হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পূর্বে স্বামীসঙ্গ প্রাপ্তা কনের স্পষ্ট আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাহাকে বিবাহ দেওয়া যাইবে না এবং পূর্বে স্বামী অ-প্রাপ্তা কনের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত তাহাকে বিবাহ দেওয়া যাইবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, উহার অনুমতি কিভাবে লওয়া যাইতে পারে? বলিলেনঃ তাহার চুপ থাকাই (অনুমতি)।
(মুসলিম, বুখারী, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির মূল বক্তব্য স্পষ্ট। ইহাতে বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে উদঘাটিত করা হইয়াছে। বিবাহ মূলত একটি মেয়ে ও একটি ছেলের নিজস্ব ব্যাপার হইলেও ইহা একটা বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে মেয়ে ও ছেলের অভিভাবকরাই সাধারণত কর্তৃত্ব করিয়া থাকে এবং সে কর্তৃত্বে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ছেলে ও মেয়ের- মূলত যাহাদের বিবাহ- মতামত, সন্তুষ্টি- অসন্তুষ্টি ও খুশী-অখুশীর প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করা বা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাহাদের উপর অভিভাবকদের জবরদস্তি ও নিপীড়নও চলে। তাহাদের ইচ্ছা ও মজীর বিরুদ্ধে ও কেবল অভিভাবকদের ইচ্ছানুক্রমেই বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতে দেখা যায়। কিন্তু ইহা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না। এইরূপ বিবাহ ছেলে বা মেয়ের- বর বা কনে যাহার মনেই সামান্য অনিচ্ছার বীজ বপিত থাকিবে, সে এই বিবাহকে অন্তর দিয়া কখনই গ্রহণ করতে পারিবে না। ফলে তাহাদের গোটা দাম্পত্য জীবনই তিক্ত বিষাক্ত এবং শেষ পর্যন্ত চরম ভাঙন ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইয়া পড়ে। এই কথা কেবল আরব জাহিলিয়াতের সমাজেই প্রচলিত ছিল না, বর্তমান সুসভ্য সমাজেও এইরূপ ঘটনার দৃষ্টান্ত নেহাত বিরল নয়।
কিন্তু মানব সমস্যার সুষ্ঠু নির্ভূল সমাধান ও সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য যাঁহার আগমন সেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান পেশ করিয়াছেন। তাঁহার এই ঘোষণা স্পষ্ট, অকাট্য এবং শরীয়াতের বিধান ইহার উপরই ভিত্তিশীল।
হাদীসবিদরা বলিয়াছেন, হাদীসের শব্দ ****** অর্থঃ ******* বিবাহিতা, স্বামী প্রাপ্তা, যে স্ত্রীর স্বামী মরিয়অ গিয়াছে, কিংবা তালাক পাইয়াছে। ইহার আরও কয়েকটি অর্থ রহিয়াছে। এই পর্যায়ের অন্যান্য হাদীস হইত তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠে। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসের ভাষা এইঃ
****************************************
পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়ে তাহার নিজের যাবতীয় (বিশেষ করিয়া বিবাহ) ব্যাপারে তাহার অভিভাবকের তুলনায় বেশী অধিকার সম্পন্না। আর পূর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা কুমারী মেয়ের নিকট বিবাহের নির্দেশ চাহিতে হইবে। আর তাহার অনুমতি হইল তাহার চুপ থাকা।
*********** শব্দের অর্থ ******** নির্দেশ বা সিন্ধান্ত চাওয়া, কিংবা ************ পরামর্শ করা, মত চাওয়া।
আর হযরত ইবনে আব্বাস হইতে অপর একটি সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে তাহার নিজের যাবতীয় ব্যাপারে তাহার অভিভাবকদের তুলনায় বেশী অধিকার সম্পন্না। আর পর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা কন্যার নিকট অনুমতি চাহিবে তাহার পিতা। আর তাহার অনুমতি হইল তাহার চুপ করিয়া থাকা। অনেক সময় বলা হয়, তাহার চুপ থাকাই তাহার স্বীকৃতি।
শরীয়াত বিশারদ কাজী ইয়াব বলিয়াছেন, ************ শব্দের আভিধানিক অর্থ হইল এমন মেয়ে লোক, যাহার স্বামী নাই, সে ছোট হউক বা বড়। অবিবাহিকা হউক, কি পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা। এই অভিধানিক অর্থের দৃষি।টতে এই শব্দটি পুরুষদের সম্পর্কেও ব্যবহৃত হয়। আরবী ভাষায় বলা হয়ঃ ****** স্ত্রীহীন পুরুষ, স্বামীহীনা মেয়ে। কিন্তু আলোচ্য হাদীসে ******* বলিয়া কি বোঝানো হইয়াছে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছন। বিশেষজ্ঞ ও ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, আলোচ্য হাদীসে *********** অর্থ ******* ‘স্বামী নাই এমন মেয়ে লোক’। তাঁহাদের দলীল হইল, প্রথমোক্ত হাদীসটিতে ******* বলিয়া যাহাদিগকে বুঝাইয়াছেন, অনান্য হাদীসে ***** বলিয়া ঠিক তাহাদিগকেই বোঝানো হইয়াছে। উপরন্তু এই দুইটি শব্দ প্রত্যেকটি হাদীসেই ******** এর বিপরীতে ব্যবহৃত হইয়াছে, আর *********** শব্দটির অধিক ব্যবহারও ******* অর্থেই হইয়া থাকে। কূফী ফিকাহবিদ ও ইমাম জুফার বলিয়াছেনঃ
****************************************
‘আল-আয়েম্ম’ বলিতে এখানে এমন প্রত্যেক মেয়েকে বুঝায়, যাহার স্বামী নাই। সে পূর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা হউক, কি স্বামী প্রাপ্ত।
এসব হাদীসের মূল বক্তব্য হইল, যে মেয়েই পূর্ণ বয়স্কা হইয়াছে, সে তাহার নিজস্ব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাহার অভিভাবক অপেক্ষা বেশী অধিকার সম্পন্না। আর সে নিজেই উদ্যোগী হইয়া যদি তাহার নিজের বিবাহ সম্পন্ন করে, তবে তাহার সম্পূর্ণ সহীহ হইবে। শ’বী ও জুহরী এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন। আর অভীভাবকদের কর্তৃত্ব পর্যায়ে তাঁহাদের মত হইলঃ
****************************************
কোন মেয়ের অভিভাক তাহার (মেয়ের) বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোন অপরিহার্য শর্ত নয়; বরং উহা বিবাহের পূর্ণত্ব লাভের অংশ বিশেষ।
ইমাম আওজায়ী আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদ বলিয়াছেন, পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়ের ইচ্ছাকৃত বিবাহের শুদ্ধতা অভীভাবকের অনুমতির উপর নির্ভরশীল। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, নবী করীম (স)-এর বাণী *********** এ কথার তাৎপর্যে মতভেদ রহিয়াছে। প্রশ্ন হইয়াছে, ‘সাইয়্যেবা’- ‘পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে তাহার বিবাহে তাহার অভিভাবকের অপেক্ষাও বেশী অধিকার সম্পন্না’ কোন ব্যাপারে? তাহা কি কেবল অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে, না অনুমতি দান ও নিজের বিবাহ সংঘটন- এই উভয় ব্যাপারে? জমহুর আলিমগণের মধ্যে কেবলমাত্র বিবাহের অনুমতির ব্যাপারেই তাহার অধিকার তাহার অভিভাবকের অপেক্ষাও বেশী। আর অন্যান্য ফিকাহবিদের মতে এই উভয় ব্যাপারেই তাহার অধিকার সর্বাধিক। নবী করীম (স)- এর বানী ********** শাব্দিক অর্থের দিক দিয়া ইহার অর্থ হইলঃ
****************************************
সে তাহার অভিভাবকের অপেক্ষা বেশী অধিকার সম্পন্ন সব ব্যাপারেই- বিবাহ সংঘটন করা ইত্যাদি।
ইমাম আবূ হানীফা ও দায়ূদ যাহেরীও এই মত দিয়াছেন। তবে রাসূলের এই কথাটির এ-ও অর্থ হইতে পারেঃ ************ ‘রাযী হওয়ার ব্যাপারে সে-ই বেশী অধীকার সম্পন্না’।অর্থাৎ সে যতক্ষণ পর্যন্ত সশব্দে অনুমতি দান না করিবে, ততক্ষণ তাহার বিবাহ সংঘটিত হইতে পারে না। পূর্বে স্বামী অপ্রাপ্তা- ********* - মেয়ের কথা ভিন্নতর। কিন্তু রাসূলে করীম (স)এর অপর একটি কথাও রহিয়াছে। তাহা হইল ************ অভিভাবক ছাড়া কোন মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতে পারে না’। এই পর্যায়ে রাসূলে করীমের আরও অনেক উক্তি রহিয়াছে। এই সব হাদীসের দৃষ্টিতে মেয়ে বিবাহ দেওয়ার ব্যাপারে অভীভাবকের সম্মতি জরুরী শর্ত বিশষ। তাই ‘মেয়ের বেশী অধিকার সম্পন্না হওয়া’ সংক্রান্ত আলোচ্য বাণীটির দ্বিতীয় অর্থ- ‘কেবলমাত্র বিবাহর চূড়ান্ত অনুমতি দানের ব্যাপারেই বেশী অধিকার সম্পন্না’ মনে করা সমীচীন।
এই পর্যায়ে আরও কথা হইল, রাসূলের কথা ********** শব্দটি মূলত অধিকারের ব্যাপারে অংশীদারিত্ব বুঝায়। অর্থাৎ ‘সাইয়্যেবা’ মেয়ে তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সম্পন্না। সেই সঙ্গে তাহার অভিভাবকদের এই ব্যাপারে মত দেওয়া ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উদ্যোগ-আয়োজন করার অধিকার রহিয়াছে। তবে এই দুইটি অধিকারের মধ্যে মেয়ের অধিকার অধিক প্রভাবশালী ও অগ্রাধিকার সস্পন্ন। কেননা অভিভাবক যদি মেয়েকে কোন উপযুক্ত ছেলের নিকট বিবাহ দিতে ইচ্ছা করে আর সে মেয়ে সেখানে অরাযী থাকে ও নিষেধ করে, তাহা হইলে সে বিবাহে মেয়েকে বাধ্য করা যাইবে না। আর মেয়ে নিজে যদি কোন উপযুক্ত ছেলের সহিত বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু অভিভাবক তাহাতে অরাযী হয়, তাহা হইলে সরকার মেয়ের মত অনুযায়ী বিবাহ দিতে অভিভাবককে বাধ্য করিতে পারিবে। ইহা শরীয়াতের সর্বসম্মত শাশ্বত বিধান। ইহা হ ইতেও মেয়ের বেশী অধিকার থাকার কথাটাই প্রমাণিত হয়।
এই পর্যায়ে হযরত খানসা (কিংবা খুনাস) বিনতে খিজাম বর্ণিত হাদীসটি স্মরণীয়। তিনি নিজে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
তাহার পিতা তাহাকে বিবাহ দেন, অথচ তিনি সাইয়্যেবা- পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা। তিনি এই বিবাহ পছন্দ করেন নাই- এই বিবাহে রাযী হন নাই। পরে তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিয়া তাহার অসম্মতি জানাইলে রাসূলে করীম (স) তাঁহার পিতার দেওয়া বিবাহকে প্রত্যাখ্যান করিয়া দেন।
মুসনাদে আহমাদে এই মেয়েটির পরিচয় দিয়া বলা হইয়াছে, এই মেয়েটির একবার বিবাহ হইয়াছিল। পরে সে স্বামীহীনা হয়। তখন তাহার পিতা তাহার মতের বিরুদ্ধে বিবাহ দেন। তখন এই বিবাহ বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়া নবী করীম (স) ফরমান জারী করিলেনঃ
****************************************
তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাহার অধিকারই বেশী। অতএব তাহাকে তাহার নিজের ইচ্ছামত স্বামী গ্রহণের জন্য ছাড়িয়া দাও।
ফলে এই মেয়েটি যাহাকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিল, তাহাকেই বিবাহ করিল।
ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়েকে তাহার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী গ্রহণে বাধ্য করা যাইবে না। করা হইলে তাহা সেই মেয়ের ইচ্ছামত বাতিল হইয়া যাইবে।
(***************)
কিন্তু মেয়ে সাইয়্যেবা- পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা নয়, কুমারী- তাহার প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র। এই পর্যায়ের মেয়ের বিবাহ ব্যাপারে রাসূলে করীম (স) এর পূর্বোদ্ধৃত বাণীর শেষাংশ। তাহা হইলঃ
****************************************
এই কথাটির সঠিক তাৎপর্য সম্পর্কে বিভিন্ন মতের উল্লেখ হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ী, ইবনে আবূ লাইলা, ইমাম আহমাদ ও ইসহাক প্রমুখ ফিকাহবিদগন বলিয়াছেনঃ কুমারী মেয়ের বিবাহে তাহার অনুমতির গ্রহণ করার জন্য শরীয়াতের স্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে। অভিভাবক যদি পিতা হয় কিংবা দাদা হয়, তাহা হইলে মেয়ের অনুমতি গ্রহণ মুস্তাহাব। এইরূপ ক্ষেত্রে অভিভাবক যদি মেয়ের মত জানিতে না চাহিয়াও বিবাহ দেয় তবে সে বিবাহ সহীহ হইবে। কেননা পিতা বা দাদা এমন অভিভাবক, কন্যার প্রতি যাহার স্নেহ মমতা ও সার্বিক কল্যাণ কামনা সকল প্রকার সন্দেহ বা প্রশ্নের উর্ধ্বে। অভিভাবক যদি পিতা বা দাদা ছাড়া অন্য কেহ হয়, তাহা হইলে মেয়ের সন্তুষ্টিমূলক অনুমতি গ্রহণ ওয়াজিব। এইরূপ অনুমতি ব্যতিরেকে মেয়ের বিবাহ কোনক্রমেই সহীহ হইতে পারে না। কিন্তু ইমাম আওজায়ী ও ইমাম আবূ হানীফা প্রমুখ কূফী ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
প্রত্যেক পূর্ণ বয়স্কা কুমারী মেয়ের বিবাহে তাহার অনুমতি গ্রহণ ওয়াজিব।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
পূর্ণ বয়স্কা ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্না মেয়ে যদি অভিভাবক ছাড়াই নিজে বিবাহিতা হয়, তবে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসুফের মতে তাহার এই বিবাহ কার্যকর হইবে। তবে ইমাম মুহাম্মদের মতে এই বিবাহ অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষ থাকিবে।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ তিনি বলিলেনঃ
****************************************
ইয়া রাসূল! কুমারী মেয়ে তো বিবাহের অনুমতি দিতে লজ্জাবোধ করে। তাহা হইলে তাহার অনুমতি পাওয়া যাইবে কিরূপে? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তাহার চুপ থাকাটাই তাহার অনুমতি ও রাযী থাকা বুঝাইবে।
মুসলিম শরীফে রাসূলে করীমের এই কথাটির ভাষা হইলঃ ************** ‘তাহার চুপ থাকাই তাহার অনুমতি’- এই কথাটি সাধারণভাবে প্রত্যেক বয়স্কা কুমারী মেয়ে এবং প্রত্যেক অভিভাবকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মেয়ের নিকট যথারীতি অনুমতি চাওয়া হইবে। অনুরূপভাবে অভিভাবকের সম্মতিও জানিতে চাওয়া হইবে। ইহাদের কেহ চুপ থাকিলে- হ্যাঁ বা না কিছু না বলিলে- ধরিয়া লইতে হইবে যে, প্রস্তাবিত বিবাহে তাহার অনিচ্ছা বা অমত নাই, বরং সম্মতিই রহিয়াছে। ইমাম নববী লিখিয়াছেন: ********************* ;ইহাই সঠিক, যথার্থ ও সহীহ বিধান’। অন্যান্য হাদীসবিদগণ লিখিয়াছেনঃ অভিভাবক যদি পিতা বা দাদা হয়, তাহা হইলে তাহার অনুমতি গ্রহণ মুস্তাহাব। জিজ্ঞাসার পর চুপ থাকিলে অনুমতি আছে বুঝিতে হইবে। কিন্তু অভিভাবক যদি এই দুইজন ব্যতিরেকে অন্য কেহ হয়- যেমন ভাই, চাচা, মামা, নানা ইত্যদি- তাহা হইলে মেয়ের স্পষ্ট সশব্দ উচ্চারিত অনুমতি আবশ্যক। কেননা মেয়ে পিতা বা দাদার নিকট লজ্জায় চুপ থাকিতে পারে; ইহা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অন্যদের বেলায় এই লজ্জার মাত্রা অতটা হওয়া স্বাভাবিক বিবেচিত হইতে পারে না। অবশ্য জমহুর হাদীস-ফিকাহবিদদের মতে, সব অভিভাবকের বেলায়ই কনের চুপ থাকাটা অনুমতির সমার্থবোধক হইবে। ইহাকে বলিতে হইবে ‘মৌন সম্মতি’। কেননা এ ব্যাপারে হাদীসের ভাষঅ সাধারণ ও ব্যাপক এবং লজ্জা কুমারী মেয়ের শালীনতার পরিচায়ক বিধায় সর্বক্ষেত্রেই প্রকট হইতে পারে। তবে অ-কুমারী- সাইয়্যেবার ব্যাপারে মৌন সম্মতি যথেষ্ট বিবেচিত হইবে না। সেখানে সশব্দ অনুমতির উচ্চারণ আবশ্যক, সে অভিভাবক যে-ই হউক না কেন। ইহাতে কোন মতবিরোধ নাই। কেননা ইতিপূর্বে একবার সে এইরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছে। সে বিবাহের ফলে স্বামী কর্তৃক সঙ্গমকৃত ও সতীত্বের আবরণ ছিন্ন হউক, আর না-হউক, তাহাতে কোন পার্থক্য হইবে না। শাফেয়ী ও অন্যান্য সব ফকহী মযহাবে একথা স্বীকৃত যে, কুমারী মেয়ের চুপ থাকাটাই যে তাহার সম্মতি ও অনুমতির সমার্থবোধক, এ কথা প্রকাশ করিয়া বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে মালিকী মাযহাবের কিছু সংখ্যক ফিকাহবিদ ইহার শর্ত করেন। ইহা প্রকাশ করা যে ভাল, সে বিষয়ে মালিকী মাযহাবের সকলেই একমত।
এখানে আর একটি প্রশ্ন আলোচিতব্য। তাহা হইল, বিবাহের শুদ্ধতায় অভিভাবকের অনুমতি কি শর্ত? এ প্রসঙ্গে ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেনঃ
****************************************
হ্যাঁ, অভিভাবকের সম্মতি ব্যতীত কুমারী মেয়ের বিবাহ সহীহ হইবে না। এই সম্মতি বিবাহের শুদ্ধতার জন্য শর্ত।
আর ইমাম আবূ হানীফা (র) বলিয়াছেনঃ
****************************************
অভিভাবকের সম্মতি ও অনুমতি অ-কুমারী-সাইয়্যেবা মেয়ের বিবাহ শুদ্ধ হওয়অর জন্য শর্ত নয়। কুমারী বালিগা মেয়ের ক্ষেত্রেও নয়। বরং কুমারী বালিগা মেয়ে তাহার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীতই নিজের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণ করিতে পারে।
ইমাম আবূ সওর বলিয়াছেন, কুমারী বালিগা মেয়ে তাহার অভিভাবকের অনুমতি লইয়া নিজের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিজেই লইতে পারে। কিন্তু অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাহা জায়েয নয়।
দায়ূদ যাহেরী বলিয়াছেন, কুমারী মেয়ের বিবাহে অভিভাবকের সম্মতি একটা জরুরী শর্ত। সাইয়্যেবা মেয়ের জন্য নয়।
ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ীর দলীল হইল, রাসূলে করীম (স)- এর প্রখ্যাত হাদীস ************* ‘অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নাই- হয় না’। এই কথাটির স্পষ্ট প্রতিপাদ্য হইল, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হইলে তাহা শুদ্ধ হইবে না। আর দায়ূদ বলিয়াছেনঃ মুসলিম শরীফের উপরোদ্ধৃত হাদীসে কুমারী ও অকুমারী মেয়ের বিবাহে সুস্পষ্ট পার্থক্য ঘোষিত হইয়াছে। সে অনুযায়ী সাইয়্যেবা নিজের ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। আর কুমারী মেয়ের অনুমতি লওয়ার শর্ত করা হইয়াছে।
শাফেয়ী, মাযহাবের পক্ষ হইতে ইহার জবাবে বলা হইয়াছে যে, অকুমারী- অর্থাৎ সাইয়্যেবা মেয়ে- ‘অধিক অধিকার সম্পন্না’ বলার অর্থই হইল এই অধিকার সম্পূর্ণ নিরংকুশ নয়। ইহাতে তাহার অধিকারের সঙ্গে অভিভাবকের অধিকারও স্বীকৃত। তবে একথা সঠিক যে, সাইয়্যেবা মেয়েকে অভিভাবকের মতে চাপ দিয়া বাধ্য করা যাইবে না। আর স্বামী কে হইবে তাহা নির্ধারণেও মেয়ের বকক্তব্যই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
আবূ সওর তাঁহার মতের সমর্থনে একটি হাদীসের উল্লেখ করিয়াছেন। হাদীসটি এইঃ
****************************************
যে মেয়েই তাহার অভিভাবকের অনমুতি ব্যতিরেকে বিবাহ করিবে, তাহারই সে বিবাহ বাতিল গণ্য হইবে।
ইহার যৌক্তিকতা এখানে যে, ওলী বা অভিভাবক সব সময়ই মেয়ের উপযুক্ত এবং ভাল বর-এর নিকট বিবাহ দিতে ইচ্ছুক ও সচেষ্ট থাকে। যেন পরে কোন দিক দিয়াই লজ্জার, অপমানের বা দুঃখের কারণ না ঘটে। এমতাবস্থায় অভিভাবকের অভিমত অনুযায়ী বিবাহ হইলে এই দিকটি পুরাপুরি রক্ষা পায়। কেননা অভিভাবক সর্বদিক বিচার করিয়াই বিবাহে অনুমতি দিবে, ইহাই স্বাভাবিক।
ইমাম তিরমিযী উপরোদ্ধৃত হাদীস নিজ গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়া ইহাকে ************* ‘উত্তম সনদভিত্তিক হাদীস’ বলিয়া নিজে মন্তব্য করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও তিনি লিখিয়াছেন, জুহরী বর্ণিত এই হাদীসটির সনদের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ আপত্তি তুলিয়াছেন। এই কারণে এই হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলা যাইতে পারে। স্বয়ং ইমাম জুহরীও এই হাদীসটিকে অপছন্দ করিয়াছেন। আর হাদীসের বর্ণনাকারী নিজেই যদি তাহার বর্ণিত হাদীসকে অপছন্দ করেন, তা হইলে সে হাদীসটি মিথ্যাও হইতে পারে, তাহাতে বিস্মৃতিও লাগিতে পারে। আর কোন হাদীসের ক্ষেত্রে তাহা ঘটিলে তাহা গ্রহণযোগ্যতা হারাইয়া ফেলে অনিবার্যভাবে।
(*************************)
এমতাবস্থায় বলা যায়, মেয়ের বিবাহ অভিভাবকের অনুমতির অপরিহার্যতা সহীহ হাদীস হইতে প্রমাণিত নয়।
ইমা আবূ হানীফা (র) ক্রয়-বিক্রয়ের উপর কিয়াস করিয়াছেন। অভিভাবক ছাড়াই যখন ক্রয় বিক্রয় করারও তাহার অধিকার রহিয়াছে, তখন তাহার নিজের বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাহার অধিকার অবশ্যই স্বীকার্য। যেসব হাদীসে অভিভাবকের অনুমতির শর্তের উল্লেখ রহিয়অছে, ইমাম আবূ হানীফার মতে তাহা কেবলমাত্র ক্রীতদাসী ও নাবালেগা মেয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এই পর্যায়ে সর্বশেষে উল্লেখ্য এই যে, নাবালেগা মেয়েল অভিভাবকরা তাহার বিবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিবাহ দিতে পারে। দিলে তাহা শরীয়াতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ জায়েয হইবে। নাবালেগা’র বিবাহ অবশ্য বাঞ্ছনীয় নয়। সর্বক্ষেত্রে তাহা শুভ পরিণতি আনিবে- সে দাবি করা যায় না।
(*******************)
****************************************
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একটি যুবতী মেয়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল। অতঃপর বলিলঃ ইয়া রাসূল! আমার পিতা আমাকে তাহার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিকট বিবাহ দিয়াছে। সে আমার দ্বারা তাহার নীচতা-হীনতাকে উচ্চ-উন্নত বাইতেছে। নবী করীম (স) এই ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করার দায়িত্ব তাহার উপর ন্যাস্ত করিয়া দিলেন। তখন মেয়েটি বলিলঃ আমার পিতা যাহা করিয়াছে আমি উহা অক্ষুন্ন, অব্যাহত ও অপরিবর্তিত রাখিলাম। কিন্তু আমার ইচ্ছা হইয়াছে, আপনি মহিলাদিগকে এই কথা শিক্ষা দিবেন যে, এই ক্ষেত্রে আসলে পিতাগণের কোন কিছু করার ক্ষমতা নাই।
(আবূ দায়ূদ, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকী দারে কুতনী)
ব্যাখ্যাঃ বায়হাকী ও দারে কুতনী বলিয়াছেন, এই হাদীসটি ‘মুরসাল’। অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রা) হইতে হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন আবদুল্লাহ ইবনে কুরাইদা। কিন্তু আবদুল্লাহ নিজে হযরত আয়েশা হইতে ইহা সরাসরি শুনিতে পান নাই। মাঝখানে একজন বর্ণনাকারী- অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রা) হইতে নিজে শুনিয়া যিনি ইহা প্রথম বর্ণনা করিয়াছেন, তাঁর নাম অনুল্লেখিত। কিন্তু তবুও হাদীস হিসাবে ইহা সহীহ। ইবনে মাজাহ গ্রন্হে ইহা সঠিক সনদে- আবদুল্লাহ তাঁহার পিতার মুরাইজা হইতে- হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। এই সন্দ নির্ভূল ও সহীহ।
হাদীস উল্লেখিত মেয়েটির অভিযোগের সারমর্ম হইল, তাহার পিতা তাহাকে নিজের পছন্দ মত পাত্রের নিকট বিবাহ দিয়াছে, এই পাত্র হইতেছে পিতার ভাই-পুত্র। অর্থাৎ মেয়েটির চাচাতো ভাই। কিন্তু ছেলেটি ছিল অত্যন্ত হীন ও নীচ স্বভাব-চরিত্রের লোক। মেয়েটি তাহাকে আদৌ পছন্দ করিতে পারে নাই। স্বামী হিসাবে তাহাকে মানিয়া লইতে তাহার মন প্রস্তুত হইতে পারিতেছিল না। এইরূপ বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, হীন-নীচ স্বভাব-চরিত্রের ছেলে ভাল স্বভাব চরিত্রের মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পাইলে সে হয়ত পরিণামে ভাল হইয়া যাইবে। কিন্তু মেয়েটি এই মতলবকে আদৌ সমর্থন করিতে পারে নাই। তাহার মতে ইহা অশোভন বিবাহ। সব কথা শুনিয়অ নবী করীম (স) এই বিবাহ ব্যাপারে কিছু একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ার মেয়েটিকেই দান করেন। অর্থাৎ বলেন, এই বিবাহ বহাল রাখা বা না রাখা ও ভাঙ্গিয়া দেওয়া মেয়েটির ইচ্ছাধীন। সে ইচ্ছা করিলে এই বিবাহ অস্বীকার করিতে ও ভাঙিয়াও দিতে পারে। মেয়েটি বলিল, আমার পিতা যাহা করিয়াছে আমি তাহা খতম করিয়া দিতে চাহিনা। পিতার অমর্যাদা হয় এমন কাজ আমি করিব না। কিন্তু ইহার মাধ্যমে নারীকূলের জন্য একটা নীতিমূলক শিক্ষা হইয়া যাওয়া উচিত। এই শিক্ষা আপনিই তাহাদিগকে দিবেন। সে শিক্ষাটি হইল, মেয়েদের বিবাহ শাদীর ব্যাপারে বাপদের নিজেদের ইচ্ছামত কিচু করার কোন অধিকার নাই।
হাদীস এইখানেই শেষ। মেয়েটির প্রস্তাব ও অনুরোধের জওয়াবে নবী করীম (স) কি বলিলেন বা কি করিলেন, এখানে তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই পর্যায়ের অন্যান্য বহু ঘটনা হইতেই একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এই প্রস্তাবটি নবী করীম (স)-এর নিকট আগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যঅন হয় নাই। মেয়েদের বিবাহের ব্যাপারে পিতাদের মৌলিকভাবেযে কিছুই করার নাই, মেয়েটির এই কথাকে নবী করীম (স) প্রত্যাখ্যান বা বাতিল করিয়া দেন নাই। উপরন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে মেয়ের নিজের মতের গুরুত্ব যে অনেক বেশী রাসূলে করীম (স) নিজে সেই গুরুত্ব দিয়াছেন, তাহা বহু সংখ্যক হাদীস ও হাদীসের উল্লেখিত ঘটনাবলী হইতে নিঃসন্দেহে জানা যায়। বস্তুত বিবাহে মেয়ের নিজের মতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী। এই ব্যাপারে বাপদের তেমন কোন ক্ষমতা বা ইখতিয়ার ইসলামী শরীয়াতে দেওয়া হয় নাই। ইসলামের বিবাহ বিধানেই এই কথা স্বীকার্য ও ঘোষিত।
হযরত জাবির (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
এক ব্যক্তি তাহার কুমারী কন্যাকে বিবাহ দেয়, কিন্তু সে তাহার কন্যার নিকট হইতে এই ব্যাপারে অনুমতি গ্রহণ করে নাই। পরে মেয়েটি নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া এই বিবাহে তাহার অনুমতি নেওয়া হয় নাই এবং ইহাতে তাহার মতও নাই বলিয়া জানায়। নবী করীম (স) সমস্ত কথা শুনিয়া এই বিবাহ বাতিল করেন এবং উভয়কে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেন।
(নাসায়ী)
ইহা হইতে স্পষ্ট জানা গেল, পূর্বে বয়স্কা কুমারী মেয়ের মত ও অনুমতি ছাড়াই যদি পিতা-ও তাহার ইচ্ছামত বিবাহ দেয়ে, তবে মেয়ে ইচ্ছা করিলে এই বিবাহ বাতিল করিবার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করিতে পারে এবং সরকার তদন্ত করিয়া ব্যাপার সত্য দেখিতে পাইলে এই বিবাহ ভাঙিয়া উভয়কে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করিয়া দিতে পারে। তবে বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়ার এই ইখতিয়ার নাবালেগা মেয়ের বালেগ হওয়ার মুহুর্ত পর্যন্ত সীমিত। সেই মুহুর্তে এই বিবাহের প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধতা না করিলে প্রমাণিত হইবে যে, সে এই বিবাহ মানিয়া লইয়াছে। তবে অতঃপর তাহা ভাঙিয়া দেওয়ার অধিকার থাকিবে না।