হযরত আবূ হুরাইয়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, তিনজন লোকের সাহায্য করার দায়িত্ব আল্লাহ নিজের উপর গ্রহণ করিয়াছেন। সে তিন জন হইলঃ (১) যে ক্রীতদাস মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে চুক্তিমানা লিখিয়া দিয়াছে ও প্রতিশ্রুত পরিমাণ অর্থ আদায় করিয়া দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে; (২) বিবাহকারী- যে, চারিত্রিক পবিত্রতা ও নিষ্কুলষতা রক্ষা করিতে ইচ্ছুক এবং (৩) আল্লাহর পথে জিহাদকারী। (তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসে তিনজন ব্যক্তিকে একই মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সম্ভাব্যতার কথা ঘোষণা করা হইয়াছে। এই তিনজন ব্যক্তি আসলে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি কাজের কারক। কাজ তিনটি হইল; (১) দাসত্ব ন্ধন হইতে আর্থিক বিনিময়ের ভিত্তিতে মুক্তি লাভের চেষ্টা, (২) নৈতিক চারিত্রের পবিত্রতা ও নিষ্কুলষতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ করা এবং (৩) আল্লাহর পথে জিহাদ। কাজ তিনটির মধ্যে পারস্পরিক সাদুশ্য বাহ্যতঃ কিছু নাই বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু মানবিক ও দ্বীনদারীর দৃষ্টিতে এই তিনটি কাজই অতিশয় গুরুত্বের অধিকারী। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে জন্মগতভাবেই মুক্তি চেষ্টা মানবিক মর্যাদার দৃষ্টিতে অবর্ণনীয় গুরুত্বের অধিকারী। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে জন্মগতভাবেই মুক্ত ও স্বাধীন মর্যাদা সম্পন্ন করিয়া সৃষ্টি করিয়অছেন। কিন্তু মানবতার দুশমন লোকদের মনগড়া ও ভুল সমাজ-ব্যবস্থার দরুন মানুষ তাহারই মত মানুষেল দাসত্ব-শৃঙ্খলে বন্দী হইয়া পড়িয়াছে। এই রূপ অবস্থায় এহেন দাসত্ব-শৃঙ্খল হইতে মুক্তি লাভই হইতে পারে তাহার সর্বপ্রথম কর্তব্য। এই মুক্তি যদি অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করিতে হয়, মানবতা বিরোধী সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দরুন অর্থ- বিনিময় ব্যতিরেকে মুক্তি লাভোর কোন পথই যদি উন্মুক্ত না থাকে, তবে অর্থের বিনিময়েই তাহা ক্রময় করিতে হইবে এবং এই জন্য প্রয়োজনে মনিবের সহিত চুক্তিবদ্ধ হইতেও দ্বিধা করা যাইবে না। এই চুক্তি যদি আন্তরিকতা সহকারে সম্পাদিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী অর্থ দিয়া মুক্তি অর্জন করিতে ক্রীতদাস যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালায়, তাহা হইলে হাদীসে বলা হইয়াছে- তাহার সাহায্য করা, চুক্তি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করিতে তাহাকে সমর্থতকপত্কত বানাইয়া দেওয়ার দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলা নিজেই গ্রহণ করিয়াছেন। কেননা আল্লাহর নিকট ইহা অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার কাজ আর কিছুই হইতে পারে না।
দ্বিতীয়, চরিত্রের পবিত্রতা ও নিষ্কুলষতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ করাও আল্লাহর নিকট নিরতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা চরিত্রহীন মানুষ পশুর অপেক্ষা অধম। চরিত্র হারাইয়া ফেলার ভয় আল্লাহর নাফরমানীতে পড়িয়া যাওয়ার ভয়। এই ভয় যে আল্লাহ তা’আলার নিকট খুবই পছন্দীয় তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই ভয়ের দরুন অন্য কথায় চারিত্রিক পবিত্রতা নিষ্কুলষতা রক্ষার তাকীদে যে লোক বিবাহ করে, স্ত্রী ভরণ-পোষণের আর্থিক যোগ্যতা তাহার না থাকিলেও আল্লাহ তা’আলা সেজন্য তাহার সাহায্য করিবেন,ইহাই স্বাভাবিক। কেননা মনুষ্যত্বের দৃষ্টিকে ইহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর তৃতীয় হইল, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আল্লাহর পথে জিহাদের চরম লক্ষ্য হইল মানুষের প্রভুত্ব-সার্বভৌমত্ব ও মানুষের মনগড়া ভাবে রচিত আইন- বিধানের রাজত্ব খতম করিয়া দিয়া আল্লাহ তা’আলার সার্বভৌমত্ব ও তাহারই নাযিল করা দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহর সৃষ্ট এই জমীনে, আল্লাহর সৃষ্ট মানুষের উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হইবে, মানুষ মানুষের গড়া আইন ও শাসন হইতে মুক্তি লাভ করিয়া একান্তভাবে আল্লাহর বান্দা হইয়া জীবন যাপন করিতে পারিবে, ইহা অপেক্ষা আল্লাহর অধিক সন্তুষ্টির কাজ আর কি হইতে পারে! কাজেই যে লোক এই উদ্দেশ্য লইয়া জিহাদে ঝাঁপাইয়া পড়িবে, সে যে মহান আল্লাহর অসামান্য সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করিবে, তাহাতে কোন সন্দেহেরই অবকাশ নাই।
বস্তুত এই তিনটি কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই তিনটি কাজের ব্যক্তিগণকে সাহায্য করিবেন বলিয়া আল্লাহ নিজেই দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, ইহাই আলোচ্য হাদীসের বক্তব্য। আর এই বক্তব্য যে আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদের বিভিন্ন ঘোষণার সহিত পুরাপুরি সামঞ্জস্যশীল, তাহা বলিষ্ঠ কণ্ঠেই বলা যায়।
তবে এই তিনটি কাজেরই মূলে নিহিত রহিয়াছে চরিত্র। চরিত্রই মানুষের মানবিক মেরুদণ্ড শক্ত ও অনমনীয় করিয়া দেয়। সে দাস হইলে তাহা হইতে মুক্তি লাভের জন্য চেষ্টা চালাইবে। যৌন উত্তেজনার প্রাবল্যের চাপে চরিত্র হারাইয়া ফেলার আশঙ্কা দেখা দিলে সে তাহা রক্ষা করার জন্য তৎপর হইবে, বিবাহ অপরিহায্য বোধ হইলে সে বিবাহ করিবে। আর আল্লাহর দ্বীন কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন ইলে সে সম্মুখে সমরে ঝাঁপাইয়া পড়িবে। খালেস নিয়্যতের উপর ভিত্তিশীল এই কাজ কয়টিতে একমাত্র ভরসা থাকিবে আল্লাহর সাহায্য লাভের আশার উপর। উপরোক্ত হাদীসটিই এই আশার বাণী ঘোষণা করিয়াছে। বস্তুত আল্লাহর সাহায্য না হইলে এই তিনটি কাজের কোন একটিও করা কাহারও পক্ষেই সম্ভবপর হইতে পারে না।
পক্ষান্তরে যাহার চরিত্র নাই, সে দাসত্ব শৃঙ্কল হইতে মুক্তি লাভের কোন চেষ্টাই করিবে না, নৈতিক পতনের আশঙ্কা দেখা দিলে সে হাল ছাড়িয়া দিবে, যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে পড়িয়া গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়া যাইবে এবং আল্লাহর দ্বীন কায়েম না থাকিলে সে তাহা কায়েম করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করিবে না- ইহাই স্বাভাবিক। তাই চরিত্রই যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করাই যে অত্যন্ত কঠিন কাজ, তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না। কেননা ইহার জন্য মানুষের স্বভাবজাত ও কেন্দ্রীভূত যৌন-উত্তেজনা দমন করা অপরিহার্য হইয়া পড়ে। যৌন শক্তি আসলে দুর্দমনীয় পাশবিকতা। ইহা মানুষের উপার একবার জয়ী হইয়া চাপিয়া বসিতে পারিলে মানুষকে চরম অধঃপতনের নিম্নতম পংকে নামাইয়া দেয়। কিন্তু মানুষ যদি এই শক্তির নিকট পরাজয় বরণ করিতে অস্বীকার করে ও পূর্ণ শক্তিতে উহার মুকাবিলায় নিজেকে জয়ী করিয়অ রাখে তবে তাহার প্রতি আল্লাহর রহমত ও সাহায্য অবশ্যই নাযিল হইবে। আর তাহা সম্ভব হইতে পারে শরীয়াত সম্মত বিবাহের মাধ্যমে। কাজেই কোন লোক যদি নিজের চরিত্র পুত-পবিত্র ও নির্মল- নিষ্কুলষ রাখার নিয়্যাতে বিবাহ করে, বিবাহের মূলে এতদ্ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য না থাকে, বিবাহ করিলেই তাহার চরিত্র রক্ষা পাইয়া যাইবে মনে করিয়া কেহ বিবাহ করে, তবে এই কাজে সে আল্লাহর সাহায্য লাভ করিবে। তাহার আর্থিক দৈন্য ও অসচ্ছলতা থাকিলেও আল্লাহ তা’আলা তাহা ক্রমশ দূর করিয়া দিবেন। কুরআন মজীদে পূর্ণ বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের বিবাহের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়ার পরই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
*****************************************************************
এই লোকেরা যদি দরিদ্র হয়, তাহা হইলে আল্লাহ তাঁহার অনুগ্রহ দানে তাহাদিগকে সচ্ছল ও ধনশালী করিয়া দিবেন।
এই আয়াতের ভিত্তিতে মুফাসসিরগণ লিখিয়াছেন, কেবলমাত্র দারিদ্রের কারণে তোমরা কাহাকেও বিবাহ করা হইতে বিরত রাখিও না। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁহার নাফরমানী হইতে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে কেহ বিবাহ করিলে আল্লাহ তা’আলা তাহাকে সচ্ছলতা দেওয়ার ওয়াদা করিয়াছেন। তবে ইমাম শওকানীর মতে ইহা আল্লাহ তা’আলার নিশ্চিত ও অবশ্যপূরনীয় কোন প্রতিশ্রুতি নহে। বিবাহ করলেই দরিদ্র ব্যক্তির দারিদ্র দূর হইয়া যাইবে এবং তাহার সচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জিত হইয়া যাইবে, এমন কথা বলা হয় নাই, আর তাহা বাস্তবও নহে। কেননা অসংখ্য দম্পতিকেই চরম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত দেখা যায় অহরহ। তবে ইহা একান্তভাবে আল্লাহর অনুগ্রহের ও তাঁহার নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। কিন্তু ইমাম কুরতুবী উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে এই ব্যাপারে নিশ্চয়তার উল্লেখ করিয়াছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ
*****************************************************************
তোমরা বিবাহের মাধ্যমে সচ্ছলতা লাভ করিতে চেষ্টা কর।
হযরত উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
*****************************************************************
লোকেরা বিবাহের মাধ্যমে সচ্ছলতা অর্জন করিতে চাহিতেছে না দেখিয়া আমার আশ্চর্য লাগে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-ও এইরূপ উক্তি করিয়াছেন এবং তাঁহারা প্রত্যেকে উপরোক্ত আয়াতটিকেই এই কথার দলীল হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন।
ইবনে মাজাহ গ্রন্হ এই হাদীসটির ভাষায় ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে। উহাতে হাদীসটির রূপ এইঃ
****************************************
তিন শ্রেণীর লোকের সাহায্য করা আল্লাহর উপর অর্পিত। (১) আল্লাহর পথে জিহাদকারী, (২) বিবাহকারী- যে নৈতিক পবিত্রতা রক্ষার ইচ্ছা করে এবং (৩) অর্থের বিনিময়ে দাস মুক্তির চুক্তিতে আবদ্ধ- যে চুক্তির অর্থ আদায় করিতে ইচ্ছুক।
কিন্তু এই বর্ণনায় হাদীসের মূল কথাগুলি অভিন্নই রহিয়াছে।
উপরোক্ত আয়াতেও এই হাদীসের তাৎপর্যস্বরূপ ইহাতে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
লোকেরা যদি বিবাহের মুখাপেক্ষী হইয়াই পড়ে তাহা হইলে আল্লাহ হালাল উপায়ে তাহাদের এই মুখাপেক্ষিতা দূর করিয়া দিবেন, যেন তাহারা জ্বেনা-ব্যভিচার হইতে নিজেদের চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কুলষ করিয়া রাখিতে পারে।
এই আয়াত ও হাদীসের ভিত্তিতে ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষেও বিবাহ করা জায়েয এবং সঙ্গত। কেননা রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর। রাসূলে করীম (স) বহু দরিদ্র নারী পুরুষেরই বিবাহের ব্যবস্থা করিয়াছেন। দারিদ্রই যদি বিবাহ হইতে বিরত থাকার ভিত্তি হইত, তাহা হইলে নবী করীম (স) নিশ্চয়ই তাহা করিতেন না।
এতসব সত্ত্বেও যদি কোন লোক বিবাহ করার সুযোগ বা ব্যবস্থা করিতেই সমর্থ নাই হয়, তবে আল্লাহ তাহাকে বলিষ্ঠভাবে স্বীয় নৈতিক পবিত্রতা ও নিষ্কুলষতা রক্ষা করিবার ও কোনরূপ নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা ও পদস্থলন জ্বেনা-ব্যভিচারে না পড়িবার জন্য তাকীদ করিয়াছেন। উপরোক্ত আয়াতের পরই বলা হইয়াছেঃ
****************************************
যে সব লোক কোনরূপেই বিবাহের ব্যবস্থা করিতে পারিতেছে না, তাহাদের কর্তব্য হইল শক্তভাবে স্বীয় নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করা, যতদিন না আল্লাহ তাহাদিগকে সচ্ছল করিয়া দেন।
প্রথমোক্ত হাদীসে এইরূপ অবস্থায় চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার জন্য নফল রোযা রাখার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।