অলীমার দাওয়াত কবুল করা ইসলামে দাওয়াত দেয়া ও গ্রহণের নীতিমালা

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদিগকে যখন দাওয়াত করা হইবে, তখন তোমরা সে দাওয়াতে উপস্থিতত হও। (তিরমিযী)

 

ব্যাখ্যাঃ তিরমিযী উদ্ধৃত এই হাদীসটির মোটামুটি অর্থ এই যে, কোন দাওয়াত পাওয়া মাত্র তাহা কবুল করা এবং সেই অনুযায়ী  দাওয়াতকারী কর্তৃক নির্দিষ্ট স্থানে কিংবা তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হওয়অ কর্তব্য। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে কোন দাওয়াতের কথা নির্দিষ্ট করা না হইলেও ইমাম নববী বলিয়াছেন, এই হাদীসে খাওয়ার দাওয়াতের কথা বলা হইয়াছে। এই কারণে হাদীসবিদগণ বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

প্রত্যেক প্রকারের দাওয়াতই কবুল করা ও তদানুযায়ী উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব- তাহা  বিবাহের দাওয়াত হউক বা অন্য কিছু, এই হাদীসটি-ই এই কথার দলীল।

 

মুসলিম শরীফে এই হাদীসটির ভাষা হইলঃ

 

তোমাদের কেহ যখন অলীমা উপলক্ষে নিমন্ত্রিত হবে, তাহার উচিত তাহাতে উপস্থিত হওয়া।

 

শাফেয়ী মাযহাবের কোন কোন লোক এই হাদীসের ভিত্তিতেই এই মত গ্রহণ ও প্রকাশ করিয়াছেন যে, দাওয়াত মাত্রই কবুল করা ওয়াজিব, তাহা বিবাহের উপলক্ষে খাওয়ার দাওয়াত হউক কি অন্য কিছুর। ইবনে হাজামের মতে জমহুর সাহাবী ও তাবেয়ীনেরও ইহাই মত। হযরত ইবনে উমর (রা) একজন লোককে খাওয়ার দাওয়াত করিলেন। তিনি বলিলেন ************* ‘আমাকে মাফ করুন’। ইহা শুনিয়অ হযরত ইবনে উমর বলিলেনঃ ***************** ‘না ইহা হইতে আপনার জন্য কোন ক্ষমা নাই- উঠুন চলুন’। ইবনে সাফওয়ান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে দাওয়াত করিলেন। তিনি বলিলেনঃ ************ ‘আমাকে আপনি যদি ক্ষমা না-ই করেন, তাহা হইলে আসিব’। অলীমার দাওয়াত সম্পর্কে এই কথা। কিন্তু অলীমার দাওয়াত ছাড়া অন্যান্য দাওয়াতে কবুল করা ও উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব নয় বলিয়া মালিকী, হানাফী, হাম্বলী ও জমহুর শাফেয়ীগণ মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম সরখসী এই ব্যাপারে  চূড়ান্ত মত দিয়াছেন এই বলিয়া যে, ইহাতে ইজমা হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ীর কথা হইলঃ  *************** ‘অলীমার দাওয়াত গ্রহণ ও তাহাতে উপস্থিত অবশ্য কর্তব্য’। আর অলিমা বলিতে সাধারণত বিবাহের দাওয়াতকেই বুঝায়। আর সাধারণভাবে যে জিয়াফতেই লোকদেরকে আহবান করা হয়, তাহাই অলীমা। কাজেই উহা প্রত্যাখ্যঅন করা ও উহাতে না যাওয়ার অধিকার কাহারও নাই। যদি কেহ তাহা প্রথ্যাখ্যান করে তবে সে গুনাহগার হইবে কিনা তাহা অবশ্য স্পষ্টভাবে জানা যায় নাই। কিন্তু অলীমার দাওয়াত সম্পর্কে একথা পরিষ্কার যে, তাহা কবুল না করিলে গুনাহগার হইতে হইবে। আর অলীমা বলিলেই তাহা বিবাহ উপলক্ষে খাওয়া বুঝাইবে। ইহা একটি সাধারণ কথা।

 

****************************************

 

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, যে অলীমা রদাওয়অতে বাছিয়অ বাছিয়া কেবলমাত্র ধনী লোকদিগকে আহবান করা হয় এবং গরীব লোকদিগকে আহবান করা হয় না, সে অলীমার খাবার নিকৃষ্টতম খাবার। আর যে লোক অলীমার দাওয়াত কবুল করে না ও উহাতে যায় না, সে আল্লাহ এব তাঁহার রাসূলেরই নাফরমানী করে।

 

(বুখারী, মুসলিম)

 

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে মোট দুইটি কথা বলা হইয়াছে। একটি হইল অলীমার খাওয়ায় লোকদিগকে দাওয়াত করার নীতি কি হইবে এবং দ্বিতীয় অলীমার দাওয়াত কবুল করা সম্পর্কে।

 

প্রথম পর্যায়ে বলা হইয়অছে, যে অলীমার জিয়াফতে বাছিয়া বাছিয়া কেবলমাত্র ধনী ও সচ্ছল অবস্থার লোকদিগকে আহবান করা হয়, গরীব লোকদিগকে দাওয়াত করা হয় না, গরীব লোকদের পক্ষে সেখানে ‘প্রবেশ নিষেধ’, সে অলীমায় যত মূল্যবান খাবারেরই ব্যবস্থা করা হউক না কেন, তাহা নিকৃষ্টতম খাবার। ইহার কারণ এই যে, একেতো ইহা জাহিলিয়াতের রসম ও রেওয়াজ। ইসলামের পূর্বে তদানীন্তন আরব সমাজে এই প্রচলন ছিল যে, ধনী লেঅকেরা বিরাট-বিরাট ও অতিশয় জাঁকজমক পূর্ণ বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠান করিত এবং অলীমার দাওয়াতে কেবলমাত্র ধনী লোকদিগকেই শরীক হওয়ার জন্য আহবান করা হইত। গরবী লোকদিগকে আদৌ দাওয়াত ক রা হইত না। এইভাবে কেবল ধনী লোকদিগকে খাওয়ানো ও গরীব লোকদিগকে তাহা হইতে বঞ্চিত রাখা অতিশয় হীন মানসিকতার লক্ষণ। ইহা মানবতার প্রতি চরম অবমাননাও বটে। ইসলাম এই মানসিকতার মূলোৎপাটন করিয়াছে এবং এইরূপ কেবল ধনীদের জন্য অলীমার অনুষ্ঠান করাকে হারাম করা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ এইরূপ নীতির দ্বারা নির্বিশেষ শ্রেণীহীন মানব সমাজকে সরাসরি দুইটি ভাগে বিভক্ত করিয়া দেওয়া হয়। এক শ্রেণীর লোক শুধু ধনী। আর এক শ্রেণীল লোক সর্বহারা- গরীব। ধনী শ্রেণীর লোকেরা যাবতীয় আনন্দ-উৎসব নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তাহাতে সর্বহারা শ্রেণীর লোকদের প্রবেশানুমতি নাই। আর সর্বহারা শ্রেণীর লোকদের পক্ষে যেহেতু এই ধরনের জাঁকজমক পূর্ণ আনন্দ অনুষ্ঠান করা সম্ভবপর হয় না, এই কারণে এরূপ শ্রেণী কেন্দ্রিক দাওয়াত অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের মধ্যে খুব তীব্র হইয়া দেখা দেয়। তাহারা স্বাভাবিকভাবেই মনে করিতে শুরু করে, আমরা বুঝি মানুষ নহি। আমাদেরই সম্মুখে এতবড় অলীমার জিয়অফতের অনুষ্ঠাহ হইয়া গেল। অথ তাহাতে আমাদিগকে দাওয়াত দেয়া হইল না কেবলমাত্র এই কারণ যে, আমরা গরীব। ফলে তাহাদের হৃদয়-মনে যে ক্ষোভ দেখা দেয়, তাহাই বিক্ষোভের উদ্ভব করে এবং বিক্ষোভের ও বঞ্চনা-অনুভূতির ফলে তীব্র আক্রোশ ও প্রতিহিংসার সৃষ্টি করে। ইহার দরুন যে সামষ্টিক অশান্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহাকেই বলা হয় শ্রেণী বিদ্বেষ। ইহারই অনিবার্য পরিণতি শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী সংঘর্ষ। আর যে সমাজে একবার এই শ্রেণী বিদ্বেষ ও শ্রেণী সংগ্রাম সূচিত হয়, সে সমাজে চরম ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দেওয়া অনিবার্য হইয়া পড়ে। এই প্রেক্ষিতেই নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটির তাৎপর্য অনুধাবনীয়ঃ

 

****************************************

 

হযরত ইবনে আব্বসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ

 

যে অলীমায় কেবলমাত্র পেট ভরা পরিতৃপ্ত লোকদিগকেই খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয় এবং অভুক্ত ক্ষুধর্ত লোকদিগকে তাহাতে শরীক হইতে বাধাগ্রস্ত করা হয়, সেই খাবার অত্যন্ত খারাপ ধরনের- নিকৃষ্টতম খাবার।

 

বস্তুত মূল খাবারে তো কোন কারাবী বা দোষ প্রবেশ করে নাই। আসল দোষ হইল লোকদিগকে খাওয়ানের এই নিয়ম ও দৃষ্টিভঙ্গীতে। কেননা ইহা বিদ্বেষমূলক ও বিভেদকারী রসম। তেলা মাথায় তেল ঢালার ও তেলহীন মাথাকে তেল বঞ্চিত রাখার দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গী মানবতার জন্য কখনই কল্যাণকর হইতে পারে না। দূর অতীত কাল হইতে বর্তমান এবং বর্তমান হইতে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত এই হীন ও বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা ও দৃষ্টি ভঙ্গীর বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম অভিযান অব্যাহত, অবিশ্রান্ত ও শাশ্বত। কাজেই শুধু অলীমারই নয়, সর্বপ্রকারের দাওয়াতেই ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দেওয়া ও শেষোক্তদের দাওয়াত না দেওয়ার নীতি বর্বর জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

দ্বিতীয় বলা হইয়াছে, অলীমা’র দাওয়াত পাইলে তাহা কবুল করা ও সে দাওয়াত অনুযায়ী উপস্থিত হওয়া একান্তই কর্তব্য। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের ভাষা অত্যন্ত তীব্র ও কঠোর। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ দাওয়াত পাইয়া যে তাহা কবুল করে না ও উপস্থিত হয় না, সে আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করে। ইহার কারণ এই যে, আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূল (স) এই সব দাওয়াতে উপস্থিতত হওয়ার নির্দেশ দিয়াছেন। আর সে কার্যত উহা পালন করে নাই, দাওয়াতে উপস্থিত না হইয়া সে আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের আদেশ অমান্য করিয়াছে।

 

ইহা হইতে বুঝা যায়, অলীমা’র দাওয়াত কবুল করা- কথা ও বাস্তব উভয় দিক দিয়াই ওয়াজিব। *********** ‘নাফরমানী’ শব্দটি কেবল ওয়াজিব তরক করা সম্পর্কেই প্রযোজ্য। ওয়াজিব কাজ করা না হইলেই বলা যায়, নাফরমানী করা হইয়াছে। আর ইবনে আবদুল বার, কাযী ইয়ায ও নববী প্রমুখ হাদীসবিশারদ মনীষীগণ ইহার ওয়াজিব হওয়া বিষয়ে সম্পূর্ণ মতৈক্য প্রকাশ করিয়াছেন।

 

এই পর্যায়ের আর একটি হাদীসঃ

 

****************************************

 

রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে অলীমার জিয়াফতে সেই লোকদিগকে আসিতে নিষেধ করা যাহারা এই ধরনের দাওয়াতে সাধারণত অসিতে অভ্যস্থ- আসে এবং আহবান জানানো হয় সেই লোকদিগকে, যাহারা উহা অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করে। আর যে লোক দাওয়াত কবুল করে না, দাওয়াতে উপস্থিত হয় না, সে আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের  নাফরমানী করে

 

এই হাদীসটি ‘মরফু-মুত্তাসিল’ অর্থাৎ রাসূলে করীম (স) এর কথা, সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত এবং সনদের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন, সুরক্ষিত।

 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বিবাহের অলীমা ও অন্যান্য সকল প্রকারের দাওয়াতই কবুল করিতেন এবং অনেক সময় তিনি রোযাদার হইয়াও তাহাতে উপস্থিত হইতেন। হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

দাওয়াতে উপস্থিত তো হইবে। তাহার পর রোযাদার না হইলে সে খাইবে, আর রোযাদার হইলে যুগল দম্পতির জন্য সে দোয়া করিবে।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]