হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (স) হইতে, তিনি বলিয়াছেনঃ যে লোক আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার, সে যেন তাহার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয় আর তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও। কেননা তাহারা পাঁজড়ের হাড় হইতে সৃষ্ট। আর পাঁজড়ের হাড়ের উচ্চ দিকটাই বেশী বাঁকা। তুমি যদি উহাকে সোজা করিতে যাও, তাহা হইলে উহাকে চূর্ণ করিয়অ ফেলিবে। আর উহাকে যদি এমনিই ছাড়িয়া দাও, তাহা হইলে উহা চিরকাল বাঁকা-ই থাকিবে। অতএব তোমরা মেয়েদের প্রতি কল্যাণকামী হও।
(বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী)
ব্যাখ্যাঃ পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে হাদীসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইহাতে সাধারণভাবে স্ত্রীলোকদের কল্যাণ কামনার কথা বিশেষ তাকীদ সহকারে বলা হইয়াছে, বলা হইয়াছে প্রতিবেশীকে কোনরূপ কষ্ট না দেওয়ার কথা এবং সর্বোপরি ইহাতে নারী-প্রকৃতি সম্পর্কে এক গভীর সুক্ষ্ম তত্ত্ব কথা বলা হইয়াছে। কথাগুলি বিস্তারিত বিশ্লেষণ সাপেক্ষ।
হাদীসটির সূচনাতেই বলা হইয়াছে, যে লোক আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার, সে যেন তাহার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। অন্য কথায় সৃষ্টিলোকের সূচনা কিরূপে হইল, মানুষ কিভাবে অস্তিত্ব ও জীবন লাভ করিল এ বিষয়ে ইসলামের দেওয়া আকীদা বিশ্বাস করিলে সে কখনও প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে পারে না। কেননা, ইসলামের ঘোষণা হইল, কিছুই ছিল না, এক আল্লাহ ছাড়া। তিনিই প্রথম নিজ ইচ্ছা ও কুদরতে এই বিশ্বকে সৃষ্টি করিয়াছেন। মানুষকেও তিনিটি জীবন ও অস্তিত্ব দিয়াছেন। আর মানুষ হিসাবে দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে একই বংশজাত সন্তান রূপে সৃষ্টি করিয়াছেন। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন সামাজিক জীব হিসাবে। সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে মানুষ নানা দিকদিয়াই বাধ্য। অতএব মানুষের পাশে মানুষের অবস্থান এক স্বাভাবিক ও অপরিহার্য ব্যাপার। তাহা সম্ভব হইতে পারে কেবল তখন তিনি যদি পাশাপাশি বসবাসকারী লোকেরা পরস্পরকে কোনরূপ কষ্ট ও যন্ত্রণা না দেয়। যদি দেয়, তাহা হইলে ইহা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, সে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনিতে পারে নাই। কেননা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমানদার হইত, তাহা হইলে প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রতিবেশীকে আল্লাহর সৃষ্ট ও একই মানব বংশজাত মনে করিয়া তাহাকে ভাই বলিয়া বুকে জড়াইয়া রাখিত, তাহাকে জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়ার কোন কাজই সে করিতে পারিবে না। তবে প্রতিবেশীকে জ্বালা যন্ত্রণা দেয় এমন মুসলমান ব্যক্তি যে সম্পূর্ণ কাফির হইয়া গিয়াছে, এইরূপ ফতোয়া দেওয়া বোধ হয় এই হাদীসের উদ্দেশ্য নয়। ইহার তাৎপর্য এই যে, এইরূপ ব্যক্তি নিজেকে ঈমানদার দাবি করিলে বুঝিতে হইবে, তাহার যথার্থ বা পূর্ণ ঈমান নাই। ইহা অবশ্য এক ধরনের আকায়েদের ব্যাপার। কিন্তু রাসূলে করীম (স)-এর কথার ভঙ্গী ও ধরন বিবেচনা করিলে নিঃসন্দেহে বুঝিতে হয় যে, প্রতিবেশীকে জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়া বা না দেওয়ার ব্যাপারটির স হিত ব্যক্তির আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের গভীর সম্পর্ক রহিয়াছে। তাহা না হইলে রাসূলে করীম (স) এইরূপ ভঙ্গীতে কথাটি বলিতেন না। প্রতিবেশীকে জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়া সম্পূর্ণ বেঈমানীর কাজ। ইহা পরবর্তী কথার ভূমিকায় মনে করা যাইতে পারে। কেননা পুরুষের জন্য স্ত্রী এবং স্ত্রীর জন্য স্বামী সর্বাধিক নিকটবর্তী প্রতিবেশী। সেই কারণেই ইহার পরবর্তী সব কথাই স্ত্রীলোক সম্পর্ক বলা হইয়াছে। প্রথম কথা, ***************** ইহার একটি অর্থ, স্ত্রী লোকদের কল্যাণ চাওয়ার ব্যাপারে, হে পুরুষেরা- তোমরা পরস্পরকে উপদেশ দাও। কিন্তু বায়জাবী বলিয়াছেন, এই বাক্যাংশে অর্থঃ
****************************************
আমি তোমাদিগকে স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে ভাল উপদেশ দিতেছি, তোমরা তাহাদের ব্যাপারে আমার দেওয়া এই অসিয়াত কবুল কর।
আর তাইয়্যেবী বলিয়াছেনঃ এই বাক্যটির অর্থঃ
****************************************
স্ত্রীলোকের কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে তোমরা নিজেদের নিকট হইতেই সৎপরামর্শ লাভ করিতে চেষ্টা কর।
আবার কেহ কেহ এই বাক্যটির অর্থ করিয়াছেনঃ *************** ‘তোমরা রোগাক্রান্ত মুমূর্ষ ব্যক্তির নিকট হইতে তাহার স্ত্রী বা স্ত্রীদের ব্যাপারে অসীয়াত বা উইল পাইতে চাও’। অর্থাৎ এইরূপ ব্যক্তি তাহার স্ত্রী বা স্ত্রীদের জন্য অসীয়াত করিয়া যাইতে বল, তাহাকে এই জন্য উদ্বুদ্ধ কর। কেননা স্ত্রীলোকেরা নাজুক, দুর্বল, অসহায়। সহসা স্বামীর মৃত্যু হইয়া গেলে তাহারা অকূল পাথরে পড়িয়া যাইতে পারে ও নানাভাবে তাহাদিগকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেওয়অর ও জীবিকা পাওয়ার অধিকার হইতে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র শুরু হইয়া যাইতে পারে।
ইহার আরও একটি অর্থ লিখা হইয়াছে। তাহা হইলঃ
****************************************
তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আমার দেওয়া উপদেশ ও নসীহত গ্রহণ কর, সেই অনুযায়ী আমল কর। তাহাদের ব্যাপারে মোটেই তাড়াহুড়া করিবে না- বিশেষ ধৈর্য তিতিক্ষা ও অপেক্ষা-প্রতীক্ষা অবলম্বন করিও। তাহাদের সহিত খুবই সহৃদয়তাপূর্ণ দয়ার্দ্র এবং নম্র-মসৃণ ব্যবহার গ্রহণ করিবে। আর তাহাদের প্রতি অনুগ্রহ ও অনুকম্পামূলক আচরণ করিও।
ইহার পর হাদীসে স্ত্রীলোদের প্রকৃতি ও স্বভাব সম্পর্কে যাহা বলা হইয়াছে তাহা এ পর্যন্ত বলা কথার কারণ ও যৌক্তিকতা বুঝাইবার জন্য বলা হইয়াছে। এই পর্যায়ের কথা দুইটি ভাগে বিভক্ত। উহার প্রথম ভাগে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
কেননা স্ত্রীলোক পাঁজড়ের হাড় হইতে সৃষ্টি। আর পাঁজড়ের হাড়ের উপরিভাগটাই অধিক বাঁকা।
অন্য কথায় স্ত্রীলোককে পাঁজড়ের অধিক বাঁকা হাড় দিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে। আর অধিক বাঁকা হাঁড়টি হইতেছে সর্বোচ্চের হাড়খানি। এখানে প্রশ্ন উঠে, স্ত্রী লোকদিগকে পাঁজড়ের অধিক বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হইয়াছে রাসূলের এই কথাটির ব্যাখ্যা কি? প্রকৃতই কি পাঁজড়ের অধিক বাঁকা হাড় দিয়া স্ত্রীলোকদিগকে সৃষ্টি করা হইয়াছে? (তাহা হইলে প্রশ্ন উঠে সে হাড় কাহার?) না এই কথাটি দৃষ্টান্তমূলক বা রূপক? স্ত্রীলোকদের স্বভাব প্রকৃতি সাধারণত যে বক্রতা, হঠকারিতা, জিদ ও অনমণীয়তা দেখা যায়, ভাঙ্গিয়া যায়, তবু নতি স্বীকার করে না- এই কথাটি পাঁজড়ের বাঁকা হাড়ের দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইয়াছেন? কুরআন হাদীসে বিশেষজ্ঞ লোকদের নিকট হইতে এই উভয় পর্যায়ের কথা ও ব্যাখ্যা গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেন, হ্যাঁ, প্রকৃতপক্ষেই স্ত্রীলোকদিগকে পাঁজড়ের বাঁকা হাড় দিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে। তাহার ইতিহাস এই যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আ)-কে সৃষ্টি করিয়া যখন জান্নাতে থাকিতে দিলেন, তখন তিনি একাকীত্ব ও সঙ্গীহীনতার কারণে অস্থীর চিত্ত হইয়া পড়েন। তিনি নিরুপায় হইয়া আল্লাহর নিকট স্বীয় নিঃসঙ্গতার অভিযোগ করেন। পরে তিনি যখন ঘুমাইলেন, তখন স্বপ্নে এক অপূর্ব সুন্দরী রমনী দেখিতে পান। নিদ্রাভঙ্গ হইলে জাগ্রতাবস্থায় তিনি তাঁহার পার্শ্বে সেই স্বপ্নে দেখা রমনীকেই বসিয়া থাকিতে দেখলেন। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কে? বলিলেনঃ আমি হাওয়া। আমাকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করিয়াছেনঃ ************** “এই উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার নিকট শান্তি সুখ স্থিতি লাভ করিবে। আর আমি শান্তি সুখ স্থিতি লাভ করিব তোমার নিকট”।
এই পর্যায়ে তাবেয়ী আতা হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ ************ ‘হযরত হওয়া হযর আদমের পাঁজড়ের হাড় দিয়া সৃষ্ট হইয়াছিলেন’। আল্লামা জাওহারী বলিয়াছেন; হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করা হইয়াছে পাঁজড়ের যে হাড় দিয়া উহার নাম ******** সর্বনিম্ন হাড়। মুজাহিদ বলিয়াছেনঃ নারীকে নারী বলা হইয়াছে এই কাণে যে, তাহাকে নর হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে। আর সে নর ব্যক্তি হইল আদম। মুকাতিল ইবনে সুলাইমান বলিয়াছেনঃ হযরত আদম জান্নাতে কিছুক্ষণ ঘুমাইয়া ছিলেন। তখন তাঁহার ডান পার্শ্বের পাঁজড়ের ছোট হাড়খানি দিয়া হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়। এই হাড়খানিকে বলা হয় **********। কিন্তু আদম কোনরূপ ব্যাথ্যা যন্ত্রণা অনুভব করেন নাই। কেননা তিনি যদি ব্যাথ্যাই পাইতেন, তাহা হইলে পুরুষরা স্ত্রীলোকদিগকে কক্ষণই ভালবাসিতে পারিতেন না।
রুবাই ইবনে আনাস বলিয়াছেনঃ হযরত হাওয়া হযরত আদমের (সৃষ্টির পর উদ্ধৃত্ত) মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি হইয়াছেন। তিনি তাঁহার এই কথার দলীল হিসাবে কুরআনের এই আয়াতটি পেশ করিয়াছেনঃ ********* ‘সেই আল্লাহই তোমদিগকে মৃত্তিকা দিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন’। ‘তোমাদিগকে’ বলিতে পুরুষ ও নারীর সব মানুষই বুঝায়। কিন্তু এই মত সমর্থনীয় নয়। কেননা কুরআন মজীদেরই ঘোষণাঃ
****************************************
সেই আল্লাহ তোমাদিগকে এক মাত্র ‘প্রাণী’ হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন। সেই একটি মাত্র প্রাণী হইতেই তাহার জৃড়িতে সৃষ্টি করিয়াছেন।
এ আয়াত একটি মাত্র প্রাণী’ হইলেন হযরত আদম এবং তাঁহার জুড়ি বলিতে হযরত হাওয়াকে বুঝানো হইয়াছে। হওয়াকে সৃষ্টি করা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী হইল ************** সেই একটি মাত্র প্রাণী হইতেই (হাওয়াকে) সৃষ্টি করিয়াছেন। এই হিসাবে রাসূলে করীম (স)আলোচ্য হাদীসের বাণীটুকু কুরআনের এই আয়াতেরই ব্যাখ্যা বলিতে হইবে।
এই ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রাসূলে করীমের আলোচ্য কথাটির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হইয়া যায়। ইহা ছাড়া ইহাকে দৃষ্টান্তমূলক কথা মনে করিলেও কোন দোষ নাই। বরং বলিতে হইবে, নারী প্রকৃতি বুঝাইবার জন্য ইহাপেক্ষা সুন্দর পূর্ণাঙ্গ যথার্থ দৃষ্টান্ত আর কিছু হইতে পারে না। নারী প্রকৃতির বক্রতা বুঝাইবার জন্য ********* পাঁজড়ের হাড়ের শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে। কেননা পাঁজড়ের হাড় বাঁকা- উহার অগ্রভাগ বেশী বাঁকা, তাহাতো সর্বজনবিদিত। ইহার অর্থঃ
****************************************
স্ত্রীলোক এমন এক প্রকৃতিতে সৃষ্ট হইয়াছে যে, সেই মূল সৃষ্টি-প্রকৃতিতেই বক্রতা নিহিত হইয়া আছে। অন্য কথায়, তাহারা বাঁকা মৌল উপাদান দ্বারাই সৃষ্ট। কাজেই উহা দ্বারা কাজ লইতে ও উপকৃত হইতে হইলে তাহারা প্রকৃতিগতভাবে যেমন আছে তেমন রাখিয়া ও তাহা পুরাপুরি পর্যবেক্ষণাধীন রাখিয়অ উহাকে প্রয়োগ ও নিয়োগ করিতে হইবে এবং তাহাদের স্বভাবগত বক্রতার ব্যাপারে পুরাপুরি ধৈর্য অবলম্বন করিতে হইবে।
এই প্রেক্ষিতেই দ্বিতীয় ভাগের কথা অনুধাবনীয়। বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তুমি যদি এই বক্রতাকে সোজা করিতে যাও বা চেষ্টা কর তাহা হইলে তুমি উহাকে ভাঙিয়া ফেলিবে। আর যদি যেমন আছে, তেমনি থাকিতে দাও, তাহা হইলে উহা চিরকালই বাঁকা থাকিবে। এই বাঁকা অবস্থায়ই তোমরা কাজ করিয়া যাইবে।
কথাটি স্পষ্ট। সাধারণত বলা হয়, ‘স্বভাব যায় না মইলে’। কয়লার কৃষ্ণত্ব উহার আসল প্রকৃতিগত। সহস্র লক্ষবার ধুইলেও উহা কখনই সাদা বা ধলা হইবে না। রাসূলে করীম (স) এই জন্যই বলিয়াছেনঃ তোমরা যদ শুনিতে পাও একটি পাহাড় স্থানান্তরিত হইয়াছে, তবে তাহা বিশ্বাস করিতে পার। কিন্তু কাহারও স্বভাব বা প্রকৃতি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে শুনিতে পাইলে তাহা কিছুতেই বিশ্বাস করিও না।
এতদসত্ত্বেও উহাকে সোজা ও ঋজু করিতে চাহিলে উহার অনিবার্য পরিণতি হইবে উহার চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাওয়া। ইহাও পূর্ববর্তী দৃষ্টান্তেরই জের। চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাওয়া অর্থ তালাক ও চিরবিচ্ছিন্নতার উদ্ভব হওয়া। ইহা ছাড়া অন্য কোন পরিণতি হইতে পারে না নারী প্রকৃতিকে সোজা ও ঋজু করিতে চেষ্টা করার। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত এই হাদীসটির ভাষা হইতে উহা অধিকতর স্পষ্ট হইয়া উঠে। হাদীসটি এইঃ
****************************************
তুমি যদি তাহা দ্বারা সুখ লাভ করিতে চাহ, তাহা হইলে তোমাকেক তাহার এই স্বভাবগত বক্রতা সহকারেই তাহাকে ব্যবহার করিতে হইবে। আর তুমি যদি এই বক্রতাকে সোজা ও ঋজু করিতে চেষ্টা কর, তাহা হইলে তুমি তাহাকে চূর্ণ করিয়া দিবে। আর তাহার চূর্ণতা হইল তাহাকে তালাক দিয়া দেওয়া।
অর্থাৎ তোমার সেই চেষ্টা ব্যর্থ ও অসফল হওয়ার কারণে তোমার মন এতই বিরক্ত ও বিদ্রোহী হইয়া উঠিবে যে, শেষ পর্যন্ত তুমি তাহাকে তালাক না দিয়া পারিবে না।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
স্ত্রীলোকদের সহিত সহৃদয়তা ও সহানূভূতিপূর্ণ ব্যবহার করা, তাহাদের প্রতি কল্যাণময় আচরণ গ্রহন করা- দয়া অনুগ্রহ প্রদর্শন করা, তাহাদের স্বভাব-চরিত্রের বক্রতার জন্য ‘সবর’ করা- তাহা দেখিয়া ধৈর্য হারাইয়া না ফেলা, তাহাদের জ্ঞান-বুদ্ধির দুর্বলতা বরদাশত করার জন্য স্বামীগণকে উদ্বদ্ধ করিতে চাওয়া হইয়াছে এই হাদীসে এবং বিনা কারণে তাহাদিগকে তালাক দেওয়ার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে যে, তাহাদের স্বভাবগত বক্রতাকে সোজা করিতে চাওয়া ও চেষ্টা করা উচিত নয়।
ইহাই হাদীসটির সারকথা ও মূল শিক্ষা।
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস স্মরণীয়। হাদীসটি এইঃ
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ কোন ঈমানদার পুরুষ কোন ঈমানদার মেয়ের প্রতি কোন সর্বাত্মক ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করিবে না। কেননা সে মেয়েলোকটির চরিত্রের একটি দিক যদি তাহার পছন্দ না-ই হয়, তবুও তাহার চরিত্রের অপর একটি দিক নিশ্চয়ই এমন যাহাতে সে অবশ্যই সন্তুষ্ট হইতে পারিবে।
(মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ কোন মানুষই নিরংকুশ ও অবিমিশ্রভাবে মন্দ ও ঘৃণ্য হইতে পারে না। তাহার মধ্যে অনেকগুলি খারাপ দিক থাকিলেও কোন কোন দিক নিশ্চয়ই এমন থাকিবে যাহা ভাল বলিয়া মনে করা যাইবে ও পছন্দ হইবে। ইহা সাধারণ লোক-চরিত্র সম্পর্কিত কথা। কিন্তু আলোচ্য হাদীসটির বিশেষ প্রয়োগ হইল স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক জীবনের ক্ষেত্রে। স্বামী হয়ত স্ত্রীর চরিত্রের কোন একটি দিক খুব খারাপ দেখিতে পাইল। আর এমনি চট করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়া বসিল, এ ভাল নয়, এই স্ত্রী লইয়া ঘর করা যাইবে না, ইহাকে লইয়া আমার জীবন সুখময় হইবে না। আর এই মনোভাবের দরুন তখন-তখনই তাহাকে তালাক দিয়া বসিল। ইহা বস্তুতই শুধু অনুচিতই নয়, ইহা জুলুম, ইহা মানবতার অপমান। কেননা সে যখন ঈমানদার-স্বামী কিংবা স্ত্রী- তখন তাহার মধ্যে মন্দ দিক দুই-একটা থাকিলেও অনেকগুলি দিক তাহার নিশ্চয়ই ভাল থাকিবে। ইহাই স্বাভাবিক। ফলে একদিক দিয় স্ত্রী কিংবা স্বামী অপছন্দ হইলেও এবং উহার দরুন জীবন অচল ও বিড়ম্বনাময় হইলেও অন্য অনেক কয়টি দিক দিয়া জীবন মাধুর্যপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারে। বিশেষত সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা দুই যুবক-যুবতী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া নূতনভাবে জীবন যাপন করিতে শুরু করে, তখন পরস্পরের ব্যাপারে এইরূপ অবস্থা দেখা দেওয়া- বিশেষ করিয়া বিবাহের পর-পরই এ দাম্পত্য জীবনের সূচনায়ই- কিছুমাত্র বিচিত্র নয়, অসম্ভবও নয়। তাই নবী করীম (স)- এর এই বাণী এবং এই দৃষ্টিতে ইহার মূল্য অসামান্য। এ কথাটির প্রয়োগ এখানেও যে, স্ত্রীর গায়ের চামড়া উজ্জ্বল কান্তিপূর্ণ নয় দেখিয়া স্বামী যদি হতাশাগ্রস্ত হইয়া পড়ে, তবে তাহার চিন্তা করা উচিত যে, হইতে পারে ইহার চামড়া সুশ্রী বা সুন্দর নয়, কিন্তু ইহার হৃদয়-অন্তর ও স্বভাব-চরিত্র তো সুন্দর হইতে পারে; ভাল ভাল গুণ, যোগ্যতা-কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা তাহার থাকিতে পারে। অতএব মনে তাহার প্রতি কোন স্থায়ী বিদ্বেষ ও বিরুপভাব পোষণ করা এবং ইহার ফলে তাহাকে ত্যাগ করিতে উদ্যত হওয়া কোন বুদ্ধিমান লোকের কাজ হইতে পারে না। কুরআন মজীদে ঠিক এই কথাটিই বলা হইয়াছে, এই ভাষায়ঃ
****************************************
তোমরা যদি (তোমাদের) স্ত্রীদের অপছন্দই করিয়া বস, তাহা হইলে নিশ্চিত জানিও, এটা খুবই সম্ভব যে, তোমরা হয়ত কোন একটি জিনিস অপছন্দ করিতেছ, অথচ আল্লাহ তা’আলা তাহাতেই বিপুল কল্যাণ রাখিয়া দিয়াছেন।
আল্লামা কুরত্ববী এই আয়াতটির তফসীরে উপরোক্ত হাদীসটিই উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা হইতে নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারা যায় যে, এই আয়াতটির তাফসীর যেমন এই হাদীসটির দ্বারা স্পষ্ট হয়, তেমনি এই হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা বুঝিবার জন্য এই আয়াতটি অবশ্যই স্মার্তব্য। কুরআন ও হাদীস যে কতখানি ওতোপ্রোত ও পরস্পর জড়িত, তাহা বুঝিতে কিছুমাত্র কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
(*************)
অতএব নারী জাতির কল্যাণ কামনায় ব্রতী হওয়া সকলেই কর্তব্য। এই কল্যাণ কামনা প্রসঙ্গে যে সব উপদেশ নসীহত দেওয়া হইয়াছে, তাহা মনে-প্রাণে কবুল করা উচিত। স্ত্রী জাতির এই স্বাভাবিক বক্রতার কথা মনে রাখিয়া দাম্পত্য জীবন শুরু করিলে বিপর্যয় এড়াইয়া নিয়া সুন্দর সহজ ও মধুময় জীবন যাপন সম্ভবপর হইবে। কেননা নারী প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য ধারণাও না থাকার দরুন স্বামীর দিক হইতে এমন সব আচরণ হয়, যাহার পর বিচ্ছেদ অনিবার্য হইয়া পড়ে। অথচ তাহা কখনই কাম্য হইতে পারে না।
(*******************)
এই হাদীসটির আলোকে মানব-প্রকৃতি সব বিশ্বপ্রকৃতি খুব সহজেই বুঝিতে পারা যায়। মহান সৃষ্টিকর্তা এই বিশ্বলোককে- ইহার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকেও একটি কঠিন নিয়মের বন্ধনে বাঁধিয়া রাখিয়াছেন। প্রত্যেকটি বস্তুকেই দিয়াছেন একটা একান্ত্র নিজস্ব ও স্বতন্ত্র প্রকৃতি। সে প্রকৃতি সমূলে পরিবর্তন করার সাধ্য কেহরই নাই। বাহ্যিক দিকদিয়া কিছুটা পরিবর্তন আনা সম্ভব হইলেও হইতে পারে। লবনের লবনাক্ততা ও মধুর তীব্র মিষ্টতা বদলানো যায় না। বদলাইলে তখন লবন লবন থাকিবে না, মধু উহার মাধুর্য হারাইয়া ফেলিবে।
মানুষও একটি মৌলিক প্রকৃতিতে সৃষ্ট। ইহা সাধারণ সর্বমানুষের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই মানুষতো জন্মগতভাবেই দুই লিঙ্গে বিভক্ত পুরুষ ও নারী। পুরুষ তাহার নিজস্ব প্রকৃতি লইয়াই বাঁচিতে পারে। বাঁচিতে পারে. দায়িত্ব পালন করিতে পারে পুরুষ হিসাবে। তাহার পৌরুষ নিঃশেষ করিয়া নারী প্রকৃতিতে সজ্জিত করা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে নারীও একটা বিশেষ ও একান্ত নিজস্ব প্রকৃতিতে নারী। তাহার নারীত্ব উৎপাটিত করিয়া তাহাকে পৌরুষে সুশোভিত করিতে চাওয়া শুধু ভুলই নয়, প্রকৃতি পরিপন্হী কাজ। আর প্রকৃতি পরিপন্হী কাজ কখনই সফল হইতে পারে না। এই কথা যেমন পুরুষকে মনে রাখিতে হইবে, তেমনি মনে রাখিতে হইবে নারীকেও। অতএব পুরুষকে পুরুষোচিত কাজ করিবার এবং নারীকে নারীজনোচিত কাজ করিতে দিতে হইবে সমাজ গঠন ও সামাজিক শৃংখলা স্থাপন ও সংরক্ষণের জন্য। অন্যথায় বিপর্যয় অবধারিত হইয়া পড়িবে।