হযরত আদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, নবী করীম (স) হালালকারী ব্যক্তি ও যাহার জন্য হালাল করা হয় সেই ব্যক্তির উপর অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন।
(মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী, নাসায়ী, তিরমিযী)
(ইবনুল কাতান ও ইবনে দকীকুল-ঈদ-এর মতে এই হাদীসটি বুখারীর শর্তে উত্তীর্ণ সহীহ হাদীস।)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসের শব্দ ********* অর্থ ‘তাহলীলকারী’- অর্থাৎ অন্য একজনের জন্য কোন মেয়ে লোককে হালাল বানাইবার উদ্দেশ্যে সেই মেয়ে লোকটিকে বিবাহ করাকে বলা হয় তাহলীল বিবাহ। ইহার তাৎপর্য হইল, একজন লোক তাহার স্ত্রীকে তিন তালাক বাইন দিয়াছে। তালাক দেওয়ার পর সে আবার সেই স্ত্রীকেই স্ত্রীরূপে রাখিতে ইচ্ছুক হইয়াছে এবং সে স্ত্রীও তাহার স্ত্রী হইয়া থাকিতে ও পূর্বে তালাক দাতাকেই পুনরায় স্বামীরূপে বরণ করিয়া লইতে রাযী হইয়াছে। কিন্তু কুরআনের বিধান মতে এ স্ত্রী লোকটি যতক্ষণ অন্য একজন লোককে বিবাহ না করিবে, ততক্ষণ সে তাহার প্রথম স্বামীকে স্বামীরূপৈ বরণ করিতে পারে না। এইরূপ অবস্থায় একজন আপন জনকে রাযী করানো হয় এই উদ্দেশ্যে যে, সে এই স্ত্রী লোকটিকে বিবাহ করিবে, তাহার সহিত সঙ্গম করিবে এবং পরে সে তাহাকে তালাক দিবে- যেন মেয়ে লোকটি তাহার প্রথম স্বামীর বিবাহিত স্ত্রী হইতে পারে ও সেই প্রথম স্বামীর পক্ষেও তাহাকে বিবাহ করা হালাল হইয়া যায়। মোটামুটি এই রূপ বিবাহকে তাহলীল বিবাহ বলে এবং যে লোক এই বিবাহ করে তাহাকে বলা হয় ‘মুহাল্লিল’ (********)। আর যাহার জন্য হালাল করার উদ্দেস্যে সে বিবাহ করে তাহাকে বলা হয় ‘মুহাল্লিল লাহু’ (******)। আলোচ্য এই দুই ব্যক্তির উপরই রাসূলে করীম (স) লা’নত ও অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া জানানো হইয়াছে। বস্তুত এই লা’নত ও অভিশাপ বর্ষণের বাস্তব কারণ রহিয়াছে। যাহারা এই বিবাহকে হালাল মনে করে তাহারা কুরআনের আয়াতের ধৃষ্টতাপূর্ণ কদর্য করে। কেননা কুরআনের আয়াতঃ
****************************************
তিন তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীলোকটি তালাকদাতার জন্য হালাল হইবে না যতক্ষণ না সে অপর একজন লোককে স্বামীরূপে বরণ করিবে। (ও তাহার সহিত সঙ্গম করিবে)
ইহার সঠিক অর্থ হইল, একজন স্বামী তাহার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়া দিলে মূলত এই স্ত্রীলোকটি তাহার এই স্বামীর জন্য চিরকালের তরে হারাম হইয়া যায়- তবে মেয়ে লোকটি যদি সাধারণ নিয়মে অন্য এক স্বামী গ্রহণ করে ও তাহার সহিত সঙ্গম হয় ও তাহার পর সে হয় মরিয়া যায়, কিংবা সেও তিন তালাক দিয়া ছাড়িয়া দেয়, তাহা হইলে সেই প্রথম স্বামী ও সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নূতন ব্যক্তির ন্যায় এই মেয়ে লোকটিকে বিবাহ করিতে পারিবে। তখন এই বিবাহ জায়েয এবং এই মেয়েলোকটি তাহার জন্য হালাল হইবে। ইহা অতীব স্বাভাবিক নিয়মের কথা। ইহাতে কৃত্রিমতার লেশ মাত্র নাই। কিন্তু বর্তমান কালে কুরআনের এই আইনটির সম্পূর্ণ ভূল অর্থ করিয়া কার্যত করা হইতেছে এই যে, কেহ রাগের বশবর্তী হইয়া স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে পরে তাহার ঘর-সংসার সব রসাতলে যাইতেছে ও জীবন অচল হইয়া পড়িতেছে দেখিয়া আবার সেই স্ত্রীকেই গ্রহণ করিতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু কুরআনের এই আয়াতটি তাহার সম্মুখে বাধা হইয়া দাঁড়ায় দেখিয়া ইহাকেই অতিক্রম করার জন্য এই তাহলীল বিবাহ করিতেছে এবং মেয়েলোকটিও জানে যে, তাহাকে স্থায়ী স্বামী রূপে বরণ করার জন্য নয়- একরাত্রির যৌন-সঙ্গিণী হইবার জন্যই সে তাহাকে বিবাহ করিতেছে এবং সেও তাহার নিকট বিবাহ বসিতে রাযী হইয়াছে। নবী করীম (স) এই তাহলীল বিবাহকারীকে ‘ভাড়া করা বদল’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। হযরত উকবা ইবনে আমর (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) ইরশঅদ করিয়াছেনঃ
****************************************
আমি কি তোমাগিদকে ধার করা ষাড়ের সম্পর্কে বলিব? সাহাবাগণ বলিলেনঃ হ্যাঁ রাসূল! বলূন, তখন তিনি বলিলেনঃ তাহলীল বিবাহকারীই হইতেছে ধার করা ষাড়। আল্লাহ তা’আলা তাহলীলকারী ও যাহার জন্য তাহলীল করে এই উভয় ব্যক্তির উপরই অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন।
(ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)
হযরত আলী (রা) ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে এই একই হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। এই সব হাদীস হইতে অকাট্য ভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাহলীল বিবাহ সম্পূর্ণ হারাম। কেননা রাসূলে করীম (স)- এর মুখে এই ব্যাপারে এতবেশী কঠোর ও তীব্র ভাষায় হাদীস উচ্চারিত ও বর্ণিত হইয়াছে যে, তাহা পড়িলে শরীর মন কাঁপিয়া উঠে। ইহা প্রমাণ করে যে, ইহা নিশ্চয়ই অতি বড় গুনাহ। তাহা না হইলে এতভাবে ও এত কঠোর ভাষঅয় নবী করীম (স) এই কথা বলিতেন না। কেননা সুস্পষ্ট হারাম কবিরা গুনাহের কাজ এবং যে করে কেবল তাহার প্রতিই অভিশাপ বর্ষণ করা যাইতে পারে। অন্য কাহারও প্রতি নয়। আল্লাম ইবনুল কাইয়্যেম লিখিয়াছেনঃ ************************** “অভিশাপ হয় বড় কোন গুনাহের জন্য”। এই জন্য শরীয়াত বিশেষজ্ঞগণ এই বিষয়ে একমত হইয়াছেন যে, অন্য কাহারও জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে যে বিবাহ হয়, তাহা শরীয়াত মুতাবিক বিবাহ নয়। আর এইরূপ বিবাহের পর যে যৌন সঙ্গম হয় তাহা নির্লজ্জ ও প্রকাশ্য ব্যভিচার ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন কি, যদি মৌলিকভাবে এজন্য কোন শর্তও করা নাও হয় যে,একরাত্রির সঙ্গমের পর সে তাহাকে তালাক দিবে, তবুও ইহা শরীয়াত মুতাবিক বিবাহ হইতে পারে না।[তাহলীল বিবাহ সম্পর্কে রাসূলে করীম-কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ
****************************************
না, জায়েয নয়। কেবল সেই বিবাহই জায়েয যাহা বিবাহের উদ্দেশ্যে ও আগ্রহে করা হইবে, যাহাতে কোন ধোঁকা প্রতারণার অবকাশ থাকিবে না এবং আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপও হইবে না, উহার অপমান হইবে না- যতক্ষণ তুমি তোমার স্বামীর নিকট যৌন মিলনের স্বাদ-আস্বাদন না করিবে।]
[‘ফাসেদ বিবাহ’ বলা হয় সেই বিবাহকে যাহা আনুষ্ঠানিক ভাবে হইলেও প্রকৃত পক্ষে শরীয়ত অনুযায়ী সংঘটিত হয় না।]
ইমাম তিরমিযী লিখিয়াছেন, নবী করীম (স)- এর সাহাবীগণের মধ্যে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবনে আফফান, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) প্রমুখ, তাবেয়ী ফিকাহবিদ সুফিয়ান সওরী, ইবনুল মুবারক, শাফেয়ী, আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইসহাক প্রমুখ বিশেষজ্ঞগণ সম্পূর্ণ একমত হইয়া এইরূপ বিবাহকে হারাম বলিয়াছেন।
ইমাম আবূ হানীফার মত হইল, কেহ যখন কোন মেয়েলোককে এই উদ্দেশ্যে বিবাহ করে যে, সে মেয়েলোকটিকে তাহার তালাকক দাতার জন্য হালাল করিয়া দিবে এবং শর্ত করে যে, সে যখন তাহার সহিত যৌন সঙ্গম করিবে, তখনই সে তালাক হইয়া যাইবে- কিংবা অতঃপর এই বিবাহের কোন অস্তিত্ব থাকিবে না, তাহা হইলে এই বিবাহটা সহীহ হইবে; কিন্তু যে শর্ত করিয়াছে, তাহার বাধ্যবাধকতা থাকিবে না। ইমাম মালিকের মতে তালাকদাতার (প্রথম স্বামীর) জন্য এই মেয়েটি হালাল হইবে কেবল সহীহ ও আগ্রহ প্রসূত বিবাহ অন্য কাহারও সহিত অনুষ্ঠিত হইলে ও সে তাহার সহিত যৌন সঙ্গম করিলে। এই যৌন সঙ্গম হইবে তখন যখন মেয়েটি পাক থাকিবে ও হায়েয অবস্থায় থাকিবে না এবং এই বিবাহে তাহলীল- অন্য কাহারও জন্য হালাল করিয়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে সে বিবাহ করিতেছে এই রূপ কোন ইচ্ছা বা ধারণা থাকিতে পারিবে না। তাহার পর যদি সেও তালাক দেয় কিংবা সে মরিয়া যায়, তাহা হইলে। যদি তাহলীলের শর্ত করা হয়, কিংবা উহা নিয়্যাত থাকে, তাহা হইলে এই বিবাহ সহীহ হইবে না ও দ্বিতীয় জনের জন্যও সে হালাল হইবেনা, প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হওয়া তো দূরের কথা।
এই বিষয়ে ইমাম শাফেয়ী হইতে দুইটি কথার উল্লেখ হইয়াছে। তন্মধ্যে নির্ভূলতম কথা হইল, এই বিবাহ সহীহ নয়। ইমাম আবূ ইউসূফ বলিয়াছেনঃ ইহা ফাসেক বিবাহ। কেননা ইহা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হইয়াছে। ইমাম মুহাম্মদ (****************) বলিয়াছেনঃ দ্বিতীয় স্বামীর সহিত বিবাহ শুদ্ধ, প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হইবে না।
হযরত উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
হালাল বিবাহকারী ও যাহার জন্য হালাল করা হয় এই দুই জন এমন যে, আমার নিকট তাহাদিগকে উপস্থিত করা হইলে আমি তাহাদের ‘রজম’- পাথর নিক্ষেপে হত্যা দন্ডে দন্ডিত করিব।
হযরত ইবনে উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
ইহারা উভয়ই ব্যভিচারী।
এক ব্যক্তি হযরত ইবনে উমর (রা) কে জিজ্ঞাসা করিলঃ
আমি একটি মেয়ে লোককে বিবাহ করিলাম তাহাকে তাহার স্বামীর জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে, কিন্তু সে আমাকে কোন আদেশ করিল না, জানাইলও না। এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ
****************************************
না ইহা বিবাহ হইবে না। বিবাহ হইবে যদি বিবাহের আন্তরিক আগ্রহ লইয়া বিবাহ করা হয়। অতঃপর তোমার পছন্দ হইলে তাহাকে স্ত্রী হিসাবে রাখিবে আর তাহাকে অপছন্দ করিলে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিবে।
উক্তরূপ বিবাহকে রাসূলে করীম (স)-এর যুগে আমরা ব্যভিচার গণ্য করিতাম।
তিনি আরও বলিয়াছেনঃ
এইরূপ বিবাহের পর পুরুষ-নারী উভয়ই ব্যভিচারীরূপে গণ্য হইবে বিশ বৎসর পর্যন্ত তাহা স্থায়ী হইলেও- যখন সে জানিবে যে, সে স্ত্রী লোকটিকে কাহারও জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যেই বিবাহ করিয়াছিল।