হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে মেয়েই কোন মহরানা কিংবা কোন দান বা অন্যান্য দ্রব্যাদির ভিত্তিতে বিবাহিত হইবে বিবাহ-বন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে, তাহা সবই সেই মেয়ের হইবে। আর যাহা বিবাহ বন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দেওয়া হইবে। তাহা সে পাইবে, যাহাকে সেই জিনিস দেওয়া হইয়াছে। ব্যক্তি তাহার কন্যার বা বোন হওয়ার কারণে সম্মানিত হইবার অধিক অধিকারী।
(আবু দায়ূদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী।)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে যে বক্তব্য রাখা হইয়াছে তাহা মোটামুটিভাবে এই যে, কোন মেয়ের বিবাহের কথ-বার্তা পাকপাকি হইয়া গেলে এবং তাহার মহরানাও নির্দিষ্ট হইলে তখন বর পক্ষ হইতে যাহা কিছু দেওয়া হইবে, তাহা মহরানা বাবদ হউক কিংবা নিছক দান হউক বা এই দান পর্যায়ের অন্য যে কোন জিনিসই দেওয়া হইবে, তাহা সবই সেই মেয়ে পাইবে, যে মেয়ের বিবাহের কথাবার্তা চূড়ান্ত হইয়াছে। ইহা বিবাহ বন্ধন হইয়া যাওয়ার পূর্বকার বিষয়ে কথা।
আর বিবাহের আকদ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জামাতার পক্ষ হইতে শ্বশুর বাড়ীতে বিশেষ হাদিয়া তোহফা যাহা আসিবে, তাহা সেই লোক পাইবে, যাহার যাহার জন্য আসিবে। অর্থাৎ বিবাহের আকদ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কাহারও সাথে যেহেতু পুরুষটির কোন আত্মীয়তা থাকে না, সম্পর্ক থাকে শুধু এতটুকু যে, এই মেয়েকে সে বিবাহ করিবে বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে। অতএব বিবাহের আকদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে যদি কিছু হাদিয়া-তোহফা দেয় তবে তাহা সেই মেয়ের জন্যই দেওয়া হইয়াছে বলিয়া ধরিয়া লইতে হইবে। এবং যাহা দেওয়া হইবে তাহা সে-ই পাইবে। অন্য কাহারও তাহাতে কোন অংশ নাই।
কিন্তু আকদ অনুষ্ঠিত হওয়র পর সেই মেয়ে ছাড়াও মেয়ের বাবা বা মেয়ের ভাই বোনও জামাতার নিকট সম্মান বা হাদিয়া তোহফা পাওয়ার অধিকারী হইয়া যায়। তখন কেবল স্ত্রীকেই সব কিছু দেওয়া উচিত নয়। বরং মেয়ে যে পিতার সন্তান সে পিতাও সম্মান পাওয়ার যোগ্য। যে ভাইর সে বোন, কিংবা যে বোনের সে বোন, সেও হাদিযা তোহফা পাইতে পারে। জামাতার উচিত তাহাদিগকেও হাদিয়া তোহফা দিয়া সম্মানিত করা। উমর ইবনে আবদুল আজীজ, সওরী, আবূ উবাইদ, মালিক প্রমুখ ফিকাহবিদগণ এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম আবূ ইউসূফ বলিয়াছেন, বিবাহের আকদ হওয়ার পূর্বেও যদি কাহারও জন্য কোন হাদিয়া-তোহফা প্রস্তাবিত বরের পক্ষ হইতে আসে তবে তাহা গ্রহণ করা তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ জায়েয হইবে। ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, আকদ অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে কনে ছাড়া অন্য কাহারও নামে হাদীয়া-তোহফা বরপক্ষ হইতে আসিলে এই নাম নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য হইবে না। মূলত ইহা স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের সহিত ভাল সম্পর্ক রক্ষা করার পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর পথ-নির্দেশ। এই রূপ হাদিয়া-তোহফা দিলে স্ত্রী এবং তাঁহার পিতা বা ভাই কনে ও বরে প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হইবে ইহাই স্বাভাবিক। এইরূপ হাদিয়া তোহফা গ্রহণ করা তাহাদের জন্য হালাল। ইহা কোন নিষিদ্ধ রসম নয়।
(*************************)
****************************************
হযরত আলী (রা) হইতে বর্নিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স) হযরত ফাতিমা (রা) কে বড় পাড়ওয়ালা চাদর, পানি পাত্র, এমন বালিশ বা উপাধান যাহার উপরের খোলটা চামড়া দিয়া তৈরী এবং ভিতরে সুগন্ধি যুক্ত ঘাষ ভর্তি থাকে- বিবাহের জেহায বা যৌতুক স্বরূপ দিয়াছিলেন।
(মুসহাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ বিবাহ হওয়ার পর কন্যা যখন পিতার বাড়ি হইতে বিদায় লইয়া স্বামীর বাড়ি চলিয়া যাইতে থাকে, তখন পিতার কর্তব্য হইল মেয়েকে কিছু প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র ও গার্হস্থ্য সরঞ্জামাদি সংগে দিয়অ দেওয়া। নবী করীম (স) তাহার কন্যা হযরত ফাতিমা (রা)-কে এই পর্যায়ে কিছু জিনিস দিয়াছিলেন। উপরোক্ত হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর দেওয়া কয়েকটি জিনিসের নাম উল্লেখ করা হইয়াছে। সে জিনিসগুলি হইলঃ একখানি মোটা পাড়ওয়ালা চাদর, একটি পানি-পাত্র এবং বালিশ বা উপাধান।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) যখন হযরত ফাতিমা (রা)-কে বিবাহ দিলেন, তখন তাঁহার সহিত একটি চাদর, সুগন্ধিযুক্ত ঘাষ ভর্তি চামড়ার খোলের বালিশ, একটি যাঁতা, পানির একটি পাত্র এবং দুইটি পাঁকা মাটির পাত্র পাঠাইয়অ দিয়াছিলেন।
এই বর্ণনায় দুইটি বেশী জিনিসের উল্লেখ আছে। একটি হইল যাঁতা, যাহাতে গম বা চাল বা ডাল পেষা হয়। আর ইহা ছাড়া দুইটি মাটির পাত্র, সম্ভবত রান্না-বান্না করার জন্য।
হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) যখন তাঁহাকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, তখন তাঁহারকে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিয়াছিলেনঃ
****************************************
তোমার অন্যান্য দ্বীনী বোনদিগকে যাহা যাহা দেওয়া হইয়াছে আমি তোমাকে তাহা হইতে কিছু মাত্র কম দিব না। আর তাহা হইলঃ যাঁতা, মাটির তৈরী পাত্র এবং ঘাষভর্তি চামড়ার খোলের তৈরী বালিশ।
এই বর্ণনা কয়টি হইতে স্পষ্ট বোঝা যায়, দান-জেহাযে চমৎকারিত্ব, চাকচিক্য ও উচ্চমানের বিলাসিতা করা রাসূলে করীম (স)-এর নীতি নয়। তিনি তদানীস্তন সমাজ ও জীবন যাত্রার মান অনুযায়ী মাঝা মাঝি ধরনের জেহেয দিয়াছিলেন।
কিন্তু এই পর্যায়ে দুইটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রথম কথা হইল, রাসূলে করীম (স) এই যাহা কিছু দ্রব্য সামগ্রী দিয়াছিলেন তাহা কেবলমাত্র হযরত ফাতিমা (রা) রুখসত করার বা তুলিয়া দেওয়ার সময়। তাহার কারণও ছিল এবং সে কারণটি এই যে, মদীনা শহরে হযরত আলী (রা)-এর নিজস্ব কেন ঘর-বাড়ি ছিল না। তিনি অর্থশালী লোকও ছিলেন না। বিবাহের পূর্বে তিনি স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে বসবাস করিতেন। বিবাহের পর একটি বাড়ি ভাড়ায় লইয়া তিনি হযরত ফাতিমা (রা)-কে তুলিয়া নিয়াছিলেন। এই নূতন ঘর বাসোপযোগী বানাইবার জন্যই নবী করীম (স) নিজ হইতে এই জিনিসগুলি সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিলেন। ইহা ছিল গার্হস্থ্য জীবনের জন্য অপরিহায্য প্রয়োজন পূরণ মাত্র। ইহা যৌতুক দেওয়ার কোন রসম পালন নয়।
দ্বিতীয়ত নবী করীম (স) হযরত ফাতিমা (রা) ছাড়া তাঁহার অন্যান্য কোন কন্যাকে বিবাহ দেওয়ার সময় এই ধরনের কোন জিনিসই কিন্তু দেন নাই। কেননা তাহার দ্বিতীয় জামাতা হযরত উসমান (রা) অর্থশালী ব্যক্তি ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত ফাতিমা (রা) কে রাসূলে করীম (স) কর্তৃক কিছু গার্হস্থ্য দ্রব্য দেওয়া হইতে রড়জোর শুধু এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, কন্যার বিবাহ কালে কন্যার নূতন ঘর-সংসার চালূ করার উদ্দেশ্যে ও প্রাথমিক প্রয়োজন পূরণ স্বরূপ কোন জিনিস সঙ্গে পাঠাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হইলে এবং পিতা তাহা সহজে ও কোনরূপ ঋণের বোঝা মাথায় চাপাইয়া লওয়া ছাড়াই দিতে সক্ষম হইলে তাহা দেওয়া জায়েয হইবে। কিন্তু ইহাকে বাধ্যতামূলক রসম হিসাবে চালূ করা ও পালন করা আর যাহাই হউক রাসূলে করীম (স)-এর ‘সুন্নাত’ হইতে পারে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজে যে কঠিন যৌতুক প্রথা চাপিয়া বসিয়াছে ইহাকে একটি অবাঞ্ছিত অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই ‘রসম’ সোজাসুজি প্রতিবেশী মুশরিক হিন্দু সমাজ থেকেই যে আমদানী হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
বস্তুত দান জেহেয (আজ কালকার যৌতুক) দাবি করিয়া বা চাপ প্রয়োগ করিয়া আদায় করার জিনিস নয়। কন্যাপক্ষ মেয়ের স্বামীর ঘন করিতে যাওয়ার সময় প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজনীয় কেন জিনিস দেওয়াকেই ‘জেহেয’ বলা হয়। ইহা পিতার ইচ্ছা, কন্যা-বাৎসল্য ও ক্ষমতা সামর্থ্য অনুপাতেই হইয়া থাকে। সেই সঙ্গে নিজের ও বর পক্ষের সামাজিক মান-মর্যাদার দিকেও লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। আসলে ইহা দ্বারা বর ও বরপক্ষের লোকজনকে খুশী করিয়অ দেওয়াও একটা লক্ষ্য। তাহাদের সহিত সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় ও গাঢ় করিয়া তোলা ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু তাই বলিয়া মেয়ের যৌতুক জোগাড় করিতে গিয়া পিতাকে যদি জমি বা অন্য কোন বিত্ত সম্পত্তি বন্ধক রাখিতে বা বিক্রয় করিয়া দিতে অথবা ঋণ গ্রহণ করিতে হয় কিংবা বিরাট মূল্যের জেহেয দিতে অক্ষম বলিয়া কোন পিতার কন্যাকে আইবুড়ো ও অবিবাহিতা হইয়া থাকিতে হয়, তবে তাহার অপেক্ষা অধিক দুঃখের কারণ আর কিছুই হইতে পারে না। সামাজিক বদ রসমের প্রবাল্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তাহাই হইতে দেখা যায়। এই বদরসম যত শীঘ্র বিলুপত্ হয়, মানবতার পক্ষে ততই মঙ্গল।
বস্তুত শরীয়াতের বিচারে এইরূপ বদ রসম সম্পূর্ণ হারাম। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
পুরুষটির জন্য একটি শয্যা, তাহার স্ত্রীর জন্য একটি শয্যা, তৃতীয় শয্যা অতিথি-মেহমানের জন্য। আর ইহার উপর চতৃর্থ একটি থাকিলে তাহা নিশ্চয়ই শয়তানের জন্য।
বস্তুত একটি নব দম্পতির জন্য শয্যার দিক দিয়া ইহাই নূন্যতম প্রয়োজনের মান। ইমাম নববী উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেনঃ
নূন্যতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাহা কিছু হইবে, তাহা সংগ্রহ করা বড় মানুষী, বাহাদুরী, গৌরব- অহংকার প্রদর্শন এবং দুনিয়ার চাকচিক্য ও জাঁকজমকের উপকরণ মাত্র। আর যাহা এই পর্যায়ের প্রয়োজনাতিরিক্ত হইবে, তাহাই শয়তানের প্ররোচনার ফসল মাত্র। কেননা প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলাস সমাগ্রী দেখিয়া শয়তান সন্তুষ্ট হয়। সেই ইহার প্ররোচনা দেয়, ইহার সৌন্দর্য প্রচার করে এবং এই কাজে সহযোগিতা করে।
কাহারও কাহারও মতে রাসূলে করীম (স)- এর উপরোক্ত কথার বাহ্যিক অর্থই গ্রহনীয়। ঘরে প্রয়োজনাতিরিক্ত সাজ-শয্যা ও দ্রব্য সরঞ্জাম পুঞ্জীভূত হইয়া থাকিলে তাহা প্রকৃতপক্ষেই শয়তানের ব্যবহারে আসে। যেমন অন্য হাদীসে বলা হইয়াছে, রাত্রিকালে ঘরের মালিক আল্লাহর যিকির না করিলে সে ঘরে শয়তানের বসতি হয়। হাদীসে স্বামী ও স্ত্রীর জন্য দুইটি শয্যার কথা বলিয়া ঘরের লোকসংখ্যানুপাতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি সাধনের প্রয়োজন সম্প্রসারিত হওয়ার দিকেই ইংগিত করা হইয়াছে। এই কথায় এদিকেও ইশারা হইতে পারে যে, স্বামী স্ত্রী যদি এক শয্যায় রাত্রি যাপন না করে, ভিন্ন ভিন্ন শয্যায় থাকে, তবে তাহাতে কোন দোষ নাই। এক শয্যায় একত্রে থাকা জরুরী নয় বলিয়াও কেহ কেহ এই হাদীসের ভিত্তিতে মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু এই হাদীসের ভিত্তিতে এইরূপ মত প্রকাশ অত্যন্ত দুর্বল কথা। আসলে এই হাদীসের প্রয়োজন হিসাবে আলাদা শয্যার কতা বলা হইয়াছে। আর একজনের অসুখ বিসুখ হইলে যে এই প্রয়োজন তীব্রভাবে দেখা দেয় তাহা সকলেই জানেন। স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে একই শয্যায় শয়ন করা শরীয়াতের দিক দিয়া ওয়াজিব না হইলেও অন্য এক দলীলের ভিত্তিতে ইহাই সঠিক কাজ। আর তাহা হইল, স্বতন্ত্র শয্যায় শয়নের বিশেষ কোন কারণ না হইলে স্বামী-স্ত্রীর একই শয্যায় রাত্রি যাপন বাঞ্ছনীয় এবং উত্তম। রাসূলে করীম (স) তাহাই করিয়াছেন চিরকাল। তিনি ইহাকে স্ত্রীর হক মনে করিয়াই তাহার সঙ্গে সব সময় একই শয্যায় শয়ন করিয়াছেন। আর একই শয্যায় একত্রে শয়ন করিলেই যে স্বামী-স্ত্রী সঙ্গম হইবে বা হইতে হইবে, এমন কোন কথা নাই।