অলীমা’র দাওয়াত অলীমা’র সময় সুন্নতি বিয়ের নিয়ম আকদ বৌভাত কি

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন। তাঁহার দেহে সোনালী হলূদের চিহ্ন লাগানো ছিল। ইহা দেখিয়া নবী করীম (স) তাঁহকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। জবাবে তিনি জানাইলেন যে, তিনি সম্প্রতি আপনার বংশের একটি মেয়ে বিবাহ করিয়াছেন। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তাহাকে কত মহরানা দিলে? তিনি বলিলেনঃ এক দানা পরিমাণ স্বর্ণ। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ অলীমা’র দাওয়াত কর- একটি ছাগী দিয়া হইলেও।

 

(বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী)

 

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি মোটামুটি তিনটি কথা আলোচনা সাপেক্ষ। প্রথম সোনালী হলুদের চিহ্ন গায়ে, থাকা; দুই মহরানার পরিমাণ এবং তিন, অলীমা করার নির্দেশ।

 

এই হাদীসটির মূল ভাষা হইলঃ **************** তাহার দেহে হলুদের চিহ্ন ছিল। অপর এক বর্ণনায় এই স্থলের শব্দ হইলঃ ********** অর্থাৎ তাঁহার গায়ের জাফরানের রঙ মাখা ছিল। অন্য একটি বর্ণনায় এখানকার ভাষা হইল ********** অর্থাৎ এক প্রকার সুগন্ধি মাখা ছিল। আর একটি বর্ণনার ভাষা এইঃ *************** নবী করীম (স) তাঁহার চোখে-মুখে নব বিবাহের হাসি-খুশী ও উৎফুল্লতা দেখিতে পাইলেন। আর তিরমিযীর ভাষা হইলঃ **************** ‘নবী করীম (স) আবদুর রহমান ইবনে আউফের (দেহে বা কাপড়ে) হলুদ চিহ্ন দেখিতে পাইলেন। হলুদ চিহ্ন বা জাফরান মাখা দেখার তাৎপর্য হইল, তাহার শরীরে জাফরান মাখা কাপড়- যাহা সাধারণত নব বিবাহিত ব্যক্তিরা পরিয়া থাকে- পরিহিত ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

যে মুসলমানই বিবাহ করিবে সে যেন সোনালী হলুদ বর্ণ মাখা কাপড় পড়ে। ইহা নব বিবাহ ও তজ্জনিত আনন্দ উৎফুল্লতার বাহ্য লক্ষণ হইবে। তোমরা কি হাদীসের এই বাক্যটি দেখিতে পাওনা, যাহাতে বলা হইয়াছেঃ তাঁহার চোখে-মুখে নববিবাহের উৎফুল্লতা প্রতিভাত ছিল।

 

কেহ কেহ বলিয়াছেনঃ ‘নব বিবাহিত ব্যক্তি এই ধরনের কাপড় পরিবে এই উদ্দেশ্যে, যেন লোকেরা তাহার অলীমা’র অনুষ্ঠান করায় ও নব গঠিত পরিবারের ব্যয় বহনে সাহায্য করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

সমস্ত রঙের মধ্যে সর্বোত্তম রঙ হইল সোনালী হলুদ বর্ণ। কেনা কুরআন মজীদেই আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ হলুদবর্ণ- উহার রঙ অত্যুজ্জল। উহা দ্রষ্টা ও দর্শককে আনন্দিত ও উৎফুল্ল করিয়া দেয়।

 

কুরআনের ও আয়াতটি সূরা আল-বাকারা’র ৬৯ আয়াতাংশ। ইহাতে বলা কথার ভঙ্গী হইতে জানা যায়, মানসিক আনন্দ লাভ হয় হলূদ বা ঘিয়ের রঙে। এই কারণে নবী করীম (স)ও এই রঙটি খুবই পছন্দ করিতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কে নবী করীম (স)-এর পছন্দনীয় রঙ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল। জবাবে তিনি বলিয়াছিলেনঃ

 

****************************************

 

নবী করীম (স) সোনালী হলুদ রঙ মাখিতেন। আমিও উহা মাখি এবং এই রঙ আমি ভালবাসি, পছন্দ করি।

 

ইবনে আবদুল বার জুহরী হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

সাহাবায়ে কিরাম (রা) সোনালী হলুদ রঙ মাখিতেন এবং তাহাতে তাঁহারা কোন দোষ দেখিতে পাইতেন না।

 

ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, বর্তমানকালে বিবাহের প্রক্কালে বর-কনের গাত্রে হলূদ মাখার যে সাধারণ ও ব্যাপক রেওয়াজ রহিয়াছ তাহা বহু প্রাচীনকাল হইতে চলিয়া আসা রীতি এবং তাহাতে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কোন দোষ নাই।

 

দায়ূদী বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উমর  ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁহার শ্বশ্রু সোনালী হলুদ বর্ণে রঙীন করিয়া রাখিতেন। ফলে তাঁহার কাপড়-পোষাক এই রঙে রঙীন হইয়া যাইত।

 

হযরত উমর (রা) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আমি নবী করীম (স)-কে দেখিয়াছি, তিনি এই রঙ মাখিতেন এবং ইহার অপেক্ষা অন্য কোন রঙ তাঁহার অধিক প্রিয় ও পছন্দ ছিল না। তিন তাঁহার সমস্ত কাপড়- এমন কি তাঁহার পাগড়ীও এই রঙে রঙীন করিয়া রাখিতেন।

 

আসলে ইহা জাফরানী রঙ সম্পর্কে কথা। উহা ছাড়া আর যে রঙে কোন গন্ধ নাই তাহা মাখা জায়েয হওয়ায়  কোন মত-বিরোধ নাই।

 

(**************)

 

অবশ্য ইবনে সুফিয়ান বলিয়াছেনঃ সোনালী হলুদ বর্ণ কাপড়ে লাগানো জায়েয, দেহে লাগানো জায়েয নয়। ইমাম আবূ হানীফা, শাফেয়ী ও তাঁহাদের সঙ্গী-সাগরিদগণ কাপড়ে বা দাড়িতে জাফরানী রঙ ব্যবহার মকরুহ মনে করিতেন। তাঁহাদের দলীল হইল হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসঃ

 

****************************************

 

পুরুষ মানুষকে জাফরানী রঙ লাগাইতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।

 

প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকারী আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরী লিখিয়াছেনঃ হাদীসের এই বাক্যটির অর্থ হইলঃ

 

****************************************

 

হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের (রা) অবয়বে নব বিবাহ সংক্রান্ত সুগন্ধি হিসাবে ব্যবহৃত জাফরানের চিহ্ন লাগিয়া ছিল।

 

অর্থাৎ তিনি এই জাফরানী রঙ নিজে ইচ্ছা করিয়া লাগান নাই। কেননা পুরুষদের এই রঙ ব্যবহার সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর স্পষ্ট নিষেধ সহীহ বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। অনুরূপভাবে ************* হলুদবর্ণ সম্বলিত সুগদ্ধি ব্যবহারও পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। কেননা ইহা মেয়েদের ভূষণ। আর পুরুদিগকে মেয়েদের সহিত সাদৃশ্য করিতে নিষেধ করা হইয়াছে। তাঁহার মতে ইহাই আলোচ্য হাদীসের সঠিক তাৎপর্য। কাযী ইয়ায ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ হাদীসের এই অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু আল্লমা বদরুদ্দীন আইনী এইরূপ অর্থ গ্রহণে এক মত নহেন।

 

কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, বলা হইয়াছে, বরের জন্য এই রঙ ব্যবহার করা জায়েয। আবূ উবাইদ উল্লেখ করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

সাহাবায়ে কিরাম (রা) যুবকদের বিবাহ উৎসব কালে এই রঙ ব্যবহার করা জায়েয বলিয়া ঘোষণা করিতেন।

 

হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) আনসার বংশের যে মেয়েটি বিবাহ করিয়াছিলেন, জুবাইর উল্লেখ করিয়াছেন, সে মেয়েটি আবুল হাসান ইবনে রাফে’র কন্যা। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেন ******* ইহার অর্থঃ ***** ‘তাহাকে মহরানা বাবদ কত দিয়াছ’? জওয়াবে তিনি বলিয়াছিলেনঃ ******** ‘একদানা ওজনের স্বর্ণ’। মূল কথা একই, ভাষা ও শব্দ প্রয়োগের পার্থক্য মাত্র। ‘একদানা পরিমাণ’ বা ‘একদানা ওজনের স্বর্ণ’ কতটুকু? ইমাম খাত্তাবী বলিয়াছেনঃ ******** এমন একটা ওজন বা পরিমাণ বুঝায় যাহা তদানীন্তন সমাজের সকলেরই জানা ছিল এবং ইহা কাহারও নিকট অপরিচিত ছিলনা। উহার মূল্য পরিমাণ ছিল পাঁচ দিরহাম। ইহাই অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মত। তবে ইমাম তিরমিযীর বর্ণনা মতে একদানা পরিমাণ স্বর্ণের ওজন হইল তিন দিরহাম ও এক দিরহামের এক তৃতীয়াংশ। আর ইসহাক বাহওয়াই বলিয়াছেন, ইহার ওজন পাঁচ দিরহাম ও এক দিরহামের এক তৃতীয়াংশ। বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণের মূলে যে পার্থক্য হইয়াছে, তাহারই প্রতিফলন ঘটিয়াছে এই সব কথায়।

 

এই আলোচনা হইতে জানা গেল, বিবাহে মহরানা একটা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কে কত মহরানা ধার্য করিয়াছে বা দিয়াছে তাহাই পারস্পরিক জিজ্ঞাসা বিষয়। সমাজ প্রধান হিসাবে রাসূলে করীম (স)-এরও ইহা একটি দায়িত্ব ছিল।

 

রাসূলে করীম (স) হযরত আবদুর রহমান (রা)-এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর তাঁহাকে নির্দেশ দিলেনঃ *********** অলীমা কর- অলীমার জিয়াফতের ব্যবস্থা কর একটি ছাগী দ্বারা হইলেও।

 

‘অলীমা’ কাহাকে বলে? আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় যে খাবার বা জিয়াফতের আয়োজন ও অনুষ্ঠান করা হয়, তাহারই নাম ‘অলীমা’।

 

ইবনুল আসীর বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

বিবাহ উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ খাবার ও জিয়াফতকেই অলীমা বলা হয়।

 

আল্লামা আজহারী বলিয়াছেন ******* শব্দের মূল হইল ***********- ইহার অর্থ *******- ‘একত্রিত ও সমবেত হওয়া’। এইরূপ নাম করণের কারণ হইলঃ ********** ‘কেননা স্বামী-স্ত্রী দুইজন একত্রিত হয়’- এই উপলক্ষেই এই জিয়াফতের ব্যবস্থা করা হয়। এই জন্যই ইহার নাম ‘অলীমা’।

 

বস্তুত বিবাহ উৎসবকে কেন্দ্র করিয়া কিংবা বিবাহন্তে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদিগকে দাওয়াত করিয়া খাওয়ানোর জন্য রাসূলে করীম (স) এই নির্দেশ দিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ************ ‘তুমি কি বিবাহ করিয়াছ’? বলিলেনঃ **** হ্যাঁ’। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ********* ‘তুমি কি অলীমা করিয়াছ’? বলিলেনঃ ‘না’।

 

****************************************

 

তখন রাসূলে করীম (স) একদানা পরিমাণ স্বর্ণ তাঁহার দিকে নিক্ষেপ করিলেন এবং বলিলেনঃ অলীমা কর- যদি একটি ছাগী দ্বারাও তাহা হয়।

 

কথার ধরন হইতেই স্পষ্ট হয় যে, একটি ছাগীদ্বারা অলীমার জিয়াফত খাওয়ানো কমসে-কম নিয়ম। অর্থাৎ বেশী কিছু করিতে না পারিলেও অন্তত একটি ছাগী যবেহ করিয়া অলীমা খাওয়াইতে হইবে। আর নবী করীম (স) যে একটি স্বর্ণ দানা তাহাকে দিলেন, ইহার তাৎপর্য এই যে, বর বা তাহার অভিভাবক নিজস্ব ব্যয়ে যদি অলীমার জিয়াফতের ব্যবস্থা করিতে অসমর্থ হয়, তাহা হইলে সমাজের লোকদের- অন্ততঃ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, মুরব্বী, সমাজপতি সর্বশেষ অবস্থায় সরকারের কর্তব্য হইল তাহার সাহায্য করা। নবী করীম (স) ইহারই পথ-নির্দেশ করিয়াছেন বাস্তব আদর্শ সংস্থাপন করিয়া।

 

হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

রাসূলে করীম (স) তাঁহার স্ত্রীগণের মধ্যে জয়নবের বিবাহে যে অলীমা করিয়াছেন সেইরূপ অলীমা অন্য কোন স্ত্রীর বিবাহে করেন নাই। তখন তিনি একটি ছাগী যবেহ করিয়া অলীমা করিয়াছেন।

 

অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেনঃ লোকদেরকে আহবান করার জন্য রাসূলে করম (স) আমাকে পাঠাইয়াছিলেন। পরে তিনি তাহাদিগকে পেট ভরিয়া গোশত রুটি খাওয়াইয়াছিলেন।

 

বুখারী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

নবী করীম (স) তাঁহার কোন কোন স্ত্রীকে অধিক মর্যাদা দেওয়ার জন্যই অলীমা খাওয়ানোর এইরূপ পার্থক্য করিয়াছেন, তাহা নয়। বরং বিভিন্ন সময়ের বিবাহ কালে রাসূলে করীম (স)-এর আর্থিক সামর্থ্য কখনও সংকীর্ণ ছিল এবং কখনও প্রশস্ত ছিল, এই কারণেই এই রূপ হইয়াছে।

 

হযরত বুরাইদা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

হযরত আলী (রা) যখন হযরত ফাতিমা (রা)-কে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়াছিলেন, তখন নবী করীম (স) বলিয়াছিলেনঃ বিবাহে অলীমা করা একান্ত আবশ্যক।

 

ইবনে হাজার আল আসকালানী বলিয়াছেনঃ প্রথমে উদ্ধৃত মূল হাদীসটির সনদে কোন দোষ নাই। আর এই হাদীসটি একথাও প্রমাণ করে যে, অলীমা করা ওয়াজিব। অবশ্য ইবনে বাত্তাল বলিয়াছেন, অলীমা করাকে কেহ ওয়াজিব বলিয়াছেন, তাহা আমার জানা নাই। কিন্তু তিনি জানেন না বলিয়াই তাহা ওয়াজিব হইবে না, এমন কথা নয়। কাহারও অজ্ঞতা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ প্রমাণ করে না। অহশী ইবনে হারব-এর মরফু’ হাদীসের ভাষা এইরূপ (************) অলীমা সত্য-সপ্রমাণিত। ইহার সহিত বিভিন্ন লোকের হক জড়িত। বস্তুত বিবাহ একটা সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠান। এই সময় বর পক্ষের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং কনে পক্সের নিকটাত্মীয় ও আপনজনের হক বা অধিকার হয় বর পক্ষের নিকট হইতে জিয়াফত খাওয়ার আহবান পাওয়ার। এই হক বা অধিকার অবশ্যই পূরনীয়, পালনীয়। কিন্তু ইবনে বাত্তাল এই হাদীসেরও ভিন্ন অর্থ করিয়াছেন। তাঁহার মতে হাদীসের শব্দ ************ অর্থ ‘বাতিল নয়- ভিত্তিহীন নয়’। আর যাহা বাতিল বা ভিত্তিহীন নয়, তাহা বড়জোড় ‘মুস্তাহাব’ হইতে পারে। তাই উহাকে ********** ‘একটি মর্যাদাশীল সুন্নাত’ বা ‘রাসূলের একটি সম্মানযোগ্য রীতি’ বলা যাইতে পারে, ওয়াজিব নয়। উপরন্তু উহা সম্প্রতি সৃষ্ট একটি আনন্দমূলক ঘটনা সংশ্লিষ্ট জিয়াফত। ফলে ইহা অন্যান্য সাধারণ দাওয়াত-জিয়াফতের মতই একটি কাজ। (আল মুগনী-ইবনে কুদামাহ( আর ইহা করার জন্য যে আদেশ দেওয়া হইয়াছে, তাহা পালন করা ‘মুস্তাহাব’ মাত্র- ওয়াজিব নয়। আর রাসূলে করীম (স)-এর কথা ****** ‘একটি ছাগী দিয়া হইলেও’- ছাগী জবেহ করিয়া অলীমা করা যে ওয়াজিব নয়, ইহা তো সর্ববাদী সম্মত কথা। তবে জমহুর আলেমের মতে ইহা ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদা’।

 

কিন্তু ইহাও সর্বশেষ কথা নয়, কেননা আল্লাম বদরুদ্দীন আইনীর উদ্ধৃতি অনুযায়ী, শাফেয় মাযহাবের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে ইহা ওয়াজিব। কেননা নবী করীম (স) হযরত আবদুর রহমানকে ইহা করার জন্য আদেশ করিয়াছেন। আর হযরত আবদুর রহমানকে একটি ছাগী যবেহ করিয়া হইলেও অলীমা করার নির্দেশ দিয়াছেন, তাহার অর্থ এই নয় যে, অলীমার দাওয়াতে ইহার অধিক কিছু করা যাইবে না। হযরত আবদুর রহমানের আর্থিক অবস্থার বিচারে ইহা ছিল তাঁহার সামর্থ্যের সর্বনিম্ন পরিমাণ ব্যয়। অবশ্য কাহারও কাহারও মতে সদ্য হিজরতকারী সাহাবীদের আর্থিক অস্বচ্চলতা বরং সংকটের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই এইরূপ বলা হইয়াছে। উত্তরকালে সাহাবীদের আর্থিক অবস্থায় যখন প্রশস্ততা আসে, তখন অলীমা’র ব্যয়-পরিমাণেও প্রশস্ততা আসে।

 

(****************)

অলীমা’র সময়

 

****************************************

 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ প্রথম দিনের দাওয়াত সত্য, দ্বিতীয় দিনের দাওয়াত সুন্নাত, তৃতীয় দিনের দাওয়াত প্রদর্শনমূলক। আর যে লোক দান ও বদান্যতা ইত্যাদি করিয়া নিজেকে বিখ্যাত করিতে বা গৌরব অহংকার প্রকাশ করিতে চাহিবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাহাকে মিথ্যুক প্রদর্শনকারী লোকদের মধ্যে প্রখ্যাত করিবেন।

 

(তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ)

 

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী জিয়াদ ইবনে আবদুল্লাহ। ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেন, এই হাদীসটি কেবলমাত্র জিয়াদ ইবনে আবদুল্লাহর সূত্রেই মরফূ’। ইবনে হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেন, তাঁহার বর্ণিত হাদীসকে দলীলরূপে গ্রহণ করা যায় না। ইহা ছাড়াও তিনি ইহা আতা’র নিকট শুনিয়াছিলেন এমন সময় যখন তাঁহার স্মৃতি শক্তি প্রখরতা হারাইয়া ফেলিয়াছিল। সম্ভবত তাঁহার বর্ণিত হাদীস দলীলরূপে গ্রহণ করিতে এবং জন্যই আপত্তি উঠিয়াছে। কিন্তু এই পর্যায়ে ইহাই একক হাদীস নয়। ইহার সমর্থক ********* আরও হাদীস রহিয়াছে। ফলে এই একই বিষয়ে বর্ণিত বহু কয়টি হাদীসের সমষ্টি একথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, এই সব হাদীসের মূল কথা ও প্রতিপাদ্য মোটেই অমূলক ও ভিত্তিহীন নয়। ইহার একটি ভিত্তি থাকা এবং রাসূলে করীম (স) এইরূপ কথা বলিয়াছেন, এইরূপ বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না- ইহাও হাদীস শাস্ত্রেরই সর্বজন স্বীকৃত নীতি।

 

হাদীসিটতে বলা হইয়াছে, প্রথম দিনের জিয়াফত হক। অর্থাৎ একান্ত্রভাবে প্রমাণিত, অনিবার্য কর্তব্য, জরুরী ভিত্তিতে পালনীয়। এক কথায় ওয়াজিব। প্রথম দিন বলিতে বিবাহ হওয়ার দিন। যাঁহারা মনে করেন, অলীমা করা ওয়াজিব বা অন্তত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, ইহা তাহাদের মত। তাঁহারা রাসূলে করীম (স)-এর এই কথা হইতে বুঝিয়াছেন যে, অলীমা করা ওয়াজিব। ইহা তরক করা নিতান্তই অন্যায় ও দোষনীয়। ইহা না করিলে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। যদিও সেজন্য শাস্তি হওয়াটা অনিবার্য বা অবধারিত নয়। আল্লামা আইনী লিখিয়াছেনঃ অলীমা করার উপযুক্ত সময় সম্পর্কে প্রাচীন কাল হইতেই শরীয়াতবিদদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, ইহা কখন করিতে হইবে? বিবাহের আকদ হওয়ার সময়? কিংবা উহার পর-পরই? অথবা প্রথম মিলন বা বাসর ঘর অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন? না উহার পর অথবা বিবাহের আকদ হওয়ার সময় হইতে স্বামী-স্ত্রী মিলন ও প্রথম বাসর ঘর উদযাপনের দিন পর্যন্ত অলীমা করার সময়টি বিস্তীর্ণ ও সম্প্রসারিত- ইহার মধ্যে যে কোন সময় করিলেই চলিবে? ইমাম নববীও এই মত-বিরোধের উল্লেখ করিয়াছেন। কাযী ইয়ায কোন সময় করিলেই চলিবে? ইমাম নববীও এই মত-বিরোধের উল্লেখ করিয়াছেন। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, মালিকী মাযহাব মতে স্বামী-স্ত্রী মিলন সংঘটিত হওয়ার পর এই দাওয়াত হওয়া মুস্তাহাব- অর্থাৎ ইহাই পছন্দনীয় সময়। এই মালিকী মাযহাবের অনেকে আবার বিবাহের আকদ হওয়ার সময়টিই ঠিক সময় বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইবনে হুবাইবের মতে হয় আকদ হওয়ার সময় করিতে হইবে, নতুবা করতে হইবে মিলন হওয়ার পর। অন্যত্র বলা হইয়াছে, মিলনের পূর্বে বা পরে যে কোন সময়ই করা যাইতে পারে। আল্লামা মা-আর্দি বলিয়াছেন, মিলন-সময়ই ঠিক সময়। হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

রাসূলে করীম (স) জয়নাবের সঙ্গে বাসর রাত্রি উদযাপন করার পর সকাল বেলা লোকদের দাওয়াত করিলেন।

 

ইহা হইতে বুঝা যায়, অলীমা মিলন হওয়ার পর অনুষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে বর্তমান মুসলিম সমাজের রেওয়াজ হইল, বর যাত্রীরা কন্যার পিত্রালয়ে গমন করে কনেকে তুলিয়া আনার জন্য। সেখানে কন্যা পক্ষ হইতে বর পক্ষকে জিয়াফত দেওয়া হয়। পরে কনেকে বাড়ীতে লইয়া আসার দিন কিংবা উহার পর ২-৩ দিনের মধ্যে প্রথম সুযোগেই বর পক্ষ অলীমা’র জিয়াফত করে, ইহা সর্বদিক দিয়া শরীয়াত সম্মত কাজ।

 

দ্বিতীয় দিনের জিয়াফন সুন্নাত। আবূ দায়ুদে বর্ণিত হাদীসের ভাষা হইলঃ ************ বিবাহ উপলক্ষে প্রথম দিনের জিয়াফতটাই অলীমা, দ্বিতীয় দিনের খাওয়ানোটা চলতি রীতি’। অর্থাৎ ইহাতে কোন দোষ নাই। আর তৃতীয় দিনের জিয়াফত খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যমূলক। লোকেরা জানিতে পারে যে, অমুকের বিবাহের পর পর তিন দিন পর্যন্ত লোকদিগকে খাওয়ানো হইয়াছে। সে যে একজন বড় ও নামকরা দানশীল, লোকদিগকে খুব খাওয়ায়, এই সুনাম ও সুখ্যাতি চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িবে, এই খাওয়ানো ঠিক সেই উদ্দেশ্যে এবং এই উদ্দেশ্য ছাড়া তিন দিন ধরিয়অ খাওয়ানের কোন কারণ বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে থাকিতে পারে না। এই কারণে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাহাকে এই শাস্তিই দিবেন যে, যে মিথ্যাবাদী ও খ্যাতি লোভী বলিয়া চিহ্নিত হইবে এবং আল্লাত তা’আলা লোকদিগকে জানাইয়া দিবেন যে, এইলোকটি রিয়াকার, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও সুনাম পাওয়ার অসৎ মতলবে কাজ করিয়াছে- লোকদিগকে খাওয়াইয়াছে। ইহার ফলে লোকদের নিকট সে অকথ্যভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হইবে। আল্লামা তাইয়্যেবী বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আল্লাহ তা’আলা যদি কাহাকেও নিয়ামত দান স্বরূপ ধন-ঐশ্বর্য দেন, তবে সেজন্য তাহার প্রকাশ হওয়া উচিত আল্লাহর শোকর স্বরূপ। দ্বিতীয় দিনের খাওয়ানো দ্বারা প্রথম দিনের খাওয়ানোর যে অসম্পূর্ণতা রহিয়া গিয়াছে, তাহার ক্ষতিপূরণ হইয়া  যায়। আর সুন্নাত তো সব সময় ওয়াজিবের পূর্ণতা বিধায়ক- পরিপূরক। অতঃপর তৃতীয় দিনেও খাওয়ানো হইলে তাহা নিতান্তই রিয়াকারীমূলক ও খ্যাতিলাভের মতলব প্রসূত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।

 

অতএব প্রথম দিনে যাহাদিগকে আহবান করা হইবে, তাহাদের দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব। দ্বিতখীয় দিনেরও দাওয়াত হইলে তাহা রক্ষা করা সুন্নাত। কিন্তু তৃতীয় দিনেও সে দাওয়াত হইলে তাহা কবুলকরা শুধু মাকরূহ নয়- হারাম।

 

মূল্লা আলী আল-কারী লিখিয়াছেন, মালিকী মাযহাবের লোকদের অলীমার দাওয়াত ক্রমাগত সাত দিন পর্যন্ত কবুল করা মুস্তাহাব। কিন্তু আলোচ্য হাদীস এই কথার প্রতিবাদ করে। এই উক্তি সম্পর্কে বক্তব্য হইল, মালিকী মাযহাবের লোকদের এই মতটি নিতান্ত  ভিত্তিহীন নয়। হাফসা বিনতে শিরীন বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আমার পিতা যখন বিবাহ করিয়াছিলেন, তখন তিনি সাতদন পর্যন্ত সাহাবায়ে কিরাম ( রা) কে জিয়াফত খাওয়াইয়াছেন। যে দিন আনসারগণ নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন, সে দিন হযরত উবাই ইবনে কায়াব ও জায়দ ইবনে সাবিত (রা) কে আহবান করিলেন। এইদিন আমার পিতা রোযাদার ছিলেন। উপস্থিত লোকেরা যখন খাওয়া দাওয়া সমাপ্ত করিলেন, তখন আমার পিতা দোয়া করিলেন ও আল্লাহর হামদ-সানা করিলেন।

 

আবদুর রাজ্জাক উদ্ধৃত এই বর্ণনাটিতে তিন দিনের পরিবর্তে সাত দিনের উল্লেখ হইয়াছে। সম্ভবত এই বর্ণনাটিই মালিকী মাযহাবের লোকদের উপরোক্ত মতের ভিত্তি। (ফতহুল বারী) ইমাম বুখারীও এই মত সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বুখারী শরীফে এ পর্যায়ে হাদীস সমূহের শিরোনামায় দিয়াছন এই ভাষায়ঃ

 

****************************************

 

অলীমার দাওয়াত কবুল করা কর্তব্য এবং সাত দিন বা এই রকম সময় পর্যন্ত অলীমা করা সম্পর্কিত অধ্যায়।

 

সেই সঙ্গে ইহাও বলিয়াছেন যে, অলীমা একদিন করা হইবে কি দুইদিন এমন নির্দিষ্ট করা কোন কথা নবী করীম (স) বলেন নাই। ইহাতে আলোচ্য হাদীসটি যায়ীফ হওয়ার ইংগিত থাকিলেও যেহেতু এই পর্যায়ে বহু কয়টি হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, সেই জন্য উহার কোন না কোন ভিত্তি আছে বলিয়া বিশ্বাস করিতে হইবে। আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীরা আমল করেন। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, অলীমার জিয়াফত খাওয়ানো এক সপ্তাহকাল চলাটা অপছন্দীয় নয়। অবশ্য ইহা কেবলমাত্র বিপুল ঐশ্বর্যশালী লোকদের পক্ষেই সম্ভব। তবে সেজন্য অনেকে এই শর্তের উল্লেখ করিয়অছেন যে, এই সাতদিন পর্যন্ত একই লোকদিগকে না খাওয়াইয়া প্রত্যেক দিন নূতন নূতন লোককে খাওয়াইতে হইবে। একবার যাহারা খাইয়াছে, তাহাদিগকে বার বার খাওয়ানো চলিবে না। আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী তৃতীয় ও উহার পরবর্তী দিনগুলি খাওয়ানো নিষিদ্ধ বলিব শুধু তখন, যদি ইহা অকারণ করা হইবে এবং কেবলমাত্র সুনাম সুখ্যাতি লাভই ইহার উদ্দেশ্যে হইবে এবং তাহা যদি হয় বর পক্ষের প্রকৃত আর্থিক সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও- ঋণ করিয়া বা জমি বন্ধক দিয়া ইত্যাদি।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]