ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সালাতের গুরুত্ব

প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর উপর দৈনিক পাঁচ বার নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কয়েক রাক‘আত (মোট ১৭ রাক‘আত) সালাত আদায় করা ফরয। ঈমানের পরে মুসলিমের সবচেয়ে বড় করণীয় নিয়মিত সালাত আদায় করা। কুরআনে প্রায় শত স্থানে এবং অসংখ্য হাদীসে সালাতের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। কুরআনের আলোকে সালাতই সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন: “মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগিতার সাথে সালাত আদায় করেন।”[২] অন্যত্র তিনি বলেন: “সেই ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করে, যে নিজেকে পবিত্র করে এবং নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করে।”[৩] আল্লাহ তা‘আলা বলেন- সালাত পরিত্যাগের পরিণতি জাহান্নামের মহাশাস্তি। আল্লাহ বলেন: “তাদের পরে আসল অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা সালাত নষ্ট করল এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। কাজেই তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি পাবে।”[৪] জাহান্নামীদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন: “(তাদের প্রশ্ন করা হবে) তোমাদেরকে জাহান্নামে ঢুকালো কিসে? তারা বলবে: আমরা সালাত আদায় করতাম না...।”[৫] যে মুমিন সালাত আদায় করেন; কিন্তু সালাত আদায়ে অনিয়মিত-অমনোযোগী তার পরিণতি বিষয়ে আল্লাহ বলেন: “মহাশাস্তি-মহাদুর্ভোগ সে সকল সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন।”[৬]
[২]. সূরা (২৩) আল-মু’মিনূন: ১।
[৩] . সূরা (৮৭) আল-আ‘লা: ১৪-১৫।
[৪]. সূরা (১৯) মারইয়াম: ৫৯ আয়াত।
[৫] . সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ৪২-৪৩।
[৬]. সূরা (১০৭) মাঊন: ৪-৫ আয়াত।
১৪ সালাত, দু‘আ ও যিক্র
সালাত বা নামায মুমিন ও কাফিরের মধ্যে মাপকাঠি।
সালাত ত্যাগ করলে মানুষ কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ  বলেছেন- “একজন মানুষ ও কুফরী-শিরকের
মধ্যে রয়েছে সালাত ত্যাগ করা।”[৭] তিনি আরো বলেন: “যে
ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল সে কুফরী করল।”[৮]
কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার আলোকে একথা নিশ্চিত যে,
সালাত মুসলিমের মূল পরিচয়। সালাত ছাড়া মুসলিমের অস্তিত্ব
কল্পনাতীত। সালাত পরিত্যাগকারী কখনোই মুসলিম বলে গণ্য
হতে পারে না। যে ব্যক্তি মনে করে যে, সালাত না পড়লেও চলে
বা কোনো নামাযীর চেয়ে কোনো বেনামাযী ভাল হতে পারে- সে
ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে কাফির। প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ মুসলিম
উম্মাহর সকল ইমাম ও ফকীহ এ বিষয়ে একমত। পক্ষান্তরে যে
মুসলিম সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সালাত কাযা করা কঠিনতম
পাপ, দিনরাত শুকরের গোশত ভক্ষণ করা, মদপান করা, রক্তপান
করা ইত্যাদি সকল ভয়ঙ্কর গুনাহের চেয়েও ভয়ঙ্করতর পাপ।
ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত সালাত কাযা করা, সে ব্যক্তি যদি ইচ্ছে
করে কোনো সালাত ত্যাগ করে তাহলে তাকে মুসলমান বলে গণ্য
করা হবে কিনা সে বিষয়ে ফকীহগণের মতভেদ আছে। সাহাবীতাবেয়ীগণের যুগে এ প্রকারের মানুষকেও কাফির গণ্য করা হত।
“মুহাম্মাদ  এর সাহাবীগণ সালাত ছাড়া অন্য কোনো
কর্ম ত্যাগ করাকে কুফ্রী মনে করতেন না।” হাদীসটি সহীহ।[৯]
[৭]. মুসলিম (১-কিতাবুল ঈমান, ৩৫-ইতলাক ইসমিল কুফর...) ১/৮৮, নং ৮২ (ভা. ১/৬১)।
[৮]. সহীহ ইবনু হিব্বান ৪/৩২৩, নং ১৪৬৩। হাদীসটি সহীহ।
[৯]. তিরমিযী, ৫/১৪ (ভা. ২/৯০); আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১৩৭।
সালাত, দু‘আ ও যিক্র ১৫
বিশেষত সাহাবীগণের মধ্যে উমার , আব্দুল্লাহ
ইবনু মাস‘ঊদ , তাবিয়ীগণের মধ্যে ইবরাহীম নাখয়ী,
ফকীহগণের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল, ইমাম ইসহাক
ইবনু রাহাওয়াইহি ও অন্যান্য অনেকে এ মত পোষণ করতেন।
তাঁদের মতে মুসলিম কোনো পাপকে পাপ জেনে পাপে লিপ্ত
হলে কাফির বলে গণ্য হবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম সালাত।
যদি কেউ সালাত ত্যাগ করা পাপ জেনেও এক ওয়াক্ত সালাত
ইচ্ছাপূর্বক ত্যাগ করেন তাহলে তিনি কাফির বলে গণ্য হবেন।
পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম মালিক ও
অধিকাংশ ফকীহ বলেন, এ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সরাসরি কাফির বলা
হবে না। তবে তাকে সালাতের আদেশ দিতে হবে এবং সালাত
পরিত্যাগের শাস্তি হিসেবে জেল, বেত্রাঘাত ইত্যাদি শাস্তি প্রদান
করতে হবে। ইমাম শাফিয়ী বলেন: সালাত আদায়ের আদেশ
দিলেও যদি সে তা পালন না করে তবে তাকে শাস্তি হিসেবে
মৃত্যুদÐ প্রদান করতে হবে।[১০]
১. ১. ২. আল্লাহর যিক্রের জন্য সালাত
আমরা এ পুস্তকের ক্ষুদ্র পরিসরে সালাত বা নামাযের মূল
নিয়ম পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব। তবে প্রথমে
কয়েকটি মূল বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে:
প্রথম বিষয়: মহান প্রতিপালক মালিক আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর
কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে হৃদয়কে পবিত্র, পরিশুদ্ধ, আবিলতামুক্ত ও
ভারমুক্ত করার জন্য সালাত বা নামায। সালাতের ফরয, ওয়াজিব,
সুন্নাত ইত্যাদি অনেক বিধান রয়েছে। সবই সাধ্য অনুসারে।
[১০]. বাগাবী, হুসাইন ইবন মাসঊদ, শারহুস সুন্নাহ (বৈরুত, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য়
মুদ্রণ, ১৪০৩/১৯৮৩) ২/১৭৯-১৮০; আবূ বাকর ইসমাঈলী, ই‘তিকাদ আয়িম্মাতিল
হাদীস (শামিলা), পৃ. ১৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আর-রাফউ ওয়াত তাকমীল, পৃ. ৩৭৭;
ড. ওয়াহবাহ যুহাইলী, আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু (শামিলা) ১/৫৭৭-৫৭৯;
আল-মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুআইতিয়্যাহ ২৭/৫৩-৫৪। বিস্তারিত জানতে শাইখ
মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রচিত ‘হুকমু তারিকিস সালাত’ বইটি পড়–ন।
১৬ সালাত, দু‘আ ও যিক্র
এজন্য সাধ্যের বাইরে হলে এগুলো রহিত ও মাফ হয়ে যায়, কিন্তু
সালাত মাফ হয় না।
আল্লাহ বলেন: “যদি তোমরা বিপদের আশংকা কর তবে
হাঁটতে হাঁটতে অথবা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে।”[১১]
“তোমার কাছে যদি কুরআনের কিছু থাকে তবে তা পাঠ
কর; আর তা না হলে তুমি আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার
এবং লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ বল।”[১২]
কুরআন ও হাদীসের এ সকল নির্দেশনার আলোকে সকল
মাযহাব ও মতের ফকীহগণ মূলত একমত যে, ওযরে বা বাধ্য
হলে মুমিন অযু ছাড়া, বসে, শুয়ে, অপবিত্র পোশাকে, উলঙ্গ
অবস্থায়, যে কোন দিকে মুখ করে, হাঁটতে হাঁটতে, দৌঁড়াতে
দৌঁড়াতে, সূরা-কিরাত ছাড়া, শুধু সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার
ইত্যাদি যিক্রের মাধ্যমে সালাত আদায় করবেন। কিন্তু কোন
কারণেই তিনি স্বেচ্ছায় এক ওয়াক্ত সালাত কাযা করতে পারবেন
না। যতক্ষণ হুঁশ আছে বা হৃদয়ে আল্লাহর স্মরণ করার ক্ষমতা
আছে ততক্ষণ তার সালাত রহিত বা মাফ হয় না। তাকে সময়
হলে সাধ্যানুসারে রাসূলুল্লাহ  এর শেখানো পদ্ধতিতে তাঁর
প্রভুর দরবারে হাযিরা দিয়ে তাঁকে স্মরণ করে হৃদয়কে প্রশান্ত
করতেই হবে। নইলে তার হৃদয় ও আত্মা মৃত্যুবরণ করবে।
ফিকহের গ্রন্থগুলির বিভিন্ন স্থানে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে
এবং এ বিষয়ে মৌলিক কোনো মতভেদ নেই।
মানুষকে স্বভাবত সমাজের মধ্যে বাস করতে হয়। সারা
[১১] . সূরা (২) বাকারা: ২৩৯ আয়াত।
[১২]. তিরমিযী (আবওয়াবুস সালাত, বাব ওয়াসফিস সালাত) ২/১০০, নং ৩০২ (ভারতীয়
১/৬৬)।
সালাত, দু‘আ ও যিক্র ১৭
দিনের কর্মময় জীবনে বিভিন্নমুখী আবেগ, ভালবাসা, ঘৃণা, হিংসা,
রাগ, বিরাগ, ভয়, লোভ ইত্যাদির মধ্যে পড়তে হয়। এগুলো
তার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত, অসুস্থ ও কলুষিত করে তোলে। শুধুমাত্র
মাঝে মাঝে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে নিজের
আবেগ, বেদনা ও আকুতি পেশ করার মাধ্যমেই মানুষ এ ভয়ানক
ভার থেকে নিজের হৃদয়কে মুক্ত করতে পারে।
দ্বিতীয় বিষয়: এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মহান
আল্লাহর যিক্র বা স্মরণই হলো সালাতের মূল বিষয়। যিক্র বা
স্মরণ হৃদয় দিয়ে করতে হয় এবং মুখ তাকে পূর্ণতা দেয়। এজন্য
নামাযের মধ্যে মনোযোগ দিয়ে আল্লাহর স্মরণ করা ও নামাযের
মধ্যে যা কিছু পাঠ করা হয় তার অর্থের দিকে লক্ষ রাখা ও অর্থের
সাথে হৃদয়কে আলোড়িত করা অতীব প্রয়োজন। মহান আল্লাহ
বলেছেন: “এবং আমার যিক্র বা স্মরণের জন্য সালাত কায়েম
কর।”[১৩] হৃদয়হীন স্মরণহীন সালাত মুনাফিকের সালাত। মহান
আল্লাহ মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেন: “আর যখন তারা সালাতের
জন্য দÐায়মান হয় তখন অলসতাভরে দাঁড়ায়, তারা মানুষকে
দেখায় এবং খুব কমই আল্লাহর যিক্র (স্মরণ) করে।”[১৪]
তৃতীয় বিষয়: নামাযের অন্যান্য নিয়মাবলি পালনের ক্ষেত্রে
ওযর বা অসুবিধা থাকলেও যিক্র বা স্মরণের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা
কখনোই থাকে না। আমরা যে অবস্থায় থাকি না কেন, যেভাবেই
সালাত আদায় করি না কেন, যে যিক্র বা কিরাআতই পাঠ করি
না কেন, নামাযের মধ্যে পঠিত দু‘আ, যিক্র বা কিরাআতের
অর্থের দিকে মন দিয়ে মনকে আল্লাহর দিকে রুজু করে অন্তরের
আবেগ দিয়ে সালাত আদায়ের চেষ্টা করতে পারি। মনোযোগ
নষ্ট হলে আবারো মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে পারি।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা নামাযের অন্যান্য প্রয়োজনীয়,
[১৩]. সূরা (২০) ত্বাহা: ১৫।
[১৪]. সূরা (৪) নিসা: ১৪২।
১৮ সালাত, দু‘আ ও যিক্র
সূচীপত্র
ওয়েবসাইট ভিজিট করতে ক্লিক করুন- এখানে
অল্পপ্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে অতি সচেতন হলেও
মনোযোগ, আবেগ ও ভক্তির বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখাই না।
সাহাবীগণ নামাযে মনোযোগের জন্য খুবই সচেষ্ট থাকতেন।
এক সাহাবী তাঁকে বলেন, শয়তান আমার ও আমার নামাযের
(মনোযোগ আনয়নের) মধ্যে বাধ সাধে এবং আমার কিরাআত
এলোমেলো করে দেয়। তখন রাসূলুল্লাহ  বলেন: “ঐ শয়তানের
নাম: খিনযিব। যখন এরূপ অনুভব করবে তখন: (আ‘ঊযু বিল্লাহি
মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম, অর্থাৎ: আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয়
গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়তান থেকে) পাঠ করে তোমার বাম দিকে
থুথু ফেলবে। তিনবার করবে।” এতে মনোযোগ ফিরে আসে।
চতুর্থ বিষয়: আরো দুঃখজনক বিষয়, অনেক ধার্মিক
মুসলিম দ্রæত সালাত আদায়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। ধীর ও
শান্তভাবে পরিপূর্ণ আবেগ ও মনোযোগ সহকারে সালাত আদায়
করাই কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা। মাত্র কয়েক রাক‘আত সালাত
এভাবে মাসনূন পদ্ধতিতে আদায় করলে হয়ত ১০ মিনিট সময়
লাগবে। আর তাড়াহুড়ো করে আদায় করলে হয়ত ৩/৪ মিনিট
কম লাগবে। আমরা সারাদিন গল্প করতে পারি। মসজিদ থেকে
বেরিয়ে গল্প করে সময় নষ্ট করতে পারি, কিন্তু নামাযের মধ্যে
তাড়াহুড়ো করি ও অস্থির হয়ে পড়ি। এ তাড়াহুড়ো সালাতকে
প্রাণহীন করে দেয়।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]