জায়দ ইবনে আসলাম হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যখন বিবাহ করে কিংবা কোন দাসী ক্রয় করে তখন (তাহার সহিত প্রথম সাক্ষাতের কালে) তাহার মাথার অগ্রভাগের উপর হাত রাখা ও বরকতের জন্য দোয়া করা তাহার কর্তব্য। আর তোমাদের কেহ যখন কোন উট (গরু বা মহিষ) খরীদ করে, তখন উহার চুটে’র উপর হাত রাখিয়া শয়তান হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া উচিত।
(মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি মুয়াত্তা ইমাম মালিক হইতে গ্রহীত। জায়দ ইবনে আসলাম সাহাবী নহেন। তিনি একজন তাবেয়ী। তাবেয়ী লোকের সরাসরিভাবে রাসূলের কথা বর্ণনা করা ও যে সাহাবী রাসূলের নিকট এই কথাতিট প্রথম শুনিয়াছিলেন তাঁহার নাম উল্লেখ না করাকে ******** বলা হয় ও এই হাদীসকে বলা হয় ‘মুরসাল’। এই হিসাবে উপরোদ্ধৃত হাদীসটি ‘মুরসাল’। ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেন, আম্বাসা ইবনে আবদুর রহমানও এই হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু তিনি এই হাদীসের প্রথম বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম উল্লেখ করিয়াছেন। সেই হিসাবে তাঁহার বর্ণনার সনদ ‘মুত্তাসিল’ (***********)। ‘তবে আম্বাসা যয়ীফ বর্ণনাকারী।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবূ লাসআল-খাজায়ী হইতেও এই হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে। তবে উহার ভাষা ইহা হইতে কিছুটা ভিন্নতর। ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত ‘আমর ইবনে শুয়াইব- তাঁহার পিতা হইতে- তাহার দাদা হইতে- এই সনদে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে, তাহাতে **************- এর স্থলে ************ উদ্ধৃত হইয়াছে।
এই কথার অপর একটি বর্ণনার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
তোমাদের কেহ যখন স্ত্রী গ্রহণ (বিবাহ) করে, কিংবা কোন সেবক (দাস) ক্রয় (নিয়োস) করে, তখন যেন সে তাহার মাথার অগ্রভাসে হাত রাখিয়া মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ করিয়া বরকতের জন্য দোয়া করে। এই সময় যেন সে বলে, হে আল্লাহ আমি ইহার অনিষ্ট দুষ্কৃতি ও যে স্বভাব-প্রকৃতি দিয়া তুমি ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছ উহার অনিষ্ঠ ও ক্ষতি হইতে তোমার নিকট আশ্রয় চাহি।
রীতি অনুযায়ী একটা হইল ইজাব-কবুল- বিবাহের আকদ। আর একটা হইল স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকার। আলোচ্য হাদীসে যে দোয়া করিতে বলা হইয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই স্ত্রীর সহিত নিবিড় নিভৃত একাকীত্বে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ই হইতে পারে, তাহার পূর্বে নয়।
বরকতের দোয়া অর্থ, স্ত্রীর কপালের উচ্চ-অগ্রভাগের উপর হাত রাখিয়া এইরূপ দোয়া করাঃ
****************************************
হে আল্লাহ! আমার জন্য এই স্ত্রীতে বরকত দাও এবং উহার উপরও বরকত বর্ষণ কর।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর বর্ণনায় দোয়ার ভাষা এইঃ
****************************************
হে আমাদের আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ইহার সার্বিক কল্যাণ পাইতে চাহি এবং তুমি যে মৌল প্রকৃতির উপর উহাকে সৃষ্টি করিয়াছ, তাহার কল্যাণ তোমার নিকট প্রার্থনা করি। আর আমি তোমার নিকট পানাহ চাহি ইহার সর্বপ্রকার অনিষ্ট ও অনিষ্টকারিতা হইতে এবং তুমি তাহাকে যে প্রকৃতির উপর সৃষ্টি করিয়াছ উহার ক্ষতি ও অনিষ্ট হইতে।
আর যখন উষ্ট (গরু ছাগল মহিষ) ইত্যাদি খরীদ করিবে তখন উহার পৃষ্ঠদেশের উচ্চ স্থানে হাত রাখিয়া শয়তানের শয়তানী প্রভাব হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া উচিত। এই পানাহ চাওয়ার কাজটি হইবে তখন যখন খরীদ করা হইয়া যাইবে ও মালিক জন্তুটি ক্রয়কারীর হাতে হস্তান্তরিত করিয়া দিবে। ইহার কারণ এই যে, জন্তু-জানোয়ারের উপর শয়তানের অনেকটা কর্তৃত্ব স্থাপিত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আল্লাহর নাম ও ‘আয়ুযুবিল্লাহ’ উচ্চারিত হয়, তখন শয়তান পালাইয়া যায়। হযরত ইবনে উমরের বর্ণনামতে এইখানেও পূর্বোদ্ধৃত দোয়া পাঠ করিতে বলা হইয়াছে।
বস্তুত স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকালে উক্তরূপ দোয়া করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা স্ত্রীর কারণেই সাধারণত দাম্পত্য জীবন সুখেরও হয়, হয় দুঃখেরও। অথচ এই স্ত্রীকে লইয়া সারাটি জীবন অতিবাহিত করিতে হয়। পরবর্তী বংশের ধারা তাহার গর্ভজাত সন্তান হইতেই অগ্রসর হইতে থাকে। সেই বংশের ভাল বা মন্দ হওয়া অনেকখানি স্ত্রীর উপরই নির্ভর করে।
(*******************)
নব দম্পতির প্রথম সাক্ষাৎ ও নিভৃত একাকীত্বে প্রথম মিলনকালে নফল নামায পড়ার কথাও একটি হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে। আবূ উমাইদের মুক্ত দাস আবূ সায়ীদ একজন তাবেয়ী। তিনি বলিয়াছেনঃ আমি বিবাহ কলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবূ যার গিফারী ও হুযাইফা (রা) প্রমুখ সাহাবীগণকে আহবান করিলাম। তখন তাঁহারা আমাকে বলিলেনঃ
****************************************
তোমার নিভৃত ঘরে তোমার স্ত্রী যখন প্রবেশ করিবে, তখন তুমি দুই রাকআত নামায পড়িবে। অতঃপর তোমার ঘরে যাহা প্রবেশ করিয়াছে উহার কল্যাণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর এবং উহার অনিষ্ট হইত তাঁহার নিকট পানাহ চাও। তাহার পর তুমি ও তোমার স্ত্রীর যাহা ইচ্ছা তাহাই করিবে।
মনে রাখা আবশ্যক, এই বক্তব্যটি স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর নয়, ইহা সাহাবীগণের কথা। এই হাদীসটির সনদ সহীহ বলা হইয়াছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্ত্রী যখন তাহার স্বামীর নিভৃত কক্ষে প্রথম প্রবেশ করিবে, তখন স্বামী দাঁড়াইবে এবং স্ত্রী তাহার পিছনে দাঁড়াইবে। অতঃপর দুইজনেই একত্রে দুই রাকআত (নফল) নামায পড়িবে। আর এই বলিয়া দোয়া করিবে; হে আমাদের আল্লাহ! আমার পরিবারবর্গে আমাকে বরকত দাও এবং আমাকে বরকত দাও আমার পরিবারবর্গের জন্য। হে আল্লাহ! আমার মাধ্যমে তুমি তাহাদিগকে রিযিক দাও, আর আমাকে রিযিক দাও তাহাদের মাধ্যমে। হে আল্লাহ! আমাদিগকে তুমি যতক্ষণ একত্রিত রাখিবে, কল্যাণের মধ্যে রাখিও। আর যখন তুমিই বিচ্ছিন্ন করিবে, তখনও কল্যাণের মধ্যেই বিচ্ছন্ন করিও।
(ইবনে আবূ শাইবাহ, তাবারানী)
মুহাদ্দিসদের মতে হাদীসটির সনদ সহীহ।
এই পর্যায়ে আরও একটি কথা স্মরনীয়। আর তাহা হইল, স্ত্রীর সহিত প্রথম সাক্ষাৎকারে করে যেমন সুসজ্জিত থাকে, অনুরূপভাবে, পুরুষটিরও উচিত বর হিসাবে যথা সম্ভব সুসজ্জিত হইয়া কনের সম্মুখে উপস্থিত হওয়া। এই বিষয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর একটি উক্তি উল্লেখ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমি অবশ্যই আমার স্ত্রীর (সন্তুস্টির) জন্য সুসাজে সজ্জিত হইব যেমন সে আমার (সন্তুষ্টির) জন্য সুসাজে সজ্জিত হইয়াছে। উপরন্তু তাহার উপর আমার যা কিছু অধিকার আছে তাহা সবই সম্পূর্ণরূপে আমি আদায় করিয়া লইতে চাহি। তাহা হইলে সেও আমার নিকট হইতে তাহার পাওনা সম্পূর্ণ মাত্রায় আদায় করিয়া লইবে।
(কুরতুবী)