উপন্যাসের সংজ্ঞা
উপন্যাস গণতন্ত্রের দান, গণমানুষের আত্মজাগরণের দান। উপন্যাস হলো বাস্তব জীবনের কল্পিত রূপ। ‘উপন্যাস’ শব্দটির বুৎপত্তি হচ্ছে: উপ-নি-আস+অ (ঘঞ্জ), যার অর্থ উপস্থাপন। এর আভিধানিক অর্থ ঘটনাবহুল আখ্যান, কল্পিত কাহিনি, অভিনব সৃষ্টি, অপূর্ব উপস্থাপন ইত্যাদি। একটি সমাজের পটভূমিতে মানবজীবনের বাস্তব রূপকে কল্পিতভাবে প্রকাশ করা হলে, তখন তাকে উপন্যাস বলে। ঔপন্যাসিক শ্রীশচন্দ্র দাশের মতে- “গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন দর্শন ও জীবনানুভূতি কোনো বাস্তব কাহিনি অবলম্বন করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্প কর্মে রূপায়িত হয়, তাহাকে উপন্যাস বলে।”
বস্তুত উপন্যাস জীবন নয়, জীবনের ছায়াপাত, খণ্ডিত জীবন নয়, অখণ্ড জীবনের ছায়াপাত, জীবনের কার্বন কপি নয়, ইঙ্গিতময়, অর্থপূর্ণ; খণ্ডিত জীবন নয়, অখণ্ড জীবনই উপন্যাসের কাম্য। তাই উপন্যাস জীবনের নিকটতম শিল্প; ঘটনার ধারাবাহিক সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাস। আকর্ষণীয় গাল্পিক রস, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্র, চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ, বাস্তবতার আলোকে বর্ণনা একটি সার্থক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। ‘উপন্যাস’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ঘড়াবষ’। বিশিষ্ট ইংরেজ ঔপন্যাসিক ঊ.গ. ঋড়ৎবংঃবৎ উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “ঘড়াবষ রং ঢ়ৎড়ংব হধৎৎধঃরাব ড়ভ ংঁভভরপরবহঃ ষবহমঃয ঃড় ভরষষ ড়হব ড়ৎ ঃড়ি াড়ষঁসবং” অর্থাৎ উপন্যাস হলো গদ্যে লিখিত সুদীর্ঘ কল্পিত কাহিনি, এক বা একাধিক খণ্ডে রচিত পাঠকের মনোরঞ্জনকারী সাহিত্যকর্ম বিশেষ।
উপন্যাস আধুনিক যুগে সমাজ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষের বেঁচে থাকার যে জীবন সংগ্রাম, তারই মহাকাব্যিক রূপ।
উপন্যাসের গঠন কৌশলের শর্তাবলি
একটি সার্থক উপন্যাসের জন্য কয়েকটি শর্ত বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর সেগুলো হচ্ছে-
১ প্লট বা আখ্যানভাগ
২ কাহিনি বা ঘটনা বিন্যাস
৩ চরিত্র চিত্রণ
৪ জীবন দর্শন বা সমাজচিত্র
৫ ভাষা ও বর্ণনা ভঙ্গি
৬ প্রণয় রস।
সাধারণত এসব বৈশিষ্ট্য একটি উপন্যাসের কাম্য। তবে সময়ের দাবি অনুযায়ী উপন্যাসও খোলস বদলাচ্ছে। তাই আজকাল বৈশিষ্ট্যের ওপর উপন্যাস নির্ভরশীল নয়।
ঔপন্যাসিক-পরিচিতি
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। জীবন-সন্ধানী ও সমাজসচেতন এ সাহিত্য-শিল্পী চট্টগ্রাম জেলার ষোলশহরে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃনিবাস ছিল নোয়াখালীতে। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমদউলাহ্ ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পিতার কর্মস্থলে ওয়ালীউলাহ্র শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত হয়। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকে নানাভাবে দেখার সুযোগ ঘটে তাঁর, যা তাঁর উপন্যাস ও নাটকের চরিত্র-চিত্রণে প্রভূত সাহায্য করে। অল্প বয়সে মাতৃহীন হওয়া সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তারপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে এমএ পড়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু ডিগ্রি নেওয়ার আগেই ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তিনি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘দি স্টেট্স্ম্যান’-এর সাব-এডিটর নিযুক্ত হন এবং সাংবাদিকতার সূত্রে কলকাতার সাহিত্যিক মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে করাচি বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ক‚টনৈতিক দায়িত্বে নয়াদিলি, ঢাকা, সিডনি, করাচি, জাকার্তা, বন, লন্ডন এবং প্যারিসে নানা পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল প্যারিস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর তিনি প্যারিসে পরলোক গমন করেন।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র সাহিত্যকর্ম সমগ্র বাংলা সাহিত্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। ব্যক্তি ও সমাজের ভেতর ও বাইরের সূ² ও গভীর রহস্য উদ্ঘাটনের বিরল কৃতিত্ব তাঁর। তাঁর গল্প ও উপন্যাসে একদিকে যেমন স্থান পেয়েছে কুসংস্কার ও অন্ধ-ধর্মবিশ্বাসে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত, আশাহীন ও মৃতপ্রায় সমাজজীবন, অন্যদিকে তেমনি স্থান পেয়েছে মানুষের মনের ভেতরকার লোভ, প্রতারণা, ভীতি, ঈর্ষা প্রভৃতি প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কেবল রসপূর্ণ কাহিনী পরিবেশন নয়, তাঁর অভীষ্ট ছিল মানবজীবনের মৌলিক সমসার রহস্য উন্মোচন।
‘নয়নচারা’ (১৯৪৬) এবং ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৬৫) তাঁর গল্পগ্রন্থ এবং ‘লালসালু’ (১৯৪৮) ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ নিরীক্ষামূলক চারটি নাটকও লিখেছেন। সেগুলো হলো ‘বহিপীর’ ‘তরঙ্গভঙ্গ’, ‘উজানে মৃত্যু’ ও ‘সুড়ঙ্গ’।
সাহিত্যের রূপশ্রেণি : উপন্যাস
উপন্যাস আধুনক কালের একটি বিশিষ্ট শিল্পরূপ। উপন্যাসের আক্ষরিক অর্থ হলো উপযুক্ত বা বিশেষ রূপে স্থাপন। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে কাহিনি-রূপ একটি উপাদানকে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল, পদ্ধতি বা রীতি। ‘উপন্যাস’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হড়াবষ-এর আভিধানিক অর্থ হলো : ধ ভরপঃরঃরড়ঁং ঢ়ৎড়ংব হধৎৎধঃরাব ড়ৎ ঃধষব ঢ়ৎবংবহঃরহম ঢ়রপঃঁৎব ড়ভ ৎবধষ ষরভব ড়ভ ঃযব সবহ ধহফ ড়িসবহ ঢ়ড়ৎঃধুবফ। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনি যার ভেতর দিয়ে মানব-মানবীর জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
এভাবে ব্যুৎপত্তিগত এবং আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, মানব-মানবীর জীবন যাপনের বাস্তবতা অবলম্বনে যে কল্পিত উপাখ্যান পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষ বিন্যাসসহ গদ্যে লিপিবদ্ধ হয় তাই উপন্যাস। যেহেতু উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মানুষের জীবন তাই উপন্যাসের কাহিনী হয় বিশ্লেষণাত্মক, দীর্ঘ ও সমগ্রতাসন্ধানী। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক ঊ.গ. ঋড়ৎংঃবৎ-এর মতে, কমপক্ষে ৫০ হাজার শব্দ দিয়ে উপন্যাস রচিত হওয়া উচিত।
বিখ্যাত উপন্যাস বিশ্লেষকগণ একটি সার্থক উপন্যাসের বিভিন্ন উপাদানের কথা বলেছেন। সেগুলো হচ্ছে :
১. প্লট বা আখ্যান;
২. চরিত্র;
৩. সংলাপ;
৪. পরিবেশ বর্ণনা;
৫. লিখনশৈলী বা স্টাইল;
৬. লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন।
১ প্লট বা আখ্যান : উপন্যাসের ভিত্তি একটি দীর্ঘ কাহিনী। যেখানে মানব-মানবীর তথা ব্যক্তির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, ঘৃণা-ভালোবাসা ইত্যাদি ঘটনা প্রাধান্য লাভ করে। উপন্যাসের প্লট বা আখ্যান হয় সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত। প্লটের মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রের ক্রিয়াকাণ্ডকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয় যাতে তা বাস্তব জীবনকে প্রতিফলিত করে এবং কাহিনিকে আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও বাস্তবোচিত করে তোলে।
২ চরিত্র : ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সমাজসম্পর্ক। এই সম্পর্কজাত বাস্তব ঘটনাবলি নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি নির্মিত হয়। আর, ব্যক্তির আচরণ, ভাবনা এবং ক্রিয়াকাণ্ডই হয়ে ওঠে উপন্যাসের প্রধান বর্ণনীয় বিষয়। উপন্যাসের এই ব্যক্তিই চরিত্র বা পযধৎধপঃবৎ। অনেকে মনে করেন, ঔপন্যাসে ঘটনাই মুখ্য, চরিত্র সৃষ্টি গৌণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ঘটনা ও চরিত্র পরস্পর নিরপেক্ষ নয়, একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মহৎ ঔপন্যাসিক হিসেবে একজন লেখকের অন্বিষ্ট হয় দ্ব›দ্বময় মানুষ। ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, সুনীতি-দুর্নীতি প্রভৃতির দ্ব›দ্বাত্মক বিন্যাসেই একজন মানুষ সমগ্রতা অর্জন করে এবং এ ধরনের মানুষই চরিত্র হিসেবে সার্থক বলে বিবেচিত হয়।
৩ সংলাপ : উপন্যাসের ঘটনা প্রাণ পায় চরিত্রগুরোর পারস্পরিক সংলাপে। যে কারণে ঔপন্যাসিক সচেষ্ট থাকেন স্থান-কাল অনুযায়ী চরিত্রের মুখে ভাষা দিতে। অনেক সময় বর্ণনার চেয়ে চরিত্রের নিজের মুখের একটি সংলাপ তার চরিত্র উপলব্ধির জন্য বহুল বিচার-বুদ্ধির প্রকাশ ঘটাতে পারেন। সংলাপ ও চরিত্রের বৈচিত্র্যময় মনস্তত্ত¡কে প্রকাশ করে এবং উপন্যাসের বাস্তবতাকে নিশ্চিত করে তোলে।
৪ পরিবেশ বর্ণনা : উপন্যাসের কাহিনিকে হতে হয় বাস্তবধর্মী ও বিশ্বাসযোগ্য। ঔপন্যাসিক উপনাসের দেশ-কালগত সত্যকে পরিস্ফ‚টিত করার অভিপ্রায়ে পরিবেশকে নির্মাণ করেন। পরিবেশ বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্রের জীবনযাত্রার ছবিও কাহিনিতে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পরিবেশ মানে কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়; স্থান-কালের স্বাভাবিকতা, সামাজিকতা, ঔচিত্য ও ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক জীবন পরিবেশ। দেশ-কাল ও সমাজের রীতি-নীতি, আচার প্রথা ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠে উপন্যাসের প্রাণময় পরিবেশ।
৫ শৈলী বা স্টাইল : শৈলী বা স্টাইল হচ্ছে উপন্যাসের ভাষাগত অবয়ব সংস্থানের ভিত্তি। লেখকের জীবনদৃষ্টি ও জীবনসৃষ্টির সঙ্গে ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপন্যাসের বর্ণনা, পরিচর্যা, পটভূমিকা উপস্থাপন ও চরিত্রের স্বরূপ নির্ণয়ে অনিবার্য ভাষাশৈলীর প্রয়োগই যেকোনো ঔপন্যাসিকের কাম্য। উপজীব্য বিষয় ও ভাষার সামঞ্জস্য রক্ষার মাধ্যমেই উপন্যাস হয়ে ওঠে সমগ্র, যথার্থ ও সার্থক আবেদনবাহী। উপন্যাসের লিখনশৈলী বা স্টাইল নিঃসন্দেহে যেকোনো লেখকের শক্তি, স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতার পরিচায়ক।
৬ লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন : মানবজীবনসংক্রান্ত যে সত্যের উদ্ঘাটন উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হয় তাই লেখকের জীবনাদর্শন। আমরা একটি উপন্যাসের মধ্যে একই সঙ্গে জীবনের চিত্র ও জীবনের দর্শন-এই দুইকেই খুঁজি। এর ফলে সার্থক উপন্যাস পাঠ করলে পাঠক মানবজীবনসংক্রান্ত কোনো সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। উপন্যাসে জীবনদর্শনের অনিবার্যতা তাই স্বীকৃত।
উপন্যাসের উদ্ভব
গল্প শোনার আগ্রহ মানুষের সুপ্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষের এই আগ্রহের ফলেই কাহিনির উদ্ভব। তখন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে মুখে মুখে প্রচলিত গল্প-কাহিনির বিষয় হয়ে ওঠে দেব-দেবী, পুরোহিত, গোষ্ঠীপতি ও রাজাদের কীর্তিকাণ্ড। লিপির উদ্ভবন, ব্যবহার ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার হতে বহু শতক পেরিয়ে যায়। ততদিনে মানবসমাজে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট, পুরোহিত ও ভূস্বামীদের। ফলে দেবতা ও রাজ-রাজড়ার কাহিনিই লিপিবদ্ধ হতে থাকে ছন্দ ও অলংকারমণ্ডিত ভাষায়। এভাবেই ক্রমে কাব্য, মহাকাব্য ও নাটকের সৃষ্টি।
দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষায় তথা গদ্যে কাহিনি লেখার উদ্ভব ঘটে ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে। মুখে মুখে রচিত কাহিনি যেমন রূপকথা, উপকথা, পুরাণ, জাতকের গল্প ইত্যাদি পরে গদ্যে লিপিবদ্ধ হলেও মানুষ এবং মানুষের জীবন ওইসব কাহিনির প্রধান বিষয় হতে পারেনি। কারণ তখনো সমাজে ব্যক্তি মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়নি, গড়ে ওঠেনি তার ব্যক্তিত্ব, ফলে কাহিনিতে ব্যক্তির প্রাধান্য লাভের উপায়ও ছিল অসম্ভব।
ইউরোপ যখন বাণিজ্য পুঁজির বিকাশ শুরু হয় তখন ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার অবসান ঘটাতে থাকে। খ্রিষ্টীয় চৌদ্দো-ষোলো শতকেই ইউরোপীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের ফলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভরতা, ইহজাগতিকতা এবং মানবতাবাদ। ক্রমে যা হয়ে ওঠে শিক্ষিত সমাজের সচেতন জীবনযাপনের অঙ্গ। রেনেসাঁসের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠিত হলে বিজ্ঞান ও দর্শনের অগ্রগতি বাধাহীন হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্য পুঁজির বিকাশ আরম্ভ হলে সমাজে বণিক শ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং রাজা, সামন্ত-ভূস্বামী এবং পুরোহিতদের সামাজিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ্যনির্ভরতা পরিহার করে মানুষ হয়ে ওঠে স্বাবলম্বী, অধিকার-সচেতন এবং আত্ম প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ। এভাবে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র চর্চার পথ খুলে দেয়। সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিমানুষ এবং ব্যক্তির জীবনই হয়ে ওঠে সাহিত্যের প্রধান বিষয়। এভাবেই ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তনের পটভূমিকাতেই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে উপন্যাসের।
অবশ্য এর পূর্ববর্তী কয়েক শতকেও পৃথিবীর নানা দেশে রচিত হয়েছে বিভিন্ন কাহিনিগ্রন্থ, যাতে ব্যক্তির জীবন, তার অভিজ্ঞতা, তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, তার আশা-হতাশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গভীর বিশ্বস্ততার সঙ্গে। এর উলেখযোগ্য উদাহরণ হলো- ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লানে’, ‘ডেকামেরন’, ‘ডন কুইকজোট’ ইত্যাদি।
উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে উনিশ শতক খুবই তাৎপর্যবহ। এ সময়ে লেখা হয়েছে পৃথিবীর বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। যেমন- ফ্রান্সের স্তাঁদালের ‘স্কারলেট অ্যান্ড ব্ল্যাক’, এমিল জোলার ‘দি জারমিনাল’; ব্রিটেনের হেনরি ফিল্ডিং-এর ‘টম জোন্স’, চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অফ টু সিটিজ’, রাশিয়ার লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ফিয়োদর দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ ইত্যাদি। উপন্যাস-শিল্পকে বিকাশের শীর্ষ স্তর পৌঁছে দেয়া এসব মহৎ উপন্যাস পাঠকের মনকে যুক্ত করে বৃহত্তর জগৎ ও জীবনের সঙ্গে।
উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ
উপন্যাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। কখনও তা কাহিনি নির্ভর, কখনও চরিত্র-নির্ভর; কখনও মনস্তাত্তি¡ক, কখনও বক্তব্যধর্মী। বিষয় চরিত্র, প্রবণতা এবং গঠনগত সৌকর্যের ভিত্তিতে উপন্যাসকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন :
সামাজিক উপন্যাস : যে উপন্যাসে সামাজিক বিষয়, রীতি-নীতি, ব্যক্তি মানুষের দ্ব›দ্ব, আশা-আকাক্সক্ষার প্রাধান্য থাকে তাকে সামাজিক উপন্যাস বলা হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’, নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’, কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুলাহ’, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ প্রভৃতি সামাজিক উপন্যাসের উদাহরণ।
ঐতিহাসিক উপন্যাস : জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রের আশ্রয়ে যখন কোনো উপন্যাস রচিত হয় তখন তাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে লেখক নতুন নতুন ঘটনা বা চরিত্র সৃজন করে কাহিনিতে গতিমত্তা ও প্রাণসঞ্চার করতে পারেন কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুতি হতে পারেন না। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধর্মপাল’ মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’, সত্যেন সেনের ‘অভিশপ্ত নগরী’, ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে বিবেচিত। রুশ ভাষায় লিখিত তলস্তয়ের কালজয়ী গ্রন্থ ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ভাসিলি ইয়ানের ‘চেঙ্গিস খান’ বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস।
মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাস : মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসের প্রধান আশ্রয় পাত্র-পাত্রীর মনোজগতের ঘাত-সংঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। চরিত্রের অন্তর্জগতের জটিল রহস্য উদ্ঘাটনই ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য। আবার সামাজিক উপন্যাস ও মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসে নৈকট্যও লক্ষ করা যায়। সামাজিক উপন্যাসে যেমন মনস্তাত্তি¡ক ঘাত-প্রতিঘাত থাকতে পারে, তেমনি মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসেও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত থাকতে পারে। মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসে কাহিনি অবলম্বন মাত্র, প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে মানবমনের জটিল দিকগুলো সার্থক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। বিশ্বসাহিত্যে ফরাসি লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার লিখিত ‘মাদাম বোভারি’, রুশ লেখক দস্তয়ভস্কি লিখিত ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এবং বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্-র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসের উজ্জ্বল উদাহরণ।
রাজনৈতিক উদাহরণ : সমাজ-বিকাশের অন্যতম চালিকাশক্তি যে রাজনীতি সেই রাজনৈতিক ঘটনাবলি, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট চরিত্রের কর্মকাণ্ড যে উপন্যাসে প্রাধান্য লাভ করে তাকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে রাজনৈতিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপুল পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক উপন্যাসের দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, গোপাল হালদারের ‘ত্রয়ী’ উপন্যাস-‘একদা’, ‘অন্যদিন’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ ও ‘ঢোড়াই চরিত মানস’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন’, শহীদুলাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ প্রভৃতি।
আঞ্চলিক উপন্যাস : অঞ্চল বিশেষের মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং স্থানিক রং ও স্থানিক পরিবেশবিধৌত জীবনাচরণ নিয়ে যে উপন্যাস লেখা হয় তাকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, অদ্বৈত মলবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাঁশবনের কন্যা’ ও ‘সমুদ্রবাসর’ প্রভৃতির নাম এক্ষেত্রে স্মরণীয়।
রহস্যোপন্যাস : রহস্যোপন্যাসে ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য রহস্যময়তা সৃষ্টি এবং উপন্যাসের উপান্ত পর্যন্ত তা ধরে রাখা। এ জাতীয় উপন্যাসে রহস্য উদঘাটনের জন্য পাঠক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকে। দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, নীহারঞ্জন গুপ্ত, কাজী আনোয়ার হোসেন প্রমুখ লেখক বাংলা ভাষায় বহু রহস্যোপন্যাস লিখেছেন। ফেলুদা সিরিজ, কিরীটা অমনিবাস, মাসুদ রানা সিরিজ, কুয়াশা সিরিজ প্রভৃতি এ জাতীয় উপন্যাসের দৃষ্টান্ত।
চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস : মানুষের মনোলোকে বর্তমানের অভিজ্ঞতা, অতীতের স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের কল্পনা এক সঙ্গে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহের ভাষিক বর্ণনা দিয়ে চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস লিখিত হয়। আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এমনই একটি বিখ্যাত উপন্যাস। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ চৈতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস হিসেবে পরিচিত।
আত্মজৈবনিক উপন্যাস : ঔপন্যাসিক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে যখন আন্তরিক শিল্পকুশলতায় উপন্যাসে রূপদান করেন তখন তাকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলে। এ ধরনের উপন্যাসে লেখকের ঔপন্যাসিক কল্পনার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানা অন্তর্ময় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঘটনাসূত্র। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’, বিভূতিভূবণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’-‘অপরাজিত’ এ ধরনের উপন্যাসের দৃষ্টান্ত।
রূপক উপন্যাস : সাহিত্যের রূপকাশ্রয় কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে কখনো কখনো ঔপন্যাসিক তাঁর রচনায় উপস্থাপিত কাহিনি কাঠামোর অন্তরালে কোনো বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী রূপকাশ্রয়ী বক্তব্যের সাহায্যে উপন্যাসের শিল্পরূপ প্রদান করেন। এ ধরনের উপন্যাসকে রূপক উপন্যাস বলা হয়। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের রূপক উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’- যেখানে পাত্র-পাত্রী মানুষ নয় জন্তু-জানোয়ার। রূপক উপন্যাস সৃষ্টিতে শওকত ওসমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘সমাগম’, ‘রাজা উপাখ্যান’, ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ রূপক উপন্যাসের সার্থক দৃষ্টান্ত।
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলার ভাষায় উপন্যাস লেখার সূচনা ঘটে উনিশ শতকে। টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয় প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামের কাহিনিগ্রন্থ। আধুনিক উপন্যাসের বেশ কিছু লক্ষণ, যেমন- জীবনযাপনের বাস্তবতা, ব্যক্তিচরিত্রের বিকাশ এবং মানবিক কাহিনি ইত্যাদি এ উপন্যাসে ফুটে ওঠে এবং একই সঙ্গে কিছু সীমাবদ্ধতাও সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে উলেখ্য যে, উনিশ শতকের প্রথম ষাট বছরে এ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা উপন্যাস পাঠের উপযোগী জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের আগমনকে ক্রমশ অনিবার্য করে তোলে। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫)। কাহিনি বিন্যাস এবং চরিত্র চিত্রসহ উপন্যাস রচনায় শৈল্পিক কৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়ে তিনিই প্রথম জীবনের গভীর দর্শন-পরিস্রুত ব্যক্তি-মানুষের কাহিনি উপস্থাপন করেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসেই অতীতচারী কল্পনার প্রাধান্য এবং সমকালীন জীবনের স্বল্প উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কেবল ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস দুটিতে সমকালীন জীবন ও বাস্তবতা মোটামুটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের জটিল সমস্যা ও তীব্র সংকটের কাহিনি তিনি ওই দুই উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্তে¡ও বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা উপন্যাসের বিকাশের পথ উন্মোচন করেছেন।
বঙ্কিম-পরবর্তী বাংলা উপন্যাসের ধারায় প্রধান শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্তি¡ক ও ব্যক্তিজীবনের সংকটমুখ্য কাহিনি রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর উলেখযোগ্য উপন্যাস ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘যোগাযোগ’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘শেষের কবিতা’। তিনিই প্রথম রূপায়ন করেন প্রকৃত নাগরিক জীবন। উদার মানবতাবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ধর্ম, আদর্শ ও সংস্কার নয়- মানব জীবন অনেক বেশি মূল্যবান- এই বিবেচনা তাঁর প্রায় সকল উপন্যাসেই উপস্থিত। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’ প্রভৃতি উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তিজীবনের আশা-আকাক্সক্ষার পাশাপাশি বৃহত্তর জীবনের যাবতীয় প্রসঙ্গই প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে বাংলা উপন্যাস তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আর জনপ্রিয়তম ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাসের বিষয় বাঙালি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হিন্দু সমাজের গ্রামীণ ও গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনি। তাঁর
অন্তরঙ্গ ভাষা এবং অনবদ্য বর্ণনা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে বিরল। সামাজিক সংস্কারের পীড়নে নারীর অসহায়তার করুণ চিত্র অঙ্কনে তিনি অদ্বিতীয়। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সামাজিক বাস্তবতার পাশাপাশি মুক্তি-আকাক্সক্ষার ইচ্ছাসঞ্জাত মানব মনের জটিলতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘গৃহদাহ’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’ প্রভৃতি উপন্যাসে।
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সময়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বাস্তবতা দ্রুত বদলে যায়। মানুষের পারিবারিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে শিক্ষার প্রসার ও অর্থনেতিক সংকট। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এবং অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা সাধারণ মানুষকে যেমন করে তোলে অস্থির তেমনি তাকে করে তোলে অধিকার-সচেতন। এই নতুন সামাজিক বাস্তবতায় নতুন দিগন্ত সন্ধানের তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে যুক্ত হন নতুন ধারার কয়েকজন লেখক। এঁরা মানুষের মনোলোকের জটিল রহস্য সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাছে সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে সমাজের দরিদ্র এবং অবজ্ঞাত মানুষের জীবন। এঁরা হলেন : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিন লেখক রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হন। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-‘অপরাজিত’, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’-‘পঞ্চগ্রাম’, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এক ঐতিহাসিক পটভূমিতেই বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান প্রমুখ লেখকের আবির্ভাব ঘটে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে আবির্ভূত হন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ন কবীর প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশে পরিণত হয়। নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এখানে সাহিত্য সাধনা নতুন মাত্রা লাভ করে। সূচনায় বাংলাদেশের উপন্যাস, আধুনিক চিন্তা ও ভাবধারার অনুসারী সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্, শওকত ওসমান, আবু রুশদ্ প্রমুখ লেখকের হাত ধরে এগিয়ে চলে। উপন্যাসে উপস্থাপিত হয় ব্যক্তি, সমাজ ও সমগ্র জীবনের বিশ্লেষণমূলক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলটি ছিল পাকিস্তানের এক ধরনের উপনিবেশ। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবন বিকশিত হলেও গ্রামীণ জীবন ছিল পশ্চাৎপদ। অন্ধ কুসংস্কার, ধনী-দরিদ্র্যের দ্ব›দ্ব, দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যায় বিপন্ন ও বিপর্যস্ত ছিল মানুষের জীবন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বাংলাদেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয়ের মাধ্যমে বাঙালির জাতয়ি জীবনে সৃষ্টি হয় নতুন উদ্দীপনা। নাগরিক জীবনে যেমন লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমনি শেকড়-সন্ধানী গ্রামীণ জীবনেও সৃষ্টি হয় নবতর উদ্দীপনা। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকগণ রচনা করেন নানা ধরনের উপন্যাস। নিচে উলেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাসের নাম দেয়া হলো :
আবুল ফজলের ‘রাঙা প্রভাত’, সত্যেন সেনের ‘অভিশপ্ত নগরী’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, শওকত ওসমানের ‘জননী’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, শহীদুলাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ও ‘সারেং বউ’, সরকার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, রশীদ করিমের ‘উত্তম পুরুষ’, জহির রায়হানের ‘হাজার বছরে ধরে’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’, ও ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ও ‘খোয়াবনামা’, সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, ও ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, হুমায়ন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’, ও ‘জ্যোস্না ও জননীর গল্প’ এবং শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ইত্যাদি।
‘লালসালু’র প্রকাশতথ্য
‘লালসালু’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা-র কমরেড পাবলিশার্স এটি প্রকাশ করে। প্রকাশক মুহাম্মদ আতাউলাহ। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার কথাবিতান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নওরোজ কিতাবিস্তান ‘লালসালু’ উপন্যাসের দশম মুদ্রণ প্রকাশ করে।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘লালসালু’ উপন্যাসের উর্দু অনুবাদ করাচি থেকে প্রকাশিত হয় 'খধষ ঝযধষঁ' নামে। অনুবাদক ছিলেন কলিমুলাহ।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’র ফরাসি অনুবাদ। খ'ধৎনৎব ংধহং ৎধপরহং নামে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি অনুবাদ করেন সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্-র সহধর্মিণী অ্যান-ম্যারি-থিবো। প্যারিস থেকে এ অনুবাদটি প্রকাশ করে ঊফরঃরড়হ'ং ফঁ ঝবঁরষ প্রকাশনী। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এ অনুবাদটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। 'ঞৎবব রিঃযড়ঁঃ জড়ড়ঃং' নামে লন্ডনের ঈযধঃঃড় ধহফ রিহফঁং খঃফ. এটি প্রকাশ করেন। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ নিজেই এই ইংরেজি অনুবাদ করেন।
পরবর্তীকালে ‘লালসালু’ উপন্যাসটি জার্মান ও চেক ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ-বাস্তবতা
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। রচনাটিকে একজন প্রতিভাবান লেখকের দুঃসাহসী প্রচেষ্টার সার্থক ফসল বলে বিবেচনা করা হয়। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতালিশের মন্বন্তর, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, আবার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তোলার উদ্দীপনা ইত্যাদি নানা রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখী জটিলতায় বিপর্যস্ত ও উজ্জীবিত। নবীন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্, এই চেনা জগৎটাকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাসের জন্য গ্রামীণ পটভূমি ও সমাজে-পরিবেশ বেছে নিলেন। আমাদের দেশ ও সমাজ মূলত গ্রামপ্রধান। এদেশের বেশিরভাগ লোকই গ্রামে বাস করে। এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন দীর্ঘকাল ধরে অতিবাহিত হচ্ছে নানা অপরিবর্তনশীল তথাকথিত অনাধুনিক বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে। এই সমাজ থেকেই সৈয়দ ওয়ালীউলাহ বেছে নিলেন তাঁর উপন্যাসের পটভূমি, বিষয় এবং চরিত্র। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ; বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত ধারণা বিশ্বাস, চরিত্রসমূহ একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শোষিত,দরিদ্র গ্রামবাসী, অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক-ভূস্বামী।
‘লালসালু’ একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। এর বিষয় : যুগ-যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্ব›দ্ব। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস। কাহিনিটি ছোট, সাধারণ ও সামান্য কিন্তু এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। লেখক সাধারণ একটি ঘটনাকে অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্লেষণী আলো ফেলে তাৎপর্য-মণ্ডিত করে তুলেছেন।
শ্রাবণের শেষে নিরাক পড়া এক মধ্যাহ্নে মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের প্রবেশের নাটকীয় দৃশ্যটির মধ্যেই রয়েছে তার ভণ্ডামি ও প্রতারণার পরিচয়। মাছ শিকারের সময় তাহের ও কাদের দেখে যে, মতিগঞ্জ সড়কের ওপর একটি অপরিচিত লোক মোনাজাতের ভঙ্গিতে পাথরের মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে আছে। পরে দেখা যায়, ওই লোকটিই গ্রামের মাতব্বর খালে ব্যাপারীর বাড়িতে সমবেত গ্রামের মানুষকে তিরষ্কার করছে? ‘আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ্। মোদাচ্ছের পিরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?’ অলৌকিকতার অবতারণা করে মজিদ নামের ওই ব্যক্তি জানায় যে, পিরের স্বপ্নাদেশে মাজার তদারকির জন্যে তার এ গ্রামে আগমন। তার তিরষ্কার ও স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে গ্রামের মানুষ ভয়ে এবং শ্রদ্ধায় এমন বিগলিত হয় যে তার প্রতিটি হুকুম তারা পালন করে গভীর আগ্রহে। গ্রামপ্রান্তের বাঁশঝাড়সংলগ্ন কবরটি দ্রুত পরিচ্ছন্ন করা হয়। ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয় কবর। তারপর আর পিছু ফেরার অবকাশ থাকে না। কবরটি অচিরেই মাজারে এবং মজিদের শক্তির উৎসে পরিণত হয়। যথারীতি সেখানে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বলে; ভক্ত আর কৃপাপ্রার্থীরা সেখানে টাকা পয়সা দিতে থাকে প্রতিদিন। কবরটিকে মোদাচ্ছের পিরের বলে শনাক্তকরণের মধ্যেও থাকে মজিদের সুগভীর চাতুর্য। মোদাচ্ছের কথাটির অর্থ নাম-না-জানা। মজিদের স্বগত সংলাপ থেকে জানা যায়, শস্যহীন নিজ অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া মজিদ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আসলে এই প্রক্রিয়ায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বহুকাল ধরে বিদ্যমান। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ গ্রামীণ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যথাযথভাবেই এখানে তুলে ধরেছেন।
মাজারের আয় দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মজিদ ঘরবাড়ি ও জমিজমার মালিক হয়ে বসে এবং তার মনোভূমির এক অনিবার্য আকাক্সক্ষায় শক্ত-সমর্থ লম্বা চওড়া একটি বিধবা যুবতীকে বিয়ে করে ফেলে। আসলে স্ত্রী রহিমা ঠাণ্ডা ভীতু মানুষ। তাকে অনুগত করে রাখতে কোনো বেগ পেতে হয় না মজিদের। কারণ, রহিমারও মনেও রয়েছে গ্রামবাসীর মতো তীব্র খোদাভীতি। স্বামী যা বলে, রহিমা তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। রহিমার বিশ্বাস তার স্বামী অলৌকিক শক্তির অধিকারী। প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সাথে মজিদ ধর্মকর্মের পাশাপাশি সমাজেরও কর্তা-ব্যক্তি হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে উপদেশ নির্দেশ দেয়-গ্রাম্য বিচার-সালিশিতে সে-ই হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রধান ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীই তার সহায়ক শক্তি। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর পারিবারিক জীবনেও নাক গলাতে থাকে সে। তাহেরের বাপ-মার মধ্যেকার একান্ত পারিবারিক বিবাদকে কেন্দ্র করে তাহেরের বাপের কর্তৃত্ব নিয়েও সে প্রশ্ন তোলে। নিজ মেয়ের গায়ে হাত তোলার অপরাদে হুকুম করে মেয়ের কাছে মাফ চাওয়ার এবং সেই সঙ্গে মাজারের পাঁচ পয়সার সিন্নি দেয়ার। অপমান সহ্য করতে না পেরে তাহেরের বাপ শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়। খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী আমেনা সন্তান কামনায় অধীর হয়ে মজিদের প্রতিদ্ব›দ্বী। পিরের প্রতি আস্থাশীল হলে মজিদ তাকেও শাস্তি দিতে পিছপা হয় না। আমেনা চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে খালেক ব্যাপারীকে দিয়ে তাকে তালাক দিতে বাধ্য করে মজিদ। কিন্তু তবু মাজার এবং মাজারের পরিচালক ব্যক্তিটির প্রতি আমেনা বা তার স্বামী কারুরই কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয় না।
গ্রামবাসী যাতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মজিদের মাজারকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ জীবন ধারা থেকে সরে যেতে না পারে, সে জন্য সে শিক্ষিত যুবক আক্কাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। মজিদ এমনই ক‚ট-কৌশল প্রয়োগ করে সে আক্কাস গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক গ্রাম, সমাজ ও মানুষের বাস্তব-চিত্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংযোজন।
‘লালসালু’র প্রধান উপাদান সমাজ-বাস্তবতা। গ্রামীণ সমাজ এখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থবির, যুগযুগ ধরে এখানে সক্রিয় এই অদৃশ্য শৃঙ্খল। এখানকার মানুষ ভাগ্য ও অলৌকিকত্ব গভীরভাবে বিশ্বাস করে। দৈবশক্তির লীলা দেখে নিদারুণ ভয় পেয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে নয়তো ভক্তিতে আপ্লুত হয়। কাহিনির উন্মোচন-মুহূর্তেই দেখা যায়, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি। যেখানে ন্যাংটা থাকতেই বাচ্চাদের আমসিপারা শেখানো হয়। শস্য যা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। সুতরাং ওই গ্রাম থেকে ভাগ্যের সন্ধানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে-গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে চায় সেই গ্রামেও একইভাবে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের জয়-জয়কার। এ এমনই এক সমাজ যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবলই শোষণ আর শোষণ- কখনো ধর্মীয়, কখনো অর্থনৈতিক। প্রতারণা, শঠতা আর শাসনের জটিল এবং সংখ্যাবিহীন শেকড় জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পরতে পরতে ছড়ানো। আর ওইসব শেকড় দিয়ে প্রতিনিয়ত শোষণ করা হয় জীবনের প্রাণরস। আনন্দ, প্রেম, প্রতিবাদ, সততা-এই সব বোধ এবং বুদ্ধি ওই অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা সমাজের ভেতরে প্রায়শ ঢাকা পড়ে থাকে। এই কাজে ভূস্বামী, জোতদার এবং ধর্মব্যবসায়ী একজন আর একজনের সহযোগী। কারণ স্বার্থের ব্যাপারে তারা একাট্টা-পথ তাদের এক। একজনের আছে মাজার, অন্যজনের আছে জমিজোত প্রভাব প্রতিপত্তি। দেখা যায়, অন্য কোতাও নয় আমাদের চারপাশেই রয়েছে এরূপ সমাজের অবস্থান। বাংলাদেশের যে-কোনো প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে সমাজের ভেতর ও বাইরের চেহারা যেন এরূপ একই রকম।
আবার এই বদ্ধ, শৃঙ্খলিত ও স্থবির সামাজিক অবস্থার একটি বিপরীত দিকের চিত্রও আছে। তা হলো, মানুষের প্রাণধর্মের উপস্থিতি। মানুষ ভালোবাসে, স্নেহ করে; কামনা-বাসনা এবং আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হয়। নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছা ও বাসনার কারণে সে নিজেকে আলোকিত ও বিকশিত করতে চায়। কোনো ক্ষেত্রে যদি সাফল্য ধরা না-ও দেয় তবু কিন্তু স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বেঁচে থাকে। প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকে তার চাওয়া ও না-পাওয়ার সাংঘর্ষিক রক্তময় হৃদয়ার্তি। এটা অব্যাহত থাকে মানব সম্পর্কের মধ্যে, দৈনন্দিন ও পারিবারিক জীবনে, এমনকি ব্যক্তি ও সমষ্টির মনোলোকেও।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ মানবতাবাদী লেখক। মানব-মুক্তির স্বাভাবিক আকাক্সক্ষা তাঁর সাহিত্য সাধণার কেন্দ্রে সক্রিয়। এ দেশের মানুষের সুসংগত ও স্বতঃস্ফ‚র্ত বিকাশের অন্তরায়গুলিকে তিনি তাঁর রচিত সাহিত্যের পরিমণ্ডলেই চিহ্নিত করেছেন; দেখিয়েছেন কুসংস্কারের শক্তি আর অন্ধবিশ্বাসের দাপট। স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও সমাজ সরল ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্তি ও ভীতির মধ্যে রেখে শোষণের প্রক্রিয়া চালু রাখে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ এবং ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব। তিনি সেই সমাজের চিত্র তুলে ধরেন যেখানে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’। তিনি মনে করেন, ধর্ম মানুষকে সত্যের পথে, কল্যাণের পথে, পারস্পরিক মমতার পথে নিয়ে এসেছে; কিন্তু ধর্মের মূল ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দিয়েছে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। এ কারণে মানুষের মন আলোড়িত, জাগ্রত ও বিকশিত তো হয়ইনি বরং দিন দিন হয়েছে দুর্বল, সংকীর্ণ এবং ভীত। স্বার্থ ও লোভের বশবর্তী হয়ে এক শ্রেণির লোক যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানা ভণ্ডামি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয় সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র আঘাত তার বিরুদ্ধে। লেখক সামাজিক এই বাস্তবতার চিত্রটিই এঁকেছেন ‘লালসালু’ উপন্যাসে; উন্মোচন করেছেন প্রতারণার মুখোশ।
অত্যন্ত যতœ নিয়ে রচিত একটি সার্থক শিল্পকর্ম ‘লালসালু’ উপন্যাস। এর বিষয় নির্বাচন, কাহিনি ও ঘটনাবিন্যাস গতানুগতিক নয়। এতে প্রাধান্য নেই প্রেমের ঘটনার, নেই প্রবল প্রতিপক্ষের প্রত্যক্ষ দ্ব›দ্বসংঘাতের উত্তেজনাকর ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে চমক সৃষ্টির চেষ্টা। অথচ মানবজীবনের প্রকৃত রূপ আঁকতে চান তিনি। মানুষের অন্তর্ময় কাহিনি বর্ণনা করাই লক্ষ্য তাঁর। ফলে চরিত্র ও ঘটনার গূঢ় রহস্য, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাঁকে দেখাতে হয়েছে যা জীবনকে তার অন্তর্গত শক্তিতে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করে। যে ঘটনা বাইরে ঘটে তার অধিকাংশেরই উৎস মানুষের মনে লোভ, ঈর্ষা, লালসা, বিশ্বাস, ভয়, প্রভুত্ব কামনাসহ নানরূপ প্রবৃত্তি। বাসনাবেগ ও প্রবৃত্তি মানুষের মনে সুপ্ত থাকে বলেই বাইরের বিচিত্র সব ঘটনা ঘটাতে তাকে প্ররোচিত করে। ধর্ম-ব্যবসায়ীকে মানুষ ব্যবসায়ী হিসেবে শনাক্ত করতে না পেরে ভয় পায়। কারণ, তাদের বিশ্বাস লোকটির পেছনে সক্রিয় রয়েছে রহস্যময় অতিলৌকিক কোনো দৈবশক্তি। আবার ধর্ম-ব্যবসায়ী ভণ্ড ব্যক্তি যে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ বোধ করে তা নয়, তার মনেও থাকে সদা ভয়, হয়ত কোনো মানুষ স্বাভাবিক প্রেরণা ও বুদ্ধির মাধ্যমে তার গড়ে তোলা প্রতিপত্তির ভিত্তিটাকে ধসিয়ে দেবে। নরনারীর অবচেতন ও সচেতন মনের নানান ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই এভাবে লেখকের বিষয় হয়ে উঠেছে ‘লালসালু’ উপন্যাস।
চরিত্র-সৃষ্টি
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ যে অসাধারণ কুশলী শিল্পী তা তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। ‘লালসালু’ উপন্যাসের শৈল্পিক সার্থকতার প্রশ্নে সুসংহত কাহিনিবিন্যাসের চাইতে চরিত্র নির্মাণের কুশলতার দিকটি ভূমিকা রেখেছে অনেক বেশি। ‘লালসালু’ একদিক দিয়ে চরিত্র-নির্ভর উপন্যাস।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। শীর্ণদেহের এই মানুষটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা-সবই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন, বারবার অনুসরণ করেছেন এবং তার ওপরই আলো ফেলে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন। উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আর তাই মজিদের প্রবল উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে মহব্বতনগর গ্রামের সামাজিক পারিবারিক সকল কর্মকাণ্ডে।
মজিদ একটি প্রতীকী চরিত্র- কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক সে। প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবদ্ধ জীবনধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়, ওই জীবনধারার সে প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে। এজন্য সে যেকোনো কাজ করতেই প্রস্তুত, তা যতই নীতিহীন বা অমানবিক হোক। একান্ত পারিবারিক ঘটনার রেশ ধরে সে প্রথমেই বৃদ্ধ তাহেরের বাবাকে এমন এক বিপাকে ফেলে যে সে নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়। নিজের মাজারকেন্দ্রিক শক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ অনুভব করে সে আওয়ালপুরের পির সাহেবের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নামে। ব্যাপারটি রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায় এবং নাস্তানাবুদ পির সাহেবকে শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরন করতে সে বাধ্য করে। সে খালেক ব্যাপারীকে বাধ্য করে তার সন্তান-আকাক্সক্ষী প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে। আর আক্কাস নামের এক নবীন যুবকের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। এভাবেই মজিদ তার প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠাকে নিরঙ্কুশ করে তোলে।
মহব্বতনগরে মজিদ তার প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করলেও এর ওপর যে আঘাত আসতে পারে সে বিষয়ে মজিদ অত্যন্ত সজাগ। সে জানে, স্বাভাবিক প্রাণধর্মই তার ধর্মীয় অনুশাসন এবং শোষণের অদৃশ্য বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। ফলে ফসল ওঠার সময় যখন গ্রামবাসীরা আনন্দে গান গেয়ে ওঠে তখন সেই গান তাকে বিচলিত করে। ওই গান সে বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। রহিমার স্বচ্ছন্দ চলাফেরায় সে বাধা দেয়। আক্কাস আলিকে সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত অপমানিত করে। মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও নিজের জাগতিক প্রতিষ্ঠার ভিতটিকে মজবুত করার জন্যে এসবই আসলে তার হিসেবি বুদ্ধির কাজ। সে ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তার বিশ্বাস সুদৃঢ় কিন্তু প্রতারণা বা ভণ্ডামির মাধ্যমেই যেভাবেই হোক সে তার মাজারকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এরপরও মাঝে মাঝে তার মধ্যে হতাশা ভর করে। মজিদ কখনো কখনো তার প্রতি মানুষের অনাস্থা অবলোকন করে নিজের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একেকবার আত্মঘাতী হওয়ার কথা ভাবে। মাজার প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে ক‚ট-কৌশল অবলম্বন করেছে তার সব কিচু ফাঁস করে দিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবে।
প্রতিষ্ঠাকামী মজিদ স্বার্থপরতা, প্রতিপত্তি আর শোষণের প্রতিভূ। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের পর নিঃসন্তান জীবনে সে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একপ্রকার শূন্যতা উপলব্ধি করে। এই শূন্যতা পূরণের অভিপ্রায়ে অল্পবয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে সে। প্রথম স্ত্রী রহিমার মতো দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা ধর্মের ভয়ে ভীত নয়। এমনকি, মাজারভীতি কিংবা মাজারের অধিকর্তা মজিদ সম্পর্কেও সে কোনো ভীতি বোধ করে না। তারুণ্যের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী তার মধ্যে জীবনের চঞ্চলতা ও উচ্ছলতা অব্যাহত থাকে। মজিদ তাকে ধর্মভীতি দিয়ে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়। জমিলা তার মুখে থুথু দিলে ভয়ানক ক্রুদ্ধ মজিদ তাকে কঠিন শাস্তি দেয়। তার মানবিক অন্তর্দ্ব›দ্ব তীব্র না হয়ে তার ক্ষমতাবান সত্তাটি নিষ্ঠুর শাসনের মধ্যেই পরিতৃপ্তি খোঁজে। রহিমা যখন পরম মমতায় মাজার ঘর থেকে জমিলাকে এনে শুশ্র“ষা আরম্ভ করে তখন মজিদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় তুমুল আলোড়ন। মজিদের মনে হয়, ‘মুহূর্তের মধ্যে কেয়ামত হবে। মুহূর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেনো ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম হয়।’ কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হয়। নবজন্ম হয় না তার। মজিদ শেষ পর্যন্ত থেকে যায় জীবনবিরোধী শোষক এবং প্রতারকের ভূমিকায়।
মজিদ একটি নিঃসঙ্গ চরিত্র। উপন্যাসেও একাধিকবার তার ভয়ানক নৈঃসঙ্গ্যবোধের কথা বলা হয়েছে। তার কোনো আপনজন নেই যার সঙ্গে সে তার মনের একান্তভাব বিনিময় করতে পারে। কারণ, তাঁর সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক কেবলই বাইরের-কখনো প্রভাব বিস্তার বা নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব আরোপের-কখনোই অন্তরের বা আবেগের নয়। সে কখনোই আবেগী হতে পারে না। কারণ তার জানা আছে আন্তরিকতা ও আবেগময়তা তার পতনের সূচনা করবে। আর তাতেই ধসে পড়তে হতে পারে তিলতিল করে গড়ে তোলা তার মিথ্যার সাম্রাজ্য।
এসব সত্তে¡ও মজিদ যে আসলেই দুর্বল এবং নিঃসঙ্গ-এই সত্যটি ধরা পড়ে রহিমার কাছে। ঝড়ের রাতে জমিলাকে শাসনে ব্যর্থ হয়ে মজিদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কীভাবে তরুণী বধূ জমিলাকে সে নিয়ন্ত্রণে রাখবে সেই চিন্তায় একেবারে দিশেহারা বোধ করে। এরূপ অনিশ্চয়তার মধ্যেই জীবনে প্রথম হয়ত তার মধ্যে আত্মপরাভবের সৃষ্টি হয়। নিজের শাসক-সত্তার কথা ভুলে গিয়ে রহিমার সামনে মেলে ধরে ব্যর্থতার আত্মবিশ্লেষণমূলক স্বরূপ : “কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও?” ওই ঘটনাতেই রহিমা বুঝতে পারে তার স্বামীর দুর্বলতা কোথায় এবং তখন ভয়, শ্রদ্ধা এবং ভক্তির মানুষটি তার কাছ পরিণত হয় করুণার পাত্রে।
খালেক ব্যাপারী ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র। ভূ-স্বামী ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হওয়ায় তাঁর কাঁধেই রয়েছে মহব্বতনগরের সামাজিক নেতৃত্ব। উৎসব-ব্রত, ধর্মকর্ম, বিচার-সালিশসহ এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যেখানে তার নেৃতত্বে ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত নয়। নিরাক-পড়া এক মধ্যাহ্নে গ্রামে আগত ভণ্ড মজিদ তার বাড়িতেই আশ্রয় গ্রহণ করে। একসময় যখন সমাজে মজিদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন খালেক ব্যাপারী ও মজিদ পরস্পর বজায় রেখেছে তাদের অলিখিত যোগসাজশ।
অবশ্য নিয়মও তাই। ভূ-স্বামী ও তথাকথিত ধর্মীয় মোলা-পুরোহিতদের মধ্যে স্ব-স্ব প্রয়োজনে অনিবার্যভাবে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্য। কারণ দু’দলের ভূমিকাই যে শোষকের। আসলে মজিদ ও খালেক ব্যাপারী দুজনেই জানে : ‘অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের পক্ষে উলটা পতে যাওয়া সম্ভব নয়। একজনের আছে মাজার, আরেকজনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক। হাজার বছর ধরেই শোষক শ্রেণির অপকর্মের চিরসাথী ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা সম্মিলিত উদ্যোগে সমাজে টিকিয়ে রাখে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার। শিক্ষার আলো, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও অধিকারবোধ সৃষ্টির পথে তৈরি করে পাহাড়সম বাধা-যাতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত থাকে বিকশিত মানব চেতনা থেকে। এরই ফলে সফল হয় শোষক। শুধু ভূস্বামী শোষক কেন, যে কোনো ধরনের শোষকের ক্ষেত্রে একথা সত্য। তারা শোষণের স্বার্থে ধর্মব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। একারণেই মজিদের সকল কর্মকাণ্ডে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছে খালেক ব্যাপারী। এমনকি মজিদের প্রভাব প্রতিপত্তি মেনে নিয়েছে অবনত মস্তকে; যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিজের একান্ত প্রিয় প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবিকে তালাক দেয়া।
‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খালেক ব্যাপারী উপস্থিতি থাকলেও সে কখনোই আত্মমর্যাদাশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা জানি যে, ধর্মব্যবসায়ীরা আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হিসেবে জাহির করে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভুত্ব করে। ফলে শোষকরাও তাদের অধীন হয়ে যায়। কিন্তু শোষকদের হাতে যেহেতু থাকে অর্থ সেহেতু তারাও ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থের শক্তিতে অধীন করে ফেলে। কিন্তু এখানে খালেক ব্যাপারীর চরিত্রে আমরা সে দৃঢ়তা কখনোই লক্ষ করি না। বরং প্রায় সব ক্ষেত্রেই মজিদের কথার সুরে তাকে সুর মেলাতে দেখা যায়। ফলে মজিদ চরিত্রের সঙ্গে সে কখনো দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হয়নি। তার অর্থের শক্তি সবসময় মাজার-শক্তির অধীনতা স্বীকার করেছে। তাঁর এই চারিত্রিক দৌর্বল্য ইতিহাসের ধারা থেকেও ব্যতিক্রমী।
মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। লম্বা চওড়া শারীরিক শক্তিসম্পন্না এই নারী পুরো উপন্যাস জুড়ে স্বামীর ব্যক্তিত্বের কাছে অসহায় হয়ে থাকলেও তার চরিত্রের একটি স্বতন্ত্র মাধুর্য আছে। লেখক নিজেই তার শক্তিমত্তাকে বাইরের খোলস বলেছেন, তাকে ঠাণ্ডা ভীতু মানুষ বলে পরিচিতি দিয়েছেন। তার এই ভীতি-বিহŸল, নরম কোমল শান্ত রূপের পেছনে সক্রিয় রয়েছে ঈশ্বর-বিশ্বাস, মাজার-বিশ্বাস এবং মাজারের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও ভক্তি। ধর্মভীরু মানুষেরা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের কারণে যে কোমল স্বভাবসম্পন্ন হয় রহিমা তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমগ্র মহব্বতগরের বিশ্বাসী মানুষদেরই সে এক যোগ্য প্রতিনিদি। স্বামী সম্পর্কে মাজার সম্পর্কে তার মনে কোনো প্রশ্নের কাজকর্মের পবিত্রতা রক্ষা এবং তার নিজের সকল গার্হস্থ্য কর্ম প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই সে একান্তভাবে সৎ এবং নিয়মনিষ্ঠ। মাজার নিয়ে যেমন রয়েছে তার ভীতি ও শক্তি, তেমনি এই মাজারের প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবেও রয়েছে তার মর্যাদাবোধ। এই মর্যাদাবোধ থেকেই সে গ্রামের মাজার ও মাজারের প্রতিনিধি সম্পর্কে গুণকীর্তন করে, তার শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস তুলে ধরে এবং এভাবে সে নিজেকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। হাসুনি মায়ের সমস্যা যখন সে তার স্বামীর কাছে জানায় কিংবা আমেনা বিবির সংকট মুহূর্তে তার পাশে গিয়ে অবস্থান নেয় তখন তার মধ্যে মাজার-প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবে গর্ববোধ কাজ করে। এ গর্ববোধ ছাড়াও এখানে সক্রিয় থাকে নারীর প্রতি তার একটি সহানুভূতিশীল মন। রহিমার মনটি স্বামী মজিদের তুলনায় একেবারেই বিপরীতমুখী।
মজিদের কর্তৃত্বপরায়ণতা, মানুষের ধর্মভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রযোগের দুরভিসন্ধি প্রভৃতির বিপরীতে রহিমার মধ্যে সক্রিয় থাকে কোমল হৃদয়ের এক মাতৃময়ী নারী। সেটি জমিলা প্রসঙ্গে লক্ষ করা যায়। তাদের সন্তানহীন দাম্পত্য-জীবনে মজিদ যখন দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব করে তখন রহিমার মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি হয় না। এর মূলে সক্রিয় তার স্বামীর প্রতি অটল ভক্তি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতার প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং সরল ধর্মনিষ্ঠা। কিন্তু জমিলা যখন তার সতিন হিসেবে সংসারে আসে তখনও সামাজিক গার্হস্থ্য বাস্তবতার কারণে যেটুকু ঈর্ষা সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন ছিল তাও অনুপস্থিত থাকে তার ওই হৃদয়সংবেদী মাতৃমনের কারণে। জমিলা তার কাছে সপতœী হিসেবে বিবেচিত হয় না বরং তার মাতৃহৃদয়ের কাছে সন্তানতুল্য বলে বিবেচিত হয়। এ পর্যায়ে জমিলাকে কেন্দ্র করে তার মাতৃত্বের বিকাশটি পূর্ণতা অর্জন করে যখন মজিদ জমিলার প্রতি শাসনের খড়–গ তুলে ধরে।
স্বামীর সকল আদেশ নির্দেশ উপদেশ সে যেভাবে পালন করেছে সেইভাবে জমিলাও পালন করুক সেটি সেও চায় কিন্তু সে পালনের ব্যাপারে স্বামীর জোর-জবরদস্তিকে সে পছন্দ করে না। স্বামীর প্রতি তার দীর্ঘদিনের যে অটল ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এক্ষেত্রে তাতে ফাটল ধরে। এক্ষেত্রে তার ধর্মভীরুতাকে অতিক্রম করে মুখ্য হয়ে ওঠে নিপীড়িত নারীর প্রতি তার মাতৃহৃদয়ের সহানুভূতি। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয়েছিল ব্যক্তিত্বহীন, একমাত্র আনুগত্যের মধ্যেই ছিল যার জীবনের সার্থকতা, সেই নারীই উপন্যাসের শেষে এসে তার মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বময় হয়ে ওঠে। রহিমা চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখানেই লেখকের সার্থকতা।
নিঃসন্তান মজিদের সন্তান-কামনাসূত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রীরূপে আগমন ঘটে জমিলার। শুধু সন্তান-কামনাই তার মধ্যে একমাত্র ছিল কীনা, নাকি তরুণী স্ত্রী-প্রত্যাশাও তার মাঝে সক্রিয় ছিল তা লেখক স্পষ্ট করেননি। কিন্তু বাস্তবে আমরা লক্ষ করি তার গৃহে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে যার আগমন ঘটে সে তার কন্যার বয়সী এক কিশোরী। জমিলার চরিত্রে কৈশোরক চপলতাই প্রধান। এই চপলতার কারণেই দাম্পত্য সম্পর্কের গাম্ভীর্য তাকে স্পর্শ করে না। এমনকি তার সপতœী রহিমাও তার কাছে কখনো ঈর্ষার বিষয় হয়ে ওঠে না। রহিমা তার কাছে মাতৃসম বড়বোন হিসেবেই বিবেচিত হয় এবং তার কাছ থেকে সে তদ্রূপ স্নেহ আদর পেয়ে অভিমান-কাতর থাকে। রহিমার সামান্য শাসনেও তার চোখে জল আসে। তার ধর্মকর্ম পালন কিংবা মাজার-প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবে তার যেরূপ গাম্ভীর্য রক্ষা করা প্রয়োজন সে-ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো সচেতনতাই লক্ষ করা যায় না ওই কৈশোরক চপলতার কারণে। প্রথম দর্শনে স্বামীকে তার যে ভাবী শ্বশুর বলে প্রতীয়মান হয়েছিল, বিয়ের পরেও সেটি তার কাছে হাস্যকর বিষয় হয়ে থাকে ওই কৈশোরক অনুভূতির কারণেই। ধর্মপালন কিংবা স্বামীর নির্দেশ পাঅন উভয় ক্ষেত্রেই তার মধ্যে যে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার অভাব তার মূলে রয়েছে এই বয়সোচিত অপরিপক্বতা। মাজার সম্পর্কে রহিমার মতো সে ভীতিবিহŸল নয় কিংবা মাজারের পবিত্রতা সম্পর্কেও নয় সচেতন এবং এই একই কারণে মাজারে সংঘটিত জিকির অনুষ্ঠান দেখার জন্য তার ভিতরে কৌত‚হল মেটাতে কোথায় তার অন্যায় ঘটে তা উপলব্ধির ক্ষমতাও তার হয় না। সুতরাং স্বামী মজিদ যখন এসবের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তার অনুচিত কর্ম সম্পর্কে তাকে সচেতন করে, তখন সেসবের কিছু তার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় না। সুতরাং তাকে শাসনের ব্যাপারে মজিদের মুখে যে সে থুথু নিক্ষেপ করে সেটাও তার মানসিক অপরিপক্বতারই ফল। এমনকি মাজারে যখন তাকে বন্দি করে রেখে আসে মজিদ তখন সেই অন্ধকারের নির্জনে ঝড়ের মধ্যে ছোট মেয়েটি ভয়ে মারা যেতে পারে বলে রহিমা যখন আতঙ্কে স্বামীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তখনও জমিলাকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখা যায়। এরূপ আচরণের মূলেও সক্রিয় থাকে তার স্বল্প বয়সোচিত ছেলেমানুষি, অপরিপক্বতা। অর্থাৎ এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসে একটি প্রাণময় সত্তার উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। শাস্ত্রীর ধর্মীয় আদেশ নির্দেশের প্রাবল্যে পুরো মহব্বতনগর গ্রামে যে প্রাণময়তা ছিল রুব্ধ, জমিলা যেন সেখানে এক মুক্তির সুবাতাস। রদ্ধতার নায়ক যে মজিদ, ঔপন্যাসিক সেই মজিদের গৃহেই এই প্রাণময় সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
একদিকে সে নারী অন্য দিকে সে বয়সে তরুণীÑ এই দুটিই তার প্রাণধর্মের এক প্রতীকী উদ্ভাসন। এ উপন্যাসে মজিদের মধ্য দিয়ে যে ধর্মতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছে তার পেছনে পুরুষতন্ত্রও সক্রিয়। সুতরাং নির্জীব ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে সজীব প্রাণধর্মের জাগরণের ক্ষেত্রে এ নারীকে যথাযথভাবেই আশ্রয় করা হয়েছে। জমিলা হয়ে উঠেছে নারীধর্ম, হৃদয়ধর্ম বা সজীবতারই এক যোগ্য প্রতিনিধি।
‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ ও খালেক ব্যাপারীর পরিবার ছাড়া আরেকটি পরিবারের কাহিনি গুরুত্ব লাভ করেছে। সেটি তাহের-কাদের ও হাসুনির মায়ের পরিবার। এদের পিতামাতার কলহ এবং তাই নিয়ে মজিদের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে তাহের-কাদেরের পিতা চরিত্রটি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। উপন্যাসের এটিই একমাত্র চরিত্র যে মজিদের আধ্যাত্মিক শক্তির ব্যাপারে অবিশ্বাস পোষণ করেছে, বিচার সভায় প্রদর্শন করেছে অনমনীয় দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব। তার নির্ভীক যুক্তিপূর্ণ ও উন্নত-শির অবস্থান নিশ্চিতভাবে ব্যতিক্রমধর্মী। সে মজিদের বিচারের রায় অনুযায়ী নিজ মেয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে ঠিকই কিন্তু তা মজিদের প্রতি শ্রদ্ধা বা আনুগত্যবশত নয়। মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই সে এ কাজ করেছে। তবে এর পরপরই তার নিরুদ্দেশ গমনের ঘটনায় এই চরিত্রের প্রবল ব্যক্তিত্বপরায়ণতা ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় ফুটে ওঠে। এই আচরণের মধ্য দিয়ে মজিদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদও ব্যক্ত হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের কাহিনি অত্যন্ত সুসংহত ও সুবিন্যস্ত। কাহিনি-গ্রন্থনায় লেখক অসামান্য পরিমিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনির বিভিন্ন পর্যায়ে নাট্যিক সংবেদনা সৃষ্টিকে লেখক প্রদর্শন করেছেন অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা, ধর্মতন্ত্র ও ধর্মবোধের দ্ব›দ্ব, ধর্মতন্ত্র-আশ্রয়ী ব্যবসাবৃত্তি ও ব্যক্তির মূলীভূত হওয়ার প্রতারণাপূর্ণ প্রয়াস, অর্থনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামোর সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির যোগ প্রভৃতি বিষয়কে লেখক এক স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ভাষায় রূপায়ণ করেছেন। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শেকড়হীন বৃক্ষপ্রতিম মজিদ, ধর্মকে আশ্রয় করে মহব্বনগরে প্রতিষ্ঠা-অর্জনে প্রয়াসী হলেও তার মধ্যে সর্বদাই কার্যকর থাকে অস্তিত্বের এক সূ²তর সংকট। এরূপ সংকটের একটি মানবীয় দ্ব›দ্বময় রূপ সৃষ্টিকে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র সার্থকতা বিস্ময়কর।
বাংলা উপন্যাসের ধারা
গল্প বলতে ও শোনতে মানুষের ভালো লাগে। অতীতে মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়েছে অনেক কাহিনি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্য নির্ভর। সে-কাব্য নির্ভর সাহিত্যের মঙ্গল কাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ও ময়মনসিংহ গীতিকার নীতির মাঝে বাংলা উপন্যাসের বীজ নিহিত ছিল।
উপন্যাসের বাহন পদ্য নয় গদ্য। পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও রচিত হয় প্রথমে কবিতা, পরে গদ্য। ১৮০১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এ কলেজে শুরু হয় বাংলা গদ্য চর্চা। তার পর বাংলা গদ্য দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। কাল ক্রমে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাজ-কর্মের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে বাংলা গদ্য। এই গদ্যে রচিত হতে থাকে সমাজ পরিস্থিতি। তখন দেশ ছিল ইংরেজ বেনিয়াদের অধীনে। ইংরেজ শাসন ইংরেজি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে এ দেশের সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছিল তখন (১৮৫১ সালের পরে) এক ধরনের সামাজিক উপন্যাস রচিত হতে থাকে। পরর্বতিতে ভবানীচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নব বাবু বিলাস’, ‘নব বিবি বিলাস’, কালী প্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ইত্যাদি এ ধরনের রচনা। বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায় হানা ক্যাথারিন মুলেন্সের ‘ফুলমণি’ ও ‘করুণার বিবরণ’ এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রভৃতি গ্রন্থে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস। এরপর রবীন্দ্রনাথের হাতে উপন্যাসের গতিধারা আরো সার্থক ও সুন্দর হয়। ‘চোখের বালি’, ‘যোগাযোগ’, ‘ঘরে বাইরে’ ইত্যাদি তার সার্থক উপন্যাস।
এর পর বাংলা সাহিত্যের গতিধারায় আসেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে বলা হয়ে থাকে অপরাজেয় কথাশিল্পী। তিনি এ দেশের পারিবারিক ও সমাজিক জীবনকে তার উপন্যাসে অত্যন্ত সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘বড় দিদি’, ‘মেজদিদি’, ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’, ‘দেনা-পাওনা’ ইত্যাদি তাঁর উলেখযোগ্য উপন্যাস। তাঁর উপন্যাসে নৈতিক সমস্যার কথা না থাকলেও নারী সমস্যার নানা বক্তব্য পেশ করা হয়েছে অত্যন্ত সার্থকভাবে। স্বর্ণকুমারীদেবী, নিরুপমা দেবী, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন প্রমুখ মহিলা ঔপন্যাসিকও বাংলা উপন্যাসের গতিধারায় বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। পরবর্তী কালে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, নাজিবর রহমান সাহিত্যরতœ, ইমদাদুল হক, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের সাহিত্যকর্মে বাংলা সাহিত্যের বৃদ্ধি হয়।
বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারা
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে। পাকিস্তান ও ভারত নামে উপমহাদেশ দুভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। আজকের বাংলাদেশের তখন নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালিরা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। তাই বাংলাদেশের সাহিত্য বলতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঊনসত্তর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রকাশিত সাহিত্যকে বোঝায়। এ সুদীর্ঘ কালে ঘটেছে অনেক ঘটনা। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের আমলে রাজনৈতিক পালা বদল ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশের উপন্যাসের আঙ্গিক ও বক্তব্যে অনেক পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য এনেছে।
বাংলাদেশের উপন্যাসের গতিধারা ক্রমশ গ্রামীণ জীবন থেকে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের দিকে যাচ্ছে। সমকালীন সমাজজীবন, যুগ যন্ত্রণা ইত্যাদি দিক চিত্রায়নে শিল্পীগণ যথেষ্ঠ সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। আবুল মনসুর আহমদের ‘সত্যমিথ্যা’, ‘আবেহায়াত’; আবুল ফজলের ‘চৌচির’, ‘জীবন পথের যাত্রী’, শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ সৈয়দ ওয়ালীউলাহর ‘লালসালু’, আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ শহীদুলাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’,-সারেংবৌ’ জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’ ইত্যাদি উলেখযোগ্য উপন্যাস।
স¤প্রতি কালের উলেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হলেন শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমদ, হুমায়ুন আজাদ, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখ। এ যুগের উপন্যাসে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি-সমাজনীতি, মূল্যবোধের পরিবর্তন, নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজ মানসের চিত্র ও চরিত্র সুন্দর এবং সার্থকভাবে মূর্ত হয়ে ওঠেছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে প্রতিফলিত সমাজচিত্র
‘লালসালু’ উপন্যাসটি যদিও বিশ শতকের প্রথমার্ধে রচনা, তবু সামগ্রিক বিবেচনায় এই উপন্যাসটি সব কালেই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার প্রধান কারণ এই যে, এ উপন্যাসে কাল খুব একটা স্পষ্ট রেখায় অঙ্কিত হয়নি, যতটা স্পষ্ট করে অঙ্কিত হয়েছে সমাজ ও জীবনের রূপায়ণ। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে গ্রামীণ বাংলার সমাজ ও জীবনের যে-চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন, তা আমাদের অনেক চেনা; বলা যায়, আবহমান কাল ধরে চেনা, এবং এই চেনা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাংলার সমাজ ও জীবন যে গত পাঁচ শ বছরে খুব একটা বদলেছে এমন নয়গ্রামীণ পটভূমিতে তো নয়ই। তাই, এ কথা আমরা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, ‘লালসালু’ উপন্যাসে ছায়াপাতে আবহমান কালের গ্রামীণ বাংলার জনজীবন ও সমাজের রূপায়ণে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ যথেষ্ট সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ এমন একটি সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যেটি স্মরণাতীত কাল থেকে কুসংস্কারের জটাজালে আচ্ছন্ন। লালসালু কাপড় দিয়ে মাজার ঢেকে রেখে যেমন ধর্মব্যবসায়ীরা যুগের পর যুগ ধর্মপ্রাণ অশিক্ষিত মানুষদের ধোঁকা দিয়ে আসছে এবং কুসংস্কারের ভারী চাদরে মোড়ানো গ্রামীণ বাংলাদেশের সমাজের পরতে পরতে অন্ধত্ব ও প্রথাবদ্ধতা কী রকম অশুভ ছায়া বিস্তার করেছিল, সেটাই মূলত ওয়ালীউলাহ্ তাঁর এ মহান উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
লেখকের মূল অবলম্বন হচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। ধর্মব্যবসায়ের সে-ই হোতা। তাকে আপাতভাবে সহায় সম্বলহীন হিসেবে অঙ্কন করলেও সে অত্যন্ত ধুরন্ধর, শঠ ও নিপীড়ক। এ উপন্যাসের সমাজচিত্র অঙ্কনে লেখক মজিদ চরিত্রের মনোজাগতিক অনুভব ও তার চিন্তারাশিকেই মূল সহায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, মজিদই এ উপন্যাসে লেখকের প্রতিনিধি চরিত্রপ্রতিনিধি এই অর্থে, লেখক মজিদের চোখেই মহব্বতনগর ও আওয়ালপুরের গ্রামের জনজীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন, অনুভব করেছেন সে কালের মানুষের হৃদস্পন্দন আপন হৃদয়ে। মজিদ নিঃসন্দেহে একটি নেতিবাচক চরিত্র; তবু সে ‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র সমাজ ও জীবনের অভিজ্ঞতার ফসলঅপপুত্র হলেও মজিদ ওয়ালীউলাহ্র মানস সন্তান।
‘লালসালু’ সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র প্রথম উপন্যাস। আমরা জানি, তিনি আজন্ম শহরে থেকেছেন, অভিজাত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। নাগরিক রুচি ও মননের অধিকারী হলেও তিনি শহরকেন্দ্রিক কোনো উপন্যাস লেখেননি। মাত্র তিনটি উপন্যাস তিনি রচনা করেছেন। তিনটির পটভূমিই গ্রামে সংস্থাপিত। এর কারণ হিসেবে সমালোচকগণ জানিয়েছেন, গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির মর্মমূলে যুগ যুগ ধরে যে কুংসংস্কার গ্রোথিত আছে, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ মূলত সেই কুসংস্কারের শিকড় উপড়ে ফেলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। শওকত আলী বলেছেন:
“তাঁর উপন্যাসের পটভূমি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং তার সমাজ-চরিত্র, একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু শোষিত দরিদ্র গ্রামবাসী; অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক ভূস্বামী। তাঁর উপন্যাসের বিষয় যুগ যুগ ব্যাপী শিকড়-গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্ব›দ্ব।”
‘লালসালু’তে আমরা গ্রামীণ বাংলাদেশকে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। নাগরিক বিদগ্ধ লেখক সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ এক মুহূর্তে আমাদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যান, যে জগৎ তাঁর বাস্তব পরিচিত ছিল কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের অপরিচিত নয়। এমন এক গ্রাম মহব্বতনগর। সবাই সেখানে সব কাজের মধ্যে দৈব শক্তির লীলা দেখতে পায়। এ দৈব শক্তি আবার এমন দৈব শক্তি যা কিনা আবার মাজারের ভেতরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন একজন মোদাচ্ছের পীর। পীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শেষ করবার মতো নয়। পীরের মাজারের যিনি খাদেম, তিনিও কম যান না। তাকেও কেবল দণ্ডমুণ্ডের কর্তাই কেবল ভাবা হয়নি, প্রাণসংহারক এমনকি প্রাণদাতাও কল্পনা করা হয়েছে। রহিমার মাধ্যমে হাসুনির মা যখন আর্জি পেশ করে, “ওনারে কইবেন, আমার যেন মওত হয়” অথবা খ্যাংটা বুড়ী মাজারে এসে তার সর্বস্ব আনা পাঁচেক পয়সা মজিদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে বলে, “সব দিলাম আমি, সব দিলাম। পোলাটার এইবার জান ফিরাইয়া দেন।” তখন আমাদের বুঝতে কোনো কষ্টই হয় না যে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ এতটাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে, তারা মনে করে মজিদ চাইলে যে কারও মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দিতে পারে, অথবা চাইলেই মৃত মানুষকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা রাখে। অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের চাদরে মোড়ানো সে সমাজ যে সমাজের প্রতিভূ ধর্মব্যবসায়ী মজিদ এবং ভূস্বামী খালেক ব্যাপারী হাতে হাত মিলিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে গেছে। এদের কাছে যারা মাথা নত করে নি, তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেমন তাহের-কাদেরের বাবাকে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে, আওয়ালপুরের পীর সাহেবকে পিছু হঠতে হয়েছে, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠা সফল হয়নি। সুতরাং, আমরা বলতেই পারি, ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা এমন এক সমাজের সাথে পরিচিত হই, যে সমাজ আবহমান কালের কুসংস্কারের তামাসায় আচ্ছন্ন। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন।
“........যুগ যুগ ধরে এ নরম মাটির ধর্মভীরু মানুষের মনটিও নরম; এ মাটির শাসক-শোষক শ্রেণির অন্যতম হলো ধর্ম-ব্যবসায়ী স¤প্রদায়, তাদের কাছে মানুষের দুর্বলতাই বড় পুঁজি। ‘লালসালু’র কাহিনিটি ওপরে ওপরে এমনি একটি ভুঁইফোড় মাজার কেন্দ্রিক গল্প কিন্তু ভিতরে-ভিতরে গ্রামের বাঙালি মুসলমান সমাজ জীবনের আলেখ্য।”
তবে এর বিপরীত চিত্রও ‘লালসালু’তে বিদ্যামান। মজিদের চাপিয়ে দেওয়া কুসংস্কারভিত্তিক প্রথাধর্মের আবরণ ভেদ করে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ প্রায়শই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। সেটা তাদের স্বতঃর্স্ফূত প্রাণধর্মের বিকাশ। এমনিতে তারা ধর্মকর্ম বিশেষ একটা করে না, যতটা মগ্ন থাকে আনন্দ ফ‚র্তিতে। খরার দিনে জমিতে যখন ফাটল ধরে, তখন আলাহর নাম নেয়। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর উপন্যাসে প্রথাধর্মের সাথে প্রাণধর্মের চিরন্তন দ্ব›দ্ব দেখিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণধর্মের পক্ষ নিয়ে তার জীবন নিশ্চিত করেছেন।
‘লালসালু’ উপন্যাসে বিধৃত সমাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হয় না। প্রথমটি হচ্ছে, লেখকের আক্রমণের লক্ষ্য কী ছিল? ধর্ম, নাকি ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার? দ্বিতীয়টি হলো, সমাজপতি খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি এরূপে অঙ্কিত হয়েছে কেন? এটি কি লেখকের পরিকল্পিত ইচ্ছাকৃত কোনো সম্পাদিত বাস্তবতা, নাকি গ্রামীণ সমাজ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের অনভিজ্ঞতার অভাবে এমনটি হয়েছে?
যেহেতু সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ এমন এক সমাজের গল্প বলেছেন, যে সমাজে ‘শস্যের চেয়ে টুপী বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’ সুতরাং, তার আক্রমণের লক্ষ্য ধর্ম নয়, ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার। ধর্ম চিরদিনই মানুষকে সত্য সুন্দর ও কল্যাণের পথ দেখিয়ে এসেছে কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থকে হাসিল করার অসৎ উদ্দেশ্যে ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে কুসংস্কার, মাজার-পূজা ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এসেছে এবং তারা তা বাস্তবায়ন করার জন্য নিরন্তরভাবে করে যাচ্ছে নানা ছলাকলা, কায়দা-কানুন। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ আঘাত করেছেন এই শ্রেণিটিকেধর্মকে নয়। তবে বিতর্ক এই কারণে ওঠে যে, তার উপন্যাসে শুদ্ধ ধার্মিক কোনো চরিত্র মর্যাদার সঙ্গে অঙ্কিত হয়নিধর্ম ও ধর্মসংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলো সবই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
খালেক ব্যাপারী, স্পষ্টতই লেখকের বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে যতটা সম্পর্কিত, তার পরিকল্পনার স্বাক্ষর ততটা বহন করে না। সমাজপতি এবং সেই সমাজের ধর্মীয় নেতার স্বার্থ অভিন্ন হয়এটি অর্থতত্তে¡ বলে, সমাজবিজ্ঞানে বলে, ইতিহাসে আছে। খালেক ব্যাপারী ও মজিদের স্বার্থ অভিন্ন। তারা দুজন একে অপরের পরিপূরক, কিন্তু সমাজপতি কখনই ধর্মীয় নেতা দ্বারা পরিচালিত হয় না। কারণ, অর্থ সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ করে, ধর্ম হচ্ছে যার ক্ষুদ্র একটি বহির্কাঠামো মাত্র। কাজেই খালেক ব্যাপারী চরিত্র নির্মিতিতে ব্যর্থতার পেছনে অর্থশাসিত সমাজবিশেষ করে গ্রামীণ সমাজ, বাস্তব জীবনে লেখক যে সমাজকে খুব কাছে থেকে দেখেননি, তার অনভিজ্ঞতা একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাহিনি-সংক্ষেপ
দেশটাই যেন কেমন। ফসল একদম ফলে না অথচ অনেক মানুষের সেখানে বসবাস। ঘরে খাবার নেই। ঘরে অভাব থাকলে যা হয়সারাক্ষণ এলাকার মানুষ ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে, কখনও খুনখারাবিও। তাই তারা ছোটে। এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। আশাই তাদের দেশ থেকে বাহিরে নিয়ে আসে। খিদে সহ্য করতে না পেরে তারা ঘর ছাড়া। এদের একজনই মজিদ ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র।
শ্রাবণ মাসের শেষ দিক। মহব্বতনগর গ্রামের দুই যুবক তাহের ও কাদের কোচ জুতি নিয়ে ধানক্ষেতে নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করছিল। তারাই প্রথমে মজিদকে দেখে। দেখে মজিদ মতিগঞ্জের সড়কের ওপরে আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মজিদের এমন নাটকীয়তার কারণ এই যে, সে জানে গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক কোনো ঘটনা পছন্দ করবে না। তার আগমন যতটা নাটকীয় বানানো যায়, সেটা সে করার চেষ্টা করেছে। এর অংশ হিসেবে সে খুঁজে বের করে গ্রাম থেকে একটু বাইরে একটা বড় বাঁশ-বাগান। বাঁশ-ঝাড়ের ওধারে পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ভাঙা একটি প্রাচীন কবর। ইটগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো। শেয়ালের বাসা হবে হয়তো। সেই কবরটিকে সে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে দাবি করে।
মহব্বতনগর গ্রামে ঢুকে সে সোজা চলে যায় গ্রামের মোড়ল খালেক ব্যাপারীর বাড়ি। সবাইকে চিৎকার করে সে ‘জাহেল’, ‘বেএলেম’ ‘আনপাড়াহ্’ বলে বিস্তর গালমন্দ করে জানায় যে, এ-রকম একজন কামেল পীরের মাজারকে এভাবে অযতেœ ফেলে রেখে এরা মহাপাপ করেছে। গ্রামবাসী তো বটেই মোড়ল খালেক ব্যাপারী, মাতাব্বর রেহান আলীও লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকে। মজিদ তাদের জানায়, সে গারো পাহাড়ে খুব শান্তিতে ছিল, কিন্তু এখানে সে ছুটে এসেছে তার কারণ এক দৈবস্বপ্ন। স্বপ্নে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মহব্বতনগরে চলে আসার জন্য। তাই তার এ আগমন।
জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলা হলো। কবর নতুন করে বাঁধানো হলো। আগরবাতির গন্ধে, মোমবাতির আলোয় সৃষ্টি হলো নতুন এক পরিবেশ। কবরের ওপরে টানিয়ে দেওয়া হলো লালসালু কাপড়। এ গ্রাম ও গ্রাম থেকে লোকজন আসে। তাদের নানা আশার কথা, নানা কষ্টের কথা লালসালু কাপড়ে ঢাকা কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তিকে শোনায় আর যাবার সময় দিয়ে যায় টাকা-পয়সা। শুরু হলো মজিদের ব্যবসা।
মজিদের ঘরবাড়ি উঠতে বেশিদিন লাগে না। জমিজমা হলো। তারপর সে একদিন তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়েও করে। পাত্রীর নাম রহিমা। লম্বা-চওড়া, শক্তিশালী হলেও সে স্বামীর খুব অনুগামী। গ্রামের মানুষ মজিদকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে, খালেক ব্যাপারীকে হয়তো ভয়ই কেবল পায় অথবা এড়িয়ে চলে। মেয়ে-মহলে রহিমার আলাদা একটা কদর। মহিলারা তো আর মজিদের বরাবর তাদের আর্জি পেশ করতে পারে না, তাই রহিমাই তাদের অবলম্বন। রহিমার মাধ্যমেই তারা তাদের ফরিয়াদ জানায়।
তাহের-কাদেরের বাবা-মার বয়স হয়েছে, কিন্তু ঝগড়াঝাটি করার অভ্যাস তো কমেইনি বরং দিনদিন তা অশ্লীল গালাগালিতে গিয়ে পৌঁছেছে। বুড়ো এক কালে মারপিটে ওস্তাদ ছিল, এখন বয়স হয়ে গেছে বলে হাতের সেই জোরটা নেই, কিন্তু বুড়ির বয়স হলে হবে কি, মুখের ধারটা যেন আরও বেড়েছে। সে যা বলে, তা শুনে পাড়া-পড়শি তো বটেই, তার বিধবা মেয়েও আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসে। বুড়ির বক্তব্য একটিই তার পেটে যে ছেলেমেয়েগুলো জন্মেছে, এগুলো বুড়োর নয়বুড়োর আবার ওই ক্ষমতা ছিল নাকি কোনো কালে? ঝগড়া তো নয় সে এক এলাহি কাণ্ড! তাহের-কাদেরের বাবা কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েকেহাসুনির মাকেপিটিয়েছিল। মজিদ ভর মজলিশে তাহের-কাদেরের বাবাকে অপমান করে, যার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে বৃদ্ধ লোকটি এক সন্ধ্যায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সে আর বাড়ি ফেরে না। যে বুড়ি প্রতিদিন তাকে নানা গালমন্দ করতো, সে-ও স্তব্ধ হয়ে যায়; শিশুর মতো ডাকতে থাকে: ‘আলা আলা ........’
হাসুনির মা বিধবা। রহিমার কাছে সে জানিয়েছে যে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মানুষ নয়। বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছে। ভাইয়েরা অকর্মণ্য, অপদার্থ। সে তো একাও নয়, সঙ্গে আছে তার শিশুপুত্র। তাই সে কাজ নেয় মজিদের বাড়িতে। রহিমাকে ঘর গেরস্থালিতে সাহায্য করা। হাসুনির মা মজিদের বাড়িতে কাজ করতে এলে মজিদের কুদৃষ্টি তার ওপর পড়ে। মুখে যদিও সে হাসুনির মাকে ‘বিটি’ (মেয়ে) সম্বোধন করেছে, কিন্তু তার চেপে রাখা আদিম আবেগ শেষ পর্যন্ত চাপা থাকেনিনা হাসুনির মার কাছে, না রহিমার কাছে। যদিও প্রতিবাদ করেনি দুজনের কেউই, বরং দুজনই বুঝে তা না বোঝার ভান করেছে।
দিন ভালোই যাচ্ছিল মজিদের। হঠাৎ পাশের গ্রাম আওয়ালপুরে তাশরিফ নিলেন এক বয়স্ক পীর সাহেব। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মতলুব খাঁ তার পুরানো মুরিদ। সেখানেই তিনি উঠেছেন। উর্দু ভাষাটা তার আয়ত্তে। তাঁর বোলচালে আওয়ালপুরের বাসিন্দা মুগ্ধ, দিওয়ানা। মজিদ দেখলো যে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষ‚ণœ হতে চলেছে, তাই সে তার প্রতিদ্ব›দ্বীকে হঠাতে নিজেই আওয়ালপুরে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে দেখে ওই পীর সাহেব এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছেন। বিচিত্র সুরে তিনি ফারসি ভাষায় ওয়াজ করছেন। উপস্থিত উত্তাল জনতা তার অর্থ না বুঝেই হাউ মাউ করে কাঁদছে। পীর সাহেব সেদিন দফায় দফায় ওয়াজ করছেন, ওদিকে জোহরের নামাজের সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। হুজুরের মুরিদরা একবাক্যে মেনে নিয়েছে তাদের পীর-এ কামেল সূর্যকে ধরে রাখবার ক্ষমতা রাখেন। তিনি যতক্ষণ না সূর্যকে হুকুম দেবেন, সূর্য এক আঙ্গুলও নড়তে পারে না। অবেশেষে আসরের নামাজের সময় যখন জোহরের নামাজ পড়ার জন্য সবাই কাতারবদ্ধ হয়, মজিদ চিৎকার করে প্রতিবাদ করে, “যতসব শয়তানী, বেদাতী কাজ কারবার। খোদার সঙ্গে মস্করা।” উলেখ্য, একই কাজ এতদিন সে নিজে করে এসেছে, কিন্তু আজ যখন মাঠে তার প্রবল প্রতিদ্ব›দ্বী উপস্থিত, তার মুখে শোনা যায় উল্টো কথা।
এরপর পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে মজিদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। অবশেষে মজিদ এলাকার লোকজনকে সাথে করে মহব্বতনগর গ্রামে ফিরে আসে-যদিও গ্রামবাসী দোটানায় ছিল। একদিন তাদের মনে ছিল মোদাচ্ছের পীরের প্রতি ভয় তথা মজিদের প্রতি আনুগত্য। অন্যদিকে আওয়ালপুরে আগত উর্দু-ফারসিভাষী বয়স্ক পীর সাহেবের প্রতি কৌতূহল ও মোহ। তবু তারা গ্রামে ফেরে বরং বলা চলে ফিরতে হয়। গ্রামে ফেরার পর ওই রাতেই গ্রামবাসীকে একত্র করে খালেক ব্যাপারীকে নিয়ে মজিদ এক জরুরি বৈঠক বসালো। যেখানে সে পাশের গ্রামে আগত পীর সাহেবকে ‘মনোমুগ্ধকর শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করে তার কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। সভায় সাব্যস্ত হলো: অন্তত এ গ্রামের কোনো মানুষ আওয়ালপুরের পীর সাহেবের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না। এই কড়া নিষেধাজ্ঞার পরেও মহব্বতনগর গ্রামের কয়েকজন যুবক পাশের গ্রামে পীর সাহেবের সভায় গিয়েছিল। আওয়ালপুরবাসী তাদের উত্তম মধ্যম দিয়েছিল। ফলে তাদের করিমগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
খালেক ব্যাপারীর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর নাম আমেনা বিবি, দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম তানু বিবি। আমেনা বিবি তের বছর বয়সে স্বামীর ঘরে এসেছেন আজ তার বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে। কোনো সন্তানাদি তার হয়নি। অথচ সতীন তানু বিবি বছর বছর ছেলেপুলে জন্ম দিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কত আর সহ্য হয়? এদিকে লোকজন বলাবলি করছে: আওয়ালপুরে যে পীর সাহেব এসেছেন, উনি খুব কামেল মানুষ, তার ‘পানি পড়া’ খেলেই পেটে বাচ্চা আসবে। এদিকে আওয়ালপুরে তো যাওয়া বারণ। সেখানকার পীর সাহেবের সাথে মজিদের নাকি কী সমস্যা হয়েছে। কিন্তু আমেনা বিবি এসব শুনতে নারাজ। তার ‘পানি পড়া’ চাই-ই চাই। খালেক ব্যাপারী গোপনে রাজী হয়।
আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছ থেকে ‘পানি পড়া’ নিয়ে আসার দায়িত্ব খালেক ব্যাপারী দিল তার সম্বন্ধী ধলা মিঞাকে। ধলা মিঞা তানু বিবির বড় ভাই। সে খালেক ব্যাপারীর বাড়িতেই থাকে। খায় দায় ঘুমায় কোনো কাজকর্ম করে না। বাইরে থেকে তাকে বোকা কিসিমের মানুষ মনে হলেও সে আসলে ধুরন্ধর ও প্রতারক। সে তার ভগ্নিপতিকে জানায় যে আওয়ালপুরে গিয়ে ‘পানি পড়া’ এনে দেবে কিন্তু সে তা করে না। সে সোজা মজিদের কাছে চলে যায় এবং তাকেই পানি পড়ে দিতে বলে। মজিদ এতে অপমানিত হয় এবং সরাসরি টাকার ইঙ্গিত দেওয়ার পরেও সে ‘পানি পড়া’ দেয় না। ধলা মিঞা যে আওয়ালপুরের পীরের কাছে গেল না এটি মজিদের প্রতি তার আনুগত্য নয় বরং সে ছিল অলস, অকর্মণ্য ও শঠ প্রকৃতির মানুষ। তার উপর দুই গ্রামের মাঝখানে ছিল একটা মস্ত তেঁতুল গাছ সবাই ওটাকে ভুতুড়ে গাছ বলে রাত বিরেতে এড়িয়ে চলতো। ধলা মিঞাকে রাতের বেলা ওই গাছতলা দিয়েই যেতে হতো, ভীতু প্রকৃতির মানুষ ছিল বলে সে তা কৌশলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে।
এ ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে খালেক ব্যাপারীর সঙ্গে মজিদের কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তখন খালেক ব্যাপারী মজিদকেই এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহŸান জানায়। মজিদ তখন একটা কৌশলের আশ্রয় নেয়। সে বলে, আমেনা বিবির পেটে বেড়ী পড়েছে বলেই তো সন্তানাদি হচ্ছে না। পেটে নানা মাপের বেড়ী পড়তে পারে। পেটে একুশ পর্যন্ত বেড়ী মজিদ দেখেছে বলে জানায়। সাত বেড়ী পর্যন্ত খোলা যায়, তার বেশি সম্ভব নয়। তার স্ত্রী রহিমার পেটেও তো চৌদ্দ প্যাঁচ আছে, তাই বাচ্চা-কাচ্চা হচ্ছে না তাদের। এ ক্ষেত্রে মজিদ কেন কারুরই কিছু করণীয় নেই। আমেনা বিবির পেটে যদি সাত বেড়ীর বেশি না পড়ে যাকে, তাহলে মজিদ খুলে ফেলতে পারবে মজিদ বলে। এজন্য আমেনা বিবিকে মজিদের পড়া পানি খেয়ে মোদাচ্ছের পীরের মাজার সাত পাক ঘুরতে হবে। নির্ধারিত দিনে আমেনা বিবি রোজা রাখে। উদ্বেগে-ভয়ে-ক্ষুধায় তার দেহ-মন দুর্বল। সে মাজার সাত পাক ঘুরে আসতে সমর্থ হয় নাতিন পাক ঘুরতেই সে জ্ঞান হারিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে এলিয়ে পড়ে। ধূর্ত মজিদ জানায় আমেনা বিবি অসতী, তাই এমনটি ঘটেছেএমন স্ত্রীকে সে যেন আর ঘরে ঠাঁই না দেয়। মজিদের হাতের পুতুল খালেক ব্যাপারী সেই কথা মতো আমেনা বিবিকে তালাক দেয়।
এদিকে হাওয়ায় কদিন ধরে একটা কথা ভাসছে। মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটা স্কুল বসাবে। আক্কাস বহুদিন বিদেশে ছিল। করিমগঞ্জের স্কুলে নাকি কিছুদিন পড়াশুনাও সে করেছে। তারপর কোথায় পাটের আড়তে না তামাকের আড়তে চাকরি করে কিছু পয়সা কামিয়েছে। কোথায় গিয়ে সে শিখে এসেছে যে স্কুলে না পড়লে মুসলমানদের মুক্তি নেই। সে স্কুলের জন্য চাঁদা তুলতে লাগলো। স্কুলের জন্য সাহায্য চেয়ে সরকারের কাছে একটা দরখাস্তও পাঠিয়ে বসে।
মজিদ আর বরদাস্ত করতে পারে না। গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে নবীন প্রজন্মের চোখ-কান খুলে যাবে। এতে তার ধর্মব্যবসার সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে সে আক্কাসকে ঠেকাতে উঠে পড়ে লাগে। ঠেকিয়েও দেয়। এক সন্ধ্যার পর বৈঠক ডাকা হলো। তলব করা হলো আক্কাসের বাবা মোদাব্বের মিঞাকে। ভর মজলিসে ঠাস করে চড় মারার ভঙ্গিতে মজিদ তাকে প্রশ্ন করে বসে, ‘তোমার দাড়ি কই মিঞা? ..... তুমি না মুসালমানের ছেলেদাড়ি কই তোমার?” খালেক ব্যাপারী বলে: “হে নাকি ইংরাজি পড়ছে। তা পড়লে মাথা কি আর ঠান্ডা থাকে?” সভায় সিন্ধান্ত হয়: গ্রামে পাকা মসজিদ দেওয়া হবে। গ্রামবাসী এতে সাধ্যমতো চাঁদা দেবে। সভায় আক্কাস তার স্কুল প্রতিষ্ঠার কথাটা উত্থাপন করলে তা চাপা পড়ে যায়, এমনকি তার বাবাই বলে ওঠে“চুপ কর ছ্যামড়া, বেত্তমিজের মতো কথা কইসনা।” আক্কাস অগত্যা সভা থেকে আস্তে আস্তে উঠে বের হয়ে যায়।
এদিকে মজিদকে নেশায় পেয়ে বসেছে। সে নেশা জীবনকে উপভোগের নেশা। সে আবার বিয়ে করতে চায়। রহিমাকে নানা উসিলা দেখায়। কখনও বলে: “বিবি আমাগো যদি পোলাপাইন থাকতো।” কখনও খোলাসা করে বলে: “বিবি, আমাগো বাড়িটা বড়ই নিরানন্দ। তোমার একটা সাথী আনুম?” রহিমা কী বলবে? তার মতে কী আসে যায়?
নতুন বউ হয়ে এলো যে বালিকাটি নাম তার জমিলা। জমিলাকে প্রথম দিন থেকেই রহিমা সতীন হিসেবে না দেখে মেয়ে হিসেবে দেখেছে। আদর-যতœ করে তাকে খাওয়ায় পাশে পাশে রাখে। জমিলা খুব হাসিখুশি মেয়ে। রহিমাকে একদিন সে বলেই বসলো: বিয়ের দিন সে মজিদকে ভেবেছিল শ্বশুর আর এখানে এসে রহিমাকে দেখে মনে করেছিল এ মহিলাটি নিশ্চয়ই তার শাশুড়ি। তারপর তার প্রাণখোলা হাসি। রহিমা তাকে হাসতে বারণ করে। মজিদের বাড়িতে হাসা নিষিদ্ধ। মেয়েদের তো বটেই, কোনো মানুষের হাসি সহ্য করতে পারে না মজিদ।
মজিদ খুব কঠোর প্রকৃতির লোক। সে আড়ালে আবডালে হয়তো লক্ষ করে থাকবে যে তার বালিকা-বধূ জমিলা নামাজ পড়ে না। তাই রহিমার মাধ্যমে জমিলাকে সে নামাজ পড়ার তাগিদ দেয়। রহিমা মজিদকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে জমিলা নামাজ জানে এবং পড়বে ধীরে সুস্থে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই জমিলার ঘুম পেয়ে যায়। মজিদ বলা কওয়াতে সে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু প্রায়ই তার এশার নামাজ পড়া হয় না। আজ সে মাগরিবের নামাজ পড়ার পর থেকেই ঘুমে ঢুলছিল, তবু নামাজ পড়ার জন্য সে বসেছিল। এশার নামাজ পড়েই সে সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মজিদ ঘরে এসে হাঁকডাক শুরু করে, টান মেরে বিছানা থেকে তাকে তুলে বসায়, কিন্তু সে বলেও না যে সে এশার নামাজ পড়েই শুয়েছিল।
এরপর মজিদ শুরু করে নির্যাতন। নির্যাতন করে চলে এবং ক্রমশ তার মাত্রা বৃদ্ধি করে। সহ্য করতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে জমিলা একদিন মজিদের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দেয়। এবার মজিদের ভ্যাবাচেকা খাওয়ার পালা।
উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি: জমিলাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য একাকী ঝড়ের রাতে মাজারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সারা রাত ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টি হলো। মেয়েটা একা একা পড়ে থাকে মাজারের খোলা প্রাঙ্গণে। সকালে এসে দেখা গেল, কবরের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা। তার একটা পা কবরের গায়ে লেগে আছে। তখনও জীবিত সে।
এরপর দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায়। যে রহিমা এতদিন তার অনুগত ছিল, সে ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করে। বলা যায় শুরু করেছিল আরও আগে থেকেই, কিন্তু জমিলাকে মাজারে বেঁধে রেখে আসার পর থেকেই এবার সে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন হলো। মজিদ দেখতে পাচ্ছে: হাতে সব ধরনের অস্ত্র থাকার পরেও সে পরাজিত হচ্ছে। সমাজে সে রাজাধিরাজ হতে পারে, কিন্তু নিজের ঘরে সে উদ্বাস্তু, গৃহহীন, অনাথ।
লালসালু উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা
নামকরণের সাথে যেকোনো শিল্পের রসপরিণতির একটা সরাসরি সম্পর্ক থাকে কেননা, তাতে শিল্পীর পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। সুতরাং, উইলিয়াম শেকসপিয়র কথিত ‘নামে কিবা আসে যায়’ কথাটি অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে খাটে না; খাটে না বলেই তিনি তাঁর চরিত্রপ্রধান নাটকের নাম রেখেছেন চরিত্রের নাম অনুসারে, যেমন: ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’ ও ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘ম্যাকবেথ’ ইত্যাদি। অথচ, বিষয় অনুসারে তিনি যে নামকরণ করেননি এমন নয় যেমন: ‘মিড সামার নাইটস ড্রিম’, ‘দা টেম্পেস্ট ইত্যাদি। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে মূল চরিত্রের নাম অনুযায়ী উপন্যাসের নামকরণ করবার প্রচলনটা পুরনো। যেমন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’। দ্বিতীয় ধারা হিসেবে আসে বিষয়বস্তু অনুযায়ী নামকরণ করার আগ্রহ। এই আগ্রহটাও অনেকটাই সেকেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাসুনী বাঁকের উপকথা’র নামকরণ এই পদ্ধতিতে করা হয়েছে।
নামকরণের তৃতীয় সে পদ্ধতি সেটিই এখন পর্যন্ত সর্বাধুনিক। এটি বিষয়বস্তু নয় তবে তার ব্যঞ্জনা থেকে নামকরণ করা হয়ে থাকে। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসের নামকরণ ব্যঞ্জনার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করেছিলেন বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। ঔপন্যাসিক যদি কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামে উপন্যাসটির নামকরণ করতে চাইতেন, তবে এ উপন্যাসের নাম দিতে পারতেন ‘মজিদ’। কিন্তু তিনি পুরনো পথে হাঁটেননি। বিষয়বস্তু অনুযায়ী নামকরণের পক্ষপাতীও যে তিনি ছিলেন না, তার প্রমাণ আমরা পাই। এ উপন্যাসের বিষয় পীরমাহাত্ম্য, মাজার পূজা, ধর্মের নামে প্রচলিত অন্ধ কুসংস্কার। লক্ষণীয়, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ বিষয়নির্ভর নামকরণ করলে তাঁর উপন্যাসের নামের স্টাইল ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘অনল প্রবাহ’, ‘মহাশ্মশান’, ‘জমীদার দর্পণ’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’কে স্মরণ করিয়ে দিত। ওয়ালীউলাহ্ সেই সেকেলে পথেও হাঁটেননি। তিনি বেছে নিলেন ব্যঞ্জনা আধুনিক পদ্ধতি।
তিনি তাঁর উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘লালসালু’। ‘সালু’ শব্দের অর্থ ‘লাল কাপড়’। সুপ্রাচীন কাল থেকে যুক্তিরহিত কারণ ছাড়াই এই সালু কাপড় পীরদের মাজারে টানানো থাকে। এ দেশের প্রচলিত হাজার হাজার কুসংস্কারের ভেতর এটিও একটি কুসংস্কার। এই সালু কাপড়ের নিচে ঢাকা পড়ে আছে হাজার বছরের বাঙালির মুক্তবুদ্ধি। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ সেটি টান মেরে ফেলে দিতে চেয়েছেন। লালসালু কাপড়ে ঢাকা মানুষগুলোর আসল চেহারাগুলোও তিনি তাঁর উপন্যাসে দেখিয়ে দিয়েছেন। এ উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি: জমিলার মেহেদি মাখা একটি পা মাজারের গায়ে লেগে আছে। এটি প্রতীকায়িত। লেখক জমিলাকে দিয়ে ভুয়া মাজার ও ভুয়া ধর্মব্যবসাকে তথা যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রবহমান কুসংস্কারকে লাথি মেরেছেন। এ উপন্যাসের শেষে মজিদের পরাক্রম ক্ষুণœ হয়েছে। লেখক লালসালুর দৌরাত্ম্য যেকোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না উপন্যাসের কাহিনিবিন্যাস তা-ই প্রমাণ করে।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে লালসালু কাপড়ে ঢাকা তথাকথিত মাজারকেন্দ্রিক সমাজ ও মানুষগুলোর আসল চেহারা আমাদের দেখাতে চেয়েছেন; অতঃপর টান মেরে ওই অশুভ লাল-সালু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুভ-সুন্দর-মুক্ত আলোয় কুসংস্কারহীন আলোকিত সমাজ গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি তাঁর উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘লালসালু’। এই নামকরণ শিল্পসফল, সার্থক।
চরিত্র আলোচনা
মজিদ
‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। এ উপন্যাস আপাততভাবে সে কুসংস্কার, শঠতা ও প্রতারণার প্রতীক। সে প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এই কারণে যে প্রথা টিকে না থাকলে তার প্রভুত্ব টিকে থাকবে না। মহব্বতনগর গ্রামে নিজের পরাক্রম টিকিয়ে রাখার জন্য এমন কোনো কর্ম নেই, যা সে না করেছে তাহের-কাদেরের বাবাকে শাস্তি, আওয়ালপুরের প্রতিদ্ব›দ্বী পীরকে হঠানো, গ্রামবাসীকে সব সময় খোদাভীতির কথা বলে নিজের অনুগত করে রাখা, খালেক ব্যাপারীর ওপর কড়া নজরদারি, আমেনা বিবিকে তালাক দানে বাধ্য করা, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বানচাল করে দেওয়া, পরিশেষে জমিলাকে শায়েস্তা করা। তবে অন্য সব ক্ষেত্রে মজিদ আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করলেও জমিলাকে সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনিবরং বলা যায়, পুরোপুরি সে ব্যর্থ হয়েছে।
শীর্ণদেহের এই মানুষটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় ও শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা-সবই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন; বার বার অনুসরণ করেছেন এবং তার ওপরই আলো ফেলে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন। উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আর তাই মজিদের প্রবল উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে মহব্বতনগর গ্রামের সামাজিক পারিবারিক সকল কর্মকাণ্ডে।
আপাতদৃষ্টিতে মজিদ একটি চরিত্র; শুধু চরিত্র নয়, উপন্যাসটির একদম কেন্দ্রীয় চরিত্র অথচ সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্কে যারা জানেন, তাঁর দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যাঁদের কমবেশি পরিচয় আছে, তাঁরা সবাই জানেন, মজিদ মূলত একটি প্রতীক।
কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের মূর্তিমান প্রতীকও সে। প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবদ্ধ জীবনধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়, ওই জীবনধারার সে প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে। এজন্য সে যেকোনো কাজ করতেই প্রস্তুত, তা যতই নীতিহীন বা অমানবিক হোক।
‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ প্রাণধর্ম ও প্রথাধর্মের চিরন্তন দ্ব›দ্বকে দেখিয়েছেন। মজিদ ধর্মের নামে প্রচলিত প্রথাধর্ম তথা কুসংস্কারের প্রতীভূ। সে প্রাণধর্মের প্রবল বিরোধিতায় তৎপর থেকেছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। কারণ, সে জানে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ জেগে উঠলে তার ধর্মব্যবসা লাটে উঠবে। ফলে ফসল ওঠার সময় গ্রামবাসীরা যখন আনন্দে গান গেয়ে ওঠে, তখন সে থামিয়ে দেয়; হিন্দুপাড়ায় ঢোল বাজলে নিষ্ফল ক্রোধে ছটফট করে কেননা, ওই সমাজে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তার মোদাচ্ছের পীরের দোহাই তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। রহিমা উঁচু গলায় কথা বললে কিংবা শব্দ করে হাঁটলে সে খোদার ভয় দেখায়; জমিলা প্রাণোচ্ছ¡ল হাসি হাসলে সে নিষ্ঠুরভাবে ওই হাসি বন্ধ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যায়।
মজিদ প্রতিষ্ঠাকামী। যেকোনোভাবেই হোক, সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চালচুলোহীন মজিদ অল্পদিনের মধ্যেই মহব্বতনগরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিল, সেটি তার এই যোগ্যতা বলে। তবে তার এই প্রতিষ্ঠাপর্বে শোষণের আশ্রয় নিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার ছিল কথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার।
অপরাধবোধ মানুষের নিঃসঙ্গবোধ জাগিয়ে তোলে। মজিদকেও আমরা চূড়ান্ত রকম নিঃসঙ্গবোধে আক্রান্ত থাকতে দেখি। তার মন সবসময়ই বিচলিত ছিল। একবারই রহিমার কাছে তার প্রকাশ ঘটেছে। রহিমার কাছে সমর্পিত মজিদ যখন বলে, “কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও?” তখন তার অন্তর্শায়িত হতাশা, নিঃসঙ্গতাকে আমরা প্রত্যক্ষ করি।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ পাশ্চাত্য অস্তিত্ববাদী দর্শন দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মজিদ চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি এই অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তত্ত¡টিকে মূর্ত করে তুলেছেন। অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত মানুষের ক্রমশ অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠা এবং তারপর অশুভ শক্তিতে পরিণত হয়ে নিজেই অন্যের অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি করার এক অপূর্ব বৃত্ত মজিদ চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এই অর্থে, মজিদ একই সঙ্গে মানুষ এবং একই সঙ্গে তত্ত¡। সে অশুভ কিন্তু লেখকেরই অন্তরশায়িত অপপুত্র।
জমিলা
জমিলা সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। সীমিত আয়তনের এ উপন্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে কিশোরী এ মেয়েটির আগমন; যে-কিনা নিতান্তই হতদরিদ্র একটি পরিবারের কন্যা। কিন্তু তার প্রভাবে প্রবল মজিদ বিচলিত, উন্মূলিত হয়ে পড়ে। জমিলা যে দারিদ্র লাঞ্ছিত, সাধারণ একটি গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে, সেটি খুব সহজেই আমরা কল্পনা করতে পারি এই সূত্রে যে, তার বাবা পৌঢ় এবং বিবাহিত মজিদের সাথে কন্যার বিবাহ দিতে কোনো রকম দ্বিধা করেনি বরং আমাদের সংগত অনুমান: কন্যাদায়গ্রস্ত হতভাগ্য পিতার কাছে এটি সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেই গণ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি লক্ষযোগ্য, সেটি হলো: জমিলাও এটি অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে করেনি শুধু একটু কৌতুক অনুভব করেছিল। স্বামীগৃহে আসার পর সতীন রহিমাকে একদিন পরিহাস করে সে বলেছিল, প্রথম দেখায় মজিদকে সে শ্বশুর মনে করেছিল, আর রহিমাকে দেখে ভেবেছিল শাশুড়ি। এই পরিহাসের তরল স্রোতের মধ্যে হয়তো অন্তর্লীন হয়ে আছে একটুখানি হতাশা, দুঃখ, গ্লানিও; তবে তার মধ্যে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার প্রবল একটা ব্যাপার ছিল আবহমান কালের সব বাঙালি নারীর ভেতরই যেমন থাকে সব দুর্ভাগ্যের সাথেই নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার একটা দীর্ঘশ্বাসজড়িত বিচ্যুতি।
তাহলে সমস্যা কোথায়? জমিলা তো সব মেনেই নিয়েছিল। পৌঢ় স্বামীর কাছে এসে সে সবকিছু সমর্পণ করেছিল একে একে। সবকিছু দিয়ে দেওয়ার পরেও প্রতিটি মানুষের কিছু কিছু জিনিস থেকেই যায়, যেটা কাউকে দেওয়া যায় না আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। জমিলা তার এই হাতের পাঁচগুলো যক্ষের ধনের মতো বুকের মধ্যে আগলে ধরে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু দুর্বার মজিদ সেগুলোও কেড়ে নিতে যখন তৎপর হয়ে উঠলো, তখন জমিলাকে আমরা দেখি নতুন এক রূপেমজিদেরই প্রতিপক্ষ হিসেবে। মহব্বতনগর অঞ্চলে কেউ যা কল্পনাও করতে পারে না, ঘরের ভেতরে থেকে জমিলা করে বসলো তাই। তার আক্রমণটা আসলো ভেতর থেকে। মজিদকে সে ধরাশায়ী করে ফেলে।
প্রশ্ন ওঠতেই পারে, জমিলার হাতিয়ারটি কী? জমিলার হাতিয়ার হচ্ছে (হাতিয়ার না বলে মারণাস্ত্র বলাই ভালো) সহজ প্রাণধর্ম। সে ধর্মের নমে প্রচলিত শাস্ত্রশাসনের অনুগামী নয় বরং মুক্তধর্মে বিশ্বাসী। সে প্রাণোচ্ছ¡ল। মন খুলে সে হাসে, নানা রকম কৌতুককর কথা বলে। ভুয়া মাজারের ভয় তাকে দেখালে সে ভয় পায় না। মজিদ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেএটা সে মেনে নিতে পারে না, তার সাথে করা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনগুলো সে অকপটে হজম করতে পারে না। ঘুমকাতুরে জমিলা নামাজ পড়েই শুয়েছিলকিন্তু সে এশার নামাজ পড়েছে কিনাএই নিয়ে মজিদ হলা করলে সে হ্যাঁ, না কিছুই বলে না। স্পষ্টতই, মজিদকে সে ঘৃণা করে তাই মজিদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিতেও সে দ্বিধা করে না।
বিশ শতক পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের আদর্শবাদী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। জমিলা সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র মানসকন্যা, যথার্থ আদর্শবাদী চরিত্র, যাকে দিয়ে ঘুনেধরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মুখে থুতু দিয়েছিল। লালসালু কাপড়ে ঢাকা ধর্মব্যবসায়ীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন এবং উপন্যাসের শেষে তাঁর এই মানসকন্যাকে দিয়েই তথাকথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার (শেয়ালের গর্ত)-কে পক্ষাঘাত করেছেন। বলা যায়, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র একটি সাহিত্যিক পরিকল্পনা ছিল, ‘লালসালু’ উপন্যাস রচনা করে জমিলা চরিত্রটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে তার বাস্তবায়ন ঘটেছে।
রহিমা
চরিত্রচিত্রণে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছেন তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে; যদিও এ কথা আমাদের বিস্মৃত হওয়া সংগত হবে না যে এ উপন্যাসটি চরিত্রপ্রধান উপন্যাস নয়, তাই চরিত্রসৃজন তাঁর লক্ষ নয়- উপলক্ষ মাত্র। কাহিনির দাবিতে এবং বাস্তবতার প্রয়োজনে তিনি অল্প কিছু চরিত্র নির্মাণ করেছেন, রহিমা সেগুলোর মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।
রহিমার বিশিষ্ট হয়ে ওঠার কারণ দ্বিবিধ। প্রথম কারণটি খুব সরল ও স্পষ্ট। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ রহিমার মধ্যে দিয়ে শাশ্বত বাঙালি নারীর একটি চেনা মুখকে আঁকবার চেষ্টা করেছেন খুব সচেতনভাবে। স্মরণাতীতকাল থেকেই বাঙালি নারী স্বামীর অনুগত। তারা স্বামীকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে, স্বামীর সব নির্দেশ বিনা দ্বিধায় মেনে চলে রহিমাও সেই ঘরানার মেয়ে। তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক বলেছেন,
“নাম তার রহিমা। সত্যি সে লম্বা-চওড়া মানুষ। হাড় চওড়া মাংসল দেহ। শীঘ্র দেখা গেল, তার শক্তিও কম নয়। বড় বড় হাঁড়ি সে অনায়াসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তুলে নিয়ে যায়, গোঁয়ার ধামড়া গাইকেও স্বচ্ছন্দে গোয়াল থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। হাঁটে যখন মাটিতে আওয়াজ হয়, কথা কয় যখন, মাঠ থেকে শোনা যায় গলা।”
এ চির চেনা বাঙালি নারী দৈহিক শক্তিমত্তায় সে যতই প্রবল হোক না কেন, স্বামীর প্রতি ভক্তি তার প্রবল, স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সে মেনে চলে। সে নম্র ও বিনীত। এ রকম এক নারীরই প্রয়োজন ছিল মজিদের, যে তার সংসার আগলে রাখবে। কঠিন হাতে সামাল দেবে সংসার, কিন্তু স্বামীর সামনে থাকবে সদা নতমস্তকে, বিনীতা, আনুগতা। মজিদের জন্য রহিমাই আদর্শ স্ত্রী।
রহিমার বিশিষ্ট হয়ে ওঠার দ্বিতীয় কারণটি খুব সচেতনপাঠে অনুধাবন করা যায়। দ্বিতীয় কারণটি ঔপন্যাসিকের নিতান্তই পরিকল্পনার অংশ। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর সমকালীন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন এবং এটি তিনি করতে চেয়েছিলেন সমাজের ভেতর থেকেই। তাই তিনি রহিমার মতো খুব চেনা একজন গৃহবধূকে অচেনা করে নির্মাণ করেছেন উপন্যাসের শেষ দিকে। মজিদ জমিলাকে যখন মাজারে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আসে, তখন থেকে রহিমার এই নতুন রূপ আমরা দেখতে পাই। অনুগতা স্ত্রী রহিমার হঠাৎ করেই স্বামীর প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ শুরু করে। সে স্পষ্টতই জমিলার পক্ষ অবলম্বন করে। এতদিন স্বামীকে সে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছিল কিন্তু এই পর্যায়ে আমরা দেখি সে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, রহিমার চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ধর্মের নামে কুসংস্কার এবং শাস্ত্রধর্মের বিরুদ্ধে প্রাণধর্মের স্বতঃস্ফূর্ত জয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং নিঃসন্দেহে তাঁর সেই প্রয়াস সফল হয়েছে।
খালেক ব্যাপারী
‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি নানা কারণে আলোচিত, ফলে সাহিত্য সমালোচনায় তা পেয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা চলে যে, এই চরিত্রটি নিয়ে যত কথা উঠেছে, কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদকে নিয়েও তত কথা ওঠেনি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং উৎপাদন ব্যবস্থা সামন্তবাদী হওয়ার সুবাদে যার জমি যত বেশি, সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিও তত বেশি হয়এটাই নিয়ম। খালেক ব্যাপারী মহব্বতনগর গ্রামের সমাজপতি। গ্রামীণ সমাজে এ শ্রেণির মানুষকে মোড়ল বা মাতব্বর বলা হয়ে থাকে, যারা গ্রামীণ মানুষের সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। সামন্তবাদী সমাজে ভূমি মালিকদের সাথে ধর্মীয় পুরোহিতদের নিবিড় সখ্য থাকে, যা সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর উপন্যাসে দেখিয়েছেন। একপক্ষে আছে খালেক ব্যাপারী, অন্যপক্ষের প্রতিনিধি মজিদ।
চিরায়ত বাস্তবতা এই যে, ভূমি মালিক ও ধর্মীয় পুরোহিতদের স্বার্থ সচরাচর অভিন্ন। তাই তাদের পথ এক, তারা একট্টা হোক তা সজ্ঞানে নতুবা অজান্তে-অনিচ্ছায়। তারা একে অপরের দোসর, পথ চলার সহচর, সঙ্গী। তবে সব সময়ই লক্ষণীয় হলো: সমাজপতিই শেষ পর্যন্ত ধর্মপতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে, উচ্চকণ্ঠ হয়ে থাকে; ফলে সমাজ নেতাই হয়ে যায় একচ্ছত্রধারী। চিরায়ত এই বাস্তবতার লক্ষণ ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই। খালেক ব্যাপারী গ্রামের মোড়ল কিন্তু ধর্মীয় পুরোহিত মজিদের কথায় সে পরিচালিত। মজিদের সব কথাকে খালেক ব্যাপারী সমর্থন করেছেন, মজিদের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন নির্দ্বিধায়।
আমরা আগেই বলেছি: খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি নির্মিতিতে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ বাস্তবতা লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু তিনি কেন সেটি করেছেন? এ ব্যাপারে সমালোচকেরা একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছেন, এটি তিনি করেছেন স্রেফ শিল্পের তাগিদে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদের দাপট দেখাতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার কারণে তিনি যদি খালেক ব্যাপারীকে যথার্থভাবে নির্মাণ করেন, তাহলে মজিদ গৌণ হয়ে পড়তো। মজিদকে সর্বেসর্বা হিসেবে নির্মাণ করার শিল্প পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই খালেক ব্যাপারীকে গৌণ করে অঙ্কন করার প্রয়াস। কেউ কেউ বলেছেন, এটি লেখকের অসর্তকতাপ্রসূত একটি ব্যাপার, তাই ক্ষমার্হ। তাঁরা এই যুক্তি দেন যে, ‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারী দ্বারা আর কোনো চরিত্র দুর্বল সৃষ্টি নয়। তৃতীয় পক্ষের দাবি এই যে: সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ নগর জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা সবই শহরে। তিনি তাঁর কর্মজীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বিদেশে, কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামীণ বাংলার জনজীবনের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টতা ছিল না। যার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে।
সাহিত্য সমালোচনায় বিভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, তৃতীয় মতটিই আমাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।
আক্কাস
‘লালসালু’ উপন্যাসে আক্কাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভাবনাময় একটি চরিত্র। তবে তার সম্ভাবনার সবটুকু ঔপন্যাসিক কার্যকর করতে পেরেছেন এমন মনে হয় না। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে আমরা আক্কাসের অনুপ্রবেশ লক্ষ করি। তার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য লেখক আমাদের দিয়েছেন,
“মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটা স্কুল বসাবে। আক্কাস বিদেশে ছিল বহুদিন। তার আগে করিমগঞ্জে স্কুলে নিজে নাকি পড়াশোনা করেছে কিছু। তরপর কোথায় পাটের আড়তে না তামাকের আড়তে চাকুরি করে কিছু পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরেছে কেমন একটা লাটবেলাটে ভাব নিয়ে ।.......বলে, স্কুল দেবে। কোত্থেকে শিখে এসেছে স্কুলে না পড়লে নাকি মুসলমানের পরিত্রাণ নেই। ...... আক্কাস যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। সে ঘুরতে লাগলো চরকীর মতো। স্কুলের জন্য দস্তুরমতো চাঁদা তোলার চেষ্টা চলতে লাগলো এবং করিমগঞ্জে গিয়ে কাউকে দিয়ে একটা জোরালো গোছের আবেদনপত্র লিখিয়ে এনে সেটা সিধা সে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিল। কথা এই যে, স্কুলের জন্য সরকারের কাছে সাহায্য চাই।”
আক্কাস সম্পর্কে আরও অনেক কথা ঔপন্যাসিক আমাদের বলেছেন, আরও অনেক দীর্ঘ বর্ণনা উপন্যাসে আছে অথচ এই চরিত্রটিকে তিনি শেষ পর্যন্ত পূর্ণভাবে বিকশিত করতে পেরেছেন, এটা আমাদের মনে হয় না। তার কারণ এই যে, যে প্রবল প্রত্যয়ী ‘আক্কাস স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এত কিছু করতে পারে, সেই আক্কাস ধর্মব্যবসায়ী মজিদের প্যাঁচে ঘায়েল হয়ে পিঠটান দেবেএটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, বিশেষত যে আক্কাস ওই আমলে স্কুলে পড়েছে এবং বহুকাল বিদেশে কাটিয়েছে। মহব্বতনগরের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারাটা সহজ ব্যাপার, কিন্তু স্কুল-পড়–য়া, বিদেশ ফেরত আক্কাসকে নয়। “তোমার দাঁড়ি কই মিঞা” মজিদের এই কথার পালটা কথা কেবল নয়, মজিদ যে মিথ্যার বেসাতি ফেঁদে বসেছে তাদের এলাকায়-এই বলান: “-তয় স্কুলের কথাডা?” ছেলের উত্তর লেখক দেয়ালেন বাবার মুখ থেকেই। “ চুপ কর ছ্যামড়া, বেত্তমিজের মতো কথা কইসনা।” তারপর আমরা দেখি, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ বর্ণনা দিচ্ছেন,
“আক্কাস আস্তে আস্তে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কেউ কেউ দেখে না। কিন্তু তার চলে যাওয়াটা কারো মনে প্রশ্ন জাগায় না।”
সুতরাং, আক্কাস চরিত্রের মধ্যে যে অমিত সম্ভবনা ছিল, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তার অতি ক্ষুদ্রাংশকেই কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছেন।
হাসুনির মা
তার কোনো নাম নেই। সে পরিচিত হয়েছে তার পুত্রের মাতা হিসেবে। তার বাবা-মায়েরও এই একই দশাতাহের-কাদেরের বাপ, মা। সমাজে নিশ্চয়ই এই সব মানুষের নাম থাকে কিন্তু সমাজ তা একীভূত করে দেয় তাদের সন্তানের নামের মধ্যে। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো এই যে, সমাজের ওপর তলায় এটি ঘটে না, ঘটে কেবল গ্রামীণ নিম্নবিত্তদের মধ্যে। খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় স্ত্রী তানু বিবি বছর বছর সন্তান জন্ম দিয়েও তার নাম কিন্তু সন্তানের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না, নাম বিলীন হয়ে যায় হাসুনির মায়ের।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা হাসুনির মাকে দেখি সহজ, সরল, অনাথ এক পরমদুখিনী নারী। বাবার সংসারে নিত্য অভাব। বাবা-মা সারাক্ষণ অকথ্য ভাষায় ঝগড়া এবং মারপিট করে। বিয়েও হয়েছিল তার। স্বামী মারা গেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব খারপ বলে সেখানেও সে যেতে চায় না। অথচ পেটে তার ক্ষুধা। ক্ষুধা তো তার একার নয়, সাথে আছে তার শিশুপুত্র হাসুনি। সে যাবে কোথায়? বাবার বাড়িতে ভাত নেই, শ্বশুর বাড়িতে ঠাঁই নেই, কোথায় সে যাবে?
হাসুনির মার কাজ মিললো মজিদের বাড়িতেই। রহিমাকে সে খুব আপনজন বলেই মনে করে। তাই মুখ ফুটে তার কষ্টের কথাগুলো বলে। রহিমার কাছে। সে বলে, “আমার আর্জি এনারে কইবেন আমার যেন মওত হয়।..... জ্বালা আর সহ্য হয় না বুবু। আলাহ যেন আমারে সত্বর দুনিয়া থিকা লইয়া যায়।” হাসুনির মার প্রতি মজিদের আদিম আবেগ, কামনা-বাসনা এবং তার প্রকাশ হিসেবে শাড়ি উপহার, যা কিনা রহিমা বুঝতে পারে, হাসুনির মাও বুঝতে পারে কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না করতে পারে না। স্মরণাতীত কাল থেকেই বাঙালি নারীকে সংসার করতে হলে সহ্য করতে হয়; আমরা দেখি, রহিমা সহ্য করেছে, হাসুনির মা-ও সব বুঝে না বোঝার ভান করে মজিদের বাড়িতেই দাসিবৃত্তি করে যাচ্ছে না করলে খাবে কী?
তবে কি হাসুনির মা পরিপূর্ণভাবেই একটি দুঃখবাদী চরিত্র? যতই সে নিজের মৃত্যু কামনা করুক, দূরের ধান ক্ষেতের তাজা রং হাসুনির মায়ের মনে পুলুক জাগায়। পাশের বাড়ির তেল চকচকে জোয়ান কালো ছেলেটাকে নিকা করার জন্য তার মন আনচান করে। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ যে চরিত্র সৃষ্টি করেছেন মানুষের বহির্জগৎ ও তার অন্তর্জগতের সমন্বয়ে হাসুনির মা তার বড় একটি দৃষ্টান্ত।
অনুশীলনী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন \১\ নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
ওয়াসিকা গ্রামের এক দুরন্ত মেয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে ছুটোছুটি করা, অবাধে সাঁতার কাটা তার আনন্দের কাজ। তার বাবা অভাবের তাড়নায় ওয়াসিকাকে পাশের গ্রামের এক বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। লোকটি গ্রামের মাতব্বর। তাকে সবাই একাব্বর মুন্সি বলে ডাকে। মুন্সির কথা গ্রামের সবাই মানলেও চঞ্চল ও স্বাধীনচেতা ওয়াসিকা তার কথা মানে না।
ক. ধলা মিয়া কেমন ধরনের মানুষ ছিল?
খ. ‘সজোরে নড়তে থাকা পাখাটার পানে তাকিয়ে সে মূর্তিবৎ বসে থাকে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. ওয়াসিকা ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকের একাব্বর মুন্সি ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের সামগ্রিক দিক ধারণ করেনি মূল্যায়ন কর। ১
২
৩
৪
১ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
ধলা মিয়া নির্বোধ এবং অলস প্রকৃতির মানুষ ছিল।
ছ অনুধাবন
প্রশ্নোক্ত বাক্যটি দ্বারা অপমানিত, ঈর্ষাকাতর মজিদের নির্লিপ্ত ভাবের কথা বোঝানো হয়েছে।
আওয়ালপুর গ্রামে নতুন এক পীরের আবির্ভাব ঘটে। সে গ্রাম তখন লোকে লোকারণ্য। পীরের কীর্তিকলাপ দেখতে মজিদও সেখানে যায় কিন্তু বেঁটে হওয়ার কারণে সে পীরের মুখ দেখতে পায় না, শুধু পাখা নাড়ানো দেখে। সবাই পীরকে নিয়ে ব্যস্ত, মজিদকে কেউ সমীহ করে না; এমনকি তাকে যারা চেনে তারাও না। এতে মজিদ অপমান বোধ করে। ওপরন্তু যখন মতলুব মিয়া পীরের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে এবং তা শুনে লোকজন ডুকরে কেঁদে ওঠে তখন মজিদ সজোরে নড়তে থাকা পাখাটার পানে তাকিয়ে মুর্তিবৎ হয়ে বসে থাকে।
জ প্রয়োগ
ওয়াসিকা লালসালু উপন্যাসের জমিলার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
আমাদের সমাজ নানারকম কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছে। মানুষকে অবমূল্যায়ন, প্রগতিশীল চেতনার অভাব, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ইত্যাদি সমাজের এই অসংগতির জন্য দায়ী, যা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
উদ্দীপকে দেখা যায় ওয়াসিকা নামের দুরন্ত এক কিশোরীর স্বপ্নালু জীবনকে দারিদ্র্য এবং নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। সে বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করত, আনন্দফুর্তি করত, অথচ তাকে বিয়ে দেওয়া হয় এক বৃদ্ধের সাথে, যা ওয়াসিকা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। গ্রামের লোকজন তার স্বামীকে মানলেও ওয়াসিকা তার কথা মানে না। এমনই একটি চরিত্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা। সেও দুরন্ত কিশোরী। কিন্তু নারীলোলুপ ভণ্ডপীর মজিদের লালসার শিকার হয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। গ্রামের সবাই মজিদকে ভয়-ভক্তি করলেও জমিলা ভয় পায় না। প্রায়ই তার কথার অবাধ্য হয়। উভয় চরিত্রের সাদৃশ্য এখানেই।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
উদ্দীপকের একাব্বর মুন্সি ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের সামগ্রিক দিক ধারণ করেনি। মন্তব্যটি যথার্থ।
সমাজে এমন কিছু মানুষ বাস করে যারা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেকোনো হীন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। প্রয়োজনে তারা ধর্মকেও নিজেরে স্বার্থে ব্যবহার করে। এ ধরনের মানুষের উপস্থিতি এবং কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের সমাজ তথা জীবনযাত্রা এতটা পিছিয়ে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে ‘মজিদ’ চরিত্রটির মাধ্যমে সমাজের মুখোশধারী এবং ধর্মের নামে ব্যবসা করা মানুষের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মজিদ একজন ভণ্ড, মিথ্যাবাদী, নারীলোলুপ, হীনচেতা মানুষের প্রতিমূর্তি। সে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পারে না এমন কোনো কাজ নেই। নিজের প্রয়োজনে সে ধর্ম এবং মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগায়। সে এককথায় বহুমুখী নেতিবাচক চরিত্রের অধিকারী। অপরদিকে উদ্দীপটিতে একাব্বর মুন্সি শুধু মজিদ চরিত্রের নারীর প্রতি দুর্বলতা ও ক্ষমতাশালী ভাবটি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
উদ্দীপকের একাব্বর মুন্সি গ্রামের মাতব্বর। সবাই তাকে মান্য করে। তার কথা অনুযায়ী গ্রামের অনেক কিছু নির্ধারিত হয়। কিন্তু সে বিয়ে করে তার মেয়ের বয়সী ওয়াসিকাকে, যা ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদের জমিলাকে বিয়ে করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। এই একটি বৈশিষ্ট্য ছাড়া একাব্বর মুন্সি চরিত্র উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেনি। তাই বলা যায়, প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন\ ২ \ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
মফিজ আলীর কোনো স্থির পেশা ছিল না। তার বাবা আরজ আলী ভূমিহীন কৃষক ছিল। ছেলেকে তিনি কলেজে পড়ানোর জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। ঢাকায় গিয়ে মফিজ পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। কথায় কথায় বলে আলাহ বলে কেউ নেই। এক সময় তার বাবা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। দেখতে দেখতে তার চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যায়। তারপর সে ফিরে আসে তার গ্রামে। মফিজ আলীর বর্তমান নাম হযরত শাহ সুফী মফীজ আলী ফরিদপুরী (র)। কামেল পীর হিসেবে তার খ্যাতি এখনও দেশ জোড়া।
ক. সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ কত সালে জন্মগ্রহণ করেন?
খ. ‘তাই তারা ছোটে, ছোটে।’ কেন ছোটে?
গ. উদ্দীপকের মফিজ আলীর সাথে মজিদের তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ চরিত্রের মধ্য দিয়ে কী ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তা ব্যাখ্যা কর। ১
২
৩
৪
২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।
ছ অনুধাবন
অভাবের তাড়না থেকে মানুষ ছোটে।
শস্যহীন জনবহুল এলাকা। ঘরে খাবার নেই। ভাগাভাগি, লুটতরাজ আর স্থান বিশেষে খুনখারাবিও চলে। কিন্তু তাতেও কুলায় না। অভাব যেন তাদেরকে ছায়ার মতো সব সময় ঘিরে থাকে, রাহুর মতো তাদেরকে গ্রাস করতে চায়। কিন্তু মানুষ যে ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ অমৃতের সন্তান, সে যে কোনো কিছুর কাছেই হার মানতে নারাজ। যখন কোনো আশাই অবশিষ্ট নেই তখনও সে আশা করে। সেই আশায় ভর করে শস্যহীন জনপদের মানুষ ছোটে, নিরন্তর ছুটে চলে। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ এমনই এক ভাগ্যান্বেষণী আশাবাদী মানুষ।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের মফিজ আলী এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রে মিল ও অমিল দুটি দিকই লক্ষ করা যায়। মিলের মধ্যে দুজনই ধর্মকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। দুজনই জানে গ্রামের মানুষ হয় ধর্মান্ধ, নতুনা ধর্মভীরু অথবা ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মকে মুক্তদৃষ্টিতে দেখবার মানুষ সেখানে কম। মানুষের মাঝে পাপ ও পরকালের ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে মজিদ ও মফিজ দুজনেই নিজেদের আখের ভালোই গুছিয়ে নিয়েছিল।
উদ্দীপকের মফিজ আলীর সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের অমিলও কম নয়। খুব খেয়াল করলে স্পষ্ট হবে যে মফিজ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ভণ্ড, শঠ, প্রবঞ্চক, প্রতারক। গারো পাহাড়ে মজিদ অনেক কষ্ট করে জীবন অতিবাহিত করেছে। যখন সে আর পারছিল না, তখনই সে ভিন্ন পথ বেছে নেয়Ñআমরা বলতে পারি, ভিন্ন পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। গারো পাহাড়ে যে জীবন ও জীবিকার সাথে মজিদ সংশ্লিষ্ট ছিল, তা যদি সুখদায়ক না হলেও অন্তত সহনীয়ও হতো, তাহলে মজিদ সম্ভবত ভণ্ডামির আশ্রয় নিতো না। জীবন তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল বলেই সে ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়।
উদ্দীপকের মফিজ আপাদমস্তক ভণ্ড, ইতর, শঠ, প্রবঞ্চক। ঢাকায় গিয়ে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে আঁতেল বনে যাওয়া কৃষকপুত্র মফিজ একদা আলাহ খোদার অস্তিতেই বিশ্বাস করতো না, সেই মফিজই চাকরির বয়স ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে আর কোনো উপায় না দেখে গ্রামে চলে আসে এবং পীর সেজে বসে। নাম বদলে রাখে হযরত শাহ সুফী মফীজ আলী ফরিদপুরী (রঃ)। ভণ্ডামি আর কাকে বলে! ‘লালসালু’র মজিদের প্রতি পাঠকের করুণা জাগলেও জাগতে পারে, কিন্তু উদ্দীপকের মফিজ আলীর প্রতি যে ঘৃণা জাগেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কটকে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
অস্তিত্ববাদী কথাশিল্পী হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসন অনেক ওপরে। তিনি লক্ষ করেছিলেন, মানুষ অর্থশাসিত সমাজের সৃষ্টি হলেও সে মূলত আবদ্ধ থাকে তার নিজেরই দেয়ালে। অস্তিত্বের জন্যে মানুষ কখনও দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়ে আবার নিজেই জড়িয়ে পড়ে স্বয়ংসৃষ্ট নতুন কোনো দেয়ালে। অস্তিত্ববাদী কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ মজিদ চরিত্রটির ভেতর দিয়ে মানবচরিত্রের চিরন্তন এই বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
মজিদ অভাবগ্রস্ত জনপদের বাসিন্দা। জীবন-জীবিকার তাগিদেই সে একদা ছুটে বের হয়েছিল গারো পাহাড়ের কোনো অঞ্চলে। জীবন সেখানে কঠিন থাকার কারণে সে নাটকীয়ভাবে মহব্বতনগর গ্রামে প্রবেশ করেÑ বলা যায় পালিয়ে চলে আসে। মহব্বতনগরের ধর্মভীরু মানুষদের বশীভূত করে, মোদাচ্ছের পীরের মাজারের আড়ালে সেই বনে যায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; এমনকি গ্রামের মোড়ল খালেক ব্যাপারীও তার করায়ত্ত। মজিদের ঘর-বাড়ি হলো, জমি-জমা হলো, পছন্দমতো বিয়েও করে সে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম আওয়ালপুরে আরেক পীর সাহেবের আমদানি ঘটলে সে হটিয়ে দেয়; আধুনিক যুবক আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও সে পণ্ড করে দেয় সুকৌশলে।
বলাবাহুল্য, নিজের অস্তিত্বের সঙ্কটকে অনেক আগেই কাটিয়ে উঠেছিল মজিদ, ভেঙেছিল নিজের দেয়াল কিন্তু সে এবার অন্যের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি হয়ে উঠে জমিলাকে বিয়ে করে। এটি মজিদের দ্বিতীয় পর্ব, বলা যায়, নিজেই জড়িয়ে পড়ে স্বয়ংসৃষ্ট দেয়ালে। প্রথম পর্বে যে মজিদ কুশলী সেনাপতি, দ্বিতীয় পর্বে সে মজিদকেই পাওয়া যায় পরাজিত সৈনিকের বেশে। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে মানুষের এই রূপ ও রূপান্তর মজিদের মধ্যে বহুকৌণিকভাবে রূপায়িত হয়েছে।
প্রশ্ন\ ৩ \ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
কাশেম মুন্সি মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে যখন চাকরি নিয়েছিল পনেরো বছর আগে, তখনও সে বিয়ে করেনি। ইতোমধ্যে সে বিয়ে করেছে, তিন কন্যা এবং দুটি পুত্রের পিতা হয়েছে কিন্তু বেতন বেড়ে মাত্র দুই হাজার টাকা হয়েছে। সামান্য টাকায় তার সংসার চলে না। কাশেম মুন্সি তাই বাড়তি আয়ের জন্যে গরিব মানুষকে ‘পানিপড়া’ দেয়, যদিও সে জানে এতে কোনো কাজ হয় না এবং এটা অনৈসলামিক কাজ; তবু সে এটা করে। কাজটা করতে তার খারাপ লাগে, তবু সে করে।
ক. মতলুব খাঁ কে?
খ. ‘মজিদ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যোগসূত্র হচ্ছে রহিমা।’Ñ কেন?
গ. উদ্দীপকের কাশেম মুন্সি চরিত্রটির সাথে মজিদ চরিত্রের মিল-অমিল কোথায়?
ঘ. ‘লালসালু’ উপন্যাস পাঠ করে মজিদ চরিত্রটি সম্পর্কে তোমার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া জেগেছে? ১
২
৩
৪
৩ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
মতলুব খাঁ হচ্ছে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।
ছ অনুধাবন
‘মজিদ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যোগসূত্র হচ্ছে রহিমা।’Ñ কথাটি দিয়ে মহব্বতনগর গ্রামের নারীসমাজে রহিমার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে।
মজিদ পুরুষ। ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে পর্দাপ্রথা শরিয়তসম্মত। মজিদ এটি মেনে চলে। মহব্বতনগর গ্রামের এবং আশপাশের গ্রামের মানুষ তার কাছে যখন তখন ছুটে আসতে পারে, জানতে পারে কিন্তু নারীসমাজ মজিদের সামনে চাইলেই ছুটে আসতে পারে না। প্রকৃতিগত কারণেই নারীর আবেগ বেশি এবং তা প্রকাশ করার তাড়নাও প্রবল কিন্তু মহব্বতনগর গ্রামে নারীর আবেগ পরিস্ফুটনের কোনো সরাসরি পথ নেই, মজিদের কাছে পৌঁছাবার সরাসরি পথ নেই, যোগসূত্র হচ্ছে রহিমা। মহব্বতনগর গ্রামে রহিমার কদরও কম নয়। মজিদের স্ত্রী হিসেবে তার গুরুত্ব ও সম্মান সমাজে স্বীকৃত। মজিদ যদি মোদাচ্ছের পীরের মাজারের খাদেম হয়ে থাকে তাহলে রহিমা হচ্ছে তার আদর্শ সেবিকা।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের কাশেম মুন্সি চরিত্রটির সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রটির মিল এবং অমিল দুটি দিকই লক্ষ করা যাবে।
প্রথমে মিলের দিক আলোচনা করা হবে পরে দৃষ্টিপাত করা হবে অমিলের জায়গায়। মিল এই যে, দুজনই ধর্মকে পুঁজি করে জীবন নির্বাহ করার পথ বেছে নিয়েছে। মজিদ মহব্বতনগর গ্রামের মানুষকে হাতের মুঠোয় বন্দী করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে, তথাকথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার লালসালু-কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সমাজের চোখ-কান-মুখ। কাশেম মুন্সিও পানিপড়া দিয়ে তার সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করে। দুজনই ধর্ম ব্যবসায়ী; গ্রামের সহজ সরল মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে তারা প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে।
এবার দৃষ্টিপাত করা যাক অমিলের ক্ষেত্রগুলোয়। মজিদ একটা পর্যায় পর্যন্ত কাশেম মুন্সির মতোই গণ্য, যখন সে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে গারো পাহাড় থেকে মহব্বতনগর গ্রামে চলে আসে। কিন্তু গ্রামে সে যখন বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়, তখন সে আর উদ্দীপকের কাশেম মুন্সি এক রকম ধর্ম ব্যবসায়ী থাকে না। কাশেম মুন্সিকে পাঠক মমতা, করুণার চোখে দেখতে পারে আবার নাও দেখতে পারে কিন্তু মজিদকে দেখে আপাদমস্তক ভণ্ড হিসেবেই। কাশেম মুন্সির পানিপড়া দিতে খারাপ লাগে, সে জানে যে এটা অনৈসলামিক কাজ, তবু বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে কাজটা করতেই হয়। কিন্তু মজিদের সে প্রয়োজন ছিল না। অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে কাশেম মুন্সি হয়তো সমালোচিত হতে পারে কিন্তু মজিদ অবিসংবাদিতভাবে নীচ, ইতর।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ একজন অস্তিত্ববাদী কথাশিল্পী। মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট এবং তা উত্তীর্ণ হয়ে অন্যকে সঙ্কটে ফেলার যে ধারাবাহিক জৈব প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে প্রবহমান, মজিদ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে তিনি তা চমৎকারভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাই ‘লালসালু’ উপন্যাসটি পাঠ করার সময় মজিদ চরিত্রটি সম্পর্কে আমার ধারণা এক জায়গায় স্থির থাকে নি বরং তা বারবার বদল হয়েছে।
মজিদ সম্পর্কে আমার চারটি প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াটি হচ্ছে : করুণা। মজিদ যখন গারো পাহাড়ে মানবেতর জীবনযাপন করতো, জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে সে যখন পর্যুদস্ত, ক্লান্ত, পরাজিত সৈনিকÑতখন তার জন্যে আমার রীতিমতো করুণা হলো। এটি উপন্যাসের একদম প্রথম পর্যায়।
উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে তার প্রতি প্রবল ঘৃণা জাগে যখন সে তার ভণ্ডামি দিয়ে গোটা এলাকা করায়ত্ত করে ফেলে, জমিলার মতো একটি কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে তার ওপর অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। বাঁধভাঙ্গা ঘৃণায় আমি উদ্বেল হই মজিদ নামক এই ধর্ম ব্যবসায়ীর ওপর।
উপন্যাসের শেষে মজিদের প্রতি আমার প্রবল বিতৃষ্ণা জাগে, তার অসহায়তা আমি উপভোগ করি। কিশোরী বধূ জমিলাকে কোনো ভাবেই বাগে আনতে না পেরে রণক্লান্ত, পরাজিত, বিধ্বস্ত মজিদ তার প্রথমা স্ত্রী রহিমাকে যখন বলে, “বিবি কারে বিয়া করলাম? তুমি কী বদদোয়া দিছিলা নি?” তখন আমি রীতিমতো উপভোগ করি এবং আমার আত্মতৃপ্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে যখন তার অনুগত প্রথম স্ত্রী রহিমাও তার অবাধ্য হয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, “ধান দিয়ে কী হইব, মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।”
প্রশ্ন\ ৪ \ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বিধবা, নিঃসন্তান জয়তুন বেগমের সংসার আর চলছিল না। একদিন মাঝরাতে তিনি চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন এবং তারপর থেকেই তার সব আচরণ অস্বাভাবিক। দয়ারামপুর গ্রামের মানুষ বলাবলি করছে, স্বপ্নে তিনি এক বুজুর্গ ব্যক্তির কামিয়াবি হাসিল করেছেন। সবাই তার কাছে পানিপড়া আনতে যায়। জয়তুন বেগমের আয় রোজগার মাশালা মন্দ নয়।
ক. ‘সালু’ শব্দের অর্থ কী?
খ. হাসুনির মা দ্বিতীয় বিয়ে করতে অনাগ্রহী কেন?
গ. মজিদ এবং উদ্দীপকের জয়তুন বেগমের তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. উদ্দীপকের উলিখিত জয়তুন বেগম চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর। ১
২
৩
৪
৪ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
‘সালু’ শব্দের অর্থ লাল রঙের কাপড়।
ছ অনুধাবন
হাসুনির মার দ্বিতীয় বিয়েতে অনাগ্রহী থাকার কারণ বিচিত্র। তার দাম্পত্য জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটি নিশ্চয়ই খুবই তিক্ত ছিলÑ দারিদ্র্যলাঞ্ছিত, সুবিধাবঞ্চিত, অশিক্ষিত সমাজে যেমনটি হয়ে থাকে।
স্বামীর স্ত্রীটিকে একটি প্রয়োজনীয় প্রাণী হিসেবেই ঘরে আসে এবং তাকে দিয়ে ষোল আনা খাটিয়ে নেয়। কাজে কর্মে একটু এদিক সেদিক ঘটলেই অমানুষিক নির্যাতনÑমানসিক তো বটেই, অনেক সময় শারীরিকভাবেও। শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সম্পর্কে হাসুনির মায়ের বক্তব্য : “অরা মুনিষ্যি না।” রহিমা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে আবার বিয়ে করবে কিনা, সে তখন বলে, “দিলে চায় না বুবু।” তার বৃদ্ধ বাবা-মা সারাদিন যেভাবে অকথ্য ভাষায় ঝগড়াঝাটি করে, তা-ও হাসুনির মার মনে বিয়ে সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে।
জ প্রয়োগ
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ এবং উদ্দীপকের জয়তুন বেগম চরিত্র দুটির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করলে আমরা মিল এবং অমিল দুটি দিকই দেখবো। প্রথমে আমরা মিলের দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই, পরে অমিল অংশ আলোকপাত করবো। মিলের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে, দুজনই ধর্ম ব্যবসায়ী। মজিদ এবং জয়তুন বেগমÑ দুজনই অশিক্ষিত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। মজিদ আয়ত্তে এনেছে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষদের। এই কাজটা সে করেছে সুকৌশলে, ধীরে ধীরে। অপরদিকে জয়তুন বেগম নিয়ন্ত্রণে এনেছে দয়ারামপুর গ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষদের। মিলের মধ্যে দুজনই ধর্মজীবী এবং তাদের উত্থান হয়েছে নাটকীয়ভাবে।
অমিলের কথা আসলে প্রথমেই যে দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠে, সেটা হলো মজিদের ক্রমবর্ধমান লোলুপতার পাশে জয়তুন বেগমের অসহায় রূপটি। মজিদ স্পষ্টতই নিপীড়ক, শঠ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, জোচ্চর, বাটপার, লম্পট, উদ্দেশ্যবাজ, ক্র‚র, কুটিল, হিংস্রÑ এবং সেই সঙ্গে ধর্ম ব্যবসায়ী। কিন্তু জয়তুন কেবলই ধর্ম ব্যবসায়ীÑ আর কিছু নয়। মহব্বতনগর গ্রামে থাকা খাওয়ার পাকা বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়ার পরেও মজিদ ক্ষান্ত হয়নি বরং তার ব্যবসায় আরও বৃদ্ধি কীভাবে করা যায়, সেটা নিয়ে প্রতিনিয়ত চিন্তাভাবনা করেছে, প্রতিদ্ব›িদ্বদের দমন করেছে।
আওয়ালপুরের পীর, আক্কাস তার মিত্রপক্ষ ছিল না সে লড়াই করেছে দুর্দান্তভাবে যদিও শেষে জমিলা ও রহিমার কাছেই তার শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। উদ্দীপকের জয়তুন বেগমের কোনো প্রতিপক্ষ দেখানো হয়নি এবং কাজটি নিতান্ত জীবন বাঁচানোর জন্যে করেছিলেন বলে তিনি পাঠকের সহানুভূতি পান মজিদ তা থেকে বঞ্চিত।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
মানুষ সমাজের সৃষ্টি। আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাতে এক একজন মানুষ গড়ে ওঠে এক ভাবে। উদ্দীপকের জয়তুন বেগমও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাতে গড়ে ওঠে একটি জীবন্ত চরিত্র। ব্যাপারটি কিভাবে ঘটে, সেটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রথমত, জয়তুন বেগম যে এমন হলেন, তার জন্যে দায়ী তার অর্থব্যবস্থা। লক্ষণীয়, উদ্দীপকে বলা হয়েছে, তিনি বিধবা ও নিঃসন্তান। যদি তার স্বামী কিংবা সন্তান থাকতো, তাহলে বৃদ্ধকালে তাকে এই পানিপড়া ব্যবসায় নিশ্চয় নামতে হতো না। তিনি আর্থিক দিক থেকে অসহায়। তার আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি যদি ভন্ড হতেন, তাহলে শুরু থেকেই পানিপড়া দিতেন, তা কিন্তু তিনি দেননি। তখনই দিয়েছেন, যখন দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে গেছে। সুতরাং, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত না থাকলে জয়তুন বেগম পানিপড়া দিতেন না।
দ্বিতীয়ত, জয়তুন বেগম যে এমন হলেন, তার জন্যে দায়ী আমাদের সমাজব্যবস্থা। আমাদের বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনাথ বৃদ্ধা নারীর একা বেঁচে থাকা খুব কষ্ট যদি তার না থাকে স্বামী, না থাকে সন্তান, না থাকে কোনো সম্পদ। গ্রামের মানুষ মুখে মুখেই ‘আহা’, ‘উহু’ করে কিন্তু একজন বৃদ্ধাকে নিজগৃহে ঠাঁই দেয় না। এক্ষেত্রে সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করতে পারি“জগতে কে কাহার”? আমাদের সমাজব্যবস্থা যদি উন্নত হতো, যদি মানবিক হতো, তাহলে আমার মনে হয় না এই বৃদ্ধা পানিপড়া দেওয়া শুরু করতেন। সমাজই তাকে বাধ্য করেছে।
এবারে আমরা আলোকপাত করতে চাই, একটা দেশের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা কীভাবে সে দেশের মানুষকে নির্মাণ করে। উদ্দীপকের চরিত্রটির নাম ‘জয়তুন বেগম’। নাম শুনে বোঝা যাচ্ছে তিনি প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। তিনি থাকেন দয়ারামপুর নামক গ্রামেএ কথাও উলেখ আছে; যে গ্রামের মানুষের চিন্তাজগৎ মূর্ত হয়েছে ‘বুজুর্গ’ ‘কামিয়াবি’; ‘হাসিল’ ইত্যাদি শব্দরাজির আশ্রয়ে এবং যে গ্রামের মানুষ পানিপড়ায় আস্থা রাখে। পানিপড়া সংস্কৃতিতে আস্থা থাকার কারণেই জয়তুন বেগম সৃষ্টি হতে পেরেছেন নতুবা পারতেন না। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়: টাকার অভাব না হলে কিংবা সমাজব্যবস্থা মানবিক হলে অথবা কুসংস্কৃতি না থাকলে উদ্দীপকের জয়তুন বেগম চরিত্রটি কখনই এমন চরিত্রে বাঁক নিতেন না। সুতরাং মানুষ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাপের ফসল।
প্রশ্ন\ ৫\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ফজিলাতুন নেসা বড্ড ঘুমকাতুরে। নয়টা পাঁচটা অফিস করে বাসায় ফিরলেই তার ঘুম পায়। পনেরো বছর যাবৎ তিনি সংসারের ঘানি টানছেন। স্বামী আবিদুর রহমান এম.এসসি পাস হলেও ঘরে বসে থাকেন। চাকরি নাকি পরের গোলামি। তার কাজ সারাদিন
টেলিভিশনে হিন্দি নাচগান দেখা। গতকাল এশার নামাজ না পড়েই ফজিলাতুন নেসা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে আবিদুর রহমান তাকে অনেক গালমন্দ করেন। ভদ্রমহিলা সারারাত নফল নামাজ পড়ে পরের দিন অফিসে গেছেন।
ক. মহব্বতনগর গ্রামে মজিদকে সবার আগে কে দেখেছিল?
খ. আমেনা বিবির পা দেখে মজিদের গলার কারুকার্য আরো সূ² হয় কেন?
গ. উদ্দীপকের ফজিলাতুন নেসার সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের রহিমা চরিত্রটির তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে রহিমা চরিত্রটি কীভাবে উপস্থাপন করেছেন তা বিশ্লেষণ কর। ১
২
৩
৪
৫ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
মহব্বত নগর গামে মজিদকে সবার আগে দেখেছিল তাহের।
ছ অনুধাবন
আমেনা বিবি যখন মাজার পাক দেওয়ার জন্যে পালকি থেকে নামে, তখন অসতর্কতাবশত তার পায়ের কিছুটা অংশ উন্মেচিত হয়ে যায়, যা মজিদ দেখে ফেলে।
পায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন: “সাদা মসৃণ পা, রোদ-পানি বা পথের কাদামাটি যেন কখনো স্পর্শ করেনি।” স্পষ্টতই আমেনা বিবির ফর্সা পা তাকে উত্তেজিত করে তোলে, তার ভেতর নিষিদ্ধ ভাব জাগিয়ে দেয়। এই ভাব অবদমন করার জন্যেই হোক আর খালেক ব্যাপারীর কাছে লুকানোর জন্যেই হোক অথবা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা কাটোনোর জন্যে হোক, সে মিহি সুরে দোয়া-দুরুদ পড়তে শুরু করে, গলার কারুকাজ আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে এই আবেগের উৎস যে লিবিডো, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কেননা লেখক স্পষ্ট করেই বলেছেন, “সুন্দর পা দেখে øেহ-মমতা ওঠে না এসে, আসে বিষ।”
জ প্রয়োগ
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা এবং উদ্দীপকের ফজিলাতুন নেসা চরিত্রটির ভেতর মিল এবং অমিল দুটিই রয়েছে।
প্রথমে আমরা মিলের দিকগুলো আলোচনা করতে চাই, পরে আলোকপাত করা হবে অমিলের ক্ষেত্রগুলোয়। মিল এই যে, রহিমা এবং ফজিলাতুন নেসা দুজনই স্বামীর একান্ত অনুগত, নিতান্ত বাধ্যগত। লম্বা চওড়া শরীরের রহিমা তার শক্ত সমর্থ দেহ নিয়েও যেমন পদে পদে বেঁটে, দুর্বল, ক্ষীণস্বাস্থ্য মজিদের আজ্ঞাবহ দাসী; আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ফজিলাতুন নেসা নিজে চাকরি করে স্বামী সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করার পরেও তেমনই স্বামীর প্রতি বাড়াবাড়ি রকম অনুগত। এটাই তাদের মিল। দুজনের স্বামী অযোগ্য, তবু তারা দুজনই সমর্পিতা।
অমিল হলো, রহিমা অশিক্ষিতা, গ্রামীণ সমাজে বেড়ে উঠা নারী যে কিনা বিনা যুক্তিতেই স্বামীর যে কোনো কথাকে নির্বিচারে মেনে নেয় কিন্তু ফজিলাতুন নেসার ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। সে একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। তার স্বামী এম.এসসি ডিগ্রিধারী হয়েও ঘরে বসে সারাক্ষণ টিভি দেখেন-তাও আবার হিন্দি নাচ-গান। উদ্দীপকে বলা হয়েছে; গতকাল এশার নামাজ না পড়েই ফজিলাতুন নেসা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন.........” অর্থাৎ ফজিলাতুন নেসা নিয়মিতই পড়েন, কেবল ওই দিন ক্লান্তিবশত পড়তে পারেন নি- উদ্দীপকের প্রথম বাক্যেই তাকে ‘ঘুমকাতুরে’ বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই জন্যে তার হিন্দি নাচ-গান দেখা স্বামী তাকে অনেক গালমন্দ করেন এবং ভদ্রমহিলা তার কোনো প্রতিবাদ না করে সারারাত নফল নামাজ পড়ে পরের দিন অফিসে যান। এটি কী ধরনের পতিভক্তির নমুনা? রহিমা পতিভক্ত কিন্তু এতটা নয়। জমিলাকে মাজারে বেঁধে রেখে আসার ব্যাপারটি সে পছন্দ করেনি। তখন থেকেই তার আনুগত্যে চিড় ধরেছে। মজিদকে সে স্পষ্ট কন্ঠে যখন বলে, “ধান দিয়া কি হইবো, মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।” তখন আমরা বুঝি এই রহিমা আর আগের রহিমা নেই; এ নতুন রহিমা। ‘লালসালু’র রহিমার প্রতি পাঠকের সহানুভূতি জাগে, আর উদ্দীপকের ফজিলাতুন নেসার প্রতি জাগে বিদ্রূপ।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের চরিত্রগুলো স্কেচের মতো করে আঁকা হয়েছে। প্রায় সব চরিত্রই দেশ-কাল-পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাপিত এবং তুলনারহিত সৃষ্টি।
রহিমা সৈয়দ ওয়ালীউলাহর নির্মিত সকল চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর্য সমাজে এমন একটি কথা প্রচলিত ছিল যে পাক করলেই কেবল নারী হয়ে জন্ম নিতে হয়। সগদ্বিখ্যাত অনেক নারী ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে নারী হওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন শিল্পের নানা মাধ্যমে। সেগুলো যে খুব একটা বাড়িয়ে বলা নয়, তার প্রমাণ রহিমা চরিত্রটি। কৃষকায়, রোগা, বয়স্ক, খাটো, ভগ্নস্বাস্থ্য এই লোকটির কাছে রহিমার বাবা-মা নির্দ্বিধায় তাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল। অথচ তারা জানেই না কে এই মজিদ, কী তার পরিচয়? কোনো ভাবে মেয়েকে বিদায় করা গেছে স্বামী যেমনই হোক, পাত্রস্থ করা গেছে এই হলো বাবা মায়ের চিন্তা। যেমন বাবা-মা, তেমন তাদের সন্তান। রহিমাও তেমনই সমর্পিতা নারী। মজিদ যা বলে, তাই সই। সাত চড়ে তার রা নেই। সুতরাং বলা যায়, রহিমা একজন সনাতন গ্রামীণ বাঙালি নারী।
রহিমার মধ্যে গৃহস্থভাব প্রবল। ঘরের সব কাজকর্ম নিপুণ হাতে সে সামাল দেয়। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সে। রাতের বেলা সে মজিদের শুকনো পা-ও টিপে দেয়। বলা যায়, মজিদকে সুখে-শান্তিতে রাখার জন্যে সম্ভব সবকিছুই সে করেছিল। তার ভেতর সন্তানের জন্য একটা হাহাকার ছিল যেটা সে পূরণ করে নিয়েছিল জমিলাকে দিয়ে। জমিলাকে সে কখনও সতীন হিসেবে দেখেনি, দেখেছে কন্যা হিসেবে।
উপন্যাসের শেষে জমিলার বিদ্রোহী রূপ পাঠককে চমকিত, বিস্মিত, অভিভূত ও মুগ্ধ করে। সব কিছুরই একটা সীমা আছে যা পেরিয়ে গেলে বাঁধ ভেঙে যায়। মজিদ যখন জমিলার ওপর সীমাহীন নির্যাতন শুরু করে, তখন রহিমার এই বিদ্রোহী রূপ আমরা দেখি।
প্রশ্ন\ ৬\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
শামীমা সুলতানা একজন গৃহিণী। তার স্বামী আলমাস আলী কৃষিকাজ করে। এই দম্পতির কোনো সন্তানাদি নেই। বিয়ের বারো বছরের পরেও শামীমা সুলতানার গর্ভে কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় আলমাস আলী স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ করে। দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুম একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিলে সংসারে অশান্তি দেখা দেয়।
ক. সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র পিতার নাম কী?
খ. মজিদের দ্বিতীয় বিবাহে আগ্রহের কারণ কী?
গ. ‘লালসালু’ উপন্যাসের রহিমা এবং উদ্দীপকের শামীমা সুলতানা চরিত্র দুটির মধ্যে মিল ও অমিল কী?
ঘ. উদ্দীপকের মধ্যে বাঙালি সমাজের কী ধরনের ছাড়াপতা ঘটেছে বিশ্লেষণ কর। ১
২
৩
৪
৬ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র পিতার নাম সৈয়দ আহমদউলাহ্।
ছ অনুধাবন
মজিদের দ্বিতীয় বিবাহের আগ্রহের কারণ ছিল অল্পবয়সী কোনো নারীর সঙ্গ লাভ।
মজিদের দ্বিতীয় বিয়ের উদ্দেশ্য মূলত অল্পবয়সী একজন নারীর সঙ্গ লাভের গোপন বাসনা থেকে উৎসারিত যদিও সে তা মুখে স্বীকার করেনি। সে মুখে বলেছে যে রহিমাকে একজন সঙ্গী এনে দেওয়াই তার কাজ। রহিমা নিঃসন্তান। অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও তার কোনো সন্তান হয়নি। এটি কার দোষে রহিমার না মজিদের সেটি কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় নির্ণীত হয়নি। তবু মজিদ নিজেই ধার্য করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেমনটি করা হয়ে থাকে সব দোষ রহিমারই। তাই সে অজুহাত দেখিয়ে রহিমাকে বলে : “বিবি, আমাগো যদি পোলাপাইন থাকতো।” রহিমা হাসুনিকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে মজিদ রাজী হয় না। সে আসলে খুব কম বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। লেখক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন : “মজিদের নেশার প্রয়োজন।”
জ প্রয়োগ
‘লালসালু’ উপন্যাসের রহিমা এবং উদ্দীপকের শামীমা সুলতানা চরিত্র দুটির মধ্যে মিল এবং অমিল দুটি দিকই লক্ষযোগ্য।
প্রথমে আমরা মিলের দিকগুলো আলোচনা করবো, পরে আলোকপাত করা হবে অমিল যেখানে আছে সেসব দিকে। মিল এই যে, রহিমা এবং শামীমা সুলতানা দুজনই প্রথম পর্যায়ে স্বামীর অনুগত এবং দুজনই গ্রামীণ, কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিনিধি। (যার কারণেই হোক) রহিমা এবং শামীমা সুলতানা দুজনই নিঃসন্তান এবং দুজনই স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়েতে অনুমতি দিয়েছে হয়তো মনে কষ্ট চেপে রেখেই, সাধারণত এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে। এই দুজন নারী তাদের স্বামীদের দ্বিতীয় বিবাহ পর্যন্ত এক রকম।
তাদের মধ্যে অমিল শুরু হলো তাদের স্বামীরা যখন বিয়ে করে, তারপর থেকে। রহিমার ক্ষেত্রে যদি লক্ষ করি, তাহলে স্পষ্ট হবে যে, জমিলার ওপর মজিদ যখন থেকেই অত্যাচার করা শুরু করেছে, তখন থেকেই রহিমা ধীরে ধীরে স্বামীর অবাধ্য হতে শুরু করেছে এবং তার অবাধ্যতা উপন্যাসের শেষে চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যখন সে মজিদকে বলে, “ধান দিয়া কী হইবো, মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।” অপরদিকে শামীমা সুলতানা স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিলেও সতীনের গর্ভে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরে সে বদলে গেছে। তখন সে আর স্বামীর অনুগত থাকেনি। নিতান্ত অনুগত স্ত্রী হয়ে উঠেছে নিত্য কলহপরায়ণ। তবে রহিমার সাথে শামীমা সুলতানার মূল পার্থক্য একটিই, সেটি হচ্ছে: রহিমা তার সতীনকে কখনই ঈর্ষা করেনি শামীমা সুলতানা তার সতীনকে ঈর্ষা করেছে সে পুত্রসন্তান প্রসব করেছে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
বিন্দার মধ্যে থাকতে পারে সিন্ধার ব্যঞ্জনা, গোষ্পদে তরঙ্গিত হয় সমুদ্র গর্জন এটি কেবল কথার কথা নয়, বাস্তবেও এর অজস্র প্রমাণ রয়েছে। তার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্তমান উদ্দীপকের কথাই বলা যেতে পারে। এ উদ্দীপকের মাত্র ৫টি বাক্যে বিধৃত হয়েছে আবহমান বাঙালি সমাজের একটি রূপরেখা।
প্রকৃতিগত কারণে স্বামী বা স্ত্রীর যে কোনো একজনের ত্র“টির জন্য সন্তান জন্ম নাও হতে পারে। এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক, স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু পুরুষশাসিত বাঙালি সমাজে বিশেষ করে গ্রামীণ অশিক্ষিত সমাজে ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই ধরে নেওয়া হয় যে এটি ঘটেছে নারীর ত্র“টির কারণে। তখন পুরুষটি আবার বিয়ে করে। তার স্ত্রী এটি মেনে নেয় অথবা সমাজের কারণে মেনে নিতে বাধ্য হয়। উদ্দীপকে আমরা তাই দেখেছি : আলমাস আলী ও শাসীমা সুলতানার কোনো সন্তান হচ্ছে না বলে আলমাস আলী দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছে, শামীমা তাতে অনুমতি দিয়েছে।
দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে আসার পর তার ঘরে সন্তান জন্ম নিল লক্ষণীয় ‘পুত্র সন্তান’ তখন প্রথম স্ত্রী শামীমা সুলতানা ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হয়েছে। এটি খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। উদ্দীপকে শামীমা সুলতানার সতীনের নাম উলেখ করা হয় নি। সতীনের ভূমীকায় শামীমা এবং শামীমার ভূমিকার সতীন থাকলেও প্রতিক্রিয়া একই হতো। একজনের সাজানো ঘরে অন্য একজন উড়ে এসে জুড়ে বসলে কার সহ্য হয়। শামীমারও সহ্য হয়নি। বাঙালি সমাজটাই এমন।
আবেগ, স্বার্থ ও উদারতা এই তিনটি জিনিস সমান্তরালে যেমন চলতে পারে তেমনই এর বিপরীতমুখী গতিও প্রায়ই লক্ষণীয়। তাই সংঘর্ষ সেখানে অনিবার্য। আলমাস আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী শামীমা সুলতানার মতো বন্ধ্যা হলে হিসাব-নিকাশ অন্যরকম হতো।
প্রশ্ন\ ৭\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
২০১৪ সাল। সিএনজি ড্রাইভার আবুল মিয়া তার স্ত্রী হাসনা বানুকে নিয়ে কালাচানপুরে থাকে। বিয়ে করার সাত বছর পরেও তাদের যখন ছেলেপুলে হয় না, তখন আবুল মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। হাসনা বানু বেঁকে বসে। সে চায়, আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখা হোক, সমস্যাটা কার, তার নিজের নাকি তার স্বামী আবুল মিয়ার। এই নিয়ে প্রবল পারিবারিক বিবাদ চলে।
ক. হাসপাতালটি কোথায় অবস্থিত?
খ. ধলা মিঞা আওয়ালপুরের পীরের কাছে পানিপড়া আনতে অনিচ্ছুক কেন?
গ. রহিমা এবং উদ্দীপকের হাসনা বানু চরিত্রটির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. ‘লালসালু’ উপন্যাসের সামাজিক বাস্তবতা এবং উদ্দীপকের সামাজিক বাস্তবতার ভিন্নতার প্রেক্ষাপট কী? ১
২
৩
৪
৭ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
হাসপাতালটি করিমগঞ্জে অবস্থিত।
ছ অনুধাবন
ধলা মিঞা আওয়ালপুরের পীরের কাছে গিয়ে পানিপড়া আনার ব্যাপারে প্রবল অনিচ্ছুক যদিও সে সেটা মুখে স্বীকার করে না। ধলা মিঞা খালেক ব্যাপারীর সম্বন্ধী খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় স্ত্রী তানু বিবির বড় ভাই। সে তার ভগ্নিপতির গৃহেই আশ্রিত। কাজকর্ম করে না। বসে বসে খায়। খালেক ব্যাপারী তাকে টাকা পয়সা দিয়ে যখন গোপনে কাজটা করে দেওয়ার দায়িত্ব দেয় তখন সে সেটা গ্রহণ করে কিন্তু তিনটা কারণে করে না।
প্রথম কারণ, সে অলস কাজকর্ম করার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই; কোন ভাবে সেটা ফাঁকি দেওয়া যায়, সে সেটা ভাবে। দ্বিতীয় কারণ, আওয়ালপুরের মানুষের সাথে মহব্বতনগরের গ্রামবাসীর ইতঃপূর্বে মারপিট হয়েছে, পানিপড়া আনতে গেলে সে আবার মার খাবে কিনা এই ভয় সে পায়। তৃতীয় কারণটিই সবচেয়ে বড়। দুই গ্রামের মাঝেখানে থাকা ভুতুড়ে মস্ত তেঁতুল গাছটাকে। তাই তার এই অনিচ্ছা।
জ প্রয়োগ
‘লালসালু’ উপন্যাসের রহিমা এবং উদ্দীপকের হাসনা বানু চরিত্র দুটির মধ্যে মিল এবং অমিল দুটি দিকই লক্ষণীয়। মিল খুব কম, অমিলই বেশি। প্রথমে মিলের ক্ষেত্রটি আলোচনা করা যাক, পরে দৃষ্টিপাত করা যাবে অমিলের অংশে। মিল হচেছ রহিমা এবং হাসনা বানু উভয়েই নিঃসন্তান। বিয়ের পরেও তাদের সন্তানাদি হয়নি এবং তাদের উভয়ের স্বামীই দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
অমিলের জায়গাটি ব্যাপক এবং বিচিত্র। রহিমা তার স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ নির্বিচারে মেনে নিয়েছে কোনো রকম প্রতিবাদ প্রতিরোধ ছাড়াই এমনকি কোনো রকম প্রশ্নও তার মধ্যে উচ্চারিত হয়নি। সে সন্তানহীনতার জন্যে আসলে দায় কার। অন্য দিকে, হাসনা বানু রহিমার মতো নিঃশর্তে স্বামীর কাছে সমর্পণ করেনি। সে যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করে জানতে চেয়েছে যে, তাদের সন্তানহীতার জন্য দায়ী কে? সে ডাক্তারি পরীক্ষার আয়োজন করার আহŸান করেছে। কিন্তু বলাবাহুল্য, তার স্বামী আবুল মিয়া তার এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করে নি। ফলে পারিবারিক কলহ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
পুরুষশাসিত বাঙালি সমাজে এটা মনে করা হয়ে থাকে যে, সমস্যা মূলত নারীর দিক থেকেই হয় পুরুষের সমস্যা নেই। রহিমা স্বামীপ্রাণা, পতিভক্ত সনাতন ঘরানার নারী; অন্যদিকে হাসনা বানু যুগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত বাঙালি নারী যে তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। হাসনা বানুর পতিভক্তি নেই, এমন কথা কিন্তু উদ্দীপকে ইঙ্গিত করা হয়নি কিন্তু যেখানে তার অধিকার ধূলিতে লুটিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সে হয়তো সনাতন কোমল আদর্শ ছেড়ে কঠিন মূর্তিতেই আবির্ভূতা।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
লেখক হচ্ছেন তাঁর সমকালীন দেশ-কালের নিপুণ রূপকার। তাই সাহিত্যই হচ্ছে সবচেয়ে কালের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর সময়ের কথা বলেছেন, সেটা বিশ শতকের প্রথমার্ধ কিন্তু উদ্দীপকের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে সময়টা একুশ শতকের প্রথমার্ধ। একশো বছরে সময় অনেক বদলে গেছে, বদলে গেছে সমাজের কাঠামো, বদলে গেছে সেই সমাজের মানুষগুলো। তাই ‘লালসালু’ উপন্যাসের রহিমা আর উদ্দীপকের হাসনা বানু ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি।
বিশ শতকের প্রথমার্ধের চরিত্র রহিমা স্বামীর অনুগত। মজিদ যখন দ্বিতীয় বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করে, রহিমা বিনা দ্বিধায় তা মেনে নেয়। সে প্রশ্ন তোলে না যে তাদের যে ছেলেপুলে হচ্ছে না, এর জন্য আসলে দায়ী কে? অন্যদিকে একুশ শতকের প্রথমার্ধের ঠিক একশো বছরের পরের চরিত্র হাসনা বানু একই অবস্থায় পড়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করতে বলে যে আসলে সমস্যাটি কার তার নিজের, নাকি তার স্বামীর; কার জন্যে হচ্ছে না তাদের সন্তান? হাসনা বানু নিশ্চিত হতে চায়, সমস্যা যদি হাসনা বানুর দিক থেকেই হয়ে থাকে, তাহলে আবুল মিয়া বিয়ে করুক। আবুল মিয়া এতে রাজি নয় বলেই বিবাদের সূচনা।
দুজনের সামাজিক বাস্তবতার ভিন্নতার জন্য সময়ের পরিবর্তন একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। রহিমা এবং হাসনা বানুর মাঝে একশো বছরের ব্যবধান। সময় মানুষকে নির্মাণ করে ভিন্ন ভিন্ন রকম করে। চরিত্রের ওপর সময়ের একটা ভূমিকা থাকে, যেটা এই দুটি চরিত্রের ওপর প্রবলভাবে ছায়াপাত ঘটিয়েছে।
দুজনের সামাজিক বাস্তবতার ভিন্নতার জন্য সমাজের পরিবর্তন উলেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। রহিমা গ্রামীণ সমাজের প্রতিনিধি। তার বাড়ি মহব্বতনগর গ্রামে। অপরদিকে, হাসনা বানু নগর জীবনের প্রতিনিধি। তার বাড়ি ঢাকার অদূরে কালাচানপুরে। তাই তাদের বাস্তবতা ভিন্ন হতে বাধ্য।
প্রশ্ন\ ৯\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
আমার ধারণাদুই দলের এই বিরোধের প্রধান কারণ দুইটি : তার একটি মোলাদের মধ্যে নিহিত, আর একটি তরুণদের মধ্যে। মোলাদের দোষ এইতাহারা নূতনের বিরোধী; তরুণ-দলের দোষ এই তাহারা পুরাতনের বিরোধী। মোলা-দল ভাবে : নূতন যাহা সমস্তই অনৈসলামিক। তাহাদের বিশ্বাস : নূতন-কিছু আসিলেই ইসলামকে কিছু-না-কিছু ক্ষতি না করিয়াই যাইবে না। এই উদ্ভট সজাগ বুদ্ধি তাহাদের মনের এক মস্তবড় দুর্বলতা। উদ্দেশ্য সাধু ও মহৎ হইতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে একটা কাপুরুষতা লুক্কাইয়া আছে।
ক. গ্রামে স্কুল বসাতে চায় কে?
খ. ‘তোমার দাড়ি কই মিয়া’ ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন বিষয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের মোলাদের এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের চেতনাগত বৈশিষ্ট্য একই।” মন্তব্যটি বিচার কর। ১
২
৩
৪
৯ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
গ্রামে স্কুল বসাতে চায় আক্কাস।
ছ অনুধাবন
‘তোমার দাড়ি কই মিয়া?’ উক্তিটি করে মাজারের খাদেম মজিদ।
আক্কাস শহর থেকে লেখাপড়া শিখে গ্রামে যায়। গ্রামের মানুষকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে সে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী মজিদ নিজের স্বার্থহানির ভয়ে এ প্রস্তাবে বাঁধ সাথে। ধর্মের দোহাই দিয়ে আক্কাসকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। বিচার সভায় মজিদ আক্কাসকে অপ্রতিভ করতে কৌশলে তার প্রতি ধর্মীয় অনুভূতির উক্ত কথাটি দ্বারা ঘায়েল করে। যাতে আক্কাস অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। তার মুখে কোনো কথা যোগায় না।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসে উপস্থাপিত ধর্মব্যবসায়ী ও প্রগতিশীল তরুণের চেতনার সাথে দ্ব›েদ্বর বিষয়টির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ধর্ম মানুষের মুক্তির পথ দেখায়। কিন্তু সেটা যদি অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মব্যবসায়ীদের চেতনার ওপর নির্ভর করে তবে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। উদ্দীপকে এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসে এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়।
উদ্দীপকে দেখা যায় মোলা ও তরুণের মাঝে দ্ব›েদ্বর চিত্র। লেখক এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। মোলা অর্থাৎ ধর্মের ধ্বজাধারীরা তরুণদের প্রগতিশীল চেতনাকেই ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। তাদের মতে যা নতুন তাই অনৈসলামিক।
এমন দ্ব›দ্বমূলক ভাব লক্ষ করি ‘লালসালু’ উপন্যাসে ধর্মব্যবসায়ী মজিদ ও প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ আক্কাসের মাঝে। আক্কাসের স্কুল করার প্রস্তাব সে গ্রহণ করতে পারে না। ধর্মের ধুয়া তুলে সেটাকে বন্ধ করে গ্রামে পাকা মসজিদ নির্মাণের সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। উপন্যাসের এই দ্ব›দ্বমূলক ভাবের সাথে উদ্দীপকটি সাদৃশ্যপূর্ণ।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকের মোলাদের এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের চেতনাগত বৈশিষ্ট্য একই।” মন্তব্যটি যথার্থ।
নতুন কিছু করতে গেলে বাধা আসে এটা চিরন্তন সত্য। সেটি যদি কোনো প্রগতিশীল চেতনার ধারক হয় তবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে সঠিকভাবে গ্রহণ করবে না এটাই স্বাভাবিক। উদ্দীপকে এমন বিষয়েরই অবতারণা ঘটেছে। যা উপন্যাসে উপস্থাপিত ভাবের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
উদ্দীপকে লক্ষ করা যায় মোলা ও তরুণের মধ্যে বিরোধের চিত্র। মোলার চেতনা যে নতুন মাত্রই অনৈসালামিক। তাদের বিশ্বাস নতুন কিছু আসলেই ইসলামকে কিছু-না-কিছু ক্ষতি করে যাবে। এই বুদ্ধি তাদের এক মস্তবড় দুর্বলতা ও কাপুরুষতা। এই মোলার চেতনাগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি উপন্যাসের মজিদ চরিত্রে।
উপন্যাসে মজিদের চেতনাতে লক্ষ করা যায় ধর্মান্ধতা, কাপুরুষতা, স্বার্থান্বেষী এবং শঠতা। সে ধর্মকে জীবিকা হিসেবে ব্যবহার করেছে। সমাজে সকল প্রগতিশীলতা ও নতুনত্বের সে ঘোর বিরোধী। তাইতো আক্কাস গ্রামে স্কুল দিতে চাইলে সে বিরোধিতা করে। খালেক ব্যাপারীর বৌকে তালাক দিতে বাধ্য করে। স্কুলের পরিবর্তে গ্রামে সে পাকা মসজিদ তৈরি করার প্রস্তাব করে এবং সিন্ধান্ত নেয়। ধর্মের নামে সবখানেই সে অনাচার করে। তাই বলা যায় উদ্দীপকের মোলা এবং মজিদের চেতনাগত বৈশিষ্ট্য একই।
প্রশ্ন\ ১০\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
পীর সাহেব তাঁর প্রধান খলিফার রুহে শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের রুহ-মোবারক নাযেল করিবার জন্য ঠিক তাঁর সামনে বসিলেন।
শাগরেদরা চারিদিক ঘিরিয়া বসিয়া মিলিত কণ্ঠে সুর করিয়া দরুদ পাঠ করিতে লাগিলেন। পীর সাহেব কখনও জোরে কখনও বা আস্তে নানা প্রকার দোয়া-কালাম পড়িয়া সুফী সাহেবের চোখে-মুখে ফুঁকিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ ফুঁকিবার পর শাগরেদগণকে চুপ করিতে ইঙ্গিত করিয়া পীর সাহেব বুকে হাত বাঁধিয়া একদৃষ্টে সুফী সাহেবের বুকের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
ক. পীর সাহেবের আগমন ঘটে কোন গ্রামে?
খ. ‘যত সব শয়তানি বেদাতি কারবার’- কে, কেন বলেছে কথাটি?
গ. উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের সমগ্র ভাব ধারণ করে কি? তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও। ১
২
৩
৪
১০ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
পীর সাহেবের আগমন ঘটে আওয়ালপুর গ্রামে।
ছ অনুধাবন
নবাগত পীর সাহেবের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ভন্ডামী আখ্যা দিয়ে উক্তিটি করেছে মজিদ।
আওয়ালপুর গ্রামে হঠাৎ একজন পীরের আগমন ঘটে। কৌত‚হলবশত মজিদও সেখানে যায়। সেখানে গিয়ে মজিদ পীর সাহেবের জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। তাকে কেউ সেখানে গ্রাহ্য করে না। এমনকি যারা তাকে চেনে ভক্তি করে তারাও সেদিন তার দিকে ফিরে তাকায় না। পীরের নানা কেরামতির কথা সে শুনতে পায় তারপর যখন সে দেখে অসময়ে নামাজ পড়তে পীর সাহেব হুকুম দিয়েছে তখন সে সুযোগ কাজে লাগায়। সে পীরের কেরামতির অসারতা প্রমাণের জন্যে উক্ত উক্তিটি করে।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসে বর্ণিত পীর সাহেবের আগমনের ঘটনাটির প্রতি ইঙ্গিত করেছে।
ধর্মভীরু মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের একটি বিশেষ স্থান আছে। তাদের মধ্যে সকলেই সৎ ও নিষ্ঠাবান নয়। ‘লালসালু’ উপন্যাসে এ বিষয়টি লেখক চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন যা উদ্দীপকেও লক্ষ করা যায়।
‘লালসালু’ উপন্যাসে তেমনই একজন ভন্ড পীরের কথা বলা হয়েছে। জনৈক পীর সাহেব এর তার সাগরেদের আগমন ঘটে আওয়ালপুর গ্রামে। কারণ তখন সেখানকার গৃহস্তের গোলায় ধান উঠেছে। মুরিদ মতলুব খাঁ তার চারপাশে লোকে লেকারণ্য থাকে। সেই লোকজনদের মধ্যে মুরিদ মতলুব খাঁ পীর সাহেবের গুণাগুণ বর্ণনা করে সহজ ভাষায়। সে নাকি সূর্যকেও দাঁড় করিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। এমনই এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছে উদ্দীপকে। একই পীর তার অবস্থাসম্পন্ন মুরিদের বাড়ি আস্তানা গেড়ে মুরিদসহ ধর্মপ্রাণ মানুষদের কেরামত দেখায়। যতটা না তার ক্ষমতা তার থেকে বেশি ক্ষমতা তার সাগরেদদের। উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসে বর্ণিত ভাবটির প্রতিই ইঙ্গিত করেছে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
না, উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের সম্পূর্ণ ভাব ধারণ করে না।
নিরস্তিত্বের জীবন বেদনা ও উত্তরণ প্রয়াসের শিল্প রূপায়ণে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ এক অভিনব সৃষ্টি। বুর্জোয়া সমাজের সকল সংকটের প্রেরণায় নিঃসঙ্গ আত্মসন্ধানী জীবন চেতনা নিয়ে ঔপন্যাসিক তাঁর শিল্পীমানস গঠন করে উপন্যাসের জমিনে তার স্বার্থক রূপ দিয়েছেন। এসব চেতনার সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটেনি উদ্দীপকের স্বল্পতম জমিনে।
উদ্দীপকে শুধু এক ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত সমাজে ভন্ড ধর্মব্যবসায়ীর স্বার্থসিদ্ধর পন্থাস্বরূপ মানুষের সাথে প্রতারণার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। সমাজের ধর্মব্যবসায়ীরা কীভাবে সাধারণ সহজ সরল মানুষ ঠকিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে জনৈক পীরের মাধ্যমে সে দৃশ্যই দেখানো হয়েছ্ েউদ্দীপকের এ বিষয়টি ‘লালসালু’ উপন্যাসের অনেক বিষয়ের মধ্যে একটি মাত্র বিষয়।
‘লালসালু’ উপন্যাসে বহুমুখী ভাবের প্রকাশ ঘটেছে। এদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে জীবন প্রবাহের গতিময়তা, স্থবিরতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার, সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য; ধর্মভীতি, মানুষের নেতিবাচক মূল্যবোধ-ধর্মের ধ্বজাধারীদের ভন্ডামী ও প্রতারণা, নিরক্ষর অসহায় মানুষের তাদের কাছে আত্মসমর্পণ প্রভৃতি জীবনমুখী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসে। যা উদ্দীপকে পরিলক্ষিত হয় না শুধু সমাজের ভন্ড ধর্মব্যবসায়ীর কর্মকান্ডের বিষয় ছাড়া। তাই বলা যায় উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের ভাবার্থের দর্পণ নয়।
প্রশ্ন\ ১২\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
তওবা, তওবা, কহেন কি মাস্টার সাব। খোদাভক্ত পীর, আলার ওলি মানুষ। দশ গাঁয়ে যারে মানে, তার নামে এত বড় কুৎসা! ভালো কাজ করলা না মাস্টার, ভালা কাজ করলা না। ঘন ঘন মাথা নাড়লেন জমির ব্যাপারী। পীরের বদ দোয়ায় ছাই অইয়া যাইবা! কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠল মতি মাস্টার। কি যে কও চাচা, তোমাগো কথা শুনলে হাসি পায়। হাসি পাইবো না, লেখাপড়া শিখা তো এহন বড় মানুষ অইয়া গেছ। মুখ ভেংচিয়ে বললেন জমির ব্যাপারী। চাঁদা দিলে দিবা না দিলে নাই, এত বহাত্তরী কথা ক্যান?
ক. খালেক ব্যাপারী মসজিদের কত আনা খরচ বহন করতে চায়?
খ. ‘সভায় সকলে প্রথমে বিস্ময় হয়’ কেন?
গ. উদ্দীপকের মতি মাস্টার ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের মাত্র একটি ভাবকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।” মন্তব্যটি বিচার কর। ১
২
৩
৪
১২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
খালেক ব্যাপারী মসজিদের বারআনা খরচ বহন করতে চায়।
ছ অনুধাবন
গ্রামে স্কুল স্থাপন করতে চাওয়া নব্যশিক্ষিত ছেলে আক্কাসের বিচার হবে ভেবে সভায় উপস্থিত হলেও যখন তেমন কোনো শাস্তি বিধান হলো না দেখে সবাই প্রথমে বিস্মিত হয়।
গ্রামের মানুষকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্যে মহব্বতনগর গ্রামে একটি স্কুল স্থাপন করতে চেষ্টা করে। মজিদের কাছে ব্যাপারটি মোটেও ভালো লাগে না। সে এটাকে অমুসলিম কাজ বলে আক্কাসের বিচারের ব্যবস্থা করে। গ্রামের খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে সভা বসে। সকলে তার শাস্তিবিধানের আশায় বসে থাকে। কিন্তু মজিদ যখন তাদের প্রত্যাশানুযায়ী শাস্তি ঘোষণা করে না তখন সভার সকলে প্রথমে বিস্মিত হয়।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের মতি মাস্টার ‘লালসালু’ উপন্যাসের নব্যশিক্ষিত প্রগতিশীল চেতনার আক্কাস চরিত্রের প্রতিনিধি।
শিক্ষার আলো যেখানে পৌঁছায়নি সেখান কোনো সুস্থ জীবন আশা করা যায় না। অথচ বাংলাদেশে এই অভিশাপটা সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এজন্যে আমাদের দেশ এতটা পিছিয়ে। ‘লালসালু’ উপন্যাসের ঔপন্যাসিক এই বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে বাস্তবমুখী করে উপস্থাপন করেছেন।
উদ্দীপকে দেখা যায় নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি গ্রামের মতি মাস্টার আপ্রাণ চেষ্টা করে মানুষের মধ্য থেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে দূরীভুত করতে। সে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে তারা যে চেতনা নিয়ে এতদিন বেঁচে আছে সেটা ঠিক নয়। ভন্ডপীর খাদেমদের চেতনার বলয় থেকে সহজ সরল মানুষদের বের করার প্রয়াস পেয়েছে। এমনই একটা চরিত্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের আক্কাস চরিত্র। সেও গ্রামের সাধারণ মানুষদের নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্যে একটি স্কুল স্থাপন করতে চায়। কিন্তু ভন্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ স্বার্থহানির আশায় তার সেই মহতি চেষ্টাকে সফল হতে দেয় না। উদ্দীপকের মতি মাস্টার এবং উপন্যাসের আক্কাসের সাদৃশ্য এক্ষেত্রেই দেখা যায়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের মাত্র একটি ভাবকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।” মন্তব্যটি যথার্থই হয়েছে।
শিক্ষা মানুষের অমূল্য সম্পদ। শিক্ষা ছাড়া জীবনের কোনো সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সত্যকে মনের মধ্যে ধারণ করে উপন্যাসের আক্কাস গ্রামে একটা স্কুল স্থাপন করে মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে একটু আলোর পরশ দিতে চিয়েছিল কিন্তু এ ধর্মান্ধ সমাজ সেটা হতে দিল না।
‘লালসালু’ উপন্যাসের এই দিকদিই উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে দেখা যায় পীর বা আলাহর অলিদের বিশ্বাস না করার জন্যে মতি মাস্টারকে তিরস্কার করে। জমির ব্যাপারী পীরের বদ দোয়ায় ছাই হয়ে যাবে এই কথাও তাকে শুনতে হয়। কিন্তু প্রগতিশীল চেতনার যুবক মতি মাস্টার সে কথা শুনে হাসে। মানুষের এই অন্ধবিশ্বাস দেখে তাদের প্রতি করুণা হয়। এদিকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের বহুমুখী ঘটনার মাত্র একটিমাত্র দিক।
‘লালসালু’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক জীবনাশ্রয়ী, বাস্তবমুখী অস্তিত্বের উন্মীলন ও পরাভব অঙ্কনের মধ্য দিয়ে এটিকে বাংলাদেশের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ চেতনাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এখানে অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, সামাজিক বৈষম্য, ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতারণা, সহজ সরল মানুষের জীবনধারা অসামান্য শৈল্পীক নৈপুণ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। যা উদ্দীপকে সম্পূর্ণভাবে উঠে আসেনি, শুধু শিক্ষার আলো বঞ্চিত গ্রামে আক্কাস যুবকের শিক্ষার আলো ছড়ানোর চেষ্টা করার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই বলা যায় প্রশ্নের মন্তব্য যথার্থ।
প্রশ্ন\ ১৩\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বহিপীর- অতি আশ্চর্য; কিন্তু উহা সত্য। ব্যাপারটা হইতেছে এই; গত জুম্মা রাতে তাহেরা বিবি নামে একটি বালিকার সঙ্গে আমার শাদি মোবারক সম্পন্ন হয়। তিনি আমার এক পেয়ারা মুরিদের কন্যা। অত্যন্ত হাউস করিয়া তিনি আমার সহিত তাঁহার কন্যার শাদি দিয়াছিলেন। তিনিই কথা পাড়িয়াছেন। আমি ভাবিয়া দেখিলাম, নেক পরহেজগার মানুষ; বিষয়-আশয় তেমন না থাকিলেও বংশ খান্দানি। আমারও বয়স হইয়াছে, দেখভাল করিবার জন্য আর খেদমতের জন্য একটি আপন লোকের প্রয়োজন আছে। আমার প্রথম স্ত্রীর এন্তেকাল হয় চৌদ্দ বৎসর আগে। আমি পুনর্বার শাদি না করিয়া খোদার এবাদত আর মানুষের খেদমতই করিয়াছি। আমার সন্তান-সন্ততিও নাই, দেখাশুনা করিবার জন্য এক হকিকুলাহ্ আছে। কিন্তু সে আর কত করিতে পারে। দেখিলাম, বিবাহ করাটাই সমীচীন হইবে।
ক. তাহাদের নৌকা কোন সড়কটার কাছে এসে পড়ে?
খ. ‘উনি একদিন স্বপ্নে ডাকি বললেন’- মজিদ এ উক্তিটি কেন করে?
গ. উদ্দীপকের বহিপীর ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের ভাবার্থের।” মন্তব্যটির যৌক্তিকতা নিরূপণ কর। ১
২
৩
৪
১৩ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
তাহেরদের নৌকা মতিগঞ্জের সড়কটার কাছে এসে পড়ে।
ছ অনুধাবন
মজিদ জীবিকার তাগিদে প্রবেশ করে মহব্বতনগর গ্রামে। যেখানে অশিক্ষিত ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীর সামনে তার সেখানে আসার উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে উক্ত কথাটি বলে।
মজিদ বলে, সে ছিল গারো পাহাড়ে। সেখানে সে সুখে শান্তিতেই ছিল। গেলো ভরা ধান গোয়াল ভারা গরু-ছাগল। সেখানকার মানুষের মাঝে ধর্ম-প্রচার করে তার জীবন ভালোই চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন সে স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নই তাকে এত দূরে নিয়ে এসেছে। খোদা-রসুলের নির্দেশেই মজিদ এই গ্রামে পদার্পণ করেছে, এই কথা সবাইকে বোঝাতেই মজিদ উক্ত কথাটা বলে।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের বহিপীর ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ একটি প্রতিকী চরিত্র। কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অবিশ্বাসের প্রতীক সে। নিজের স্বার্থের জন্য, জীবিকার তাগিদে প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবদ্ধ জীবন ধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়।
উদ্দীপকের বহিপীর এই মজিদ চরিত্রেররই প্রতিরূপ। তাকে দেখি কন্যার বয়সী তাহেরাকে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। তাহেরা তার মুরিদ কন্যা। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর চৌদ্দ বছর পরে নারীলোলুপ বহিপীর আবার বিয়ে করে। তার এই বৈশিষ্ট্যে একজন পুরুষের নারীর প্রতি হীনম্মন্যতা ও নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করার মনোভাবটি ওঠে এসেছে। যেমনটি দেখা যায় ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ চরিত্রে। মজিদও ঘরে স্ত্রী থাকা সত্তে¡ও কন্যার বয়সী জমিলাকে বিয়ে করে। তার এই আচরণে স্বার্থপরতা ও শোষণের দিকটি প্রকাশিত হয়। ধর্মীয় অনুশাসনে সকলকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখলেও সে নিজের জৈবিক চাহিদা ও অর্থনৈতিক চাহিদা যে কোনো ভাবে পূরণ করে। যা দেখা যায় উদ্দীপকের বহিপীরের চরিত্রে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের ভাবার্থের দর্পণ।” মন্তব্যটি আমার মতে যৌক্তিক নয়।
‘লালসালু’ একটি সামাজিক উপন্যাস। এখানে ঔপন্যাসিক বহুমুখী ভাবের অবতারণা ঘটিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠা কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্ব›দ্ব এ উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
উদ্দীপকে একজন ভন্ড পীরের জৈবিক চাহিদা চরিতার্থ করতে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে একজন কিশোরী কিভাবে বলি হয় সে চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও অশিক্ষার বোকামির সুযোগ গ্রহণ করে সমাজের ধর্মব্যবসায়ীরা কীভাবে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে সে দৃশ্য দেখানো হয়েছে বহিপীরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এটা ‘লালসালু’ উপন্যাসে বর্ণিত একটি মাত্র দিক।
‘লালসালু’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক এই বাংলাদেশের সমাজ জীবনের যুগ যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও ভীতির সাথে সুস্থ জীবনের দ্ব›দ্ব, গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভন্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ তার প্রতারণার জাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই অনুপুঙ্খ বিবরণে সমুদ্ধ উপন্যাসটি। এখানকার একটা খন্ডাংশ মজিদের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা। এ সমাজের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভন্ড ধর্মব্যবসায়ীরা কীভাবে নিজেরে স্বার্থ হালিল করে সে চিত্রটি উপস্থাপন ব্যতীত উদ্দীপকটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্য কোনো বিষয় উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমার কাছে প্রশ্নের মন্তব্যটি অযৌক্তিক।
প্রশ্ন\ ১৪\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বহিপীর - (একটু রেখে) আপনি মত না দিলেও আপনার বাপজান দিয়াছেন। তাহা ছাড়া সাক্ষী সাবদ সমেত কাবিননামাও হইয়া গিয়াছে। এখন সেকথা বলিলে চলিবে কেন। (সুর বদলিয়ে) দেখুন, মন দিয়া আমার কথা শুনুন।
তাহেরা - (আবার বাধা দিয়ে) আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার বাপজান আর সৎমা আপনাকে খুশি করবার জন্য আপনার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। আমি যেন কোরবানীর বকরি। আপনি পুলিশে খবর দিতে পারেন, আপনি আমার বাপজানকে ডেকে পাঠাতে পারেন, আমার ওপর জুলুম করতে পারেন। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে যাবো না। আপনি আমাকে দেখেননি, আমিও আপনাকে দেখিনি। আর আপনাকে আমি দেখতেও চাই না।
খোদেজা - খোদা খোদা, কোথায় যাব আমি। পীরসাহেবের মুখের ওপর এসব কী কথা বলে মেয়েটা! শুনেই আমার বুকের ভেতরটা কাঁপে।
বহিপীর - আমার কথা শোনেন।
তাহেরা - না না, আপনার কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।
ক. মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কী?
খ. ‘আমি ভাবলাম তানি বুঝি দুলার বাপ’ ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের তাহেরার সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলার চরিত্রের সাদৃশ্য কোথায়? আলোচনা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের তাহেরা এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা একই সামাজিক বৈসম্যের শিকার।” মন্তব্যটি বিচার কর। ১
২
৩
৪
১৪ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম জমিলা।
ছ অনুধাবন
‘আমি ভাবলাম তানি বুঝি দুলার বাপ’ কথাটি বলেছে মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা।
মজিদ তার ভবিষ্যৎ বংশধরের আশায় এবং নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্যে দ্বিতীয় বিয়ে করে মেয়ের বয়সী জামিলাকে। সে দরিদ্র ঘরের কন্যা এজন্যে সে খুব সহজেই জমিলাকে বিয়ে করতে পারে। ঠিক যেন বিড়ালের ছানা। তার বিয়ের সময় মজিদকে দেখে তার মনে হয়েছিল মজিদ বুঝি দুলার অর্থাৎ বরের পিতা। বিয়ের পর রহিমার কাছে জমিলা বলে আমি ভেবেছিলাম তানি বুঝি দুলার বাপ। আর তোমাকে মনে করেছিলাম শাশুড়ি। জমিলার উক্ত কথার মাধ্যমে নারীর অবমূল্যায়নের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের তাহেরার সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের জামিলা চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে প্রতিবাদী চেতনায়।
‘লালসালু’ উপন্যাসে নায়ক মজিদ কিন্তু নায়িকা কে? উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে রহিমার উপস্থিতি থাকলেও একটু গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যাবে তার চেয়ে জমিলার গুরুত্ব অনেক বেশি। ঔপন্যাসিক তাকে প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। এই জমিলা চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে উদ্দীপকের তাহেরা চরিত্রের সাথে।
উদ্দীপকের তাহেরা একজন প্রতিবাদী নারী। জনৈক বাহিপীর তাকে কলমা পড়িয়ে বিয়ে করে সৎ মা ও বৃদ্ধ পিতার ইচ্ছানুসারে। কিন্তু তাহেরা সেটাকে মেনে নিতে পারে না। বহিপীর তাকে নিতে এলে তার সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। সে জানায় তার মতে এ বিয়ে হয়নি এবং তার বাপ-মা পীরকে খুশি করার জন্যে তার সাথে বিয়ে দিয়েছে যা সে মেনে নিতে পারবে না। এমনই একটা প্রতিবাদী চরিত্র উপন্যাসের জমিলা। মাজারের খাদেম মজিদের বৌ হওয়া সত্তে¡ও তার মনে খোদাভীতি জাগাতে পারে না মজিদ। তার কোনো নিষেধ সে শোনে না। ঔপন্যাসিক তাকে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের প্রতিবাদী চেতনার নারী হিসেবে তুলে ধরেছেন যা উদ্দীপকের তাহেরার সাথে সাদৃশ্য বিধান করেছেন।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকের তাহেরা এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের জামিলা একই সামাজিক বৈষম্যের শিকার।” মন্তব্যটি সঠিক।
প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সমাজ ব্যাবস্থায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত রয়েছে। এখানে নারীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। এই পুরুষ শাসিত সমাজ নারীকে ভোগের সামগ্রী ভাবে, পুরুষের সেবাদাসী ভাবে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার, পছন্দ-অপছন্দের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। তাহেরা এবং উপন্যাসের জমিলা একই সামাজিক বৈষম্যের শিকার।
উদ্দীপকের তাহেরা দরিদ্র ঘরের মেয়ে। ধর্মান্ধ পিতা স্বার্থানেষী নারীলোলুপ পীর সাহেবকে খুশি করার জন্য মেয়ের মতামতের তোয়াক্কা না করে তার সাথে বিয়ে দেয়। এখানে মেয়ের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্যের কারণে তাহেরা এই জুলুমের শিকার হয়েছে। এমনই বৈষম্যের শিকার হতে দেখি ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলাকে। সেও দরিদ্র ঘরের মেয়ে। তাকেও বলি হতে হয় ভন্ড এক ধর্মব্যবসায়ীর লালসার কাছে।
জমিলাকে বিয়ে করে মজিদ তার বংশ রক্ষার জন্যে কিন্তু সে কখনোই ভাবে নি এ বিয়েতে জমিলার কতটুকু সম্মতি রয়েছে। কারণ বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে অভ্যস্ত পুরুষ মজিদ কাপুরুষের মতো মেয়ের বয়সী জমিলাকে বিয়ে করে। জমিলাও কোরবানীর পশুর মতো এই পুরুষ শাসিত সমাজের বধ্যভূমিতে জীবন উৎসর্গ করে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা য়ায় প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ।
প্রশ্ন\ ১৫\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
পাঁচুকান্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসান শিকদারের শ্বশুর কাসেম হালদার। দেখতে শুনতে বোকা কিসিমের মনে হলেও বদের একশেষ। মেয়েকেই শুধু হাসান শিকদারের ঘাড়ে গছিয়ে দেয়নি, নিজেও জামাইবাড়ির আজীবন ভোগদখল সদস্য বনে গেছে। হাসান চেয়ারম্যানও শ্বশুরের যাবতীয় সম্মান নাশ করে তার যাবতীয় অকামের দোসর শ্বশুরকে করে নিয়েছে। একদিন শেষরাতে শ্বশুরকে তারাকান্দি বাজার থেকে কয়েক প্যাকেট নিষিদ্ধ দ্রব্য খুব গোপনে আনতে বলে। অমাবস্যার রাতে পলাশপুরের শ্যাওড়া গাছতলা দিয়ে ‘তেনাদের’ এড়িয়ে ঝামার বাজার যাওয়ার ব্যপারে কাশেম হালদার খুব ভয় পেতে থাকে। সে নিজে না গিয়ে অন্যকে দিয়ে কাজটি সমাধাণ করার বুদ্ধি আটতে থাকে।
ক. মজিদের ঘর কিসের তৈরি?
খ. মজিদ ধলা মিঞার প্রস্তাবে রাজি হয়নি কেন?
গ. উদ্দীপকের কাসেম হালদার ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের অনুরূপ? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের চেয়ারম্যান হাসান শিকদার আর ‘লালসালু’র খালেক ব্যাপারীর সমস্যা সমধর্মী না হলেও ঘটনা ফাঁস হলে উভয়ের পরিণতি সমরূপ হতে বাধ্য।” বক্তব্য বিষয়ে তোমার মতামত তুলে ধর। ১
২
৩
৪
১৫ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
মজিদের ঘর ইটের তৈরি।
ছ অনুধাবন
মজিদ সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেই ধলা মিঞার প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
মজিদের ধারণা খালেক ব্যাপারী ও তার স্ত্রী আমেনা বিবি মজিদকে মানলেও ভেতরে ভেতরে আওয়ালপুরের পীরের প্রতি তাদের বিশ্বাস অর্জিত হচ্ছে। এজন্য সে রেগে যায়। বিশ্বাসের ভিত তৈরি হওয়ার আগেই মূলসহ তা ওপড়ে ফেলতে চায়। তাই সে ধলা মিঞার প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের কাসেম হালদার ‘লালসালু’ উপন্যাসের ধলা মিঞা চরিত্রের অনুরূপ।
‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রভাবশালী চরিত্র খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বড় ভাই ধলা মিঞা। খালেক ব্যাপারী খুব সুন্দর করে তার প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবির ইচ্ছার কথা বলে ধলা মিঞাকে রাতের আঁধারে খুব গোপনে আওয়ালপুরে গিয়ে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে পীরের পানি পড়া আনতে বলে।
ধলা মিঞাকে সহজ সরল মনে হলেও সে ধুরন্ধর প্রকৃতির। খালেক ব্যাপারী তাকে আমেনা বিবির জন্যে আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছ থেকে পানি পড়া আনতে বললে সে ভিন্নতর মতলব আঁটে। সে মজিদের কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে আওয়ালপুরের পীর সাহেবের পানি পড়ার কথা বলার ফন্দি করে। সেজন্যে মজিদকে পানি পড়া আনা বাবদ খালেকব্যাপারীর দেওয়া টাকার অর্ধেক টাকা ঘুষ দেওয়ার চিন্তাও করে যাতে মজিদ পরে বিষয়টি ফাঁস না করে দেয়। ধলা মিঞার কুমতলবেই আমেনা বিবির কপাল ভাঙে, নিরীহ চরিত্রমতি আমেনা বিবিকে তালাক নিয়ে স্বামীর সংসার ছাড়তে হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকের চেয়ারম্যান হাসান শিকদার আর ‘লালসালু’র খালেক ব্যাপারীর সমস্যা সমধর্মী না হলেও ঘটনা ফাঁস হলে উভয়ের পরিণতি সমরূপ হতে বাধ্য।”- উক্তিটি যথার্থ সঠিক।
‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রভাবশালী চরিত্র খালেক ব্যাপারী তার স্ত্রীর বড় ভাই ধলা মিঞাকে আমেনা বিবির জন্য রাতের আঁধারে, খুব গোপনে আওয়ালপুরে গিয়ে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে পানি পড়া আনতে বলে। আরও বলে যে, সে যেন তার গ্রামের কথা গোপন করে করিমগঞ্জের কথা বলে এবং বলবে তার এক নিকটতম নিঃসন্তান আত্মীয়ার একটা ছেলের জন্য বড় শখ হয়েছে। শখের চেয়েও যেটা বড়া কথা, তাহলো শেষ পর্যন্ত কোনো ছেলেপুলে যদি না-ই হয় তবে বংশের বাতি জ্বালাবার আর কেউ থাকবে না।
মোট কথা ব্যাপারটা এমন করুণভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, শুনে পীর সাহেবের মন গলে যেন পানি হয়ে যায়। কিন্তু ধলা মিঞা আওয়ালপুরে যেতে চায় না, কারণ পানি পড়া নিতে তাকে আওয়ালপুরে যেতে যাত্রা শুরু করতে হবে শেষ রাতে, যাতে ভোর হওয়ার আগেই ধলা মিঞা মহব্বতনগরে ফিরে আসতে পারে এবং এ ব্যাপারে কেউ যেন টের না পায়। অন্যদিকে আওয়ালপুর ও মহব্বতনগরের মাঝপথের তেঁতুল গাছের তলা দিয়ে রাতের বেলা আসতে সে ভীষণ ভয় পায়। কারণ, তেঁতুল গাছটি ‘দেবংশি’ অর্থাৎ এ গাছে ভূত প্রেতের আড্ডা। তাছাড়া পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ও তার ছিল। এসব কারণেই সে আওয়ালপুরে যেতে চায় না।
পরিশেষে বলা যায়, ধলা মিঞার কুমতলব ও গোপনীয়তা ফাঁসের কারণে যেমন আমেনা বিবির কপাল ভাঙে, খালেক ব্যাপারীর নিরীহ চরিত্রমতি আমেনা বিবিকে তালাক দিয়ে সংসারে বিপর্যয় আনতে বাধ্য হয়। উদ্দীপকের কাসেম হালদারের অনুরূপ কর্মকান্ডে চেয়ারম্যান হাসান শিকদারের জীবনেও খালেক ব্যাপারীর অনুরূপ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অর্থাৎ হাসান শিকদার থানা পুলিশে সোপর্দ করলে নানা দুর্ভোগের শিকার হতে পারেন।
প্রশ্ন\ ১৬\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় ‘মুসলিম সহিত্য-সমাজ’ গঠিত হয়। এ সংগঠনের লেখকের দৃষ্টি ছিল যুক্তিবাদীর দৃষ্টি, চিন্তা-সংস্কারের দৃষ্টি এবং সমাজ-সংস্কারের দৃষ্টি। নতুন চিন্তার আভাসে রক্ষণশীলেরা চিরদিনই শঙ্কিত হয়ে ওঠেন, সেদিনও হয়েছিলেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ইসলাম বিদ্বেষী।
ক. কখন বৈঠক ডাকা হলো?
খ. মসজিদের ব্যাপারে খালেক ব্যাপারী কেন বারো আনা খরচ বহন করতে চায়?
গ. ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ এর লেখকের সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের সাদৃশ্যপূর্ণ চরিত্র কোনটি? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ আর ‘লালসালু’র দাড়ি না থাকা একই রকম হামলার একই অস্ত্রবিশেষ।” মূল্যায়ন কর। ১
২
৩
৪
১৬ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
সন্ধ্যার পরে বৈঠক ডাকা হলো।
ছ অনুধাবন
মজিদের তৈরি করা ফাঁদে পা দেওয়া খালেক ব্যাপারী গ্রামের মাতব্বর এবং সবচাইতে পয়সাওয়ালা লোক। আগেও সে মাজারের জন্যে অনেক পয়সা খরচ করেছে, গিলাফ বদলে দিয়েছে। এখন সে মসজিদের জন্যেও টাকা দেবে। কিন্তু বেশির ভাগ খরচ সে একাই বহন করতে চায় কারণ তার মনটা বড় অশান্তিতে আছে, সংসারেও তার বিরাগ এসেছে। আগের মতো দুনিয়ার কাজে সে শান্তি পায় না। সে জন্যে সে পরকালের চিন্তা করে এবং আলাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়।
জ প্রয়োগ
‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ এর লেখকদের সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের সাদৃশ্যপূর্ণ চরিত্রটি হলো মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে আক্কাস মোদাব্বের মিঞার ছেলে। সে ইংরেজি স্কুলে পড়েছে। তারপর বিদেশে গিয়ে বহুদনি থেকেছে। সেখানে চাকরি করে পয়সা জমিয়ে সে আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। আক্কাস গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
উদ্দীপকের ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ এর লেখকদের আদর্শ ও তাদের বিরোধী শক্তির কথা বলা হয়েছে। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ এর লেখকদের দৃষ্টি ছিল যুক্তিবাদীয় দৃষ্টি, চিন্তা-সংস্কারের দৃষ্টি এবং সমাজ-সংস্কারের দৃষ্টি। পক্ষান্তরে নতুন চিন্তার আভাসে রক্ষণশীলেরা চিরদিনই শঙ্কিত হয়ে ওঠেন, সেদিনও হয়েছিলেন। তারা অভিযোগ করেন ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র লেখকরা ইসলাম বিদ্বেষী। উদ্দীপকের ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র লেখকদের অনুরূপ ‘লালসালু’ উপন্যাসের আক্কাসের এ ধারণা হয়েছে যে স্কুলে না পড়লে মুসলমানের ছেলেদের উন্নতি হবে না। গ্রামে মক্তব আছে বটে, কিন্তু মক্তবে পড়–য়ারা আধুনিক চেতনা থেকে পিছিয়ে থাকে। সে জন্যে আক্কাস মনে করে গ্রামে একটি স্কুল থাকা উচিত। মূলত আক্কাস একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামে আসে। কিন্তু অবশেষে ধর্মের কারবারী মজিদের কারণে আক্কাস স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
উদ্দীপকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ আর ‘লালসালু’র দাড়ি না থাকা একই রকম হামলার একই অস্ত্রবিশেষ। প্রতিক্রিয়াশীল ভন্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ দাড়ি না থাকার কথাটি বলেছে মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাসকে।
আক্কাস গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আধুনিক শিক্ষা গ্রামে চালু হলে মক্তবের লেখাপড়ায় পড়–য়াদের আগ্রহ কমে যাবে। তখন মজিদের মতো ধর্মের কারবারীদের অসুবিধা হবে। সে জন্যে মজিদ গ্রামে স্কুল হতে দিতে চায় না। মজিদের সুবিধা হলো এই যে, গ্রামের অজ্ঞ লোকেরা তাকে ভয় করে এবং তার কথায় ওঠে বসে।
উদ্দীপকে ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকয় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ এর লেখকদের আদর্শ ও তাদের বিরোধী শক্তির কথা বলা হয়েছে। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’-এর লেখকদের দৃষ্টি ছিল যুক্তিবাদীর দৃষ্টি, চিন্তা-সংস্কারের দৃষ্টি এবং সমাজ-সংস্কারের দৃষ্টি। পক্ষান্তরে নতুন চিন্তার আভাসে রক্ষণশীলেরা চিরদিনই শঙ্কিত হয়ে ওঠেন, সেদিনও হয়েছিলেন। তারা অভিযোগ করেন ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র লেখকরা ইসলাম বিদ্বেষী। উদ্দীপকের ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র লেখকদের অনুরূপ ‘লালসালু’ উপন্যাসের আক্কাস একজন প্রগতিপন্থী আধুনিক ছেলে। আক্কাসকে থামিয়ে দিতে মজিদ তৎপর হয়। মুসলমানের ছেলে দাড়ি রাখে না এ কথাটি বললে গ্রামের লোকেরা আক্কাসের বিরুদ্ধে যাবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মজিদ লোকজনদের সামনে এটি প্রমাণ করলো যে আক্কাস ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি মানে না।
মূলত উদ্দীপকের রক্ষণশীলেরা এবং ‘লালসালু’র মজিদ নিজের প্রভাব বজায় রাখার জন্যে ইসলামের নামে এসব কথা বলে সমাজের প্রগতিপন্থীদের হামলা করে থামিয়ে দিতে চায়।
প্রশ্ন\ ১৭\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ‘বিদায় হজ্জ’-এ মহানবি (স) সমগ্র মানবজাতিকে উলেখ করে বলেন, “শ্রবণ কর। মূর্খতা যুগের সমস্ত কুসংস্কার, সমস্ত অন্ধবিশ্বাস এবং সকল প্রকারের অনাচার আজ আমার পদতলে দলিত মথিত অর্থাৎ রহিত ও বাতিল হইয়া গেল। .......ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করিও না। ইহার অতিরিক্ততার ফলে তোমাদিগের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে।”
ক. করিমগঞ্জে কী আছে?
খ. মজিদের মন থমথম করে কেন?
গ. উদ্দীপকে উলিখিত ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে?
ঘ. “মূর্খতা যুগের সমস্ত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং অনাচারের আদর্শ ভূমি ‘লালসালু’র মহব্বতনগর।” মন্তব্য বিষয়ের সাথে কি তুমি একমত ? তোমার মতামতের পক্ষে যুক্তি দাও। ১
২
৩
৪
১৭ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
করিমগঞ্জে একটি হাসপাতাল আছে।
ছ অনুধাবন
মহব্বতনগরের আশপাশে আওয়ালপুরে আগত জাঁদরেল পীরের আনাগোনায় মজিদের মন থমথম করে।
সে ভীতসন্ত্রস্ত। কারণ সে বুঝে গেছে যে, লোকজন মজিদের চেয়ে ঐ পীরকে বেশি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। নতুন পীর সাহেব আসার পর মাজারেও লোকজন কম আসা-যাওয়া করে। লোকজন ছোট আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছে। তাকে একটু দেখতে চায়, তার পায়ে একটু চুমু দিতে চায়। এসব দেখে শুনে মজিদ গম্ভীর হয়ে যায়। মাজারে মন থমথম করে।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকে উলিখিত ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের আওয়ালপুরের পীরের সাথে সৃষ্ট দ্ব›দ্ব সংঘাতকে ইঙ্গিত করে।
মজিদ নিজে প্রতারক, ভন্ড ও ধর্মব্যবসায়ী। আওয়ালপুরের পীর সাহেবকেও সে বুঝেছে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি জিইয়ে রাখতে হলে মহব্বতনগর গ্রামবাসী যারা আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছে গিয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই মজিদ আওয়ালপুরের পীরের কারসাজি ধরিয়ে দিয়ে নিজের প্রভাব রক্ষার জন্যে আওয়ালপুরে যায়। সহজ কথায় মহব্বতনগরের গ্রামবাসী মজিদকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, সম্মান করেছে। এখন তারাই আবার আওয়ালপুরে ছুটছে, যা মজিদের জন্যে হুমকিস্বরূপ। তাই সে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার জন্যে আওয়ালপুরে যায়।
উদ্দীপকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স:)- এর বিশ্ব মানবতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বিদায় হজ্জের ভাষণের সংকলিত অংশে দেখা যায়, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “সাধারণ! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করিও না।” অথচ স্বীয় স্বার্থ নিষ্কন্টক রাখার স্বার্থে উদ্দীপকের মজিদ আওয়ালপুরের পীর সাহেবের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়। আওয়ালপুরের পীর সাহেবের নির্দেশে জোহরের নামাজের সময় বহুক্ষণ আগে শেষ হওয়ার পরও এক লোক সবাইকে কাতার বন্দি হতে বলে। নামাজ শেষ হওয়ার পরে মজিদ চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, জোহরের নামাজের সময় বহু আগে পার হয়েছে। পীরের লোকেরা লাঠি দিয়ে সূর্যের ছায়া মেপে দেখে মজিদের কথা ঠিক। মজিদ তখন মহব্বতনগরের লোকদের তার সাথে ফিরে আসার জন্য বলে। লোকজনও তার সঙ্গে চলে আসে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
হ্যাঁ, প্রশ্নোক্ত মন্তব্যে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মহব্বতনগরকে যে মূর্খতা যুগের সমস্ত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং অনাচারের আদর্শ ভূমি বলা হয়েছে তার সাথে আমি একমত।
সমাজচেতন ঔপন্যাসিক এবং জীবন ঘনিষ্ঠ শিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাস চলিশের দশকের বাংলার প্রচলিত সমাজব্যবস্থার একটি নির্মম দর্পণ। গ্রাম-বাংলার ধর্মান্ধতার সুযোগে অন্তঃসারশূন্য একটি কবরকে কেন্দ্র করে মজিদ নামক জনৈক ভন্ডপীরের জীবনকাহিনীই এর মুখ্য বর্ণনার বিষয় হলেও তৎকালীন পলী বাংলায় মুসলিম সমাজজীবনের অতি বাস্তব চিত্র নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে এখানে। উদ্দীপকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:)- এর সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বিদায় হজ্জের ভাষণের সংকলিত অংশ দেওয়া হয়েছে। এখানে মহানবী (স:) বিশ্ব মানবতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “শ্রবণ কর। মূর্খতা যুগের সমস্ত কুসংস্কার, সমস্ত অন্ধবিশ্বাস এবং সকল প্রকারের অনাচার আজ আমার পদতলে দলিত মথিত অর্থাৎ রহিত ও বাতিল হইয়া গেল।” ‘অথচ ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা মহব্বতনগর গ্রামের অন্ধবিশ্বাস এবং অনাচারের আদর্শভূমি রূপে দেখি।
তৎকালে এদেশের সামাজিক অবস্থা ছিল শিক্ষাবর্জিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে গ্রামের মানুষকে প্রতারিত করত। গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর মধ্যে ছিল অন্ধ পীরভক্তি, স্বার্থবাদী ভন্ডপীরেরা গ্রামের লোকদের এ সরলতার সুযোগই গ্রহণ করত। পীরের কথা ছিল তাদের নিকট দ্বৈববাণীর মতো। এ কারণে ভন্ডপীর মজিদের কথায় খালেক ব্যাপারী তার নির্দোষ স্ত্রী আমেনা বিবিকে তালাক দিয়ে প্রচলিত বিশ্বাসের স্রোতে সে আপনাকে ভাসিয়ে দিয়েছে।
ওপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, ‘লালসালু’ তৎকালীন সমাজের পীরভক্তি, ধর্মীয় ভন্ডামি, কুসংস্কার, মানুষের অজ্ঞতা ও মূর্খতার এক বাস্তব চিত্র। মহব্বতনগর গ্রামে আছে বহু মানুষের হৃদয়ের হাহাকার, আছে অনেকের ব্যর্থতার করুণ কাহিনী, ‘লালসালু’র রক্ত রঙিন আবরণে ঢাকা রয়েছে বহু বেদনা, বহু বঞ্চনার কাহিনী, বহু ব্যর্থ কামনার এক অবর্ণনীয় ইতিহাস।
প্রশ্ন\ ১৮\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বহিপীর=(দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে) এতক্ষণে ঝড় থামিল। তাহারা গিয়াছে, যাক। তা ছাড়া তো আগুনে ঝাঁপাইয়া পড়িতে যাইতেছে না। তাহারা তাহাদের নতুন জীবনের পথে যাইতেছে। আমরা কী করিয়া তাহাদের ঠেকাই। আজ না হয় কাল যাইবেই।
ক. ‘লালসালু’ উপন্যাসের শেষ বাক্যটি কী?
খ. মজিদ না ঘুমিয়ে দাওয়ার ওপর বসে থাকে কেন?
গ. উদ্দীপকের বহিপীরের অনুধাবনের অনুরূপ অনুধাবন মজিদ চরিত্রে তুলে ধর।
ঘ. “উদ্দীপকের বহিপীরের অনুধাবনের অনুরূপ অনুধাবন মজিদের ভিতর ক্ষণিকের জন্যে এলেও তা মজিদকে পাল্টাতে পারেনি।” মন্তব্য বিষয়ে মতামত তুলে ধর। ১
২
৩
৪
১৮ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে-চোখ।
ছ অনুধাবন
নিজের প্রভাব বজায় রাখার জন্যে মজিদ জোর করে অন্ধকার মাজার ঘরে জমিলাকে নিয়ে য়ায়। তারপর সে জমিলাকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। তাকে বলে এক রাত মাজার পাকের কাছে থাকলে দুষ্ট আত্মা বাপ বাপ করে পালাবে এবং এভাবে জমিলার মনে খোদাভীতি ও স্বামীভক্তি আসবে। জমিলাকে মাজার ঘরে আটকে রেখে মজিদ ঘরের ভেতরের দাওয়ায় বসে থাকে। তার ধারণা জমিলার তীক্ষè আর্তনাদ একটু পরে শোনা যাবে। তাই সে না ঘুমিয়ে দাওয়ার ওপর বসে থাকে। কিন্তু জমিলার তীক্ষè আর্তনাদ দূরে থাক কোনো টু-শব্দ পর্যন্ত শোনা যায় না ।
জ প্রয়োগ
সংজ্ঞাহীন জমিলাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর মজিদের মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তারই মাঝে উদ্দীপকের বহিপীরের অনুধাবনের অনুরূপ লক্ষণীয়।
জমিলাকে মাজার ঘরে আটকে রেখে মজিদ তার আর্তনাদ শোনার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সারা রাতে অপেক্ষা করার পরও তার সে আশা পূরণ হয়নি। সারা রাত ধরে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি থামলে রহিমার কথা মতো জমিলাকে আনতে যায় মজিদ। মাজারের ঝাপটা খুলে মজিদ দেখে জমিলা সালু কাপড়ে ঢাকা কবরের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার চোখ বোজা, বুকে কাপড় নেই। আর মেহেদি দেওয়া একটি পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। জমিলা সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন। মজিদ তাকে পাজাকোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। রহিমা তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর প্রবল আবেগের বশে জমিলার দেহে হাত বুলোতে থাকে। অদূরে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মজিদ।
উদ্দীপকে সংকলিত বহিপীরের সংলাপ থেকে আমরা ধারণা করতে সক্ষম হই যে, তীব্র এক দ্ব›দ্ব-সংগ্রামমুখর অবস্থা পেরিয়ে বহিপীর পরিবর্তনকে অনুধাবন করেছেন। উদ্দীপকের অনুরূপ পরিবর্তন ক্ষণিকের জন্যে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের মধ্যেও দেখা যায়। শুশ্র“ষারত রহিমা ও সংজ্ঞাহীন জমিলার দিকে তাকিয়ে মজিদের মনে হয়, মুহূর্তের মধ্যে যেন কেয়ামত হবে, নিমিষের মধ্যে তার ভেতরটা ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম। একটা বিচিত্র জীবন আদিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে ক্ষণকালের জন্যে প্রকাশ পায় তার চোখের সামনে। আর একটা সত্যের সীমানায় পৌঁছে জন্ম-বেদনার তীক্ষè যন্ত্রণা অনুভব করে মনে মনে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকের বহিপীরের অনুধাবনের অনুরূপ অনুধাবন মজিদের ভিতর ক্ষণিকের জন্যে এলেও তা মজিদকে পাল্টাতে পারেনি।” প্রশ্নোক্ত এ মন্তব্যের সাথে আমি একমত।
উদ্দীপকে সংকলিত বহিপীরের সংলাপ থেকে আমরা ধারণা করতে সক্ষম হই যে, তীব্র এক দ্ব›দ্ব-সংগ্রামমুখর অবস্থা পেরিয়ে বহিপীর পরিবর্তনকে অনুধাবন করেছেন। উদ্দীপকের অনুরূপ পরিবর্তন ক্ষণিকের জন্যে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের মধ্যেও দেখা যায়। শুশ্র“ষারত রহিমা ও সংজ্ঞাহীন জমিলার দিকে তাকিয়ে মজিদের মনে হয়, মুহূর্তের মধ্যে যেন কেয়ামত হবে, নিমিষের মধ্যে তার ভেতরটা ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম। একটা বিচিত্র জীবন আদিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে ক্ষণকালের জন্যে প্রকাশ পায় তার চোখের সামনে। আর একটা সত্যের সীমানায় পৌঁছে জন্ম- বেদনার তীক্ষè যন্ত্রণা অনুভব করে মনে মনে।
ইতোমধ্যে আবার শিলাবৃষ্টিতে ধানের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে গ্রামের লোকেরা হাহুতাশ করতে লাগল। একজন বলে ওঠে, “সবইতো গেল। এইবার নিজেই বা খামু কি, পোলাপাইনদেরই বা দিমু কি? তখন মজিদ গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে বলে, “নাফরমানি করিও না, খোদার ওপর তোয়াক্কল রাখো।” ধর্ম-ব্যবসায়ী মজিদ মানুষকে ঠকানোর উদ্দেশ্যেই সান্ত্বনার বাণী ছড়ায়। মজিদ চরিত্রের এই দিকটি উদঘাটিত হয়ে যাওয়ায় একটি বিষয় আলোকিত হয়ে ওঠে যে, মজিদ শেষ পর্যন্ত মজিদই থাকে, মানুষ হয়ে আর ওঠে না। উপন্যাসে মজিদ চরিত্রের কোনো প্রকার উত্তরণ ঘটে না।
উপন্যাসের প্রথমে যে মজিদের আবির্ভাব হয়েছিল, মধ্যবর্তী অবকাশে, নানাবিধ ঘটনা ঘটবার পরও উপন্যাসের সমাপ্তিতে সে সেই মজিদই থেকে যায়।
প্রশ্ন\ ১৯\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
সতীন সফুরার কাছে বিয়ের দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল চৌদ্দ বছর বর্ষীয়া জুলেখা। “বুঝলানি ভইব, আমিতো পেরথম মনে করছিলাম, তানি বুঝি দুলার চাচা, খালু”। একথা বলেই জুলেখা বিচিত্রভাবে হাসতে থাকে। ঝরনার অনাবিল গতির মতো ছন্দময় দীর্ঘ সমাপ্তিহীন জীবন্ত সে হাসির শব্দ কানে যেতেই প্রায় ষাট বছর বয়সী জুলেখার স্বামী কলিম ফরাজি খেউ খেউ করতে করতে হাজির হলো। বেশরম, বে-শরিয়তি হাসির জন্য জুলেখাকে তীব্র ভর্ৎসনা করলো। ফরাজির আচরণে আগে থেকে দানা বাঁধা কষ্টের নুড়িতে জুলেখা যেন এক কঠিন পাথর বনে গেল।
ক. সে হঠাৎ জমিলাকে বুকে টেনে নেয় কপালে আস্তে চুমা খায়?
খ. মজিদের মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠে কেন?
গ. উদ্দীপকের জুলেখা ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের প্রতিচ্ছবি?
ঘ. “জুলেখার পাথর বনে যাওয়া আর জমিলার ঠাটাপড়া মানুষের মতো হয়ে যাওয়া, একই অনুভূতি থেকে উৎসারিত আঘাতের পরিণতি।” মূল্যায়ন কর। ১
২
৩
৪
১৯ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
রহিমা হঠাৎ জমিলাকে বুকে টেনে নেয় কপালে আস্তে চুমা খায়।
ছ অনুধাবন
মজিদের মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠে, কারণ মজিদ দেখে তার মিথ্যে গল্পের একটা ফল হয়েছে। জমিলার চোখে ভীতির ছায়া দেখা যায়। মজিদ তখন ধারণা করে তার শিক্ষা সার্থক হয়েছে। মজিদ আরো তৃপ্ত হয় তখন যখন সে দেখে জমিলা অনেকক্ষণ ধরে নামাজ পড়ে। রহিমা ঘরের কাজ করে আসার পরও দেখা যায় জমিলা নামাজ পড়ছে। এতে মজিদ বেজায় খুশি হয়।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের জুলেখা উপন্যাসের জমিলা চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্ব›দ্বী ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউলাহÍ ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলার হাসির রূপ এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে।
জামিলা মজিদের দ্বিতীয় বউ হিসেবে এ বাড়িতে এসেছে। মজিদের সঙ্গে তার বয়সের বিরাট ব্যবধান। মজিদ তার পিতার বয়সী। কিন্তু এর সঙ্গে তার বিয়ে হওয়াই হাসির বিষয়। সে কথা রহিমাকে বলতে গিয়ে জমিলা দারুণভাবে হেসে উঠে।
উদ্দীপকে আমরা দেখি, সতীন সফুরার কাছে বিয়ের দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল চৌদ্দ বছর বর্ষীয়া জুলেখা। সে বলে সে প্রথমে মনে করেছিল তার স্বামীটি বুঝি দুলার চাচা বা খালু। একথা বলেই জুলেখার মতো ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলাও হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছে। হাসি আর থামে না। তার হাসি জীবন্ত। ঝরনা যেমন স্বচ্ছ গতিতে ছন্দময় ভঙ্গিতে এগিয়ে চলে এবং আসলে জমিলার এ হাসি তার জীবনের প্রতি একটি প্রচণ্ড কৌতুক।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
আশাহতের, বঞ্চিতের যে শোক তা উদ্দীপকের জুলেখাকে পাথর বানিয়েছে আর ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলাকে বানিয়েছে ঠাটাপড়া মানুষের মতো।
উপন্যাসের জমিলা মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী। অল্পবয়সী একটি বালিকা। তার জীবনে বাসনা-কামনা আছে। কিন্তু সে জীবনকে যেভাবে ভেবেছিল তার জীবন সেভাবে হলো না। তাকে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হলো পিতার বয়সী এক বুড়ো লোকের সঙ্গে। যার এক বউ আগে থেকেই আছে। সব মিলিয়ে তার জীবন তার কাছেই কৌতুককর মনে হয়।
উদ্দীপকে আমরা দেখি, সতীন সফুরার কাছে বিয়ের দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল চৌদ্দ বছর বর্ষীয়া জুলেখা সে বলে সে প্রথমে মনে করেছিল তার স্বামীটি বুঝি দুলার চাচা বা খালু। একথা বলেই জুলেখা বিচিত্রভাবে হাসতে থাকে। ঝরনার অনাবিল গতির মতো ছন্দময় দীর্ঘ সমাপ্তিহীন জীবন্ত সে হাসি। কিন্তু এমনি সহজ সচ্ছন্দময় হাসিও স্বামীর বিধি-নিষেধ ও রক্তচক্ষুর আঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায়। ফলে সে আগে থেকে দানা বাঁধা কষ্টের নুড়িতে এক কঠিন পাথর বনে যায়। উদ্দীপকের জুলেখার মতো ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা প্রাণ খুলে হাসতেও পারে না। মজিদের শাসন চলে সর্বক্ষণ। খ্যাংটা বুড়ির ছেলের জন্য জমিলারও মন খারাপ হয়। মজিদ ওসব বোঝে না। মন খারাপ হলে দুনিয়াদারির কাজ কি চলবে না। কিন্তু জমিলা পাথরের মতো হয়ে গেছে। কোনোদিকে তার হুঁশ নেই। বজ্রাহতের মতো হয়ে গেছে সে। জীবনের প্রতি সুতীব্র অভিমানে যে হাসি তা অনেক সময় তীরের ফলার চেয়েও ধারাল এবং বেদনাদায়ক।
জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা সব শেষ হয়ে যাওয়ায় উদ্দীপকের জুলেখা এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা পাথর বনে যায়, বনে যায় ঠাটাপড়া মানুষ যাদের কোনো স্বপ্ন নেই।
প্রশ্ন\ ২০\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
রাসু ডাকাত যেমন নৃশংস তেমনি দুর্ধর্ষ। নিজ দল ও এলাকায় তার অপ্রতিহত কর্তৃত্ব। প্রথম বিয়ের প্রায় বিশ বছর পর ডাকাতি করতে গিয়ে নরম লাজুক দেখতে এক ঘোড়শী সুন্দরী কন্যাকে লুট করে এনে বিয়ে করে রাসু ডাকাত। দেখতে নরম লাজুক মেয়েটিই একদিন থানার পুলিশ ডেকে এনে রাসু ডাকাতকে গ্রেফতার করায়। হতভম্ভ রাসু ডাকাত প্রথমা স্ত্রী রাশিদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এ কারে বিয়া করলাম? বিবি, তুমি বদদোয়া দিছিলা নি? রাশিদা বিয়ের দীর্ঘদিন পরে তাকিয়ে নতুন এক রাসুকে দেখে।
ক. কে ল্যাট মেরে বসেই থাকে?
খ. মজিদ আমেনা বিবির প্রতি ক্ষুব্ধ কেন?
গ. রাশিদার চোখে দেখা নতুন রাসু ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে?
ঘ. “রাসুর জিজ্ঞাসা আর মজিদের জিজ্ঞাসা একই সুতোয় গাঁথা।” মন্তব্যটি তুমি সমর্থন কর কি? মতের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন কর। ১
২
৩
৪
২০ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
জমিলা ল্যাট মেরে বসেই থাকে।
ছ অনুধাবন
সন্তানহীনা আমেনা বিবি আওয়ালপুরের পীরের পানি পড়া খেতে চেয়েছিল সন্তান কামনায়। এ ঘটনা জানতে পেরে মজিদ ভীষণ ক্ষেপে যায়। মজিদ বুঝতে পারে সে মহব্বতনগরবাসীর মনে যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাতে যদি একবার ফাটল ধরে তবে আর রক্ষা নেই। এছাড়া আমেনা বিবি মজিদকে অবিশ্বাস করে আওয়ালপুরের পীরের পানি পড়া খেতে চেয়েছে বলে মজিদ মনে করে। তাই মজিদ আমেনা বিবির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।
জ প্রয়োগ
রাশিদার চোখে দেখা নতুন রাসু ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমার চোখে দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলার প্রতিবাদে হতবুদ্ধি ও অসহায় এক নতুন মজিদকে দেখার ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে। বাংলা সাহিত্যের এক ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস ‘লালসালু’। মজিদ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। উপন্যাসের এক পর্যায়ে নতুন এক মজিদকে দেখে তার স্ত্রী রহিমা।
মজিদ হাড়সর্বস্ব ছোটখাটো মানুষ হলে কি হবে, সে খুব প্রতাপশালী। মহব্বতনগরে সে হলো সবচেয়ে শক্তিমান লোক। তার স্ত্রী রহিমা বিশালদেহী, কিন্তু সে স্বামীকে খুব ভয় করে। স্বামীর প্রতি সে তার আনুগত্য অটুট রেখেছে। উদ্দীপকে দেখা যায়, বিয়ের দীর্ঘ বিশ বছরেও রাসু ডাকাতের প্রথমা স্ত্রী রাশিদা যা পারেনি, দ্বিতীয় স্ত্রী বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তা পেরেছে। সে পুলিশকে দিয়ে রাসু ডাকাতকে গ্রেফতার করায়। হতভম্ব রাসু ডাকাত প্রথমা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তার অসহায়ত্তের কথা জানায়, এতে করে সে বিয়ের দীর্ঘ দিন পরে এক নতুন রাসুকে আবিষ্কার করে।
উদ্দীপকের রাসুর দ্বিতীয় স্ত্রীর অনুরুপ মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা মজিদকে মানতে চায় না। সে ঘোমটা খুলে সকলের সামনে বেরিয়ে আসে, জিকিরের সময় তাই হয়েছে। জমিলাকে বিয়ে করে মজিদ ভুল করেছে কিনা এটিই রহিমার কাছে মজিদের জিজ্ঞাসা। মজিদকে বড় অসহায় মনে হয়। রহিমার ওপর মজিদ নির্ভরতা খুঁজে পায় যেন। খুব কোমল কন্ঠে পরমাত্মীয়ের মতো সে রহিমার কাছে তার দুঃখ প্রকাশ করে। মজিদের এ নতুন রূপ। কখনো মজিদকে সে এমন রূপে পায় নি, এমনভাবে কথা বলতে দেখেনি। উপন্যাসের এ পর্যায়ে এসে মজিদকে একজন অসহায় মানুষ হিসেবে পাওয়া যায়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। এ কারণে মানুষ কখনো কখনো তার কৃতকর্মের ভুল আবিষ্কার করে এবং তার জন্যে অনুতপ্ত হয়।
উদ্দীপকের রাসু এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের জিজ্ঞাসা এমনি অনুতাপ বোধে গাঁথা। মজিদের ধারণা ছিল জমিলাকে বিয়ে করলে সংসারে আনন্দ ও বৈচিত্র্য বাড়বে। কিন্তু মজিদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। অল্পবয়সী উচ্ছল স্ত্রী জমিলাকে সে একেবারেই বশ করতে পারেনি। মজিদের বয়স এ মাজারের পরিবেশের সঙ্গে জমিলা মোটেও খাপ খাওয়াতে পারেনি।
উদ্দীপকে দেখা যায়, বিয়ের দীর্ঘ বিশ বছরেও রাসু ডাকাতের প্রথমা স্ত্রী রাশিদা যা পারেনি, দ্বিতীয় স্ত্রী বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তা পেরেছে। সে পুলিশকে দিয়ে রাসু ডাকাতকে গ্রেফতার করায়। হতভস্ব রাসু ডাকাত প্রথমা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তার সে অসহায়ত্তের কথা জানায়, এতে করে সে বিয়ের দীর্ঘ দিন পরে এক নতুন রাসুকে আবিষ্কার করে।
উদ্দীপকের রাসুর দ্বিতীয় স্ত্রী অনুরূপ মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা মজিদকে মানতে চায় না। সে ঘোমটা খুলে সকলের সামনে বেরিয়ে আসে, জিকিরের সময় তাই হয়েছে। মজিদ জমিলার ব্যবহারে খুব ক্রুব্ধ হয় ও দুঃখ পায়। সে বোঝে জমিলা তার কথামতো চলবে না। এ রকম একটা মেয়েকে সে কেন বিয়ে করলো এ অনুতাপে তার মন ভেঙে যায় এবং এ কথা সে রহিমাকে বলে। রহিমা তার প্রথমা স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রী থাকতে আরেকটা বিয়ে করাতে রহিমা তাকে বদদোয়া দিয়েছে নিশ্চয়ই তা না হলে জমিলা এমন অবাধ্য কেন? মজিদের উক্তিতে এটি বোঝা যায় জমিলার ব্যাপারে সে খুব অসহায়। উপন্যাসের এ পর্যায়ে এসে মজিদকে একজন অসহায় মানুষ হিসেবে পাওয়া যায়।
প্রশ্ন\ ২১\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
গত শীতে মিরা তার বান্ধবী রোজির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়াছিল। বান্ধবীর বাবা খোনকার সাব। এলাকার ছোট হুজুর হিসেবে পরিচিত। একদিন গ্রামের এক তরুণীর দুষ্ট জিনের আছর ছাড়াতে খোনকার সাব বাড়িতে দরবার বসান। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য আরবি-ফার্সি বা উর্দু জবানে নানা ছন্দময় বুলির জেকের হলো। নতুন বলে মিরার কাছে পুরো ব্যাপারটা অস্বস্তিকর ও বিভ্রান্তিকর মনে হয়। দিশেহারা মিরা বান্ধবীর মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। কিন্তু স্বামীর প্রতি মহিলার আনুগত্য ধ্র“বতারার মতো অনড়, বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল।
ক. কীসের পর জিকির শুরু হয়?
খ. জমিলা এশার নামাজ পড়তে এবং রাতের খাবার খেতে পারে না কেন?
গ. উদ্দীপকের মিরা ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের অনুরূপ তা নিরূপণ কর।
ঘ. “স্বামীর প্রতি মহিলার আনুগত্য ধ্র“বতারার মতো অনড়, বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল” ‘লালসালু’ উপন্যাসের আলোকে বিশ্লেষণ কর। ১
২
৩
৪
২১ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
যথেষ্ট দোয়া দরুদ পাঠের পর জিকির শুরু হয়।
ছ অনুধাবন
মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা বয়সে তরুণী। সে একটু ঘুমকাতুরে মেয়ে। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে যায়। মাগরিবের নামাজ কোনো রকমে পড়তে পারলেও এশার নামাজ সে পড়তে পারে না। রাতের খাবার খেতে পারে না এ কারণে। জমিলার ঘুম কাঠের মতো অর্থাৎ জমিলা একবার ঘুমালে আর উঠবার নাম করে না।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের মিরা ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলার অনুরূপ। মাজারে এক সন্ধ্যায় জিকির হয়। এ উপলক্ষে খিচুড়িও রান্না করা হয়। রান্নার দায়িত্বে থাকে মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা। দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা রহিমার রান্নাবান্নার কাজ দেখে। বাইরে থেকে জেকেরের আওয়াজ আসতে থাকে। প্রথমে জেকের চলে আস্তে আস্তে, পরে তা বহু মানুষের সম্মিলিত আওয়াজে প্রচণ্ড গতি পায়। এতে জমিলার মনের মধ্যে কেমন একটা ভয় জাগে।
উদ্দীপকের মিরা তার বান্ধবী রোজির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দুষ্ট জিনের আছর ছাড়াতে কথিত দরবারের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। দরবারে বেশ কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য আরবি-ফার্সি বা উর্দু জবানে নানা ছন্দময় বুলির জেকের হয়। নতুন বলে মিরার কাছে পুরো ব্যাপারটা অস্বস্তিকর ও বিভ্রান্তিকর ঠেকে। সে দিশেহারা হয়ে উঠে।
উদ্দীপকের মিরার অনুরূপ মজিদের জেকেরের আওয়াজে তার দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলাও সচকিত হয়ে উঠে। ঝড়ের সমুদ্্েরর এক একটা ঢেউ যেমন তীরে আঘাত হানে, ঠিক তেমনি জেকেরের ঘন ঘন ধ্বনি জমিলার হৃদয়ে আঘাত হানে, জমিলার হৃদয় সমুদ্রের তীরের মতো শক্ত নয়। রহিমার মধ্যে বরং কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। রহিমা বহুবার জেকের শুনেছে। কিন্তু জমিলা কখনও জেকের শোনে নি। সে জন্যে প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন জেকের জমিলাকে দিশেহারা করে তোলে, সে বিভ্রান্ত হয়ে রহিমার দিকে তাকায়।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
প্রশ্নোক্ত মন্তব্য উদ্দীপকের মিরার বান্ধবীর মায়ের ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমার মতো স্বামীভক্তি সম্পর্কে সুন্দর একটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
মহব্বতনগর গ্রামে এসে মজিদ স্থায়ীনিবাস গড়েছে এবং রহিমাকে বিয়ে করেছে। চওড়াদেহী রহিমা তেমন সুন্দর নয়, কিন্তু সে শান্তশিষ্ট কর্মনিপুণা এক মহিলা। তাছাড়া স্বামীর মুখের ওপর সে কখনো কথা বলেনি। রহিমা সেবাযতœ ও পরিশ্রম দিয়ে সংসারকে আগলে রেখেছে; মজিদের মেজাজ-মর্জি সবই সে ভালো করে বোঝে এবং সেভাবে চলে। মজিদ পরে অল্পবয়সী তরুণী জমিলাকে বিয়ে করে। জমিলার রূপ যৌবনে আকৃষ্ট হয়ে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। মজিদ আশা করেছিল জমিলাকে বিয়ে করে সে আরো বেশি আনন্দ পাবে কিন্তু সে অচিরেই তার ভুল বুঝতে পারে। উদ্দীপকের মিরা তার বান্ধবী রোজির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দুষ্ট জিনের আছর ছাড়াতে কথিত দরবারের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। দরবারে বেশ কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য আরবি-ফার্সি বা উর্দু জবানে নানা ছন্দময় বুলির জেকের হয়। নতুন বলে মিরার কাছে পুরো ব্যাপারটা অস্বস্তিকর ও বিভ্রান্তিকর ঠেকে। সে দিশেহারা হয়ে উঠে।
উদ্দীপকের মিরার অনুরূপ মজিদের জেকেরের আওয়াজে তার দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলাও জিকিরের সময় রীতিনীতি ভয় উপক্ষো করে ঘরের বাইরে চলে আসে। ঝড়ের সময় সমুদ্রের তীরের মতো শক্ত নয়। রহিমার পার্থক্য বোঝা যায়। মজিদ অনুভব করে, এমন একটি মেয়েকে সে কেন বিয়ে করলো এ প্রশ্ন জাগে। তখন রহিমার সঙ্গে জমিলার পার্থক্য বোঝা যায়। মজিদ অনুভব করে, রহিমা এমন একটি মেয়ে যায় উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায়। স্বামীর প্রতি রহিমার ভক্তি বিশ্বাস কখনো টলেনি এবং সব সময় সে স্বামীর প্রতি অনুগত থেকেছে। স্বামীর প্রতি রহিমার আনুগত্য ধ্র“বতারর মতো অনড়, বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল।
প্রদত্ত উদ্দীপকের মিরার বান্ধবীর মায়েরও স্বীয় স্বামীর প্রতি এমনটিই দৃশ্যমান। এটি আবহমান বাংলার স্ত্রীদের তাদের স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের চিরন্তন রূপ।
প্রশ্ন\ ২২\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
কুসুমি গ্রামের এক চপলা ষোড়শী। একটু ডানপিটে বলেও তার বদনাম রয়েছে। ডানপিটে মেয়ের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে বলে হিতৈষীজনদের কথায় হরিকৃষ্ণপুরের হারেজ ফকিরকে আনা হয়েছে কুসুমির জিনের আছর তাড়াতে। ফকিরের দরবার বা আসনে কুসুমি সহজভাবেই বসল। হারেজ ফকির চোখ দুটো ভাটার মতো লাল করে মেঘগর্জনে বলে ওঠল দ্যাশের তাবৎ দুষ্ট জিন আমার নাম শুনলে বাপ বাপ করে পালায়। আমার সর্ষে বাণ, মরিচে বাণ, ঝাড়– দাওয়া আর পানি পড়ায় ভূত-পেতিœ থরথর করে কাঁপে। ফকিরের মিথ্যাচার ও বাগাড়ম্বরের এমনি পর্যায়ে কুসুমি বিরক্তি ও ঘৃণায় ফকিরের মুখে একদলা থুথু ছিটায়। স্তম্ভিত হতভম্ব ফকিরের কুসুমের মতো দেখতে কুসুমির প্রতি এক অজনা ভীতি দুর্দান্ত হয়ে উঠল।
ক. মাজারে জমিলাকে বেঁধে রেখে মজিদ কোন সুরাটি পাঠ করেছিল?
খ. জমিলা বেঁকে বসে কেন?
গ. কুসুমির প্রতি হারেজ ফকিরের মিথ্যা বাগাড়ম্বরতা ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন ঘটনার অনুরূপ?
ঘ. “কুসুমের মতো দেখতে কুসুমির প্রতি দুর্দান্ত হয়ে ওঠা এক অজানা ভীতি ফকিরের মতো ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদকেও প্রকম্পিত করে তুলেছিল।” যথার্থতা মূল্যায়ন কর। ১
২
৩
৪
২২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
মাজারে জামিলাকে বেঁধে রেখে মজিদ সুরা ফালাক পাঠ করেছিল।
ছ অনুধাবন
‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা একমাত্র প্রত্যক্ষ প্রতিবাদী চরিত্র। প্রথমে সে বোঝেনি যে তাকে মাজারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে যখন বুঝলো তখন সে বেঁকে বসে। এর কারণ মাজার সম্পর্কে তার ভীতি।
প্রথমত, সে মাজারের ত্রিসীমানায় কখনো ঘেঁষেনি; দ্বিতীয়ত, মজিদ আজ যে গল্প বলেছে তাতে তার ভয় আরো বেড়ে গেছে। সে জন্যে মজিদের শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চায়।
জ প্রয়োগ
কুসুমির প্রতি হারেজ ফকিরের মিথ্যা বাগাড়মাম্বরতা ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলাকে শায়েস্তা করা কালে মজিদের মিথ্যা বাগাড়ম্বরতার অনুরূপ।
ভণ্ড, প্রতারক ও ধর্মব্যবসায়ী মজিদ জমিলাকে পাজাকোলা করে সোজা মাজার ঘরে নিয়ে আসে। মাজার ঘর অন্ধকার। জমিলা ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে অসাড় হয়। সে যেন চোখে কিছু দেখে না। চারদিকে চোখ হাতড়ায়। আলো দেখার একটা তীব্র ব্যাকুলতা তার মধ্যে জাগে। কিন্তু অন্ধকারের পর্দা আরো গাঢ় হয়। সব মিলিয়ে মাজার ঘরে এক ভৌতিক পরিবেশে জমিলার অবস্থা তথৈবচ।
উদ্দীপকে আমরা হারেজ ফকিরকে কুসুমির কাছে মিথ্যা বাগাড়ম্বরতা করতে দেখি। সে বলে, তার নাম শুনলে দেশের তাবৎ দুষ্ট জীন বাপ বাপ করে পালায়। তার সর্ষে বাণ, ঝাড়ু দাওয়া আর পানি পড়ায় ভূত- পেতিœ থরথর করে কাঁপে। উদ্দীপকের হারেজ ফকিরের মতো ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ নিজের প্রভাব বজায় রাখার জন্যে জমিলাকে বলে সে যেভাবে বলবে জমিলা যেন সেভাবে কাজ করে। দুনিয়ার মানুষেরা সবাই মজিদকে মানে, এমনকি জীন-পরীরাও তাকে ভয় করে, কিন্তু জমিলা তার অবাধ্য। মনে হয় তার ওপর কিছুর আছর রয়েছে। মজিদ জমিলাকে এও জানায় যে, তার জন্যে মায়া হয়। জমিলাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে তারও মনে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মজিদ নিরুপায়। তবে মজিদ জিনের আছর ছাড়ানোর জন্যে জমিলাকে বিশেষ কষ্ট দিতে চায় না। শুধু এক রাতের জন্যে তাকে মাজারে বেঁধে রাখবে। তাহলে জমিলা দুষ্ট আত্মা থেকে মুক্ত হবে এবং আগামীকালই দেখা যাবে জমিলার মনে খোদার ভয় ও স্বামীভক্তি এসে গেছে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“কুসুমের মতো দেখতে কুসুমির প্রতি দুর্দান্ত হয়ে ওঠা এক অজানা ভীতি ফকিরের মতো ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদকেও প্রকম্পিত করে তুলেছিল।” প্রশ্নোক্ত ঐ মন্তব্যটি সঙ্গত কারণেই যথার্থ বলে আমি মনে করি।
মজিদের মুখে থুথু ফেলার পর মজিদ যখন জমিলাকে পাঁজাকোলা করে মাজারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখনকার জমিলার অবস্থা দেখে মজিদের মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা-ই প্রশ্নোক্ত অংশে বর্ণিত হয়েছে।
উদ্দীপকে আমরা দেখি, কথিত জিনের আছর ছাড়াতে এসে হারেজ ফকির কুসুমির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে মিথ্যা বাগাড়ম্বরতা শুরু করে। বিরক্তি ও ঘৃণায় কুসুমি ফকিরের মুখে একদলা থুথু ছিটায়। স্তম্ভিত হতভম্ব ফকিরের কুসুমের মতো দেখতে কুসুমির প্রতি এক অজানা ভীতি দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। উদ্দীপকের অনুরূপ ‘লালসালু’ উপন্যাসে জমিলা এক সন্ধ্যায় মজিদের কথামতো নামাজ পড়তে শুরু করে। কিন্তু নামাজ পড়তে গিয়ে জমিলা জায়নামাজে ঘুমিয়ে পড়ে। এতে ভীষণ রাগ করে মজিদ জমিলাকে টেনে হিঁচড়ে মাজারে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মাজারে যেতে জমিলার দারুণ ভয়। মজিদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পেরে সে মজিদের মুখের ওপর থুথু নিক্ষেপ করে। এতে মজিদ হতভম্ব হয়ে পড়ে। পরে থুথু মুছে সে জমিলাকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে মাজারের দিকে যেতে থাকে।
এবার দেখা যায় জমিলা কোনো প্রতিবাদ করছে না কিংবা হাত ছাড়াতেও চাইছে না। সে নিস্তেজ হয়ে থাকে। মজিদের ইচ্ছে হয় তার লইট্টা মাছের মতো নরম দেহকে সম্পূর্ণ পিষে ফেলতে। কিন্তু খুব সতর্ক থাকে। এ প্রতিবাদী মেয়েটিকে তার ভয় হয়। কখন সে কি করে বসবে তা বোঝার উপায় নেই। মজিদ জমিলাকে বিষাক্ত সাপের সঙ্গে তুলনা করে। এখন চুপচাপ থাকলেও যে কোনো মুহূর্তে ফণা তুলতে পারে। সুতরাং, তার নিস্তেজ ভাব দেখে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই বরং ভয়ের আশঙ্কাই বেশি।
প্রশ্ন\ ২৩\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
২০১৪ সাল। মনতোষ রায়ের স্ত্রী মারা গেছে মাস তিনেক হলো। তিনি দুই পুত্রের পিতা। বড় ছেলের বয়স আটারো বছর, ছোটটির বয়স নয়। কৃষ্ণপুর নিবাসী দরিদ্র নমঃশূদ্র হরিহর শীলের চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যা নমিতাকে বিবাহ করতে গিয়ে মনতোষ বাবু গ্রামবাসীর গণধোলাই খেয়েছেন।
ক. জমিলা ঘরে আসার পরে রহিমা কোথায় শয়ন করে?
খ. মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ মজিদকে মান্য করে কেন?
গ. ‘লালসালু’ উপন্যাসের মহব্বতনগর গ্রাম এবং উদ্দীপকের কৃষ্ণপুর গ্রামের মধ্যে তুলনা কর।
ঘ. ‘লালসালু’ উপন্যাসে তৎকালীন সমাজ কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে? ১
২
৩
৪
২৩ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
জমিলা আসার পরে রহিমা বারান্দার মতো ঘরটায় শয়ন করে।
ছ অনুধাবন
মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ মজিদকে মান্য করে ভয় থেকে শ্রদ্ধা বা ভক্তি থেকে নয়। মজিদের পেছনে গ্রামবাসী মাছের পিঠের মতো তথাকথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার দেখতে পায়। গ্রামবাসীর ধারণা, তিনি ‘জিন্দা পীর’। তিনি সব কিছু দেখেন এবং শুনতে পান। বলাবাহুল্য, এসবই কুসংস্কার। এ ধরনের চিন্তাভাবনা ইসলামবিরোধীও বটে। গ্রামবাসী মনে করতো, মজিদ যেহেতু ওই পীরের একনিষ্ঠ খাদেম, সুতরাং তাকে মান্যগণ্য করা অবশ্য কর্তব্য। এই মনমানসিকতা থেকে মহব্বতনগর গ্রামের ধনী গরিব সবাই তাকে মেনে চলতো। মহব্বতনগর যেন লাল সালু-কাপড়ে আবৃত একটি গাম।
জ প্রয়োগ
সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে কোনো সাহিত্যকর্ম বা সাহিত্যিককে মূল্যায়ন করবার সময় তাই দেশ-কাল-পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহর ‘লালসালু’ উপন্যাস রচিত হয়েছে বিশ শতকের প্রথমার্ধে; কিন্তু উদ্দীপকের সূচনাতেই বলে দেওয়া হয়েছে যে এর কালসীমা একুশ শতকের প্রথমার্ধ। সুতরাং কালগত ব্যবধান এক শতক। সমাজে এই এক শতকের পার্থক্য আমরা দেখতে পাবো।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ‘লালসালুতে মজিদ পৌঢ় বয়সে কিশোরী জমিলাকে বিয়ে করেছিল; কোনো সমস্যাই তার হয় নি। অপরদিকে উদ্দীপকে, একুশ শতকের প্রথমার্ধে মনতোষ রায় পৌঢ় বয়সে কিশোরী একটি মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়ে গ্রামবাসীর কাছে গণধোলাই খেয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ব্যাপকভাবে বদলে গেছে বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। মহব্বতনগর গ্রামের মানুষেরা ছিল অন্ধ। তাদের কাছে সমাজবিধিই ছিল একমাত্র বিধান যে বিধানের জোরে পুরুষ হয়ে ওঠে নারীর ভাগ্যবিধাতা। অপর দিকে একুশ শতকে পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোতে আমরা দেখি, মানুষ জেগে উঠেছে। সমাজবিধিকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষ ভাবতে শিখেছে, জাগ্রত করেছে তার বিবেককে সবার ওপরে যদিও দুই সামাজে মহব্বতনগরে এবং কৃষ্ণপুরে রয়ে গেছে সেই একই রকম আদিম মানুষ, আদিম প্রবৃত্তির তাড়না। তবু বলা যায়, সময়ের সাথে সাথে সমাজ এগিয়ে গেছে কিছুটা হলেও; যার প্রমাণ এই উদ্দীপক।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
সাহিত্য হচ্ছে সময়ের দর্পণ, কালের নিরপেক্ষতম ইতিহাস। সাহিত্যে সময়কালের অমোছনীয় ছাপ রয়ে যায়। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে বিশ শতকের প্রথমার্ধের গ্রামীণ বাঙালি সমাজের রূপরেখা নিপুণভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ বিশেষ একটি দেশ-কাল-পরিপ্রেক্ষিতের ফ্রেমে মানুষের অবয়ব আঁকতে চেয়েছেন, যে মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে হক-নাহক যে কোনো উপায়ে বাঁচার চেষ্টা করে এবং ক্রমশ তার অপকর্ম মাত্রা ছড়িয়ে যায়। এই ব্যক্তিটি মজিদ। যে নিজেই অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগেছে একদা, সে নিজেই কিনা পরবর্তীতে অন্যদের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহব্বতনগর গ্রামের বাস্তবতার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের একটি বিশ্বস্ত ছবি আমরা পাই যা মালার মতো মজিদের যাবতীয় কর্মের সঙ্গে যুক্ত। তৎকালীন সমাজ ছিল কৃষিপ্রধান, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধনবৈষম্যপূর্ণ, পুরুষতান্ত্রিক, মোলাশাসিত, পীরভক্ত, শ্রেণিবৈষম্যপূর্ণ, ধর্মবিশ্বাসী, কলহপরায়ণ, জীবনরসিক......। মহব্বতনগরের মানুষ কৃষিকাজ করে। এ গ্রামের লোক সবাই-ই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন ব্যতিক্রম কেবল আক্কাস। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ বলেই মজিদ এখানকার রাজাধিরাজ সেজে বসে আছে। মহব্বতনগর গ্রামে ধনবৈষম্য খুবই স্পষ্ট। একমাত্র ধনী ব্যক্তি খালেক ব্যাপারী। মজিদের অবস্থা দ্বিতীয়। বাকিদের অবস্থা কহতব্য নয়। তৎকালীন সমাজ পুরুষতান্ত্রিক ছিল বলেই রহিমাকে দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে হয়; জমিলাকে কিশোরী বয়সে স্ত্রী হয়ে যেতে হয় বৃদ্ধ মজিদের ঘরে এবং সহ্য করতে হয় শারীরিক মানসিক নানা নির্যাতন; হাসুনির মার ঠাঁই হয় না। মোলাশাসিত সমাজে শাসক সেজে বসে থাকে ভন্ড ধর্মীয় নেতা। আওয়ালপুরে পীর এলে তাকে নিয়ে শুরু হয় মাতামাতি। মহব্বতনগরে মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে আশরাফ-আতরাফ ভেদ পরিলক্ষিত হয়েছে। সে সমাজের সবাইকে দেখি ধর্মের প্রতি প্রবল বিশ্বাস। কলহপরয়ণতা গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। ফলে মহব্বতনগর ও আওয়ালপুরের গ্রামবাসীর সঙ্গে মারপিটও বেঁধেছিল। এতকিছুর পরেও ‘লালসালু’র সমাজের মানুষ জীবনরসিক। মাঠে ফসল ফললে তারা গান গেয়ে ওঠে গলা ছেড়ে।
বস্তুত, ‘লালসালু’ উপন্যাস তৎকালীন গার্হস্থ্য জীবনের অনুপম আখ্যান। ।
প্রশ্ন\ ২৪\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
কার্ল মার্কসের তত্ত¡ অনুযায়ী অর্থই সমাজের মূল নিয়ন্তা। অর্থ যার কাছে থাকবে, সেই শাসন করবে সমাজ এবং সে তার পছন্দ মতো ঢেলে সাজিয়ে নেবে সমাজ, সংস্কৃতি এমনকি ধর্মও। এই কারণে মার্কস তাঁর বিখ্যাত মূলধন তত্তে¡ অর্থকাঠামোকে বলেছেন ‘ইন্টার স্ট্রাকচার’, আর সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মকে বলেছেন ‘সুপার স্ট্রাকচার’।
ক. আক্কাসের বাবার নাম কী?
খ. আক্কাস কেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়?
গ. ‘লালসালু’ উপন্যাসের বাস্তবতার সাথে উদ্দীপকের তত্ত¡ কতখানি সঙ্গতিপূর্ণ?
ঘ. সৈয়দ ওয়ালীলাহ্ কী বাস্তববাদী লেখক? ১
২
৩
৪
২৪ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
আক্কাসের বাবার নাম মোদাব্বের মিঞা।
ছ অনুধাবন
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে অনগ্রসর একটি গ্রামের আখ্যান রূপায়িত করেছেন।
এই গ্রামটির নাম মহব্বতনগর। এই গ্রামের মানুষকে ধর্মপ্রাণ না বলে কুসংসঙ্কারাচ্ছন্ন বলাই সংগত। তারা আধুনিক এবং যুগোপযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বলেই তাদের এমন অবস্থা হয়েছে। ওই গ্রামের মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস কিছুটা ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আসার কারণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। সে বুঝতে পারে, গ্রামবাসীকে সচেতন করে তুলতে হলে তাদের মনে আধুনিক শিক্ষার দীপশিক্ষা জ্বালিয়ে দিতে হবে। তাই সে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
জ প্রয়োগ
‘লালসালু’ উপন্যাসের বাস্তবতার সঙ্গে উদ্দীপকের বাস্তবতা সঙ্গতিসম্পন্ন নয়।
উদ্দীপকে বলা হয়েছে অর্থ সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা দেখি অর্থ নয়, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ধর্ম নামধারী প্রচলিত কুসংস্কার। মার্কসের তত্ত¡ অনুযায়ী সমাজের শাসক হওয়ার কথা খালেক ব্যাপারীর; মজিদ থাকবে তার সহযোগী বা সম্পূরক শক্তি হিসেবে। কিন্তু এ উপন্যাসে আমরা ঠিক বিপরীত ব্যাপারটি লক্ষ করি। সমাজ শাসন করছে মজিদ, তাকে সহযোগিতা করছে খালেক ব্যাপারী।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন কেন হলো? কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত, অভিজাত এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন বলে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র প্রকৃতপ্রস্তাবে গ্রামীণ বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করার বা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়তো সেভাবে হয়ে ওঠেনি। যার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে তাঁর সাহিত্যে। দ্বিতীয় কারণটি ঔপন্যাসিকের পরিকল্পনাগত। লেখক তাঁর এই উপন্যাসে ধর্মীয় কুসংস্কার কীভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাস পাঠ করবার সময় পাঠক আঁচ করতে পারে, ধর্ম সম্পর্কে লেখকের এক ধরনের বৈরাগ্য, বিতৃষ্ণা আছে যা তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেন নি। মজিদ নিঃসন্দেহে ধর্মজীবী, অসৎ, ভন্ড তাকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই আসে না কিন্তু কখনও কখনও ধর্মীয় পরিমণ্ডলকে তিনি শ্লেষের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের মনে হয়েছে, ‘লালসালু’ উপন্যাসে যে বাস্তবতা, সেটা প্রকৃত বাস্তবতা নয়, বফরঃবফ বাস্তবতা। তাই তা উদ্দীপকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় নি।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
বাস্তবতা একটি আপেক্ষিক ধারণা। এই অর্থে একজনের কাছে যেটি বাস্তব, অন্য জনের কাছে সেটি বাস্তব না-ও হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সর্বজনীন বাস্তববাদ বলে কি কিছু নেই তাহলে? সেটি তাহলে কী? বাস্তবতা বলতে আমরা সর্বজনীন বাস্তবতাকেই বুঝে থাকি। সর্বজনীন বাস্তবতা হচ্ছে ওই বাস্তবতা সবার কাছেঅন্তত বেশিরভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। আমরা এই মানদণ্ডে যাচাই করে দেখতে চাই, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ বাস্তববাদী লেখক ছিলেন কিনা।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ নিশ্চয়ই বাস্তববাদী লেখকই ছিলেন, তবে সর্বজনীন বাস্তববাদী লেখক তাঁকে বলা সংগত হবে না। তিনি নির্দিষ্ট একটি তত্ত¡কে কাহিনির প্যাটার্নে দাঁড় করাতে চেয়েছেন, সেটি হচ্ছে অস্তিত্ববাদী তত্ত¡। এই অর্থে তিনি তাত্তি¡ক লেখক, দার্শনিক লেখক। নির্দিষ্ট দার্শনিক তত্তে¡র আদর্শে তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটক রচানা করেছেন সমাজ চিত্র অঙ্কন তাঁর লক্ষ ছিল না।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র উপন্যাসে এই কারণে সমাজচিত্রে নানারকম অসঙ্গতি দেখা যায়। অল্প কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা যাক : (ক) মহব্বতনগর এমনিতেই প্রত্যন্ত গ্রাম কিন্তু তার বিলের পাশেই ‘মতিগঞ্জের সড়ক’। বাস্তবে অজ পাড়াগাঁতে ওই আমলে পাকা সড়কের অস্তিত্ব অকল্পনীয় বিশেষ করে তা-ও আবার বিলের পাশ। (খ) মজিদ গ্রামে ঢুকেই খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে ধমকা ধমকি শুরু করে দেয়। শুরুতেই এত সাহস সে পেল কিসের ভিত্তিতে? (গ) খালেক ব্যাপারীকে পাঠক বুঝতে পারে যে সে মোটেই বোকা কিছিমের মানুষ নয়, বিশেষ করে ধলা মিঞাকে গোপনে পানিপড়া আনতে পাঠিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার পর সে যেভাবে মজিদকে মোকাবেলা করে, তাতে বোঝা যে সে যথেষ্ট চিকন বুদ্ধির লোক; তাহলে সে কেন মজিদের ভন্ডামি বুঝতে পারে না? কেন সে মজিদের প্রভুত্ব মেনে নেয়? (ঘ) এ উপন্যাসে গ্রামীণ প্রকৃতির বাস্তবোচিত বর্ণনা নেই। (ঙ) এ উপন্যাসে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মিশ্রণ দেখা যায়......।
আসলে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ বাহ্য বাস্থবতাকে মুখ্য না করে অন্তর্বাস্তবতাকে হয়তো প্রধান করে তুলতে চেয়েছেন। তাই তাঁর উপন্যাসের রসপরিণতি এ-রকম দেখতে পাই। এটিই হয়তো তাঁর পরিকল্পনার অংশ।
প্রশ্ন\ ২৫\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
আম্বিয়া বিবির মুখের ঝাঁজ খুব বেশি। পাড়া-পড়শিরা আড়ালে আবডালে বলাবলি করে যে, তার জন্মের সময় নাকি তার বাবা-মা মুখে মধু দেয়নি। আঠারো বছর বয়সে স্বামীর ঘরে এসেছিলেন কিন্তু গত ছয় বছর হলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। রোগে-শোকে ভুগে কী না কী বলেন, তার ঠিক আছে নাকি? স্বামী হাসমত আলী গতবার ষোলো বছরের জয়নাবকে বিয়ে করে ঘরে এনেছেন। বলা যায়, হাসমত-জয়নব দম্পতি দরিদ্রগৃহেই সুখে আছে শুধু ওই আম্বিয়া বিবির বিরামহীন গালমন্দটুকু ছাড়া।
ক. সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র শেষ কর্মস্থল কোথায় ছিল?
খ. তাহের-কাদেরের বাবা এত তিক্ত স্বভাবের কেন?
গ. ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা এবং উদ্দীপকের জয়নাবের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. উদ্দীপকের হাসমত আলী চরিত্রটিকে তুমি কীভাবে মূল্যায়ন করবে? ১
২
৩
৪
২৫ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র শেষ কর্মস্থল ছিল প্যারিস।
ছ অনুধাবন
একজন মানুষের স্বভাব কেমন হবে সেটা নির্ভর করে নানা বিষয়ের ওপর : এর ভেতরে রয়েছে তার বংশীয় উত্তরাধিকার, আর্থ-সামাজিক পটভূমি, বয়স, পারিপার্শ্বিক প্রভাব ইত্যাদি।
তাহের-কাদেরের বাবা এত তিক্ত স্বভাবের কেন হলো তার কারণ অনুসন্ধান করলে আমরা তিনটি কারণ দেখতে পাই। প্রথমত, তার আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে গেছে। এক সৎ ভাইয়ের সাথে জায়গা জমি, সম্পত্তি নিয়ে মারামারি, মামলা-মকদ্দমা করে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এদিক থেকে তার মনে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী তার সাথে দিনরাত অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে যা তার জন্যে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অসম্মানের। বৃদ্ধ বয়সে না পারে সে গর্জন করতে, না পারে সে সহ্য করতে। ছেলেদের তাই সে উসকে দিয়ে বলে, ‘ঠ্যাঙ্গা বেটিকে ঠ্যাঙ্গা’। তাহের-কাদেরের বাবার তিক্ত মেজাজের পেছনে তৃতীয় যে কারণ লুক্কায়িত ছিল, সেটা খুব সূ²। মজিদ যখন মহব্বতনগর গ্রামে প্রবেশ করে, তখন তার ভন্ডামি আর কেউ বুঝতে না পারলেও তাহের-কাদেরের বাবাই একমাত্র তা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল। তাই তার মেজাজ আরও বেশি তিক্ত হয়ে যায়। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেনি। অবদমিত এই ক্রোধের কারণে সে এক পর্যায়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েও যায়।
জ প্রয়োগ
সৈয়দ ওয়ালীউলাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলা এবং উদ্দীপকের জয়নাব চরিত্র দুটির মধ্যে আমরা কিছু মিল এবং বেশ কিছু অমিল লক্ষ করি। প্রথমে মিলের দিকটি আলোচনা করা যাক এরপরে আমরা আলোচনা করবো অমিলের ক্ষেত্রসমূহ।
মিল এই যে, জমিলার বিয়ে হয়েছে মজিদের সাথে; উদ্দীপকের জয়নাবের বিয়ে করেছিল, তেমনি উদ্দীপকের হাসমত আলীও তার প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থাতেই দ্বিতীয় বিবাহ করেছে। জমিলা এবং জয়নাব দুজনেই শ্বশুর-বাড়িতে এসেছে সতীন হিসেবে। আর একটি মিল আমরা দেখতে পাই, দুটো বিয়েই হয়েছে পারিবারিক সম্মতি হিসেবে।
এবারে দুটি চরিত্রের ভেতর যে পার্থক্যগুলো রয়েছে আমরা তা দেখানোর চেষ্টা করবো। প্রথম অমির এবং বলা যায় সবচেয়ে বড় অমিল এই যে, স্বামীর ঘরে জমিলা সুখে দিনযাপন করে নি; অপরদিকে উদ্দীপকের জয়নাব হাসমত আলীর ঘরে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে এলেও সে স্বামীর সুখে সোহাগিনী হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, জমিলা দুখিনী নারী, জয়নাব সুখী। প্রশ্ন হতে পারে একই সমাজ কাঠামোতে একই পরিবার ব্যবস্থা একই ধরনের অর্থনৈতিক বৃত্তে থেকেও জমিলা কেন দুঃখ পেল চিন্তা-চেতনা আশা-আকাক্ষার মধ্যে ছিল দুস্তর ব্যবধান এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক টিকে থাকার জন্যে ন্যূনতম যে শ্রদ্ধাবোধ ভালোবাসা থাকা জুরুরি মজিদ-জামিলা দম্পতির ভেতর তা ছিল না। অপরদিকে হাসমত আলী-জয়নাব দম্পতির মধ্যে এগুলোর কোনোটারি কোনো রকম অভাব ছিল না। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবেই হয়ত জয়নাব স্বামীর ঘরে এসেছিল কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে দ্বিতীয় স্ত্রীসুলভ ব্যবহার সে কখনও পায় নি হাসমত আলী তাকে ভালোবেসেছিল সেও ভালোবেসেছিল হাসমত আলীকে তাই তার সুখের পথে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হয়নি।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
দেখবার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এক একজন ব্যক্তির মূল্যায়ন একেক রকম লাল চশমা পরে তাকালেই সবকিছু যেমন লাল মনে হয়, সবুজ চশমায় সবুজ, নীল চশমায় নীল। কোনো চরিত্র মূল্যায়নের সময় পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চরিত্রটি হয়ে উঠতে পারে পাঠকীয়, আবার তেমনই হয়ে যেতে পারে বিরক্তকরও। সাহিত্যতত্তে¡র এই সূত্রটি উদ্দীপকের হাসমত আলী চরিত্রটি মূল্যায়নের সময়েও প্রযোজ্য হবে। হাসমত আলী আমার চোখে কেমন হয়ে ধরা পড়েছে সেটি আমি লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি।
হাসমত আলীকে আমার স্বার্থপর, দায়িত্বহীন, লোলুপ, কৃত্রিম, পাষাণ প্রকৃতির মানুষ মনে হয়। কারও কারও কাছে হাসমত আলী হয়ত দুর্দান্ত স্বামী কিন্তু আমার কাছে তাকে সেরকম মনে হয়নি। উদ্দীপকের মধ্যে রয়ে গেছে বেশ কিছু চোরা স্রোত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, হাসমত আলী প্রথম স্ত্রী অম্বিয়া বিবির ঝগড়াঝাটিতে ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে বুঝি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছে, ব্যাপারটা আসলে সেরকম নয়।
উদ্দীপকটি খুব সচেতনভাবে পাঠ করলে দেখা যাবে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে যাওয়ার পর থেকেই আম্বিয়া বিবির জীবনে তীক্ততা শুরু হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে তার মুখের ভাষায়। উদ্দীপকের এক জায়গায় বলা আছে, “ রোগে- শোকে ভুগে কী না কী বলেন, তার ঠিক আছে নাকি? ” আম্বিয়া বিবির মুখের যে ঝাঁজ তার কারণ দুটো একটি হলো তার শারীরিক অসুস্থতা, অন্যটি হলো মাত্র তেইশ বছর বয়সে সতীন ঘরে আসার জন্যে তার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা।
আম্বিয়া বিবি প্রথম জীবন থেকেই তীক্ত স্বভাবের, এমন কোনো কথা উদ্দীপকে উলেখ করা হয়নি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অন্য দশজন স্বাভাবিক নারীর মতোই। অসুস্থ’ হয়ে যাবার পরে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এবং তার স্বামী আবার বিয়ে করলে এবং তার চোখের সামনে সতীনকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করলে তার সহ্য হয় না। তাই তার এই চিৎকার। হাসমত আলী তার অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা করেছে অথবা নিয়মিত সেবা-যন্ত্র করেছে অথবা নিতান্ত বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এমন কোনো প্রমাণ উদ্দীপকে নেই। তার চেয়েও বড় কথা হাসমত আলী তার অসুস্থ স্ত্রীর সামনেই নিতান্ত অসভ্য এবং অমানবিকভাবে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত থেকেছে যা কোনো ভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। সুতরাং, আমার কাছে হাসমত আলীকে একজন সুবিধাবাদী, নির্মম, অমানবিক মানুষ মনে হয়। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে সে যে ব্যবহার করেছে প্রয়োজনবোধে সে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে একই ব্যবহার করবে। হাসমত আলীর এই আন্তরিকতা কৃত্রিম।
প্রশ্ন\ ২৬\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
আকরাম চৌধুরী গ্রামের মোড়ল। পরপর তিনবার তিনি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তার প্রথম স্ত্রী জরিনা খাতুন বেশ সুন্দরী কিন্তু তার কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। আকরাম চৌধুরী তাই আরেকটি বিয়ে করতে চান। একই গ্রামের বাবুল মুন্সি তাকে অল্প বয়সী এক সুন্দরী পাত্রীর সন্ধান দিয়েছে। বাবুল মুন্সির স্থির কোনো পেশা নেই। সে এলাকার এক পীরের প্রধান খাদেম। গ্রামের মানুষ বলাবলি করছে, এ কাজ করার বিনিময়ে বাবুল মুন্সি বিশ হাজার টাকা উপহার নিয়েছে।
ক. খ্যাংটা বুড়ীর মৃত পুত্রের নাম কী?
খ. মজিদ ক্রমশ লোভী হয়ে ওঠে কেন?
গ. ‘লালসালু’ উপন্যাসের খালেক ব্যাপারী এবং উদ্দীপকের আকরাম চৌধুরীর চরিত্রের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।
ঘ. খালেক ব্যাপারীর চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর। ১
২
৩
৪
২৬ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
খ্যাংটা বুড়ীর মৃত পুত্রের নাম যাদু।
ছ অনুধাবন
মানব চরিত্রের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে সে যত পায় সে আরও বেশি চায়। মজিদ চরিত্রের মধ্যে আমরা এই বৈশিষ্ট্যই লক্ষ করি। অস্তিত্ববাদী কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর এই উপন্যাসে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট এবং অস্তিত্বের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পর অন্যের অস্তিত্বের জন্যে মানুষ কীভাবে হুমকি হয়ে উঠে, তা দেখাবার চেষ্টা করেছেন। মজিদ মূলত তার এই অস্তিত্ববাদী তত্ত¡টির রূপায়ণ ঘটিয়েছে।
উপন্যাসে মজিদ প্রথমে অভাবী ছিল তাই সে মহব্বতনগর গ্রামে আশ্রয় নেওয়ার জন্যে এসেছিল। কিন্তু তার অভাব মিটে যাওয়ার পরেও সে তার ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করে নি বরং তা আরও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যে মজিদের চাল-চুলো ছিল না, সে মজিদের বাড়িঘর হলো, জমিজমা হলো, স্ত্রী হলো- তারপরেও তার লোভের শেষ হয় না। পুরো এলাকায় সে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, পাশের গ্রামে এসেছিল আরেক পীর, কৌশল করে তাকে সে হটিয়েছে। এরপর সে বিয়ে করে কিশোরী জমিলাকে। গ্রামের মোড়ল খালেক ব্যাপারীর প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবিকেও সে তালাক দিতে বাধ্য করে। তার সামনে থাকে শুধু খালেক ব্যাপারী সুতরাং, বলা যায় মজিদের এই যে ক্রমবর্ধমান লোভ, তার পেছনে সক্রিয় ছিল মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। যে যত পায়, সে আরও তত চায়।
জ প্রয়োগ
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের খালেক ব্যাপারী এবং উদ্দীপকের আকরাম চৌধুরী চরিত্র দুটির মধ্যে আমরা মিল এবং অমিল দুটি দিকই লক্ষ করি। প্রথমে আমরা মিলের দিকগুলো আলোচনা করব তারপর আলোকপাত করা হবে অমিলের অংশগুলো। শুরুতেই বলে দিচ্ছি, দুটি চরিত্রের মধ্যে মিলগুলো আপাতত বাহ্যিক আর অমিলটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগত।
মিল এই যে খালেক ব্যাপারীর প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবি বন্ধা; অনরূপভাবে উদ্দীপকের আকরাম চৌধুরীর স্ত্রীও সুন্দরী কিন্তু তারও সন্তানাদি হচ্ছে না। সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে ঘর সংসার করলেও দুজনের কেউই পিতা হতে পারেনি এই অর্থে তাদের দুজনের মনের কোণেই রয়ে গেছে গভীর বেদনা। এই বেদনা থেকে খালেক ব্যাপারী তার সম্বন্ধীকে রাতের অন্ধকারে গোপনে আওয়ালপুরের পীরের কাছে পানিপড়া আনতে পাঠিয়েছিল। একই দুঃখ থেকে আকরাম চৌধুরী দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে চায়। এবার আলোচনা করবো অমিলের ক্ষেত্রগুলো।
উদ্দীপকটি সচেতনভাবে পাঠ করলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে খালেক ব্যাপারী যে প্রকৃতির মানুষ আকরাম চৌধুরী ঠিক তার ভিন্ন ধাতুতে গড়া। একজন যদি হয় উত্তর মেরু অন্যজন তাহলে দক্ষিণ মেরু। মহব্বতনগর গ্রামের ওপর খালেক ব্যাপারীর প্রকৃতপক্ষে কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সে ধনী হলেও বুদ্ধিমান নন এবং একান্তভাবেই সে মজিদ দ্বারা পরিচালিত। অপরদিকে উদ্দীপকের আকরাম চৌধুরী যথার্থ অর্থে মোড়ল গ্রামের মানুষকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা তার ভালোই জানা ছিল এবং কেবল জানা নয় কীভাবে তা প্রয়োগ করতে হয় তার প্রমাণ সে হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছে বাবুল মুন্সিকে বিশ হাজার টাকা উপহার দেওয়া তার সেই কৌশলেরই দৃষ্টান্ত। খালেক ব্যাপারী নামেই মোড়ল কাজে নয় আকরাম চৌধুরী নামে এবং কাজে মোড়ল, আসল মোড়ল।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
একজন কথাশিল্পী যখন কোনো চরিত্র নির্মাণ করেন তখন ঐ চরিত্রটিকে তিনি স্থাপন করেন চরিত্রটির দেশ-কাল সমাজ-সংস্কৃতির পটভূমিতে। তাহলেই কেবল অঙ্কিত চরিত্রটি বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে ওঠে। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারীর চরিত্রটি নির্মাণ করবার সময় চরিত্রটিকে তার দেশ-কাল-সমাজ-সংস্কৃতির পটভূমিতে ফেলে রূপায়ণ করেছেন কিনা সেটা আমরা পরীক্ষা করে দেখতে চাই। সার্থক চরিত্র হিসেবে খালেক ব্যাপারীর নির্মিতির জন্যে এটি একটি অপরিহার্য শর্ত।
গ্রাম বাংলার সমাজ ও জীবনের সঙ্গে সামান্য পরিচয় আছে এমন যে কোনো পাঠকের কাছে খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি একটি অবাস্তব চরিত্র বলে মনে হবে, আমার কাছেও মনে হয়েছে। মহব্বতনগর গ্রামের মোড়ল খালেক ব্যাপারী, ধনসম্পদেও সে ধনী। মজিদ যেদিন মহব্বতনগর গ্রামে নাটকীয়ভাবে প্রবেশ করলো, সেই প্রথম দিনেই সে কেবল পুরো গ্রামবাসীকেই গালমন্দ করেনি, খালেক ব্যাপারীকেও করেছিল। মোড়ল সাহেব ভন্ডের ভন্ডামি বুঝতে পারেনি এবং নীরবে গালমন্দ সহ্য করেছে। এরপর নামেই সে থেকে গেছে গ্রামের মোড়ল, প্রকৃতপক্ষে গ্রামশাসন করেছে মজিদ। আমরা দেখেছি বিভিন্ন সালিশে তাহের-কাদেরের বাবার বিচারে, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপনের সময় খালেক ব্যাপারী কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি সিদ্ধান্ত এসেছে মজিদের কাছ থেকে। এমনকি আওয়ালপুরের পীরকে হটিয়েছে মজিদ একাই, খালেক ব্যাপারীর স্ত্রীকে পর্যন্ত তালাক দিতে বাধ্য করেছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে গ্রামের মোড়লকে পুতুল নাচের মতো নাচিয়েছে মাজারের খাদেম মজিদ সেটা কখনই বাস্তব নয়, হতে পারে না।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র উপন্যাসে বাস্তবতার এই লঙ্ঘন ঘটেছে কেন? তার সরল উত্তর এই যে গ্রামের সমাজ এবং ঐ গামের মানুষ সম্পর্কে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র বাস্তব কোনো ধারণা কখনই ছিল না। তিনি অস্তিত্ববাদী তত্ত¡কে গ্রামের ওপরে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন কিন্তু গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার অনেক কমতি ছিল।
খালেক ব্যাপারী চরিত্র হিসেবে বাস্তবসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনে তার অবস্থান এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন\ ২৭\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
মধ্যরাতেরও পরে ট্রেনটি ঢাকা থেকে প্রায় এক’শ কিলোমিটার দূরের নদীভাঙন কবলিত এলাকার এক স্টেশনে পৌঁছাল। মুহূর্তে ট্রেনটি প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে থরথর করে কেঁপে উঠল। তারপরে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার নানা স্বর ও সুরের বিচিত্র ও ভয়াবহ কলরবে ট্রেনসমেত পুরো স্পেশনটি কাঁপতে থাকল। লোকজন ট্রেনটিতে উঠার জন্যে যেন পাগল হয়ে উঠেছে। কারও পোটলা, কারও পুত্র, কারও বা পরিবার অর্থাৎ স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যায়নাব তার বাবার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্তস্বরে জানতে চায়, এরা নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় যেতে এরকম উন্মাদ হয়ে উঠেছে কেন?
ক. অন্যের পায়ের তলায় কী দুমড়ে যায়?
খ. ‘তাই তারা ছোটে, ছোটে’ কারা ছোটে? কেন ছোটে?
গ. উদ্দীপকের বক্তব্য ‘লালসালু’ উপন্যাসের যে বিশেষ দিকটি আলোকপাত করেছে তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “উদ্দীপকের যায়নাবের জিজ্ঞাসার জবাব ‘লালসালু’ উপন্যাসের শুরুতেই পরিস্ফুট হতে দেখা যায়।” বক্তব্যটির যথার্থতা নিরূপণ কর। ১
২
৩
৪
২৭ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
অন্যের পায়ের তলায় টুপিটা দুমড়ে যায়।
ছ অনুধাবন
অভাব ও অনাহারক্লিষ্ট গরিব মানুষ কাজের সন্ধানে ছোটে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে চিত্রিত অঞ্চলটির ক্ষেত্রে শস্য নেই, কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাই জলবহুল সেই এলাকার লোকজন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দেশের নানা অঞ্চলে ছুটে বেড়ায়, শহর, গ্রাম, বন্দর, যত দুর্গম অঞ্চল হোক তারা সেখানে ছুটে যায় কজের আশায়। হোক না সে কাজ জাহাজের খালাসি, কারখানার শ্রমিক, ছাপাখানার মেশিনম্যান, মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিম।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের বক্তব্য ‘লালসালু’ উপন্যাসের শস্যহীন জনবহুল অঞ্চলে নিশুতি রাতে ট্রেন পৌঁছার পরে জীবনের প্রয়োজনে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ার বিষয়টিকে আলোকপাত করেছে।
‘লালসালু’ সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র প্রথম উপন্যাস এবং এটি তাঁর একটি দুৎঃসাহসী প্রয়াস। জীবনের বাস্তবতা যেমন তেমনি সামাজিক বাস্তবতাও এর ভিত্তি। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালি অঞ্চলের জনবহুলতা, শস্যহীনতা, দারিদ্র্য, অভাব ও ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের জীবনযাত্রা দিয়ে এ উপন্যাসের শুরু।
উদ্দীপকে দেখা যায়, মধ্যরাতেরও পরে একটি ট্রেন ঢাকা থেকে প্রায় এক’শ কিলোমিটার দূরের নদীভাঙন কবলিত এলাকার এক স্টেশনে পৌঁছায়। অতঃপর মুহূর্তে আবাল-বৃদ্ধ বণিতার নানা স্বর ও সুরের বিচিত্র ও ভয়াবহ কলরবে ট্রেনসমেত পুরো স্টেশনটি কাঁপতে থাকে। লোকজন ট্রেনটিতে উঠার জন্য যেন পাগল হয়ে উঠেছে। এলাকা ছেড়ে ঢাকাগামী তাদের এ প্রচেষ্টা যায়নাবের কাছে উন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তির আচরণের মতো মনে হয়েছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসও অন্য অঞ্চল থেকে গভীর রাতে নোয়াখালি অঞ্চলে ট্রেনে পেঁৗঁছালে লোকজনের বর্হিমুখী উন্মত্ততা আগুনের হুলকার মতো ট্রেনটির দেহ যেন পুড়িয়ে দেয়। রেলগাড়ির খুপরিগুলো থেকে আচমকা জেগে উঠা যাত্রীরা কেউ বা ভয় পেয়ে, কেউ বা অপরিসীম কৌতূহলে মুখ বাড়ায়, দেখে আবছা অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে থাকা লোকদের। যাত্রীদের ভিতর প্রশ্ন জাগে এভাবে কোথায় যাবে তারা? কীসের এত উন্মত্ততা? কীসের এত অধীরতা?
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালি অঞ্চলের জনবহুলতা শস্যহীনতা, দারিদ্র্য, অভাব ও ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের জীবনযাত্রা দিয়ে শুরু।
বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক, আধুনিক ও নাগরিক রুচির অধিকারী, মননশীল লেখক সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্। ‘লালসালু’ তাঁর প্রথম উপন্যাস এবং একটি দুঃসাহসী প্রয়াস। জীবন বাস্তবতা যেমন তেমনি সামাজিক বাস্তবতাও এর ভিত্তি শস্যহীন জনবহুল গ্রামীণ জনজীবনকে এবং তার মানসিক চিন্তা-ভাবনা, সুখ-দুখ ও বিশ্বাস, সংস্কারগুলোকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে লেখক সামাজিক সমস্যাকে যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি এসব সমস্যার কারণও উলেখ করেছেন।
উদ্দীপকে মধ্যরাতেরও পরে ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরের নদীভাঙন কবলিত এলাকার এক স্টেশনে গভীর রাতে একটি ট্রেন পৌঁছায়, সে ট্রেনে চড়ে জনতার এলাকা ত্যাগ করার উন্মত্ততা দর্শক হিসেবে যায়নাবের ভিতির বিরাট এক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উদ্দীপকের অনুরূপ চিত্র দেখা যায় ‘লালসালু’ উপন্যাসের শুরুতে। সেখানে বৃহত্তর নোয়াখালি অঞ্চলের কোনো এক রেল স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পরে দেশত্যাগী জনতার উন্মত্ততা যাত্রীদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। উপন্যাসের ভাষায়: কোথায় যাবে তারা? কীসের এত উন্মত্ততা, কীসের এত অধীরতা।
উদ্দীপকের যায়নাবের এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের যাত্রীদের একইধর্মী প্রশ্নের জবাব সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসের শুরুতেই দিয়েছেন। লেখকের ভাষায় “শস্যহীন জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত যেন সদাসন্ত্রস্ত করে রাখে। কিংবা ‘এরা ছোটে, ছোটে আর চীৎকার করে। গাড়ির এ-মাথা থেকে ও-মাথা। এতগুলো খুপরির মধ্যে কোনটাতে চড়লে কপাল ফাটবে তাই যেন খুঁজে দেখে।” অর্থাৎ জীবনের প্রয়োজনে, উন্নততর জীবনের সন্ধানে তাদের এ উন্মত্ততা।
প্রশ্ন\ ২৮\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজার অবস্থিত। সারা দিনরাত হাজারো লোক মাজারে আসে যায়। প্রধান সড়কের ওপর অবস্থিত এ মাজারের খাদেম সফদার মিয়া পরিষ্কার ধবধবে সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবী আর সাদা কিস্তি টুপি মাথায় পরে এবং মেহেদি রঞ্জিত দাড়ির সাথে মিল করে গেরুয়া রঙের একটি পাগড়ি বা রুমাল গলায় পেঁচিয়ে অষ্টপ্রহর দানের টাকার দেখভাল করছে। গোলাপ শাহ কে? কী তাঁর জবীনবৃত্তান্ত? এসব বিষয় জিজ্ঞেস করলে সে কোনো জবাব দেয় না। জবাব দেয় না কয়েক গজ দূরের মসজিদ থেকে নামাজের জন্যে আজান ভেসে এলেও নামাজ পড়তে না যাওয়ার ব্যাপারেও।
ক. কী শুনে মৌলবীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে?
খ. মহব্বতনগরের লোকদের মজিদের ‘জাহেল, বেএলেম, আনপাড়াহ’ বলার কারণ কী?
গ. উদ্দীপকের সফদার মিয়া ‘লালসালু’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়? নির্ণয় কর।
ঘ. উদ্দীপকের সফদার মিয়া ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের চরিত্রের সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে না।” মন্তব্যটি ‘লালসালু’ উপন্যাসের আলোকে বিশ্লেষণ কর। ১
২
৩
৪
২৮ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
শিকারির নাম শুনে মৌলবীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
ছ অনুধাবন
মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের নাটকীয়ভাবে আগমন ঘটে। তার নাটকীয় আগমনকে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রামবাসীকে তার পদানত করতে মজিদ আলোচ্য মন্তব্য করে।
মজিদ বলে যে, স্বপ্নে একজন মোদাচ্ছেদ পীরের আদেশ পেয়েই সে এ গ্রামে এসেছে। উক্ত পীরের মাজারটি দীর্ঘদিন যাবৎ গ্রামবাসীর অযতœ ও অবহেলার শিকার। এ কাল্পনিক গল্পটি বর্ণনা করতে গিয়েই মজিদ ধমকের সুরে অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে মহব্বতনগরের লোকদের ‘জাহেল, বেএলেম, আনপাড়াহ’ বলে তিরস্কার করে।
জ প্রয়োগ
উদ্দীপকের সফদার মিয়া ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যসের কাহিনি নির্মাণে ঘটনা বিন্যাসের ভূমিকা যতোখানি না তার চাইতে চরিত্র বিশ্লেষণের ভূমিকা অনেক বেশি। ‘লালসালু’ এদিক দিয়ে চরিত্রনির্ভর উপন্যাস। আর একটিই এ উপন্যাসের চরিত্র যাকে লেখক বরাবর অনুসরণ করেছেন। দেখা যায়, যতো কিছু ঘটে এবং তাতে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সমস্ত কিছুর পশ্চাতে প্রত্যক্ষে হোক, পরোক্ষে হোক মজিদের নিয়ন্ত্রণ।
উদ্দীপকে দেখা যায়, ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজার অবস্থিত। এ মাজারের খাদেম সফদার মিয়া বেশভূষায় জবরদস্ত আলেমের সুরত ধরে অষ্টপ্রহর দানের টাকার দেখভাল করছে। অথচ গোলাপ শাহ কে? কী তার জীবনবৃত্তান্ত এসব বিষয় জিজ্ঞেস করলে সে কোনো জবাব দেয় না। একটা অজ্ঞেয়, দুর্ঞ্জেয় রহস্যের বেড়াজালে সে মাজারকে, নিজেকে আড়াল করতে সচেষ্ট। উদ্দীপকের অনুরূপ ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদও নাটকীয়ভাবে মহব্বতনগর গ্রামে প্রবেশ করে কাল্পনিক মোদাচ্ছের পীরের গল্প ফেঁদে অজ্ঞ, কুসংস্কাচ্ছন্ন ও ধর্মভীরু জনতাকে তার হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। কিন্তু এর পরে পুরো উপন্যাসে কোথাও সে মোদাচ্ছের পীর কে? কী তার পরিচয়? বা তার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে কোনো কথা বলে না। বরং মাছের পিঠের মতো লালসালু কাপড়ে আবৃত নশ্বর জীবনের প্রতীকটির পাশে মহব্বতনগরের গ্রামবাসীর জীবন পদে পদে এগিয়ে চললো।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
উদ্দীপকের সফদার মিয়া ‘লালসালু’ উপন্যাসের নায়ক মজিদ চরিত্রের সামগ্রিক দিক নয়, বরং এক বিশেষ দিককে ধারণ করে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট ভাগ্যান্বেষী দুস্থ মানুষ মজিদ। জীবন সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেতে মহব্বতনগর গ্রামে উপস্থিত হয়। গ্রামের একটু বাইরে টাল খাওয়া ভাঙা এক পুরনো কবরকে ‘মোদাচ্ছের পীরের মাজার’ ঘোষণা করে সে তার সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। তারপর মহব্বতনগর গ্রামবাসীর জীবনের ঘটনা দ্রুত এগিয়ে চলে সালু কাপড়ে ঢাকা মাছের পিঠের মতো কবরকে কেন্দ্র করে।
উদ্দীপকে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজারের খাদেম সফদার মিয়ার কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে। বেশভূষায় জবরদস্ত আলেমের সুরত ধরে অষ্টপ্রহর দানের টাকার দেখভাল করা সফদার মিয়া গোলাপ শাহ কে? কী তার জীবনবৃত্তান্ত? এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না। একটা অজ্ঞেয়, দুর্ঞ্জেয় রহস্যের বেড়াজালে সে মাজারকে, নিজেকে আড়াল করে রাখে। এমনি আড়াল করে রাখার প্রবণতা আমরা ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রেও দেখতে পাই। উদ্দীপকের সফদার মিয়া মজিদ চরিত্রের এটুকুমাত্র ধারণ করে। বাস্তবিক ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্র ব্যাপক, গভীর ও তাৎপর্যময়।
‘লালসালু’ একটি চরিত্রনির্ভর উপন্যাস। আর একটিই এ উপন্যাসের চরিত্র যাকে লেখক বরাবর অনুসরণ করেছেন। দেখা যায়, যতো কিছু ঘটে এবং তাতে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সমস্ত কিছুর পশ্চাতে প্রত্যক্ষে হোক, পরোক্ষ হোক মজিদের নিয়ন্ত্রণ। মানুষের ধর্মকর্মের ক্ষেত্রেই শুধু নয় তার সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রেও মজিদের প্রবল উপস্থিতি। প্রদত্ত উদ্দীপকের সফদার মিয়ার চরিত্রে এসব কিছু অনুপস্থিত। তাছাড়া আজান-নামাজের ব্যাপারে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ সফদার মিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র।
প্রশ্ন\ ৩০ \ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
মাজারটি প্রধান সড়কের ওপরে অবস্থিত। নির্মাণকাজের জন্যে চারপাশের বেড়া দেওয়ায় রাস্তার চলাচলকারী যানবাহগুলো প্রায় সময়ই মাজারের বেড়া ঘেঁষে যায়। সেদিন এমনি একটি যাত্রীবাহী বাস মাজারের বেড়া ঘেঁষে যেতেই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে থেমে পড়ে। সাথে সাথে মাজারের খাদেম গহের আলী রোষকষায়িত চোখে বাসের ড্রাইভারকে ধমকে উঠে বলে, “পাগলা পীরের মাজারের সাথে বেয়াদবি। আরও বড় আরও ভয়াবহ বিপদে পড়বি। বিপদ থেকে বাঁচতে চাইলে বাবার দরবারে যার যা আছে ফেলে যা।” মুহূর্তে বাসের জানালা গলে কালবৈশাখীর ঝড়ে পড়া আমের মতো অজস্র ধারায় ঝকঝকে পয়সা, ঘষা পয়সা, সিকি, আদুলি, সাচ্চা টাকা, নকল টাকা মাঝার প্রাঙ্গণে ঝরে পড়তে লাগলো।
ক. গারো পাহাড় মধুপুর গড় থেকে কত দিনের পথ?
খ. মহব্বতনগর গ্রামবাসীর কাছে মজিদের গারো পাহাড়ে বসবাসের বর্ণনা লিপিবদ্ধ কর।
গ. মজিদ চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য উদ্দীপকের গহের আলীর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে? চিহ্নিত কর।
ঘ. “উদ্দীপকে বর্ণিত সমাজ-মানস ‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ মানসেরই প্রতিচ্ছবি।”- যথার্থতা মূল্যায়ন কর। ১
২
৩
৪
৩০ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
গারো পাহাড় মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ।
ছ অনুধাবন
‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ মহব্বতনগর গ্রামে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে গারো পাহাড়ে তার বসবাস সম্পর্কে এক চমৎকার গল্প ফেঁদে বসে।
মজিদ মহব্বতনগর গ্রামবাসীকে জানায়, সে মুধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ গারো পাহাড়ে সুখে শান্তিতেই ছিল। গোলাভরা ধান, গরু-ছাগল। ওই অঞ্চলের লোকদের মন নরম। তারা আলাহ-রসুলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের খাতির-যতœ ও স্নেহ-মমতার মধ্যে মজিদের দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু একদিন স্বপ্নে এ গ্রামের মোদাচ্ছের পীরের আহŸানে সাড়া দিতেই সে সব ফেলে ছুটে এসেছে।
জ প্রয়োগ
মজিদ চরিত্রের উপস্থিত ঘটনাকে কাল্পনিক গল্প, রোমাঞ্চকর বর্ণনা, আর নাটকীয় উপস্থাপনার মাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার বৈশিষ্ট্য উদ্দীপকের গহের আলীর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের শুরুটাই নাটকীয়। সেই সাথে মজিদের মহব্বতনগর গ্রামে প্রবেশটাও হয়েছে বেশ নাটকীয়। মজিদ সুচতুর এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। গ্রামের লোকেরা নাটকেরই পক্ষপাতি তা মজিদ উপলব্ধি করেছিল। এ জন্যেই মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের প্রবেশ ও মোদাচ্ছের পীরের মাজার আবিস্কার হয়েছিল নাটকীয় ও চমকপ্রদ।
উদ্দীপকে দেখি, নির্মাণকাজের জন্যে প্রধান সড়কের ওপরে অবস্থিত মাজারের চারপাশে বেড়া দেওয়ায় প্রায় সময়ই মাজারের বেড়া ঘেঁষে যানবাহনগুলো চলাচল করে। একদিন এমনি এক যানবাহন যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে থেমে পড়ার সাথে সাথে মাজারের খাদেম গহের আলী মাজারের অলৌকিক ক্রিয়াকান্ডের রোমাঞ্চকর বর্ণনা দিয়ে যার যা আছে সব হাতিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদও গ্রামের একটু বাইরে টালখাওয়া ভাঙা এক পুরনো কবরকে ‘মোদাচ্ছেদ পীরের মাজার’ ঘোষণা করে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ গ্রামবাসীর অযতœ ও অবহেলার শিকার কথিত পীরকে জড়িয়ে কাল্পনিক এক গল্প ফেঁদে নাটকীয় ভঙ্গিতে গ্রামবাসীকে জাহেল, বেএলেম, আনপাড়াহ বলে তিরস্কার করে। আর এমনিভাবে সে তার সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“উদ্দীপকে বর্ণিত সমাজ মানস ‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ মানসেরই প্রতিচ্ছবি” শীর্ষক মন্তব্যটি যথার্থ।
‘লালসালু’ উপন্যাসে প্রত্যক্ষ বাস্তবতাই প্রধান। লেখক আমাদের এমন এক গ্রামীণ সমাজে নিয়ে যান যেখানে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনের চারদিকে ঘিরে আসে অসম্ভব শক্ত অথচ অদৃশ্য একটি বেষ্টনী মানুষ যেখানে সবকিছুই ভাগ্য বলে মেনে নেয়। অলৌকিকত্বে যেখানে তার অগাধ বিশ্বাস। সমস্ত ঘটনার মধ্যেই দৈবশক্তির লীলা দেখতে পায় সে, আর তাতে ভয় পায় এবং শ্র্রদ্ধাভক্তিতে কখনো কখনো আপ্লুত হয়ে পড়ে।
উদ্দীপকের খাদেম গহের আলী মাজারের বেড়া ঘেঁষে যাওয়া একটি যানবাহনের যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে থেমে যাওয়া ঘটনার ভিতরে মাজারের অলৌকিকত্ব আরোপ করে, বিপদের নানা ভীতি সঞ্চার করে যার যা আছে বাবার দরবারে ফেলে যাওয়ার কথা বলা মাত্র কালবৈশাখীর ঝড়ে পড়া আমের মতো মাজার প্রাঙ্গণে টাকা পয়সার স্তূপ জমে যায়। ‘লালবালু’ উপন্যাসেরও গ্রামের একটু বাইরে টাল খাওয়া ভাঙা পুরনো এক কবরকে ‘মাদাচ্ছের পীরের মাজার’ ঘোষণা করে সে কথিত পীরকে জড়িয়ে মজিদের কাল্পনিক গল্প, রোমাঞ্চকর বর্ণনা আর নাটকীয় উপস্থাপনে মোহিত, মুগ্ধ, ভীত, ভক্তরসে আপ্লুত হয়ে মহব্বতনগরের গ্রামবাসীসহ এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে লোকেরা লাল সালুতে ঢাকা মাছের পিঠের মতো মাজারে দানের টাকার স্তূপ জমিয়ে দেয়।
‘লালসালু’ উপন্যাসে বলা হয়েছে, গ্রামের লোকেরা নাটকেরই পক্ষপাতি। সরাসরি মতিগঞ্জের সড়ক দিয়ে যে গ্রামে এসে ঢুকবে তার চেয়ে বেশি পছন্দ হবে তাকে, যে বিলটার বড় অশ্বত্থগাছ থেকে নেমে আসবে। লেখকের এ কথার বাস্তব প্রমাণ আমরা প্রদত্ত উদ্দীপকে লক্ষ করি। উদ্দীপক ও ‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ মানস বিচার করে এ সিন্ধান্তে সহজেই আসা যায় যে, উদ্দীপকে বর্ণিত সমাজ মানস ‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ মানসেরই প্রতিচ্ছবি।
প্রশ্ন\ ৩১\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী আবহমান কাল থেকে জল হাওয়ার, সবুজের ছায়ায় মানুষ। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর প্রভাবে এখানকার জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বড় সহজ-সরল আর শান্ত কুসংস্কারে আবদ্ধ ও আপাত ভীতু জনগোষ্ঠীর জমিকে যখন ১৯৭১ সালে মরুর হানাদারেরা জ্বালাতে পোড়াতে এলো, মুহূর্তে এরা বজ্রকঠিন হয়ে উঠল। শত নদীর স্রোতধারায় সিক্ত বাংলার জমিকে বুকের রক্ত দিয়ে সিক্ত করে রক্ষা করতে দ্বিধা করেনি এ জাতি।
ক. মাঠে গিয়ে মানুষ কী হয়ে উঠে?
খ. জমির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক ও ভালোবাসার কারণ ব্যাখ্যা কর।
গ. জমির প্রতি বাংলার চিরকালীন যে রূপটি উদ্দীপকে এসেছে তা কীভাবে ‘লালসালু’ উপন্যাসে উঠে এসেছে?- আলোচনা কর।
ঘ. দেখাও যে, উদ্দীপকের জনগোষ্ঠী ও ‘লালসালু’ উপন্যাসের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী চরিত্রগত দিক থেকে একই আদর্শের অনুসারী। ১
২
৩
৪
৩১ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
মাঠে গিয়ে মানুষ মেঠো হয়ে উঠে।
ছ অনুধাবন
মাটিই যাদের প্রাণ, মাটিই যাদের ধ্যান, মাটিতেই যারা আশ্রিত সেই বাংলার জমি আর কৃষককুল যেন এক সুতায় গাঁথা।
বাংলার কৃষক জমিকে আপন সত্তা জ্ঞান করে। এই জমির জন্যে জীবন দিতেও তারা কুন্ঠাবোধ করে না। এদেশের জমির প্রতি মানুষের এরকম নিবিড় সম্পর্ক ও ভালোবাসার মূলে রয়েছে এদেশের জমির উর্বরতা। এদেশের মাটিতে সোনা ফলে, পরিশ্রমের অধিক মর্যাদা পাওয়া যায়।
জ প্রয়োগ
বাংলার চিরকালীন যে রুপটি উদ্দীপকে এসেছে তা জমির প্রতি আন্তরিক নিবিড় ভালোবাসা এবং তার জন্য বুকের রক্ত ঝরানোর মধ্যে দিয়ে ‘লালসালু’ উপন্যাসে উঠে এসেছে।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা বিধৌত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলাদেশ চির শান্তির নিকেতন। নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে সামান্য পরিশ্রমেই সোনার ফসল ফলে। আর্দ্র জলবায়ু ও সহজে উৎপাদিত ফসলের কারণে এখানকার লোকজন স্বভাবতই কোমল প্রকৃতির। বৈদেশিক সম্পদ লুন্ঠনকারী ও হানাদার শক্তি এ জাতির এ বৈশিষ্ট্যকে ভীরুতা মনে করে যখনই এদেশে হামলা করেছে, সাথে সাথে তারা শক্ত প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে।
উদ্দীপকে নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুগত কারণে গড়ে ওঠে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানকার জনগোষ্ঠী বড় সহজ-সরল আর শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু এদের কোমল প্রকৃতিকে ভীরুতা জ্ঞান করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মরু হানাদারেরা এদেশের জমিকে যেই জ্বালাতে পোড়াতে এলো, অমনি তারা বজ্রকঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হলো। বুকের রক্ত জমিতে ঢেলে দিতে এদেশের মানুষ দ্বিধা করেনি। উদ্দীপকের জনগোষ্ঠীর এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ‘ লালসালু’ উপন্যাসে মহব্বতনগরের লোকদের জমির প্রতি একান্ত ভালোবাসা এবং তা রক্ষায় নিজের রক্ত দেওয়া ও অপরের রক্ত করাতে দ্বিধা করে না। ........ খাবলা খাবলা রুঠাজমি, ডোবাজমি, কাদাজমিফাটল-ধরা জ্যৈষ্ঠের জমিসব জমি একান্ত আপন।”
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ু কারণে উদ্দীপকের জনগোষ্ঠী এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী উভয়ে কোমল প্রকৃতির, অজ্ঞেয়, অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাসী এবং জমির জন্যে মুহূর্তে বজ্রকঠোর প্রকৃতির অধিকারী হয়ে উঠে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার গাঙ্গেয় উপত্যাকায় গড়ে ওঠা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপের বাসিন্দাবাঙালি জনগোষ্ঠী সহজ-সরল-কোমল প্রকৃতির অধিকারী। সহজেই এদেশের জমিতে সোনার ফসল ফলে বলে একদিকে তারা শ্রমবিমুখ অপরদিকে অজ্ঞেয়, অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাসী, ভক্ত, কুসংস্কারে নিমজ্জিত। এদের চারিত্রিক আদর্শের শ্রেষ্ঠতর দিকটি ফুটে ওঠে জমির প্রতি নিবিড় ভালোবাসা এবং তা রক্ষায় জীবন দেওয়া ও নেওয়ার মধ্যে।
উদ্দীপকে নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর চরিত্রগত আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানকার জনগোষ্ঠীর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যও বড় সহজ-সরল আর শান্ত প্রকৃতির। অজ্ঞেয়, দুর্ঞ্জেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, ভয় ও কুসংস্কারে আবদ্ধ এখানকার বেশিরভাগ মানুষ। এরপরে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ জনগোষ্ঠীর ‘জমি জান, রক্ত দিয়ে রাখব তার মান’ রূপী এক গৌরবজনক চারিত্রিক আদর্শ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উদ্দীপকের এ জনগোষ্ঠীর শিল্পপতী রূপ যেন ‘লালসালু’ উপন্যাসের মহব্বতনগরের গ্রামবাসী।
‘লালসালু’ উপন্যাসে মহব্বতনগরের গ্রামবাসীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ তুলে ধরতে বলা হয়েছে, গ্রামের লোকেরা যেন রহিমারই অন্য সংস্করণ। তাগড়া তাগড়া দেহ চেনে জমি আর ধান, চেনে পেট। খোদার কথা নেই। স্মরণ করিয়ে দিলে আছে, নচেৎ ডুব মেরে থাকে। জমির জন্যে প্রাণ। সে জমিতে বর্ষণহীন খরার দিনে ফাটল ধরলে তখন কেবল স্মরণ হয় খোদাকে। অর্থাৎ উদ্দীপকের জনগোষ্ঠী ও ‘লালসালু’ উপন্যাসের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী চারিত্রগত বৈশিষ্ট্য বিচারে এ কথা সহজেই উচ্চারণ করা যায়, উভয় জনগোষ্ঠী চরিত্রগত দিক থেকে একই আদর্শের অধিকারী।
প্রশ্ন\ ৩২\ উদ্দীপকটি পড় এবং নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
হঠাৎ রমিজ চমকাইয়া গেল। একটা বিরাট মেটে ইঁদুর কবর হইতে সুড়ঙ্গ পথে বাহির হইয়া পাশের ঝোপে আত্মগোপন করিল। রমিজের মনে হইল: “সব উপহাস। কোথায় বৌ। বৌত এ কবরে নাই। এখানে তাহার অস্থি পিঞ্জরের মধ্যে বাসা বাঁধিয়াছে ঐ মেটে ইঁদুরটি। বৌ কোথায় কে বলিবে?”
ক. ধুলো-ওড়ানো মাঠের দিকে তাকিয়ে মজিদের কী স্মরণ হয়?
খ. মজিদের নীরবতা পাথরের মতো ভারি কেন?
গ. উদ্দীপকের রমিজের চিন্তার সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের চিন্তার মিল কোথায়? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “চিন্তার মিল থাকলেও উদ্দীপকের রমিজ আর ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের অধিকারী।” ১
২
৩
৪
৩২ নং প্রশ্নের উত্তর
চ জ্ঞানমূলক
ধুলো ওড়ানো মাঠের দিকে তাকিয়ে মজিদের জীবনের অতিক্রান্ত দিনগুলোর কথা স্মরণ হয়।
ছ অনুধাবন
মজিদের নীরবতা পাথরের মতো ভারি, কারণ তার মধ্যে বঞ্চনা রয়েছে, সন্তান না পাওয়ার হাহাকার আছে।
মহব্বতনগর গ্রামে মজিদ যখন প্রভুর আসনে তখন সন্তানহীনতা তাকে পীড়া দেয়। সে সন্তানাদি চায়। কিন্তু রহিমা বাঁজা মহিলা। তার সন্তান হবে না। সে রাতে এ নিয়ে কথাবার্তা বলার পর যখন দুজনে চুপ হয়ে যায় তখন রহিমা ভাবতে বসে। মজিদ আর কথা বলে না, নীরব হয়ে থাকে। কিন্তু মজিদের নীরবতা রহিমার কাছে পাথরের মতো ভারি মনে হয়।
জ প্রয়োগ
একাকিত্বের, নিঃসঙ্গতার হাহাকারে নিজের আশ্রয়স্থলের অস্তিত্ব সম্পর্কে চরম জিজ্ঞাসা উদিত হওয়ার দিক থেকে উদ্দীপকের রমিজের চিন্তার সাথে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের মিল রয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠে। প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায়, প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে। এজন্য সে এমন কোনো হেন কাজ নেই যা করে না। অথচ মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত তার কথিত পীরের মাজার যা তার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি, সময়ে সময়ে তাও তাকে ভয়ানক নিঃসঙ্গতায়, অনিশ্চয়তায় ভোগায়।
উদ্দীপকের স্ত্রীর কবর থেকে বিরাট এক মেটে ইঁদুর বের হয়ে এলে রমিজ চমকে যায়। স্ত্রীর কবরকে সে তার সঙ্গী, সান্তনার আশ্রয় জ্ঞান করে এসেছিল এতদিন। অথচ আজ সব উপহাস মনে হয়। তার ভিতর প্রশ্ন জাগে বৌ কোথায়? উদ্দীপকের অনুরূপ জিজ্ঞাসা, অনিশ্চয়তা ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের ভিতরেও উত্থিত হতে দেখা যায়। মিথ্যার ওপর ক্ষমতার ভিত গড়া নিঃসঙ্গ মজিদ একদিন সত্যি চমকে উঠে। তার মনে প্রশ্ন জাগে কার কবর এটা? যদিও মজিদের সমৃদ্ধির, যশমান ও আর্থিক সচ্ছলতার মূল কারণ এই কবরই; কিন্তু সে জানে না কে চিরঘুমে শায়িত এর তলে। অর্থাৎ একাকিত্বের অসহনীয় মুহূর্তে নিজের আশ্রয়স্থলের অস্তিত্ব সম্পর্কে উদ্দীপকের রমিজের মতো ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদও সমধর্মী চিন্তা করতে থাকে।
ঝ উচ্চতর দক্ষতামূলক
“চিন্তার মিল থাকলেও উদ্দীপকের রমিজ আর ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের অধিকারী।” প্রশ্নোক্ত এ মন্তব্যটি সঙ্গত কারণেই যথার্থ বলে আমি মনে করি।
মজিদ ধর্মব্যবসায়ী। সে জীবনের ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা পেতে বসেছে। তার ব্যবসায়ের প্রধান বেসাতি কথিত মোদাচ্ছের পীরর মাজার। এই মাজার মজিদের মান-সম্মত ও অর্থবিত্তের মূল। কিন্তু মাজারের ভিতরে শায়িত ব্যক্তিকে মজিদ চিনে না। একাকীত্বের মুহূর্তে এই মাজারই তার ভিতরে শূন্যতার হাহাকার তোলে, অনিশ্চয়তার ভীতি তোলে।
উদ্দীপকে নিঃসঙ্গ জীবনে সান্ত্বনার আশ্রয়স্থল স্ত্রীর কবর থেকে একটা বিরাট মেটে ইঁদুরের বেরিয়ে আসা রমিজকে চমকে দেয়, নতুন এক বোধে পৌঁছে দেয়। তার কাছে মনে হয় সবকিছু উপহাস। কবরে তার বৌ নাই। বৌ-এর অস্থি পিঞ্জরের মধ্যে বাসা বেঁধেছে মেটে ইঁদুর। তার আত্মজিজ্ঞাসা বৌ কোথায়? উদ্দীপকের অনুরূপ ঘটনা আমরা ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের একাকীত্ব মুহূর্তেও দেখতে পাই। সেখানেও মজিদের আত্মজিজ্ঞসা কার কবর এটা? উভয়ের চিন্তার মধ্যে ধরন ও ভঙ্গির সাদৃশ্য থাকলেও জিজ্ঞাসায় পিছনের কারণ ও আদর্শের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
উদ্দীপকের রমিজের চিন্তায়, জিজ্ঞাসায় রয়েছে আত্মোপলব্ধি এবং বাস্তবতাকে নতুন বোধে, নতুন চেতনায় যাচাইয়ের ব্যাপার। পক্ষান্তরে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের চিন্তায়, জিজ্ঞাসায় রয়েছে মিথ্যার ওপর গড়ে তোলে সমৃদ্ধির, প্রাধান্যের সৌধের অসহনীয় ভার। একাকীত্বের নিঃসঙ্গতায় বাতাসে সালু কাপড় উল্টে গিয়ে মাজারের অনাবৃত অ
Quality Can Do Soft - এর মোবাইল এপস পেতে নিচের লিংকে ক্লিক করুণ