ইসলামে বিবাহ বিবাহ বন্ধন

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেনঃ হে যুবক দল! তোমাদের মধ্যে যে লোক স্ত্রী গ্রহণে সামর্থবান, তাহার অবশ্যই বিবাহ করা কর্তব্য। কেননা বিবাহ দৃষ্টিকে নীচ ও নিয়ন্ত্রিত করিতে এ লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করিতে অধিক সক্ষম। আর যে লোক তাহাতে সামর্থ্যবান নয়, তাহার উচিত রোযা রাখা। কেননা রোযা তাহার জন্য যৌন উত্তেজনা নিবারণকারী।

 

                                                                                    (বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, মুসনামে আহমদ)

 

ব্যাখ্যাঃ  এই হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) একজন অতীব মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী। হাদীসের যে সময়কার, তখন তিনি যুবক ছিলেন। যে যুব সমাজকে সম্বোধন করিয়া নবী করীম (স) কথাটি বলিয়াছিলেন, তিনি নিজে তখন সেই সমাজের মধ্যেই গণ্য হইতে ছিলেন এবং কথাটি বলার সময় তিনিও তথায় উপস্থিত ছিলেন। এই কারণেই তিনি বলিতে পারিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) ‘আমাদিগকে’ সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন’।

 

হাদীসটিতে নবী করীম (স) যুব সম্প্রদায়কে সম্বোধন করিয়া বিবাহ করার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা বুঝাইতে চাহিয়াছেন। ইহার সার নির্যাস হইল, পৌরুষ সম্পন্ন ও স্ত্রী সঙ্গমে সামর্থ্যবান সকল ব্যক্তিকেই বিবাহ করিতে হইবে, স্ত্রী গ্রহণ করিতে হইবে। বিবাহ করার জন্য যুবকদিগকে তাকিদ দেওয়ার তাৎপর্য সুস্পষ্ট ও সহজেই অনুধাবনীয়।

 

হাদীসে ব্যবহৃত ********* শব্দটির দুইটি অর্থ হইতে পারে। একটি ******- স্ত্রী-সঙ্গম। অর্থাৎ যাহারাই স্ত্রী-সঙ্গমে সক্ষম, বিবাহ করা তাহাদেরই কর্তব্য। ইহার দ্বিতীয় অর্থ ***** বিবাহ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার বহন ও প্রয়োজনীয় উপকরণদি সংগ্রহের সামর্থ্য। এই দৃষ্টিতে হাদীসটির বক্তব্য হইল, যে সব যুবক বিবাহের দায়িত্ব পালনে সমর্থ, স্ত্রী গ্রহণ, প্রতিপালন ও পরিপোষণের দায়িত্ব পালনে সক্ষম, তাহাদেরই বিবাহ করা উচিত। হাদীসের ভাষ্য হইতে স্পষ্ট মনে হয়, স্ত্রী সঙ্গমে অসমর্থ লোকদের জন্য এই হাদীস নহে। এই কাজে যাহারা দৈহিক ভাবে সক্ষম তাহাদের জন্যই এখানে কথা বলা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, তাহরা যদি বিবাহের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা সম্পন্ন হয় এবং বিবাহের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করিতে পারে, তবে তাহাদের বিবাহ করা উচিত। এই লোকদের অবিবাহিত থাকা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় ও সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এই শ্রেণীর যুবকরা যদি বিবাহের দায়িত্ব পালনে আর্থিক দিক দিয়া অসমর্থ হয়, তবে তাহাদিগকে রোযা রাখিতে বলা হইয়াছে। কেননা দৈহিক দিক দিয়া সামর্থ্য ও আর্থিক কারণে অসামর্থ্য মানুষকে ন্যায়-অন্যায় জ্ঞানশূন্য করিয়া ফেলিতে ও অন্যায় অবৈধ পন্হায় যৌন উত্তেজনা প্রশমনে প্রবৃত্ত করিয়া দিতে পারে। কিন্তু যদি কেহ স্ত্রী সঙ্গমেই অসমর্থ্য হয় এবং এই সামর্থ্যহীনতা বা অক্ষমতা হয় দৈহিক দিক দিয়া, তবে তাহার যেমন বিবাহের প্রায়োজন হয় না, তেমনি রোযা রাখিয়া যৌন উত্তেজনা প্রশমনেরও কোন প্রশ্ন তাহার ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে না। এই শ্রেণীর লোক তো রোগী বিশেষ।

 

যৌন উত্তেজনা সম্পন্ন ও স্ত্রী সঙ্গমে সক্ষম যুবকদের পক্ষে বিবাহ করা ও স্ত্রী গ্রহণ যে কত প্রয়োজন এবং বিবাহ তাহাদের জন্য কতদূর কল্যাণকর, তাহা বুঝাইবার জন্য রাসূলে করীম (স) ইহার পরই বলিয়াছেনঃ “উহা দৃষ্টিকে নীচ ও নিয়ন্ত্রিত করিতে ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করিতে অধিক সক্ষম- অধিক কার্যকর”। বস্তুত যৌন উত্তেজনা সম্পন্ন যুবকদের পক্ষে পরস্ত্রী দর্শন একটি মারাত্মক রোগ হইয়া দেখা দেয়। এই রোগ যাহার হয় তাহার কেবল মনই খারাপ হয় না, মগজও বিনষ্ট ও বিভ্রান্ত হইয়া যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন ফুলে ফুলে রূপ সুধা পান ও যৌবন মধু আহরণের মাদকতা তাহাকে নেশাগ্রস্থ করিয়া চরম চারিত্রিক কুলষতার গভীর পংকে নিমজ্জিত করিয়া দিতে পারে। ইহা কিছু মাত্র অস্বাভাবিক নহে। এই কারণেই নবী করীম (স) ইহার পরই বলিয়াছেন, ‘বিবাহ লজ্জাস্থানের পবিত্রতা সংরক্ষণে অধিক সক্ষম- অধিক কার্যকর’। এই কথা কেবল পুরুষ যুবকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, স্ত্রী যুবতীদের অবস্থাও সম্পূর্ণ অভিন্ন। বস্তুত যৌবনকালীন সঙ্গম  ইচ্ছা অত্যন্ত তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য হইয়া দেখা দিয়া থাকে। এই ইচ্ছার যথার্থ চরিতার্থতা ভিন্ন এই কাজ হইতে বিরত থাকা অসম্ভব। পুরুষ ও নারী উভয়ের পারস্পরিক লিঙ্গের সহিত দৈহিক মিলন সাধনেই ইহা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব। এই রূপ অবস্থায় যে (পুরুষ) যুবকের স্ত্রী নাই এবং যে (স্ত্রী) যুবতীর স্বামী নাই, তাহার পক্ষে স্বীয় চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা অসম্ভব না হইলেও অত্যন্ত কষ্টকত ও দুঃসাধ্য ব্যাপার, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এই অবস্থায় সংযমের বাঁধন কিছুটা শিথিল হইলে যুবকদের বেলায় পরস্ত্রী দর্শনের এবং যুবতীদের বেলায় ভিন্ন পুরুষ দর্শনের ঝোক ও প্রবণতা অপ্রতিরোধ হইয়া দাঁড়ায়। পরস্ত্রী বা ভিন্ন পুরুষ দর্শনের এই প্রবণতা একদিকে যেমন যৌন উত্তেজনার মাত্রা অসম্ভব রকম বৃদ্ধি করিয়া দেয়, তেমনি যৌন সঙ্গম অভিলাম মানুষকে ব্যভিচাররে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে পুরুষ ও নারীর লজ্জাস্থানের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। মানুষ নৈতিক চরিত্র হারাইয়া ফেলে। আর নৈতিক চরিত্রহীন মানুষ পশুরও অধম।

 

ঠিক এই কারণেই নবী করীম (স) এই ধরনের যুবক-যুবতীদিগকে বিবাহ করার- বিধিসম্মত পন্হায় যৌন স্পৃহা নিবৃত্তির ব্যবস্থা করার- নির্দেশ দিয়াছেন। বিবাহ করিলে যৌন- উত্তেজনা ও সঙ্গম-স্পৃহার চরিতার্থতা বিবাহের নির্দিষ্ট আওতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং ইহার ফলে যৌন-অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা পাইতে পারে।

 

দৃষ্টি শক্তিকে সংযত করা না হইলে ভিন্ন লিঙ্গের সহিত দৈহিক মিলমন স্পৃহা অদম্য হইয়া উঠে। এই কারণে কুরআন মজীদেও এই ব্যাপারে বলিষ্ঠ নির্দেশ উদ্ধৃত হইয়াছে। পুরুষদের সম্পর্কে ইরশাদ হইয়াছেঃ

 

*****************************************************************

 

হে নবী! মু’মিন লোকদিগকে নিজেদের দৃষ্টি নীচ রাখিতে ও এই উপায়ে নিজেদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করিতে বল। বস্তুত ইহা তাহাদের জন্য অতীব পবিত্রতাপূর্ণ পদ্ধতি। তাহার যাহা কিছুই করে সে বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা যে পূর্ণ মাত্রায় অবহিত তাহা নিঃসন্দেহে।

 

এর পর পরই নারীদের সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

 

*****************************************************************

 

এবং ঈমানদার মহিলাদের বল, তাহারা যেন তাহাদের দৃষ্টি নিম্নমুখী রাখে, তাহাদের লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করে এবং তাহাদের সৌন্দর্য ও অলংকার প্রকাশ হইতে না দেয়।

 

দৃষ্টি সংত করণের এই নির্দেশ বস্তুত অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞান সম্মত। ইহা বিবাহিত ও অবিবাহিত সব যুবক-যুবতীর জন্য সমান ভাবে অনুসরনীয়। কেননা যে সব ইন্দ্রিয়ের কারণে মনে-মগজে আলোড়নের সৃষ্টি হয়, দৃষ্টি শক্তি তন্মধ্যে প্রধান এবং অধিক তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী। হাতের স্পর্শ না হইলেও দৃষ্টির পরশ শানিত তীরের মত গভীর সূক্ষ্ম তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিতে সক্ষম। এই প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে মনের বিভ্রান্তি ও জ্বেনা-ব্যাভিচারের দিকে আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই দৃষ্টির সংযম ও নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। আর ইহারই জন্য বিবাহ একমাত্র উপায়। ইহাতে যেমন মনের স্থিতি ও এককেন্দ্রিকতা লাভ হয়, তেমনি সৌন্দর্য সন্ধানী ও রূপ পিয়াসী দৃষ্টিও নিজ স্ত্রীতে কেন্দ্রীভূত হয়। আলোচ্য হাদীসে বিবাহের এই তাকীদের মূলে এই যৌক্তিকতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হইয়াছে।

 

আলোচ্য হাদীসের ভিত্তিতে বলা যায়, যে সমাজে প্রত্যেক যুবক যুবতী উপযুক্ত বয়সে বিবাহিত হয় বা উহার সুযোগ হইতে বঞ্চিত থাকে না, সেখানে সাধারণত জ্বেনা-ব্যভিচারের দুর্ঘটনা খুব কমই ঘটিতে পারে। কিন্তু যে সমাজে অধিক বয়স পর্যন্ত যুবক-যুবতীরা অবিবাহিত থাকে বা থাকিতে বাধ্য হয় সেখানে জ্বেনা-ব্যভিচারের সয়লাব প্রবাহিত হওয়া ও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবন কলুষিত হওয়া ও উহা মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত হওয়া একান্তই অবধারিত।

 

যে সব যুবক-যুবতী যৌন চেতনা থাকা সত্ত্বেও বিবাহের দায়িত্ব পালন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ তথা পরিবার ভরণ-পোষনের দায়িত্ব গ্রহণে অসমর্থ, রাসূলে করীম (স) তাহাদিগকে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়াছেন। রোযা মানুষের মধ্যে নিহিত ষড়রিপু দমন করিয়া রাখে। যৌন উত্তেজনা বহুলাংশে অবদমিত থাকে। ফলে অবিবাহিত থাকার কুফল ও খারাপ পরিণতি হইতে রক্ষা পাওয়া অনেকটা সহজ হইয়া দাঁড়ায়।

 

এই হাদীসটি হইতে স্পষ্ট জানা গেল, রাসূলে করীম (স) যে ধরনের সমাজ গঠনের দায়িত্ব লইয়া আসিয়াছিলেন ও যে উদ্দেশ্যে আজীবন চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাইতেছিলেন, তাহাতে পুরুষ ও নারীর বিবাহ বিমুখতা, বেশী বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকার প্রবণতা বা অবিবাহিত রাখার প্রচেষ্টা এবং তদ্দরুন নারী পুরুষের যৌন মিলনজনিত চরিত্রহীনতার কোনই স্থান নাই।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]