হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে ‘প্রয়োজন সময়ের ভাষণ’ শিক্ষা দিয়াছেন। তাহা-এই যে, প্রথমে পড়িতে হইবে (মূলের তরজমা): ‘সমস্ত তা’রীফ আল্লাহন জন্য তাঁহারই সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁহার নিকট ক্ষমা চাহি। আমরা সকলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি আমাদের মন ও প্রবৃত্তির সমস্ত দুষ্কৃতি হইতে। আল্লাহ যাহাকে হেদায়েত দেন, তাহার ভ্রষ্টকারী কেহ নাই।, আর তিনি-ই যাহাকে ভ্রষ্ট করেন, তাহার হেদায়াতকারী কেহ নাই। আমি সাক্ষ্য দিতেছি, আল্লাহ ছাড়া কেহ মা’বুদ নাই। আমি এই সাক্ষ্যও দিতেছি যে, হযরত মুহাম্মদ তাঁহার বান্দাহ ও রাসূল। অতঃপর তিনটি আয়াত পরপর পড়িতে হইবে। (১) হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমন ভয় তাঁহাপকে করা উচিত এবং তোমরা মুসলমান অবস্থা ছাড়া মৃত্যু মুখে পতিত হইও না। (২) হে মানুষ! তোমরা ভয় কর তোমাদের রবকে, যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন একই ব্যক্তিসত্তা হইতে এবং তাহা হইতেই সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার জুড়ি। আর এই দুই জনের সম্মিলনের ফলে ছড়াইয়া দিয়াছেন বিপুল সংখ্যক পুরুষ ও নারী। তোমরা ভয় কর আল্লাহকে, যাঁহার দোহাই দিয়া তোমরা পরস্পরের নিকট কিছু চাও এবং রেহেমকে- আল্লাহ নিঃসন্দেহে তোমাদের পর্যবেক্ষক হইয়া আছেন। (৩) হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ভয় কর আল্লাহকে এবং বল সত্য যথার্থ কথা, তাহা হইলে তিনি তোমাদের কাজ কর্ম ভাল কল্যাণময় করিয়া দিবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ মাফ করিয়া দিবেন। আর যে লোক আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, সে বিরাট সাফল্য লাভে ধন্য হয়। ইহা পড়ার পর তোমার প্রয়োজনের কথা বল।
(মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী, হাকেম, বায়হাকী)
ব্যাখ্যাঃ ইহা রাসূলে করীম (স)-এর শিক্ষা দেওয়া একটা ভাষণ। হাদীসের মূল ভাষায় ইহাকে ************** ‘প্রয়োজনের ভাষণ’ বলা হইয়াছে। বিবাহও মানব সমাজের একটা বিরাট প্রয়োজন। তাই হাদীসে উদ্ধৃত সমস্ত ভাষণটি বিবাহ অনুষ্ঠানকালে পাঠ করার স্থায়ী নিয়ম হিসাবে গৃহীত হইয়াছে।
এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী শু’বা। তিনি আবূ ইসহাকের নিকট হইতে এই হাদীসটি শুনিয়াছিলেন। তিনি আবূ ইসহাককে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
****************************************
এইসব কথা কি বিবাহ-ভাষণে বলিতে (বা পড়িতে) হইবে? না উহা ছাড়া অন্য প্রসঙ্গেও পড়া যাইবে?
তিনি জবাবে বলিলেনঃ *************** সর্বপ্রকার প্রয়োজন কালেই এই খোতবা পড়া যাইতে পারে।
তিরমিযী’র বর্ণনায় ইহাকে বলা হইয়াছে ************- সাক্ষ্যদান। সে বর্ণনার শুরুতে বলা হইয়াছে; হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে নামায পড়ার তাশাহুদ এবং প্রয়োজনে পড়ার তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়াছেন।
অতঃপর নামাযের তাশাহুদ হিসাবে আততাহিয়্যাতু উদ্ধৃত হইয়াছে এবং প্রয়োজনের তাশাহুদ হিসাবে উপরোক্ত ভাষণটির উল্লেখ হইয়াছে। ‘তাশাহুদ’ শব্দের অর্থ সাক্ষ্যদান। নামাযের আততাহিয়্যাতুতে এবং উপরোদ্ধৃত ভাষণে যেহেতু আল্লাহর তাওহীদের ও রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য উদ্ধৃত হইয়াছে, এই কারণে এই সমস্ত বর্ণনাকে ‘তাশাহুদ’ বলা হইয়াছে।
বস্তুত ইহা বিবাহে ‘ঈজাব’ ‘কবুল’ হওয়াকালীন ভাষণ এবং এই ভাষণ রাসূলে করীম (স) শিক্ষা দিয়াছেন। অতএব বিশেষ করিয়া বিবাহকালে ইহা পড়া বাঞ্ছনীয়। বায়হাকীর বর্ণনার শুরুতেই স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তোমাদের কেহ যখন বিবাহ ইত্যাদি প্রয়োজনে ভাষণ দিতে ইচ্ছা করিবে তখন সে বলিবে।
এই ভাষণে পরপর তিনটি আয়াত পড়ার শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে। তন্মধ্যে প্রথম আয়াতটিতে ঈমানদার লোকদিগকে দুইটি কথা বলা হইয়াছে। একটি হইল, আল্লাহকে ভয় কর- যেমন ভয় আল্লাহকে করা উ চিত। আল্লাহই স্রষ্টা, রিযিকদাতা, রক্ষাকর্তা, জীবন ও মৃত্যুদাতা, অতএব তাঁহাকে সর্বাধিক ভয় করা- প্রতি মুহূর্তে ভয় করিতে থাকা বাঞ্ছনীয়। আর দ্বিতীয় কথা হইল, তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মরিও না। ‘মুসলিম’ অর্থ বাস্তবভাবে আল্লাহর আনুগত্য, খোদার আইন-বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনকারী। আর মৃর্তু কখন আসিবে তাহা যেহেতু কাহারও জানা নাই। তাই সব সময়ই আল্লাহর অনুগত হইয়া থাকা আবশ্যক, যেন যে মুর্হর্তে মৃত্যু আসিবে, সে মুহূর্তে সে ‘মুসলিমৱ হইয়া থাকিতে ও মরিতে পারে।
দ্বিতীয় আয়াতটিতে, প্রথমে আল্লাহকে ভয় করিতে বলা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, তিনিই প্রথমে একজন পুরুষ মানুষ বানাইয়া ও তাহা হইতেই তাহার স্ত্রী জুড়ি বানাইয়া মানব বংশের ধারা প্রবাহের সূচনা করিয়া দিয়াছেন এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষ এই ধারা হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। আয়াতটির শেষের দিকে পুনরায় আল্লাহকে ভয় করিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘রেহেম’ পারস্পরিক রক্ত সম্পর্ককেও ভয় করিত ও উহার হক্ক আদায় করিতে, উহার মর্যাদা রক্ষা করিতে বলা হইয়াছে।
তৃতীয় আয়াতটিতেও প্রথমে আল্লাহকে ভয় করিতে বলা হইয়াছে এবং জীবনের সমস্ত কাজ সুষ্ঠূ সুন্দর ও নির্ভুল করার এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সত্য সঠিক কথা বলিবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। সেই সঙ্গে একথাও বলা হইয়াছে যে, খোদা ও রাসূলের আনুগত্য করিলেই জীবনের সাফল্য সম্ভব।
এই আয়াত তিনটির মূল কথাগুলি বিবেচনা করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, বিবাহকালীন ভাষণ প্রসঙ্গে এই তিনটি আয়াত পাঠ করিয়অ শুনানো এবং বর ও মজলিসে উপস্থিত সমস্ত মানুষকে এই কথাগুলি বুঝাইয়া দেওয়ার গভীর তাৎপর্য এবং ‘সুদূরপ্রসারী শুভ প্রভাব নিহিত রহিয়াছে। বিবাহ অর্থ নূতন পরিবারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা। পরস্পর পূর্ব অপরিচিত, ভিন্ন ভিন্ন পরিবার পরিবেশের- পরস্পরের জন্য হারাম দুইটি নারী-পুরুষ এই বিবাহের মাধ্যমেই একত্রিত, পরস্পর পরিচিত, নিবিড় ঘনিষ্ঠ ও পরস্পরের জন্য হালাল হইয়া যায় এই বিবাহের মাধ্যমেই এই সময় এই কথাগুলি যদি উভয়ের মনে দৃঢ়মূল করিয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে উভয়ের পক্ষে একত্রিত জীবনে ইসলামী আদর্শ পুরাপুরি অনুসরণ করিয়া চলা সম্বব ও সহজ হইবে বলিয়া খুব-ই আশা করা যায়। ইসলামী আদর্শের উপর পরিবার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইহা জরুরী।
(*****************)
বিবাহে এই খোতবা পড়া কি? ইহা না পড়িলে কি বিবাহ হয় না? ইহার জবাবে প্রথমে বলিতে চাই, ফিকাহর খুঁটিনাটি প্রশ্ন না তুলিয়া সোজাসুজি চিন্তা করা দরকার, রাসূলে করীম (স) নিজে ইহা শিক্ষা দিয়াছেন এবং পড়িয়াছেন ও। আর ইহাতে যে সব কথা বলা হয়, তাহা মুসলিম নব দম্পতির পক্ষে খুবই প্রেরণাদায়ক ও উদ্বোধক। দ্বিতীয় বলিতে চাই, এই খোতবা পাঠ না করিলে বিবাহ শুদ্ধ হইবে না এমন কথা নয়। রাসূলে করীম (স)ও এই খোতবা ছাড়া বিবাহ পড়াইয়াছেন। বনু সুলাইম বাংশের এক ব্যক্তি (নাম অজ্ঞাত) বলিয়াছেন আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আবদুল মুত্তালিব কন্যা আমামাতাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলে তিনি তাহা মঞ্জুর করিলেন। *************** তিনি আমার বিবাহ পড়াইলেন, কিন্তু তাহাতে তাশাহুদ- বিবাহের খোতবা- পড়িলেন না। এই হাদীসটি আবূ দায়ূদ ও বুখারীও উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন ইহার মূলসুত্র অজ্ঞাত। ইমাম শাওকানী বলিয়াছেন, মূল বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম জানা না গেলেও বিশেষ দোষ নাই। ইবনে হাজার আল-আসকালানী সহল ইবনে সায়াদ সায়েদীর হাদীস উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছেনঃ
****************************************
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, প্রথমে খোতবা পড়া বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়।
অবশ্য জাহেরী মতের ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেনঃ বিবাহের পূর্বে খোতবা পাঠ ওয়াজিব। শাফেয়ী মাযহাবের আবূ আওয়ানাও এই মতই পোষণ করেন। তিনি তাঁহার হাদীস গ্রন্হে একটি শিরোনামা দিয়াছেন এই ভাষায় ************** বিবাহের আকদ হওয়ার সময় খোতবা পড়া ওয়াজিব।
(*********************)\r\nইমাম তিরমিযী উপরোদ্ধৃত হাদীসটি লেখার পর লিখিয়াছেনঃ
****************************************
খোতবা ছাড়াও বিবাহ জায়েয- সহীহ। সুফিয়ান সওরী প্রমুখ হাদীস ও ফিকাহবিদগণ এই মত দিয়াছেন। তাহা হইলে এই খোতবা পাঠ মুস্তাহাব মনে করিতে হইবে।