হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হযরত নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পৃথিবী সুমিষ্ট-সুস্বাদু সবুজ-সতেজ। আর আল্লাহ তা’আলা তোমাদিগকে এই পৃথিবীতে তাঁহার খলীফা বানাইয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি যেন দেখিতে পারেন তোমরা কিরূপ ও কিভাবে কাজ কর। অতএব তোমরা ভয় কর পৃথিবী, ভয় কর নারীদের। কেননা বনী ইসরাইলীদের সমাজে যে প্রথম বিপর্যয় দেখা দিয়াছিল এই নারীদের লইয়া।
(মুসলিম, বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ এই পৃথিবী সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করা উচিত, পৃথিবীতে মানুষের স্থান ‘পজিশন’ কি এবং এই পৃথিবীতে মানুষের কিভাবে জীবন যাপন করা উচিত, উপরোক্ত হাদীসটির মূল বক্তব্য সেই পর্যায়ের। দুনিয়া বাস্তবতার দৃষ্টিতে মানবজীবনে কি রূপ লইয়া দেখা দেয়, এখানে মানুষের জীবনের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য কি এবং কিরূপ সতর্কতার সহিত এখানে মানুষের জীবন যাপন করা উচিত তাহাই মৌলিকভাবে বলা হইয়াছে এই হাদীসটিতে।
প্রথমতঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, দুনিয়াটা সুমিষ্ট শ্যামল সবুজ সতেজ। মানুষের নিকট ইহা চিরকালই লোভনীয় ও আকর্ষণীয় হইয়া দেখা দেয়। বৈষয়িক সুখ-শান্তি ও স্বাদ সুমিষ্ট ফলের মতই। উহা যেমন মানুষকে প্রলুব্ধ করে, তেমনি উহা মানুষকে নিজের দিকে আকর্ষণও করে অত্যন্ত তীব্রভাবে। মানুষ স্বভাবতই এই সব পাওয়ার জন্য আকুল ও উদগ্র হইয়া উঠে। দ্বিতীয়তঃ ইহা যতই আকর্ষণীয় ও লোভনীয় হউক না- কেন, উহার আয়ূষ্কাল খুবই সীমাবদ্ধ। খুব অল্পকালের মধ্যেই ধ্বংস হইয়া যায়। ইহাতে স্থায়ীত্ব বলিতে কিছুই নাই। ইহা নয় শাশ্বত বা চিরস্থায়। কিন্তু ইহার ক্ষণস্থায়ীত্ব ও প্রতিমূহুর্ত তিলে তিলে অবক্ষয়মানতা মানুষ সাধারণত বুঝিতে পারে না, উপলব্ধীও করিতে পারে না। ফলে মানুষ এক মায়া মরীচিকার পিছনে পাগলপারা হইয়া ছুটিতে থাকে। আর ইহার পরিণাম মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে কখনই ভাল হইতে পারে না।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর বুকে খলীফার মর্যাদার অভিষিক্ত করিয়াছেন। ‘খলীফা’ বলা হয় তাহাকে যে প্রকৃত মালিক বা কর্তা হয় না, হয় আসল মালিক ও কর্তার প্রতিনিধি। আসল মালিক ও কর্তার যাবতীয় কাজের কর্তৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব তাহার উপরই অর্পিত হয়। কিন্তু সে কর্তৃত্ব সে নিজ ইচ্ছমত চালাইতে পারে না, প্রকৃত মালিকের দেওয়া আইন-বিধান ও নিয়ম-নীতি অনুসরণের ভিত্তিতেই সে এই কাজ করিতে বাধ্য। বস্তুত মানুষও এই দুনিয়অর আসল মালিক ও কর্তা নয়। আসল মালিক ও কর্তা মহান আল্লাহ তা’আলা। তিনি মানুষকে এই দুনিয়া পরিচালনার যেমন অধিকার ও সুযোগ দিয়াছেন, তেমনি দিয়াছেন সেই অধিককার ও সুযোগ ব্যবাহারের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও মৌলিক আইন ও বিধান। এই হিসাবেই মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা। কুরআন মজীদেও আল্লাহ তা’আলার মানব-সৃষ্টি পূর্বের ঘোষনা উল্লেখ করা হইয়াছে এই ভাষায় ************** ‘আমি দুনিয়ার খলীফা বানাব’।
এই ঘোষণানুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষই ব্যক্তিগতভাবে এবং সমস্ত মানুষ সামষ্টিকভাবে এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফাহ। এই খিলাফত এই দিক দিয়াও যে, প্রত্যেক যূগের মানুষ তাহাদের পূর্ববর্তী যুগের স্থলাভিষিক্ত। আর সামষ্টিকভাবে গোটা মানব জাতি তাহাদের পূর্ববর্তী পৃথিবী-অধিবাসীদের- তাহারা যাহারাই হউক না কেন- স্থলাভিষিক্ত। এই স্থলাভিষিক্ততার মধ্যে এই কথাটিও নিহিত রহিয়াছে যে, তাহাদিগকে তাহাদের পরবর্তী কালের লোকদের জন্য নিজেদের স্থান ছাড়িয়া দিয়া পৃথিবী হইতে চলিয়া যাইতে হইবে। তখন তাহাদের পরবর্তী লোকেররা তাহাদের স্থানে হইবে আল্লাহর খলীফা। এই দুনিয়ার সর্বযুগের মানুষের প্রকৃত অবস্থান কোথায়, তাহা বুঝাইবার জন্য রাসূলে করীম (স)-এর সংক্ষিপ্ত বাক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে মানুষের আসল অবস্থানের কথা বলার পর রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ মানুষকে এইভাবে খলীফা বানাইবার মূলে আল্লাহ তা’আলার একমাত্র উদ্দেশ্য হইল, তিনি বাস্তবভাবে দেখিতে চাহেন, মানুষেরা কি রকমের কাজ করে- ব্যক্তি হিসাবে এবং সামষ্টিকভাবে। কুরআন মজীদে এই পর্যায়ে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
সেই মহান আল্লাহই মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করিয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি তোমাদের মধ্যে উত্তম কাজ কে করে, তাহা পরীক্ষা করিবেন।
এই পরীক্ষায় সঠিকভাবে উত্তীর্ণ হইবার জন্য আহবান জানাইয়া রাসূলে করীম (স) মানুষকে দুনিয়া এবং নারী সমাজ সম্পর্কে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের জন্য বলিয়াছেন। দুনিয়া সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্কতাবলম্বনের নির্দেশ দিয়াছেন এই জন্য যে, দুনিয়া বাস্তবিকই এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ নিজেদের প্রকৃত অবস্থানের কথা ভূলিয়া গিয়া অবাঞ্ছনীয় ও মারাত্মক ধরনের কাজ কর্মে লিপ্ত হইতে পারে। আর এই দুনিয়ার মানুষের বিভ্রান্তির সর্বাপেক্ষা বড় কারণ হইতে পারে নারী। কেননা দুনিয়ায় পুরুষের জন্য সর্বাধিক তীব্র আকর্ষণীয় হইতেছে নারী, আর নারীর জন্য পুরুষ। এই আকর্ষণ নারী ও পুরুষকে অবৈধ সংসর্গ ও সংস্পর্শে প্রবৃত্ত করে এবং উভয় উভয়ের নিকট হইতে সর্বধিক স্বাদ গ্রহণে লালায়িত হইয়া পড়ে। কিন্তু এই অবস্থাটা মানুষের জন্য কখনই কল্যাণকর হইতে পারে না। আর ইহা যে কল্যাণকর হইতে পারে না, বনী ইসরাইলীদের বিপর্যয়ের ইতিহাসই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। রাসূলে করীম (স) তাঁহার নারী সংক্রান্ত সতর্কীকরণের মুক্তি হিসাবে সেই ইতিহাসের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেনঃ বনী ইসরাইলরা যে কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়িয়া গিয়াছিল, নারীই ছিল উহার প্রথম কারণ। সেই সমাজের নারীরা তাহাদের পুরুষদেরকে প্রথমে অবৈধ সংসর্গে প্রলুব্ধ করে। তাহার পরই গোটা সমাজের যে পতন ও বিপর্যয় শুরু হয়, তাহারই পরিণতিতে তাহারা আল্লাহ কর্তৃক চরমভাবে অভিশপ্ত হয়। বস্তুত যে সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মিলনের নিয়ন্ত্রণহীন সুযোগ উন্মুক্ত থাকে, সে সমাজের সর্বাত্মক পতন ও বিপর্যয় কেহই রোধ করিতে পারে না। সমাজ জীবনে সুস্থতা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য এই হাদীসটি দিগদর্শনের কাজ করে। রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি আরও গুরুত্ব সহকারে বলা হইয়াছে নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনায়।
সায়ীদ ইবনে জায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল নবী করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার পরে লোকদের মধ্যে পুরুষদের জন্য সর্বাধিক বিপদ মেয়েদের হইতে আসার আশংকাবোধ করিতেছি।
এই হাদীসের ***** শব্দের অর্থ পরীক্ষার মাধ্যম। ইহার আর এক অর্থ বিপদ, মুছীবত, বিপর্যয়। এই বিপদ-মুছীবত-বিপর্যয়ও পরীক্ষারই উদ্দেশ্যে। বস্তুত নারীরা পুরুষের ঈমান ও চরিত্রের ব্যাপারে একটা বিরাট পরীক্ষা-মাধ্যম। কেননা আল্লাহ তা’আলা পুরুষদের স্বভাব প্রকৃতিতেই নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ সংরক্ষিত করিয়াছেন। এই আকর্ষনের দরুন জ্বেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হইতে পারে যেমন, তেমনি তাহাদের জ ন্য পুরুষরা মারা-মারি কাটাকাটি বা পারস্পরিক কঠিন শক্রতায় লিপ্ত হইতে পারে- হইয়া থাকে। অন্তত নারীরা যে পুরুষদের দুনিয়ার দিকে অধিক আকৃষ্ট করিতে ও হালাল-হারাম নির্বিচারে অর্থ লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত করিতে পারে- করিতে থাকে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। আর মানুষের জন্য ইহাপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদ আর কিছু হইতে পারে না। রাসূলে করীম (স)-এর কথা ***** ‘আমার পর- ইহার অর্থ, আমি দুনিয়ায় বাঁচিয়া থাকা পর্যন্ত এই ব্যাপারে জনগণকে সর্বোতভাবে সাবধান ও সতর্ক রাখিয়াছি। ফলে নারীকেন্দ্রিক সামাজিক উচ্ছৃংখলতা ও বিপর্যয় অনেকাংশে প্রতিরুদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু এই ‘কারণ’ কি একটি চিরস্থায়ী ব্যাপার? এবং ইহা কি সর্বাধিক ক্ষতিকর বিষয়? এই ক্ষতিকর ‘কারণ’ কি মানুষকে অনেক বেশী ক্ষতির মধ্যে ফেলিবে? এইরূপ আশংকা রাসূলে করীম (স) দুনিয়া হইতে চলিয়া যাওয়ার সময়ও অনুভব করিতেছিলেন। বস্তুত সেই তীব্র আশংকাবোধই প্রকাশি হইয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি হইতে।
হাফেজ ইবনুল হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
****************************************
অন্যান্য জিনিসের দ্বারা সৃষ্ট বিপর্যয়ের তুলনায় নারীদের সৃষ্ট বিপর্যয় অনেক কঠিন মারাত্মক ও সুদুরপ্রসারী হইয়া থাকে।
কুরআন মজীদে নৈতিক সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ সমূহের উল্লেখ প্রসঙ্গে এই নারীদের প্রতি যৌন আকর্ষনের সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ
****************************************
নারী আকর্ষণের প্রেম মানুষের জন্য সাধারণভাবে বেশী চাকচিক্যপূর্ণ বানাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
ইহা হইতে বুঝা যায় যে, নৈতিক ও সামাজিক জীবনে যে সব কারণে বিপর্যয় ঘটে, তাহার মধ্যে নারীই হইতেছে আসল কারণ।
চিন্তাবিদ বিজ্ঞানীরা বলিয়াছেনঃ
নারীর সবটাই বিপর্যয়ের কারণ। আর তাহাতে অধিক খারাপ দিকটি হইল এই যে, তাহাদিগকে এড়াইয়া চলা খুবই অসম্ভব ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়।
নারীদের বিবেক-বুদ্ধির স্বাভাবিক অসম্পূর্ণতা এবং দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে কম দায়িত্বের কারণে তাহারা কঠিন বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হইয়া থাকে।