দ্যাশের মানুষ’, ‘কোকিলারা’; মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’, ‘এখানে নোঙর’, ‘ইবলিশ’, ‘ওরা আছে বলেই’, সেলিম আল দীনের ‘সর্প বিষয়ক গল্প’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘শকুন্তলা’; সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি। এসব নাটক বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফরের জন্ম ১৯১৮ সালে তেঁতুলিয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা। খুলনা তালা বি.ডি. উচ্চ ইংরেজি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করার পর তিনি কলকাতার রিপন (সুরেন্দ্রানাথ) কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪১ সালে তিনি শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কলকাতার ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। পরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক মিল­াত’ পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫৩ পর্যন্ত রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্মরণীয় অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ‘অভিযান’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। তাঁর রচিত ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সিকান্দার আবু জাফর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
সিকান্দার আবু জাফর রচিত সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে কাব্য : ‘প্রসন্ন প্রহর’ (১৯৬৫), ‘বৈরী বৃষ্টিতে’ (১৯৬৫), ‘তিমিরান্তিক’ (১৯৬৫), ‘বৃশ্চিক লগ্ন’ (১৯৭১), ‘বাংলা ছাড়’ (১৯৭২), ‘পূরবী’ (১৯৪৪), ‘নূতন সকাল’ (১৯৪৬)। নাটক: ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৫), ‘মাকড়সা’ (১৯৬০), ‘শকুন্ত উপাখ্যান’ (১৯৬২), ‘মহাকবি আলাওল’ (১৯৬৬)। পাঠ্যপুস্তক: ‘নবী কাহিনী’ (১৯৫১), ‘আওয়ার ওয়েলথ’ (১৯৫১)। নাট্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৬ সালে তাঁকে ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৫ সালে ৫ আগস্ট সিকান্দার আবু জাফর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের পটভূমি, চরিত্র-চিত্রণ ও সার্থকতা
বাংলা বিহার উড়িষ্যার তরুণ নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যশাসনের কাল এক বছর ষোল দিন (১৯ জুন ১৭৬৫ থেকে ২ জুলাই ১৭৫৭)। এই সময় পরিসরে নানা প্রতিক‚ল ঘটনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ষড়যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি রচিত হয়।
এ নাটকে চার অঙ্কে মোট বারোটি দৃশ্যে কাহিনিকে সাজিয়েছেন নাট্যকার। সংঘটিত ঘটনাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে উলে­খ করে কাহিনির মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য গতি দান করার চেষ্টা করেছেন লেখক, যা নাটকটিকে ঐতিহাসিক সত্যের খুব নিকটবর্তী করেছে।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে প্রধান-অপ্রাধান মিলে প্রায় চলি­শটিরও বেশি চরিত্র আছে। চরিত্রের সংলাপ ও গতিবিধি বাস্তবানুগ করে চিত্রিত করা হলেও একথা সত্যি যে, নাটকের চরিত্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক চরিত্রের হুবহু মিল থাকার কথা নয়। বাস্তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলায় কথা বলতেন না এবং রবার্ট ক্লাইভও ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতেন কিনা সন্দেহ। উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম, রাজবল­ভ এ নাটকে যেভাবে পদচারণা করেছে, বাস্তবে তাদের আচরণ হয়ত ঐ রকম ছিল না। সিকান্দার বলতে গিয়ে নাট্যকার যথেষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ তিনি নাটকের বশ, ইতিহাসের দাস নন। সিকান্দার আবু জাফর ইতিহাসের সত্যকে অবিকৃত রেখে ঐতিহাসিক চরিত্রের অনাবিষ্কৃত ও অনুদঘাটিত সত্য ও সৌন্দর্যকে সংস্থাপিত করেছেন। কারণ, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ চরিত্র নিয়ে বিচিত্র জনশ্র“তি প্রচলিত রয়েছে। এসব জনশ্র“তির প্রভাব এড়িয়ে প্রকৃত সত্যেকে নতুনতর শিল্পমাত্রায় রূপ দান করা সত্যি দুরুহ। এই দুরুহ কাজটিকে সিকান্দার আবু জাফর আপন প্রতিভার ঔদার্যে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। নাট্যকার নিজেই ভূমিকাতে বলেছেন
১ সিরাজউদ্দৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি।
২ প্রকৃত ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজউদ্দৌলার জীবন নাট্য পুনঃনির্মাণ করেছি।
৩ ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজউদ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও তাঁর চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদ্গুণ এই নাটকে প্রধানত সেই আদর্শ এবং মানবীয় গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।
সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজ’ তাই একাধারে দেশপ্রেমিক, জাতীয় বীর, সাহসী যোদ্ধা, প্রেমময় স্বামী, স্নেহশীল পিতা, একনিষ্ঠ ধার্মিক প্রভৃতি মহৎ গুণের অধিকারী।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মূল বিষয় যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে স্বয়ং সিরাজই নায়ক। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে তিনি ইংরেজদের তাড়িয়েছেন। ইংরেজরা প্রাণভয়ে সেখানে থেকে পালিয়েছেন। সিরাজের আপন খালা ঘসেটি বেগমকে মতিঝিল প্রাসাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রাখার জন্য নিজ প্রাসাদে উঠিয়ে এনেছেন। কিন্তু সম্মানিতা আত্মীয়ের প্রতি তিনি অশ্রদ্ধা দেখান নি। খালাতো ভাই এবং রাজনৈতিক শত্র“ শওকত জংকে তিনি পরাজিত ও নিহত করেছেন। তাঁর এক বছর ষোল দিন শাসন কালে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তিনি কখনো যুদ্ধ ভয়ে ভীত হন নি। পলাশীর যুদ্ধ প্রান্তরেও সিরাজ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। নিজেই সেনাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন প্রভূত দেরি হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারীরা সিরাজ চরিত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেসব কলঙ্ক লেপন করেছেন তার বিপরীতে সিরাজ চরিত্রের নানা সদ্গুণাবলির আলোকে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয় বীর সিরাজকে নবনির্মাণ করেছেন সিকান্দার আবু জাফর। কাহিনি, সংলাপ, চরিত্র-চিত্রণ ও দৃশ্য পরিকল্পনার দিক থেকে বিচার করলে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটককে সার্থক ঐতিহাসিক নাটক না বলা গেলেও একটি শিল্পসার্থক নাটক বলা যায়।
চরিত্রলিপি
সিরাজউদ্দৌলা ওয়াট্স
মিরজাফর ক্লেটন
রাজবল­ভ কিলপ্যাট্রিক
উমিচাঁদ জর্জ
জগৎশেঠ মার্টিন
রায়দুর্লভ হ্যারী
মোহনলাল লুৎফুন্নিসা
মিরমর্দান ঘসেটি বেগম
মিরন আমিনা বেগম
মানিকচাঁদ ইংরেজ মহিলা
রাইসুল জুহালা
মোহাম্মদি বেগ লবণ বিক্রেতা
সাঁফ্রে কমর বেগ
ক্লাইভ
ড্রেক ওয়ালী খান
হলওয়েল

নর্তকী, পরিচারিকা, নবাব সৈন্য, ইংরেজ সৈন্য, প্রহরী, নকীব, বার্তাবাহক ও নাগরিকবৃন্দ।



সংক্ষেপে নাটকের কাহিনি
প্রথম অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৭৫৬ সাল। ১৯ জুন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব কলকাতার ইংরেজ কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেছেন। নবাব সৈন্যের দুর্বার আক্রমণে দুর্গের অভ্যন্তরে ইংরেজদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তবু তাদের যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই। ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গের একাংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ সৈনিক নিয়ে কামান দাগাচ্ছেন। ইংরেজ সৈনিকেরা নিস্তেজ, আতঙ্কগ্রস্ত। অধিনায়ক পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টর সমস্ত ছাউনি তছনছ করে ভাবি ভাবি কামান নিয়ে দুর্গের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে নবাব-সৈন্য। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে বন্যাস্রোতের মতো প্রবেশ করছে নগরে, গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে অগ্রসর হচ্ছে অমিত বিক্রমে; বাধা দেবার কেউ নেই। ক্যাপ্টেন মিন্ চিন দমদমের রাস্তায় নবাব-সৈন্যের গতিরোধ করতে সাহস পান নি। তিনি কাউন্সিলার ফ্রাঙ্কল্যান্ড আর ম্যানিংহ্যামকে নিয়ে নৌকাযোগে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। হলওয়েল প্রবেশ করে ক্লেটনকে বলেন, কামান চালিয়ে কোনো ফল হবে না। তিনি তাঁকে পরামর্শ দেন গভর্নর ড্রেকের সাথে পরামর্শ করে নবাব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে। হলওয়েলের প্রস্তাব শুনে ক্লেটন বলেন, আত্মসমর্পণ করলেও নবাবের জুলুম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তিনি হলওয়েলকে দাঁড় করিয়ে ছুটে যান গভর্নর ড্রেকের কাছে। হলওয়েলের হুকুমে বন্দি উমিচাঁদকে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়। নবাব-সৈন্যদের যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। কিন্তু উমিচাঁদ কঠোর স্বরে বলে, সে গভর্নর ড্রেকের ধ্বংস দেখতে চায়। এমন সময় জর্জ এসে জানায় যে, গভর্নর ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকাযোগে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুনে উমিচাঁদ দুঃখিত হয়; কারণ ড্রেক তার হাত ছাড়া হয়ে গেলো। সে বিদ্রূপাত্মক ভাষায় হলওয়েলকে বলে, ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিয়েছে, এ বড় লজ্জার কথা। হলওয়েল হতাশায় ভেঙে পড়েন। তিনি উমিচাঁদের পরামর্শ চান। আবার প্রচণ্ড গোলার আওয়াজ ভেসে আসে। উমিচাঁদ মানিকচাঁদের কাছে চিঠি লিখতে চলে যায়; বলে যায় হলওয়েল যেন দুর্গ-প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দেন। জর্জ এসে খবর দেয় একদল সৈন্য গঙ্গার দিকে ফটক ভেঙে পালিয়ে গেছে আর সে-পথ দিয়ে নবাবের পদাতিক বাহিনী হুড়হুড় করে প্রবেশ করেছ দুর্গের ভেতরে। হলওয়েলের আদেশে জর্জ সাদা নিশান উড়িয়ে দেয়।
এমনি সময় প্রবেশ করেন নবাব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদ আর মিরমর্দান। মানিকচাঁদের আদেশে হলওয়েল তাঁর দলবল নিয়ে হাত তুলে দাঁড়ান। এমন সময় প্রবেশ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। হলওয়েল রাতারাতি কোম্পানির সেনাধ্যক্ষ বলে গেছেন দেখে নবাব অবাক হন। হলওয়েল বলেন, নবাব যেন তাঁদের ওপর অন্যায় জুলুম না করেন। সিরাজ বলেন, ঘৃণ্য আচরণের জবাবে তাদের ওপর সত্যিকার জুলুম করতে পারলে তিনি সুখী হতেন, আর তাঁর আক্রমণের কথা শুনেই ড্রেক প্রাণভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তবু তার আচরণের জন্য যেকোনো একজনকে অবশ্যই কৈফিয়ৎ দিতে হবে। বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথায়, তিনি তা জানতে চান। হলওয়েল বলেন, ইংরেজরা যুদ্ধ করতে চান নি, শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। নবাব শ্লেষাত্মক স্বরে তাকে বলেন, আত্মরক্ষার জন্য কাশিমবাজারে কুঠিতে তারা অস্ত্র আমদানি করছিল। খবর পেয়ে তাঁর হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, বন্দি করা হয়েছে ওয়ট্স্ আর কলেটকে। তিনি বন্দিদের তাঁর সামনে হাজির করতে হুকুম দেন রায়দুর্লভকে। বন্দিদের আনা হলে নবাব ওয়াট্সকে বলেন, তিনি জানতে চান, তাদের অশিষ্ট আচরণের জবাবদিহি কে করবে। কাশিমবাজারে তারা গোলাগুলি আমদানি করছে, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম তারা দখল করে নিচ্ছে, দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে, তাঁর নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল­ভকে আশ্রয় দিয়েছে, বাংলার মসনদে বসার পর তারা তাঁকে নজরানা পর্যন্ত দেয় নি। এসব উলে­খ করে তিনি জানান যে, ইংরেজদের এসব অনাচার সহ্য করবেন না।
ওয়াট্স জানান, তাঁর নবাবের অভিযোগ তাঁদের কাউন্সিলে পেশ করবেন। উত্তরে নবাব বলেন, ইংরেজদের ধৃষ্টতার জবাবদিহি না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের বাণিজ্য করার অধিকার তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ওয়াট্স তাঁকে বলেন, বাণিজ্যের অধিকার নবাব দেন নি, দিয়েছেন দিল­ীর বাদশাহ। নবাব বলেন, বাদশাহকে তারা ঘুষের টাকায় বশীভূত করে রেখেছে, তিনি তাদের অনাচার দেখতে আসেন না। হলওয়েল সবিনয়ে বলেন, নবাব আলিবর্দী তাদের বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছেন।
ওয়াট্স বলেন, তারা বাংলায় এসেছেন বাণিজ্য করতে, রাজনীতি করতে নয়; টাকা রোজগারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। নবাব উষ্ণ হয়ে বলেন, তারা বাণিজ্য করেন না, করেন লুন্ঠন; বাধা দিতে গেলই শাসন-ব্যবস্থায় আনতে চান ওলট-পালট; কর্ণাটকে, দক্ষিণাত্যে তাঁরা শাসন-ক্ষমতা করায়ত্ত করে লুটতরাজের পথ পরিষ্কার করেছেন। বাংলাতেও তা-ই করতে চান তারা। তাঁর নিষেধ সত্তে¡ও তারা কলকাতার দুর্গ সংস্কার বন্ধ রাখেননি। ওয়াট্স অজুহাত দেখান যে, তাঁরা ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চান। নবাব বলেন, ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজ খুব সজ্জন নয়। ওয়াট্স বলেন, ইংরেজরা অশান্তি চায় না। নবাব কঠোর কণ্ঠে রায়দুর্লভকে হুকুম করেন,গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা যেন কামানের গোলায় উড়িয়ে দেয়া হয় এবং গোটা ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে যেন ঘোষণা করা হয় যে, ইংরেজরা যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যান। আশপাশের গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়া হোক কেউ যেন ইংরেজের কাছে তাদের সওদা না বেচে, আর এ নিষেধ অমান্যকারীকে ভোগ করতে হবে ভয়ঙ্কর শাস্তি।
নবাব কলকাতার নাম আলীনগর রেখে রাজা মানিকচাঁদকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করতে হবে কোম্পানির প্রতিনিধিদের আর কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট কলকাতার প্রত্যেকটি ইংরেজকে।
ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরে একটা মসজিদ তৈরি করতে নবাব হুকুম দিলেন মিরমর্দনকে। উমিচাঁদের কাঁধে হাত রেখে নবাব তাঁকে মুক্তি দিলেন। মিরমর্দানকে বললেন, রাজা রাজবল­ভের সাথে তাঁর একটা মিটমাট হয়ে গেছে, তাই কৃষ্ণবল­ভকে মুক্তি দেবার ব্যবস্থা যেন করা হয়।
তিনি হলওয়েলকে বলেন, তাঁর সৈন্যদের তিনি মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু হলওয়েল তাঁর বন্দি। রায়দুর্লভকে হুকুম দিলেন কয়েদি হলওয়েল, ওয়াট্স আর কলেটকে নবাবের সাথে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। মুর্শিদাবাদে ফিরে তাঁদের বিচার করবেন।
প্রথম অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৬ সাল, ৩ জুলাই। ভাগীরথী নদীতে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ। পলাতক ড্রেক, হ্যারী, মার্টিন প্রমুখ ইংরেজ পুঙ্গবেরা দলবলসহ আশ্রয় নিয়েছে সে জাহাজে। চরম দুরবস্থা তাদের। আহার্য দ্রব্য তারা পায় না। যৎসামান্য পায় চোরাচালানের মাধ্যমে। পরনে বস্ত্র নেই বললেই চলে। সবারই এক কাপড় সম্বল। জাহাজের ডেকে ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক ও দুজন ইংরেজ তরুণ পরামর্শ করছেন। ড্রেক বলেন, মাদ্রাজ থেকে কিলপ্যাট্টিক খবর এনেছেন, প্রয়োজনীয় সাহায্য আসছে, কিন্তু হ্যারী বলে, তার আগেই তাদের দফা শেষ হয়ে যাবে। মার্টিন বলে যে, কিলপ্যাট্রিক এসেছেন মাত্র আড়াইশ সৈন্য নিয়ে; এ নিয়ে একটা দাঙ্গা করাও সম্ভব নয়, যুদ্ধ করে কলকাতা পুনরাধিকার করা যাবে না। হ্যারী বলে, লোকবল বিশেষ বাড়ে নি, কিন্তু দুর্লভ আহার্যের অংশীদার বেড়েছে। ড্রেক তাদের আশ্বাস দেন যে, আহার্যের জোগাড় কোনো রকমে করা যাবেই। মার্টিন কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে বলে, কাছে হাটবাজার নেই। নবাবের হুকুমে কেউ কোনো জিনিস ইংরেজদের কাছে বেচে না, চার গুণ দাম দিয়ে সওদাপাতি করতে হয় গোপনে। সে আরও বলে যে, তাদের এ দুর্দশার জন্য দায়ী গভর্নর ড্রেক। ড্রেক নবাবকে উদ্ধত ভাষায় চিঠি লিখেছে, নবাবের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষ্ণবল­ভকে আশ্রয় দিয়েছেন। উত্তরে ড্রেক বলেন যে, সব ব্যাপারে সবার নাক গলানো সাজে না। হ্যারী শ্লেষাত্মক ভাষার বলে, কৃষ্ণবল­ভের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ খাবেন ড্রেক, তাতে তাদের মাথা ঘামানো অবশ্যই উচিত নয়। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, ঘুষের অঙ্ক খুব মোটা হওয়াতেই নবাবের ধমকানি সত্তে¡ও ড্রেক কৃষ্ণবল­ভকে পরিত্যাগ করতে পারেন নি। মার্টিন অভিযোগ করে, ড্রেক তাঁদের ভাগ্যবিপর্যয় সম্পর্কে কাউন্সিলের কাছে মিথ্যা রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। টেবিলে ঘুষি মেরে ড্রেক তাঁকে ধমক দেন।
ড্রেক আরও বলেন, ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃত্ব তখনো তাঁর হাত ছাড়া হয় নি, ও জাহাজটাই তখন তাঁদের দুর্গ। একযোগে কাজ করার পরামর্শের জন্য তাঁদের ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তারা তেমন মর্যাদার পাত্র নন। মার্টিন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, তাঁরা ড্রেকের কর্তৃত্ব মানবে না। ড্রেক ক্ষেপে ধঢ়ড়ষড়মু দাবি করেন মার্টিনের কাছে, নতুবা তাকে কয়েদ করা হবে। ড্রেকের কথায় ইংরেজ মহিলা ছুটে এসে ড্রেককে বলেন, তিনি মেয়েদের নৌকায় কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছেন, তাঁর এমন দম্ভ শোভা পায় না। ড্রেক তাকে বোঝাতে চান যে, তারা তখন কাউন্সিলে বসেছেন। রমণী উত্তেজিত হয়ে বলেন, প্রাণ বাঁচাবার কোনো ব্যবস্থা নেই, অথচ কাউন্সিলে বসছেন, কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন, প্রত্যহ শোনান কিছু একটা করা হচ্ছে, অথচ হচ্ছে শুধু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। ড্রেক তাকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করেন। রমণী প্রবোধ মানেন না। তিনি বলেন, এক প্রস্থ জামা-কাপড়ই সম্বল। ছেলে-বুড়ো সবাইকে তা খুলে রেখে রাতে ঘুমাতে হয়, কোনো আব্র“ নেই।
এমন সময় হলওয়েল আর ওয়াট্স এসে উপস্থিত। হলওয়েল বলেন, মুর্শিদাবাদ পৌঁছে নবাব তাঁদের মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তি পেতে তাঁদের নানা ওয়াদা করতে হয়েছে, নাকে কানে খৎ দিতে হয়েছে। ওয়াট্স বলেন, কলকাতায় এখন ফেরা যাবে না, তবে ধীরে ধীরে একটা ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যাবে, অর্থাৎ মেজাজ বুঝে যথাসময়ে একটা উপঢৌকনসহ হাজির হয়ে আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। হলওয়েল বলেন, একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট যে, নবাব ইংরেজদের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করতে চান না, তা চাইলে তখন কলকাতায়ও তাঁরা নিশ্চিত থাকতে পারবেন না। তাঁরা নবাবের সাথে যোগাযোগের কিছুটা ব্যবস্থাও করে এসেছেন। তা ছাড়া উমিচাঁদ নিজের থেকেই ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। শুনে ড্রেক উল­াস-ধ্বনি করেন। ওয়াট্স বলেন, মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল­ভ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও নবাবের কানে কথাটা তুলবেন। ড্রেক তখন হ্যারী আর মার্টিনকে বলেন, তিনি আশা করেন, তাদের মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। তিনি তাদের বুঝিয়ে বলেন, তাদের মিলেমিশে থাকতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে। হ্যারী আর মার্টিন বলে যে, তারা ঝগড়া করতে চায় না, তারা তাদের ভবিষ্যৎ জানতে চায়, একটা নিশ্চিত ফলাফল দেখতে চায়।
যে জায়গায় পলাতক ইংরেজরা আস্তানা গেড়েছেন তা নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর। মশার উপদ্রব অত্যন্ত বেশি। ম্যালেরিয়ায় ভুগে ইতোমধ্যে কেউ কেউ মরেও গেছে। তবে সামরিক দিক দিয়ে জায়গাটার গুরুত্ব আছে। সমুদ্র কাছেই, কলকাতাও চলি­শ মাইলের মধ্যে। প্রয়োজনমতো যেকোনো দিকে ধাওয়া করা যাবে। কিলপ্যাট্রিকের মতে, কলকাতায় ফেরার আশায় বসে থাকতে হলে ফলতা জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ; নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল, সেদিক দিয়ে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। বিপদ যদি আসেই তবে আসবে কলকাতার দিক থেকে এবং সতর্ক হবার মতো সুযোগ পাওয়া যাবে। হলওয়েল জানায়, কলকাতার দিক থেকে তখনকার মতো বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। উমিচাঁদ কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদকে হাত করেছে। তাঁর অনুমতি পেলে ইংরেজরা জঙ্গল কেটে ফলতায় হাট-বাজার বসিয়ে দেবে। ড্রেক দুঃখ করেন, নেটিভরা তাদের সাথে ব্যবসা করতে চায়, কিন্তু ফৌজদারের ভয়ে তা করতে পারছে না।
এমন সময় একটা লোক এসে ড্রেকের হাতে উমিচাঁদের পত্র দেয়। উমিচাঁদ লিখেছে, সে চিরকালই ইংরেজদের বন্ধু এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব সে অক্ষুণœ রাখবে। মানিকচাঁদকে সে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। সে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। এজন্যে তাঁকে নজর দিতে হয়েছে বারো হাজার টাকা। টাকাটা উমিচাঁদ নিজের তহবিল থেকে দিয়ে দেওয়ানের স্বাক্ষরিত হুকুমনামা হাতে হাতে সংগ্রহ করে পত্রবাহক মারফত পাঠিয়েছে। সে বারো হাজার টাকা ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যা ন্যায্য বিবেচিত হয় তা পত্রবাহকের মারফত পাঠিয়ে দিলে উমিচাঁদ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। সে পারিশ্রমিক বাবদ পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার আশা রাখে।
হলওয়েল আর ওয়াটসের মতে, অনেক টাকার বিনিময়ে হলেও উমিচাঁদের সাহায্য হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। ড্রেক বলেন, উমিচাঁদের লাভের অন্ত নেই, মানিকচাঁদের হুকুমনামার জন্য সে সতেরো হাজার টাকা দাবি করেছে। তিনি হলফ করে বলতে পারেন যে, সে টাকার মধ্যে দু’হাজারের বেশি মানিকচাঁদের পকেটে যাবে না, বাকিটা যাবে উমিচাঁদের তহবিলে। তিনি টাকাটা দিয়ে উমিচাঁদের লোকটাকে বিদায় করতে চলে যান।
ওয়াট্স বলেন যে, টাকার ব্যাপারে একা উমিচাঁদই দোষী নয়; মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল­ভ, মানিকচাঁদ সবাই হাত পেতে রয়েছে। কিলপ্যাট্রিকের মতে, দশ দিকের দশটি খালি হাত ভর্তি করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ইংরেজ, ডাচ আর ফরাসিরা।
ড্রেক আবার প্রবেশ করে জানান, আরেকটা জরুরি খবর আছে উমিচাঁদের চিঠিতে। সে লিখেছে, শওকতজঙ্গের সাথে সিরাজের সংঘর্ষ আসন্ন। সে সুযোগ নেবেন মিরজাফর, জগৎশেঠ আর রাজবল­ভের দল। তাঁরা সমর্থন করবেন শওকতজঙ্গকে। ওয়াটসের মতে, তাঁদের শওকতজঙ্গকে সমর্থন করাটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ শওকতজঙ্গ নবাব হলে সবার উদ্দেশ্য হাসিল হবে। ভাং খেয়ে নর্তকীদের নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকবেন শওকতজঙ্গ; উজির-ফৌজদাররা তখন যাঁর যা খুশি করতে পারবেন। ড্রেকের মতে, আগেভাগেই শওকতজঙ্গের কাছে ইংরেজদের ভেট পাঠানো উচিত।
হলওয়েল আর ওয়াট্স সদ্য কয়েদমুক্ত হয়ে এসেছেন। তারা বাতি চান, পেগ ভর্তি মদ চান। এ সময় নেপথ্য থেকে কে বলে ওঠে সমুদ্রের দিক থেকে জাহাজ আসছে। দুখানা, তিনখানা, চারখানা, পাঁচখানা জাহাজ আসছে কোম্পানির। নিশ্চয়ই মাদ্রাজ থেকে সবাই নিজ নিজ গ্লাসে মদ ঢেলে নেয়।
প্রথম অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ১০ অক্টোবর। ঘসেটি বেগমের বাসভবন। প্রৌঢ়া ঘসেটি বেগম জমকালো জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবল­ভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, বাদক আর নর্তকী। খানসামা তাম্বুল আর তামাক পরিবেশন করছে। এমন সময় আসরে প্রবেশ করে উমিচাঁদ, সঙ্গে একজন বিচিত্র বেশধারী মেহমান। ঠিক এ সময়, এক পর্যায়ের নাচ শেষে উপস্থিত সবাই করতালি দিতে থাকেন। ঘসেটি বেগম উমিচাঁদকে সমাদর করে বসতে দেন। বিচিত্রবেশী লোকটার দিকে তাকাতেই উমিচাঁদ বলেন, তিনি একজন জবরদস্ত শিল্পী, তার সাথে পরিচয় অল্পদিনের। এর মধ্যে তার কেরামতিতে উমিচাঁদ মুগ্ধ, সেদিনকার জলসা সরগরম করতে সে লোকটাকে সাথে নিয়ে এসেছে। রাজবল­ভ অপরিচিত লোকের আবির্ভাব সন্দেহের চোখে দেখেন। উমিচাঁদ বলে, ভাবনার কোনো কারণ নেই, লোকটা দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে-জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ায়। জগৎশেঠ লোকটাকে তার কেরামতি দেখাতে আহŸান করেন। তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয় ঘসেটি বেগমের। লোকটা গিয়ে দাঁড়ায় আসরের মাঝখানে। রাজবল­াভ নাম জানতে চাইলে বলে নাম তার রাইসুল জুহালা। সবাই হেসে ওঠেন। রায়দুর্লভ ঠাট্টা করে বলেন, জাহেরদের রইস বলেই কি সে উমিচাঁদকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে? সবাই আবার হাসিতে ফেটে পড়তেই উমিচাঁদ বলেন যে, সে তো বেশ জাহেল, এ কারণে তাঁরা সব সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফটা শুকনো রাখেন, আর সে দুধের হাঁড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাঁড়ির কালি মেখে বনে যায় গুলবাঘা।
ঘসেটি বেগম তাদের কথা কাটাকাটিতে বাধা দেন। তাঁর হুকুমে রাইসুল জুহালা বলে, সে নানা রকম জন্তুজানোয়ারের কথা জানে, তবে সে তখন তাঁদের দেশের একটা নাচ একটা বিশেষ শ্রেণির ধার্মিক পাখির নাচ দেখাবে সে। সমকালীন অবস্থা বিবেচনা করে সে বিশেষ নাচটি জনপ্রিয় করতে চায়। নৃত্য চলতে থাকে। এ সময় ঘসেটি বেগম আর রাজবল­ভ নিচুস্বরে পরামর্শ করেন। পরে উমিচাঁদ ও রাজবল­ভের সাথে আলোচনা চলে। নাচ শেষ হয়। সবাই হর্ষধ্বনি করেন। রাজবল­ভ রাইসুল জুহালাকে আরো কিছু আনন্দ পরিবেশনের দায়িত্ব দেবার প্রস্তাব করায় উমিচাঁদ তার সাথে এক পাশে গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেন। তারপর নিজের আসনে ফিরে এসে জানায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে নৃত্যের কলা-কৌশল দেখবার ফাঁকে ফাঁকে দুচারখানা চিঠিপত্রের আদান-প্রদানেও তার আপত্তি নেই। রাজবল­ভ তাকে দরকার মতো কাজে লাগাবেন বলে তখনকার মতো বিদায় করে দেন। তাঁর ইচ্ছায় নর্তকীরাও দলবল নিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন তাঁদের পরামর্শ শুরু হয়।
ঘসেটি বেগমের ইঙ্গিতে জগৎশেঠ বলেন, শওকতজঙ্গকে তাঁরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছেন, কিন্তু তিনি নবাব হলে জগৎশেঠ কী পাবেন? বেগম বলেন, শওকতজঙ্গ তো তাঁদেরই ছেলে, তিনি যদি নবাব হন তবে তারাই হবেন দেশের মালিক। রায়দুর্লভ কিছু বলতে গেলে জগৎশেঠ তাঁকে থামিয়ে দিতে গেলে রায়দুর্লভ বলেন, জগৎশেঠ তাঁর কথা শেষ হলে আর কোনো কথা ওঠাতে পারবেন না। রাজবল­ভ বলেন, তর্ক না করে খুব সংক্ষেপে তাঁদের কথা শেষ করতে হবে। তখনকার পরিস্থিতিতে কথা দীর্ঘায়িত হলে বিপদ ঘটতে পারে।
জগৎশেঠ বলতে থাকেন, নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তিনি খোলাখুলি বেগমকে বলেন, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাং-এর গ্লাস আর নাচওয়ালী ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। কাজেই সে নবাব হবে নামে মাত্র, আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগমের হাতে, আর তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজা রাজবল­ভ। ঘসেটি বেগম আর রাজবল­ভ সম্পর্কে এমন একটা উক্তি করায় রায়দুর্লভ জগৎশেঠকে সতর্ক করে দেন; বলেন, এমন একটা ব্যাপারের জন্যই হোসেনকুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। জগৎশেঠ তখন বলেন যে, শওকতজঙ্গ নবাব হলে বেগম আর রাজবল­ভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘœ হবে, তাঁদের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, কাজেই তাঁরা চান নগদ লেনদেন। বেগম প্রতিবাদ করে বলেন, ধনকুবের জগৎশেঠকে টাকা দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খরচ চলবে না। উত্তরে জগৎশেঠ বলেন, তিনি নগদ টাকা চান না, যুদ্ধের খরচও তিনি তাঁর সাধ্যমতো চালাবেন, কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে তাঁকে লিখে দিতে হবে একটা কর্জনামা। কর্জনামা সই করে দিলেই তিনি নিশ্চিত হতে পারেন। রায়দুর্লভও তখন দাবি করেন একটা একরারনামা।
এমন সময় প্রহরী এসে বেগমের হাতে দেয় মিরজাফরের পত্র। তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে। শুনে রাজবল­ভ খুশি হয়। উমিচাঁদ জানান, মিরজাফরের প্রস্তাব তাঁর পছন্দ হয়েছে। ইংরেজরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠেছে। তারা সিরাজের পতন চায়, শওকতজঙ্গ যদি ঠিক সে সময় আঘাত হানতে পারেন তবে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা তিনি পাবেন এবং জয় হবে অবধারিত। বেগমের মতে সিরাজের পতন সবাই চায়, তবে সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের প্রবল আশঙ্কা নিয়ে টিপ্পনী কাটেন বেগম। উমিচাঁদ বলেন দওলত তাঁর কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়, তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করে ড্রেক তাঁর চিঠির জবাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, শওকতজঙ্গের যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সিরাজের সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটানো হয় এবং ইংরেজদের মিত্র সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে, তা হলেই সিরাজের পতন হবে অনিবার্য। রাজবল­ভ বলেন, তাঁদের বন্ধু মিরজাফর রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছা করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।
হঠাৎ বাইরে শুরু হয় তুমুল কোলাহল। কে যেন বলে নবাব আসছেন। রাজবল­ভ আর ঘসেটি বেগম নর্তকীদের ডেকে জলসা সরগরম করে তোলেন। পর মুহূর্তেই জলসার আসরে ঢুকে পড়েন মোহনলালকে নিয়ে স্বয়ং নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজের ব্যঙ্গোক্তির জবাবে তাঁর খালাম্মা ঘসেটি বেগম বলেন, তাঁর বাড়িতে জলসা নতুন নয়। নবাব বলেন, নতুন না হলেও দেশের সবগুলো সেরা মানুষ সে জলসায় শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। নবাব বলেন, তাঁর খালাম্মা নাচ-গানের মাহফিলের জন্যে দেওড়িতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছেন, তারা তো নবাবকে প্রায় গুলি করেই ফেলেছিল। দেহরক্ষী ফৌজ সাথে ছিল বলেই তিনি বেঁচে গেছেন। নবাব রাজবল­ভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সবাইকে বিদায় দিতে গিয়ে বলেন, তিনি চিরদিনের জন্যে সে জলসা ভেঙে দিলেন তাঁর চারদিকে তখন ষড়যন্ত্রের জাল, তাই তখন নবাবের খালা আম্মার বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। তিনি তাঁকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছেন।
ঘসেটি বেগম ক্রুদ্ধ হন। তিনি সরোষে চিৎকার করে বলেন, নবাব তাঁকে বন্দি করেছেন। তাঁর এত বড়ো স্পর্ধা হলো কি করে তা তাঁর বোধের অতীত। নবাব শান্ত কন্ঠে বলেন তাঁকে বন্দি করা হয়নি; প্রাসাদে তিনি তাঁর বোন সিরাজ-জননীর সাথে একসঙ্গে বাস করবেন। ঘসেটি বেগমের অনুরোধে রাজবল­ভ নবাবকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। নবাব উত্তপ্ত কন্ঠে বলেন যে, তিনি রাজবল­ভদের চলে যেতে বলেছেন। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল।
তাঁরা চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নবাব রায়দুর্লভকে বলেন, তিনি শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করেছেন। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে; তিনিও যেন প্রস্তুত থাকেন। প্রয়োজন হলে তাঁকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।
রায়দুর্লভ হুকুম শুনে নিষ্ক্রান্ত হন। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে ওঠেন। সিরাজ বলেন, মোহনলাল তাঁকে প্রাসাদে নিয়ে যাবেন, তাঁর কোনো অমর্যাদা হবে না। ঘসেটি বেগম উন্মাদিনীর মতো নবাবকে অভিশাপ দিতে থাকেন।
দ্বিতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ১০ মার্চ। মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবার। মিরজাফর, রাজবল­ভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ ও কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াট্স উপবিষ্ট, অস্ত্রসজ্জিত মিরমর্দান, মোহনলাল আর সাঁফ্রে দাঁড়ানো। দৃঢ় পদক্ষেপে প্রবেশ করেন সিরাজ। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে নতশিরে শ্রদ্ধা জানান। সিংহাসনে বসে নবাব বলেন, কয়েকটি জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্যে সভাসদদের সেদিনকার দরবারে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। রাজবল­ভ বলেন, দরবারে আগে জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি। নবাব উত্তর দেন যে, তার কারণ তখন পর্যন্ত তাঁকে কোনো জরুরি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। তাঁর বিশ্বাস ছিল সিপাহসালার মিরজাফর, রাজা রাজবল­ভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকবেন এবং তাঁর পথ বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে না, অন্তত যাঁরা একদিন আলিবর্দীর অনুগ্রহভাজন ছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি তেমনটিই আশা করেছিলেন। মিরজাফর নবাবের মনোভাব জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি নালিশ করছেন নিজের বিরুদ্ধে, বিচার করবেন তারা। বাংলার প্রজা-সাধারণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতে পারেন নি বলে তিনি তাদের কাছে অপরাধী। জগৎশেঠ নবাবের অপরাধ কি তা জানতে চাইলে নবাবের ইঙ্গিতে দরবারে এনে হাজির করা হয় এক ব্যক্তিকে। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। তার মর্মন্তুদ দুরবস্থার প্রতিকার করতে রায়দুর্লভ তরবারি নিষ্কাষণ করেন। তাঁকে নিরস্ত্র করে নবাব বলেন, লোকটার সে দুরবস্থার জন্যে দায়ী তাঁর দুর্বল শাসন। উৎপীড়িত লোকটা জানায়, সে লবণ বিক্রি করেনি বলে কুঠির সাহেবরা তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, ওদের আরেক জন তার নখের ভেতরে খেজুরকাঁটা ফুটিয়েছে। তার বউকে ওরা খুন করেছে।
নবাব ওয়াটসের কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, নবাবের নিরীহ প্রজার এমন দুরবস্থার জন্যে দায়ী কে এবং ওয়াট্স বলে তা সে জানে না। নবাব রেগে গিয়ে বলেন যে, ইংরেজদের অপকীর্তির সব খবরই তিনি রাখেন। কুঠিয়াল সাহেবরা দৈনিক কতগুলো নিরীহ প্রজার ওপর অত্যাচার করে তার হিসাব চান তিনি ওয়াটসের কাছে। ওয়াটস অপমান বোধ করে। সে বলে, দরবারে ইংরেজের প্রতিনিধি হয়ে দেশের কোথায় কি হচ্ছে তার কৈফিয়ত সে দিতে পারে না।
সিরাজ বলেন, ওয়াটস সত্যিকার প্রতিনিধি নয়, তাঁর এবং ড্রেকের পরিচয় তাঁর অজানা নেই। দুশ্চরিত্রতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে তাদের স্বদেশ থেকে নির্বাসিত না করে পাঠানো হয়েছে ভারতে বাণিজ্য করতে। এ দেশে এসে তারা দুর্নীতি আর অনাচারের পথ ত্যাগ করতে পারেনি নবাব ওয়াটসের কাছে। নিরীহ প্রজাদের ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচারের কৈফিয়ত দাবি করেন । ওয়ার্টস বলতে চায় যে, তারা ট্যাক্স দিয়ে শান্তিতে বাণিজ্য করে, প্রজাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। উত্তরে নবাব বলেন, ট্যাক্স দিয়ে বাণিজ্য করে বলে তারা তাঁর প্রজাদের ওপর অত্যাচার করার অধিকার পায় নি। তিনি মিরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখ সভাসদদের বলেন, তাঁদের পরামর্শেই তিনি কোম্পানিকে লবণের ইজারাদারী দিয়েছেন। তাঁরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, রাজস্বের পরিমাণ বাড়লে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হবে। তিনি সভাসদদের জিজ্ঞেস করেন, বাংলার নবাব ব্যক্তিগত অর্থলালসায় বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে কুঠিয়ালদের প্রশ্রয় দিয়েছেন কিনা; তিনি অনাচারীদের বিরুদ্ধে শাসন-শক্তি প্রয়োগের সদিচ্ছা হৃষ্ট মনে গ্রহণ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
সিরাজ জোর গলায় বলেন, সিপাহ্সালার নবাবকে ভয় দেখাচ্ছেন। দরবারে বসে নবাবের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত তাও তার স্মরণ নেই। তিনি সেই মুহূর্তেই সিপাহ্সালারকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করতে পারেন। মিরজাফর, রাজবল­ভ, জগৎশেঠ সবাইকে কয়েদখানায় আটক করতেও পারেন, আর শত্র“র কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে তাঁকে তা করতে হবে, দুর্বলতা দেখালে চলবে না। মোহনলাল তরবারি নিষ্কাশন করেন, নবাব তাঁকে হাতের ইঙ্গিতে নিরস্ত করে আবার সভাসদদের বলেন, তিনি তা করবেন না। তিনি ধৈর্য ধারণ করবেন। অসংখ্য ভুল বোঝাবুঝি, অসংখ্য ছলনা আর শঠতার ওপর নবাব আর তাঁর সভাসদদের স¤প্রীতির ভিত প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সন্দেহের কোনো অবকাশ তিনি রাখবেন না। মিরজাফর বলেন, তাঁদের প্রতি নবাবের সন্দিগ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন না হলে দেশের অকল্যাণের কথা ভেবে তাঁরা উৎকণ্ঠা বোধ করবেন।
সিরাজ বলেন, দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণই সবচেয়ে বড়ো কথা। দেশের কল্যাণের পথেই তাঁরা আবার পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পারেন। তিনি জানতে চান, দেশের কল্যাণের পথে তাঁরা তাঁর সহযাত্রী হবেন কিনা। রাজবল­ভ নবাবের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে জানতে চাইলে নবাব বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়। কলকাতায় ওয়াটস এবং ক্লাইভ আলীনগরের সন্ধি খেলাপ করে তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে ফরাসিদের চন্দননগর আক্রমণ করেছে। তাদের ঔদ্ধত্য বিদ্রোহের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এ বিদ্রোহ দমন না করলে একদিন ওরা মুর্শিদাবাদের মর্যাদার ওপর আঘাত হানবে।
মিরজাফর নবাবের হুকুম চাইলে সিরাজ বলেন, তিনি অন্তহীন সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ভরসা নিয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ইচ্ছে করলে নবাবকে ত্যাগ করতে পারেন। বোঝা যতই দুর্বহ হোক, তিনি তা একাই বইবেন। শুধু একটি অনুরোধ, যেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত না করেন।
মিরজাফর বলেন, দেশের স্বার্থের জন্যে নিজেদের স্বার্থ তুচ্ছ করে তাঁরা নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবেন। সিরাজ আশ্বস্ত হন। তিনি বলেন, তিনি জানতেন যে, দেশের প্রয়োজনকে তাঁরা কখনও তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। মিরজাফর সিরাজের হাত থেকে পবিত্র কোরান নিয়ে নতজানু হয়ে দুহাতে কোরান ছুঁয়ে আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।
জগৎশেঠ, রাজবল­ভ, রায়দুর্লভ নিজ নিজ প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করলেন তামা, তুলসী আর গঙ্গাজল ছুঁয়ে; উমিচাঁদ কসম করেন রামজীর নামে। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন সর্বশক্তি দিয়ে চিরকাল তাঁরা আজ্ঞা পালন করবেন বাংলার নবাবের।
সিরাজ ওয়াটসকে বলেন, আলীনগরের সন্ধির শর্তানুসারে তিনি ওয়াটসকে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওয়াট্স সে সম্মানের অপব্যবহার করে গুপ্তচরের কাজ করছে। তিনি তাঁকে সাজা দিলেন না, তবে বিতাড়িত করলেন তাঁর দরবার থেকে। তাকে বলে দিলেন ক্লাইভ আর ড্রেককে জানাতে যে, তিনি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন। নবাবের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেইমান নন্দকুমারকে ঘুষ দিয়ে তারা চন্দননগর ধ্বংস করেছে। সে ঔদ্ধত্যের যথাযোগ্য শাস্তি তাদের দেয়া হবে।
দ্বিতীয় অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ১৯ মে। মিরজাফরের আবাসগৃহ। মিরজাফর, রাজবল­ভ, জগৎশেঠ মন্ত্রণারত। জগৎশেঠ বলেন যে, মিরজাফর বড়ো বেশি হতাশ হয়ে পড়েছেন। মিরজাফর প্রতিবাদ করে বলেন যে, তিনি হতাশ হয়ে পড়েন নি, নিস্তব্ধ হয়ে আছেন অগ্নিগিরির মতো প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়ার জন্যে। তাঁর বুকের ভেতর আকাক্সক্ষা আর অধিকারের লাভা টগবগ করে ফুটছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের অসহ্য তাপে। তিনি তাঁর আঘাত হানবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজবল­ভ বলেন, প্রকাশ্য দরবারে সেদিনকার এত বড়ো অপমানের কথা তিনি কল্পনাও করেন নি। মিরজাফর বলেন, সিরাজ সেদিন শুধু অপমান করেন নি, প্রাণের ভয়ে তাদেরকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন। পদস্থ কেউ হলে সেদিন মানীর মর্যাদা বুঝতো, কিন্তু মোহনলালের মতো একটা সামান্য সিপাই যখন নাঙ্গা তলোয়ার হাতে দাঁড়ায় তখন আতঙ্কে তিনি কেয়ামতের ছবি দেখেছিলেন। রায়দুর্লভ ফোঁড়ন কাটেন যে, সিপাহসালারের অপমানটাই সেদিন তার বুকে বেশি বেজেছিল। জগৎশেঠ অবাক হয়ে বলেন, চারদিকে বিপদবেষ্টিত হয়েও সিরাজ চান তাঁদের বন্দি করতে; সিংহাসনে স্থির হয়ে বসতে পারলে তো কথাই নেই। রাজবল­ভ বলেন, সিরাজ তাদের অস্তিত্বই লোপ করে দিতে চান। তাঁদের সম্বন্ধে নবাবের বাইরের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে যতখানি তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে অপ্রকাশিত। শওকতজঙ্গের ব্যাপারে নবাব তাঁদের কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি। শুধু মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠিয়ে তাকে বিনাশ করেছেন; এতে তাঁদের নিশ্চিন্ত বোধ করার কিছুই নেই। জগৎশেঠ বলেন, তাঁরা যে নিরাপদ নন, তার প্রমাণ তো হাতের কাছেই রয়েছে। নবাব তাঁদের বন্দি করতে যেয়েও করেন নি, কিন্তু রাজা মানিকচাঁদ তো ছাড়া পান নি। শেষ পর্যন্ত দশ লক্ষ টাকা খেসারাত দিয়ে তাঁকে মুক্তি কিনতে হয়েছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, নন্দকুমারের অদৃষ্টেও বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। মিরজাফর জানান, তাঁদের কারো অদৃষ্টই মেঘমুক্ত নয়। মিরজাফর বলেন, কাজেই নবাবের উচ্ছেদের ব্যাপারে কালক্ষয় করা উচিত হবে না। রাজবল­ভ জানান যে, তাঁরা প্রস্তুত। নেতৃত্ব ন্যস্ত হয়েছে মিরজাফরের হাতে; তিনি কর্মপন্থার নির্দেশ দিলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
মিরজাফর বলেন যে, যদিও তাঁর ওপর তাঁদের সবার আন্তরিক ভরসা রয়েছে, তবু মনের সন্দেহটা দূর করার জন্যে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমে পাকাপাকি করে নেয়া উচিত। এমন সময় রাইসুল জুহালা প্রবেশ করে বলে যে, মিরজাফরের নবাব হতে আর বেশি দেরি নেই। সে বলে, উমিচাঁদের চিঠি নিয়ে গিয়েছিল সে ক্লাইভের কাছে; ক্লাইভ তাকে গুপ্তচর সন্দেহ করে কতল করতে চেয়েছিল; সে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সে অবশ্যি তখন উমিচাঁদের কাছ থেকে তার পত্র নিয়ে এসেছে। পত্রটা সে মিরজাফরের হাতে তুলে দেয়। মিরজাফর পত্র পড়ে তা এগিয়ে দেন রাজবল­ভের দিকে। সবার হাত ঘুরে চিঠিটা আবার ফিরে আসে মিরজাফরের হাতে। মিরজাফর অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে চান। চিঠির জবাব দেবার আগে তিনি সরাতে চান রাইসুল জুহালাকে। জগৎশেঠের মতে তাঁদের নিজস্ব গুপ্তচরকেও বিশ্বাস করা যায় না। তারা মূল চিঠি হয়তো আসল জায়গাতেই পৌঁছে দিচ্ছে কিন্তু তার একখানা নকল হয়তো বা নবাবের লোকের হাতে গিয়ে পড়ছে। রাইসুল জুহালা ফোঁড়ন কেটে বলে, সন্দেহ করাটা অবশ্যি বুদ্ধিমানের কাজ, কিন্তু অতিরিক্ত সন্দেহে বুদ্ধিটা গুলিয়েও যেতে পারে। সে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গুপ্তচরেরাও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে, তাদের বিপদের ঝুঁকিও কম নয়।
জগৎশেঠ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, রাইস সম্পর্কে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি। মিরজাফর তাকে বিদায় দিয়ে বলেন, সে যেন তার সাংকেতিক মোহরটা উমিচাঁদকে দেয়। তাহলে তিনি রাইসের কথা বিশ্বাস করবেন। তাঁকে জানাতে হবে যে, পরবর্তী মাসের ৮ তারিখে দু’নম্বর জায়গায় তাঁদের সবকিছু লেখাপড়া হবে। রাইস মিরজাফরের সাঙ্কেতিক মোহর নিয়ে বেরিয়ে যায়। মিরজাফর তখন জগৎশেঠকে বলেন, রাইসুল জুহালা অত্যন্ত চতুর লোক। সে উমিচাঁদের বিশ্বাসী লোক। ওর সামনে জগৎশেঠের ওসব কথা বলা ঠিক হয় নি। জগৎশেঠ কৈফিয়তের সুরে বলেন, কি হতে পারে তাই শুধু তিনি বলেছন।
মিরজাফর বলেন, অনেক কিছুই হতে পারে। তাঁরা নিজেরাই তো দিনকে রাত করে তুলেছেন। তাদের চক্রান্তে নবাবের মীর মুন্সি আসল চিঠি গায়েব করে নকল চিঠি পাঠাচ্ছে কোম্পানির কাছে, তাতেই তারা অত সহজে ক্ষেপে উঠেছে। বুদ্ধিটা অবশ্যি রাজবল­ভের, কিন্তু নবাবের বিশ্বাসী মীর মুন্সি অসামান্য দায়িত্ব ও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে এটাও একবার ভেবে দেখা উচিত। জগৎশেঠের মতে, গুপ্তচরের সাহায্য ছাড়া তাঁরা এক পাও এগোতে পারতেন না।
মিরজাফর জানিয়ে দেন প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে তাঁর মনে একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি ভাবছেন ইংরেজের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে কি না। রাজবল­ভ তাঁর কথায় সায় দেন। তাঁর মতে ইংরেজরা বেনিয়ার জাত, পয়সা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ওরা জানে নবাবের কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধার আশা তাদের নেই; তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা সিপাহসালারকে মসনদে বসাবার জন্যে সব রকম সাহায্যই দেবে। জগৎশেঠ টাকার লোক। তিনি বলেন, ইংরেজ সব রকমের সাহায্য দেবে বটে, কিন্তু টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। সিরাজকে গদিচ্যুত করা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজন, তবুও সিপাহ্সালারকে তারা সাহায্য দেবে নগদ টাকার বিনিময়ে।
রাজবল­ভের মতে, ইংরেজের প্রবল অর্থলোভও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি যতদূর শুনেছেন ইংরেজের দাবি দু’কোটি টাকার ওপরে যাবে। এত টাকা নবাবের তহবিল থেকে কিছুতেই পাওয়া যাবে না।
মিরজাফর রাজবল­ভকে জানিয়ে দেন, তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে পড়েছেন, তখন আর ও-কথা ভাববার সময় নেই, উপায়ও নেই। তাঁদের সবার স্বার্থেই ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আবেগে বিভোর হয়ে বলেন যে, স্বপ্ন তাঁর সফল করতেই হবে। বাংলার মসনদ নবাব আলিবর্দীর আমলে, উদ্ধত সিরাজের আমলে, মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু এই একটি কথাই ভেবেছেন একটি দিন, শুধুমাত্র একটি দিনও যদি তিনি সে মসনদে বসতে পারেন, তবেই তাঁর জীবনের স্বপ্ন সফল হবে।
মিরজাফরের স্বপ্ন-সাধের একমাত্র প্রতিবন্ধক সিরাজ। তরুণ নবাবকে সরিয়ে সে মসনদ দখল করতে হবে। তার জন্যে যে-কোনো মূল্য দিতে মিরজাফর প্রস্তুত।
আবেগের আতিশয্যে মিরজাফর তাঁর অন্তরের গোপন কামনাকে সুস্পষ্টভাবে ও ভাষায় ব্যক্ত করেন। বাংলার স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ, কোরান হাতে নিয়ে প্রকাশ্য দরবারে শপথ গ্রহণ, নবাবের প্রতি কর্তব্য সবকিছু ভুলে মিরজাফর তখন বাংলার মসনদের লোভে উন্মাদ, দৃঢ়সঙ্কল্প।
দ্বিতীয় অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ৯ জুন। মিরনের আবাসগৃহ। ফরাসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে অর্ধশায়িত মিরন। নর্তকীর হাতে ডান হাত সমর্পিত। অপর নর্তকী নৃত্যরতা। নৃত্যের মাঝেমাঝে সুরামত্ত মিরনের উল­াসধ্বনি। সে বলে নর্তকীরা আছে বলেই সে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে তার ভালো লাগছে। নৃত্যরতা নর্তকী এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দেয় মিরনের দিকে। পরিচারিকা এসে একটা চিঠি দেয় মিরনের হাতে। চিঠি পড়ে বিরক্ত হয় সে। পাশে-বসা নর্তকী তার ইঙ্গিতে উঠে যায় কামরার অন্যদিকে। ছদ্মবেশধারী এক ব্যক্তিকে পৌঁছে দিয়ে পরিচারিকা নিষ্ক্রান্ত হয়। মিরন বলে যে, সেনাপতি রায়দুর্লভ আসবেন তা সে ভাবেনি। তার ইঙ্গিতে নর্তকীরা চলে যেতে উদ্যত হয়। রায়দুর্লভ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, মিরন তাঁকে নৃত্যগীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত বলেই ধরে নিয়েছে। মিরন প্রতিবাদ করে বলে যে, রায়দুর্লভ যখন ছদ্মবেশে এসে হাজির হয়েছেন তখনি সে বুঝেছে যে, প্রয়োজনটা জরুরি; তাই সে চায় না সময় নষ্ট করতে।
রায়দুর্লভ একটি নর্তকীকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন তাকে সে কোথায় পেয়েছে। তিনি বলেন, তাকে যেন আগেও কোথায় দেখেছেন। হঠাৎ মিরনের ওখানে বৈঠকের কথা হয়েছে শুনে তিনি এসেছেন। মিরন বলে, মোহনলালের গুপ্তচর তাদের জীবন অসম্ভব করে তুলেছে, তাই তার বাসগৃহেই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। মোহনলাল জানেন, মিরন নাচগানে মশগুল থাকতেই ভালোবাসে। বৈঠকে প্রয়োজনীয় সবাই আসবেন, আর আসবেন কোম্পানির একজন প্রতিনিধি। প্রতিনিধি আসবেন কাশিমবাজার থেকে।
রায়দুর্লভ জানান, তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না। তার পক্ষে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কখন কোন কাজে নবাব তলব করে বসবেন তার ঠিক নেই। তলবের সঙ্গে সঙ্গে হাজির না হলে সন্দেহ করবেন তিনি। তাই আগে-ভাগে জানতে এসেছেন, তাঁর সম্বন্ধে তাঁরা কি ব্যবস্থা করছেন। মিরন প্রত্যুত্তরে জানাল, রায়দুর্লভ সম্বন্ধে ব্যবস্থাটা পাকা করা হয়েছে; সিরাজের পতন হলে মসনদে বসবেন তার আব্বা আর রায়দুর্লভ হবেন প্রধান সেনাপতি।
রায়দুর্লভ বলেন যে, তাঁর দাবিটাও তাই, তবে চারদিকের অবস্থা দেখে যদি তিনি বোঝেন যে, তাঁদের সাফল্যের কোনো আশা নেই তখন যেন তাঁরা তাঁর সহায়তার আশা ছেড়ে দেন। মিরন বিস্মিত হয়; বলে, রায়দুর্লভকে যেন কিছুটা আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। রায়দুর্লভ বলেন, তিনি আতঙ্কিত নন, তবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। চারদিকে শুধু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র, তার মধ্যে তিনি কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না।
পরিচারিকা খরব দেয় যে, মেহমানেরা সবাই এসে পড়েছেন। মিরনের অনুরোধ সত্তে¡ও রায়দুর্লভ সরে পড়েন। যাবার সময় বলে যান যে, তাঁর সম্পর্কিত ওয়াদার যেন খেলাপ না হয়। কামরায় প্রবেশ করেন রাজবল­ভ, জগৎশেঠ আর মিরজাফর। মিরন জানায়, একটু আগে রায়দুর্লভ এসেছিলেন; ব্যক্তিগত কারণে তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না বলে গেছেন, তবে তাঁর দাবিটা খোলাখুলি বলে গেছেন।
রাজবল­ভ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, সবাই উচ্চাভিলাষী। রায়দুর্লভ চান প্রধান সেনাপতির পদ, অথচ তিনি রাজবল­ভের কাছ থেকে মাসে মাসে যে বেতন পাচ্ছেন তাতেই তাঁর হাতে স্বর্গ পাবার কথা। মিরজাফর রাজাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, সবাইকে একজোটে কাজ করতে হবে, মানতে হবে সবার দাবি। রায়দুর্লভের মতো ক্ষুদ্র শক্তিধরের সাহায্যেই তাঁরা জিতবেন, এমন কথা নয়; তবে প্রয়োজনের সময় নবাবের সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্ব প্রচুর।
ঠিক সেই সময় পরিচারিকা এসে জানায়, জানানা সওয়ারি এসেছে। শুনে সবাই একটু বিব্রত হয়ে পড়েন। মিরজাফর পকেট থেকে কয়েক টুকরা কাগজ বের করে তাতে মন দেন। মিরন লজ্জিত হয়। হঠাৎ আত্মসংবরণ করে ধমক দিয়ে পরিচারিকাকে তাড়িয়ে দেয়। রাজবল­ভের মুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। তাঁর ইঙ্গিতে মিরন বেরিয়ে যায়। তিনি নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করে বলেন সেদিনকার আলোচনায় উমিচাঁদের অনুপস্থিতিতে কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়। মিরজাফর হঠাৎ খেই ধরে বলেন, উমিচাঁদ আস্ত কাল কেউটে; তার দাবি আগে না মেটালে সে পরদিনই নবাব দরবারে সব খবর ফাঁস করে দেবে। মিরন জানানাবেশী ক্লাইভ আর ওয়াটসকে নিয়ে প্রবেশ করে। মিরজাফরকে অবাক হতে দেখে ক্লাইভ কারণ জিজ্ঞেস করেন। মিরজাফর বলেন, তাঁদের ওভাবে সেখানে আসাটা বিপজ্জনক। ক্লাইভ তাঁকে ও জগৎশেঠকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি নবাবকে ভয় করেন না; নবাব তাঁর কিছুই করতে পারবেন না। রাজবল­ভ বলেন, গাল ফুলিয়ে বড়ো বড়ো কথা বললেই হয় না। ক্লাইভ সেখানে একাকী এসেছেন, তাঁকে ধরে বস্তাবন্দি করে হুলো-বেড়ালের মতো পানাপুকুরে নিয়ে দুচারটে চুবুনি দিতে বাদশাহের ফরমানের দরকার হবে না। ক্লাইভ বলেন যে, তিনি রাজার কথা বুঝতে পারছেন না; নবাব তাঁদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবেন না।
ক্লাইভের মতে, নবাবের ক্ষমতা নেই। যাঁর প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক, যাঁর খাজাঞ্চি, দেওয়ান, আমির-ওমরাহ্ সবাই প্রতারক, তাঁর কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। তবে রাজবল­ভরা ইচ্ছে করলে ইংরেজদের ক্ষতি করতে পারেন; কারণ তারা সব পারেন। সেদিন তারা নবাবকে ডোবাচ্ছেন, পরদিন যে তারা কোম্পানিকে পথে বসাবেন না তা বিশ্বাস করা যায় না। ইংরেজরা বরং নবাবকে বিশ্বাস করতে পারে।
মিরজাফর তাঁদের সভার উদ্দেশ্যের কথা উত্থাপন করলে ক্লাইভ বলেন, একটা জরুরি কথা প্রথমে সেরে নেয়া দরকার। তাঁর মতে, উমিচাঁদ সে-যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক। ইংরেজদের মনের কথা সে নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। কলকাতা আক্রমণের সময় উমিচাঁদের যে ক্ষতি হয়েছে নবাব তা পুষিয়ে দিতে চেয়েছেন। বদমাসটা তাদের কাছে এসেছে আবার একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে। মিরজাফর শুনেছেন, সে আরো ত্রিশ লক্ষ টাকা চায়। ক্লাইভের মতে তাকে অত টাকা দেবার ক্ষমতা তাদের নেই; আর ক্ষমতা থাকলেও তাকে অতগুলো টাকা দেবার কোনো যুক্তি নেই। রাজবল­ভ বলেন, উমিচাঁদ যেমন ধড়িবাজ তাতে সে অন্যরকম ষড়যন্ত্র করতে পারে। যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁদের যাবতীয় গোপন খবরই তার জানা। ক্লাইভ রাজবল­ভকে আশ্বস্ত করে বলেন, উমিচাঁদ অনেক বুদ্ধি রাখে, কিন্তু ক্লাইভও তার চেয়ে কম বুদ্ধি রাখে না। তিনি উমিচাঁদকে ঠকাবার ব্যবস্থা করেছেন। দুটো দলিল হবে; আসল দলিলে উমিচাঁদের কোনো উলে­খ থাকবে না। নকল দলিলে লেখা থাকবে, নবাব হেরে গেলে কোম্পানি তাকে ত্রিশ লাখ টাকা দেবে।
উমিচাঁদকে ঠকাবার যে ব্যবস্থা ক্লাইভ করেছেন তা মিরজাফর, রাজবল­ভ প্রমুখ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না। তারা যদি তা ফাঁস করে না দেন তবে তা কখনো প্রকাশ পাবে না। উমিচাঁদ যদি একথা জানে, তবে বুঝতে হবে তাঁরাই তাকে তা জানিয়েছেন। জগৎশেঠ ক্লাইভকে নিশ্চয়তা দেন যে, তাঁরা তা কখনো উমিচাঁদকে জানাবেন না।
ক্লাইভ বলেন যে, দলিলে কমিটির সবাই সই করেছেন, শুধু মিরজাফরই তখনো সই করেন নি। একটা নির্দিষ্ট স্থানে সই করবেন মিরজাফর; রাজবল­ভ আর জগৎশেঠ হবেন সাক্ষী। দলিলে লেখা ছিল যুদ্ধে সিরাজের পতন হলে কোম্পানি পাবে এক কোটি টাকা, কলকাতার বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণ পাবে সত্তর লাখ টাকা, ক্লাইভ পাবেন দশ লাখ টাকা ইত্যাদি। সন্ধির শর্ত অনুসারে সিপাহ্সালার নামকাওয়াস্তে মসনদে বসবেন, কিন্তু রাজ্য চালাবে কোম্পানি কথাটা বলেন রাজবল­ভ। ক্লাইভ চঞ্চল হয়ে ওঠেন, মিরজাফর ইতস্তত করেন। কিন্তু তিনি ভাবেন, এমনিতেই বাজারে নানা গুজব রটেছে, সিরাজ যে-কোনো মুহূর্তে সবাইকে গারদে পুরে দিতে পারেন। তাই তিনি কম্পিত বক্ষে দলিলে সই করতে যান; কিন্তু মনের দ্বিধা তার কাটে না। ভাবেন, রাজবল­ভ যেমন বললেন, তারা সবাই মিলে বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছেন না তো! ক্লাইভ মিরজাফরকে কাপুরুষ বলেই জানেন। তার মতে, কাপুরুষদের ওপর কোনো কাজেই ভরসা করা যায় না। তাই তিনি দলিল সই করাতে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নিজেই এসেছেন, ওয়াট্সকে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন নি। তিনি মিরজাফরকে বুঝিয়ে বলেন, নবাব হেরে গেলে বাংলা মিরজাফরদেরই থাকবে। কোম্পানি রাজা হতে চায় না; চায় টাকা। তাদের কোনো ভয় নেই। তারা দেশের জন্যেই দেশের নবাবকে সরিয়ে দিচ্ছেন। নবাব থাকলে দেশের কল্যাণ হবে না।
ক্লাইভের কথায় মিরজাফর অনুপ্রাণিত হন। তিনি দলিলে সই করেন। বলেন, ক্লাইভ ঠিকই বলেছেন, কারণ নবাব তাদের সম্মান দেন না। জগৎশেঠ আর রাজবল­ভও সই করেন দলিলে। ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত হয়। দলিল ভাঁজ করতে করতে ক্লাইভ বলেন, তারা এমন কিছু করেছেন, যা একদিন ইতিহাস হবে। ক্লাইভ, ওয়াট্স রমণীর ছদ্মবেশ পরার পর সবাই বেরিয়ে গেলে প্রবেশ করে মিরন। সে পরিচারিকাকে সোল­াসে বলে, পরদিন যুদ্ধ। তারপরে শাহজাদা মিরন, তারপর একদিন বাংলার নবাব। একটু পরে এসে পড়েন সেনাপতি মোহনলান। মিরন তাঁকে জলসা-ঘরে প্রবেশ করেছেন বলে দোষারোপ করে। মোহনলাল মিরনকে জিজ্ঞেস করেন, সেখানে প্রচণ্ড ষড়যন্ত্র হ্িচ্ছল কিনা। শুনে মিরন যেন আকাশ থেকে পড়ে; বলে মোহনলাল তার পিতার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। নবাবের সাথে তার পিতার সব গোলমাল প্রকাশ্যভাবে মিটে গেছে; নবাব তাঁকে সৈন্য পরিচালনার ভার দিয়েছেন। এ অপবাদের বিচারপ্রার্থী হয়ে সে তখনই পিতাকে নিয়ে নবাবের কাছে যাবে।
মোহননলাল তরবারি কোষমুক্ত করে মিরনকে বলেন, সে যেন প্রতারণার চেষ্টা না করে। তিনি মিরনকে সতর্ক করে দিয়ে জানান, তাঁর গুপ্তচর কখনো ভুল সংবাদ দেয় না। তিনি জানতে চান, সেখানে কি হচ্ছিল, কে, কে ছিল সে মন্ত্রণা-সভায়। মিরন উত্তর দেয়, মন্ত্রণাসভা হচ্ছিল কিনা, হলেও কোথায় হচ্ছিল সে তার কিছুই জানে না। ওসব বাজে কাজে সময় কাটানোর স্বভাব তার নেই। সে নর্তকীকে ডেকে আবার জলসার আয়োজন করে। সে মালা হাতে নাচের ভঙ্গিতে মোহনলালের দিকে এগিয়ে যায়। মোহনলাল তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে মালাটি শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে তরবারির দ্বিতীয় আঘাতে তা শূন্যেই দ্বিখণ্ডিত করে নিষ্ক্রান্ত হন।
তৃতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৭৫৭ সালের ১০ জুন থেকে ২১ জুনের মধ্যে যে কোনো একটা রাত। স্থান লুৎফুন্নেসার কক্ষ। লুৎফুন্নেসা ও আমিনা বেগম উপবিষ্ট। ঘসেটি বেগম প্রবেশ করে শ্লেষবিজড়িত কণ্ঠে বলেন যে, রাজ-মাতা আমিনা বেগম বড়ো সুখে আছেন। লুৎফুন্নেসা সাদর সম্ভাষণ জানান তাঁর খালা শাশুড়িকে। ঘসেটি বলেন, সুখী ও সৌভাগ্যবতী হবার দোয়া করলে তা তার জন্যে অভিশাপ বয়ে আনবে। আমিনা বেগম বড় বোনকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানান কাছে গিয়ে বসতে। ঘসেটি বেগম শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, তিনি বসতে অসেননি, এসেছেন কত সুখে আছেন বোন আমিনা বেগম পুত্র নবাব, পুত্রবধূ নবাব-বেগম শ্লেষপূর্ণ শাহজাদীকে নিয়ে তা দেখতে। আমিনা বাধা দিয়ে বলেন, সিরাজ তো তাঁরও পুত্র, তিনিও তো তাঁকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। ঘসেটি আক্ষেপ করেন। বলেন, অদৃষ্টের পরিহাসে তিনি ভুল করেছিলেন। তিনি তখন জানতেন না যে সিরাজ বড়ো হয়ে একদিন তাঁর সুখের অন্তরায় হবে, অহরহ তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জানলে সেদিন দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতেন না। লুৎফা বলেন, তাঁরা ঘসেটি বেগমকে মায়ের মতো ভালোবাসেন, মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করেন।
ঘসেটি প্রতিবাদের সুরে বলেন, যিনি তাঁদের সত্যিকার মা তাঁকে নিয়ে তাঁরা চাঁদের হাট বসিয়েছেন। লুৎফুন্নেসা তাঁকে পরিহাস করছেন। তিনি দরিদ্র রমণী, নিজের সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নবাব সে অধিকারটুকুও তাঁকে দেন নি। ঘসেটির কথায় আমিনা বেগম বিরক্ত হন। তিনি বলেন, পুত্রবধূর সামনে তার এমন রূঢ় ব্যবহার অশোভন। ঘসেটি জবাবে বলেন যে, কেউ তাঁর পুত্র বা পুত্রবধূ নন। সিরাজ বাংলার নবাব, আর তিনি তাঁর প্রজা। সিরাজ ক্ষমতার অহঙ্কারে উন্মত্ত, তা না হলে তিনি তাঁর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করতেন না, মতিঝিল থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে পারতেন না।
লুৎফুন্নেসা বলেন, তিনি শুনেছেন নবাব ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন কলকাতা অভিযানের সময় তাঁর টাকার প্রয়োজন হয়েছিল বলে এবং গোলমাল মিটে গেলে তিনি তার টাকা ফেরত দেবেন বলে। ঘসেটি কথাটা বিশ্বাস করেন না। লুৎফুন্নেসা বলেন, সে টাকা ফেরত না দেবার কোনো কারণ নেই। নবাব সে টাকা ব্যয় করেছেন দেশের প্রয়োজনে। ঘসেটি ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি সিরাজকে বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছেন, কিন্তু তার সম্বন্ধে লুৎফুন্নেসার মুখে বড়ো কথা শুনলে গায়ে তার জ্বালা ধরে যায়। আমিনা বলেন, সিরাজ তার কোনো ক্ষতি করেন নি। কিন্তু ঘসেটি বলেন, তাঁর নবাব হওয়াটাই তাঁর ক্ষতি। আমিনা দুঃখিত হন। তিনি বলেন, তাঁর বড়ো আপা অনর্থক বিষ উদ্গীরণ করে চলেছেন; তাঁর এমন ব্যবহারের অর্থ তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।
সিরাজ ঘরে ঢুকে খালাকে বলেন, তিনি একটা দিনও সুখে নবাবী করেন নি। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে খালাম্মার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তাঁর আরো কিছু টাকার দরকার। তিনি জানেন, বাংলার ভাগ্য নিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা চলছে তার সব খবরই ঘসেটি বেগম জানেন। সিরাজকে দেখে, বিশেষ করে তিনি টাকা চাইতে এসেছেন বলে ঘসেটি তাঁকে শয়তান বলে, অত্যাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে খালাম্মার আক্রোশ নয়, তাঁর খালাম্মা রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের উন্মাদিনী। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন খালাম্মার সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করতে তাঁকে যেন বাধ্য করা না হয়। ঘসেটিও তাঁকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, তাঁর চোখে রাঙানোর স্পর্ধা আর বেশি দিন থাকবে না। উত্তরে সিরাজ বলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ ভেবে তাঁর খালাম্মার উৎকন্ঠিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। সিরাজ তাকে তার নিজের সম্বন্ধে সতর্ক করে দেন। তিনি তাঁর খালাম্মাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নবাবের মাতৃস্থানীয় হয়ে তাকে শত্র“দের সাথে যোগাযোগ রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। অন্তত সিরাজ তাকে সে দুর্নাম থেকে রক্ষা করতে চান। ঘসেটি বলেন নবাবের মতলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। নবাব তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময় কোনো ক্ষমতাভিলাষী স্বার্থপরায়ণ রমণীর পক্ষে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দেশের পক্ষে অকল্যাণকর; তিনি তাই তাঁর গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখার ব্যবস্থা করেছেন। নবাবের প্রাসাদে ঘসেটির স্বাধীনতার ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, তবে লক্ষ রাখা হবে যাতে দেশের তৎকালীন অশান্তি দূর হবার আগে বাইরের কারও সাথে তিনি কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারেন।
ঘসেটি বুঝতে পারেন নবাবের উদ্দেশ্য ও মতলব। তিনি নবাব জননীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বিরক্ত হয়ে তাঁকে বলেন, নবাব তাঁকে বন্দিনী করেছেন। এবার আমিনা তা বুঝতে পেরেছেন তিনি নবাবের কেমন মা আর নবাব ঘসেটির কেমন পুত্র। এই বলে তিনি সরোষে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে যান। আমিনা বেগমও তাঁর বড়ো আপাকে ডাকতে ডাকতে তাঁর পেছনে পেছনে বেরিয়ে যান।
লুৎফুন্নেসা নবাবকে বলেন, খাল­াম্মা বড়ো বেশি অপমান বোধ করছেন। তাঁর সাথে নবাবের অমন ব্যবহার করাটা হয়তো উচিত হয় নি। নবাব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, তাঁর ব্যবহারে সবাই অপমান বোধ করেছেন, শুধু তাঁর নিজেরই কোনো অপমান নেই। তিনি বলেন, তাঁর জীবন-সঙ্গিনী লুৎফুন্নেসাও যদি অমন অন্ধ হন তবে তিনি আশ্রয় পাবেন না কোথাও। তিনি বেগমকে বলেন, তিনি দেখতে পাচ্ছেন না শুধু অপমানই নয় নবাবকে ধ্বংস করার জন্যে সবাই কেমন মেতে উঠেছে। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে খালাম্মাই খুশি হবেন সবচেয়ে বেশি। খালাম্মা তাঁর নিজের বোনের ছেলের ধ্বংস করতে চান কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন বলেই মনে করেন লুৎফুন্নেসা। তবে তিনি নবাবকে বলেন, খালাম্মার মন যে তার ওপর যথেষ্ট বিষিয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। অত্যন্ত সংকোচের সাথে তিনি স্বামীকে বলেন, খালাম্মা বিধবা মেয়ে মানুষ, তাঁর সম্পত্তিতে নবাব বার বার অমন হস্তক্ষেপ করতে থাকলে ভরসা নষ্ট হবারই কথা। লুৎফুন্নেসা তাঁর কাজের সমালোচনা করছেন দেখে নবাব ক্ষুব্ধ হন। লুৎফুন্নেসা কৈফিয়তের সুরে বলেন, তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার জন্যে কোনো কথা বলেননি। খালাম্মা রেগে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন, তাই তিনি ও কথা বলেছেন। নবাব তাঁকে বাধা দিয়ে অভিমান-ক্ষব্ধু কণ্ঠে বলেন, তাই বুঝি লুৎফার মনে হলো, নবাব তাঁর টাকা-পয়সায় হাত দিয়েছেন বলেই তিনি নবাবের ওপর অতখানি বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু লুৎফুন্নেসা জানেন না, কতোখানি উৎসাহ নিয়ে তিনি শওকতজঙ্গের সফলতার জন্যে অজস্র অর্থ ব্যয় করেছেন। শুধু শওকতজঙ্গ নয়, নবাবের শত্র“দের শক্তিবৃদ্ধির জন্যেও ঘসেটি বেগমের দান কম নয়।
লুৎফুন্নেসা নিজের ভুল বুঝতে পেরে নবাবের কাছে ক্ষমা চান। নবাব তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর চারপাশে অতো দেয়াল কেন? উজির, অমাত্য সেনাপতিদের এবং তাঁর মাঝখানে দেয়াল, দেশের নিশ্চিন্ত শাসন-ব্যবস্থা এবং নবাবের মাঝখানে দেয়াল, খালাম্মা আর তাঁর মাঝখানে দেয়াল, দেয়াল তাঁর চিন্তা আর কাজের মাঝখানে, তাঁর স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে, তাঁর অদৃষ্ট আর কল্যাণের মাঝখানে শুধু দেয়াল আর দেয়াল। তিনি সে-সব দেয়ালের কোনোটি ডিঙিয়ে যাচ্ছেন, কোনোটি ভেঙে ফেলছেন, কিন্তু তবু দেয়ালের শেষ হচ্ছে না। মসনদে বসার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত যেন দু’পায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তিনি লুৎফুন্নেসার কথায় সায় দিয়ে বলেন, সত্যিই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
লুৎফুন্নেসা তাঁকে সব দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁর কাছে দু’একদিন বিশ্রাম নিতে বলায় নবাব বলেন, কবে যে তিনি দু’দণ্ড বিশ্রাম পাবেন তার ঠিক নেই; আবারও তাঁকে যেতে হচ্ছে যুদ্ধে। শুনে লুৎফুন্নেসা ভীত হন। নবাব বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোম্পানির আয়োজন সম্পূর্ণ। তিনি এগিয়ে গিয়ে বাধা না দিলে তারা সরাসরি রাজধানী আক্রমণ করবে। তাদের সাথে আলীনগরে যে সন্ধি হয়েছিল সে সন্ধি এক মাস না যেতেই তারা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। আর বিদেশি বেনিয়াদের অতদূর স্পর্ধা হয়েছে তাঁর ঘরের লোক অবিশ্বাসী হয়েছে বলেই। তিনি শুধু একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারছেন না, ধর্মের নামে ওয়াদা করে মিরজাফর, রাজবল­ভেরা কি করে সে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। তাঁদের কাছে স্বার্থ কি ধর্মের চেয়েও বড়ো?
লুৎফুন্নেসার প্রশ্নের উত্তরে নবাব তাঁকে জানান যে, ওসব ষড়যন্ত্রের কোনো প্রতিকার করতে পারেন নি। তিনি চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ভরসা পাননি। রাজবল­ভ, জগৎশেঠকে কয়েদ করলে, মিরজাফরকে ফাঁসি দিলে হয়তো প্রতিকার হতো, কিন্তু সেনাবাহিনী তা বরদাস্ত করতো কিনা তা অনিশ্চিত।
লুৎফুন্নেসা নবাবের সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে ব্যাকুলভাবে প্রস্তাব করেন সেদিন নবাব যেন তাঁর কাছে বিশ্রাম নেন, শুধু তিনি আর নবাব থাকবেন, আর কেউ না। নবাব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, তেমন একটা বিশ্রামের কথা অনেক সময় তিনি নিজেও ভেবেছেন। তিনি বেগমের কাছে বহুদিন আসতে পারেননি। তাঁদের মাঝখানে একটা রাজত্বের দেয়াল। মাঝে মাঝে তিনি কামনা করেছেন বাধাটা দূর হয়ে যাক। তাহলে নিশ্চিন্ত সাধারণ গৃহস্থের ছোট্ট সাজানো সংসার তাঁরা পেতেন। মোহনলালের কাছ থেকে খবর এলে সিরাজ লুৎফুন্নেসার বাধা না মেনে বেরিয়ে যান।
তৃতীয় অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ২২ জুন। পলাশীতে সিরাজের শিবির। গভীর রাতে চিন্তাক্লিষ্ট নবাব পায়চারী করেছেন। দূর থেকে ভেসে আসছে শৃগালের প্রহর ঘোষণার শব্দ। নবাব বলেন, রাতের দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। ঘুম নেই শুধু শেয়াল আর সিরাজের চোখে। ভেবে তিনি অবাক হয়ে যান........।
মোহনলাল এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ান। তিনি মোহনলালকে বলেন, সত্যিই তিনি ভেবে অবাক হয়ে যান। তিনি শুনেছেন ইংরেজ সভ্য জাতি। তারা শৃঙ্খলা জানে, শাসন মেনে চলে, কিন্তু পলাশীতে তারা যা করছে, সেতো স্পষ্ট রাজদ্রোহ, একটা দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরেছে, ভেবে তিনি অবাক হন।
মোহনলাল নবাবকে জানান, ইংরেজের পক্ষে মোট সৈন্য তিন হাজারের বেশি হবে না। তারা অবশ্যি অস্ত্র চালনায় সুশিক্ষিত। নবাবের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। ছোটবড়ো মিলে ইংরেজের কামান হবে গোটা দশেক, আর নবাবের কামান পঞ্চাশটার অধিক। মোহনলাল বলেন, তাঁর সব সৈন্য লড়বে কিনা, সব কামান গোল বর্ষণ করবে কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন। মোহনলালের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে নবাব বলেন, তিনিও তেমন একটা আশঙ্কা করছেন। মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ নিজ নিজ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে, তাঁরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বেন।
মোহনলাল বলেন, মিরজাফরের আর একখানা পত্র ধরা পড়েছে। তিনি পত্রখানা নবাবের হাতে দেন। চিঠি পড়ে নবাবের মুখে উচ্চারিত হয় ‘বেঈমান’। মোহনলাল বলেন, ক্লাইভেরও তিনখানা পত্র ধরা পড়েছে। সে মিরজাফরের জবাবের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে বেলে মনে হয়। সিরাজ বলেন, সাংঘাতিক লোক ক্লাইভ। মতলব হাসিল করবার জন্যে সে যে-কোনো অবস্থার ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কাছে সবকিছুই যেন একটা বড়ো রকমের জুয়াখেলা। মিরমর্দান প্রবেশ করে বলেন, ইংরেজ সৈন্য লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। ক্লাইভ আর তার সেনাপতিরা উঠেছে গঙ্গাতীরের ছোট বাড়িটায়। সেখান থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে।
নবাব জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের ফৌজ সাজাবার আয়োজন শেষ হয়েছে কিনা। একটা প্রকাণ্ড নকশা নবাবের সামনে মেলে ধরে মিরমর্দান বলেন, তাঁরা সব গুছিয়ে ফেলেছেন। নবাবের ছাউনির সামনে গড়বন্দি হয়েছে, ছাউনীর সামনে মোহনলাল, সাঁফ্রে আর তিনি নিজে। আর ডানদিকে গঙ্গার ধারে ঢিপিটার ওপরে একদল পদাতিক তাঁর জামাতা বদ্রী আলী খাঁর অধীনে যুদ্ধ করবে। তাদের ডান পাশে গঙ্গার দিকে একটু এগিয়ে নৌবেসিং হাজারীর বাহিনী। বাঁ-দিক দিয়ে লক্ষবাগ পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকারে সেপাই সাজিয়েছেন সিপাহ্সালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁ।
নকশার কাছ থেকে সরে এসে নবাব পায়চারী করে বলেন, তাঁর শক্তিটা কত বড়ো অথচ কতই না তুচ্ছ। তিনি ভাবছেন অঙ্কের হিসেবে শত্র“র যেন সুবিধের পাল­াটা ভারি হয়ে উঠেছে। মিরমর্দান বলেন, ইংরেজকে ঘায়েল করতে সাঁফ্রে, মোহনলাল আর তিনিই যথেষ্ট। সিরাজ তাঁকে বলেন, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তিনি জানেন, তাঁদের বাহিনীতে পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার আর আট হাজার পদাতিক সৈন্য রয়েছে আর তারা জান দিয়ে লড়বে, কিন্তু মিরজাফরদের বাহিনী সাজিয়েছে দূর লক্ষবাগের অর্ধেকটা ঘিরে। যুদ্ধে মিরমর্দানেরা হারতে থাকলে তারা দু’কদম এগিয়ে ক্লাইভের সাথে হাত মেলাবে বিনা বাধায়, আর তাঁরা যদি না হারেন তবে মিরজাফরদের সৈন্যরা যে তাদের ওপর গুলি চালাবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তবু তিনি ওদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন; কারণ তাদের চোখে চোখে না রাখলে তারা সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী দখল করতো। মিরমর্দান নবাবকে ভরসা দিয়ে বলেন, তাদের জীবন থাকতে নবাবের কোনো ক্ষতি হবে না। নবাব বলেন, সে কথা জানেন বলেই আরো বেশি করে ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভাবছেন, তাদের প্রাণ বিপন্ন হবে অথচ স্বাধীনতা রক্ষা হবে না এ চিন্তাটাই বেশি পীড়াদায়ক।
মিরমর্দান নবাবকে আশ্বাস দেন, তাঁদের জয় হবে। সিরাজ বলেন, পরাজয়ের কথা তিনিও ভাবছেন না, তিনি শুধু অশুভ সম্ভাবনাগুলো শেষবারের মতো খুঁটিয়ে দেখছেন। পরদিন যুদ্ধ করবে মিরমর্দানেরা অথচ হুকুম দেবেন মিরজাফর। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এড়াবার জন্যে যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব সিপাহ্সালারকে দিতেই হবে। তার ফল কি হবে কেউ তা জানে না। নবাব কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না এবং কেন পারছেন না তা মিরমর্দান বুঝেছেন বলেই তিনি আশা করেন।
নবাব বলেন, সেনাবাহিনীর শক্তির ওপর নয়, তাঁর একমাত্র ভরসা পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁর যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সে সম্ভাবনাটুকুর ওপর।
রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। সিরাজ সবাইকে বিশ্রামের জন্যে বিদায় দিয়ে পায়চারী করেন। সোরাহী থেকে পানি ঢেলে খান। তারপর রেহেলে রাখা কোরআন শরীফের কাছে গিয়ে জায়নামাজে বসেন। কোরআন শরীফ তুলে ওষ্ঠে ঠেকিয়ে রেহেলের ওপর রেখে পড়তে থাকেন। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। শুনে কোরআন শরীফ মুড়ে রাখেন তিনি। ‘আস্সালাতো খায়রুম মিনান্নাওম’; এরপর মোনাজাত করেন। হঠাৎ সুতীব্র তুর্যনাদ নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দেয়।
তৃতীয় অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ২৩ জুন। পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র। সিরাজ নিজের তাঁবুতে পায়চারী করেছেন। প্রহরী এসে জানায় যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ইংরেজ ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্যরা যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মিরমর্দান আর মোহনলাল সসৈন্যে পশ্চাদ্ধাবন করে লক্ষবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় সৈনিক এসে জানায় যে, সেনাপতি নৌবেসিং হাজারী ঘায়েল হয়েছেন। তৃতীয় সৈনিক এসে বলে, একটু আগে যে বৃষ্টি হয়েছিল তাতে ভিজে নবাবের বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। সেনাপতি মিরমর্দান তাই কামানের অপেক্ষা না করে হাতে হাতে লড়বার জন্যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন। শত্র“দের সময় দিতে চান না বলেই তিনি শুধু তলোয়ার নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন।
দ্রুত সৈনিক এসে খবর দেয় সেনাপতি বদ্রী আলী খাঁ নিহত। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ। সিরাজ বলেন, মিরমর্দান ও মোহনলাল রয়েছেন কোনো ভয় নেই।
হঠাৎ সাঁফ্রে প্রবেশ করে উৎকণ্ঠিত নবাবকে বলেন, নবাব সৈন্যের তখন পর্যন্ত পরাজয় না হলেও যুদ্ধের অবস্থা তাঁদের জন্যে খারাপ হয়ে উঠেছে। সিরাজ তাঁকে রণক্ষেত্রে যেয়ে যুদ্ধ করতে ও জয়ী হতে নির্দেশ দেন। সাঁফ্রে বলেন, তিনি তো ফ্রান্সের শত্র“দের বিরুদ্ধে লড়ছেন। প্রয়োজন হলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেবেন, কিন্তু নবাবের বিরাট সেনাবাহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজ দৃঢ়তায় সাথে বলেন, মিরজাফর, রায়দুর্লভদের বাদ দিয়েও সাঁফ্রে, মিরমর্দান প্রমুখ যুদ্ধে জিতবেন। তিনি জানেন, জয় হবেই।
সাঁফ্রে জানান, তাদের গোলার আঘাতে কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময় এলো বৃষ্টি এবং হঠাৎ জাফর আলী খাঁ হুকুম দিলেন তখন যুদ্ধ হবে না। মোহনলাল যুদ্ধ বন্ধ করতে চান নি, কিন্তু সিপাহসালরের আদেশ পেয়ে পরিশ্রান্ত সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে শিবিরে ফিরতে থাকে। সুযোগ পেয়ে কিলপ্যাট্রিক তখনি তাদের আক্রমণ করে। মিরমর্দান তাদের বাধা দিচ্ছেন, কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। তাঁকে এগুতে হচ্ছে কামান ছাড়া। এমন সময় সৈনিক খরব দেয় সেনাপতি মিরমর্দান নিহত হয়েছেন। সাঁফ্রে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আচ্ছন্নের মতো সিরাজ বলেন, সেনাপতি মিরমর্দানের পতন হয়েছে। সাঁফ্রে বলেন, ‘ঞযব নৎধাবংঃ ংড়ষফরবৎ রং ফবধফ’. তিনি চলে যান এবং কথা দিয়ে যান ফরাসিরা প্রাণপণে লড়বে। সিরাজ বলেন, সাঁফ্রে ঠিকই বলেছেন শ্রেষ্ঠ সৈনিকের পতন হয়েছে। নৌবেসিং, বদ্রী আলী, মিরমর্দান নিহত। হঠাৎ মনে পড়ে আলীবর্দীর সাথে থেকে যুদ্ধ তিনিও করেছেন, বাংলার সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি উপস্থিত নেই বলেই পরাজয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। তিনি সৈনিককে হুকুম করেন তাঁর হাতিয়ার নিয়ে আসতে, তিনি যুদ্ধে যাবেন; এতোদিনের ভুল সংশোধন করার সে সুযোগ তাঁকে নিতে হবে। এমন সময় মোহনলাল প্রবেশ করে জানান, পলাশীতে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তখন আর আত্মভিমানের সময় নেই। নবাবকে অবিলম্বে ফিরে যেতে হবে রাজধানীতে। মিরজাফরের কৈফিয়ৎ চাইবারও সুযোগ নেই, সে ততক্ষণে হয়তো ক্লাইভের সাথে যোগ দিয়েছে। নবাব যেন এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করেন; মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে তাঁকে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে। নবাবকে একাই ফিরে যেতে হবে; কারণ মোহনলাল আর সাঁফ্রের যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। মোহনলালের শেষ যুদ্ধ পলাশীতে।
মোহনলাল চলে গেলে নবাব আত্মগতভাবে বলেন, মোহনলালের সাথে তাঁর আর দেখা হবে না। তার কথামতো নবাবকে একাকীই প্রস্তুতি নিতে হবে নতুন করে। সবকিছু প্রস্তুত ছিল; সিরাজ রাজধানী অভিমুখে বেরিয়ে পড়লেন। যাবার আগে মোহনলালের জন্যে নির্দেশ রেখে গেলেন, মীরমর্দানের লাশ যেন উপযুক্ত মর্যাদায় মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
তুমুল কোলাহলের মধ্যে সসৈন্যে প্রবেশ করেন ক্লাইভ, মিরজাফর, রাজবল­ভ আর রায়দুর্লভ। সিরাজের প্রহরীরা বন্দি হয়। ক্লাইভ তাদের সিরাজের খবর জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু তারা নিরুত্তর। রাইসুল জুহালাকে বুটের লাথি মারেন ক্লাইভ। সে হেসে উঠে বাংলার সিপাহ্সালারকে জিজ্ঞেস করে, যুদ্ধে বাংলাদেশের জয় হয়েছে কিনা। ক্লাইভ তাকে আবারও লাথি মারেন। সে বলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তখনো জীবিত, তার বেশি আর কিছু সে জানে না। রাজবল­ভ তাকে রাইসুল জুহালা বলে চিনতে পারে। ক্লাইভ টান মেরে তাঁর পরচুলা ফেলে দিলে মিরজাফর বলে ওঠে সে নারান সিং, সিরাজের প্রধান গুপ্তচর। ক্লাইভ মিরজাফরকে বলে, তখনই মুর্শিদাবাদের দিকে মার্চ করতে হবে। তার আদেশে নারান সিং বলে, বাংলাদেশে থেকে সে দেশটাকে ভালোবেসেছে, গুপ্তচরের কাজ করেছে দেশের স্বাধীনতার খাতিরে। সে কাজ বেঈমানী আর মোনাফেকির চেয়ে খারাপ নয়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে, তবু ভয় নেই, নবাব তখনো বেঁচে আছেন।
সে প্রার্থনা করে, ভগবান যেন সিরাজউদ্দৌলাকে রক্ষা করেন; ক্লাইভ পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে। নারান সিং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
তৃতীয় অঙ্ক : চতুর্থ দৃশ্য
১৭৫৭ সালের ২৫ জুন। মুর্শিদাবাদ, নবাবের দরবার। দরবারে গণ্যমান্য লোকের সংখ্যা কম, সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। সিরাজ বক্তৃতা করছেন। তিনি বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয়েছে, সে কথা গোপন করে কোনো লাভ নেই। তবে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসেন নি। সেনাপতিদের পরামর্শে যুদ্ধের বিধি অনুসারেই এসেছেন, তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বিজয়ী শত্র“র কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা করবেন বলে ফিরে এসেছেন রাজধানীতে। এক ব্যক্তি বলে, রাজধানী ছেড়ে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ বলেন, তারা পালাবে কোথায়? পেছন থেকে আক্রমণ করবার সুযোগ দিলে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো যায় না। সিরাজ বলেন, জনগণ যেন অধৈর্য না হয়, সবাই যেন শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেটাই তাদের শেষ সুযোগ। ক্লাইভের হাতে রাজধানীর পতন হলে দেশের স্বাধীনতা চিরদিনের জন্যে চলে যাবে। সিরাজ শ্রোতৃমণ্ডলীকে বলেন, দু’একদিনের মধ্যে বিভিন্ন জমিদারের কাছ থেকে যথেষ্ট সৈন্য আসবে, নাটোরের মহারাণীর কাছ থেকেও সৈন্য সাহায্য আসবে, অর্থেরও অভাব নেই। সেনাবাহিনীর খরচের জন্যে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
প্রতারক সৈনিকরা রাজধানী রক্ষার জন্যে সদলবলে লড়বে বলে রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে ভেগে পড়ে। সিরাজ ভেবেছিলেন যে, নগর রক্ষার জন্যে মুর্শিদাবাদে অন্তত দশ হাজার সৈন্য রয়েছে। আরও আশা করেছিলেন জমিদারদের সৈন্য আসবার আগে তাঁদের দিয়ে শত্র“র গতিরোধ করতে পারবেন। কিন্তু বার্তাবাহক এসে তাঁকে জানায়, শহরে বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছে। স্বয়ং নবাবের শ্বশুর ইরিচ খাঁ সপরিবারে শহর ছেড়ে চলে গেছেন। সিরাজ শুনে বিস্মিত হন, কারণ মাত্র কিছুক্ষণ আগে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন সেনাবাহিনী সংগঠনের জন্যে। তবু তিনি আশা ছাড়েন না। এমন সময় তিনি খবর পান, সৈন্য-সংগ্রহের জন্যে যারা টাকা নিয়েছে তাদের অনেকেই নিজেদের লোকজন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। সিরাজ তবু আশা রাখেন। তিনি বলেন, ভীরু প্রতারকের দল চিরকালই পালায়, কিন্তু তাতে বীরের মনোবল ক্ষুণœ হয় না। এমনি করে পালাতে পারতেন মিরমর্দান, মোহনলাল, বদ্রী আলী, নৌবেসিং; তার বদলে তাঁরা পেতেন শত্র“র অনুগ্রহ, প্রভূত সম্পদ ও সম্মান, কিন্তু তা তাঁরা করেন নি। দেশের স্বাধীনতার জন্যে দেশবাসীর মর্যাদার জন্যে তাঁরা জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁদের আদর্শ যেন লাঞ্ছিত না হয়, দেশপ্রেমিকের রক্ত যেন আবর্জনার ¯তূপে চাপা না পড়ে।
নীরব জনতাকে লক্ষ্য করে তিনি তাদের ভেবে দেখতে বলেন, কে বেশি শক্তিমান। একদিকে দেশের সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন দেশদ্্েরাহী যাদের আছে কেবল অস্ত্র, শঠতা আর ছলনা। অস্ত্র দেশবাসীরও আছে। আর তা ছাড়াও আছে মহামূল্যবান দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা রক্ষার সঙ্কল্প। এ অস্ত্র নিয়ে তারা কাপুরুষ দেশদ্রোহীদের অবশ্যই দমন করতে পারবেন।
হাজার হাজার মানুষ একযোগে রুখে দাঁড়াতে পারলে কৌশলের প্রয়োজন হবে না বিক্রম দিয়েই তারা শত্র“কে পরাজিত করতে পারবে। তা না হলে বাংলার ঘরে ঘরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দেবে মিরজাফর ও ক্লাইভের লুণ্ঠন ও অত্যাচার, কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই তিনি জনগণকে বলেন একযোগে মাথা তুলে দাঁড়াতে এবং আশ্বাস দেন, জনগণের অবশ্যই জয় হবে।
সিরাজ বলতে থাকেন, সৈন্য পরিচালনার যোগ্য সেনাপতিও তাঁদের আছে। মোহনলাল বন্দি হন নি, তিনি অবিলম্বে তাঁদের সাথে যোগ দেবেন। তাছাড়া তিনি নিজেও আছেন। আবার যুদ্ধ হবে, আর সৈন্য পরিচালনা করবেন তিনি নিজে। তাদের সাথে যোগ দেবেন বিহার থেকে রামনারায়ণ, পাটনা থেকে ফরাসি বীর মসিয়েঁ লা।
বার্তাবাহক এসে খবর দেয় সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হয়েছেন। শুনে হতাশাগ্রস্ত জনতা দরবার ত্যাগ করে যেতে থাকে। সিরাজ ভেঙে পড়েন। আত্মসংবরণ করে জনতাকে বলেন, তাহলেও কোনো ভয় নেই। তারা যেন হাল ছেড়ে না দেয়। তিনি অনুরোধ করেন, জনতা যেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়, তাঁরা অবশ্যই শত্র“কে রুখবেন। কিন্তু তাঁর আশ্বাসে কান না দিয়ে জনতা পালিয়ে যায়। অবসন্ন সিরাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে আসনে বসে পড়েন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। ধীরে ধীরে লুৎফুন্নেসা প্রবেশ করে নবাবের মাথায় হাত রেখে তাঁকে ডাকেন। তিনি নবাবকে বলেন, অন্ধকারে ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। নবাব আবেগ ভরে লুৎফুন্নেসাকে বলেন, তাঁর কেউ নেই, সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। লুৎফুন্নেসা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, তবু ভেঙে পড়লে চলবে না। মুর্শিদাবাদে থেকে যখন হলো না তখন যেখানে নবাবের বন্ধুরা রয়েছেন সেখান থেকেই বিদ্রোহীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নবাব তার কথায় সায় দেন। লুৎফুন্নেসা ইতোমধ্যেই সব আয়োজন করে ফেলেছিলেন। তখনি তাঁদের প্রাসাদ ছেড়ে যেতে হবে। লুৎফুন্নেসাও স্বামীর সঙ্গিনী হবেন। সব অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে, সব কষ্ট সহ্য করে নবাবের সাথে পালিয়ে লুৎফুন্নেসাও যাবেন পাটনায়। সেখান থেকে যদি বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার আয়োজন করা যায়, সে চেষ্টা করবেন তারা।
চতুর্থ অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৮৫৭ সাল, ২৯ জুন। মিরজাফরের দরবার। রাজবল­ভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সভাসদেরা দরবারে আসীন। দরবারটা নাচ-গানের মজলিশের মতো আনন্দমুখর। নতুন নবাব মিরজাফর তখনো দরবারে আসেননি। তা নিয়ে রাজবল­ভ, জগৎশেঠরা মুখরোচক মন্তব্য ও রঙ্গ-রসিকতা করছেন।
যথাসময়ে মিরনকে নিয়ে দরবারে প্রবেশ করেন মিরজাফর। তিনি সরাসরি সিংহাসনে না বসে সিংহাসনের হাতল ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরেই দরবারে প্রবেশ করে কর্নেল ক্লাইভ, সঙ্গে ওয়াট্স আর কিলপ্যাট্রিক। মিরজাফরের মুখমণ্ডল আনন্দে ভরে ওঠে। ক্লাইভ নতুন নবাবের দীর্ঘজীবন কামনা করেন এবং নবাব তখনো মসনদে বসেন নি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। মিরজাফর সবিনয়ে বলেন, ক্লাইভ তাঁকে হাত ধরে তুলে না দিলে তিনি মসনদে বসবেন না।
ক্লাইভ নিচু গলায় ওয়াটসকে বলেন, লোকটা আস্ত একটা ভাঁড়। তিনি প্রকাশ্যে দরবারীদের বলেন, নবাব জাফর আলী খাঁ তাঁকে লজ্জায় ফেলেছেন, তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে মিরজাফরের হাত ধরে তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে বলেন, তিনি নতুন নবাব জাফর আলী খানকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। ওয়াট্স ও কিলপ্যাট্রিক হর্ষধ্বনি করেন। মিরজাফর মসনদে বসলে দরবারে সবাই তাঁকে কুর্নিশ করেন। ক্লাইভ দরবারীদের বলেন, বাংলায় আবার শান্তি এসেছে। তিনি নবাবকে নজরানা দেন। ওয়াট্স আর কিলপ্যাট্রিক নবাবের দীর্ঘজীবন কামনা করেন। একে একে অন্যেরা নজরানা দিয়ে কুর্নিশ করতে থাকে। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে প্রবেশ করে উমিচাঁদ। ক্লাইভের কাছে গিয়ে বলে, তিনি যেন তাকে খুন করে ফেলেন এবং ক্লাইভের তরবারির খাপ টেনে নিয়ে নিজের বুকে ঠুকতে থাকে। মিরজাফর ব্যাপারটা জানতে চাইলে উমিচাঁদ বলে, ওরা সব বেঈমান, তাকে খুন করা হোক। সে আত্মহত্যা করবে। সে নিজের গলা টিপে ধরে। গলা দিয়ে গড় গড় আওয়াজ বেরোতে থাকে। ক্লাইভ সবলে তার হাত ধরে ছাড়িয়ে নিতে ঝাঁকুনি দিতে দিতে উমিচাঁদকে বলেন, সে পাগল হয়ে গেছে। উমিচাঁদ বলে, তাঁরাই তাকে পাগল বানিয়েছে, এবার ক্লাইভ যেন তাকে খুন করে ফেলে।
উমিচাঁদ বলে, যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেলে তাকে বিশ লাখ টাকা দেয়া হবে বলে তারা দলিলে সই করেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে ইংরেজরা সে দলিল জাল করেছে। দৌড়ে সিংহাসনের কাছে গিয়ে মিরজাফরকে অনুরোধ করে সুবিচার করতে। ক্লাইভ বলেন, তিনি উমিচাঁদের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। উমিচাঁদ বলে, ক্লাইভ তা জানবেন কেন? নবাবের রাজকোষ বাটোয়ারা করে ক্লাইভের ভাগে পড়েছে একুশ লাখ টাকা। সবার ভাগেই অংশ মতো কিছু না কিছু পড়েছে। শুধু উমিচাঁদের বেলাতে শূন্য। ক্লাইভ সবলে উমিচাঁদের বাহু আকর্ষণ করে বলে, উমিচাঁদ স্বপ্ন দেখছে। তিনি সই করলে তা তাঁর মনে থাকতো। উমিচাঁদের বয়স হয়েছে, কাজেই তার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। সে কিছুদিন তীর্থ করলে, ঈশ্বরকে ডাকলে তার মন ভালো হবে। কিলপ্যাট্রিক তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যান। সে যেতে যেতে বলতে থাকে, আমার টাকা, আমার টাকা।
জগৎশেঠ বলে, একটা শুভদিনকে লোকটা থমথমে করে দিয়ে গেলো। ক্লাইভ নবাবকে বলেন যে, প্রথম দরবারে নবাবের কিছু বলা উচিত। রাজবল­ভ তাকে সমর্থন করেন। নবাব ধীরে ধীর উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই শুকরিয়া জানান কর্নেল ক্লাইভকে। তিনি ঘোষণা করেন, ক্লাইভকে পুরস্কার দেয়া হলো বার্ষিক চার লাখ টাকা আয়ের জমিদারি, ২৪ পরগণার স্থায়ী মালিকানা। তিনি দেশবাসীকে আশ্বাস দেন তাদের দুর্ভোগের অবসান হয়েছে, সিরাজের অত্যাচারের হাত থেকে তারা রেহাই পেয়েছে, এখন থেকে কারো শান্তিতে আর কোনো রকম বিঘœ ঘটবে না।
এমন সময় সেনাপতি মির কাসেমের দূত এসে তাঁর পত্র প্রদান করে। মির কাসেম লিখেছেন, তাঁর সৈন্যরা সিরাজউদ্দৌলাকে ভগবানগোলায় বন্দি করেছে এবং তাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে রাজধানীতে। দরবারের সবাই খবর শুনে উল­সিত হয়ে ওঠেন। ক্লাইভ বলেন, এখন তাঁরা সবাই সত্যিকার নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারবেন। মিরজাফর বলেন, সিরাজকে রাজধানীতে নিয়ে আসার দরকার ছিল না, তাকে বাইরে কোথাও আটকে রাখলেই চলতো। ক্লাইভ প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, নতুন নবাবকে শক্ত হতে হবে। শাসন চালাতে হলে মনে দুর্বলতা রাখা চলবে না। তিনি যে শাসন করতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, সে-কথা দেশের লোকের মনে প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখতে হবে। কাজেই সিরাজকে শেকল-বাঁধা অবস্থায় পায়ে হেঁটে সবার চোখের সামনে দিয়ে আসতে হবে জাফরাগঞ্জের কয়েদখানায়। কোনো লোক তার জন্যে এতটুকু দয়া দেখালে তার গর্দান যাবে। এখন মসনদের মালিক নবাব জাফর আলী খাঁ। সিরাজউদ্দৌলা এখন কয়েদি, ওয়ার ক্রিমিনাল, তার জন্যে যে সহানুভূতি দেখাবে সে ঃৎধরঃড়ৎ, আর আইনে ঃৎধরঃড়ৎ-এর শাস্তি মৃত্যু।
মিরজাফর সবাইকে জানিয়ে দেন, সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে। যথাসময়ে তাঁর বিচার হবে। তিনি আশা করেন, কেউ তার জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে বিপদ ডেকে আনবেন না।
মিরজাফর মসনদ থেকে নেমে দাঁড়াতেই দরবারের কাজ শেষ হয়। নবাব দরবার থেকে বেরিয়ে যান, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যান অন্য সবাই। কথা বলতে বলতে প্রবেশ করে মিরন আর ক্লাইভ। ক্লাইভ বলেন, সে রাতেই কাজ সারতে হবে, ওসব ব্যাপারে সুযোগ নেয়া চলে না। মিরন বলে, তার আব্বা তাতে রাজি হন নি, কাজেই হুকুম দেবে কে? রাজবল­ভ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ কেউই হুকুম দিতে রাজি হন নি। ক্লাইভ বলেন, তাহলে হুকুমটা মিরনকেই দিতে হবে। মিরন বলে, প্রহরীরা তার হুকুম শুনবে না। ক্লাইভ বলেন, মিরনকে নিজের স্বার্থে নিজের হাতে মারতে হবে সিরাজউদ্দৌলাকে। সিরাজ বেঁচে থাকতে মিরনের কোনো আশা নেই। নবাবের আসন তো দূরের কথা।
মিরন বলে, সে একটা লোক ঠিক করেছে, তবে ক্লাইভের হুকুম দরকার হবে। দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করে, মোহাম্মদি বেগ হত্যা করবে সিরাজকে। তাকে দিতে হবে নগদ দশ হাজার টাকা। ক্লাইভ নির্দেশ দেন কাজ শেষ হলেই তাঁকে যেন খবর দেয়া হয়। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ বেরিয়ে যায়।
চতুর্থ অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ২ জুলাই। জাফরাগঞ্জের কয়েদখানা। প্রায়ান্ধকার কারাকক্ষে সিরাজউদ্দৌলা। এক কোণে একটি নিরাবরণ দড়ির খাটিয়া। অন্য প্রান্তে একটি সোরাহী আর পাত্র। সিরাজ অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন আর বসছেন। কারাকক্ষের বাইরে প্রহরারত শান্ত্রী। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ প্রবেশ করে। তার দুহাত বুকে বাঁধা। ডান হাতে নাতিদীর্ঘ মোটা লাঠি। প্রহরী দরজা খুলে দিলে কামরায় একটুখানি আলো এসে পড়ে। আলো দেখে চমকে ওঠেন সিরাজ। প্রভাত হয়েছে ভেবে মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসেন তিনি। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ এসে দাঁড়ায় মঞ্চের মাঝখানে। মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে সিরাজ বলেন, সে প্রভাত শুভ হোক লুৎফার জন্যে, শুভ হোক তাঁর বাংলার জন্যে, নিশ্চিত হোক বাংলার প্রত্যেকটি নরনারীর জীবন। তিনি পড়েন আলহামদুলিল­াহ।
মিরন বলে, সিরাজ যেন আল­াহর কাছে মাফ চেয়ে নেন। সিরাজ চমকে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন, মিরন তখন সেখানে কেন? সে কি তাঁকে অনুগ্রহ দেখাতে গিয়েছে, না পীড়ন করতে। মিরন বলে, সে গেছে সিরাজের অপরাধের জন্যে নবাবের দণ্ডাজ্ঞা শোনাতে। বাংলার প্রজাসাধারণকে পীড়নের জন্যে, দরবারের পদস্থ আমির-ওমরাহদের মর্যাদাহানির জন্যে, বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনসঙ্গত বাণিজ্যের অধিকার ক্ষুণœ করবার জন্যে, অশান্তি ও বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে সিরাজ অপরাধী। নবাব জাফর আলী খাঁ তাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিয়েছেন।
কথাটা সিরাজের বিশ্বাস হয় না। তিনি জাফর আলী খাঁর স্বাক্ষরযুক্ত আদেশ দেখতে চান। মিরন বলে আসামীর তেমন অধিকার থাকে না। সে পেছন ফিরে মোহাম্মদি বেগকে নবাবের হুকুম তামিল করার হুকুম দিয়ে বেরিয়ে যায়। মোহাম্মদি বেগ লাঠিটা মুঠো করে ধরে নবাবের দিকে এগোতে থাকে। সিরাজ বলেন, প্রথমে মিরন তারপর মোহাম্মদি বেগমিরন তবু মিরজাফরের পুত্র কিন্তু মোহাম্মদি বেগ কেন গিয়েছে তাঁকে খুন করতে। মোহাম্মদি বেগ এগোতে থাকে। সিরাজ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বলেন, তিনি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত, কিন্তু মোহাম্মদি বেগ যেন সে কাজ না করে। মোহাম্মদি বেগ যেন তাঁকে হত্যা না করে। তিনি তাকে অতীতের কথা ভেবে দেখতে বলেন। তিনি বলেন, তাঁর আব্বা-আম্মা তাকে পালন করেছে পুত্রস্নেহে, তাঁদেরই সন্তানের রক্তে সে যেন ঋণ পরিশোধ না করে।
মোহাম্মদি বেগ লাঠি দিয়ে সিরাজের মাথায় প্রচন্ড আঘাত করে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। মোহাম্মদি বেগ স্থিরদৃষ্টিতে দেখতে থাকে মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সিরাজ ডান হাতের কনুই আর বা হাতের তালুতে ভর দিয়ে কিছুটা মাথা তোলেন। কাতর কণ্ঠে বলেন লুৎফুন্নেসা তাঁর স্বামীর ওপর সে পীড়ন দেখতে পায় নি, সে জন্যে খোদার কাছে শুকরিয়া। মোহাম্মদি বেগ লাঠি ফেলে খাপ থেকে ছোরা খুলে সিরাজের ভূলুণ্ঠিত দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিরাজের পিঠে পরপর কয়েকবার আঘাত হানে ছোরা দিয়ে। সিরাজের দেহ তখন ধীরে ধীরে নিথর হতে থাকে। মোহাম্মদি বেগ উঠে দাঁড়ায়। ঈষৎ মাথা নাড়াবার চেষ্টা করতে করতে মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে সিরাজ বলেন লা ইলাহা ইল­াল­াহু...........।
মোহাম্মদি বেগ লাথি মারে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় সিরাজের জীবন। শুধু মৃত্যুর আক্ষেপে তাঁর হাত দুটি মাটি আঁকড়ে ধরবার চেষ্টায় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে চিরকালের মতো নিস্পন্দ হয়ে যায়।


চরিত্র আলোচনা
সিরাজউদ্দৌলা
ভূমিকা : সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নায়ক সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। এ তরুণ নবাবকে স্বার্থান্ধ স্বদেশী ষড়যন্ত্রকারী এবং ক্ষমতা ও অর্থলোভী বিদেশি চক্রান্তকারীদের সম্মিলিত শঠতা, দুরভিসন্ধি ও শক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এ মোকাবেলা প্রচেষ্টার কাহিনি ও তাঁর করুণ পরিণতিই বিধৃত হয়েছে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। তাঁর চরিত্রে সমাবেশ ঘটেছিল বহু বিরল গুণের। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, নীতিবান, সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিবেচক, ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও সর্বোপরি স্বদেশপ্রেমিক।
আপসকামী : সিরাজ মসনদে আরোহণ করার সময় চিরাচরিত প্রথায় নজরানা পাঠানো থেকে বিরত থাকলেও তিনি বার বার ইংরেজদের সাথে আপস করার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি জানতেন যে, ঘসেটি বেগম তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। কিন্তু নবাবের আপোসকামিতা অর্থলোভী ইংরেজ কোম্পানির লোকদের স্পর্ধা বাড়াতে থাকে। তারা কাশিমবাজার কুঠিতে গোপনে অস্ত্র আমদানি করে, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম দখল করে, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং নবাবের আদেশ লঙ্ঘন করে কৃষ্ণবল­ভকে আশ্রয় দেয়। এভাবে ধৃষ্টতা ও অনাচার যখন চরমে পৌঁছে তখন নবাব কোম্পানির বিরুদ্ধে সামরিক দেওয়ান নিযুক্ত করেন, মুক্তি দেন উমিচাঁদকে এবং কোম্পানির কর্মচারী হলওয়েল, ওয়াট্স ও কলেটকে রাজধানীতে পাঠাবার নির্দেশ দেন।
কৌশলী : গভর্নর ড্রেক, ক্যাপটেন ক্লেটন প্রমুখ ইংরেজ পালিয়ে সঙ্গীদেরসহ ভাগিরথী নদীবক্ষে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং শোচনীয় জীবনযাপন করতে থাকেন। অর্থলোভী উমিচাঁদ ঘুষের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতক মানিকচাঁদের কাছ থেকে কলকাতার ইংরেজদের ব্যবসার অনুমতি আদায় করে তা ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে পাঠিয়ে দেয়। নবাব এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ওদিকে নবাবও নানা ওয়াদা আদায় করে হলওয়েল ও ওয়াটসকে মুক্তি দেন। নবাবের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করা ও তাদের ক্ষমতা খর্ব করা, তাদের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করা নয়; তাই তিনি বন্দিদের মুক্তি দেন।
তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী : উভয় স্বার্থান্বেষী পক্ষ অপদার্থ শওকতজঙ্গকে মসনদে বসাতে তৎপর হয়। ঘসেটি বেগমের মতিঝিলের প্রাসাদে যখন সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে আসে তখন মোহনলালকে নিয়ে নবাব সেখানে উপস্থিত হন। তিনি জানান, শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে অভিযানের আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি ঘসেটি বেগমকে তাঁর নিজ প্রাসাদে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। মতিঝিলের ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ভেঙে যায় এবং এরপর শওকতজঙ্গ পরাজিত ও নিহত হয়। সিরাজের তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ফলে একটা বিপদের অবসান হয়।
ধৈর্যশীল : ষড়যন্ত্র তখন নতুন খাতে বইতে থাকে, বিজ্ঞ সিরাজ তখন ইংরেজদের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে তাঁর অমাত্যদের বিবেক ও স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে তিনি দেখিয়ে দেন তাদের পরামর্শের ভ্রান্তি। কিন্তু নির্যাতিত লবণ-প্রস্তুতকারীকে উপস্থিত করার ব্যাপারটাকে তাঁরা তাঁদের প্রতি অপমান বলে গণ্য করে ক্ষুব্ধ হন। মিরজাফর প্রচ্ছন্ন ভীতি প্রদর্শন করতেও কুণ্ঠিত হন না। সিরাজ তাঁদের শিষ্ট আচরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন যে, দেশকে বাঁচাতে হলে সিপাহ্সালার, জগৎশেঠ, রাজবল­ভ, উমিচাঁদ প্রমুখকে কয়েদখানায় আটক রাখা উচিত। তাঁর এ মন্তব্যে তাঁর বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণাই প্রকাশ পায়। কিন্তু ধৈর্যশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নবাব একতাবদ্ধভাবে দেশের কল্যাণ প্রচেষ্টার পথ অনুসরণ করাকে শ্রেয় মনে করেন। তিনি ইংরেজদের বিদ্রোহমূলক কার্যকলাপের কথা উলে­খ করে সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত স¤প্রীতির ভিত্তিতে কল্যাণের পথে অগ্রসর হবার আহŸান জানান। তিনি সেনাপতি ও অমাত্যদের কাছে তাঁকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভ্রান্ত না করারও অনুরোধ জানান।
দূরদর্শী : স্বার্থান্ধদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। মিরজাফর মসনদ লাভের আকাক্সক্ষায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। অন্যান্যরাও নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে বদ্ধ-পরিকর। মিরনের বাড়িতে দেশি ষড়যন্ত্রকারী ও বিদেশি ক্ষমতালিপ্সুদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নবাব সব খবরই রাখতেন। তিনি ইংরেজদের রাজধানী আক্রমণ করার সুযোগ না দিয়ে ইংরেজদের মোকাবেলা করার জন্য পলাশির প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। মিরজাফর, রায়দুর্লভ প্রমুখ সেনাপতিরা তাঁর পক্ষে লড়বেন না জেনেও দূরদর্শী নবাব তাঁদের সাথে নিয়ে যান যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজধানী দখল না করতে পারে। উলে­খ্য যে, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের আশঙ্কায় তাঁদের পদচ্যুত করাও সম্ভব ছিল না।
দেশপ্রেমিক : নবাব ছিলেন অনন্যসাধারণ দেশপ্রেমিক। তাই তিনি আশা করতেন, দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লুৎফ খাঁদের অন্তরে শেষ মুহূর্তে দেশপ্রেম জেগে উঠতে পারে। উচ্চ চিন্তার অধিকারী নবাব জানতেন না স্বার্থবোধ মানুষকে কত নিচে নামাতে পারে। নবাবের ক্ষীণ আশা পূর্ণ হয়নি। পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধের অভিনয় হলো; মিরমর্দান, বদ্রী আলী প্রমুখ প্রাণ দিলেন, কিন্তু বিপর্যয় এড়ানো গেল না।
প্রবল মনোবল : চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তেও নবাব আশা না হারিয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৈরি হতে লাগলেন। অবিলম্বে মোহনলাল এসে পরাজয়ের খবর জানিয়ে নবাবকে মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়ে রাজধানী রক্ষা করার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিলেন। তিনি দ্রুত ফিরে এসে জনগণকে দেশরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তখন তিনি পতিগত-প্রাণা লুৎফুন্নেসাকে সাথে নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করলেন। ধৃত হয়ে বন্দিবেশে তাঁকে রাজধানীতে ফিরে আসতে হলো। ঘাতকের আঘাতে দেশের ও সাধ্বী-স্ত্রী লুৎফুন্নেসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা জানিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে নবাব প্রাণ ত্যাগ করেন।
উপসংহার : নবাব চরিত্রে একটি মাত্রই দুর্বলতা দেখা যায় কিন্তু তাঁর উৎসও একটি মহৎ গুণ। এ দুর্বলতা হচ্ছে দয়া-মমতার আধিক্য। তিনি একটু কঠোর হতে পারলে হয়তো শেষ রক্ষা করতে পারতেন। তবে ষড়যন্ত্র ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে তিনি যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তাতে তার দক্ষতা, মানবিকতা, প্রজাদরদি ও নির্ভেজাল দেশপ্রীতির পরিচয় ফুটে উঠেছে।
মিরজাফর
ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত প্রতীক মিরজাফর। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিপাহ্সালার, সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। দেশরক্ষার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার ওপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন নি। নিজের স্বার্থের জন্য বিদেশি বণিক-চক্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে তিনি দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে বসেছিলেন বাংলার মসনদে। তাই মিরজাফর বাংলার ইতিহাসে সর্বাধিক ঘৃণিত, ধিকৃত আর অভিশপ্ত ব্যক্তি।
মসনদলোভী : সিপাহ্সালারূপে বাংলার নবাবের প্রতি তার আনুগত্য ছিল না। তিনি আজীবন স্বপ্ন দেখতেন বাংলার নবাবীর। “একটা দিন, মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম।” এ লোভই তাকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা থেকে স্খলিত করেছিল।
ওয়াদাভঙ্গকারী : মসনদে বসার পর থেকে সিরাজ মিরজাফরকে সঙ্গত কারণেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। তবু দেশের জনগণের কল্যাণের খাতিরে তিনি তাকে অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত না করেন। জবাবে মিরজাফর দেশের স্বার্থের জন্য পবিত্র কোরান ছুঁয়ে ওয়াদা করলেন আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবেন। অথচ তাঁর স্বার্থবোধ ধর্মবোধকে গলা টিপে মেরেছে, করেছে নিষ্ক্রিয়।
হীন স্বার্থপর : মিরজাফরের মতো দুর্জনের ছলের অভাব নেই। নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার ব্যাপারে এ লোকটা ছিলেন সদা তৎপর। নিজের কার্যকলাপের কথা ভুলে গিয়ে তিনি প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন সিরাজ তাঁকে মর্যাদা দেন না। প্রকাশ্য দরবারে মোহনলালের তরবারি নিষ্কাশনে তিনি অপমানিত বোধ করেন। অথচ এই মর্যাদা-অভিমানী সিপাহ্সালার অন্তরের অন্তস্থলে ছিল ঘৃণ্য কাপুরুষতা। মোহনলালের উন্মুক্ত তরবারি তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। ক্লাইভের কাছে কৃতজ্ঞতায় তিনি লজ্জাজনকভাবে নতজানু।
ধূর্ত : ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মিরজাফর ছিলেন সবচেয়ে ধূর্ত। ধরা পড়বার ভয়ে গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করতেন খুবই কম। ক্লাইভের দাবি দেশের আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অযৌক্তিক জেনেও তিনি তা মেনে নিতে ষড়যন্ত্রের সাথিদের অনুরোধ করেন। তিনি রাজা রাজবল­ভকে বলেন, “আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি রাজা রাজবল­ভ। ও কথা আর এখন ভাবলে চলবে না। সকলের স্বার্থের খাতিরে ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।”
তার সাংগঠনিক বুদ্ধিও ছিল প্রচুর। তিনি বিভিন্ন স্বার্থের পূজারী একদল বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্রকারীকে এক জোটে কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছেন, তাদের মধ্যে ঐক্য রক্ষার দুঃসাধ্য কাজে সফলতা অর্জন করেছেন।
ক্ষীণ দেশপ্রেম : এমন যে স্বার্থান্ধ দেশদ্রোহী, তাঁর প্রাণেও দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল। ক্লাইভের সাথে ভবিষ্যতের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দেবার পূর্ব মুহূর্তে তিনিও বিবেকের দংশন অনুভব করেছেন, কল্পনায় অমঙ্গলসূচক মরাকান্না শুনেছেন। তার সে সময়ের অস্বস্তি চতুর ক্লাইভের দৃষ্টি এড়ায় নি। এ জন্য ক্লাইভ তাকে 'পড়ধিৎফ' আখ্যা দিয়েছেন। তা সত্তে¡ও কলম হাতে নিয়েও মিরজাফর বলেছেন, “কিন্তু রাজবল­ভ যেমন বলেন, সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না তো?” কিন্তু চতুর ক্লাইভ লোকটার আসল দুর্বলতার খোঁজ রাখতেন। তাই প্রচণ্ড উত্তেজনায় মিরজাফর শেষ পর্যন্ত সে ঐতিহাসিক ঘৃণ্য দলিলে স্বাক্ষর করেন।
চক্রান্তকারী : পলাশির রণক্ষেত্রে মিরজাফরের চক্রান্ত চরমে ওঠে। তিনি তার বিরাট বাহিনী নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মিরমর্দানের দুর্বার আক্রমণে ইংরেজ সৈনিকেরা যখন লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল, তখন এলো বৃষ্টি। সিপাহ্সালার হিসেবে তখন মিরজাফর যুদ্ধরত নবাব বাহিনীকে হুকুম দেন যুদ্ধ বন্ধ করতে। তারা বিশ্রামের জন্য শিবিরের দিকে ফিরছে এমন সময় কিলপ্যাট্রিক আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ক্লাইভের সাথে হাত মিলিয়ে মিরজাফর প্রবেশ করেন নবাবের শিবিরে।
অন্যের হাতের পুতুল : ইংরেজের সেবাদাস মিরজাফর নবাব হয়ে প্রথম দরবারে ক্লাইভ না আসা পর্যন্ত মসনদে বসেন নি। ক্লাইভ এলে তিনি গদগদ কণ্ঠে সিংহাসনের জন্য ক্লাইভের কাছে প্রকাশ্য দরবারে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং তাঁর হাত ধরে মসনদে আসন গ্রহণ করেন। তিনি ক্লাইভকে বার্ষিক চার লাখ টাকা আয়ের চব্বিশ পরগণার জমিদারীর স্থায়ী মালিকানা প্রদান করেন। তিনি প্রকৃত নবাব হন নি, হয়েছিলেন ক্লাইভের হাতের পুতুল। ইতিহাসে এ কারণে তাঁকে বলা হয়েছে ‘ক্লাইভের গর্দভ’।
উপসংহার : মিরজাফর নবাব হবার পরও সিরাজ সম্পর্কে তার অন্তরের ভীরু সঙ্কোচ ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন সিরাজকে রাজধানীতে না এনে বাইরে কোথাও আটকে রাখতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের চাতুর্যের কাছে তাকে হার মানতে হয়। ক্লাইভের কথায় তিনি ঘোষণা করেন সিরাজের বিচার হবে এবং কেউ ভূতপূর্ব নবাবের প্রতি অনুকম্পা দেখালে তার শাস্তি হবে। এ ঘোষণা তার অন্তর থেকে বেরোয়নি, ক্লাইভই তাঁকে দিয়ে কথাগুলো বলিয়েছেন। সিরাজকে রাজপথে অপমানিত করার যে প্রস্তাব ক্লাইভ করেছিলেন মিরজাফর তা মেনে নেন নি। নাট্যকার মিরজাফরকে কিছুটা মানবিক গুণে গুণান্বিত করে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। তাই মিরজাফরকে পুরোপুরি হৃদয়হীন টাইপ চরিত্র বলা চলে না। মিরজাফর দুরাকাক্সক্ষী, মিরজাফর লোভী, কিন্তু তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ, সংবেদনশীল চরিত্র। তিনি কিছুতেই সিরাজের হত্যার আদেশে স্বাক্ষর করতে পারেন নি, তার মুরুব্বি ক্লাইভের পরোক্ষ ইঙ্গিতেও তা তিনি করেন নি। এ মানবিক গুণটি বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত-প্রতীক মিরজাফরকে দোষে-গুণে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
রাজবল­ভ
ভূমিকা : দেশীয় প্রভাবশালী জমিদার রাজবল­ভ ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু তিনি তার ব্রাহ্মণত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের মনিব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
দূরদর্শী : রাজবল­ভ ঘসেটি বেগমের অনুগ্রহভাজন। শওকতজঙ্গকে বাংলার নবাব করার ষড়যন্ত্র সফল হলে ঘসেটি বেগম হতেন সত্যিকার নবাব এবং ঘসেটির নামে শাসনকার্য চালাতেন রাজবল­ভ। কিন্তু তাঁর সে ষড়যন্ত্র সফল হয় নি। কিন্তু তাই বলে এ উদ্যোগী পুরুষ হতাশ হননি। তিনি মিরজাফরের সমর্থক হিসেবে কোম্পানির কর্মচারীদের সাথে ষড়যন্ত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। রাজবল­ভ ক্লাইভের সাথে সম্পাদিত দলিলে স্বাক্ষর করেছেন। তবে তিনি সন্ধির পেছনে ক্লাইভের যে অভিসন্ধি ছিল তা ঠিকই ধরে ফেলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এই সন্ধি অনুসারে সিপাহ্সালার শুধু মসনদে বসবেন। কিন্তু রাজ্য চালাবে কোম্পানি।” সন্ধিতে কোম্পানির কর্মচারীদের যে ক্ষতিপূরণ ও পুরস্কারের শর্ত ছিল তাও তিনি সমর্থন করতে পারেন নি। চুক্তি পড়ে তিনি বলেছিলেন, “নবাবের তহবিল দুবার লুট করলেও তিন কোটি টাকা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।”
তবু এ লোকটিই শেষ পর্যন্ত মিরজারকে সেই মারাত্মক দলিলে সই করতে প্ররোচিত করেছিলেন। কখনো বিবেকের উদয় হলেও রাজবল­ভের সিরাজের প্রতি বিদ্বেষ ছিল প্রখর। কারণ সিরাজ তাকে অর্থ আত্মসাতের দায়ে বন্দি করেছিলেন। তাই তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে।
সাবধানী অথচ রসিক : রাজবল­ভ অত্যন্ত সাবধানী লোক। মন্ত্রীসভায় রাইসুল জুহালার প্রবেশকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখেন। তবে তিনি রসিক লোক। রাইসুল জুহালার কৌতুক অভিনয় তিনি উপভোগ করেন। কিন্তু দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি পূর্ণ সচেতন। নর্তকীদের কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম দিয়ে তিনি কাজের কথা সেরে নিতে চান। আলোচনার প্রারম্ভেই সবাই তর্ক জুড়ে দিলে তিনি তাদের বারণ করেন। তিনি ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা সংক্ষেপে সারতে চেয়েছেন। ক্লাইভের চুক্তিনামাটাও তিনি আগে পড়ে দেখতে চান। কারণ তিনি সতর্ক স্বভাবের ব্যক্তি।
আত্মসম্মানবোধ : সিরাজ তাঁর সভাসদদের প্রকৃত পরিচয় জানতেন বলে তাঁদের সাথে আলোচনা করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না; তাতেও রাজবল­ভ ক্ষুব্ধ ছিলেন। একবার সিরাজ জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্য তাদের দরবারে ডেকেছেন বলে রাজবল­ভ তাঁর মুখের ওপর বলেন: “বেয়াদবি মাপ করবেন জাঁহাপনা। দরবারে আজ পর্যন্ত কোনো জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি।” রাজবল­ভের আত্মসম্ভ্রম-বোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। অত্যাচারিত লবণ প্রস্তুতকারীকে দরবারে হাজির করলে তিনি নবাবকে বলেছিলেন, “কিন্তু প্রকাশ্যে দরবারে এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনায় আমাদের অপমান না করলেও চলতো।”
প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক : রাজবল­ভ প্রতারক, রাজবল­ভ বিশ্বাসঘাতক। তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে নিয়ে প্রকাশ্য দরবারে শপথ করেও তিনি নবাবের অর্থাৎ সমগ্র দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নবাব তাদের প্রকৃত পরিচয় জানেন এবং উপযুক্ত সময়ে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিলুপ্তি ঘটাবেন। তাই তিনি সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য অবিলম্বে কর্মপন্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। তিনি মিরজাফরকে অপদার্থ জেনেও তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, ইংরেজরা বেনিয়ার জাত। টাকা ছাড়া তারা আর কিছুই বোঝে না। তারা জানে যে, সিরাজের কাছ থেকে তাদের সুবিধা আদায়ের কোনো আশা নেই। কাজেই তারা তাদের সেবাদাস মিরজাফরকে মসনদে বসাবার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্য করবে। ষড়যন্ত্র সফল করবার জন্য রাজবল­ভ অতিমাত্রায় উৎসাহী।
স্পষ্টভাষী : রাজবল­ভ ছিলেন স্পষ্টভাষী। তিনি ক্লাইভকেও ছেড়ে কথা বলেন নি। ক্লাইভ গাল ফুলিয়ে বড়ো কথা বললে তিনি তার মুখের ওপর বলেছিলেন, “তোমাকে ধরে বস্তাবন্দি হুলো-বেড়ালের মতো পানা-পুকুরে দুচারদিট চুবুনি দিতে বাদশাহের ফরমান যোগাড় করতে হবে নাকি?”
রাজবল­ভ রসিক পুরুষ। মিরজাফর বাংলার মসনদে বসবার প্রথম দিন আসতে দেরি করায় তিনি রসিকতা করে বলেছেন, “দর্জি নতুন পোশাকটা নিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছে কিনা কে জানে।”
উপসংহার : মিরজাফরের প্রথম দরবারে ক্লাইভ নবাবকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে রাজবল­ভ বলেছেন, “রাজকার্য পরিচালনায় কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে তাও মোটামুটি জানা দরকার।” এতে বোঝা যায় সরকারি পদমর্যাদা লাভের জন্য রাজবল­ভের একটা মোহ ছিল।
উমিচাঁদ
ভূমিকা : উমিচাঁদ লাহোরের শিখ ব্যবসায়ী। অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে সে বাংলায় এসেছিল। নিজের স্বার্থসিন্ধির জন্য সে নবাবের শাসন-ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। এ স্বার্থান্ধ বণিক নিজের মতলব হাসিলের জন্য নবাবের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়, কিন্তু কোনো পক্ষের প্রতিই সে পুরোপুরি বিশ্বস্ত ছিল না। স্বার্থের পাল­া যেদিকে ভারি দেখেছে, সেদিকেই সে ঝুঁকে পড়েছে। দু’নৌকায় পা দিয়ে চলেছিল বলে শেষ পর্যন্ত তার ভরাডুবি হয়েছে।
ইংরেজ তোষণ : উমিচাঁদ এক সময় কলকাতায় ইংরেজদের হাতে বন্দি হয়। নবাব কলকাতা জয় করলে হলওয়েল তাকে মুক্তি দেন। ছাড়া পেয়ে সে ইংরেজের বিপদ মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। তার রসিকতাও বেশ উপভোগ্য। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে ক্যাপ্টেন ক্লেটন পালিয়ে গেছেন শুনে সে রসিকতা করে হলওয়েলের মুখের ওপর বলেছিল, “ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন, এ বড় লজ্জার কথা।” সে আরও বলেছিল, “ক্যাপ্টেন কর্নেলরা সব পালিয়ে গেছেন, এখন ফাঁকা ময়দানে হাসপাতালের হাতুড়ে সার্জন জন জেকানিয়া হলওয়েল সর্বাধিনায়ক। “আপনিই এখন কমান্ডার-ইন-চীফ।” হলওয়েল ব্যাকুলভাবে উমিচাঁদের সাহায্য চাইলে ধূর্ত উমিচাঁদ রাজা মানিকচাঁদের কাছে চিঠি লিখবে বলে আশ্বাস দেয়। দুর্গের পতনের মুখে দুর্গ-প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দিতে সে হলওয়েলকে পরামর্শ দেয়।
স্বার্থান্বেষী : স্বার্থান্বেষী উমিচাঁদ নিজের স্বার্থের সন্ধানে সেই দুর্যোগের দিনে প্রভাবশালী সবার সাথেই যোগাযোগ রেখে চলত। তাকে কেউই পুরোপুরি বিশ্বাস করতো না; সেও সবসময় মনে করতো তাকে সবাই ঠকাচ্ছে। ঘসেটির বাড়িতে তাই সে রায়দুর্লভকে বলেছে, “আপনারা সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফ শুকনো রাখেন, আর আমি দুধের হাড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাড়ির কালি মেখে গুলবাঘা বনে যাই।”
ভিজেবেড়াল : উমিচাঁদ ভিজেবেড়াল। সিরাজের পতন হলে কে কী পদ পাবেন তা নিয়ে আলোচনার সময় উমিচাঁদ বলেছে তার কোনো বিষয়ে দাবি-দাওয়া নেই। সে খাদেম। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই সে নেয়। উমিচাঁদের বুদ্ধির অভাব ছিল না। সে তখনকার পরিস্থিতিটা ঠিক আঁচ করতে পেরেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, সিরাজ তাকে বিশ্বাস করেন না। সিরাজের নবাবী কায়েম থাকলে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের মতো তারও রক্ষা নেই। তাই সে মনে-প্রাণে সিরাজের পতন কামনা করেছে।
উমিচাঁদের জীবনে টাকার মতো পরম কাম্য অন্য কোনো জিনিস নেই। সে নিজেই বলেছে, “দওলত তার কাছে ভগবানের দাদা মশায়ের চেয়েও বড়ো। সে দওলতের পূজারী।”
কালকেউটে : মিরনের বাড়িতে সিরাজের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র-সভায় উমিচাঁদ ছিল না। জগৎশেঠ বলেছেন উমিচাঁদকে বাদ দিয়ে কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়। কারণ কোম্পানি যেমন এদেশে বাণিজ্য করতে এসে লুটপাট করছে, উমিচাঁদও ব্যবসা করতে এসে অর্থ সংগ্রহ করে চলেছে। মিরজাফর নিজেও উমিচাঁদকে ভালো করে জানতেন। জগৎশেঠের মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে বলেছেন, উমিচাঁদ একটা আস্ত কালকেউটে। তার দাবিই সবার আগে মেটানো দরকার। তা না হলে, দণ্ড না পেরোতেই সমস্ত খবর পৌঁছে যাবে নবাবের দরবারে।
উপসংহার : ক্লাইভের মতে সে-যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক উমিচাঁদ। উমিচাঁদ ইংরেজদের গোপন অভিসন্ধি নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। তারপর আবার একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তাদের কাছে। উমিচাঁদ ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবি করেছে। উমিচাঁদ ধড়িবাজ, কিন্তু ক্লাইভও কম ছিলেন না। তাই ক্লাইভ জাল দলিল করে উমিচাঁদকে ফাঁকি দিয়েছে। সিরাজের পতনের পরে উমিচাঁদ তার ত্রিশ লক্ষ টাকা না পেয়ে টাকার শোকে পাগল হয়ে যায়। উন্মাদের মতো নতুন নবাবের দরবারে প্রবেশ করে চিৎকার করে ফরিয়াদ জানায়। ক্লাইভ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে বলেন, তার বয়স হয়েছে, তাই মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। তিনি তাকে তীর্থ করতে আর ঈশ্বরের ভজনা করতে উপদেশ দেন। কিলপ্যাট্রিক তাকে টেনে নিয়ে যায় দরবারের বাইরে। সে টাকা টাকা বলে অবিরাম চিৎকার করতে থাকে। তার উক্তি অর্থলোভী শাইলককে মনে করিয়ে দেয়।
জগৎশেঠ
ভূমিকা : জৈন জগৎশেঠ তৎকালীন বাংলার ধনকুবের ছিলেন। স্বয়ং নবাবও মাঝে মাঝে টাকার জন্য তার কাছে হাত পাতেন। ঘসেটি বেগমের বাড়িতে নাচ-গানের জলসায় তার সাথে পাঠকের প্রথম পরিচয়। তিনি লোভী, অর্থটাই তার জীবনের পরমার্থ। তিনি বুদ্ধিমান ও বহুদর্শী। ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্র সফল হলে কার কী লাভ হবে তিনি সঠিকভাবে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ঘসেটি বেগমকে স্পষ্ট বলেছিলেন, “শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাং-এর গেলাস আর নর্তকী ছাড়া তিনি আর কিছুই জানেন না। তিনি নবাব হলে আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার হাতে। তখন বেগমের নামে শাসনকার্য চালাবেন তার অনুগ্রহভাজন রাজা রাজবল­ভ।” কাজেই শওকতজঙ্গের আমলে জগৎশেঠের স্বার্থ কিছুতেই নির্বিঘœ হবে না। অতএব তার জন্য সে ক্রান্তিলগ্নে নগদ কারবারই ভালো। তাই তিনি বলেন যুদ্ধের ব্যয় বাবদ তিনি শওকতকে সাধ্যমতো সাহায্য করবেন, কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে বেগম সাহেবা তাঁকে একটা কর্জনামা লিখে দিলে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন।
সিরাজভীতি : জগৎশেবের ধারণা ছিল সিরাজ তাদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা টের পেয়েছেন। তিনি যে-কোনো সময় তাদের বন্দি করতে চান। কাজেই সিরাজ স্থির হয়ে মসনদে বসতে পারলে তাদের নিষ্কৃতি নেই। তিনি নিজের ধনসম্পদ নবাবের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অজস্র অর্থ ব্যয়ে সেনাপতি ইয়ার লুৎফা খাঁর অধীনে দু’হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের একটা দল পুষতেন।
বুদ্ধিমান : বুদ্ধিমান জগৎশেঠের কোনো আস্থা ছিল না তৎকালীন বাংলার গুপ্তচরদের ওপর। তার মতে, গুপ্তচররা মূল চিঠি হয়তো আসল জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু তার আগে সে চিঠির একটা নকল নবাব-দরবারেও পাচার করে দিচ্ছে। তবে বাংলার তৎকালীন বিশৃঙ্খল অবস্থায় গুপ্তচরদের সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে এক পা-ও অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
দ্বিধা-দ্ব›দ্ব : ইংরেজের ওপর জগৎশেঠ পুরোপুরি আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। তিনি ক্লাইভকেও তার মুখের ওপর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “ভগবানের দিব্যি, কর্নেল সাহেব, তোমরা বড় বেহায়া। এই সেদিন কলকাতায় যা মার খেয়েছো এখনো তার ব্যথা ভোলার কথা নয়।” তিনি বলেছেন, ইংরেজরা তাদের ব্যবসায়ের স্বার্থ রক্ষা করুক; কিন্তু তারা যেন দেশের শাসন-ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করে। শাসন-ব্যবস্থায় বিদেশিদের অনুপ্রবেশ সম্বন্ধে তার এ স্পষ্ট ভাষণ প্রণিধানযোগ্য।
উপসংহার : মিরজাফরের ওপরও জগৎশেঠের আস্থা পুরোপুরি ছিল না। মিরজাফর নবাব হয়ে প্রথমে দরবারে আসতে দেরি করায় তিনি রসিকতা করে বলেছেন, “খাঁ সাহেব ঢাল-তলোয়ার ছেড়ে নবাবী লেবাস নিচ্ছেন, তাই দেরি হচ্ছে। তা ছাড়া চুলে নতুন খেজাব, চোখে সুরমা, দাড়িতে আতর, এসব তাড়াহুড়ার কাজ নয়।”
অর্থপিশাচ এই ধনকুবের রসিক-পুরুষও ছিলেন।
রায়দুর্লভ
ভূমিকা : কায়স্থ রায়দুর্লভ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম সেনাপতি। নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে অধিকার করেছিলেন। সে- অভিযানে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন রায়দুর্লভ। তিনি প্রথম জীবনে নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতিই ছিলেন। শেষ দিকে ষড়যন্ত্রকারীদের খপ্পরে পড়ে সিপাহসালার হবার প্রলোভনে তাদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। শওকতজঙ্গের বিরুদ্ধে সিরাজের সার্থক অভিযানের প্রাক্কালে রায়দুর্লভ গোপনে শওকতকে সমর্থন করেন কিন্তু বিনা স্বার্থে তিনি তা করেন নি। শওকত নবাব হলে তাঁকে পদাধিকারের একটা একরারন্যামা সই করে দেবার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
লোভী : রায়দুর্লভের হৃদয় থেকে দেশপ্রেম একেবারে শুকিয়ে যায় নি। নবাব তাঁর প্রকাশ্য দরবারে কুঠিয়াল সাহেবদের দ্বারা নির্মমভাবে উৎপীড়িত একজন হতশ্রী লবণ-প্রস্তুতকারককে হাজির করালে রায়দুর্লভ তার দুর্দশায় সাতিশয় ব্যথিত হয়ে ক্ষোভে-রোষে তরবারি নিষ্কাশন করে বলেছেন, “একি! এর এই অবস্থা কে করলো?” তিনিও তামা, তুলসী ও গঙ্গাজল স্পর্শ করে শপথ করেছিলেন, সর্বশক্তি নিয়ে তিনি নবাবের অনুগামী থাকবেন, কিন্তু তিনিও লোভ দমন করতে পারেন নি। সিরাজের পতন হলে তিনি সিপাহসালার হবেন, এ প্রলোভন তাঁকে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করে। তিনি সম্ভবত এ লোভেই মিরজাফর তোষামোদ করে চলতেন। প্রকাশ্য দরবারে সিরাজ সভাসদদের অপমান করলে এ সুযোগসন্ধানী সেনাপতি বলেছিলেন, “সিপাহ্সালারের অপমানটাই আমার বেশি বেজেছে।”
রসিক : স্বার্থপর রায়দুর্লভের মধ্যেও রসিকতার অভাব ছিল না। মিরনের বাড়িতে নৃত্য-গীতের আসরে মন্ত্রণাসভা বসবার পূর্ব মুহূর্তে তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। তার সে আকস্মিক আবির্ভাবে মিরন বিস্ময় প্রকাশ করলে রায়দুর্লভ বলেন, “আমাকে আপনি নৃত্য-গীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত ধরে নিয়েছেন।” তিনি বলেছেন, অহরহ অশান্তি আর অব্যবস্থার মধ্যে থেকে তার জীবন বিস্বাদ হয়ে উঠেছে।
ধূর্ত : রায়দুর্লভ ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত ও ধুরন্ধর। তিনি ইচ্ছে করেই গোপন সভায় উপস্থিত থাকেন নি। তার পক্ষে অধিকক্ষণ বাইরে থাকা তিনি নিরাপদ মনে করেন নি। তিনি ভয় করেছেন, কখন কী কাজে নবাব তাকে তলব করে বসেন তার ঠিক নেই। তলবের সাথে সাথে হাজির না পেলে নবাবের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। তবুও বিপদ ঘাড়ে করে তিনি মিরনের সাথে বৈঠকের আগে দেখা করতে এসেছেন শুধু তার সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করা হলো তা জানার জন্য। মিরন তাকে প্রধান সেনাপতিত্ব প্রাপ্তির আশ্বাস দেয় এবং তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে প্রস্থান করেন।
দ্ব›দ্ব-সন্দেহ : দুক‚ল বজায় রেখে চলেছেন কায়স্থ সেনাপতি রায়দুর্লভ। তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের সাফল্যটা নিশ্চিত বলে ধরে নিতে পারেন নি। তিনি মিরনকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, চারদিকের অবস্থা দেখে যদি তিনি বুঝতে পারেন যে, ষড়যন্ত্রকারীদের সাফল্য লাভের কোনো আশা নেই, তাহলে তারা যেন তার সহায়তার আশা না করেন। অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের ধুম্রজালে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি তার সঠিক কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারেন নি।
বিশ্বাসঘাতক : রায়দুর্লভ মাসে মাসে রাজবল­ভের কাছ থেকে যে-মোটা বেতন পেতেন এ তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি প্রকৃত অর্থে নবাবের অনুগত ছিলেন না। তবে আনুগত্যের মুখোশটা রক্ষা করতে তিনি বেশি তৎপর ছিলেন। মিরজাফরের কথায়, রায়দুর্লভ ছিলেন ক্ষুদ্র শক্তিধর। তবু ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে প্রয়োজনের সময় নবাবের বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্বও ছিল যথেষ্ট।
উপসংহার : পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে মিরজাফরের মতো তিনিও যুদ্ধ করেন নি। তিনি ইংরেজের সাথে হাত মিলিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার মনে অনুশোচনা জেগেছিল কি না তা বলা দুষ্কর। তিনি সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন নি। মিরজাফরের নবাবী আমলের প্রথম দরবারেও তাকে দেখা যায় না।
মোহনলাল
ভূমিকা : কাশ্মীরি মোহনলাল সাহসী যোদ্ধা ও বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক। নিজের জীবন দিয়ে মোহনলাল দেশের কল্যাণ চেয়েছিলেন, বিদেশি ক্ষমতালোভী আর স্বদেশি দেশদ্রোহীদের গতিরোধ করতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়ে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। সিপাহসালার আর গণ্যমান্য সভাসদেরা যখন ঘসেটি বেগমকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্রের ছুরি শাণাচ্ছেন তখন এ বিশ্বাসী সেনাপতির অধীনে ফৌজ পাঠিয়ে নবাব শওকতজঙ্গের বিদ্রোহ দমন করেন। নবাবের বিরুদ্ধে নিরন্তর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ঘসেটি বেগমকে তার মতিঝিলের প্রাসাদ থেকে নিয়ে এসে নবাবের নিজের প্রাসাদে রাখার দায়িত্বও পেয়েছিলেন মোহনলাল। নবাব যখন মিরজাফরের মত প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য দরবারে শপথ করান তখনও বিশ্বাসী মোহনলাল ছিলেন নবাবের পাশে। একমাত্র মিরমর্দান ছাড়া ভাগ্যবিড়ম্বিত নবাবের এতোবড়ো বিশ্বস্ত অনুচর মোহনলাল ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
নবাবপ্রীতি : বাংলার স্বাধীনতা, নবাবের নিরাপত্তার চিন্তায় মোহনলালের চোখে ঘুম ছিল না। মিরনের আবাসে ষড়য়ন্ত্রকারীরা গোপন সভায় সম্মিলিত হয়েছে- গুপ্তচরের মুখে এ সংবাদ পেয়ে মোহনলাল সেখানে হানা দিয়েছিলেন।
দেশপ্রীতি : পলাশির যুদ্ধের পূর্বরাত্রে নবাব যখন নিজের শিবিরে বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের কথা ভেবে ক্ষণে ক্ষণে বিভ্রান্ত ও ব্যাকুল হয়ে পড়ছিলেন, তখনো সবশেষ খবর জানতে এসেছেন মোহনলাল। তিনি নবাবকে আশ্বাস দিয়েছেন, নবাবের শক্তি ইংরেজদের শক্তির চেয়ে অনেক বেশি। ইংরেজের তিন হাজার সৈন্যের মোকাবেলায় নবাবের রয়েছে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য, ইংরেজদের দশটি কামানের তুলনায় নবাবের রয়েছে পঞ্চাশটিরও বেশি। মোহনলাল ছিলেন নবাবের দুর্দিনের বন্ধু, অন্ধকারের আলো। দেশহিতব্রতী এ বিশ্বস্ত সৈনিকের ছিল একটি নির্ভরযোগ্য গুপ্তচর বাহিনী। তাদের মাধ্যমে তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের সব সংবাদ রাখতেন। মিরজাফর আর ক্লাইভের মধ্যে যে সব গোপনীয় পত্র বিনিময় হতো তার বেশ কয়েকটি তার গুপ্তচরদের হাতে ধরা পড়ে। তিনি নিজেদের জয় সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলেন। পলাশিতে যুদ্ধের প্রহসন না হয়ে সত্যিকার যুদ্ধ হলে নবাবের জয় ছিল অবধারিত।
বিশ্বস্ত : তিনি নবাবকে শ্রদ্ধা করতেন, ভয়ও করতেন। যুদ্ধের পূর্বরাত্রে মিরজাফরের গুপ্তচর কমর বেগ ধরা পড়লে সে নবাবকে জানায় মোহনলালের হুকুমে তার ভাই উমর বেগ জমাদারকে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজ তাঁর প্রতি অসন্তোষের দৃষ্টিতে তাকান। তখন মোহনলাল নবাবকে কৈফিয়তের সুরে জানান, মিরজাফরের গুপ্তচর উমর বেগ জমাদার ক্লাইভের চিঠিসহ ধরা পড়ে। সে পালাবার চেষ্টা করলে প্রহরীদের তরবারির আঘাতে তার মৃত্যু হয়।
সাহসী যোদ্ধা : মোহনলাল ছিলেন দুর্দান্ত সাহসী যোদ্ধা। প্রতিক‚ল অবস্থার মধ্যেও পলাশির যুদ্ধের সময় তিনি তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। ইংরেজ বাহিনী লক্ষবাগের দিকে হটে যেতে থাকে। বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর বৃষ্টিতে নবাবের বারুদ ভিজে অকেজো হয়ে গেছে অজুহাতে যুদ্ধ বন্ধ করার হুকুম জারি করেন, কিন্তু দুঃসাহসী যোদ্ধা মোহনলাল সে হুকুম মানতে চান নি। সিপাহ্সালার, রায়দুর্লভ প্রমুখের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতায় যুদ্ধের অবস্থা যখন মারাত্মক পরিণতির দিকে যাচ্ছিল, তখনো তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি। তিনি নবাবকে শিবিরে গিয়ে জানিয়েছেন, যুদ্ধে তাঁদের পরাজয় হয়েছে। তখন আর আত্মভিমানের সময় নেই। নবাব যেন এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট না করে মুর্শিদাবাদে গিয়ে রাজধানী রক্ষার চেষ্টা করেন। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও মোহনলাল নবাবের সাথে রাজধানীতে ফিরে যান নি। তিনি বলেছেন, পলাশিতে তাঁর যুদ্ধ তখনো শেষ হয় নি। তিনি ফরাসি বীর সাঁফ্রের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যান জীবনের শেষ যুদ্ধ লড়তে।
উপসংহার : সিরাজ অনেক ভরসা রাখতেন তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের ওপর। পরাজিত হয়ে রাজধানীতে ফিরে তিনি জনগণকে জানিয়েছিলেন, তখনো মোহনলাল জীবিত আছেন। তিনি বন্দি হননি। তিনি শত্র“র বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে জনগণকে পরিচালিত করবেন। এমন সময় বার্তাবাহক এসে জানায় সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হয়েছেন। খবরটা নবাবের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। মোহনলালের স্মৃতি সিরাজের নামের সাথে অমর হয়ে আছে।
মিরমর্দান
ভূমিকা : ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের অন্যতম ঐতিহাসিক চরিত্র মিরমর্দান। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণে সিরাজের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন মিরমর্দান। তিনিই দুর্গে প্রবেশ করে হলওয়েলকে জিজ্ঞেস করেন, তারা আত্মসমর্পণ করছে কিনা।
তিনিই ইংরেজদেরকে হাত তুলে দাঁড়াতে হুকুম দেন। দুর্গ জয়ের পর সিরাজ তাঁর এ বিশ্বস্ত সেনাপতির ওপর দায়িত্ব দেন রাজবল­ভের পুত্র কৃষ্ণবল­ভকে ছেড়ে দেবার।
বিশ্বস্ত যোদ্ধা : যুদ্ধের পূর্বরাত্রে পলাশির নবাব শিবিরে নিজেদের সৈন্য বিন্যাস ও প্রস্তুতির নকশা নবাবকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নবাব মিরমর্দানকে বলেছিলেন, কেমন যেন অঙ্কের হিসাবে শত্র“র সুবিধের পাল­া ভারি হয়ে উঠেছে। তিনি বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। দুঃসাহসী বীর মিরমর্দান বুক উঁচিয়ে নবাবকে বলেছিলেন, ইংরেজদের ঘায়েল করতে সেনাপতি মোহনলাল, সাঁফ্রে আর তাঁর বাহিনীই যথেষ্ট। সিরাজ তাঁকে বলেছিলেন, মিরমর্দান হারতে থাকলে মিরজাফরদের বাহিনী দু’কদম এগিয়ে ক্লাইভের সাথে হাত মেলাবে বিনা বাধায়। মিরমর্দান বলেছিলেন, তাঁদের হারবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মিরমর্দান চিন্তিত নবাবকে বুকভরা ভরসা দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর চিন্তিত হবার কারণ নেই, তাঁদের প্রাণ থাকতে নবাবের কোনো ক্ষতি হবে না। নবাবকে চিন্তিত দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। কারণ আত্মশক্তিতে তিনি ছিলেন পরম বিশ্বাসী।
সাহসী : মিরমর্দান শত্র“পক্ষের গুপ্তচরদের ভালো করেই চিনতেন। যুদ্ধের পূর্বরাত্রে গুপ্তচর কমর বেগ জমাদার ধরা পড়লে তিনিই তাকে শনাক্ত করেন। যুদ্ধের সময় বৃষ্টিতে নবাবের বারুদ ভিজে অকেজো হয়ে গেলেও দুর্দান্ত সাহসী সেনাপতি মিরমর্দান কামানের অপেক্ষা না করে হাতাহাতি লড়বার জন্য দ্রুত এগিয়ে যান। শত্র“কে কামান ছুঁড়বার সময় না দিয়ে তিনি তলোয়ার নিয়েই সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
উপসংহার : শত্র“র গোলার আঘাতে মীরমর্দানের পতন সংবাদ শুনে নবাবের বুক ভেঙে গিয়েছিল। আচ্ছন্নভাবে তিনি শুধু প্রশ্ন করতে পেরেছিলেন মিরমর্দান শহিদ হয়েছেন কিনা। ফরাসি সাঁফ্রে বলেছেন, 'ঞযব নৎধাবংঃ ংড়ষফরবৎ রং ফবধফ.' মিরমর্দান সত্যিই ছিলেন পলাশি যুদ্ধের সর্বাধিক সাহসী সৈনিক। মিরমর্দানের মৃত্যুতে সিরাজ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে নবাব প্রহরীকে বলে যান, সে যেন মোহনলালকে খবর দেয়, তিনি যেন কয়েকজন ঘোড়সওয়ারের হেফাজতে মিরমর্দানের মৃতদেহ তক্ষুণি রাজধানীতে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। উপযুক্ত মর্যাদার যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন মিরমর্দান।
ক্লাইভ
ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসের বড় কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করেন বিদেশি বণিকের অন্যতম কর্মকর্তা রবার্ট ক্লাইভ। বাংলার পতনের দিনে এ ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ কর্মচারী বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন, বাংলার জনজীবনে সূচনা করেছেন অপরিসীম দুর্গতি। তিনি ছিলেন বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান চক্রান্তকারী। তারই ক‚ট-কৌশলে বণিকের মানদণ্ড দেখা দিয়েছিল রাজদণ্ডরূপে।
জোচ্চোর ও ষড়যন্ত্রকারী : যে কোনো রকম ছলনা, জোচ্চুরি এবং ঘৃণ্য কাজের পাণ্ডা ছিলেন কর্নেল ক্লাইভ। মিরনের বাড়িতে ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন সভায় ক্লাইভ আসেন ওয়াটসনকে সাথে নিয়ে রমণীর ছদ্মবেশে। ক্লাইভ ছিলেন বেপরোয়া দুঃসাহসী। জুয়া খেলায় অভ্যস্ত ক্লাইভ নিজের জীবন বিপন্ন করেও সে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। সুচতুর ক্লাইভ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার নবাবের সত্যিকারের কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি ঠিকই জানতেন যে, নবাবের সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক। যার খাজাঞ্চি, দেওয়ান, আমির-ওমরাহ্ প্রত্যেকেই প্রতারক, তার কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। চতুর ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আমির-ওমরাহদের বিশ্বাস করতেন না। তাদের সাথে চলতে তিনি প্রতি পদক্ষেপে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তিনি গোপন বৈঠকে রাজবল­ভকে খোলাখুলি বলেছেন, তারা ইচ্ছে করলে ইংরেজের ক্ষতি করতে পারেন। বিশ্বাসহন্তারা সবই পারে। তারা নবাবকে ডোবাচ্ছেন, কাল যে ইংরেজকে ডোবাবেন না তা বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি বরং নবাবকে বিশ্বাস করতে পারেন। স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারীর পক্ষেই এ মূল্যায়ন করা সম্ভব।
নীতিহীন : ক্লাইভ উমিচাঁদের চেয়েও নীতিহীন বুদ্ধিমান ছিলেন। জাল-জুয়োচুরিতে পাকা ছিল তার হাত। তিনি মানুষ চিনতেন। তিনি নবাবের বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক কর্মচারীদের যেমন চিনতেন, তেমনি চিনতেন প্রতারক উমিচাঁদকে। তার মতে, উমিচাঁদ ছিল সে যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক। ক্লাইভ এ ধূর্ত-বিশ্বাসঘাতককেও বিশ্বাসঘাতকতায় হার মানিয়ে পাগল বানিয়েছিলেন।
দেশ ও জাতির প্রতি বিশ্বস্ত : নবাবের কর্মচারীরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন, নিজেদের স্বার্থের জন্য। কিন্তু ক্লাইভের জালিয়াতি ও ক‚ট-কৌশলের পিছনে লুকানো ছিল তার দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ স্বার্থ। সেদিক থেকে তার স্থান এদের অনেক ওপরে। পলাশির যুদ্ধের আগে মিরজাফরদের সাথে ক্লাইভের যে চুক্তি হয় তার মুসাবিদা করেন ক্লাইভ। সে চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল সিরাজের পতনের পরে মিরজাফর নামেমাত্র নবাব হবেন। কিন্তু রাজ্যশাসনের দায়িত্ব থাকবে কোম্পানির হাতে। ধরা পড়ে ধূর্ত ক্লাইভ সাফাই গেয়েছেন, তারা শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের ঢ়ৎরারষবমব-টুকু ংবপঁৎবফ করে নিচ্ছেন। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হতেই ক্লাইভ দলিল দুটো ফেরত নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেন। তখন বাংলার প্রতারকরা নরম হয়ে পড়েন।
দূরদৃষ্টি : মিরজাফর দলিলে সই করতে ইতস্তত করছেন দেখে ক্লাইভ তাকে ডড়সবহ- দের চেয়েও ঈড়ধিৎফ বলে কাজ হাসিল করেন। ঈড়ধিৎফ- দের ওপর কোনো কাজের জন্যই ভরসা করা যায় না। তাই দলিল সই করাতে তিনি নিজেই এসেছেন। মিরজাফর দলিলে স্বাক্ষর দেবার পর এ ধূর্ত ইংরেজ প্রসন্ন মুখে বলেছিলেন, “আমরা এমন কিছু করলাম যা ইতিহাস হবে।” তার সে ভবিষ্যদ্বাণী নিদারুণ ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে।
সতর্ক : অতিমাত্রায় সতর্ক ছিলেন এ ইংরেজ। পলাশির যুদ্ধের শেষে তিনি সিরাজের শিবিরে প্রবেশ করে তাঁর প্রধান গুপ্তচর নারান সিংকে হত্যা করেন। নবাব পলায়ন করেছেন শোনামাত্র তিনি মিরজাফরকে রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করতে নির্দেশ দেন। তিনি জানতেন সময় পেলে নবাব প্রস্তুতি গ্রহণ করে রুখে দাঁড়াবেন। তিনি মিরজাফরকে অপদার্থ বলেই জানতেন। মিরজাফর যখন কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে বলেন, ক্লাইভের হাত ধরে বসতে না পারলে তিনি বাংলার মসনদে বসবেন না, ক্লাইভ তখন মিরজাফরকে সেরা ঈষড়হি বলেই অভিহিত করেন। তবে এ ধূর্ত ইংরেজ অনুগত প্রজার মতো নতুন নবাবকে নজরানা দেন। দরবারের লোকজনকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে আবার শান্তি ফিরে এসেছে। নিজের ব্যক্তিগত লাভের প্রতিও তার ছিল প্রখর দৃষ্টি। ষড়যন্ত্রের নায়ক হিসেবে তিনি পেলেন নগদ একুশ লাখ টাকা আর বার্ষিক চার লাখ টাকা আদায়ের জমিদারি চব্বিশ পরগণার স্থায়ী মালিকানা। এরপর শঠের চূড়ামণি রূপে তিনি উমিচাঁদকে তীর্থে গিয়ে ঈশ্বরের নাম জপ করার পরামর্শ দেন।
বুদ্ধিমান : বুদ্ধিমান ক্লাইভ তার হাতের পুতুল নবাব মিরজাফরকে মসনদে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন, এ লোভী ও অপদার্থ লোকটাকে কলের পুতুল হিসেবে সামনে রেখে বাণিজ্যের নামে এ দেশের রাজদণ্ড হস্তগত করা ইংরেজের পক্ষে খুবই সহজসাধ্য হবে। তাই তিনি মিরজাফরকে শক্ত হতে বলেছেন।
উপসংহার : সিরাজকে হত্যা করতে বাংলার কোনো কর্মকর্তাই চান নি। কিন্তু ক্লাইভ তার জনপ্রিয়তার কথা জানতেন, ভবিষ্যতে বাংলার মানুষ যে-কোনো সময় সিরাজের বন্ধন মুক্তি ঘটিয়ে ক্লাইভের কবল থেকে বাংলার শাসনব্যবস্থা আবার ছিনিয়ে নিতে পারে, তার এমন আশঙ্কা ছিল। তাই তিনি মিরজাফরের অপদার্থ পুত্র মিরনকে প্ররোচিত করেন সিরাজকে হত্যা করতে; সে মোহাম্মদি বেগকে দিয়ে সিরাজকে হত্যা করায়। এভাবে ক্লাইভের কৌশলে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের জীবনাবসান হয়।
লুৎফুন্নেসা
ভূমিকা : নবাব সিরাজদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ছিলেন পতিগতপ্রাণা মহিয়সী রমণী। তিনি ছিলেন রমণীসুলভ সরলতার মূর্তপ্রতীক, শত্র“-মিত্র চেনার মতো প্রখর দৃষ্টি তাঁর ছিল না। নবাবের অফুরন্ত ভালোবাসার অমৃত সরোবরে নিশ্চিত হৃদয়া স্বচ্ছন্দ বিহারিণী ছিলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। আভিজাত্যের ঔদ্ধত্য বা ক‚টনীতির বক্রতা তার চরিত্রে কখনও ছায়াপাত করে নি। মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট অভিজাত মির্জা ইরাজ খাঁর কন্যা লুৎফুন্নেসা বাংলার পতন যুগের ইতিহাসে সরলতা, পবিত্রতা ও পতিপ্রেমের জন্য স্মরণীয়া হয়ে আছেন।
শ্রদ্ধাবোধ : প্রাসাদে নিজের কক্ষে তিনি খালা শাশুড়ি ঘসেটি বেগমকে প্রবেশ করতে দেখে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সালাম করে বলেন, তিনি তাকে মায়ের মতো ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। এ সরলা নবাব-পতœী ঘসেটিকে এ কথাগুলো বলেন তাঁর নিজের কক্ষে তাঁর ও আমিনা বেগমের সামনে সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটির প্রচণ্ড বিষোদগারের পরের মুহূর্তে। রাজনীতির কুটিল আবর্তের বাইরে সাধ্বী রমণীর এসব উক্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র কপটতা ছিল না।
বিশ্বস্ত : ঘসেটি বেগম সিরাজ সম্পর্কে অনেক অশ্রাব্য কটূক্তি করার পরও লুৎফুন্নেসার স্বাভাবিক চরিত্র মাধুর্যের ওপর বিন্দুমাত্র ছায়াপাত ফেলে নি। পতিগতপ্রাণা লুৎফুন্নেসা ধীর প্রশান্ত বাক্যে খালা শাশুড়ি ঘসেটিকে নিশ্চিত আশ্বাস দিয়েছেন যে, নবাব তার কাছ থেকে যে-টাকা নিয়েছেন তা অবশ্যই ফেরত দেবেন।
চিরন্তন বাঙালি নারী : সিরাজের সাথে ঘসেটি বেগমের যে-কথা কাটাকাটি হয় ঘসেটি বেগম তাতে নিজেকে অপমানিত বোধ করেন। কথাটা তিনি সরলভাবে স্বামীকে অবহিত করেছেন। সিরাজ তখন তাকে ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝিয়ে বলেন। লুুৎফুন্নেসা তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বামীর কাছে ক্ষমা চান। নবাবের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি লুৎফুন্নেসার হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি প্রস্তাব করেছেন, নবাব সমস্ত দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তার কাছে দুএকদিন যেন বিশ্রাম করেন। লুৎফুন্নেসা স্বামীর বিশ্রাম কামনা করেছেন, ব্যাকুলভাবে চেয়েছেন স্বামীকে নিজের কাছে একান্তভাবে পেতে। কিন্তু সেনাপতি মোহনলালের কাছ থেকে জরুরি খবর পেয়ে নবাব দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন লুৎফুন্নেসার কামরা থেকে। দুফোঁটা অশ্র“ গড়িয়ে পড়ে লুৎফুন্নেসার দুগাল বেয়ে। লুৎফুন্নেসার এ চিরন্তনী নারী-মূর্তি সত্যিকার প্রশংসার দাবিদার।
প্রেরণাদাত্রী : পলাশির যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নবাব দরবারে সমবেত জনগণকে শত্র“র আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তাঁর পাশে দাঁড়াবার জন্য ব্যাকুল আবেদন জানান। কিন্তু তার সে-আবেদনে কেউ সাড়া দেয় নি। সেনাপতি মোহনলালের বন্দি হওয়ার সংবাদ শুনে নবাব যখন মর্মাহত, তখন সবাই দরবার থেকে একে একে বেরিয়ে যায়। তখন হাতাশাপীড়িত অসহায় নিঃসঙ্গ নবাবের পাশে এসে দাঁড়ান বেগম লুৎফুন্নেসা। তিনি স্বামীকে বলেন, ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই।
প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী : লুৎফুন্নেসা ছিলেন নবাবের সত্যিকার জীবনসঙ্গিনী। দুর্দিনের ঘনীভূত অন্ধকারেও তিনি স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন, বলেছেন- ভেঙে পড়া চলবে না। তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে দূরে নির্ভরযোগ্য বন্ধুদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেবার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন নবাবকে, সেখান থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বিদ্রোহীদের শাস্তি বিধানের কথাও তিনি বলেছেন। স্বামীর নিরাপত্তার জন্য এ সাধ্বী রমণী অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাই দেরি না করে প্রাসাদ ত্যাগ করতে তিনি স্বামীকে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি নিজেও প্রাসাদে থাকতে রাজি হননি। নবাব তাকে বলেছিলেন, মানুষের দৃষ্টি থেকে চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে তাকে পথ চলতে হবে পাটনার পথে। লুৎফুন্নেসা সে কষ্ট সইতে পারবেন না। প্রত্যুত্তরে পতিগতপ্রাণা রাজমহিষী লুৎফুন্নেসা বলেছিলেন, তিনি সে কষ্ট সহ্য করতে পারবেন, তাকে পারতেই হবে এবং তিনি নবাবের সহগামিনী হয়েছিলেন।
উপসংহার : লুৎফুন্নেসা রমণী-রতœ। বাংলার পতনের যুগে নারীত্ব যখন ধূলায় লুণ্ঠিত, মানবতা ও মনুষ্যত্বের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত যখন বিলুপ্ত, তখন লুৎফুন্নেসা নারীত্বের জয় ঘোষণা করেছেন। তিনি চিরন্তন নারীত্বের অম্লান প্রতীক।
ঘসেটি বেগম
ভূমিকা : ঘসেটি বেগম নবাব আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। তার স্বামী ছিলেন ঢাকার দেওয়ান। কিন্তু বিলাসী নবাব-জামাতা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে আসতেন না। তার অবর্তমানে ঢাকায় শাসনকার্য চালাতেন রাজা রাজবল­ভ। স্বামীর মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগম বাস করছিলেন মতিঝিলে নিজের প্রাসাদে। নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম নিজের পালিত পুত্র শওকতজঙ্গকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, অপুত্রক নবাব আলিবর্দীর মৃত্যুর পরে অপদার্থ ভাংখোর শওকতকে নামেমাত্র বাংলার মসনদে বসিয়ে নিজেই দেশ শাসন করবেন। তখন তার অনুগ্রহভাজন রাজা রাজবল­ভ বাংলার শাসনকার্য চালাবেন তার হয়ে। কিন্তু নবাব আলিবর্দী মৃত্যুর আগে সিংহাসন দিয়ে যান তাঁর যোগ্যতম দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে। ফলে ঘসেটির লালিত স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি সিংহাসন লাভেব্যর্থ হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠেন সিরাজের বিরুদ্ধে। অজস্র অর্থ ব্যয় করে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলেন নবাবের বিরুদ্ধে। মিরজাফর, রাজবল­ভ, জগৎশেঠ প্রমুখ প্রভাবশালী আমির-ওমরাহদের নিজের বাড়িতে ডেকে এনে তিনি ষড়যন্ত্র করছিলেন শওকতজঙ্গকে বাংলার মসনদে বসাবার জন্য। সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করতে শওকতকে যে-যুদ্ধ করতে হবে তা পরিচালনা করবেন পরোক্ষে থেকে তিনি; তিনিই তাঁর ব্যয়ভার বহন করবেন; অর্থ দিয়ে, সৈন্য দিয়ে, মৌখিক অনুমোদন দিয়ে শওকতের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন আমির-ওমরাহরা।
ষড়যন্ত্রকারী : এ ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য নাচ-গানের জলসার আড়ালে গোপন বৈঠক হয় ঘসেটির মতিঝিল প্রাসাদে। দেউড়িতে কড়া পাহারা দেয় সশস্ত্র প্রহরী। ঘসেটি বেগম সমবেত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শওকতকে নবাব করার জন্য কে কী পুরস্কার চান তা জানতে চান। জগৎশেঠ বলেন, সিরাজের বিরুদ্ধে শওকতজঙ্গকে তারা তো ইতোমধ্যে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছেন। তবে শওকত নবাব হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কী পাবেন তা তিনি স্পষ্টভাবে জানতে চান। তিনি বলেন, শওকতজঙ্গ নবাবী পেলে বেগম সাহেবা ও রাজা রাজবল­ভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘœ হবে, অন্যদের তেমন কোনো আশা নেই। তাই তাদের পক্ষে নগদ কারবারই তিনি ভালো মনে করেন। তিনি নগদ টাকা চান না, যুদ্ধের খরচ বাবদ টাকা তিনি সাধ্য মতো দেবেন; কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে তাকে একটা কর্জনামা লিখে দিলেই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। এভাবে যখন আলোচনা অগ্রসর হচ্ছিল, তখন হঠাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার গোপন বৈঠকের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে অসাধারণ বুদ্ধিমতী ঘসেটি বেগম মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
হীনবুদ্ধি নারী : ঘসেটির বুকে কঠিন আঘাত হেনে নবাব তাঁর খালাআম্মা ও উপস্থিত সবাইকে জানিয়ে দেন, তিনি শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তাকে শায়েস্তা করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠিয়েছেন। তিনি নিজে এসেছেন তাঁর শ্রদ্ধেয়া খালাআম্মাকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে যেতে। বুদ্ধিমতী নারী বুদ্ধির খেলায় নিজের কোলে-পিঠে মানুষ করা বোনপোর কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েন। ক্ষোভে-দুঃখে তিনি পাগলিনী হয়ে যান। তিনি মুখের খোলস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রকাশ্যে উপস্থিত ওমরাহদের সাহায্য কামনা করেন। তিনি একজন অসহায় বিধবা। তার ওপর সিরাজ ওভাবে অত্যাচার করছে জানিয়ে তিনি রাজবল­ভ, জগৎশেঠ প্রমুখ ব্যক্তিদের সাহায্য কামনা করেন। দুঃখে, হতাশায়, আশা ভঙ্গের বেদনায় রমণী সিরাজকে অভিশাপ দেন। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এ উচ্চাভিলাষী রমণীর সকল আশার সমাধি রচনা করে নবাবের আদেশে মোহনলাল তাকে সসম্মানে নিয়ে যান নবাবের প্রাসাদে, নবাব-জননী তার ছোটবোন আমেনা বেগম আর নবাব মহিষী লুৎফুন্নেসার কাছে।
উচ্চাভিলাষী : ঘসেটি বেগম ছিলেন উচ্চাভিলাষী, বাংলার শাসনকার্যে কর্তৃত্ব লাভের জন্য অতিমাত্রায় উৎসাহিনী। তার উচ্চাভিলাষ পূরণের পথে একমাত্র অন্তরায় সিরাজের উচ্ছেদ সাধনে তিনি বদ্ধপরিকর। লুৎফুন্নেসার সশ্রদ্ধ সালামের প্রত্যুত্তরে এই ঈর্ষাপরায়ণা রমণী তাঁকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করতে পারেন নি। বলেছেন, তাকে সুখী ও সৌভাগ্যবতী হবার দোয়া করলে তা তার নিজের পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি সিরাজের সর্বনাশ কামনা করেন, বাংলার সিংহাসন থেকে তাঁকে বিতাড়িত করবার জন্য তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন। অথচ- ছেলেবেলায় সিরাজকে তিনিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন, সিরাজ জননী সে-কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি তাঁকে বলেন, “অদৃষ্টের পরিহাস তাই ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম বড় হয়ে সে একদিন আমার সৌভাগ্যের অন্তরায় হবে, যদি জানতাম অহরহ সে আমার দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে, জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি সে গ্রাস করবে রাহুর মতো, তাহলে দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতাম না।”
উপসংহার : ঘসেটি বেগম ঈর্ষা করতেন সিরাজকে এবং সে কারণে তার ঈর্ষার আগুনে তিনি দগ্ধ করেছেন আমিনা বেগমকে, নবাব মহিষী লুৎফুন্নেসাকে। সিরাজ বাংলার নবাব আর তিনি তাঁর প্রজা এ ধারণাটা তার কাছে ছিল একান্ত অসহ্য। নবাব তাকে নিজের প্রাসাদে এনে আবদ্ধ করে রেখেছেন, দেশের অশান্তি দূর না হওয়া পর্যন্ত বাইরের কারও সাথে যাতে তিনি যোগাযোগ করতে না পারেন সে ব্যবস্থা করেছেন। নবাবের এ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ সময়োপযোগী, কিন্তু ঘসেটি বেগম তাতে ভীষণ ক্ষুব্ধ। নিজের ঈর্ষার আগুনে তিনি জ্বলে-পুড়ে মরেছেন, নবাব আর তার স্নেহময়ী জননী আর প্রেমময়ী পতœীকে পুড়িয়ে মেরেছেন, বাংলার ভাগ্যও সে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বাংলার সমকালীন ইতিহাসে ঘসেটি বেগম ছিলেন মূর্তিমতী অভিশাপ।


অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন \১\ নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
ক. কোম্পানির ঘুষখোর ডাক্তার কে?
খ. ‘ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. উদ্দীপকের শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আংশিক ভাব ধারণ করেছে মাত্র” মূল্যায়ন কর। ১



১ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 কোম্পানির ঘুষখোর ডাক্তার হলওয়েল।
ছ অনুধাবন
 নবাব সিরাজের কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি প্রশ্নের বক্তব্যে প্রকাশিত হয়েছে।
 সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তার আত্মীয় তথা কাছের মানুষগুলো তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে শুরু করে। তার সাথে যোগ দেয় কোম্পানির প্রতিনিধিরা। প্রত্যেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নবাবের পতন কামনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় নবাবের খালা ঘসেটি বেগম, সেনাপতি মিরজাফর, রাজবল­ভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। এবং নবাবের পতনকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে। বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে স্ত্রীর কাছে নবাব সিরাজ উক্তিটি করেছেন।
জ প্রয়োগ
 শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম নাটকের নবাব সিরাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 পিতা জয়নুদ্দিন ও মাতা আমিনা বেগমের জৈষ্ঠ্য পুত্র সিরাজ ছিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খাঁর নয়নের মণি। তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা, দৃঢ়চেতা ও দেশপ্রেমিক যুবক। প্রজ্ঞা ও কর্তব্যপরায়ণয়তা, তেজস্বীতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অনন্যতা দান করেছে।
 উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন দেশপ্রেমিক নেতা। দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। তাঁর আহŸানে সাড়া দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি আজ স্বাধীন ভূ-খণ্ড পেয়েছে। এজন্যে দেশে যতদিন পদ্মা মেঘনা, যমুনা, গৌরী নদী প্রবাহিত হবে ততদিন বাঙালি জাতি তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। নাটকের নবাব সিরাজও ছিলেন এমনই একজন দেশপ্রেমিক নেতা। তিনি এদেশের মাটিকে, মানুষকে, প্রকৃতিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি কোনো কিছুর বিনিময়ে স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে চাননি। বিদেশি ইংরেজরা প্রজাদের উপর পীড়ন করলে সেটা কঠোর হাতে দমন করেছেন। জীবনের শেষ বেলাতেও তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালির মঙ্গল কামনা করে গেছেন।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আংশিক ভাব ধারণ করেছে মাত্র।”  কথাটি সত্যি।
 ঐতিহাসিক নাটকের চরিত্র চিত্রণে নাট্যকারের সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সিকান্দার আবু জাফর নীতিকে লঙ্ঘন না করে সিরাজ চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যে।
 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার প্রাণের পুরুষ। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালি বাংলাকে স্বাধীন করেছে দখলদার পাকিস্তানিদের হাত থেকে। তিনি জীবনভর চেয়েছেন বাংলা ও বাঙালির সমৃদ্ধি। তাই তিনি মরে গিয়েও বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছেন। যতদিন পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান থাকবে ততদিন বাঙালি মহান দেশনেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর এই দেশপ্রেমের বিষয়টি নাটকের নবাব সিরাজের মাঝে উপস্থাপিত হয়েছে বটে তবে এটিই নাটকের একমাত্র দিক নয়।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত হলেও এখানে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনা সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নাট্যকার এদেশের অতীত ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন তাঁর নাটকের মাধ্যমে। এখানে ইংরেজদের আচরণ, কৌশল ও শোষণ নীতি, নবাবের আত্মীয়দের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা, নবাবের পরাজয় ও করুণ মৃত্যু, ইংরেজদের পুতুল সরকার হিসেবে মিরজাফরের ক্ষমতা গ্রহণ বিষয় উঠে এসেছে যা উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়নি। এজন্যে প্রশ্নের বক্তব্যটি সত্য বলে মনে হয়।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন\ ২\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
মনে হয় সিরাজ-চরিত্রের দুর্বলতাটুকু নাট্যকার জাতীয় বীরের চরিত্র থেকে সযতেœ বিসর্জন দিয়েছেন। সিংহাসন পাবার পর সিরাজ-চরিত্রের আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। সেই পরিবর্তিত স্বাধীনতা পিয়াসী বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার চরিত্রই গিরিশচন্দ্র ঘোষ গভীর সহানুভূতি ও নিবিড় শ্রদ্ধার সঙ্গে অঙ্কিত করেছেন। ষড়যন্ত্র-লোলুপ ক্ষমতাপিপাসু অমাত্যবর্গের ঘৃণ্য মন্ত্রণা ও বিদ্রোহী মনোবৃত্তি সিরাজের অন্তর বিক্ষুব্ধ করে তুলল।
ক. ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে প্রধান-অপ্রধান মিলে মোট কতটি চরিত্র রয়েছে?
খ. “সিরাজউদ্দৌলা’ একটি ঐতিহাসিক নাটক”Ñ ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের সিরাজ-চরিত্রটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের সমালোচনাটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নাট্যকারের কাছে পূর্ণতা পেয়েছে।” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর। ১



২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে প্রধান-অপ্রধান মিলে মোট ৪০টি চরিত্র রয়েছে।
ছ অনুধাবন
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি ঐতিহাসিক, কারণ ইতিহাসকে আশ্রয় করে এটি রচিত হয়েছে।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ঐতিহাসিক সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। ইংরেজদের এদেশে আগমন, বাণিজ্যের প্রসারতা এবং এদেশের নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ, সিরাজের সিংহাসন আরোহণ, ষড়যন্ত্রের জালে আটক হওয়া, ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষ এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হওয়া নাটকের প্রধান বিষয়বস্তু। ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠা রেখে নাট্যকার নানা ঐতিহাসিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে এটি রচনা করেছেন। তাই এটিকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায়।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের সিরাজ চরিত্রটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক, প্রজাবৎসল নেতা। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানবিক গুণাবলি, কর্তব্যনিষ্ঠা তাঁকে মহিমান্বিত করেছে। তাঁর পরাজয়ের সাথে সাথে প্রায় দুশো বছরের জন্যে বাংলার তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
 উদ্দীপকের সিরাজ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে আমরা অবলোকন করি নাট্যকার তাঁর চরিত্রের সমস্ত দুর্বলতা বিসর্জন দিয়ে বীরের গুণাবলি দ্বারা ভরিয়ে তুলেছেন। তাঁকে স্বাধীনতাপিয়াসী দেশ নেতা হিসেবে অঙ্কিত করেছেন নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। সিকান্দার আবু জাফরও তার্ঁ নাটকে সিরাজ চরিত্রটিকে গভীর সহানুভূতি ও অসামান্য শিল্প সৌন্দর্যে অঙ্কিত করেছেন। একজন মহান বীরের যাবতীয় গুণাবলি তিনি সিরাজ চরিত্রে অঙ্কন করেছেন। উভয় ক্ষেত্রে এখানেই সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের সমালোচনাটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে পূর্ণতা পেয়েছে।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 “বিভিন্ন বাঙালি নাট্যকার বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বিভিন্ন গুণ-বৈশিষ্ট্যে নায়ক চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর চরিত্রে একদিকে ঔদার্য ও কোমলতা অন্যদিকে বীরত্বব্যঞ্জক মনোভাবের সম্মিলন দেখা যায়।
 উদ্দীপকের সমালোচকের বর্ণনায় দেখা যায় নাট্যকার সিরাজ চরিত্রের ঐতিহাসিক দুর্বলতাটুকু সযতেœ বিসর্জন দিয়েছেন। সিংহাসন লাভ করার পরে সিরাজ চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটান। তাঁকে স্বাধীনতাপিয়াসী বাংলার শেষ নবাব হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন নাট্যকার গভীর সহানুভূতি ও নিবিড় শ্রদ্ধার সঙ্গে। নাট্যকারের এই মনোভাবটি যেন পূর্ণতা পেয়েছে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফরের কাছে।
 নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফর সিরাজউদ্দৌলাকে বীরের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। জাতীয় চেতনাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করে তিনি চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন তাঁর নাটকে। ইতিহাসের বিভ্রান্তি এড়িয়ে ঐতিহ্য এবং প্রেরণার উৎস হিসেবে সিরাজকে তিনি নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন। ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজের যে অকৃত্রিম বিশ্বাস, তার চরিত্রের দৃঢ়তা এবং মানবীয় গুণাবলিকেই নাট্যকার তাঁর নাটকে তুলে ধরেছেন। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।

প্রশ্ন\ ৩\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুণœ রাখতে চেষ্টা করেছে। আজ বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করেছে, যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, ইতিহাসে তা থাকবে স্বর্ণ-লেখায় লিখিত। বাংলা সর্ব ঐশীশক্তির পীঠস্থান। হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী মুনি ঋষি তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি; সহস্র ফকির-দরবেশ-অলি- গাজির দরগা পরম পবিত্র। হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খঘণ্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা-মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী, নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র। [সূত্র : বাঙালির বাংলাÑকাজী নজরুল ইসলাম]
ক. ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে মোট কতটি দৃশ্য রয়েছে?
খ. ‘যুদ্ধ বন্ধ করবার আদেশ দিন, ক্যাপ্টেন ক্লেটন।’ ওয়ালী খান কেন যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ করেন?
গ. উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন ভাবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা কর। ৩
ঘ. “উদ্দীপকটির ভাব ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটিমাত্র ভাবকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র, সম্পূর্ণ ভাবকে নয়।” যথার্থতা বিচার কর। ১



৩ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে মোট ২২টি দৃশ্য রয়েছে।
ছ অনুধাবন
 ইংরেজদের পক্ষে লড়াইরত বাঙালি সৈনিক নবাব সৈন্যের ক্ষিপ্রতা ও ক্ষমতা আঁচ করতে পেরে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ করেন।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেন ইংরেজদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যে। আক্রমণের তীব্রতায় ইংরেজদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এবং পরাজয় নিশ্চিত জেনে ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধরত বাঙালি সৈন্য ওয়ালী খান ক্যাপ্টেন ক্লেটনকে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ করেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বর্ণিত বাঙালির স্বাধীনতাপিয়াসী চেতনা ও এদেশের অপার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 বাংলার রূপ চিরন্তন। এদেশের প্রকৃতির মতোই এদেশের মানুষের হৃদয় কোমল। কিন্তু তারা যখন দেশমাতৃকার অসম্মান দেখে তখনই কঠিন হয়ে দেশের সম্মান রক্ষা করার জন্যে জেগে ওঠে। অসীম সাহসে পরিস্থিতির মোকাবেলা করে।
 উদ্দীপকে বর্ণিত হয়েছে চিরন্তন বাংলা ও বাঙালির চেতনার কথা। বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগে স্বাধীনতাকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে আত্মদান করেছে। উদ্দীপকের এই ভাবটি পরিলক্ষিত হয় ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথমেই। সেখানে বলা হয়েছে এক স্বাধীন বাংলা থেকে আর এক স্বাধীন বাংলায় আসতে বাঙালিকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নবাব সিরাজের জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনী আমাদের আলোড়িত করে। যিনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে জীবনে করুণ পরিণতির শিকার হন। এভাবটিই উদ্দীপকে উঠে এসেছে।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটিমাত্র ভাবকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র, সম্পূর্ণ ভাবকে নয়।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 দেশমাতৃকার প্রশ্নে বাঙালি সবদিনই আপোষহীন। যে-কোনো মূল্যে দেশের সম্মান রাখতে তারা বদ্ধপরিকর। বাঙালির অতীতের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস আমাদের এই তথ্যই প্রদান করে।
 উদ্দীপকে বর্ণিত হয়েছে বাংলার অপরিমেয় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সম্পদের কথা। আছে বাঙালির সাহসের কথা। এরা শুধু লাঠি দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা করেছে। এদেশের আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা-মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বাঙালির এই বৈশিষ্ট্য অঙ্কনের পাশাপাশি আরও অনেক বিষয় অঙ্কিত হয়েছে।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বর্ণিত হয়েছে এদেশের সম্পদের মোহে ইংরেজদের আগমন, অবস্থান, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, বাংলার নবাবের সাহসিকতা এবং ষড়যন্ত্রের ফলে আটকা পড়ে জীবনের করুণ পরিণতির কথা। এ বিষয়গুলোর শুধু বাংলার সম্পদ ও বাঙালির সাহসের দিকটি ছাড়া উদ্দীপকে অন্য সব বিষয় অনুপস্থিত। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
[
প্রশ্ন\ ৪\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে কদমতলী ও শিমুলতলী গ্রাম দুটির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বাঁধে। কদমতলীর লোকজন অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও নিরীহ শিমুলতলী গ্রামবাসীর ঘরবাড়ি লুট করতে আসে। শিমুলতলী গ্রামের লোকজন একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে কদমতলীর দখলদাররা সিংহের মতো হুংকার দিলেও প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। শিমুলতলীর আতা খাঁ মন্তব্য করেন কদমতলীরা সিংহ হয়ে এসে বিড়াল হয়ে পালিয়ে গেছে।
ক. কে দুর্গে সাদা নিশান ওড়াতে বলে গেল?
খ. ‘আমি সব খবর রাখি হলওয়েল’Ñ সিরাজ এ উক্তিটি কেন করেছেন?
গ. উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন বিষয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটি খণ্ডাংশের ধারক মাত্র।” যথার্থতা বিচার কর। ১



৪ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 জর্জ দুর্গে সাদা নিশান ওড়াতে বলে গেল।
ছ অনুধাবন
 ইংরেজদের সব অপকর্মের কথা জানতে পেরেছেন নবাব সিরাজ কিন্তু হলওয়েল সেটা অস্বীকার করলে নবাব উক্ত উক্তিটি করেন।
 ইংরেজদের কাশিমবাজারে অস্ত্র আমদানি, প্রজাদের প্রতি অত্যাচার, নবাবের নির্দেশ অমান্য করা প্রভৃতি কারণে নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেন এবং ইংরেজদের পরাজিত করেন। সেখানে উপস্থিত ইংরেজদের ঘুষখোর ডাক্তার হলওয়েলের কাছে এসব অপকর্মের কৈফিয়ত চাইলে সে নবাবের সামনে এসব অস্বীকার করে। জবাবে নবাব উক্ত কথাটি বলেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাবের সৈন্যের সাথে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ইংরেজদের যুদ্ধের ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 ইংরেজরা এদেশে ব্যবসা করার নাম করে আসলেও ক্রমে তারা তাদের আধিপত্যের জাল বিস্তার করার কাজে মনোনিবেশ করে এবং এক পর্যায়ে ছলে বলে কৌশলে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করে।
 উদ্দীপকে দেখা যায় দখলদার কদমতলী গ্রামবাসীর সাথে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিমুলতলী গ্রামের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে দখলদারদের গুটিয়ে দেয়। কদমতলীর লোকজন ক্ষমতার বড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে বিতাড়িত হয়। এমনই চিত্র দেখি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে যুদ্ধের সময় ইংরেজ সেনাদের অনেক বড়াই দেখি কিন্তু নবাব সৈন্যের ক্ষিপ্রতা ও শক্তির সামনে তারা দাঁড়াতে না পেরে পলায়ন করে জাহাজে আশ্রয় নেয়। উভয় স্থানে এই বিষয়ের সাদৃশ্য রয়েছে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটি খণ্ডাংশের ধারক মাত্র।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 ইংরেজরা এদেশে বাণিজ্য করতে এসে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের ক্ষমতা লোভী মনোভাব আস্তে আস্তে প্রকাশ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা এদেশ শাসন করার স্বপ্ন দেখে এবং কালের বিবর্তনে তাদের সেই স্বপ্ন সফল হয়।
 উদ্দীপকে দেখা যায় ইংরেজদের দখলদারী চেহারার প্রতিরূপ কদমতলী গ্রামের লোকজনদের মাঝে। তারা শিমুলতলী গ্রামে হামলা চালায় লুটপাট করার জন্যে। এবং এক পর্যায়ে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। উদ্দীপকের এই ঘটনাটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের দখলদারী ইংরেজদের সাথে নবাব সেনাদের যুদ্ধের বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়।
 নাটকে এই ঘটনার চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি আরও অনেক চিত্র উঠে এসেছে। যেমনÑ পরাজয়ের পর ইংরেজদের কৌশলগত পরিবর্তন, নবাবের পরিজনদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা, নবাব সেনাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়-পরিজনদের ষড়যন্ত্র, নবাবের পতন, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের পুতুল নবাব হওয়া প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে যা উদ্দীপকে আলোচিত হয়নি। তাই বলা যায় উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটি খণ্ডাংশের ধারক মাত্র। মন্তব্যটি যথার্থ।

প্রশ্ন\ ৫\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
নজীব্ : তুমি বরাবরের মতোই অবুঝ! আর কি ফেরবার জো আছে, জরিনা? ঘরে বসে থাকবো কী করে? আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি।
জরিনা : যুদ্ধ শুরু হবে কাল রাতে। আপনি আজ বেরুচ্ছেন কেন? ...........
নজীব : আমার নিজস্ব বাহিনীর একটু তদারক করা দরকার। .........
জরিনা : অন্য কেউ যাক। আপনি আমার তদারক করুন। আমাদের জাগিয়ে রাখুন। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে যান। ........
নজীব : কী করতে বলো?
জরিনা : আমার কাছে থাকুন। আমার সামনে ঘুমোন। আমি বসে বসে দেখি। [সূত্র : রক্তাক্ত প্রান্তর Ñ মুনীর চৌধুরী।]

ক. ইংরেজদের পক্ষে কতজন সৈন্য ছিল?
খ. ‘সমস্ত দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কাছে দু একদিন বিশ্রাম করুন।’Ñ ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের জরিনা চরিত্রের সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের লুৎফার সাদৃশ্য দেখাও।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আংশিক ভাবের ধারক।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



৫ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ইংরেজদের পক্ষে তিন হাজার সৈন্য ছিল।
ছ অনুধাবন
 প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলার চারদিকে ষড়যন্ত্রের দেয়াল উঠেছে। আত্মীয় পরিজন এবং নিজের অমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাস-ঘাতকতায় তিনি ক্লান্ত। তার চারদিকে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে সিরাজ বিচলিত। নিজের সেনাপতিও তার পক্ষে যুদ্ধ করবে কিনা তিনি নিশ্চিত নন। তার এই বিচলিত ভাব দেখে তাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে তার প্রেমময়ী স্ত্রী লুৎফুন্নেসা তাকে উক্ত কথাটি বলেন। যাতে স্বামীর প্রতি সহানুভূতি, প্রেরণা এবং ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের জরিনা চরিত্রের সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের লুৎফা চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।
 নারীর ভালোবাসা পুরুষকে উন্নত, মহান, মহিমান্বিত করে। কোনোদিন কোনো কালে পুরুষ একা কোনো কিছু করতে পারেনি। সেখানে প্রেরণা, সাহস, শক্তি দিয়েছে নারীরা।
 উদ্দীপকের জরিনা স্নেহময়ী প্রেমময়ী একজন নারী। যে স্বামীর অমঙ্গল চিন্তায় সদা চিন্তিত থাকেন। স্বামী যাবেন যুদ্ধে তার আগে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করেন তিনি। তিনি চান স্বামী তার কাছে থেকে সমস্ত ক্লান্তি দূর করেন। জরিনার এই মনোভাব লক্ষ করি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের লুৎফা চরিত্রে। তিনিও নবাবের দুশ্চিন্তার মুহূর্তে নবাবকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতে চান। তাইতো তিনি নবাবকে তার কাছে একটি রাত বিশ্রাম করার অনুরোধ করেন। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আংশিকভাবে ধারক।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 পুরুষ ও নারী একে অন্যের পরিপূরক। তারা দুজনে মিলেই এই সৃষ্টিকে ধরে রেখেছে। এই মানব সভ্যতা নির্মাণে একে অন্যকে সাথে নিয়েই পূর্ণতা দান করেছে। সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা একাত্ম হয়ে জগৎ-সংসারকে মহিমান্বিত করেছে।
 উদ্দীপকের জরিনার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার পরিচয় আমরা পাই। তিনি চান তার স্বামী তার কাছে থেকে সমস্ত ক্লান্তি দূর করেন। কাজের নতুন উদ্দীপনা পান। যুদ্ধের ময়দান থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন। উদ্দীপকের এই ভাবটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটি মাত্র দিক।
 এ দিকটি ছাড়াও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বর্ণিত হয়েছে উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন, এদেশে তাদের স্বার্থের শিকড় গাঁথা, নবাবের বিরুদ্ধে তার আত্মীয় পরিজনদের ষড়যন্ত্র। স্ত্রীর প্রতি নবাবের ভালোবাসা, স্ত্রী লুৎফার স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেম, পলাশী যুদ্ধ, সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা, সর্বোপরি নবাবের পরাজয় এবং নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের ক্ষমতা গ্রহণ, ইংরেজদের সাথে সখ্যতা ইত্যাদি বিষয় অঙ্কিত হয়েছে। উদ্দীপকে শুধু নবাব সিরাজের প্রতি স্ত্রী লুৎফার ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
প্রশ্ন\ ৬\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
কহিলা বীরেন্দ্র বলী, “ধর্মপথগামী
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি’ কোন ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি, Ñএ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ
ক. মিরজাফর কোথা থেকে ভারতবর্ষে আসেন?
খ. ‘আপনাদের দেশে আবার শান্তি আসলো’Ñক্লাইভ এ কথা কেন বলেছে?
গ. উদ্দীপকের রাক্ষসরাজানুজ ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আংশিক ভাবকে ধারণ করেছে মাত্র।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



৬ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 মিরজাফর পারস্য দেশ থেকে ভারতবর্ষে আসেন।
ছ অনুধাবন
 মিরজাফর মসনদে বসার পর ক্লাইভ মিরজাফরকে খুশি করার জন্য উক্তিটি করে।
 অমাত্যবর্গ, সেনাপতি ও আত্মীয় পরিজনের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে নবাব সিরাজের পরাজয় ঘটে এবং বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মিরজাফর বাংলার মসনদে বসেন। নতুন নবাবকে উপঢৌকনসহ অভিবাদন জানাতে এসে সুচতুর ক্লাইভ বলে স্বৈরাচারী নবাবের পতনের পর নতুন শাসকের আগমনে বাংলায় আবার শান্তি ফিরে আসল।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের রাক্ষসরাজানুজ অর্থাৎ ‘বিভীষণ’ প্রতিনিধি।
 সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধাবোধ করে না। তারা নরকের কীটেরও অধম। অথচ এমন মানুষেই জগৎ-সংসার ভরে আছে। পৃথিবী আজ তাদের পদভারে প্রকম্পিত।
 উদ্দীপকের রাক্ষসরাজানুজ অর্থাৎ ‘রামায়ণ’ কাব্যের বিভীষণকে কবি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উত্থাপন করেছেন। যিনি নিজের জ্ঞাতি, ভাই, জাতি সকল কিছুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পরদেশি রাজের পক্ষে যোগ দেয়। এবং রামের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে মিরজাফরও একজন বিশ্বাসঘাতক। তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েও যুদ্ধের ময়দানে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং নবাব সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর পরাজয় ঘটান। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আংশিক ভাবকে ধারণ করেছে মাত্র।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 মানুষ একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকে। একে অন্যকে বিশ্বাস করে মানুষ স্বাভাবিকভাবে টিকে আছে। বিশ্বাস তাই মানুষের মহৎ গুণাবলির মধ্যে একটি। বিশ্বাসযোগ্য মানুষ সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে থাকেন। আর বিশ্বাস ভঙ্গকারীকে সবাই ঘৃণা করে।
 উদ্দীপকে একজন বিশ্বাসঘাতকের প্রতি ধিক্কার জানানো হয়েছে। তার কাছে জ্ঞাতি, ভ্রাতা, সর্বপোরি জাতির কোনো মূল্যায়ন হয়নি। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে সে পরদেশি হানাদারদের পক্ষ নেয় এবং নিজ ভাইয়ের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে। উদ্দীপকের এই বিষয়টি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটি দিককে নির্দেশ করে।
 নাটকে এই বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্রের বিষয়ের পাশাপাশি উঠে এসেছে এদেশে ইংরেজদের আগমন, তাদের উদ্দেশ্য, এদেশের মানুষের প্রতি অত্যাচার, নবাবের পারিষদ এবং আত্মীয়দের হাত করে ক্ষমতা লাভ, এবং একজন দেশপ্রেমিক শাসকের পরাজয় ও করুণ পরিণতি। উদ্দীপকে শুধু বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি ছাড়া অন্যান্য বিষয় অনুপস্থিত। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।

প্রশ্ন\ ৭\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
মোহনলাল : শুনলাম আজ এখানে ভারী জলসা হচ্ছে। বহু গণ্যমান্য লোক উপস্থিত আছেন। তাই খোঁজ নিতে এলাম।
মিরন : সেনাপতি মোহনলাল, আপনার দুঃসাহসের সীমা নেই। আমার প্রাসাদে কার অনুমতিতে আপনি প্রবেশ করেছেন?
মোহনলাল : প্রয়োজন মতো যে কোনো জায়গায় যাবার অনুমতি আমার আছে। সত্য বলুন এখানে গুপ্ত ষড়যন্ত্র হচ্ছিল কিনা?
মিরন : মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন সেনাপতি। জানেন এর ফল কী ভয়ানক হতে পারে? নবাবের সঙ্গে আব্বার সমস্ত গোলমাল সেদিন প্রকাশ্যে মিটমাট হয়ে গেল। নবাব তাঁকে বিশ্বাস করে সৈন্য পরিচালনার ভার দিয়েছেন। আর আপনি এসেছেন আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপবাদ নিয়ে। আমি এখুনি আব্বাকে নিয়ে নবাবের প্রাসাদে যাব।
মোহনলাল : প্রতারণার চেষ্টা করবেন না। (তরবারি কোষমুক্ত করল) আমার গুপ্তচর ভুল সংবাদ দেয় না। সত্য বলুন, কী হচ্ছিল এখানে? কে কে ছিল মন্ত্রণাসভায়?

ক. ‘আমার গুপ্তচর ভুল সংবাদ দেয় না।’ কথাটি কে বলেছেন?
খ. মোহনলাল কেন মিরনের জলসা ঘরে প্রবেশ করেন?
গ. উদ্দীপকের মোহনলাল এবং মিরনের চরিত্রের বৈসাদৃশ্য নিরূপণ কর।
ঘ. “সিরাজউদ্দৌলার আত্মীয় এবং পারিষদগণ মোহনলালের মতো বিশ্বাসী এবং দায়িত্বশীল হলে সিরাজকে অমন করুণ পরিণতির শিকার হতে হতো না।” মন্তব্যটি মূল্যায়ন কর। ১



৭ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 কথাটি বলেছেন নবাবের অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলাল।

ছ অনুধাবন
 তিনি খবর পেয়েছিলেন যে মিরন তার জলসা ঘরে বসে অন্যান্যদের সাথে ষড়যন্ত্র করছেন নবাবের বিরুদ্ধে তাই তিনি মিরনের জলসা ঘরে প্রবেশ করেন।
 মিরজাফরের পুত্র মিরন, মিরজাফর, ক্লাইভ, জগৎশেঠ প্রমুখ মিলে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কীভাবে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় সেই ফন্দি তারা আটতে থাকে। গুপ্তচরের কাছে এই খবর পেয়ে নবাব সিরাজের অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলাল মিরনের জলসা ঘরে প্রবেশ করে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া বানচাল করে দেন।

জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের মোহনলাল এবং মিরনের চরিত্রের ব্যাপক বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
 সুন্দর চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। বিশ্বস্ততা মানুষের সুন্দর চরিত্র গঠনের একটি অনিবার্য বিষয়। যে ব্যক্তি অপরের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারে না সে কখনোই সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না। বিশ্বাসঘাতককে কখনোই সুন্দর বা সুস্থ চরিত্রের লোক বলা যায় না।
 উদ্দীপকের মোহনলালের বিশ্বস্ততা আমাদের মুগ্ধ করে। নবাবের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। এজন্যে তিনি নবাবের কোনো ক্ষতি হতে দিতে চান না। তাই তিনি গুপ্তচরের মুখে খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন তার বিরুদ্ধে ঘটিত ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে। অপরপক্ষে মিরন একজন বিশ্বাসঘাতক মানুষ। সে এদেশের মানুষ হয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইংরেজদের সাথে হাত মেলায়। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে আপন দেশের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হন না এমনকি তার পিতার আশ্রয় দানকারীদের ধ্বংস করতে বুক কাঁপে না। উভয় চরিত্রের বৈসাদৃশ্য এখানেই।


ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “সিরাজউদ্দৌলার আত্মীয় পারিষদরা সেনাপতি মোহনলালের মতো বিশ্বাসী এবং দায়িত্বশীল হলে সিরাজকে এমন করুণ পরিণতির শিকার হতে হতো না।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 মানুষ যখন ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয় তখন নিজের অসীম সাহস বা শক্তি থাকা সত্তে¡ও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। তার বিপদ পদে পদে সংঘটিত হয়। এমনই অবস্থায় পতিত হতে দেখি সিরাজউদ্দৌলাকে।
 উদ্দীপকে দেখা যায় নবাব সিরাজের পতনের জন্যে তাঁরই পারিষদরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালকে এখানে দেখা যায় নবাবের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং দায়িত্ববোধে তিনি ছুটে আসেন ষড়যন্ত্রকারীদের মন্ত্রণাসভায়। মিরজাফরের পুত্র মিরন বিদেশি ইংরেজ এবং নিজ দেশের কিছু বিপথগামী মানুষদের নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।
 মোহনলালকে দেখি তাদের সেই মন্ত্রণাসভাকে ভণ্ডুল করতে তরবারি হাতে ছুটে আসতে। তিনি প্রাণপণে চান নবাবের তথা এই দেশের কল্যাণ। এই মোহনলালের মতো বিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল যদি নবাবের অন্যান্য পারিষদরা হতেন তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এমন করুণ পরিণতি মেনে নিতে হতো না। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
প্রশ্ন\ ৮\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ এবং হুগলী নদীর উপর আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে সতের শতকের শেষ প্রান্তে ইংরেজ কোম্পানি এদেশে যে শক্তির ভিত রচনার স্বপ্ন দেখেছিল পলাশী যুদ্ধে বিজয় অর্জন ছিল তারই অযৌক্তিক পরিণতি। এর তাৎপর্য নিয়ে কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করে পলাশীর পরাজয়কে জাতীয় গ্লানি মনে না করে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে মহিমান্বিত ‘সূর্য-উদয়কাল’ ভাবলেও ভাবতে পারেন।
ক. কে কলকাতার নাম আলীনগর রাখেন?
খ. নবাব সিরাজ প্রত্যেকটি ইংরেজের সমস্ত সম্পত্তি কেন বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিলেন?
গ. উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন বিষয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের লেখক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বর্ণিত ইংরেজদের নীতি ও কৌশলকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।” Ñমন্তব্যটি বিচার কর। ১



৮ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 কলকাতার নাম আলীনগর রাখেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
ছ অনুধাবন
 এদেশের সাধারণ নাগরিকের উপর জুলুম, অত্যাচার এবং নবাবকে না জানিয়ে দুর্গে শক্তি বৃদ্ধির কারণে নবাব সিরাজ প্রত্যেকটি ইংরেজের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিলেন।
 কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ জয় করার পর নবাব সিরাজ সেখানে অবস্থানরত ইংরেজদের বন্দি করেন। ইংরেজদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ইংরেজদের অবস্থানগুলো কামানের গোলায় উড়িয়ে দিতে নির্দেশ দেন। এবং এদেশের সাধারণ মানুষকে নির্দেশ দেন ইংরেজদের সাথে কোনো প্রকার সওদা না করার জন্যে। ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন এবং ইংরেজদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ইংরেজদের এদেশে এসে বাণিজ্য করার নামে আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 ইংরেজ জাতি নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে যে কোনো কাজে তারা নামতে পারে। এটা তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তাদের এই বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে। উদ্দীপক এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ইংরেজ চরিত্রের এ ভাবটি আলোচিত হয়েছে।
 উদ্দীপকে দেখা যায় ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ইংরেজ জাতি সতের শতকে এদেশে শক্তির ভিত রচনা করে এদেশকে শাসন করার স্বপ্ন দেখে। এবং সেটা ত্বরান্বিত হয় পলাশী যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে। উদ্দীপকের এই বিষয়টি উঠে এসেছে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। সেখানে দেখা যায় ইংরেজরা এদেশের বিভিন্ন দুর্গে শক্তি বৃদ্ধিপূর্বক এদেশের সাধারণ জনগণের উপর নানা প্রকার শোষণ নির্যাতন করতে করতে সবার মনে ভীতি সঞ্চার করে। এক সময় ছলে বলে কৌশলে এদেশের শাসন ব্যবস্থাকে হস্তগত করে যা উদ্দীপকের বিষয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের লেখক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বর্ণিত ইংরেজদের নীতি ও কৌশল তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন” মন্তব্যটি যথার্থ।
 ইংরেজরা এদেশে বাণিজ্য করার নাম নিয়ে আসলেও ক্রমে তারা এদেশে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এক পর্যায়ে এদেশ শাসনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তাদের নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করে এদেশে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়।
 উদ্দীপকে আলোচিত হয়েছে ইংরেজদের নীতি ও কৌশলের দিকটি। এখানে দেখা যায় প্রথমে হুগলী নদীর তীরে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ, সেখানে শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী করেছে এবং এদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে এখানকার মানুষকে লোভ দেখিয়ে ষড়যন্ত্র করে পলাশী যুদ্ধে জয়লাভ করে স্বপ্ন পূরণ করেছে। উদ্দীপকের এই ভাবটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ইংরেজদের নীতি ও কৌশল তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
 নাটকে দেখা যায় ইংরেজরা এদেশে প্রথমে বাণিজ্য করতে এসে এখানে তাদের শক্তির ভিত রচনা করে বিভিন্ন দুর্গে শক্তি বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে। ক্রমান্বয়ে তারা এদেশের ক্ষমতালোভী মানুষের ভিতর ঢুকে তাদের দ্বারা নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং হত্যা করে। পূরণ হয় তাদের বহুদিন ধরে দেখে আসা স্বপ্নটি। নাটকের এই বিষয়টি উদ্দীপকের লেখক তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
প্রশ্ন\ ৯\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালিরÑ আমাদের
দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়
তাড়াব আমরা, করি না ভয়
যত পরদেশি দস্যু ডাকাত
রামাদের গামাদের।
বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।
ক. ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে কতটি অধ্যায় রয়েছে?
খ. সিরাজউদ্দৌলা কেন ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার প্রত্যাহার করলেন?
গ. উদ্দীপকের ‘পরদেশি দস্যু ডাকাত’ ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে কাদের নির্দেশ করে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নাট্যকারের একটি খণ্ডিত চেতনাকে ধারণ করেছে।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



৯ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে মোট চারটি অধ্যায় রয়েছে।
ছ অনুধাবন
 নবাবকে না জানিয়ে ইংরেজরা কাশিমবাজার দুর্গে অস্ত্র আমদানি, নানা ধরনের নিষিদ্ধ কাজ এবং নবাবের শত্র“ কৃষ্ণবল­ভকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে নবাব ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার প্রত্যাহার করলেন।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের আচরণের প্রতি রুষ্ট হয়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেন এবং ইংরেজদের পরাজিত করেন। ইংরেজদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমনÑ কাশিমবাজার দুর্গে অস্ত্র আমদানি, এদেশের মানুষের প্রতি জুলুম, কৃষ্ণবল­ভকে আশ্রয় দান প্রভৃতি কারণে তাদের বাণিজ্য করার অধিকার প্রত্যাহার করেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের ‘পরদেশি দস্যু ডাকাত’ ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ইংরেজদের ধারণ করে।
 যুগে যুগে এদেশের সম্পদের মোহে আবিষ্ট হয়ে নানা ভিনদেশি এসেছে এদেশের সম্পদ হস্তগত করার জন্যে। তাদের মধ্যে অনেকে এদেশে এসে শাসন শোষণ করেছে। লুট করেছে এদেশের সম্পদ। অবশেষে এদেশের মানুষের প্রতিরোধে তারা পালাতে বাধ্য হয়েছে।
 উদ্দীপকের কবিতাংশে উঠে এসেছে এমনই চিত্র। আমাদের এই পবিত্র বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এখানে অনেক পরদেশি দস্যু ডাকাত হামলা করেছে। কিন্তু বাঙালি তাদের ভয় পায়নি। তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে বিতাড়িত করেছে। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে দেখা যায় ভিনদেশি ইংরেজরা এদেশে এসেছে সম্পদের লোভে। তারা নানা রকম অত্যাচার করেছে এদেশের মানুষের উপর। নাটকের এই ভাবটি উঠে এসেছে উদ্দীপকের দস্যু ডাকাতদের বর্ণনার মাঝে।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের একটি খণ্ডিত চেতনাকে ধারণ করেছে।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 বাঙালিরা প্রকৃতিগতভাবে কোমল ও নিরীহ স্বভাবের। এরা পারতপক্ষে কারও সাথে বিবাদে জড়াতে চায় না। তবে কেউ যদি তাদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করে তখন তারা রুখে দাঁড়ায়। বিতাড়িত করে তাদের শক্তি ও সাহস দিয়ে সে সব দুশমনদের।
 উদ্দীপকে ধারণ করা হয়েছে বাংলাদেশ ও বাঙালির চিরন্তন চেতনাকে। আমাদের এই পবিত্র বাংলাদেশে আমরা শান্তিপ্রিয় বাঙালি। কিন্তু পরদেশি দস্যু ডাকাতদের বাঙালি ভয় পায় না। প্রহারেণ ধনঞ্জয় বাঙালিরা তাদেরকে বিতাড়িত করে। উদ্দীপকের এই দস্যু ডাকাতদের খুঁজে পাই ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। নাটকে অন্যান্য কৈফিয়তও উঠে এসেছে।
 নাটকে পরদেশি ইংরেজদের এদেশে আগমন ছলে বলে কৌশলে এদেশের শাসনভার হস্তগত করার বিষয়টি ছাড়াও নাটকে বহুমুখী বিষয়ের অবতারণা ঘটেছে। এদেশে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের কলাকৌশল, এখানকার কিছু বিপথগামী লোভী মানুষের সহায়তা নিয়ে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পলাশী যুদ্ধে নবাবের পরাজয় এবং মৃত্যু, বাংলার মসনদে বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের অবস্থান ইত্যাদি বিষয় অঙ্কিত হয়েছে যা উদ্দীপকে নেই। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্যটি যথার্থ।
প্রশ্ন\ ১০\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
ইংরেজ জাতি প্রগতিশীলতার শীর্ষে অবস্থান করলেও তারা তাদের শোষণ নীতি অপরিবর্তিত রেখেছে। তাদের অতীত ইতিহাসও বলে দেয় তাদের এই হীন স্বার্থসিদ্ধির মনোভাবের কথা। পৃথিবীময় তাদের উপনিবেশ স্থাপন করার বাসনা নিয়ে তারা নানা দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়ে এবং স্বার্থসিদ্ধি করে।
ক. কিলপ্যাট্রিক কতজন সৈন্য নিয়ে হাজির হলেন?
খ. “লোকবল বাড়–ক আর না বাড়–ক আমাদের অংশীদার বাড়ল তা অবশ্য ঠিক।” ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকটির সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ইংরেজদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য নির্ণয় কর।
ঘ. “উদ্দীপকটিতে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সম্পূর্ণ ভাব উঠে আসেনি।” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর। ১



১০ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 কিলপ্যাট্রিক মাত্র আড়াইশ সৈন্য নিয়ে হাজির হলেন।
ছ অনুধাবন
 প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছে হ্যারি এবং এই কথাটির মাধ্যমে ইংরেজদের শোচনীয় অবস্থার বিষয়টি উঠে এসেছে।
 ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পতনের পর বিতাড়িত হয়ে ইংরেজরা ভাগীরথী নদীর উপর ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা চরম খাদ্য ও পানীয় সংকটে পড়ে। নবাব সেনাদের ভয়ে তারা কোনো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। সেই মুহূর্তে কিলপ্যাট্রিক মাদ্রাজ থেকে আড়াইশ সৈন্য নিয়ে হাজির হয়। বিষয়টি সেখানে অবস্থানরত সৈনিকদের মনে হতাশার সৃষ্টি করে। হ্যারির প্রশ্নোক্ত উক্তিতে সেটা প্রমাণিত।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকটির সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ইংরেজদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে।
 ইংরেজ জাতি সারা বিশ্বে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করেছে। যেখানে তারা শক্তিতে পারেনি সেখানে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। এমনিভাবে সারা পৃথিবীতে দুর্বল জাতির উপর তাদের শোষণের স্টীম রোলার চালিয়েছে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে।
 উদ্দীপকে ইংরেজ জাতির প্রগতিশীল মানসিকতার কথা উলে­খ করার পাশাপাশি তাদের শোষণ নীতির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। তাদের অতীত ইতিহাস সে কথাই বলে দেয়। প্রথমে তারা ভালো মানুষ সেজে প্রবেশ করলেও ক্রমে তাদের আসল রূপ গোচরে আসে। ইংরেজদের এই চিত্র দেখা যায় ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে এদেশে এসে ক্রমে তারা শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে এবং এদেশ শাসন করার স্বপ্ন দেখে। এবং ছলে বলে কৌশলে তারা এদেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে নানা রকম ষড়যন্ত্র করে তারা এদেশের কিছু বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় নবাবকে পরাজিত করে শাসনভার হস্তগত করে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটিতে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সম্পূর্ণ ভাব উঠে আসেনি” মন্তব্যটি যথার্থ।
 স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ইংরেজ জাতির মধ্যে মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায় দূর করার আগ্রহ দেখা গেলেও ভিতরে ভিতরে তারা মানুষকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। সুচতুর ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্দেশ্য যে কোনো ভাবে সফল করে যা উদ্দীপক এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে পাওয়া যায়।
 উদ্দীপকে বর্ণিত হয়েছে ইংরেজ জাতির ঘৃণ্য মানসিকতার কথা। তারা প্রগতিশীলতার শীর্ষে অবস্থান করলেও সারা বিশ্বে তাদের শোষণ নীতি অপরিবর্তিত রেখেছে এবং দুর্বল জাতির উপর তাদের আধিপত্য খাটিয়ে শাসন শোষণ করে আসছে। উদ্দীপকের এই ভাবটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে উপস্থাপিত হলেও এটি নাটকের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে মাত্র একটি বিষয়।
 উদ্দীপকের বিষয়টি ছাড়া নাটকে আরও বর্ণিত হয়েছে এদেশের সাধারণ জনগণের উপর ইংরেজদের অত্যাচার, এদেশে ক্রমে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, নবাবের শত্র“দের সাথে হাত মেলানো, নবাবের পরিজনদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা যার ফলে নবাবের পতন এবং স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ উদ্ধার, সিরাজের করুণ মৃত্যু, ইংরেজদের পুতুল সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় যা উদ্দীপকে অনুপস্থিত। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।

প্রশ্ন\ ১১\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
খান সেনাদের সাথে দু-তিন জন রাজাকার। তাদের একজন বলল, “অত কথায় কাজ কী? তালতলীতে বাঙ্কার তৈয়ার হইতাছে। সগগলরে ব্যাগার দিতে হইব।” ......... রহুল রেগে উঠে বলল, “এসব কী অন্যায্য কথা। তুমি পুবপাড়ার কলিমুদ্দি না? তুমি এই আকাম ধরছ?” কলিমুদ্দি গর্জে উঠল, মুখ সামলাইয়া কথা কইবেন। যাওন আপনাদের লাগবোই।
ক. ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ কোন নদীতে আশ্রয় নিয়েছিল?
খ. ‘আমি চিরকাল ইংরেজদের বন্ধু’ Ñ উমিচাঁদ এ কথাটি চিঠিতে কেন লিখেছেন?
গ. উদ্দীপকের কলিমুদ্দি চরিত্র এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের উমিচাঁদের চরিত্রের সাদৃশ্য নিরূপণ কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের অনেকগুলো ভাবের মাঝে একটি ভাবকে ধারণ করেছে মাত্র।” -মন্তব্যটি বিচার কর। ১




১১ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ ভাগীরথী নদীতে আশ্রয় নিয়েছিল।
ছ অনুধাবন
 উমিচাঁদ চিঠির মাধ্যমে লেখা উক্ত কথাটি দ্বারা ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য ও তাদের সহযোগিতা করার ভাবটি ব্যক্ত করেছেন।
 কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পতনের পর ইংরেজরা এদেশের দালালদের নিয়ে পুনরায় নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এতে যোগদান করে উমিচাঁদ, মিরজাফর, রাজবল­ভ, জগৎশেঠ প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক। উমিচাঁদ ইংরেজদের কাছে লেখা একটি চিঠিতে উলে­খ করে যে সে চিরকাল ইংরেজদের বন্ধু এবং বিপদে আপদে তাদের পাশে থাকবে। ইংরেজদের বাণিজ্য করার জন্য মানিকচাঁদকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে অনুমতি আদায় করেছে। মূলত উমিচাঁদ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ইংরেজদের সাহায্য করেছেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের কলিমুদ্দি চরিত্রের সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের উমিচাঁদের বিশ্বাসঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারী বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে।
 বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি কখনোই মানুষের বন্ধু হতে পারে না। হিংস্র জানোয়ারকে বিশ্বাস করা গেলেও এদের বিশ্বাস করা বা এদের সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়। তারা নিজের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রীর সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে ছাড়ে না। এরা দেশের শত্র“, জাতির শত্র“। উদ্দীপকের কলিমুদ্দি একজন বিশ্বাসঘাতক। সে দেশের সাথে, জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দখলদার পাকিস্তানি জানোয়ারদের সাথে হাত মিলিয়েছে। বাঙালি হয়েও বাঙালির বিরুদ্ধে সে অস্ত্র ধারণ করে বাঙালিদের হত্যা করেছে। কলিমুদ্দির মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে নাটকের উমিচাঁদের ভিতর। সে পরদেশি ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে এই দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে ইংরেজরা এদেশের মানুষের উপর অত্যাচার করেছে, নবাবের সাথে ষড়যন্ত্র করেছে তাদেরই সাথে হাত মিলিয়েছে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের অনেকগুলো ভাবের মাঝে একটি ভাবকে ধারণ করেছে মাত্র।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 স্বার্থচিন্তা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। যে ব্যক্তি নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখে তার মাঝে মানবিক মূল্যবোধ থাকতে পারে না। নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে সে যে কোনো ঘৃণ্য কাজ করতে পারে। দেশের সাথে, জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও করতে পারে। উদ্দীপক এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে এই বিষয়টি লক্ষ করা যায়।
 উদ্দীপকে আলোচিত হয়েছে দেশ ও জাতির সাথে প্রতারণা করার ঘৃণ্য চিত্র। কলিমুদ্দি এদেশের নাগরিক হয়েও ভিনদেশি দখলদারদের সাথে হাত মিলিয়ে এদেশেরই মানুষের উপর জুলুম, নির্যাতন, হত্যার মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। উদ্দীপকের এই ভাবটি নাটকের বহুমুখী ভাবের মাঝে একটি মাত্র দিক।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে উদ্দীপকের বিষয়টির বর্ণনার পাশাপাশি আরও বর্ণিত হয়েছে ইংরেজদের এদেশে আগমন, এদেশের সাধারণ জনগণের উপর জুলুম, নির্যাতন, এদেশের শাসকের সাথে বিরোধ এবং শক্তি প্রয়োগ, নবাবের শত্র“দের সাথে সখ্যতা স্থাপন, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পলাশী যুদ্ধে নবাবের পরাজয় এবং নির্মমভাবে মৃত্যু প্রভৃতি বিষয় যা উদ্দীপকে অনুপস্থিত। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্যটি যথার্থ।

প্রশ্ন\ ১২\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
ভীত-সন্ত্রস্ত সোলেমান ‘জয় বাংলা’ শব্দ শুনে খাট থেকে গড়িয়ে নামে। আরো তিন পাক গড়িয়ে সে খাটের তলায় চলে যায়। সটান শুয়ে সে মিশে যেতে চায় মেঝের সাথে। মুক্তিবাহিনী নিশ্চয়ই ঘেরাও করেছে বাড়িটা।
সাতজন সশস্ত্র পাক সেনা ও দশ-বার জন অবাঙালির সাথে মিলিটারি ট্রাকে চড়ে গত রাতে যে ‘অপারেশন’-এ গিয়েছিল পথ দেখিয়ে সে-ই নিয়ে গিয়েছিল গোপীবাগ।
ক. ইংরেজরা পরাজিত হয়ে কোন জাহাজে আশ্রয় নেয়?
খ. ‘ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন’Ñ ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের সোলায়মান চরিত্রটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “বিশ্বাসঘাতকদের কথা উলে­খ থাকলেও উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সম্পূর্ণ ভাব ধারণ করেনি।” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর। ১



১২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ইংরেজরা পরাজিত হয়ে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে আশ্রয় নেয়।
ছ অনুধাবন
 নবাবের সৈন্যের কাছে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ইংরেজদের পরাজয়ের পর পলায়ন করতে দেখে উমিচাঁদ উক্তিটি করেছেন।
 নবাবের সৈন্যের কাছে পরাজিত হয়ে ইংরেজরা দুর্গ থেকে পলায়ন করে। সার্জন হলওয়েলের কাছে বন্দি উমিচাঁদ যখন এ খবরটি শোনেন তখন ইংরেজদের প্রতি কটাক্ষ করে উক্তিটি করেন। ইংরেজদের কাপুরুষোচিত আচরণের প্রতি বিদ্রূপ করে উক্তিটি করা হয়েছে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের সোলায়মান চরিত্রটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
 বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্র“। এরা দুমুখো সাপের মতো। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে এরা যে কারো সাথে সখ্যতা স্থাপন করতে পারে আবার যে কোনো সময়ে বন্ধুর গলায় ছুরি ধরতে দ্বিধাবোধ করে না।
 উদ্দীপকে দেখা মেলে এমনই একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে। সে ব্যক্তি স্বার্থের জন্যে দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে বাঙালি নিধন যজ্ঞে মেতে ওঠে। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকেও এমন অনেক বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, রাজবল­ভ, মানিকচাঁদ, মিরজাফর প্রমুখ ব্যক্তি এদেশের নাগরিক হয়ে, নবাবের নিকটতম ব্যক্তি হয়ে নবাবের সাথে তথা দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এদের জন্যেই নবাব ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। হারিয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা দুশ বছরের জন্যে।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “বিশ্বাসঘাতকদের কথা উলে­খ থাকলেও উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সম্পূর্ণ ভাবকে ধারণ করেনি।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। যে ব্যক্তি দেশকে ভালোবাসে না সে মানুষরূপী জানোয়ার। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য এমন মানুষও আছে যারা দেশকে ভালোবাসে না। নিজের স্বার্থের জন্যে দেশের সম্মান বিকিয়ে দেয় ভিনদেশিদের কাছে।
 উদ্দীপকে উলে­খ আছে এমনই একজন দেশদ্রোহীর কথা। যে দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দখলদারদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশ ও জাতির সর্বনাশ করেছে। উদ্দীপকের সোলায়মান সামান্য অর্থের বিনিময়ে দেশ ও জাতির যতবড় ক্ষতি করেছে এ অপরাধ ক্ষমারও অযোগ্য। উদ্দীপকের এই বিশ্বাসঘাতকের কথা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে উলে­খ থাকলেও এটি নাটকের একটি মাত্র দিক।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে এই বিশ্বাসঘাতকদের কথা বর্ণনার পাশাপাশি আরও অনেক বিষয় উঠে এসেছে। বাণিজ্যের নাম করে ইংরেজদের এদেশে আগমন, সাধারণ মানুষের উপর তাদের জুলুম, নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, নবাবের শত্র“দের সাথে তাদের বন্ধুত্ব ও নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, নবাবের সেনাপতিসহ আত্মীয় পরিজনদের বিশ্বাসঘাতকতা, অবশেষে যুদ্ধ এবং নবাবের পরাজয়, তাঁর নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ, স্বার্থান্বেষীদের ক্ষমতা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে যা উদ্দীপকে নেই। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
প্রশ্ন\ ১৩\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
এইখানে প্রায় এক সপ্তাহকাল উভয় পক্ষ পরস্পরের আক্রমণের প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে। .......... সমস্ত রাত্রি আক্রমণের আয়োজন চলিতে লাগিল। রাজধর প্রস্তাব করিলেন, “দাদা, তোমরা দুইজনে তোমাদের দশ হাজার সৈন্য লইয়া আক্রমণ করো। আমার পাঁচ হাজার হাতে থাক। আবশ্যকের সময় কাজে লাগিবে।”
ইন্দ্রকুমার হাসিয়া বললেন, “রাজধর তফাতে থাকিতে চান।”
ক. নবাবের পক্ষে সৈন্য সংখ্যা কত ছিল?
খ. ফরাসি সেনাপতি সাঁফ্রে কেন নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেন?
গ. উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সমগ্র ভাবকে ধারণ করেছে।” মন্তব্যটির যৌক্তিকতা নিরূপণ কর। ১

3-Jan-00

১৩ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 নবাবের পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার।
ছ অনুধাবন
 ইংরেজদের সাথে ফরাসিদের দ্ব›দ্ব চিরকালের। এজন্যেই ফরাসি সেনাপতি সাঁফ্রে নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
 ফরাসি আর ইংরেজরা যেখানেই গেছে সেখানেই তাদের মাঝে দ্ব›দ্ব শুরু হয়েছে। ভারতবর্ষে ব্যবসায়িক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়। একে অন্যকে সবসময় দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। যার ফলশ্র“তিতে যে কোনো জায়গায় যে কোনো মুহূর্তে একে অন্যের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ফরাসিরা যখন দেখলো ইংরেজরা নবাবের সাথে যুদ্ধ করেছে তখন নীতিগতভাবে ফরাসি সেনারা নবাবকে সমর্থন দেয়।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে উপস্থাপিত পলাশী যুদ্ধের চিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে উপস্থাপিত হয়েছে ইংরেজদের সাথে নবাবের বিভিন্ন যুদ্ধের চিত্র। এর মাঝে পলাশী যুদ্ধের চিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। উদ্দীপকেও অঙ্কিত হয়েছে এমনই একটা যুদ্ধের চিত্র।
 উদ্দীপকে দেখা যায় যুবরাজ ইন্দ্রকুমার প্রায় এক সপ্তাহকাল অপেক্ষা করে পরস্পর আক্রমণের প্রতীক্ষায়। সমস্ত রাত ধরে আক্রমণের আয়োজন চলে। উদ্দীপকের সৈন্যদের আনাগোনা, যুদ্ধের আয়োজন ইত্যাদি বিষয় ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের যুদ্ধের চিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। নাটকেও দেখা যায় নবাব সৈন্য ও ইংরেজ সৈন্য জড়ো হয় পলাশীর প্রান্তরে। উভয়পক্ষের সৈন্যরা পরস্পরকে আক্রমণের প্রতীক্ষা করে। একদিকে সেনাপতি মোহনলাল, মিরমর্দান, সাঁফ্রে, অন্যদিকে ক্লাইভ, ক্লেটন প্রমুখ যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়। উদ্দীপকের সাথে নাটকের এই বিষয়ের সাদৃশ্য বিদ্যমান।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সমগ্র ভাবকে ধারণ করেছে।” মন্তব্য আমার মতে যুক্তিযুক্ত নয়।
 পলাশী যুদ্ধ বাংলার তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই যুদ্ধে নবাব সিরাজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রায় দুশ বছরের জন্যে হারিয়ে যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে নবাবের যে যুদ্ধ সেটা তাই স্মরণীয় একটা মুহূর্ত।
 উদ্দীপকে অঙ্কিত হয়েছে একটি খণ্ডযুদ্ধের চিত্র। যেখানে যুবরাজ ইন্দ্রকুমার ও তার সৈন্যরা অপেক্ষা করে আছে পরের দিন প্রতিপক্ষকে আক্রমণের জন্যে। উদ্দীপকের এ চিত্রটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের শুধু পলাশী যুদ্ধের বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছে। নাটকের অন্যান্য বিষয়গুলো এখানে একেবারেই অনুপস্থিত।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে একে একে বর্ণিত হয়েছে উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের চিত্র, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে যুদ্ধের চিত্র, সেখানে ইংরেজদের পরাজয় ও পলায়ন, নবাবের বিরুদ্ধে পুনরায় দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়া, এদেশের স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, তাদের সাথে ইংরেজদের সখ্যতা স্থাপন, নবাব সিরাজের আত্মীয় পরিজনদের ষড়যন্ত্র ও সেনাপতি মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, পলাশীর যুদ্ধ এবং সেখানে নবাবের পরাজয়, ইংরেজদের সমর্থন নিয়ে কাপুরুষ মিরজাফরের ক্ষমতা গ্রহণ, নবাবের করুণ পরিণতি প্রভৃতি চিত্র যা উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়নি। তাই আমার মতে প্রশ্নের মন্তব্যটি যুক্তিযুক্ত নয়।
প্রশ্ন\ ১৪\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
অতি প্রত্যুষেই অন্ধকার দূর হইতে না হইতেই যুবরাজ এবং ইন্দ্রকুমার দুই ভাগে পশ্চিম ও পূর্বে মগদিগকে আক্রমণ করিতে চলিয়াছেন। সৈন্যের স্বল্পতা লইয়া রূপনারায়ণ হাজারি দুঃখ করিতেছিলেন। তিনি বলিতেছিলেন, আর পাঁচ হাজার সৈন্য থাকলে ভাবনা ছিল না। ইন্দ্রকুমার বলিলেন, ত্রিপুরারির অনুগ্রহ যদি হয় তবে এই কয় জন সৈন্য লইয়াই জিতিব।
ক. ঘসেটি বেগম সম্পর্কে সিরাজের কে হন?
খ. সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে ঘসেটি বেগম কেন খুশি হবেন?
গ. উদ্দীপকের যুবরাজ এবং ইন্দ্রকুমার ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রদ্বয়ের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মাত্র একটি বিষয়কে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



১৪ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ঘসেটি বেগম সম্পর্কে সিরাজের খালা হন।
ছ অনুধাবন
 সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে ঘসেটি বেগমের স্বার্থ উদ্ধার এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ হবে তাই তিনি খুশি হবেন।
 নবাব সিরাজের খালা ঘসেটি বেগম কখনোই সিরাজের সিংহাসনারোহণ মেনে নিতে পারেননি। কারণ তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলার মসনদে বসবে তার পোষ্যপুত্র এবং তিনি দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। কিন্তু তাঁর সব স্বপ্ন মাটি হয়ে যায় যখন দেখেন সিরাজকেই বাংলার মসনদের জন্যে মনোনীত করা হয়েছে। এর পর থেকেই তিনি মনে প্রাণে চাইতেন সিরাজের পতন। সিরাজের পতন হলেই তার এতদিনের লালিত স্বপ্ন সার্থক হবে। এজন্যে তিনি সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে খুশি হবেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের যুবরাজ এবং ইন্দ্রকুমার চরিত্রদ্বয় ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মোহনলাল এবং মিরমর্দান চরিত্রদ্বয়ের প্রতিনিধি।
 মোহনলাল এবং মিরমর্দান নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত দুজন সেনাপতি। মোহনলালের বাড়ি কাশ্মিরে এবং জাতিতে হিন্দু হলেও তিনি সিরাজের অতি বিশ্বস্ত ও প্রিয় ছিলেন। মিরমর্দানও সিরাজের অন্যতম সেনাপতি। তিনি সাহসের সাথে যুদ্ধ করে শহিদ হন।
 উদ্দীপকেও দেখি দুজন নির্ভীক যোদ্ধাকে। তাঁদের একজন যুবরাজ অন্যজন ইন্দ্রকুমার। তাঁরা তাঁদের বীরত্বেই যুদ্ধে জয়লাভ করতে চান। রূপনারায়ণ হাজারি সৈন্যের স্বল্পতা নিয়ে আক্ষেপ করলেও তার যে সেনা রয়েছে তাদের নিয়েই যুদ্ধে জয়লাভ করতে চায়। এই চিত্র দেখি নাটকের পলাশী প্রান্তরে। নবাবের প্রধান সেনাপতি মিরজাফর যুদ্ধে অংশ না নিয়ে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মোহনলাল এবং মিরমর্দান তাদের যে সেনা রয়েছে তাদের নিয়ে যুদ্ধ করেই জয়ী হতে চান এবং বিপুল বিক্রমে অগ্রসর হন। উদ্দীপকের ভ্রাতৃদ্বয়ের সাথে নবাবের সেনাপতিদ্বয়ের মিল এখানেই পরিলক্ষিত হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মাত্র একটি বিষয়কে আমাদের স্মরণ করিয়া দেয়।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 সাহস ও বীরত্ব একজন মানুষকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। ভীত মানুষ কখনোই কাজের শেষ পর্যন্ত যেতে পারে না। উদ্দীপকের যুদ্ধরত ভ্রাতৃদ্বয় এবং নাটকের সেনাপতিদ্বয় তাদের সাহস ও বীরত্ব নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। এজন্যে তাদের প্রতি আমাদের সমীহ জাগে।
 উদ্দীপকটিতে দেখা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানরত দুজন সাহসী সেনাপতির শৌর্ষ বীর্যের চিত্র। যুবরাজ এবং ইন্দ্রকুমার তাদের বীরত্ব ও দুঃসাহসের সাথে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে। এ চিত্রটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের পলাশী প্রান্তরের যুদ্ধের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেও নাটকের অন্যান্য দিকগুলো উপস্থাপন করে না।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটিতে বহুমুখী বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। উদ্দীপকের বিষয় ছাড়াও এখানে রয়েছে নবাব সিরাজের ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি কী কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন তার চিত্র, বেনিয়া ইংরেজদের নির্লজ্জ ও কপটাচারিতা, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, স্বার্থান্বেষীদের নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার লোভে অন্ধ বিপথগামী সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা, নবাবের পতন ও নির্মম মৃত্যু, মিরজাফরের কাপুরুষোচিত ক্ষমতা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ের অবতারণা ঘটেছে, যা উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়নি। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থই হয়েছে।
প্রশ্ন\ ১৫\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে দখলদারদের বিতাড়িত করে বাংলার স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনে।
ক. কার হুকুমে নবাব সিরাজকে হত্যা করা হয়?
খ. পলাশী যুদ্ধে নবাব কেন পরাজিত হলেন?
গ. উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধুর সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজের চরিত্রের বৈসাদৃশ্য কোথায়? নির্ণয় কর।
ঘ. “বঙ্গবন্ধুর ডাকের মতো নবাব সিরাজের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দিলে পলাশী যুদ্ধের ফল বিপরীত হতে পারতো।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



১৫ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 মিরজাফরের পুত্র মিরনের হুকুমে নবাব সিরাজকে হত্যা করা হয়।
ছ অনুধাবন
 সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মীয় পরিজনদের ষড়ষন্ত্রের ফলে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ পারাজিত হলেন।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে বসার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সিরাজের আত্মীয়-স্বজন, অমাত্যবর্গের এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় সুযোগ সন্ধানী ইংরেজরা। সিরাজের চারপাশের এই ষড়যন্ত্রের জাল থেকে তিনি কিছুতেই বের হতে পারেন না। পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে তার যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মিরজাফর তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে। ফলে নবাবের অবশিষ্ট সৈন্যরা ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে বাংলা হারায় তার স্বাধীনতা।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধুর সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজের চরিত্রের সাথে বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
 একজন দেশনায়কের মাঝে থাকতে হয় চারিত্রিক দৃঢ়তা, প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা, দেশপ্রেম, দেশের মানুষের ভালোবাসা অর্জনের ক্ষমতা, সর্বোপরি নেতৃত্বের গভীরতা তবেই তিনি সত্যিকারের দেশনায়ক হতে পারেন। উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধুর মাঝে এসব গুণাবলি বিদ্যমান ছিল।
 বঙ্গবন্ধু ছিলেন সত্যিকারের দেশনেতা। দেশের প্রতিটি মানুষ তাঁকে ভালোবাসতো। তিনি দেশের জন্যে নিজের জীবনের ন্যূনতম সুখটুকুও ত্যাগ করতে কুন্ঠাবোধ করতেন না। তিনি বাংলা ও বাঙালির মুক্তি চেয়েছেন। তাইতো তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজ এই কাজটি পারেননি। তিনি জনগণের অন্তরের মাঝে মিশতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর মতো। তাইতো পলাশী যুদ্ধে এদেশেরই লোকজন নিজেদের স্বার্থের জন্যে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর এখানেই রয়েছে বৈসাদৃশ্য।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “বঙ্গবন্ধুর ডাকের মতো নবাব সিরাজের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দিলে পলাশী যুদ্ধের ফল বিপরীত হতে পারতো।” মন্তব্যটি যুক্তিযুক্ত।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বিপদের সময় দেশের জনগণ, এমনকি নিজের আত্মীয় পরিজনদেরও পাশে পাননি। ফলে নিতান্ত অসহায়ভাবে তাকে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। যার ফলে কোনো কাজের ফল তার পক্ষে যায় নি।
 উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের আপামর জনগণ সাড়া দিয়েছে। দেশনেতার অমোঘ ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হানাদার সৈন্যের বিরুদ্ধে। অসম সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে সংগ্রাম করে দেশের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাকের মতো নবাব সিরাজের ডাক এদেশের জনগণের মাঝে সাড়া জাগাতে পারেনি। কারণ নবাব ও জনগণের মাঝে ছিল বিস্তর দূরত্ব।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজ চেয়েছিলেন দেশের জনগণ তার পাশে থেকে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ভূমিকা রাখুক। কিন্তু দেশের জনগণতো দূরের কথা নিজের সেনাপতিই তার পক্ষে নেই। তিনি চেয়েছিলেন দেশের জনগণ তার পাশে এসে দাঁড়াক। লড়াই করুক বিদেশি দখলদারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই মুহূর্তে কেউই তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো দেশের জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। ফলে কাউকেই তিনি বিপদের সময় পাশে পাননি। তাই বলা যায় বঙ্গবন্ধুর ডাকের মতো তার ডাকে যদি দেশের জনগণ সাড়া দিত তবে পলাশী যুদ্ধের ফল বিপরীত হতে পারতো।
প্রশ্ন\ ১৬\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
সখীপুর গ্রামে আজ চরম সংকট উপস্থিত। সবাই চিন্তিত, ভীত সন্ত্রস্ত। আগামীকাল শক্তিশালী পরানপুর গ্রামের সাথে পূর্বঘোষিত ‘কাইজা’ হবে। এটা নিজ গ্রামের অস্তিত্ব রক্ষার সম্মান রক্ষার বিষয়। গ্রামপ্রধান আপামর জনসাধারণকে ডেকে আগামীকালের ‘কাইজা’ হবে। বিশ্বস্ততার সাথে, সাহসের সাথে পরানপুর গ্রামের মোকাবেলা করার অনুরোধ করেন। প্রায় সকলেই যার যার ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করে গ্রামের সম্মান রক্ষার্থে যদি জীবনও যায় তবু তারা পিছু হটবে না। কিন্তু পরদিন গ্রামপ্রধানসহ অনেকেই লক্ষ করে নকীব এবং গোলাম আলীসহ যারা কিনা ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে প্রতীজ্ঞা করেছিল তাদের অনেকেই অনুপস্থিত। কেউবা শত্র“পক্ষকে মদদ দিচ্ছে। ফলে সখীপুর গ্রামের চরম পরাজয় ঘটে।
ক. দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে কোন স্থানের কথা উলে­খ আছে?
খ. ‘আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকব’ কথাটি কে, কেন বলেছে?
গ. উদ্দীপকের ঘটনাটি নাটকের কোন ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয়? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের নকীব ও গোলাম আলীরা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মিরজাফর ও রায়দুর্লভ চরিত্রের প্রতীক” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



১৬ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নবাবের দরবারের কথা উলে­খ আছে।
ছ অনুধাবন
 কথাটি বলেছে নবাব সিরাজের প্রধান সেনাপতি মিরজাফর ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে নবাবের বিশ্বাস অর্জন করার জন্যে।
 ইংরেজদের ধৃষ্টতায় ক্ষিপ্ত হয়ে এবং অমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে নবাব সিরাজ দরবারে জরুরি সভা ডাকেন। সেখানে তিনি দেশের এই দুর্যোগের মুহূর্তে সমস্ত হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে তার পাশে দাঁড়াতে বলেন। তখন সেনাপতি মিরজাফর পবিত্র কোরান শরিফ স্পর্শ করে উক্ত ওয়াদা করেন। যার গভীরে ছিল শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতা।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের ঘটনাটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের পলাশী যুদ্ধের ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয়।
 পলাশী যুদ্ধ বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাংলার কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের স্বার্থোদ্ধারের মানসিকতার জন্যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে এবং ইংরেজ বেনিয়ারা এদেশে তাদের শক্তির ভিত রচনা করার সুযোগ পায়। এদেশের জনগণ স্বাধীনতা হারায় দুশ বছরের জন্যে।
 উদ্দীপকে দেখা যায় দু’দল গ্রামবাসীর মধ্যে অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষার লড়াই বাঁধে। সখীপুর গ্রামের মানুষ গ্রামের সম্মান রক্ষা করার জন্যে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে পরস্পরের ওয়াদাবদ্ধ হয়। কিন্তু লড়াইয়ের সময় কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার কথা ভুলে তারা দখলদারদের মদদ দেয়। যা নাটকের পলাশী যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানেও দেখা যায় যুদ্ধের ময়দানে নবাবের সেনাপতিরা যুদ্ধ না করে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে শত্র“ পক্ষকে সমর্থন জানানোর জন্য। তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাবের পরাজয় ঘটে। পরাজয় ঘটে এই বাংলার মানুষের।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের নকীব ও গোলাম আলীরা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মিরজাফর ও রায়দুর্লভ চরিত্রের প্রতীক।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা একজন মানুষ বা একটি জাতিকে কতখানি ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস সে সাক্ষী প্রদান করে। শুধু বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। এমনই বিশ্বাসঘাতক উদ্দীপকের নকীব ও নাটকের মিরজাফররা।
 উদ্দীপকে দেখা যায় নকীব এবং গোলাম আলীদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে সখীপুর গ্রামের চরম পরাজয় ঘটে। তাদের অস্তিত্ব এবং সম্মান ধ্বংস হয়ে যায়। যারা গ্রামের সম্মান রক্ষা করবে তারা যদি বিশ্বাসঘাতক, ভীরু হয় তবে সেখানে জয়ী হবার কোনো পথ খোলা থাকে না। এমনই বিশ্বাসঘাতকদের খুঁজে পাওয়া যায় ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। সেখানে মিরজাফর, রায়দুর্লভদের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের পরাজয় ঘটে।
 মিরজাফর এবং রায়দুর্লভ নবাবের অন্যতম দুজন সেনা। একজন সেনাপতি অন্যজন সাধারণ সৈনিক। এদের দুজনের বিশ্বাসঘাতকতা ও কুপরামর্শে নবাব সিরাজ মুর্শিদাবাদ যাওয়ার সময় যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে যান। সে সুযোগ গ্রহণ করে ইংরেজ সেনারা। এক প্রকার বিনা যুদ্ধে জয়লাভ করে তারা। এই দুই বিশ্বাসঘাতক চরিত্রের প্রতীক উদ্দীপকের নকীব ও গোলাম আলী চরিত্রদ্বয়।
[[[[[[[[
প্রশ্ন\ ১৭\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
আতা খাঁ : গুপ্তচর তার সবকিছু দেখাতে বাধ্য নয়। তোমাদের যাতে প্রয়োজন শুধু তাই দেখতে পাবে। নাও, এই দেখো, ভালো করে দেখো। সেনাপতির নিজ হাতের স্বাক্ষরযুক্ত ছাড়পত্র।
রহিম : (মশালের আলোতে উল্টে পাল্টে পাঞ্জাখানা দেখে) ঠিক আছে আপনাকে খামাখা তক্লিফ দিলাম। আপনি যেদিকে খুশি যেতে পারেন।
আতা খাঁ : যেদিকে খুশি। কিন্তু খুশিমতো চলে কি শেষে আরো কঠিন মুসিবতের মধ্যে পড়বো? দরকার নেই বাবা। তার চেয়ে যে পথে অন্যেরা চলে সে পথ দিয়ে এগুনোই ভালো। তা, সেপাই বাবাজীরা, একটু রাস্তা বাতলে দাও না। মানে মানে সরে পড়ি?
ক. সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালের কত তারিখে শহিদ হন?
খ. মোহাম্মদি বেগ মিরনের কাছে কেন দশ হাজার টাকা চাইল?
গ. উদ্দীপকের আতা খাঁ ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মাত্র একটি দিককে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে, সম্পূর্ণ দিককে নয়।”- ব্যাখ্যা কর। ১



১৭ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালের ২রা জুলাই তারিখে শহিদ হন।
ছ অনুধাবন
 নবাব সিরাজকে হত্যা করার পারিশ্রমিক হিসেবে মোহাম্মদি বেগ মিরনের কাছে দশ হাজার টাকা চাইল।
 পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নবাব সিরাজ মিরজাফরের অনুসারী সৈন্যের হাতে ভগবানগোলার নিকট বন্দি হন এবং জাফরাগঞ্জ কয়েদখানায় নিক্ষিপ্ত হন। ক্লাইভের প্ররোচনায় মিরজাফরের পুত্র মিরন নবাবকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে এক সময় সিরাজের পরিবারে আশ্রয় গ্রহণকারী মোহাম্মদি বেগকে নির্বাচন করে সিরাজকে হত্যা করার জন্যে। তখন মোহাম্মদি বেগ দশ হাজার টাকা চায় সিরাজকে হত্যার পারিশ্রমিক হিসেবে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের আতা খাঁ ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজের গুপ্তচর জুহালা চরিত্রের প্রতিনিধি।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকদের ভিড়ে রাইসুল জুহালা চরিত্র আমাদের মনে একটু হলেও ভালো লাগার সৃষ্টি করে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এটি একটি কৌতুক চরিত্র কিন্তু তার দেশপ্রেম এবং নবাবের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা আমাদের চমৎকৃত করে।
 উদ্দীপকে আতা খাঁকে গুপ্তচর বৃত্তি করতে দেখা যায়। সে সেনাপতির ছাড়পত্র নিয়ে মুসলিম শিবির থেকে মারাঠা শিবিরে যায় গুপ্তচর বৃত্তি করার জন্যে। পথিমধ্যে রহিম নামে জনৈক সৈন্য তার পথ আগলালে সেনাপতির ছাড়পত্র দেখিয়ে আপন কাজে চলে যায়। এর সাথে সাদৃশ্য রয়েছে নাটকের রাইসুল জুহালা চরিত্রটির সাথে। নারান সিং তার আসল নাম। তিনি নবাবের বিশ্বস্ত ও প্রিয়ভাজন। রাইসুল জুহালা নাম ধারণ করে নর্তকীর বেশে যে ঘসেটি বেগমদের মন্ত্রণা সভায় প্রবেশ করে এবং সে তথ্য নবাবকে পাঠায়। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “ উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মাত্র একটি দিককে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে, সম্পূর্ণ দিককে নয়।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 দেশপ্রেম একটি মহৎ গুণ, স্বদেশকে ভালোবাসে না এমন ব্যক্তি পশুর সমান। যে দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে জাতি কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারে না। উদ্দীপকের আতা খাঁ এবং নাটকের রাইসুল জুহালার মাঝে দেখা যায় এমনই দেশপ্রেম বা স্বাজাত্য প্রেমের চিত্র।
 উদ্দীপকের আতা খাঁ পানিপথের যুদ্ধের সময় মুসলিম শিবিরের গুপ্তচর। সে যায় রাতের অন্ধকারে মারাঠা শিবিরে তথ্য সংগ্রহ করতে। উদ্দীপকের এই গুপ্তচর বৃত্তির বিষয়টি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে বর্ণিত একটি মাত্র দিক। এছাড়াও নাটকে বহু বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে নানাবিধ ভাবের সমাবেশ যা উদ্দীপকের স্বল্প পরিসরে উপস্থাপিত হয়নি।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে উদ্দীপকের বিষয়টি ছাড়াও বর্ণিত হয়েছে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন, এদেশে এসে কুঠি স্থাপন, ব্যবসার অজুহাতে নানারকম নিষিদ্ধ কার্যকলাপ, অবশেষে নবাবের রোষানলে পড়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং পরাজয়, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যোগাযোগ এবং বন্ধুত্ব স্থাপন, সবাই মিলে নবাবের সাথে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করা, নবাব সিরাজের চারিত্রিক দৃঢ়তা, ইংরেজ বেনিয়াদের শিক্ষা দেয়ার জন্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ, সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজয় ও মৃত্যু প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে যা উদ্দীপকে নেই। তাই বলা যায় প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ।

প্রশ্ন\ ১৮\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
জমিদার আদিত্য নারায়ণ সারাক্ষণ সুরা, নারী নিয়ে মেতে থাকেন। আর প্রজাদের উপর নানা রকম কর চাপিয়ে উৎপীড়ন করে, জুলুম করে রাজ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করেন। প্রজারা তাকে একেবারেই ভালোবাসে না, শ্রদ্ধা করে না। তিনি শাসক হয়েও প্রজাদের সুখ দুঃখের খোঁজখবর রাখেন না এজন্যে প্রজারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
ক. সিরাজউদ্দৌলার মায়ের নাম কী?
খ. সিরাজউদ্দৌলা একটি দিনের জন্যেও কেন সুখে নবাবি করতে পারেননি?
গ. উদ্দীপকের জমিদারের সাথে সিরাজের চরিত্রের বৈসাদৃশ্য নিরূপণ কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ভাবার্থের দর্পণ।” মন্তব্যটি বিচার কর। ১



১৮ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 সিরাজউদ্দৌলার মায়ের নাম আমেনা বেগম।
ছ অনুধাবন
 চারদিকে ষড়যন্ত্রের দেয়াল, নিজের অমাত্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়ের প্রতিহিংসার আগুন সব মিলিয়ে সিরাজ একদিনের জন্যেও সুখে নবাবি করতে পারেননি।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা প্রকারের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তার সাথে যোগ দেয় সুযোগ সন্ধানী ইংরেজরা। যার কারণে নবাবকে সদা সতর্কভাবে চলতে হয়। হিসাব-নিকাশ করে পরিকল্পনামাফিক কাজে অগ্রসর হতে হয়। একেতো বয়সে তরুণ তার উপর ঘরের কোণেই ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের বসবাস। এজন্যে সারাটি সময় তাকে শঙ্কার মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়। এজন্যে নবাব সিরাজ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে একটি দিনের জন্যেও সুখে নবাবি করতে পারেননি।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের জমিদারের সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজের বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
 চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। চারিত্রিক দৃঢ়তা, নৈতিকতা, মানবিকতা সুন্দর চরিত্র গঠনে অপরিহার্য। এসব গুণ লক্ষ করা যায় নবাব সিরাজের মাঝে। যা উদ্দীপকের জমিদারের মাঝে অনুপস্থিত।
 উদ্দীপকের জমিদার আদিত্য নারায়ণ একজন অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষ। তিনি সারাক্ষণ সুরা নারী নিয়ে মশগুল থাকেন, আর প্রজাদের উপর নানা রকম কর, খাজনা চাপিয়ে তাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন করেন। এজন্যে প্রজারা তাকে মোটেও ভালোবাসে না, শ্রদ্ধা করে না। চরিত্রের এই অনৈতিক দিকগুলি নবাব সিরাজের মাঝে অনুপস্থিত। তিনি সৎ, নীতিবান, দৃঢ়চেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। প্রজাদের তিনি ভালোবাসেন। প্রজারাও তাকে ভালোবাসে। উভয় চরিত্রের মধ্যে বৈসাদৃশ্য এখানেই পরিলক্ষিত হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ভাবার্থের দর্পণ।” মন্তব্যটি মোটেও যথার্থ নয়।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি বহুমুখীতায় ঋদ্ধ। নাট্যকার সচেতনভাবেই ইতিহাসকে আশ্রয় করে বিভিন্ন ভাবেই অবতারণা ঘটিয়েছেন নাটকের জমিনে। যেখানে উদ্দীপকে মাত্র একটি দিকই উপস্থাপিত হয়েছে যা নাটকের একটি মাত্র দিককে নির্দেশ করেছে।
 উদ্দীপকে একজন নীতিহীন লম্পট জমিদারের কথা উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি সারাক্ষণ সুরা নারী নিয়ে মেতে থাকেন। প্রজাদের উপর নানা রকম খাজনা ও কর চাপিয়ে দিয়ে উৎপীড়নের মাত্রা বড়িয়ে দেন। প্রজারা এতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। উদ্দীপকের এই ভাবটি শুধু প্রজাবৎসল নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রজাদরদী চেতনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে মনে করিয়ে দেয় মাত্র নাটকের অন্যান্য দিকের কোনো ভাব উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়নি।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে বহুমুখী ভাবের অবতারণা ঘটেছে। ইংরেজদের এদেশে আগমন ঘটে এদেশের ধন-সম্পত্তির লোভে। একে একে তারা এদেশে ক্ষমতার জাল বিস্তার করতে থাকে। এজন্যে তারা নবাবের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রথমে পরাজিত হয়। আরও বর্ণিত হয়েছে নবাবের চারপাশের স্বার্থাম্বেষী মানুষের চক্রান্ত, আত্মীয়দের প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্র, সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় যুদ্ধে পরাজয় ও নবাবের নির্মম মৃত্যু প্রভৃতি। এসকল ভাবের একটিও উদ্দীপকে প্রকাশিত হয়নি। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য একেবারেই অযৌক্তিক।
[[[
প্রশ্ন\ ১৯\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
জোহরা : আর একদিন কি দুদিন। তারপরেই সে ঘোর সময় শুরু হবে। তুমি ফিরে এসো। আমার সঙ্গে ফিরে চলো।
কার্দি : যে ফিরে যাবে সে আমি হবো না। সে হবে বিশ্বাসঘাতক। সে হবে ইব্রাহিম কার্দির লাশ। তাকে দিয়ে তুমি কী করবে। ........ আমার সংকটের দিনে যারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, কর্মে নিযুক্ত করেছে, ঐশ্বর্য দান করেছে সে মারাঠাদের বিপদের দিনে আমি চুপ করে বসে থাকবো? পদত্যাগ করবো? দল ত্যাগ করবো? সে হয় না জোহরা।
ক. রায়দুর্লভের পিতার নাম কি?
খ. “এসেছ শয়তান। ধাওয়া করেছো আমার পিছু।” বুঝিয়ে লেখ।
গ. উদ্দীপকের কার্দি এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মিরজাফরের বৈসাদৃশ্য নিরূপণ কর।
ঘ. “উদ্দীপকের কার্দির মতো ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাবের সেনাপতি বিশ্বস্ত থাকলে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণœ থাকতো।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



১৯ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 রায়দুর্লভের পিতার নাম জানকীরাম।
ছ অনুধাবন
 উক্ত কথাটি বলেছেন ঘসেটি বেগম সিরাজকে উদ্দেশ্য করে।
 সিরাজ নবাব হওয়ার পর থেকে তার খালা ঘসেটি বেগম প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকেন। তিনি কোনো ভাবেই সিরাজের ক্ষমতা গ্রহণকে মেনে নিতে পারেন না। এজন্যে তিনি নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ কথা সিরাজ জানতে পেরে খালাকে নজরবন্দি করে রাখেন। এতে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সিরাজ তাকে অনুসরণ করলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উক্ত উক্তিটি করেন। যাতে তার প্রতিহিংসা ও ঘৃণার ভাব প্রকাশিত হয়েছে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের কার্দি এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মিরজাফর চরিত্রের সাথে বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
 জগৎ-সংসারে নানা ধরনের মানুষ রয়েছে। কেউ নিজের দায়িত্ব কর্তব্যকে জীবন দিয়ে হলেও পালন করে আবার কেউ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে বিপথে চালিত হয়।
 উদ্দীপকের কার্দি একজন দায়িত্বশীল বিশ্বস্ত সেনানায়ক। তিনি উপকারীর উপকার স্বীকার করেন তাইতো নিশ্চিত পরাজয় জেনেও একসময় সাহায্যকারীর পক্ষ তিনি কাপুরুষের মতো ত্যাগ করেননি। তার এই একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত রূপ দেখতে পাই নাটকের মিরজাফর চরিত্রে। তিনি হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্যে এক সময়ের আশ্রয়দাতা তথা দেশের শাসকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন প্রধান সেনাপতি হওয়া সত্তে¡ও। তার এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। উভয় চরিত্রে বৈসাদৃশ্য এখানেই।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 উদ্দীপকের কার্দির মতো ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজের সেনাপতি বিশ্বস্ত থাকলে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণœ থাকতো।” মন্তব্যটি সঠিক।
 কাছের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলে, ষড়যন্ত্র করলে তার পতন অনিবার্য। শত ক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও সে টিকে থাকতে পারবে না। ইতিহাস এই সত্যকেই প্রমাণ করে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
 উদ্দীপকের কার্দি একজন বিশ্বস্ত দায়িত্বশীল সেনানায়ক। তাঁর একনিষ্ঠতা সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করে। তিনি জানেন আসন্ন যুদ্ধে তার বাহিনীর পরাজয় অবধারিত। তারপরেও তিনি কাপুরুষের মতো একসময়ের সাহায্যকারীর পক্ষ ত্যাগ করেননি। তার মতো এমন একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি যদি থাকতো তবে বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।
 বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের প্রধান সেনাপতি ছিলেন মিরজাফর। তিনি ছিলেন নীচ মানসিকতার অধিকারী। হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন নবাবের সাথে, জাতির সাথে। যার জন্যে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। যদি উদ্দীপকের ‘কার্দির মতো নবাবের সেনাপতি বিশ্বস্ত হতেন তবে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণœ থাকতো’ মন্তব্যটি তাই যথার্থই বলা যায়।

প্রশ্ন\ ২০\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
শাকিলা ও নাজমা আহাদ সাহেবের জমজ দুই মেয়ে। দুবোন একই সাথে বেড়ে ওঠে। পরিণত বয়সে তাদের বিয়ে দেন। শাকিলার একটা ছেলে হলেও নাজমা নিঃসন্তান। আহাদ সাহেব তার সম্পত্তির সিংহভাগ অংশ শাকিলার ছেলের নামে উইল করে দেন। নাজমাকে দেন সামান্য অংশ। এতে নাজমা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অনবরত শাকিলা এবং তার ছেলের ধ্বংস কামনা করে। অন্যের সাথে ষড়যন্ত্র করতে থাকে কীভাবে শাকিলা তার ছেলেকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা যায়।
ক. আমেনা বেগম ঘসেটি বেগমের সম্পর্কে কী হন?
খ. ঘসেটি বেগম কেন সিরাজের ধ্বংস কামনা করেন?
গ. উদ্দীপকের শাকিলার সাথে‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কার সাদৃশ্য রয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের নাজমা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ঘসেটি বেগম চরিত্রের প্রতিভূ।” মন্তব্যটি বিচার কর। ১



২০ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 আমেনা বেগম ঘসেটি বেগমের ছোটবোন।
ছ অনুধাবন
 নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে এবং বহুদিন লালিত প্রতিহিংসার কারণে ঘসেটি বেগম নবাব সিরাজের ধ্বংস কামনা করেন।
 নবাব আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুর আগে তার দৌহিত্র সিরাজকে বাংলার মসনদের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান। এবং তার মৃত্যুর পর সিরাজ নবাব হন। যা তার আত্মীয় পরিজনরা, বিশেষ করে যারা মসনদের স্বপ্ন দেখতো তারা মোটেও মেনে নিতে পারছিল না। এমনকি তার বড় খালা ঘসেটি বেগম তার এই ক্ষমতা গ্রহণে যারপর নাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এজন্যে তিনি সারাক্ষণ সিরাজের ধ্বংস কামনা করতেন। তিনি চাইতেন সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। এজন্যেই তিনি সিরাজের ধ্বংস চাইতেন।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের শাকিলার সাথে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আমেনা বেগমের সাদৃশ্য রয়েছে।
 ভাইবোনের সম্পর্ক দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্রতম। এই সম্পর্কের মধ্যেও যখন স্বার্থ এসে দাঁড়ায় তখন একে অপরের শত্র“ হয়ে পড়ে। উদ্দীপকের শাকিলা ও নাজমা এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আমেনা ও ঘসেটি বেগমের মধ্যে বোনের সম্পর্ক থাকলেও ব্যক্তিস্বার্থ ও প্রতিহিংসা তাদের মধ্যে দেয়াল তুলে দিয়েছে।
 উদ্দীপকে দেখা যায় আহাদ সাহেবের দুই মেয়ে শাকিলা ও নাজমা। এই শাকিলার ছেলেকে যখন আহাদ সাহেব তার সম্পত্তির সিংহভাগ দান করেন তখন শাকিলা এবং তার ছেলে নাজমার রোষানলে পড়ে। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের আমেনা বেগম অর্থাৎ নবাব সিরাজের মা এই একই পিরিস্থিতির স্বীকার হন। সিরাজকে যখন আলীবর্দী খাঁ বাংলার মসনদের জন্যে মনোনীত করেন তখন আমেনা বেগম এবং তার ছেলে সিরাজ ঘসেটি বেগমের রোষানলে পতিত হন। উদ্দীপকের শাকিলা চরিত্রের সাথে এখানেই আমেনা বেগম চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের নাজমা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ঘসেটি বেগম চরিত্রের প্রতিভূ।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 স্বার্থচিন্তা মানুষকে অমানুষে পরিণত করে। তখন আত্মীয় পরিজনের কথাও মনে থাকে না। সে সর্বক্ষণ চিন্তায় থাকে কীভাবে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করবে। উদ্দীপকের নাজমা বেগম এবং নাটকের ঘসেটি বেগম এ ধরনের মানসিকতার অধিকারী।
 উদ্দীপকের নাজমা ব্যক্তিস্বার্থে বিভোর একজন নারী। শাকিলা তার আপন বোন। সেই বোন এবং তার ছেলেকে তার পিতা সম্পত্তির সিংহভাগ যখন দান করে যান তখন সেটাকে সে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। প্রতিহিংসায় সবসময় নিজের ছোট বোনের এবং তার ছেলের সর্বনাশ কামনা করেন। অন্যের সাথে ষড়যন্ত্র করেন কীভাবে আপন ছোটবোন এবং ছেলেকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি হস্তগত করা যায়। এমনই একটি চরিত্র ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ঘসেটি বেগম। তিনিও ছিলেন আপন বোন এবং তার ছেলের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ।
 সিরাজউদ্দৌলাকে যখন নবাব আলীবর্দী খাঁ বাংলার মসনদের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান তখন থেকেই ঘসেটি বেগম সিরাজ এবং তার মা আমেনা বেগমের প্রতি ক্ষুব্ধ। আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিরাজ ক্ষমতা গ্রহণ করলে তিনি প্রতিহিংসায় উন্মাদিনী হয়ে যান। কারণ তিনিও চেয়েছিলেন তার পোষ্যপুত্র সিংহাসনে বসুক এবং তিনি রাজ্য পরিচালনা করেন। এজন্যে তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। যেমনটি দেখা যায় উদ্দীপকের নাজমা চরিত্রের মাঝে। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।

প্রশ্ন\ ২১\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
জমিদার : [সাহেবের পা জড়িয়ে ধরল] আমাকে বাঁচান হুজুর। আপনি আমার জন্মদাতা পিতা, আমি ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে কসম করছি, চিরদিন গোলাম হয়ে থাকব। ....
সাহেব : জমিদার মেরাজ আলী আমার পদ ছাড়–ন। উত্থান করুন ......
জমিদার : আমি আপনার অনুগত ভৃত্য হুজুর।
ক. ছোট-বড় মিলিয়ে নবাবের পক্ষে কতটি কামান ছিল?
খ. ‘বৃদ্ধ নবাবকে ছলনায় ভুলিয়ে সিংহাসন দখল করেছ” Ñ ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের জমিদার ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সম্পূর্ণ ভাবকে ধারণ করেছে।” মন্তব্যটি সম্পর্কে তোমার মতামত উপস্থাপন কর। ১



২১ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ছোট-বড় মিলিয়ে নবাবের পক্ষে মোট দশটি কামান ছিল।
ছ অনুধাবন
 উক্ত কথাটি বলেছেন সিরাজের বড়খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের মা আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে।
 নবাব আলিবর্দী খাঁ সিরাজকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করার পর থেকে সিংহাসনের অন্যতম প্রার্থী ঘসেটি বেগম হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতে থাকেন। এবং সিরাজ যখন বাংলার মসনদে বসেন তখন তিনি প্রতিনিয়ত সিরাজের ধ্বংস কামনা করতেন। আমেনা বেগমকে তিনি বলেন, সিরাজ নবাব হওয়াই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি। তার মতে বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী খাঁকে ছলনায় ভুলিয়ে সিরাজ ক্ষমতা দখল করে। আর এজন্যেই তার সমস্ত রাগ হিংসা ঘৃণা সিরাজ এবং তার মায়ের উপর।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের জমিদার ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মিরজাফর চরিত্রের প্রতিনিধি।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে নাট্যকার অতি সচেতনভাবে ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন। এখানে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছেন। তাদের চরিত্রের নেতিবাচকতা নাটকের নায়ক সিরাজকে আরও উজ্জ্বল ও বেগবান করেছে।
 উদ্দীপকে দেখা যায় জমিদার মেরাজ আলী একজন ইংরেজদের পদহেলনকারী জানোয়ার। তার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। নিজের অপকর্মকে ঢাকার জন্যে ইংরেজদের পা ধরে অনুরোধ করে এবং জন্মদাতা বলে স্বীকার করে। সে এতই নীচ মানসিকতার মানুষ যে বাঁচার জন্যে ধর্মকেও বিসর্জন দিতে চায়। ঠিক এ ধরনের মানসিকতা লক্ষ করি নাটকের মিরজাফর চরিত্রে। তার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। নেই কোনো মানসিকতা বোধ। সেনাপতি হয়েও সে নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলার মসনদে বসে এবং ইংরেজদের হাতের পুতুল হয়ে নবাবি চালায়। সে এতটাই ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ যে ইংরেজদের হাত ধরে ছাড়া মসনদে বসে না। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই পরিলক্ষিত হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সম্পূর্ণ ভাবকে ধারণ করেছে।” মন্তব্যটি আমার মতে যথার্থ নয়।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে রয়েছে বহুমুখী ভাবের সমাবেশ। সেখানে মাত্র একটি ভাবের দ্বারা নাটকের সম্পূর্ণ বিষয়কে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। প্লট বা কাহিনী অনুযায়ী আলোচনা বা বর্ণনা ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে কোনো বর্ণনা বা বিষয় উপস্থাপন করলে নাটকের মূলভাবকে প্রকাশ করা যায় না।
 উদ্দীপকে দেখা যায় মেরাজ আলী নামের এক অত্যাচারী লম্পট জমিদার তার অপকর্মকে চাপা দেয়ার জন্যে ক্ষমতাধর ইংরেজদের হাতে পায়ে ধরে। পিতা বলে পরিচয় দেয়। চিরদিন ইংরেজের গোলাম হয়ে থাকার কথা স্বীকার করে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। পা ধরে পড়ে থাকে। এটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের বহুমুখী দিকের মধ্যে একটি মাত্র দিক। এর পাশাপাশি বিচিত্র সব ভাব ও বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে নাটকের জমিনে।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথমে দেখি বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা এদেশে আসলেও ক্রমে তারা এদেশ শাসনের স্বপ্ন দেখে। এজন্যে তারা নানা কৌশল অবলম্বন করে। সাধারণ মানুষের প্রতি অত্যাচার করে, নাটকে আরও রয়েছে এদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের ইংরেজদের পক্ষে যোগদান এবং নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তার পতন ত্বরান্বিত করা, সেনাপতি ও পরিজনদের বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধে নবাবের পরাজয়, বন্দী হওয়া এবং নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করা, ইংরেজদের হাতের পুতুল হিসেবে মিরজাফরের ক্ষমতা গ্রহণ ইত্যাদি যা উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়নি। তাই আমার মতে প্রশ্নের মন্তব্যটি যথার্থ নয়।
প্রশ্ন\ ২২\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
জমিদার : আমি জমিদার। প্রজারা বলে আমি হায়ওয়ান আলী।
২। সুন্দরবনের বাঘ। রক্ত ছাড়া খাদ্য নাই।
আবু : আমারে মাফ করে দেন, বাড়ি ঘর ছেড়ে দিলেম, কাল সকালে বৌ এর হাত ধরে যেখানে হয় চলে যাব।
জমিদার : চলে যাবি?
১। উঃ আবার বৌ নিয়ে। মগের মুল­ুক।
জমিদার : জামাল। ওর হাতে চৌদ্দপোয়া করে ইট চাপিয়ে দে। যতক্ষণ টাকা না দেয়, চাবুক চালাবি। গুদাম ঘরে বন্দী।
আবু : মালিক, ঘরে আমার বৌ একলা। আতঙ্কে জীবন দিয়ে দিবে।
ক. দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে কোন স্থানের কথা উলে­খ আছে?
খ. ‘আমাকে শেষ করে দিয়েছে হুজুর’ Ñ কে, কেন এ কথা বলেছে?
গ. উদ্দীপকের আবু ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের জমিদারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি চরিত্র ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজ।” মন্তব্যটি বিচার কর। ১



২২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নবাবের দরবারের কথা উলে­খ আছে।
ছ অনুধাবন
 কথাটি বলেছে ইংরেজদের অত্যাচারে সর্বস্বান্ত উৎপীড়িত ব্যক্তি।
 ইংরেজরা এদেশে বাণিজ্য করতে এসে এদেশের সাধারণ জনগণের উপর নানা জুলুম অত্যাচার শুরু করে। নবাব সিরাজের কাছ থেকে লবণের ইজারা নিয়ে তারা লবণ উৎপাদন শুরু করে। তারা প্রজাদের দাদন দিয়ে লবণ উৎপাদন করায় এবং কম দামে লবণ কিনে মজুদ করে এবং এক সময় দশ গুণ বেশি দামে সেই প্রজাদের কাছেই বিক্রয় করে। কোনো প্রজা যদি লবণ না বিক্রয় করে তখন তাদের উপর অত্যাচার করা হয়। সেই রকম অত্যাচারে অত্যাচারিত এক ব্যক্তি উক্ত উক্তিটি করে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের আবু ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের উৎপীড়িত ব্যক্তির প্রতিনিধি।
 দুর্বলরা চিরদিনই সবলের কাছে নির্যাতিত হয়ে আসছে। বর্তমান সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগেও এই ধারার পরিবর্তন ঘটেনি। উদ্দীপকে দেখা যায় দুর্বল প্রজার উপর জমিদার এবং নাটকে ইংরেজরা সাধারণ জনগণের উপর অত্যাচার করছে।
 উদ্দীপকের চিত্রে দেখা যায় ‘আবু’ সাধারণ একজন চাষী। সে ঠিকমতো খাজনা দিতে না পারায় জমিদারের রোষানলে পড়ে। জমিদারের হুকুমে তাকে আটকে রাখা হয় এবং হাতে ইট দিয়ে দাঁড়িয়ে রেখে চাবুক মারার নির্দেশ দেয়া হয় যতক্ষণ না খাজনার টাকা দেয়। এরকম জঘন্য অত্যাচারের চিত্র রয়েছে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। এদেশের সাধারণ চাষীরা ইংরেজদের কাছে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারিত হতো। যার বাস্তব প্রমাণ নাটকের উৎপীড়িত ব্যক্তি। সাহেবদের কাছে লবণ বিক্রি না করার অপরাধে ইংরেজরা তার ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তার স্ত্রীকে হত্যা করে। এই উৎপীড়িত ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্য রয়েছে উদ্দীপকের আবুর চরিত্রের।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের জমিদার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চরিত্র ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজ।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 নাট্যকার নতুন মূল্যবোধের তাগিদে, ইতিহাসের বিভ্রান্তি এড়িয়ে ঐতিহ্য ও প্রেরণার উৎস হিসেবে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজ চরিত্রটি আবিষ্কার করেছেন। ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে তিনি সিরাজ চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন।
 উদ্দীপকের জমিদারের চরিত্রে অঙ্কিত হয়েছে একজন অত্যাচারী, লম্পট, লোভী, দেশ শাসকের চিত্র। সে প্রজাদের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করে। খাজনা দিতে না পারলে চাবুক চালায়। সে নিজেকে প্রজাদের রক্তখেকো বাঘ মনে করে। প্রজারা তাই তাকে বলে হায়ওয়ান আলী। জমিদারের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চরিত্র নাটকের সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রটি।
 নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নবাব সিরাজ। তিনি একজন সৎ, নির্ভীক, দেশপ্রেমিক প্রজাপালক দেশ শাসক। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, প্রজাদের ভালোবাসতেন। সুখে দুঃখে প্রজাদের খোঁজখবর নিতেন। নৈতিক আদর্শে বলিয়ান এ দেশনেতার চরিত্রে ছিল দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদ্গুণাবলিতে পূর্ণ। এজন্যে তিনি দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, দেশের মানুষের কল্যাণের প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্যটি যথার্থ।

প্রশ্ন\ ২৩\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
শফিক সাহেবের কাছে এসে আশ্রয় চায় আট বছর বয়সী আকরাম। সে প্রায় বিশ বছর আগের ঘটনা। তখন থেকেই তিনি আকরামকে স্নেহ ভালোবাসায় বড় করে তোলেন। আকরাম শিক্ষিত হলেও তার মনটা ছোট। সে সুযোগ খোঁজে আশ্রয়দাতার সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করার। কোনো একদিন অস্ত্রের মুখে শফিক সাহেবকে তার সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিতে বাধ্য করে এবং নিজ হাতে আশ্রয়দাতাকে হত্যা করে।
ক. কোন কয়েদখানায় সিরাজকে বন্দি করে রাখা হয়?
খ. ক্লাইভ কেন সিরাজকে হত্যা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায় না?
গ. উদ্দীপকের আকরাম নাটকের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের শফিক সাহেব এবং নবাব সিরাজের করুণ পরিণতির কারণ একই।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



২৩ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 জাফরাগঞ্জের কয়েদখানায় সিরাজকে বন্দি করে রাখা হয়।
ছ অনুধাবন
 কারণ ক্লাইভ জানে প্রজারা সিরাজকে ভালোবাসে এবং যে কোনো সময় বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। তাই তিনি তাড়াতাড়ি চান সিরাজকে হত্যা করতে।
 পলাশী যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হওয়ার পর পাটনা যাওয়ার পথে ভগবানগোলায় বন্দি হন। তাকে রাখা হয় জাফরাগঞ্জের কয়েদখানায়। কর্নেল ক্লাইভ সিরাজকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। সিরাজের মৃত্যু নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই, কারণ সে জানে সিরাজ প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। প্রজারাও তাকে ভালোবাসতো। তাই প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করার আগে সে সিরাজকে হত্যা করতে চায়।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের আকরাম ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মোহাম্মদি বেগ চরিত্রের প্রতিনিধি।
 যে উপকারীর উপকার স্বীকার করে না সে নরকের কীটেরও অধম। তার মাঝে মনুষ্যত্ব বলতে কিছু থাকে না। যে মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে এ ধরনের জঘন্য কাজ করে সে কখনোই কারো ভালোবাসা পায় না। উদ্দীপকের আকরাম এবং নাটকের মোহাম্মদি বেগ এ ধরনের চরিত্রের মানুষ।
 উদ্দীপকের আকরাম ছোটবেলায় শফিক সাহেবের কাছে আশ্রয় চায়। দয়ালু শফিক সাহেব তাকে আশ্রয় দেন এবং তাকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলেন। কিন্তু কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। আকরামের হীন মানসিকতার জন্যে সে আশ্রয়দাতার সম্পদের লোভে তাকে হত্যা করে সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করে। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে এমনই একটা চরিত্র মোহাম্মদি বেগ। সে ছোটবেলা থেকে সিরাজের মায়ের স্নেহছায়ায় আশ্রয় লাভ ও বড় হয়েছে। সামান্য কিছু টাকার জন্যে সে সিরাজকে হত্যা করে। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের শফিক সাহেব এবং সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরিণতির কারণ একই।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 অর্থ-সম্পদের লোভ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। একবার সেদিকে দৃষ্টি গেলে মানুষের সমস্ত নৈতিকতা, মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। মানুষ তখন অমানুষে পরিণত হয়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে তখন বিরাট পাপ কাজ করে বসে। সেই পরিস্থিতির স্বীকার হয় সমাজের নিষ্পাপ ভালো মানুষগুলো।
 উদ্দীপকের শফিক সাহেব এমনই একজন নরপশুর আক্রমণের শিকার। যাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন সেই তার বুকে চরম আঘাত হানে। তার মৃত্যুর কারণ তার সম্পত্তি। এই সম্পত্তির লোভে তারই আশ্রিত এবং পালিত আকরাম তাকে হত্যা করে। এমনই পরিণতির শিকার হতে দেখি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে।
 সিরাজউদ্দৌলা নবাব হবার পর তার আত্মীয় পরিজন ক্ষমতা ও ধন সম্পত্তির লোভে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সম্পদ হস্তগত করার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। এর জন্যে তারা বিদেশি ইংরেজদের সাথে হাত মেলায়। এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে যুদ্ধে তার পরাজয় ঘটে। শেষ পর্যায়ে তাদেরই আশ্রিত এবং তার মায়ের কাছে পালিত মোহাম্মদি বেগ টাকার লোভে তাকে হত্যা করে। তাই বলা যায় উভয়ের পরিণতির কারণ একই।


প্রশ্ন\ ২৪\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাংলার স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনে। তিনি বাংলার মানুষের শান্তির জন্যে, কল্যাণের জন্যে আজীবন কাজ করে গেছেন। অথচ দেশ স্বাধীন হবার পর এদেশেরই কিছু সেনা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ক. নবাব সিরাউদ্দৌলাকে প্রথম কী দ্বারা আঘাত করা হয়?
খ. ‘নিশ্চিন্ত হোক বাংলার প্রত্যেকটি নরনারী’- বুঝিয়ে লেখ।
গ. উদ্দীপকের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রের প্রতীক? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজের পরিণতি একই” মন্তব্যটি বিচার কর। ১.



২৪ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে প্রথম লাঠি দ্বারা আঘাত করা হয়।
ছ অনুধাবন
 উক্ত বাক্যটি দ্বারা নবাব সিরাজউদ্দৌলার গভীর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার ভাবটি প্রকাশিত হয়েছে।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের সেনার হাতে বন্দি হয়ে জাফরাগঞ্জ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখাটা শত্র“পক্ষের কাছে ভীতিজনক হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু বন্দি হয়েও নির্ভিক সিরাজ অবিচল। তিনি আল­াহর দরবারে মোনাজাত করেন এদেশের মঙ্গল কামনায়। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি এদেশের জন্যে এদেশের জনগণের জন্যে মোনাজাত করেন। কারণ তিনি ছিলেন প্রজাদরদী দেশপ্রেমিক নেতা।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজ চরিত্রের প্রতীক।
 একজন যোগ্য নেতাই পারে জাতিকে রক্ষা করতে। সঠিক পথে চালনা করতে। দেশ ও জাতির দুর্যোগময় মুহূর্তে তার হাত ধরেই পরিত্রাণ পাওয়া যায়। উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নাটকের নায়ক সিরাজ এমনই দেশনেতা।
 উদ্দীপকে দেখা যায় দেশনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আহŸানে সাড়া দিয়ে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনে। তিনি এদেশের জন্যে এদেশের মানুষের জন্যে সারাজীবন নিরলস পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারই কতিপয় সেনার হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এমনই একটা চরিত্র নাটকের সিরাজউদ্দৌলা। তিনিও প্রজাবৎসল দেশপ্রেমিক নেতা। দেশের কল্যাণের জন্যে তিনি কখনও কারও সাথে আপোষ করেননি। অথচ এদেশের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই লক্ষণীয়।

ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজের পরিণতি একই”। মন্তব্যটি সার্থক।
 একজন সাহসী ও মহান নেতার হাত ধরেই একটি দেশ বা জাতি সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন এ ধরনেরই দেশনেতা। অথচ এদেশের বিপথগামী কিছু মানুষ তা না বুঝে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে।
 উদ্দীপকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নেতা। তাঁর হাত ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জয় লাভ করে। অথচ হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে কতিপয় বাঙালি সেনার হাতেই নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়। এমনই পরিণতি বরণ করতে দেখি নাটকের নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে।
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা এ দেশের জন্যে এদেশের মানুষের জন্যে কী না করেছেন। জীবনের সমস্ত আয়েস বিসর্জন দিয়ে নিরন্তর দেশের কল্যাণের চিন্তায় মশগুল থেকেছেন। তিনি বাস্তবেই ছিলেন প্রজাবৎবল দেশ শাসক। অথচ ক্ষমতার লোভে ও প্রতিহিংসায় এদেশের মানুষের ষড়যন্ত্রে আটকা পড়ে তার করুণ মৃত্যু ঘটে। নিজের সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি পরাজিত হন এবং আশ্রিত মোহাম্মদি বেগের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।

প্রশ্ন\ ২৫\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
সাহেব : সো নেটিভ জমিদার, বিদায় হও। আমি তোমাকে রক্ষা করিব। নিদ্রা যাও আর মুখ দ্বারা নাসিকা গর্জন কর।
[জমিদার সেলাম করতে করতে বিদায় নিল]
লেডিস এ্যান্ড জেন্টলম্যান, লর্ড কর্নওয়ালিসের খুব বুদ্ধি ছিল। তিনি পারমানেন্ট সেটেলমেন্ট দ্বারা জমিদার করিলেন আর জমিদারগণ লেজ নাড়িতে লাগিল। আপনারা বলেন, কর্নেল ক্লাইভ যুদ্ধ করিয়া বঙ্গদেশ জয় করিলেন নো, নেভার। আই মাস্ট নট টক লাইক এ্যান ইডিয়ট। ইতিহাসকে মিথ্যা করিতে পারিব না। বাংলাদেশের মেরাজ আলীসকল আপন হস্তে ক্লাইভের পকেটে বাংলাদেশ ঘুষড়াইয়া দিলেন। সো লঙ লিভ মেরাজ আলী, লঙ লিভ জমিদার জাতি।
ক. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য কুঠি কোনটি?
খ. ইংরেজ জাতি ভারতবর্ষে কেন আসে?
গ. উদ্দীপকের সাহেব ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রকে মনে করিয়ে দেয়? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের সাহেবের মন্তব্যটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সত্য।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



২৫ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ইস্ট ই্িন্ডয়া কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য কুঠি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ।
ছ অনুধাবন
 প্রাথমিকভাবে ইংরেজ জাতি বাণিজ্য করার জন্যে এলেও এদেশে উপনিবেশ স্থাপনই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
 ভাস্কো-দা-গামার আবি®কৃত জলপথে ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমন ঘটে। প্রথমে তারা বাণিজ্য করার বাসনা নিয়ে আসলেও এদেশের সম্পদ দেখে এখানে উপনিবেশ স্থাপন করার স্বপ্ন দেখে। ক্রমে তারা শক্তি সঞ্চয় করে এবং ছলে বলে কৌশলে এদেশের মানুষকে হাত করে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের সাহেব ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ক্লাইভ সাহেব চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।
 ইংরেজরা প্রগতিশীলতার শীর্ষে অবস্থান করলেও তারা মানুষকে শোষণ করার নীতি থেকে এক পাও সরে আসেনি। সারা পৃথিবীর দুর্বল কোনো জাতি তাদের আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তাদের সেই স্বভাবের পরিচয় পাই উদ্দীপকে এবং নাটকে।
 উদ্দীপকের সাহেব চরিত্রে ইংরেজদের চরিত্রের সবটুকু ফুটে উঠেছে। সে জমিদারদের হস্তগত করে এদেশের সাধারণ জনগণকে শোষণের পথকে ত্বরান্বিত করে। তার বক্তব্যে ইংরেজদের চরিত্রের যাবতীয় নেতিবাচক দিক ফুটে উঠেছে। এমনই একটা চরিত্র ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কর্নেল ক্লাইভ। সে প্রথমে দেশের ক্ষমতালোভীদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তাদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা হস্তগত করে। উভয় চরিত্রের এখানেই সাদৃশ্য রয়েছে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের সাহেবের বক্তব্যটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ইংরেজদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সত্য।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 এমন কোনো কাজ নেই যে কাজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে ইংরেজ জাতি করতে পারে না। তাদের মজ্জাগত স্বভাব হলো ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা হস্তগত করা, শাসন শোষণ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া। উদ্দীপকের এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ইংরেজদের এমন রূপেই দেখা যায়।
 উদ্দীপকের সাহেবের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে ইংরেজ জাতির প্রকৃত রূপটি। তার মতে কর্নেল ক্লাইভ যুদ্ধ করে বঙ্গদেশ জয় করেনি করেছে ছলনা ও চাতুরীর সাহায্যে। আর তাকে সাহায্য করেছে কিছু কাপুরুষ ক্ষমতালোভী এদেশের ঘৃণ্য চরিত্রের মানুষ। সাহেবের এই বক্তব্যটি ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সত্য।
 নাটকে দেখা যায় ইংরেজ জাতি প্রথমে বাণিজ্য করার নামে এদেশে এলেও ক্রমে তারা এদেশে ক্ষমতার শিকড় গভীরে প্রবেশ করাতে থাকে। এজন্যে তারা নানা চাতুরতা, ষড়যন্ত্র, শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। তাদের সাহায্য করে এদেশের কিছু ক্ষমতালোভী হীন চরিত্রের মানুষ। সে সুযোগ গ্রহণ করে ইংরেজরা এদেশের শাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের করায়ত্ত করে। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্যটি যথার্থ।

প্রশ্ন\ ২৬\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
রাজবল­ভ : আপনারা তর্কের ভেতর যাচ্ছেন আলোচনা শুরু করার আগেই। খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করা দরকার। বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের আলোচনা দীর্ঘ করা বিপজ্জনক।
জগৎশেঠ : কথা ঠিক। কিন্তু নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে যাওয়াটাও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মাফ করবেন বেগম সাহেবা, আমি খোলাখুলি বলছি। অঙ্গীকার করে লাভ নেই যে, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাংয়ের গেলাস এবং নাচওয়ালি ছাড়া সে আর কিছুই জানে না। কাজেই শওকতজঙ্গ নবাব হবে নামমাত্র। আসলে কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার এবং পরোক্ষে তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজবল­ভ।
রায়দুর্লভ : ঠিক এই ধরনের একটা সম্ভাবনার উলে­খ করার ফলেই হোসেন কুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
জগৎশেঠ : আমি তা বলছিনে। তা ছাড়া এখানে সে কথা অবান্তর। আমি বলতে চাইছি যে, শওকতজঙ্গ নবাবি পেলে বেগম সাহেব এবং রাজা রাজবল­ভের স্বার্থ নির্বিঘœ হবে আমাদের তেমন আশা নেই। কাজেই আমাদের পক্ষে নগদ কারবারই ভালো।
ক. ক্লাইভ এবং ওয়াটস কী ছদ্মবেশ ধারণ করে?
খ. মিরজাফররা সিরাজের পতন চায় কেন?
গ. উদ্দীপকের রাজবল­ভ এবং জগৎশেঠ চরিত্রের সাদৃশ্য নির্ণয় কর।
ঘ. “উদ্দীপকে ষড়যন্ত্রকারীদের কারণেই ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজের নির্মম এবং করুণ পরিণতি ঘটে। ”মন্তব্যটি বিচার কর। ১



২৬ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 ক্লাইভ এবং ওয়াটস মহিলাদের ছদ্মবেশ ধারণ করে।
ছ অনুধাবন
 নবাব সিরাজের পতন হলে মিরজাফরসহ আরও অনেকের স্বার্থ উদ্ধার হবে এজন্যে তারা সিরাজের পতন চায়।
 মিরজাফর ইংরেজদের প্ররোচনায় ধীরে ধীরে বাংলার মসনদের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ক্ষমতার লোভে তার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যার ফলে তিনি সিরাজের পতনের জন্যে অন্যান্যদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কারণ তারাও চায় সিরাজের পতন হোক। রাজবল­ভ, উমিচাঁদ, মানিকচাঁদ, ঘসেটি বেগম প্রমুখ মনে করেন সিরাজের পতন হলে যে যার জায়গা থেকে লাভবান হবে। এই সুযোগ গ্রহণ করে ইংরেজরা। তারাও এই দলে যোগ দিয়ে সবাই মিলে নবাব সিরাজের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের রাজবল­ভ ও জগৎশেঠ চরিত্রের মাঝে রয়েছে গভীর সাদৃশ্য।
 স্বার্থচিন্তা মানুষকে অমানুষে পরিণত করে। জাগতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্যে এরা মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে অন্যের সর্বনাশ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে। উদ্দীপকের রাজবল­ভ ও জগৎশেঠ এ ধরনের চরিত্রের দুজন মানুষ।
 রাজবল­ভ এবং জগৎশেঠ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। এরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। রাজবল­ভ বিক্রমপুরের লোক। সে ছিল বাঙালি বৈদ্য এবং জাহাজের কেরানি। হোসেন কুলি খাঁর মৃত্যুর পর ঢাকার দেওয়ান হয়। পরবর্তীতে ঘসেটি বেগমের সাথে মিলিত হয়ে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। জগৎশেঠ হলো উপাধি। তার আসল নাম মহতাব চাঁদ। নবাব সরফরাজ খাঁকে হটিয়ে বাংলার মসনদে আলীবর্দী খাঁকে বসানোর পেছনে জগৎশেঠের হাত থাকলেও স্বার্থের জন্যে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কেননা তিনি চেয়েছিলেন সিরাজকে তার হাতের মুঠোয় রাখতে। সেটা যখন পারলেন না তখন সিরাজের পতনের জন্যে অন্যান্যদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই পরিলক্ষিত হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “উদ্দীপকের ষড়যন্ত্রকারীদের কারণেই ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নবাব সিরাজের নির্মম ও করুণ পরিণতি ঘটে।” মন্তব্যটি যুক্তিযুক্ত।
 সিরাজউদ্দৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। কিন্তু তার সিংহাসনে বসার পর থেকেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। উদ্দীপকের জগৎশেঠ ও রাজবল­ভ সেসব ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে অন্যতম।
 নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে বসেন। এই মসনদের অন্যতম দাবীদার ঘসেটি বেগম ও তার পালিত পুত্র বিষয়টি ভালোভাবে মেনে নিতে পারেন না। তাছাড়া নবাব স্বাধীনচেতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, সর্বোপরি প্রজাবৎসল হওয়ায় কিছু মানুষের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করে। যার ফলে তারা নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
 নবাব সিরাজ তারুণ্যের পূজারী ও নির্ভীক হওয়ায় অন্যায়কে কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না। এদেশে ব্যবসার জন্যে আশা ইংরেজদের ধৃষ্টতা এবং চারপাশের লোকজনের স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ডকে তিনি কঠোর হাতে দমন করতে চেয়েছিলেন। এজন্যে ক্রমে তার শত্র“ বাড়তে থাকে। সঙ্গে ক্ষমতালোভী আত্মীয় পরিজনদের প্রতিহিংসা তার পতনের পথকে ত্বরান্বিত করে। একসময় তিনি ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়েন। ষড়যন্ত্রকারীরা ছলে বলে কৌশলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর হয়। উদ্দীপকের রাজবল­ভ ও জগৎশেঠসহ খালা ঘসেটি বেগম, বেনিয়া ইংরেজরা, সেনাপতি মিরজাফর প্রমুখদের ষড়যন্ত্রের কারণে তার জীবনের নির্মম পরিণতি ঘটে। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যুক্তিযুক্ত।
প্রশ্ন\ ২৭\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
মাস্টার দা সূর্যসেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এ দেশের গণমানুষকে জাগিয়ে তুলতে নানাভাবে চেষ্টা করেন। তাঁরই নির্দেশে চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল হামলার পর ব্রিটিশ শাসকদের টনক নড়ে। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে ১০,০০০/- টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অর্থের লোভে জনৈক ব্যক্তি তার অবস্থান জানিয়ে দিলে তিনি ধরা পড়েন। অতঃপর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ক. সিরাজউদ্দৌলা কোন স্থানে বন্ধি হন?
খ. ‘এ-পীড়ন তুমি দেখলে না?’  কে, কেন বলেছে এ কথা?
গ. উদ্দীপকের মাস্টার দা সূর্যসেন ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও উদ্দীপকের সূর্যসেন এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলা একই পরিণতির শিকার হয়েছেন।” মন্তব্যটি যাচাই কর। ১



২৭ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
 নবাব সিরাজউদ্দৌলা বন্দি হন ভগবানগোলা নামক স্থানে।
ছ অনুধাবন
 কথাটি বলেছেন নবাব সিরাজ তার মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার উপরে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে।
 নবাবকে বন্দি করে জাফরাগঞ্জের কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হয়। তাকে হত্যা করার জন্যে মোহাম্মদি বেগকে নির্দেশ দেয় মিরজাফরের পুত্র মিরন। তার হুকুমে মোহাম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করতে যায়। সে প্রথমে সিরাজকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। মাথা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন তিনি। তিনি স্খলিত কন্ঠে তখন বলে উঠেন লুৎফা, খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া, এ-পীড়ন তুমি দেখলে না।
জ প্রয়োগ
 উদ্দীপকের মাস্টার দা সূর্যসেন ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সিরাজ চরিত্রের প্রতিনিধি।
 মাস্টার দা সূর্যসেন একজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ছিলেন। এদেশের স্বাধীনতার জন্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। দেশের প্রতি অসীম ভালোবাসার তাগিদে তিনি নিজের সমস্ত কিছু উজাড় করেছেন।
 উদ্দীপকে দেখা যায় মাস্টার দা সূর্যসেন ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এজন্যে তারই নির্দেশে ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল হামলার পর ব্রিটিশ শাসকের টনক নড়ে। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে ইংরেজরা পুরস্কার ঘোষণা করলে জনৈক লোভী ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ধরা পড়েন ও নিহত হন। নাটকের নবাব সিরাজ এমনই দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি সবসময় চেয়েছেন দেশ ও দেশের মানুষের স্বাধীনতা। তিনি এ দেশের মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। এজন্যে তাকেও নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এখানেই রয়েছে উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
 “প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও উদ্দীপকের সূর্যসেন এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলা একই পরিণতির শিকার হয়েছেন।” মন্তব্যটি যথার্থ।
 দেশপ্রেমিকের কোনদিন মৃত্যু হয় না। সমস্ত দেশ ও জাতি তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। উদ্দীপকের মাস্টার দা সূর্যসেন ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা এমনই দেশপ্রেমিক পুরুষ। তাঁরা দেশের জন্যে নিজের জীবনের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়েছেন। এজন্যে আজও তাঁরা জাতির চেতনাতে বেঁচে রয়েছেন।
 উদ্দীপকে দেখা যায় মাস্টার দা সূর্যসেন এদেশের দখলদার ব্রিটিশদের শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এদেশের জনগণকে জাগিয়ে তুলতে নানাভাবে চেষ্টা করেন। তাঁরই নির্দেশে বিদ্রোহীরা চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল হামলা চালায়। এতে ব্রিটিশরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই একই ধরনের পরিণতিকে বরণ করতে দেখি নাটকের নবাব সিরাজকে।
 ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাট

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]