হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) পুরুষদের সহিত সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারীদের এবং স্ত্রী লোকদের সহিত সাদৃশ্য গ্রহণকারী পুরুষের উপর অভিশাপ করিয়াছেন।
(বুখারী, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ ইবনে জরীর তাবারী এই হাদীসের ভিত্তিতে লিখিয়াছেনঃ পোষাক ও নারীদের জন্য নির্দিষ্ট অলংকারাদী ব্যবহারের দিক দিয়া স্ত্রীলোকদের সহিত পুরুষদের সাদৃশ্য করণ সম্পূর্ণ হারাম। স্ত্রীলোকদের পক্ষেও জায়েয নয় এই সব দিক দিয়া পুরুষদের সহিত সাদৃশ্য করা। এই সাদৃশ্য করার অর্থ, যে সব পোষাক ও অলংকারাদি কেবলমাত্র মেয়েরাই সাধারণত ব্যবহার করে তাহা পুরুষদের ব্যবহার করা, অনুরূপভাবে যেসব পোষাক ও ভূষণ সাধারণত পুরষরা ব্যহার করে তাহা স্ত্রীলোকদের ব্যবহার করা জায়েয নয়। ইবনুল হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ কেবলমাত্র পোষাক পরিচ্ছদের দিক দিয়াই এই সাদৃশ্য নিষিদ্ধ নয়। চলন-বলনেও একের পক্ষে অপরের সহিত সাদৃশ্য করা- মেয়েদের পুরুষদের মত চলাফিরা করা, কথা বলা এবং পুরুষদের মেয়েদের মত চলাফিরা করা, কথা বলা অবাঞ্ছনীয়। এক কথায় বলা যায়, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে দুই লিঙ্গে বিভক্ত করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি যাহাদিগকে পুরষ বানাইয়াছেন, তাহারা যদি স্ত্রী লোকদের ন্যায় চলন বলন ভূষণ পরিচ্ছন গ্রহণ করে, অথবা যদি ইহার বিপরীতটা হয়- স্ত্রী লোকেরা যদি পুরুষদের চলন-বলন-ভূষণ গ্রহণ করে, তাহা হইলে ইহা আল্লাহর সৃষ্টির উপর বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই হয় না। স্পষ্ট মনে হয়, সে স্ত্রী বা পুরুষ হইয়া কিছু মাত্র সন্তুষ্ট নয়। সে বিপরীতটা হইবার কামনা-বাসনা পোষণ করে। ইহা আল্লাহর প্রতি চরম না-শোকরিয়াও বটে। আর এই ধরনের নারী পুরুষদের উপর রাসূলে করীম(স)-এর অভিশাপ বর্ষণের মৌল কারণও ইহাই। ইহারা আল্লাহর রহমত পাইতে পারে না। অভিশাপ বর্ষনের তাৎপর্যও ইহাই।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত আর একটি হাদীসের ভাষা এইঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) পুরুষ মুখান্নাস ও পুরুষালী স্ত্রীলোকদের উপর অভিশাপ দিয়াছেন।
‘মুখান্নাস’ বলা হয় পোষাক অলংকার, রং, কণ্ঠস্বর, রূপ-আকৃতি, কথা-বার্তা, সর্বপ্রকার চলাফিরা, উঠাবসা, গতি-বিধি প্রভৃতির দিক দিয়া যেসব পুরুষ নারীদের সহিত একাকার হয় তাহাদিগকে। এইরূপ করা পুরুষদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা ইহাতে আল্লাহর সৃষ্টি লক্ষ্যের চরম বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়। আর আল্লাহর সৃষ্টি লক্ষ্যের বিকৃতি ও পরিবর্তন স্বভাব-নীতির বিরুদ্ধতা এবং স্বভাব নীতির বিরুদ্ধতা যে কখনই কল্যাণকর হইতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ যে সব পুরুষ জন্মগতভাবেই কোন কোন মেয়েলী গুণের ধারক হয় এবং স্ব-চেষ্টায় এমন কোন গুণ গ্রহণ করে না, তাদের ব্যাপারে রাসূলে করীম (স)-এর এই বাণী প্রযোজ্য নয়। যাহারা নিজের ইচ্ছা করিয়া এইরূপ করে কেবল মাত্র তাহাদের সম্পর্কেই এই কথা। আর ইহাই নিষিদ্ধ। এই লোকদের উপরই অভিশাপ বর্ষণ করা হইয়াছে। অনুরূপভাবে যে সব মেয়েলোক জন্মগতভাবেই কোন-না-কোন পুরুষালি গুণের অধিকারী এবং তাহা স্বইচ্ছা ও স্বচেষ্টার কোন সংযোগ নাই, তাহারাও অভিশপ্ত হইবে না। দ্বিতীয় যে সব মহিলা পুরুষদের মতই দৃঢ় প্রত্যয় ও জ্ঞান বিবেক শক্তির অধিকারী, সাহসী, তাহাদের প্রতিও এই অভিশাপ হয় নাই। কেননা এই গুণ মেয়েদের জন্যও প্রশংসনীয়। হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কে সাধারণত বলা হইত ****** ‘তিনি পুরুষদের ন্যায় দৃঢ় মত ও বিবেচনা শক্তির অধিকারী’।
এক কথায় বলা যায়, নারী ও পুরুষের মাঝে যে স্বাভাবিক পার্থক্য, তাহা কাহারও পক্ষে কোন দিক দিয়াই লংঘন করা উচিত নয়। এ পর্যায়ে কৃত্রিমভাবে যাহাই করা হইবে, তাহাই অন্যায় ও অপরাধ হইবে।
ইসলামে নারী ও পুরুষের মাঝে এই পার্থক্য রক্ষার জন্য এক দিকে যেমন পর্দার ব্যবস্থা করা হইয়াছে, তেমনি আচার-আচরণ, কথাবার্তা, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সুগদ্ধি ব্যবহারের দিক দিয়াও এই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পুরুষদের সুগদ্ধি এমন হইবে যাহার ঘ্রাণ প্রকাশমান; কিন্তু উহার বর্ণ প্রচ্ছন্ন। আর মেয়ে লোকদের সুগদ্ধি তাহা যাহার বর্ণ প্রকাশমান ও ঘ্রাণ প্রচ্ছন্ন। (তিরমিযী)
অর্থাৎ পুরুষরা সুগন্ধির জন্য যে জিনিস ব্যবহার করিবে, তাহা বর্ণ প্রকাশমান হইবে না। যেমন গোলাপ জল, মিশক-আম্বর, কর্পূর, আতর ইত্যাদি। পক্ষান্তরে মেয়ে লোকেরা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে জিনিস ব্যবহার করিবে তাহার বর্ণ প্রকাশমান হইবে; কিন্তু উহার গন্ধ প্রকাশমান হইবে না, যেমন জাফরান, আলতা ইত্যাদি। হাদীস বিশারদগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
মহিলাদের সুগন্ধি ও সৌন্দর্যবৃদ্ধিমূলক দ্রব্যাদি সম্পর্কে উপরোক্ত হাদীসে যাহা কিছু বলা হইয়াছে, তাহা ঠিক সেই প্রসঙ্গে প্রযোজ্য, যখন তাহারা ঘর, হইতে বাহির হইবে। কিন্তু তাহারা যখন ঘরে ও স্বামীর নিকট থাকিবে, তখন তাহারা যে কোন সুগন্ধি ব্যবহার করিতে পারে। উহার ঘ্রাণ প্রকাশমান হইলেও কোন দোষ হইবে না।
এই পর্যায়ে হযরত ইমরান ইবনে হুচাইন (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছে? নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
পুরুষদের জন্য উত্তম সুগন্ধি হইল যাহারা ঘ্রাণ প্রকাশমান ও বর্ণ প্রচ্ছন্ন এবং স্ত্রী লোকদের জন্য উত্তম সুগন্ধি হইল যাহার বর্ণ প্রকাশমান ও ঘ্রাণ প্রচ্ছন্ন।
এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর কথা কেবল মাত্র ভাল মন্দ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইহাপেক্ষাও কঠিন ও কঠোর। হযরত আবূ মূসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
প্রতিটি চক্ষুই ব্যভিচারী। কোন স্ত্রী লোক যখন সুঘ্রাণ ব্যবহার করিয়া পুরুষদের সমাবেশে যায়, তখন সে ইহা…. ইহা।
‘প্রতিটি চক্ষুই ব্যাভিচারী’ অর্থ যে দৃষ্টিই ভিন মেয়ে লোক বা পুরুষ লোকের উপর যৌন কামনা মিশ্রিত হইয়া পতিত হইবে, তাহাই ব্যভিচারে লিপ্ত মনে করিতে হইবে। অর্থাৎ যৌন কামনা মিশ্রিত দৃষ্টি কখনও ভিন্ন মেয়ে পুরুষের উপর পতিত হওয়া উচিত নয়। এই ধরনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া অনিবার্য হইয়া পড়ে বিশেষ করিয়া তখন যখন কোন মেয়ে লোক তীব্র ঘ্রাণযুক্ত কোন সুগদ্ধি বা সাজ-সয্যা ব্যবহার করিয়া পুরুষদের সমাবেশে উপস্থিত হয়। তখন ইহা প্রথমে তিন মেয়ে পুরুষের কামনা-পংকিল দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। পরে ইহা ব্যাভিচারের দ্বার উন্মুক্ত করে। কেননা এই সুঘ্রাণ পুরুষদের মনে যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি করে অনিবার্যভাবে। তখন শুধু দৃষ্টি বিনিময় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে না। এক কথায় দৃষ্টির ব্যভিচার কার্যত ব্যাভিচার ঘটাইবার কারণ হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই ইহা অবশ্যই পরিতাজ্য।
(**********)\r\nবস্তুত পুরুষ পুরুষই, নারী নয়। আর নারী নারই, পুরুষ নয়। এ কথা চূড়ান্তভাবে সত্য। ইহার বিপরীত সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ইহাদের মধ্যে দেহগত মৌলিক পার্থক্য রহিয়াছে এবং তাহা জন্মগত। তাহাদের স্বাভাবিক কাজ কর্মও মৌলিক পার্থক্য পূর্ণ। প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব বিশেষত্ব রহিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় পুরুষ যদি নারীজনোচিত কাজ করে, পোষাক পরে, কিংবা নারী করে পুরুষজনোচিত, তাহা হইলে চরম সামাজিক বিপর্যয় অনিবার্য হইয়া পড়িবে। নারী তাহার নারীত্ব ও নারীর সুকোমল গুণাবলী হারাইয়া ফেলিবে, পুরুষ তাহার পৌরুষের বিশেষত্ব হইতে অবশ্যই বঞ্চিত হইয়া পড়িবে।উভয়ই নিজ নিজ মৌল সত্তা সংক্রান্ত বিশেষত্ব ও গৌরবের আসন হইতে বিচ্যুত হইবে।
এই কারণে নবী করীম (স) সম্পর্কে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
যে পুরুষ মেয়ে লোকের পোষাক পরিধান করিল এবং যে মেয়েলোক পুরুষের পোশাক পরিধান করিল, নবী করীম (স) এই উভয়ের উপর অভিসম্পাত করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত, বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) পুরুষের বেশ দারণকারী মেয়েলোকের উপর অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স হইতে ইমাম আহমাদ বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি একটা গলাবদ্ধ পরিহিত একটি মেয়েলোক দেখিতে পাইলেন- দেখিলেন, মেয়েটি পুরুষের মত চলিতেছে। তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ***** এ কে? সে জওয়াবে বলিলঃ আমি উম্মে সায়ীদ বিনতে আবূ জিহল। তখন তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
যে মেয়েলোক পুরুষ সদৃশ হইবে, সে আমাদের সমাজভুক্ত নয়।
যে সব মেয়েলোক পুরুষালি চরিত্র ও ভুষণ অবলম্বন করিবে, তাহাদিগকে নবী করীম (স) ঘ র হইতে বহিষ্কৃত করিতে বলিয়াছেন।
হযরত আহূ হুরাইরা (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, একজন নপুংষককে রাসূলে করীম (স)-এর সামনে উপস্থিত করা হইল। সে তাহার দুই হাতও হেনার রঙে রঙীন বানাইয়া লইয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ এই ব্যক্তির অবস্থা কি? লোকেরা বলিলেনঃ সে নারীদের সহিত সাদৃশ্য রক্ষা করিতেছে। তখন নবী করীম (স) তাহাকে নির্বাসিত করিবার আদেশ করিলেন। কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, হে রাসূল, আপনি লোকটিতে হত্যা করাইলেন না কেন? জওয়াবে বলিলেন, নামাযী লোকদের হত্যা করার জন্য আমি আদিষ্ট হই নাই।
রাসূলে করীম (স) হযরত উসামা ইবনে জায়দ (রা) কে মিশরের কিবতীদের বয়নে তৈরী একটি পোষাক উপঢৌকন দিয়াছিলেন। উসামা তাহা তাঁহার স্ত্রীকে দিয়াছিলেন। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কিবতীদের সেই (আমার দেওয়া) কাপড় পরিতেছনা কেন? উসামা ইবনে জায়দ বললেন, হে রাসূল! আমি তো সে পোষাক আমার স্ত্রীকে পরাইয়া দিয়াছি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
তুমি তোমার স্ত্রীকে সেই কাপড়ের নীচে আর একটা কাপড় (পেটিকোট) পরিতে বলিবে কেননা আমি ভয় পাইতেছি, ও কাপড় এতই পাতলা যে, উহা পরিলেও তোমার স্ত্রীর অস্থির মজ্জা পর্যন্ত বাহির হইতে দেখা যাইবে।
অপর একটি বর্ণনায় হাদীসটির ভাষা হইলঃ
****************************************
তোমার স্ত্রীকে বল, সে যেন সে কাপড়ের নীচে আর একটি কাপড় পরে, যাহাতে ভিতরে অঙ্গ প্রতঙ্গ দেখা যাইবে না।
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি প্রমাণ করে যে, মেয়েদের উচিত তাহার কাপড় দ্বারা দেহকে এমনভাবে আবৃত করা, যেন উহা ছাপাইয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দৃশ্যমান হইয়া না উঠে। পুরুষদের আটোশাটো পোশাক এই পর্যায়েই পড়ে। তাহা এতই টাইট হয় যে উহা পরা সত্ত্বেও অংগ প্রত্যংগ বাহিরে প্রকাশমান হইয়া পড়ে।
মোট কথা, পুরুষ সর্বদিক দিয়া পুরুষ থাকিবে, মেয়েলোক সর্বদিক দিয়া মেয়েলোক থাকিবে ইহাই ইসলামী শরীয়াতের বিধান। ইহার ব্যতিক্রম সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
লজ্জাস্থান আবৃত রাখার তাকীদ
****************************************
বহজ ইবনে হাকীম হইতে, তাহার পিতা হইতে, তাঁহার দাদা হইতে বর্ণিত হইয়াছে, বলিয়াছেন, আমি বলিলামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের লজ্জাস্থান সমূহের মধ্যে কতটা আমরা আবৃত রাখিব আর কতটা ছাড়িয়া দিব? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ কর। তবে তোমার স্ত্রী কিংবা তোমার দক্ষিণ হাতের মালিকানাভুক্তদের ব্যাপারে এই সংরক্ষণ থাকিবে না। জিজ্ঞাসা করিলাম, লোকেরা যখন পরস্পরে সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া থাকে তখন কি করিতে হইবে? বলিলেনঃ যদি পার যে, কেহ কাহারও লজ্জাস্থান দেখিবে না, তাহা হইলে কক্ষণই দেখিবে না। বলিলামঃ আমাদের কেহ যখন একান্ত একাকী থাকে, তখনকার জ ন্য কি হুকুম? বলিলেনঃ তখন তো আল্লাহ তা’আলা বেশী অধিকার সম্পন্ন এই জন্য যে, তাঁহার ব্যাপারে লজ্জাবোধ করিতে হইবে।
(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দায়ুদ, ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যাঃ ইমা তিরমিযীর ভাষায় বহজ ইবনে হাকীম বলিয়াছেনঃ ‘আমার পিতা- (হাকীম) আমার দাদার নিকট হইতে এই হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন। বহজ- এর দাদা এই হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী। তিনি সাহাবী ছিলেন এবং নিজেই রাসূলে করীম (স)-এর সহিত কথা বলিয়াছেন, যাহার বিবরণই এই হাদীস। তাঁহার নাম মুয়াবীয়া ইবনে হীদা (রা)।
হাদীসের শব্দ ***** শব্দটি ***** এর বহুবছন। মানব দেহের যে অঙ্গের উলংগ হইয়া পড়া লজ্জাকর, তাহাই **** বা লজ্জাস্থান। ইহা পুরুষে নারীতে পার্থক্য রহিয়াছে। নাভী হইতে হাটু পর্যন্ত পুরুষ দেহের লজ্জাস্থান এবং স্বাধীনা নারীর মুখ মণ্ডল ও কবজি পর্যন্ত দুই হাত ছাড়া সমগ্র দেহই লজ্জাস্থান। মানবদেহের এই লজ্জাস্থান অবশ্যই আবৃত রাখিতে হইবে। নামাযে যেমন তেমনি নামাযের বাহিরেও সব সময়ই ইহা ঢাকিয়া রাখিতে হইবে।
আমাদের দেহের কোন কোন অংশ আবৃত রাখিব আর কোন কোন অংশের আবরণ মুক্ত করিতে পারিব, এই জিজ্ঞাসার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার লজ্জাস্থান- নাভী হইতে হাঁটু পর্যন্তকার অঙ্গ সমূহের আবরণ রক্ষা কর। কিন্তু তোমার স্ত্রী ও ক্রীতদাসীর ক্ষেত্রে এই নির্দেশ নাই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হইয়াছেঃ পুরুষ লোকেরা যখন একটি স্থানে পরস্পর একত্রিত হয় ও মিলিয়া-মিশিয়া থাকে, নিজেদের স্থান ত্যাগ করে না, তখন সেই লোকদের পক্ষে লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও পূর্ণ মাত্রার পর্দা পালন সম্ভবপর হয় না। অনেক সময় পরিধানের কাপড়ের সংকীর্ণতা বা জীণ-শীর্ণতার দরুন; কিংবা প্রয়োজন দেখা দেওয়ার দরুন ইহা করা কঠিন হইয়া পড়ে। তখন আমরা লজ্জাস্থান আবৃত রাখার ব্যাপারে কি করিতে পারি? ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেন তাহার অর্থ, তখনও যদি পার তাহা হইলে কেহ স্বীয় লজ্জাস্থান অন্যকে দেখাইবে না। অর্থাৎ বহুলোকের একস্থানে একত্রিত হইয়া মিলিয়া মিশিয়া একাকার হইয়া থাকা অবস্থায়ও লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও উহার কোন অংশ অন্যকে না দেখানোর জন্য সতর্ক থাকিবে ও সাধ্যমত চেষ্টা চালাইবে।
রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি দুইটি বর্ণনায় দুই রকম উদ্ধৃত হইয়াছে; কিন্তু দুইটির মূল বক্তব্য তাহাই যাহা বলা হইল।
তৃতীয় প্রশ্ন হইল, মানুষ যখন একান্ত নিভৃতে নিঃসংগ একাকী থাকে তখন কি করিতে হইবে? অর্থাৎ তখন তো আর লজ্জা নিবারণের কোন কারণ থাকে না। তাহার লজ্জাস্থান দেখিতে পারে এমন কেহই কোথায়ও থাকে না। তখন এ ব্যাপারে খুব একটা সতর্কতার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় না? ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেনঃ তাহার তাৎপর্য হইলঃ মানুষ নিভৃত একাকীত্বে নিঃসঙ্গ হইয়া থাকিলেও এবং দ্বিতীয় কোন লোক নিকটে না থাকিলেও মহান আল্লাহ তথায় উপস্থিত থাকেন। কাজেই তাঁহার ব্যাপারে লজ্জাবোধ করা তো অধিক প্রয়োজন। আল্লাহর ব্যাপারে এই লজ্জাবোধ-লজ্জাস্থান তাঁহার অগোচরে ও তাঁহার হইতে গোপন রাখার দিক দিয়া নয়। কেননা তাহা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়। এই লজ্জাবোধ থাকিতে হইবে লজ্জাস্থান আবৃত রাখার খোদায়ী নির্দেশ পালনের দিক দিয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা লজ্জাস্থান আবৃত রাখার যে নির্দেশ দিয়াছেন তাহা লোকদের ভয়ে পালন করা উচিত নয়, পালন করা উচিত আল্লাহকে ভয় করিয়া। তাই কেহ নিকটে-আছে না থাকিলেও আল্লাহ তো থাকেন এবং দেখেন। তাই তখনও- সেই নিবৃত একাকীত্বেও-উলংগ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা তখন তাহা করা হইলে কোন লোক হয়ত লজ্জাস্থান অনাবৃত রাখার এই অপরাধ দেখিতে পায় না; কিন্তু আল্লাহ তো দেখিতে পান যে, লোকটি একাকীত্বের সুযোগে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করিয়াছে। এই সময় বরং মানুসের উচিত আল্লাহকে অধিক লজ্জা করা- আল্লাহর নিদের্শ অধিক পালন করা। বস্তুত খোদার প্রতি মানুষের এই যে ভীতি ও লজ্জাবোধ, ইহাই ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি। রাসূলে করীম (স) নানাভাবে নানা সময়ে ভিন্ন প্রসঙ্গের কথার মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে এই ভিত্তিটির সুদৃঢ় করিয়া তুলিতে ও সুদৃঢ় রাখিতে চেষ্টা করিয়াছেন।
লজ্জাস্থান আবৃত রাখার আদেশে দুইটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাখা হইয়াছে। একটি হইল স্ত্রী ও নিজ মালিকানাধীন ক্রীতদাসী। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করিয়া সঙ্গম কালে পরস্পরের যৌন অংগ দর্শন নিষিদ্ধ করা হয় নাই। এতদ্ব্যতীত অন্য সমস্ত ক্ষেত্রেই তাহা সম্পূর্ণ হারাম। অতএব একজন পুরুষ যেমন অপর পুরুষের লজ্জাস্থান দেখিতে পারে না, তেমনি একজন মেয়েলোকও পারে না অপর মেয়েলোকের লজ্জাস্থান দেখিতে।
উপরোক্ত হাদীসটি হইতে একথাও জানা যায় যে, নিতান্ত নিবৃত নির্জনের একাকীত্বকালেও উলংগ হওয়া জায়েয নয়। অবশ্য ইমাম বুখারী হযরত মুসা ও হযরত আইউব (আ)-এর ঘটনার উল্লেখ করিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, গোসল করার সময় নিভৃত একাকীত্বে উলংগ হওয়া জায়েয। কেননা এই দুইজন নবীর এইরূপ ঘটনা বর্ণিত হইয়াছে এবং আমরা তাঁহাদের মানিয়া চলার জন্য আদিষ্ট হইয়াছি। যতক্ষণ না বিশেষ কোন কাজের নিষেধ আমাদের শরীয়াতে আসিয়াছে। নবী করীম (স) নিজেই তাঁহাদের নিভৃত একাকীত্বে উলংগ হইয়া গোসল করার কথা বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু তিনি তাহা করিতে নিষেধ করেন নাই। ফলে এই ব্যাপারে উভয় শরীয়াতের অভিন্নতাই প্রমাণিত হয়। যদি আমাদের জন্য তাহা নাজায়েয হইত, তবে নবী করীম (স) তাহা সঙ্গে সঙ্গেই বলিয়া দিতেন। এই দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়াতে একটি ফর্মূলা রচিত হইয়াছে এই ভাষায়ঃ
****************************************
আমাদের পূর্ববর্তী লোকদের শরীয়াত আমাদেরও শরীয়াত যতক্ষণ না তাহা রহিত হইয়া যায়।
তবে ইমাম বুখারীর এই মত সহীহ হাদীসের বিপরীত বলিয়া মনে হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
রাসূলে করীম স) বলিয়াছেনঃ তোমরা উলংগ হওয়া হইতে নিজদিগকে দূরে রাখ। কেননা তোমাদের সহিত এমন সব লোক রহিয়াছে যাহারা তোমাদের হইতে কখনই বিচ্ছিন্ন হয় না। তবে পায়খানা করা ও স্ত্রী সহিত সঙ্গম অবস্থা এই নিষেধের বাহিরে। অতএব তোমাদের সেই সঙ্গীদের ব্যাপারে তোমরা লজ্জাবোধ করিবে এবং তাহাদিগকে সম্মান দিবে।
অর্থাৎ নিভৃত একাকীত্বেও উলংগ হইবে না। তবে কেবলমাত্র পায়খানা পেশাব করা ও স্ত্রী সঙ্গম কালে ইহার ব্যতিক্রম করার অনুমতি রহিয়াছে।
হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
****************************************
একজন পুরুষ অপর পুরুষের লজ্জাস্থানের উপর দৃষ্টি দিবে না, একজন স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোকের লজ্জাস্থান দেখিবে না। অনুরূপ ভাবে একজন পুরুষ অপর পুরুষের নিকট এক কাপড়ে এবং একজন স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোকের নিকট এক কাপড়ে যাইবে না।
এক কাপড়ে যাওয়া, অর্থ দেহের লজ্জাস্থান সম্পূর্ণ আবৃত না করিয়া যাওয়া, এমন ভাবে যাওয়া যাহাতে লজ্জাস্থানের কোন অংশ উলংগ হইয়া থাকে। ইহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।