উত্তম স্ত্রীর পরিচয় আদর্শ স্ত্রীর উত্তম গুণাবলী -

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হইল, কোন মেয়ে উত্তম? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেন, যে মেয়ে স্বামীকে সন্তুষ্ট করিয়া দবে যখন সে তাহার দিকে তাকাইবে, অনুসরণ ও আদেশ পালন করিবে যখন সে তাহাকে কোন কাজের হুকুম করিবে এবং তাহার স্ত্রীকে নিজের ব্যবহারে এবং তাহার নিজের ধনমালের ব্যাপারে সে যাহা অপছন্দ করে তাহাতে সে স্বামীর বিরুদ্দতা করিবে না। (মুসনাদে আহমদ)

 

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে উত্তম স্ত্রী তিনটি গুণের কথা বলা হইয়াছে। এই তিনটি গুণ হইলঃ (১) স্ত্রীর প্রতি স্বামী যখনই তাকাইবে, তখনই সে স্ত্রীকে দেখিয়া আনন্দিত ও উৎফুল্ল হইবে, (২) স্বামী যখন তাহাকে কোন কাজ করিতে বলিবৈ তখন সে তাহা পালন করিবে এবং (৩) স্ত্রীর নিজের ব্যাপারে স্বামী যাহা অপছন্দ করে এবং তাহার ধন-মালে স্ত্রীর যে ভূমিকা পালনে স্বামী সন্তুষ্ট হয় না, তাহাতে সে স্বামীর বিরুদ্দতা করিবে না।

 

স্ত্রীর যে তিনটি বাঞ্ছিত গুণের উল্লেখ এখানে করা হইয়াছে, তাহা বিশেষভাবে অনুধাবন সাপেক্ষ। স্বামী যখনই স্ত্রীর দিকে তাকাইবে, স্বামী তাহার স্ত্রীকে দেখিয়া আনন্দিত ও উৎফুল্ল হইবে। স্বামীর এই আনন্দ ও উৎফুল্লতা লাভের উৎস হইতে পারে স্ত্রীর রূপ-সৌন্দর্য ও তাহার দৈহিক গঠন ও অঙ্গ সৌষ্ঠব। হইতে পারে তাহার স্বামী-প্রীতি, স্বামীর জন্য প্রাণ ভরা ভালবাসা, দরদ-মায়া, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা। হইতে পারে স্বামীর আদর যত্নে তাহার সদা নিমগ্নতা। হইতে পারে দাম্পত্য ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনে একাগ্রতা ও যোগ্যতা। হইতে পারে স্বামীর সন্তানের মা হওয়ার যোগ্যতা।

 

ইহার যে কোন একটা কারণে স্বামী স্ত্রীর প্রতি তাকানো মাত্রই আনন্দিত ও উৎফুল্ল হইয়া উঠিতে পারে, স্ত্রী সুকে তাহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিতে পারে।

 

স্বামী তার ঘর-সংসারের প্রধান। আর ঘরের রাজ্যের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ্য হইতেছে স্ত্রী। ঘর ও সংসার  প্রধানের আদেশ নিয়মিত পালিত ও কার্যকর হওয়ার উপর পারিবারিক নিয়ম শৃঙ্কলা অক্ষুণ্ন থাকা নির্ভর করে। কাজেই স্বামীর আদেশ পালনে স্ত্রীর সদা সযত্ন হইয়া থাকা বাঞ্ছনীয়।

 

স্ত্রী স্বামীর মান-সম্ভ্রম, স্ত্রী স্বামীর ধন-মালের রক্ষণবেক্ষণের দায়িত্ব সম্পন্না। স্ত্রীর নিজের ব্যাপারে স্বামীর খুশী-অখুশীর অনেক দিক আছে। এ ক্ষেত্রে আছে স্বামীর রুচি-অরুচির প্রশ্ন, ভাল লাগা না-লাগার প্রশ্ন এবং নীতি ও আদর্শের প্রশ্ন। স্ত্রী কর্তব্য এই সব দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া এমনভাবে চলা ফিরা করা যাহাতে স্বামীর বিরুদ্ধতা না হয়। স্বামীর মনে কোনরূপ অনীহা অসন্তোষ বা দুঃখ ক্ষোভের সঞ্চার না হয়।

 

অনুরূপভাবে স্বামীর ধন-মালের ব্যয়-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও স্বামীর ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং সাধ্য-অসাধ্যের প্রশ্ন প্রবল হইয়া থাকে। কোন কোন কাজে অর্থব্যয় করা স্বামীর পছন্দ নয়। অনেক ব্যয় এমন আছে, যাহা স্বামীর আর্থিক সামর্থে কুলায় না। এই সব ক্ষেত্রে স্ত্রীর উচিত, সমস্ত ব্যাপারে এমন ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অবলম্বন করা যাহাতে যাবতীয় প্রয়োজন মিটে এবং স্বামীল মতের বা সামর্থের সহিত কোনরূপ সংঘর্ষের সৃষ্টি না হয়।

 

বস্তুত স্ত্রীর এ ব গুণই এমন যাহা প্রত্যেকটি পরিবারের সুখ-শান্তি ও স্থায়ীত্বের নিয়ামক হইয়া থাকে এবং স্বামীর সুখানুভূতির মূল উৎস এখানেই নিহিত।

 

অন্য একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

দুনিয়ার সবকিছুই ভোগ ব্যাবহারের সামগ্রী। আর দুনিয়ার এসব ভোগ-ব্যবহার সামগ্রীর মধ্যে সর্বোত্তম হইতেছে সদাচারী সৎ স্বভাব ও সুরুচি সুনীতি সম্পন্না স্ত্রী। কেননা এইরূপ স্ত্রীই স্বামীর পরকালীন সাফল্য লাভে সাহায্যকারী হইতে পারে। আর যাহা বা যেই পরকালীন সাফল্যে সাহায্যকারী, তাহা এবং সেই যে সর্বোত্তম, তাহা নিঃসন্দেহ।

 

(*********************)

 

****************************************

 

হযরত আবূ আমামাতা (রা) হইতে, তিনি নবী করীম (স) হইত বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি প্রায়ই বলিতেন, মু’মিনের তাকওয়ার পক্ষে অধিক কল্যাণকর ও কল্যাণ লাভের উৎস হইতেছে সচ্চরিত্রবতী এমন একজন স্ত্রী, যাহাকে সে কোন কাজের আদেশ করিলে সে তাহা মানিবে, তাহার দিকে সে তাকাইলে সে তাহাকে সন্তুষ।ট করিয়া দিবে। সে যদি তাহার উপর কোন কীড়া-কছম দেয়, তবে সে তা হাকে কছমমুক্ত বানাইবে। সে যদি স্ত্রী হইতে দূরে চলিয়া যায়, তবে সে তাহার নিজের ব্যাপারে এবং স্বামীর ধন-সম্পত্তির ব্যাপারে তাহার কল্যাণ চাহিবে। (ইবনে মাজাহ)

 

ব্যাখ্যাঃ ‘তাকওয়া’ অর্থ আল্লাহকে ভয় করিয়া তাঁহার আদেশাবলী পালন করা এবং তাঁহার নিষেধ সমূহ হইতে যথাযথভাবে বিরত থাকা। বস্তুত একজন ঈমানদার ব্যক্তির জন্য ইহকাল ও পরকালের দৃষ্টিতে ইহাই সর্বাধিক কল্যাণকর জিনিস। এই জিনিস যাহার আছে সে যে অতিবড় ভাগ্যবান তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই গুণের পর দ্বিতীয় কোন জিনিসটি মু’মিনের পক্ষে অধিক কল্যাণকর? আলোচ্য হাদীসে ইহারই জওয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহাতে বলা হইয়াছে, তাওয়ার পর মু’মিনের জন্য অধিক কল্যাণকর ও কল্যাণের উৎস হইতেছে একজন স্ত্রী। কিন্তু কেবল একজন যেন-তেন প্রকারের স্ত্রী নয়, সে স্ত্রীর প্রধান পরিচয় হইল, সে হইতে ‘সালেহা’- সদাচারী, সচ্চরিত্রবতী, সদগুণ সম্পন্না। আর এই গুণের স্ত্রী হইতে মু’মিনের সুখ ও কল্যাণ লাভের দিক হইল অন্ততঃচারটি। প্রথম, সে হইবে স্বামীর অনুগতা, স্বামীর আদেশ পালনে সদা প্রস্তুত। স্বামীই ঘরের কর্তা ও পরিচালক। অতএব তাহার আদেশাবলী ঘরের লোকদের দ্বারা পালিত ও অনুসৃত হওয়া আবশ্যক। নতুবা ঘরের শৃঙ্খলা রক্ষা হইতে পারে না। আর স্বামীর পর ঘরের অন্যান্য সন্তানাদি ও লোকজনের মধ্যে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রধান কর্ত্রী হইল স্ত্রী। তাহাকে স্বামীর অনুগতা ও আদেশ পালনে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। কিন্তু এই আদেশ পালন শর্তহীন নয়, নয় সীমাহীন। উহার শর্ত হইল, স্বামীর আদেশ যদি আল্লাহর আদেশ নিষেধের পরিপন্হী না হয়, তবেই তাহা পালন করা চলিবে। পরিপন্হী হইলে তাহা পালন না করাই সচ্চরিত্রবতী স্ত্রী হওয়ার প্রধান গুণ, উহা পালন করা নয়। আর স্বামীর হুকুম পালন চলিবে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ লংঘিত না হওয়া পর্যন্ত। যখনি দেখা যাইবে, স্বামীর আদেশ পালন করিতে গেলে আল্লাহর নিষেধের অমান্যতা হয়, আল্লাহর আনুগত্য সীমা লংঘিত হইয়া যায়, তখনই সে আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানাইতে হইবে। কেননা নবী করীম (স) স্পষ্ট অকাট্য ভাষায় বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

স্রষ্টার নাফরমানী করিয়া সৃষ্টির আনুগত্য করা চলিতে পারে না।

 

দ্বিতীয় দিক হইল, স্বামী যখন তাহার প্রতি তাকাইবে, তখন স্ত্রীর রূপ ও গুণ, তাহার কাছ থেকে পাওয়া অকৃত্রিম গভীর ভালবাসা, প্রেম-প্রীতি এবং তাহার সহিত একাত্মতা মিশ্রিত সুখময় জীবন যাত্রার কথা স্মরণ করিয়াই স্বামী গভীর ভাবে আনন্দিত ও উৎফুল্ল হইয়া উঠিবে।

 

তৃতীয়, যে কাজ করা বা না করা স্ত্রী পছন্দ করে না, সেই কাজ করিতে বা না করিতে স্বামী যদি আদেশ করেএবং সে আদেশকে বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে যদি কিড়া-কছম দেয়, তখন স্ত্রী স্বামীর কথার আনুকূল্য করিয়া ও বিরুদ্ধতা পরিহার করিয়া স্বামীকে কছমমুক্ত করিবে। ইহা হইবে স্বামীকে সন্তুষ্ট বিধানের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর ত্যাগ স্বীকার। দাম্পত্য জীবনে সুখ-মাধুর্য, স্থিতি ও স্থায়ীত্বের জন্য স্ত্রীর এই ত্যাগ স্বীকার প্রবণতার মূল্য অনেক। এই রূপ ত্যাগ স্বীকারের প্রবৃত্তি না থাকিলে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় ও ভাঙন অনিবার্য হইয়া দেখা দেয়।

 

আর চতুর্থ হইল, স্বামী যখন ঘরের বাহিরে যাইবে- ঘরে অনুপস্থিত থাকিবে, তখন স্ত্রী স্বামীর প্রতি গভীর কল্যাণ কামনা সম্পন্ন থাকিবে। সে তাহার স্বামীর জন্য নিজেকেও রক্ষা করিবে। রক্ষা করিবে স্বামীর ধন-মালও। এই দুইটি ব্যাপারে সেই হইবে স্বামীর আমাদতদার। সে তাহার এই আমানতদারীত্বে কোন দিক দিয়া ক্ষুণ্ন হইতে দিবে না। বস্তুত, এইরূপ একজন স্ত্রী মু’মিন ব্যক্তিন জন্য বিরাট সৌভাগ্যের কারণ। যে লোক স্ত্রী গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক, তাহার মনে এই রূপ স্ত্রী পাওয়ার জন্য ঐকান্তিক কামনা ও চেষ্টা থাকা বাঞ্ছনীয়। আর যাহার স্ত্রী এই সব গুণে গুণান্বিতা তাহার উচিত  আল্লাহর অশেষ শোকর আদায় করা।

 

উদ্ধৃত হাদীস সম্পর্কিত জরুরী কথা এখানেই শেষ। কিন্তু মহানবীর এই সংক্ষিপ্ত বাণিটির অনুরনন ও চিন্তার ক্ষেত্রে সৃষ্ট আলোড়ন আরও ব্যাপক। উত্তম স্ত্রীর পরিচয় দান প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স)-এর বলা চারটি কথার তাৎপর্য বাস্তব জীবনের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করিলে স্পষ্টভাবে বুঝা যাইবে, এই কয়টি কেবলমাত্র নীতি কথাই নয়। এই গুণ গুলির বাস্তবতা অবশ্য প্রয়োজনীয়। অন্যথায় দাম্পত্য সুখলাভ করা স্বামী বা স্ত্রী কাহারও পক্ষেই সম্ভব হইবে না।

 

****************************************

 

আবদুল্লাহ ইবনে আমার ইবনুল আ’স (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, দুনিয়াটাই জীবন-উপকরণ। আর দুনিয়ার সর্বোত্তম জীবনোপকরণ হইতেছে নেককার-সচ্চরিত্রবান স্ত্রী।

 

(মুসলিম)

 

ব্যাখ্যাঃ পৃথিবী ও ইহকালীন গোটা জীবনই মানুষের ভোগ-ব্যবহার ও যাপনের ক্ষেত্র। পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের ইহকালীন জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিশেষ। কিন্তু এই জীবনের প্রকৃত সুখ নির্ভর করে কল্যাণময়ী উত্তম পবিত্র চরিত্রের অধিকারী স্ত্রীর উপর। আল্লাহ দুনিয়ার সব কিছু-উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল-কে জোড়ায় জোড়ায় সৃষি।ট করিয়াছেন। মানুষের জন্যও জুড়ি ইহজীবনের অপরিহার্য অংশ। নারীর জন্য পুরুষ এবং পুরুষের জন্য নারী অবশ্যম্ভাবী। ইহা ব্যতীত মানুষের দুনিয়ার জীবন অকল্পনীয়। কিন্তু তাই বলিয়া পুরুষের জন্য যেমন-তেমন একনজ নারী এবং নারীর জন্য যেমন-তেমন একজন পুরুষ হওয়াই ইসলামের দৃষ্টিতে কল্যাণবহ হয় না। বরং পুরুষের জন্য উত্তম চরিত্রের স্ত্রী প্রয়োজন এবং স্ত্রীর জন্য প্রয়োজন উত্তম চরিত্রের পুরুষ।

 

অস্বীকার করার উপায় নাই যে, ইসলাম পরিকল্পিত সমাজে পুরুষ প্রধান। তাই হাদীসটিতে পুরুষকেই লক্ষ্য করিয়া কথাটি বলা হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে নারীর দিকটি উপেক্ষিত হয় নাই। ইসলামের মানবিক দৃষ্টিকোণে পুরুষ ও নারীর মর্যাদা ও সামাজিক গুরুত্ব অভিন্ন। তাই পুরুষের জন্য যদি নেককার চরিত্রবান স্ত্রী সর্বোত্তম জীবনোপকরণ হইয়া থাকে, তাহা হইলে নারীর জন্যও অনুরূপভাবে সর্বোত্তম চরিত্রবান ও নেককার পুরুষ হইবে সর্বোত্তম জীবনোপকরণ, তাহা বলাই বাহুল্য।

 

হযরত সায়াদ ইবনে আবূ আক্কাস (রা) হইতে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স)- এর এই কথাটি উদ্ধৃত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আদমের পুত্রের বড় সৌভাগ্যের বিষয় হইতেছে উত্তম চরিত্রবান স্ত্রী… এবং আদম পুত্রের চরম দুর্ভাগ্যের কারণ হইল খারাপ স্ত্রী।

 

আমাদের সমাজের সাধারণ ও সর্বজনবিদিত কথাঃ ‘সংসার সুখের হয় রমনীয় গুণে’। এই হাদকীস সমুহেরই নির্যাস বা প্রতিধ্বনি। কথাটির ‘রমনী’ বলিতে স্ত্রীকেই বুঝাইয়াছে, অতএব বিবাহের প্রসঙ্গে পুরুষের নিকট সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত উত্তম ও নেক চরিত্রের মেয়ে, তেমনি মেয়ের নিকট উত্তম চরিত্রের ছেলে।

 

ইহা না হইলে নারী বা পুরুষ কাহারও জীবন সুখের হইতে পারে না।

 

****************************************

 

হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ একজন স্ত্রী লোক যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথভাবে আদায় করে, রমযান মাসের রোযা থাকে, স্বীয় যৌন অঙ্গ সুরক্ষিত রাখে এবং তাহার স্বামীর আনুগত্য করে, তাহা হইলে সে জান্নাতে যে কোন দ্বারপথে ইচ্ছা হইবে প্রবেশ করিতে পারিবে। (আবূ নয়ীম- হুলিয়াতুল- আবরার)

 

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসটিতে মোটামুটি একজন আদর্শ স্ত্রীলোকের পূর্ণাঙ্গ চরিত্র অংকন করা হইয়াছে। সাধারণভাবে একজন লোকের- সে পুরুষ হউক বা স্ত্রীলোক- কর্তব্য হইল একদিকে আল্লাহর হক আদায় করা, আর অপর দিকে বান্দাহর হক আদায় করা। বান্দাহ যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহ সৃষ্টি করিয়াছেন বলিয়াই তাহার পক্ষে দুনিয়ার অস্তিত্ব লাভ ও জীবন যাপন সম্ভবপর হইয়াছে। এই কারণে তাহাকে আল্লাহর হক অগ্রাধিকারভাবে অবশ্যই আদায় করিতে হইবে। কিন্তু দুনিয়ায় সে একাকী বাস করিতে পারে না। আন্যান্য বান্দাহদের সঙ্গে একত্রে সামাজিক জীবন যাপন করিতে সে বাধ্য। এই কারণে কেবল আল্লাহর হকরূপে চিহ্নিত কয়েকটি কর্তব্য করা কাহারও পক্ষে যথেষ্ট হইতে পারে না। তাহাকে সমাজের হকও আদায় করিতে হইবে। ইহাও আল্লাহর হক এর মধ্যে গণ্য।

 

এই দুই দিকের বাহ্যত দুই ধরনের হক পরস্পর বিপরীত নয়। এই দুই হকের মধ্যে বিরোধ ও বৈপরীত্য নাই। শুধু তহাই নয়, এই দুইটি হক পরস্পর সম্পৃক্ত। একটি অপরটির উপর নির্ভরশীল। তাই এই দুইটি এক সঙ্গে জীবনের কর্মধারা ও কর্মসূচীর মাধ্যমে আদায় করিতে হইবে। কখনও একটি হক আদায় করিবে, কখনও অপর হক, এই দ্বৈত নীতি বাস্তবে চলিতে পারে না। ইহা যেমন বিবেক বিরোধী তেমনই ইসলাম বিরোধীও। এই দিক দিয়া ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবন ধারা ও জীবন সূচী উপস্থাপিত করিয়াছে, যাহা পুরাপুরি পালন ও অনুসরণ করিয়া চলিতে ও এক সঙ্গেই এই দুই ধরনের হক যথাযথভাবে আদায় করা যাইতে পারে। ইহা সাধারণভাবে ইসলামী জীবন পদ্ধতির দার্শনিক তত্ত্ব ও সত্য।

 

আলোচ্য হাদীসটিতে বিশেষভাবেইসলামী আদর্শবাদী একজন স্ত্রীলোকের জন্য এমনিই এক পূর্ণাঙ্গ ও দুই ধরনের হক আদায়কারী কর্মসূচী পেশ করা হইয়াছে। স্ত্রী লোকটি প্রথমেই আল্লাহর বান্দাহ। এই জন্য তাহাকে প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে একান্তভাবে চিহ্নিত আল্লাহর হক আদায় করিতে হইবে। এজন্য তাহাকে রীতিমত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করিতে হইবে ও বছরে রমযানের একটি মাস রোযা থাকিতে হইবে। এই দুইটি সুনির্দিষ্টভাবে আল্লাহর ইবাদত- আল্লাহর হক আদায়ের কর্মসূচী। এই কারণে এই দুইটির কথা হাদীসে প্রথমেই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে।

 

দ্বিতীয় পর্যায়ে বান্দাহর হক-এর কথা বলা হইয়াছে। বিবাহিতা স্ত্রীর অতীব নিকটবর্তী ব্যক্তি হইতেছে তাহার স্বামী। তাহার উপর অন্যান্য সকলের অপেক্ষা তাহার স্বামীর হক সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে মাত্র দুইটি কথা বলা হইয়াছে। একটি, *************** ‘সে তাহার যৌন অঙ্গ সুরক্ষিত রাখিয়াছে’। *********** শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে ********* হইতে। ইহার অর্থ দুর্গ। দুর্গ এক সুদৃঢ় সুরক্ষিত স্থান। সেখানে প্রবেশ করিতে পারে কেবল তাহারা যাহাদের জন্য প্রবেশানুমতি ও আইন ভিত্তিক প্রবেশাধিকার রহিযাছে। যাহাদের তাহা নাই, তাহারা উহাতে প্রবেশ করিতে পারে না। এই জন্য সশস্ত্র ব্যক্তিরা চব্বিশ ঘন্টা উহার পাহারা দিয়া থাকে। স্ত্রীর যৌন অঙ্গও দুর্গবৎ। দুর্গের মতই উহাকে সদা-সচেতন পাহারাদারীর মাধ্যমে রক্ষা করিতে হইবে। এই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্ত্রীলোকটির নিজের। উহার দ্বার উদঘাটন ও অনুপ্রবেশ করার অধিকার কেবল তাহাকেই দেওয়া যাইবে ও দিতে হইবে, যাহাকে  একটি বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান ও পারিবারিক-সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে তাহার স্বামীরূপে বরণ করিয়া লওয়া হইয়াছে। স্ত্রীর যৌন অঙ্গ কেবল তাহার স্বামীর জন্যই সুরক্ষিত রাখিবে। অন্য কাহারও উহার অনুপ্রবেশ বা উহা স্পর্শ তো দূরের কথা, উহা দেখিবার সুযোগও থাকিতে পারিবে না।

 

দ্বিতীয় বলা হইয়াছে, সে যদি তাহার স্বামীর আনুগত্য করে। আল্লাহ ও রাসূলের পরে স্ত্রীলোকের প্রধানত যাহাকে মানিতে হইবে, যাহার আনুগত্য করিতে হইবে, সে হইল তাহার স্বামী। স্বামীর আনুগত্য করিতে হইবে স্ত্রীকে, একথা ঠিক; কিন্তু সে আনুগত্য শর্তহীন ও অবাধ উন্মুক্ত নয়। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের সীমার মধ্যেই  স্বামীর আনুগত্য করিতে হইবে। আসলে ঈমানদার মানুষ আল্লাহ ও তাহার রাসূল ছাড়া আর কাহারও আনুগত্য করিতে পারে না। তবে স্বামী বা অন্য কাহারও আনুগত্য করা যাইবে- করিতে হইবে, কেননা তাহা করার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূল (স) দিয়াছেন। অতএব স্বামীর আনুগত্য আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য সীমার মধ্যে দৃঢ়ভাবে সীমিত।

 

মোটকথা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়িলে, রোযা থাকিলে, যৌন অঙ্গ কেবল স্বামীর জ্য সুরক্ষিত রাখিলে এবং স্বামীর আনুগত্য করিলে স্ত্রীর পক্ষে জান্নাতে যাওয়ার পথে অন্য কোন বাধার সম্মুখীন হইতে হইবে না। শুধু তহাই নয়, জান্নাতের দিকে তাহার গতি হইবে তীব্র ও দ্রুত এবং সে এই গতিতেই জান্নাতে চলিয়া যাইতে পারিবে। আর যে লোক দ্রুত ও তীব্র গতিতে জান্নাতে যাইতে পারিবে, তাহার মত সফল ও সার্থক অন্য কেহ হইতে পারে না। বস্তুত যে স্ত্রীর এই গুণাবলী আছে, যে স্ত্রী একই সময় ও একই জীবন ধারায় আল্লাহর হক ও স্বামী এবং সমাজের লোকদের হক পুরাপুরি আদায় করে এবং ইহার ফলে পরকালে জান্নাত লাভ করিতে পারিবে বলিয়া নিশ্চিত আশা করে, সেই উত্তম স্ত্রী।

 

উত্তম স্ত্রী বলিতে এইসব গুণের অধিকারী স্ত্রীকেই বুঝায়। (***************)

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]