আবূল আজফা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত উমর ইবনূল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ তোমরা মেয়েদের মহরানা বেশী বেশী পরিমাণে ধার্য করিও না। কেননা বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করাই যদি দুনিয়ায় অধীক সম্মানজনক হইত এবং ইহাই যদি আল্লাহর নিকট তাকওয়া প্রমাণকারী হইত, তাহা হইলে তোমাদের অপেক্ষা রাসূলে করীম (স)-ই এইরূপ করার অধিক উপযুক্ত ছিলেন। অথচ নবী করীম (স) তাঁহার স্ত্রীদের কেহকে বিবাহ করার সময় কিংবা তাঁহার কন্যাদের মধ্যে কাহাকেও বিবাহ দেওয়ার সময় ‘বারো আউকিয়া’র অধিক পরিমাণে মহরানা ধার্য করিয়াছেন বলিয়া আমি জানিনা।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ উপরে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, ইহা হযরত উমর ফারুকের কথা। তিনি প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। সাহাবীর কথাও হাদীস, ইহা তাহার অকাট্য প্রমাণ। কেননা সাহাবীরা শরীয়াতের যে সব বিষয়ে কথা বলিয়াছেন তাহা সরাসরি রাসূলের কথার ভিত্তিতে বলিয়াছেন কিংবা রাসূলের নিকট হইতে জানিয়া লইয়া বলিয়াছেন। এই হাদীসটিতেও তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহার সত্যতা প্রমাণের জন্য রাসূল (স)-এর ‘বাস্তব আমল’কে ভিত্তি করিয়াছেন।হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) প্রথমতঃ বলিয়াছেনঃ ‘তোমরা বিবাহে মেয়েদের জন্য খুব বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করিও না’। কেন? তাহার প্রথম কারণ এই যে, বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করা হইলেই কাহারও জন্য অত্যাধিক সম্মান ও মর্যাদার কারণ হয় না। সেকাল হইতে একাল পর্যন্তকার লোকদের মধ্যে যাহারা নিজদিগকে শরীফ খান্দানের লোক বলিয়া আহমিকা বোধ করে, তাহাদের মধ্যে বেশী বেশী পরিমাণের মহরানা ধার্য করার প্রবণতা প্রকট হইয়া থাকিতে দেখা যায়। তাহারা মনে করে, আমরা যেহেতু শরীফ খান্দান- তথা উচ্চ বংশের এবং বড় লোক, অতএব আমাদের ঘরের মেয়ে বিবাহ করিতে হইলে অধিক পরিমাণে মহরানা দিতে হইবে এবং ইহারাই যখন অন্য ঘর হইতে মেয়ে বিবাহ করিয়া লইয়অ আসে তখনও খুব বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করে ও দিতে স্বীকৃত হয়। কেননা তাহাদের মতে কম পরিমাণেল মহরানা ধার্য করা হইলে শরাফতী প্রমাণিত হয় না। হযরত উমর (রা) বলিয়াছেন, এই মনোভাব ভিত্তিহীন ও এই শরাফতীবোধ সম্পূর্ণ অমূলক। তিনি দ্বিতীয়ত; বলিয়াছেন, ইহা দ্বারা খোদাভীতির মাত্রাতিরিক্ততাও প্রমাণিত হয় না। আর এই উভয় কথার যুক্তি হিসাবে তিনি বলিয়াছেনঃ মানব সমাজে রাসূলে করীম (স)- ই সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি। বেশী পরিমাণে মহরানা ধার্য করাই যদি অধিক মর্যাদা ও খান্দানী শরাফতীর লক্ষ্য হইত, তাহা হইলে তিনি নিজে ইহা করিতেন। তিনি নিজে যে সব বিবাহ করিয়াছেন তাহাতে বেশী পরিমাণ মহরানা দিতে রাযী হইতেন এবং তাঁহার কন্যাদের বিবাহেও বেশী বেশী মহরানা ধার্য করিতেন, কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই। তিনি মোটামুটি ভাবে বারো আউকিয়া-৪৮০ দিরহামের অধিক পরিমাণ মহরানা কোন ক্ষেত্রেই ধার্য করেন নাই। এই পরিমাণটা খুবই সাধারণ, অতএব মহরানা ধার্য করার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের কর্তব্য রাসূলে করীম (স)-এর আমলকে অনুসরণ করা। এই ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পরিবারিক জীবনে চরম ভাঙন ও বিপর্যয় আনিয়া দেয় অনিবার্যভাবে। আর যদি এক্ষেত্রে জবরদস্তি বা হঠকারিতা দেখানো হয়, তাহলে দাম্পত্য কলহ ও স্থায়ী অশান্তির কারণ হওয়া অবধারিত।
রাসূলে করীমের বেগম উম্মুল মু’মিনীন উম্মে হাবীবার মহরানা ছিল চার হাজার দিরহাম, একথা ঠিক। কিন্তু এই পরিমাণ মহরানা রাসূলে করীম (স) নিজে দেন নাই, দিয়াছেন রাসূলে করীম (স)-এর পক্ষ হইতে আবিসিনীয়ার বাদশাহ নাজাশী। কাজেই ইহা হযরত উমর ফারুকের কথার আওতাবহির্ভূত। এই পরিমাণ মহরানা নবী করীম (স) কর্তৃক ধার্যকৃতও নয়। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) তাঁহার বেগমদের জন্য দেওয়া মহরানা ছিল বারো আউকিয়া ও অর্ধ আউকিয়া। আর ইহাতে মোট পাঁচ শত দিরহাম হয়। রাসূলে করীম (স)-এর দেওয়অ মহরানা গড়ে ইহাই ছিল।
কিন্তু এই পরিমাণটাও মোটামুটিভাবে হযরত উমর (রা) কথিত মহরানা পরিমাণের অধিক নয়। বড় জোর এতটুকু বলা যায়, হযরত আয়েশা (রা)- এর বর্ণনায় যে অর্ধ আউকিয়ার কথা আছে, তাহা তিনি গণ্য করেন নাই। অতএব এই দুইটি বর্ণনার মধ্যে কোনই বিরোধ বৈপরীত্য নাই। আর ইহাও হইতে পারে যে, হযরত উমর (রা) হয়ত উম্মে হাবীবা ও হযরত আয়েশার এই বর্ণনার কথা জানিতেন না। কিন্তু ইহাতে মৌলিক পার্থক্য এই জন্য নাই যে, তিনি তো রাসূলের দেওয়া মহরানা-পরিমাণের অধিক ধার্য করিতে নিষেধ করিয়াছেন মাত্র এবং তাহা নিঃসন্দেহে যথার্থ।
এখানে প্রশ্ন উঠিতে পারে, কুরআন মজীদে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
এবং তোমরা দিয়অছ তোমাদের কোন এক স্ত্রীকে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ মহরানা স্বরূপ, তাহা হইল উহা হইতে একবিন্দুও ফিরাইয়া লইও না।
*********** শব্দের অর্থ বিপুল সম্পদ।
ইহা হইতে বুঝা যায়, মহরানা স্বরূপ বিপুল ধন-সম্পদও দেওয়া যাইতে পারে। তাহা হইলে হযরত উমর (রা)- এর উপরোক্ত কথা কুরআনের এই কথার বিপরীত হয় না কি?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এই প্রশ্নই এক বর্ণনানুযায়ী হযরত উমর (রা)- এর উপরোক্ত ভাষণের পর পরই উত্থিত হইয়াছেঃ হযরত উমর (রা) যখনই উক্ত কথা বলিয়াছেন তখনই মজলিস হইতে একজন মহিলা দাঁড়াইয়া বলিলেনঃ
****************************************
হে উমর! আল্লাহ (সুবহানাহু) তা’আলা তো আমাদিগকে দিতেছেন আর আপনি আমাদিগকে বঞ্চিত করিতেছেন? আল্লাহ সুবহান কি বলেন নাই? ‘আর তোমরা কোন স্ত্রীকে যদি বিপুল ধন-সম্পদ দিয়অ থাক, তাহা হইলে উহা হইতে কিছুই ফিরাইয়া লইও না’?
তখন হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ ******* ‘একটি মেয়ে লোক ঠিক বলিয়াছে আর উমার ভুল করিয়াছে’। অন্য বর্ণনার ভাষা হইলঃ ********** মেয়েলোক ঠিক বলিয়াছে আর পুরুষ ভূল করিয়াছে’। *********** ‘অতঃপর তিনি বেশী মহরানা ধার্য অস্বীকার করা পরিহার করিয়াছেন’।
এই বর্ণনাটি ইমা কুরতুবী তাঁহার তফসীরে উদ্ধৃত করিয়াছেন। কিন্তু তিনি ইহা কোন গ্রন্হ হইতে গ্রহণ করিয়াছেন তাহার উল্লেখ করেন নাই। উপরে তিরমিযী হইতে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহাতে এই কথার উল্লেখ নাই। আবূ হাতিম আল বুস্তী তাঁহার সহীহ মুসনাদ গ্রন্হে এই আবুল আজফা হইতেই এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করিয়াছেন; কিন্তু তাহাতেও কুরতুবী উদ্ধৃত অংশের উল্লেখ নাই। ইবনে মাজাহ গ্রন্হেও আবুল আজফা হইতে বর্নিত এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু তাহাতেও মেয়ে লোকের আপত্তি করা ও হযরত উমরের ভূল (?) স্বীকার করা সংক্রান্ত বিবরণের কোনই উল্লেখ নাই।
সে যাহাই হউক, এই আয়াতের দৃষ্টিতেও হযরত উমরের কথার বাতুলতা প্রমাণিত হয় না। কেননা আয়াত হইতে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ স্ত্রীকে মহরানা স্বরূপ দেওয়া বড়জোর শুধু জায়েযই প্রমাণিত হইতে পারে; কিন্তু তাহা করাই যে উত্তম ও মঙ্গলজনক, তাহা বুঝায় না। অথচ হযরত উমরের সমস্ত কথা উত্তম ও কল্যাণময় পরিমাণ সম্পর্কে, কতটা জায়েয আর কতটা নাজায়েয সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নাই।
অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় উদ্ধৃত হইয়াছে, হযরত উমর (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা স্ত্রীদের মহরানা চল্লিশ আউকিয়ার বেশী ধার্য করিও না। যদি কেহ বেশী ধার্য করে তাহা হইলে অতিরিক্ত অংশ আমি বায়তুল মালে জমা করিয়া দিব।
ইহাতে চল্লিশ আউকিয়া ন্যুন্য পরিমাণ বলা হইয়াছে। কিন্তু এই বর্ণনাটি ********* বিচ্ছিন্ন সনদ সূত্রে উদ্ধৃত হইয়াছে। অবশ্য মসরুক হইতে ‘মুত্তাসিল’ সূত্রে এই বর্ণনাটি-ই বর্ণিত হইয়াছে। মুহাদ্দিস সাইয়্যিদ জামালুদ্দীন তাঁহার ‘রওজাতুল আহবাব’ গ্রন্হে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত ফাতিমার মহরানা ধার্য করা হইয়াছিল চার শত মিসকাল রৌপ্য।
কিন্তু ইবলুল হুম্মাম উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত ফাতিমা (রা)-এর মহরানা চার শত দিরহাম ছিল।
কাজেই প্রথমোক্ত কথা গ্রহণযোগ্য নয়। আসলে হযরত আলী (রা) ফাতিমার মহরানা বাবত তাহার একটি বর্ম দিয়াছিলেন। উহা বিক্রয় করিয়া যে মূল্য পাওয়া গিয়াছিল তাহাই ছিল হযরত ফাতিমার মহরানা।
(********************)
ন্যূন্য পরিমাণ মহরানা
ন্যুন্য পরিমাণ মহরানা সম্পর্কে বহু কয়টি হাদীস বর্ণিত ও গ্রন্হ সমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে। একটি হাদীসঃ
****************************************
হযরত জাবির (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ দশ দিরহামের কমে কোন মহরানা নাই।
ব্যাখ্যাঃ আল্লামা আবূ বকর আল জাসসাস, হানাফী এই হাদীসের ভিত্তিতে বলিয়াছেন, মহরানার ন্যূন্যতম পরিমাণ দশ দিরহাম। দশ দিরহামের কম পরিমাণে মহরানা ধার্য হইলে বিবাহ সহীহ হইবে না। তিনি ইহার সমর্থনে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
****************************************
হযরত আলী (রা) বলিয়াছেনঃ দশ দিরহামের কমে কোন মহরানা নাই।
আল্লামা জাসসাস বলিয়াছেন, মহরানা আল্লাহর নির্ধারিত হক। কিন্তু উহার পরিমাণটা যে কি, তাহা ইজতিহাদের মাধ্যমে জানা যায় না। উহা জানার উপায় হইল শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত। আর ইহার পরিমাণ হইল দশ দিরহাম। এই বিষয়ে অন্তত এতটুকু বলা যায় যে, ইহা শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত হইতে জানা গিয়াছে। এইরূপ বলার দৃষ্টান্ত শরীয়াতেই রহিয়াছে। যেমন হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ হায়েযের ন্যূন্যতম মিয়াদ হইল তিন দিন এবং বেশীর পক্ষে দশ দিন। আর উসমান ইবনে আবুল আচ আস-সাকাফী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নিফাসের মিয়াদ বেশীর পক্ষে চল্লিশ দিন। আর ইহা শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত হইতে জানা গিয়াছে। কেননা এইরূপ কখনও চিন্তা কল্পনা প্রসূত হইতে পারে না। হযরত আলী (রা)- এর আর একটি বর্ণনা এই রূপঃ
****************************************
নামাযের শেষে তাশাহুদ পাঠ পরিমাণ সময় বসিয়া থাকিলেই নামায সম্পুর্ণ হইয়া গেল।
বুঝা গেল, তাশাহুদ পরিমাণ বসার ফরযটির এই সময় পরিমাণ শরীয়াতের জ্ঞান ও ইংগিত হইতে জানা গিয়াছে।
হানাফী মযহাবের কেহ কেহ দশ দিরহামের মহরানা হওয়ার দলীল এই দিয়াছেন যে, স্ত্রীর যৌন অস্থ ব্যবহার মুবাহ হইতে পারে কোন মাল-সম্পদের বিনিময়ে। ফলে এই ব্যাপারটি চোরের হাত কাটার সহিত সদৃশ হইয়া গেল। হাতও একটা অঙ্গ। উহার কর্তন মুবাহ হইতে পারে কোন মাল-সম্পদ চুরির কারণে। আর এই সম্পদের মূল্য পরিমাণ ন্যূন্য পক্ষে দশ দিরহাম। মহরানার ব্যাপারটিও এইরূপ। দ্বিতীয় কথা, এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, স্ত্রীর যৌন অঙ্গ সম্ভোগ একজন পুরুষের জন্য মুবাহ হইতে পারে বিনিময় মূল্য দেওয়া হইলে। মতবিরোধ শুধূ নূন্যতম পরিমাণ লইয়া। কাজেই ইহার মীমাংসা হইতে পারে এমন জ্ঞানের ভিত্তিতে যাহা শরীয়াত হইতে উৎসারিত। উহা মুবাহ হইবে না যতক্ষণ না উহা জায়েয হওয়ার কোন দলীল পাওয়া যাইবে। এই দলীল হইতেই জানা গিয়াছে দশ দিরহাম। এই পরিমাণটা সর্বসম্মত। এই পরিমাণের কমে মতভেদ রহিয়াছে।
(**************)
কিন্তু মহরানার ন্যুন্যতম পরিমাণ পর্যায়ে হানাফী মাযহাবের বিশেষজ্ঞদের এই সব যুক্তি-জাল ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যায় যখন হাদীস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হযরত আলী (রা) বর্ণিত এসব হাদীসের বিচার-বিবেচনা করা হয়। হযরত জাবির বর্ণিত যে হাদীসটি দারে কুতনী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে বলা হইয়াছে ********* ‘দশ দিরহামের কমে কোন মহরানা হইতে পারে না’। ইহাকে সনদের দিক দিয়া সহীহ মনে করা গেলেও ইহা সেই সব সহীহ হাদীসের পরিপন্হী যাহা হইতে ইহার কমেও মহরানা হইতে পারে বলিয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। কিন্তু সনদের বিচারে এই হাদীসটি সহীহ নয়। কেননা ইহার সনদে মুবাশশির ইবনে উবাইদ ও হাজ্জাজ ইবনে আরতাত দুইজন বর্ণনাকারীই যয়ীফ। আর হাজ্জাজ ‘তাদলীস’ [তাদলীস-*********** হাদীসের বর্ণনাকারী উপরের বর্ণনাকারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন বটে; কিন্তু তাহার নিকট হাদীস শুনিতে পায় নাই, তাহা সত্ত্বেও তাহার নিকট হইতে শুনিয়াছেন ভুলবশতঃ এই কথা মনে করিয়অ তাহার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করা। অথবা তাহার নিকট হইতে কিছু শুনিয়াছেন বটে; কিন্তু যাহা শুনিয়াছেন তাহার পরিবর্তে অন্য কিছু তাহার সূত্রে বর্ণনা করা। হাদীস শাস্ত্রে ইহা অত্যন্ত কঠিন ঘৃণ্য কাজ। উস্তাদের নাম বা উপনাম কিংবা গুণ এমন ভাষায় উল্লেখ করা যাহাতে তাঁহাকে চিনিতে পারা না যায়, ইহাও তাদলীস। তবে ইহা প্রথম প্রকারের তুলনায় কতকটা হালকা ধরনের।] করে বলিয়া প্রখ্যাত এবং মুবাশশির পরিত্যাক্ত- তাহার বর্ণিত হাদীস অগ্রহণযোগ্য। ইমাম দারে কুতনী নিজেই ইহা বলিয়াছেন। ইমাম বুখারী বলিয়াছেনঃ *********** [সিকাহ বর্ণনাকারী অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য হাদীসের বিপরীত হাদীস বর্ণনা করে এবং একাকী অত্যন্ত যয়ীফ হাদীস বর্ণনা করিতে অভ্যস্থ।]। ইমাম আহমাদ বলিয়াছেন, তাহার বর্ণিত অপরাপর বর্ণনা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আর হযরত আলী (রা)- এর উপরোদ্ধৃত কথাটি বায়হাকী গ্রন্হে উদ্ধৃত। ইহার সনদে রহিয়াছে দায়ূদ আল-উয়াদী, এই নামটি দুইজন লোককে বুঝায়। একজন দায়ূদ ইবনে জায়দ। সে সর্বসম্মতভাবে যয়ীফ। আর দ্বিতীয় জন দায়ূদ ইবনে আবদুল্লাহ। ইমাম আহমাদ তাহাকে সিকাহ ও বিশ্বাস্য বলিয়াছেন বটে; কিন্তু ইয়অহইয়অ ইবনে মুয়ীন হইতে তাঁহার সম্পর্কে বিভিন্ন মত বর্ণিত হইয়াছে। বায়হাকী হযরত জাবির (রা) বর্ণিত কথাটিও উদ্ধৃত করিয়াছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বলিয়া দিয়াছেন *********** ইহা যয়ীফ হাদীস। হযরত আলী (রা) হইতে উক্ত কথাটি অন্য একটা সূত্রেও বর্ণিত হইয়াছে। তাহাতে আবূ খালেদ আল-ওয়াসেতী নামের একজন বর্ণনাকারী আছেন। কিন্তু ইহা একটি দূর্বল সূত্র। ইহাকে দলীল হিসাবে পেশ করা যাইতে পারে না। যদি একথা বলা হয় যে, বহু কয়টি যয়ীফ হাদীসও মিলিত হইয়া শক্তিশালী হইয়া উঠে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, এই যয়ীফ হাদীসগুলি মিলিত হইয়াও এমন পর্যায়ে পৌঁছে না, যাহা বিশ্বাসযোগ্য হইতে পারে। (আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এই কথার জবাবে বলিয়াছেনঃ যয়ীফ হাদীস যদি এমন সূত্রে বর্ণিত হয় যাহা ‘হাসান’ হইয়া যায়, তাহা হইলে উহাকে দলীল হিসাবে পেশ ও গ্রহণ করা যাইতে পারে) বিশেষত এই দুর্বল হাদীস সমুহের প্রতিপাদ্য যখন বুখারী মুসলিম বর্ণিত সহীহতম হাদীসেরও পরিপন্হী, তখনই এইগুলিকে গণনার যোগ্য মনে করা যায় না। দ্বিতীয়ত ন্যূন্যতম পরিমাণ পর্যায়ে আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ হইতেই ভিন্নতর কথা বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর বলিয়াছেন, পঞ্চম দিরহাম। নখয়ী বলিয়াছেন, চল্লিশ দিরহাম। ইবনে শাবরামাতা বলিয়াছেন, পাঁচ দিরহাম। ইমাম বলিয়াছেন, এক দীনারের এক চতুর্থাংশ.. ইত্যাদি। সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব তাঁহার কন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন মাত্র দুই দিরহাম মহরানার বদলে। আর আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) মাত্র পাঁচ দিরহাম মহরানায় বিবাহ করিয়াছিলেন।
কাজেই এই সব বিতর্কে না পড়িয়া সহজ ও সোজা মত এই হইতে পারে যে, বর ও কনে-বরপক্ষ ও কনে পক্ষের পারস্পরিক মতের ভিত্তিতে যে পরিমাণটাই ধার্য হইবে, তাহাই সঠিক মহরানা বিবেচিত হইবে। কয়েকজন প্রখ্যাত ফিকাহবিদ এই মত প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেনঃ
****************************************
সংশ্লিষ্ট লোকেরা পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও শুভেচ্ছার ভিত্তিতে যে পরিমাণটা ধার্য করিবে, তাহাই সঠিক মহরানা।
আহমাদ ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী উদ্ধৃত ও আমের ইবনে রবীয়াতা বর্ণিত হাদীস হইতে দুই জুতাকে মহরানা ধার্য করিলেও বিবাহ সহীহ হয় বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।