হযরত মুয়াবীয়া আল কুশাইরী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি বলিলাম, ইয়া রাসূল! আমাদের উপর আমাদের একজনের স্ত্রীর কি কি অধিকার রহিয়াছে? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি যখন খাইবে তখন তাহাকেও খাওয়াইবে, তুমি যখন পরিবে তখন তাহাকেও পরিতে দিবে। আর মুখের উপর মারিবে না। তাহাকে কটুরূঢ় অশ্লীল কথা বলিবে না এবং ঘরের ভিতরে ছাড়া তাহার সহিত সম্পর্ক ত্যাগ করিবে না।
(আবূ দায়ূদ ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার কি এই প্রশ্নের জওয়াবে নবী করীম (স) এখানে মোট পাঁচটি কথা বলিয়াছেন। প্রথম কথা খাবার দেওয়া, দ্বিতীয় পরার কাপড়-জামা দেওয়া, তৃতীয় মুখের উপর না মারা, চতুর্থ কটুরূঢ় অশ্লীল কথা না বলা এবং পঞ্চম ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন না করা।
রাসূলে করীম (স)-এর এই কথা কয়টি অতীব মৌলিক ও নিতান্তই প্রাথমিক পর্যায়ের। কেননা এই কাজ কয়টি যথাযথ না হইলে স্ত্রীর জীবন মান রক্ষা করাই সম্ভব হইত পারে না। যেমন খাওয়া পরা। খাওয়া মানুষের জীবন বাঁচাইয়া রাখার জন্য অপরিহার্য। খাবার জোটানো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। রাসূলের কথার ধরণ ****** ‘তুমি যখন খাইবে তখন তাহাকেও খাইতে দিবে’। অর্থাৎ তুমি নিজের খাবার ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীরও খাবার জোটানো তোমার কর্তব্য। তুমি যখন অবিবাহিত ছিলে তখন হয়ত তোমার পরিবারিক দায়িত্ব কিছুই ছিল না। তখন হয়ত তুমি একা নিজের খাবার জুটাইবার জন্যই চিন্তান্বিত হইতে। কিন্তু বিবাহ করার পর তোমার খাবারের সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে তোমার স্ত্রীর খাবার জোটানোর দায়িত্ব। ইহাতে আরও দুইটি কথা নিহিত আছে। একটি হইল, তুমি যাহা খাইবে স্ত্রীকেও তাহাই খাইতে দিবে। তোমার খাওয়া দাওয়ার যে মান, তোমার স্ত্রীর খাওয়া-দাওয়ার মানও তাহাই হইত হইবে। তাহার কোন অংশে কম হইতে পারিবে না। এমনও হইতে পারিবে না যে, তুমি ভাল খাইবে আর স্ত্রীকে নিকৃষ্ট মানের খাবার দিবে বা তাহা খাইতে বাধ্য করিবে। কিংবা যাহা রান্না হইতে তাহা তুমি একাই সব খাইয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলিবে, আর স্ত্রীকে অভুক্ত থাকিতে বাধ্য করিবে। সম্ভবত এই কথাটাও ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে খাবার খাইবে। বস্তুত এক সঙ্গে তথা একপাত্রে খাবার খাওয়া দাম্পত্য জীবনে মাধুর্য ও ভালবাসার গভীরতা সৃষ্টির জন্য বিশেষ সহায়ক। দ্বিতীয়ঃ ******* তুমি নিজে যখন জামা-কাপড় পরিবে, স্ত্রীকেও তখন জামা-কাপড় পড়িতে দিবে। পোষাক-পরিচ্ছদ তোমার একারই প্রয়োজন নয়, উহা তোমার স্ত্রীর-ও প্রয়োজন। পোশাক তো সাধারণ ভাবে সব মানুষেরই লজ্জা নিবারণের একমাত্র উপায়। কিন্তু শুধু তাহাই নয়। তোমার সামর্থ্যানুযায়ী যে মানের পোশাক তুমি নিজে পরিবে স্ত্রীকেও সেই মানের কাপড় পড়িতে দিবে। তুমি যদি বেশী মূল্যের ও অতীব উত্তম মানের পোশাক গ্রহণ কর; আর স্ত্রীকে যেমন-তেমন কাপড় পড়িতে দাও, তাহা হইলে তাহা যেমন মানবিক নয়, তেমনি দাম্পত্য জীবনের পক্ষে শান্তি-সম্প্রীতি সৃষ্টিরও অনুকুল হইতে পারে না। সেই সঙ্গে একথার প্রতিও লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে, তুমি যখন একটা নূতন পোশাক কিনিবে, তোমার স্ত্রীর জন্যও তখন নূতন কাপড় ক্রয় করিবে। ইহাতে স্ত্রীর মন রক্ষার ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব পালিত হইবে। সেই সঙ্গে স্ত্রীও তোমার প্রতি অধিক আস্থা সম্পন্না ও শ্রদ্ধাশীলা হইবে। খাওয়া-পড়া সংক্রান্ত রাসূলে করীম (স)-এর এই নির্দেশটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এই পর্যায়ে কুরআন মজীদের তিনটি আয়াত স্মরণীয়। একটি আয়াত এইঃ
****************************************
যাহার জন্য সন্তান- অর্থাৎ স্বামী- তাহার কর্তব্য স্ত্রীদের জন্য প্রচলিত নিয়মে, মধ্যম মান অনুযায়ী খোরাক ও পোশাকের ব্যবস্থা করা।
****************************************
সচ্ছল অবস্থাশালী স্বামীর কর্তব্য তাহার সামর্থ্যানুযায়ী পরিবার বর্গের জন্য ব্যয় করা এবং দরিদ্র-অভাবগ্রস্থের কর্তব্য তাহার সামর্থ অনুযায়ী ব্যয় করা। কিন্তু এই উভয় অবস্থায়ই প্রচলিত মান অনুযায়ী খোরাক-পোশাক দিতে হইবে। আর ইহা সদাচারী লোকদের জন্য অবশ্যই পালনীয়।
তৃতীয় আয়াতঃ
****************************************
সচ্ছল অবস্থাশালী ব্যক্তি পরিবার বর্গের জর্ন ব্যয় করিবে তাহার সচ্ছলতা অনুপাতে। আর যাহার রিযিক পরিমিত, স্বল্প, সে যেন আল্লাহর দেওয়া জিনিস হইতে সেই অনুপাতে ব্যয় করে। আল্লাহ কাহাকেও তাঁহার দেওয়া পরিমাণের অধিক ব্যয় করার দায়িত্ব দেন না।
হাদীসে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
স্ত্রীদের খাওয়া ও পরার ব্যবস্থা করা তোমাদের- অর্থাৎ স্বামীদের দায়িত্ব।
এই পর্যায়ের অপর একটি হাদীসের ভাষা হইলঃ
****************************************
‘মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট হইতে একটা উত্তম নিয়ম ও আচার পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াছে। তাহা হইল, আল্লাহ যখন তাহাতে প্রশস্ততা বিপুলতা দেন, সেও (ব্যয়ের ক্ষেত্রে) প্রশস্ততা অবলম্বন করে। আর যখন তিনি তাহাকে সংকীর্ণতা- অভাব ও দারিদ্রে- ফেলেন, তখন সেও সংকীর্ণতার মধ্য দিয়াই চলে।
রাসূলে করীমের অপর একটি বানী হইলঃ
****************************************
তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার তোমাদের উপর এই যে, তোমরা তাহাদের খোরাক পোশাক জোগাইবার ব্যাপারে বিশেষ আন্তরিকতা পোষণ করিবে- যতবেশী ভাল করা সম্ভব তাহা করিবে।
তৃতীয় বলা হইয়াছেঃ ******** মুখের উপর- মুখ মণ্ডলের উপর কখনও মারিবেনা। শুধু মুখ মণ্ডলের উপর মারিতে নিষেধ করা হইয়াছে। তাহা হইলে কি দেহের অন্যান্য অংশের উপর মারা যাইতে পারে… মূলত স্ত্রীকে মারার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কেননা স্ত্রীকে মার ধর করিবে, এই উদ্দেশ্যে তো আর কেহ বিবাহ করে না। কিন্তু তবুও স্ত্রীকে অবস্থা ও কারণ বিশেষ কিছুটা মারধর করার অধিকার অনুমতি স্বামীকে কুরআন মজীদেই দেওয়া হইয়াছে। এই পর্যায়ের সম্পূর্ণ আয়াতটি সম্মুখে রাখিলেই ইহার তাৎপর্য বুঝিতে পারা যাইবে এবং পাওয়া যাইবে আমাদের এইমাত্র উত্থাপিত জিজ্ঞাসাগুলির সঠিক জওয়াব। আয়াতটি এইঃ
****************************************
যে সব স্ত্রীদের স্বামীর আনুগত্য হইতে বিদ্রোহ করার ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত আশংকা বোধ করিবে, তাহাদিগকে তোমরা উপদেশ দিবে, শয্যায় তাহাদের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিবে এবং তাহাদিগকে মারিবে।
স্বামী-স্ত্রীর মিলিত সংসারের কর্ণধার ও প্রধান পরিচালক হইল স্বামী। আর স্ত্রী সর্বব্যাপারে স্বামীর সহিত সহযোগিতা ও আনুকূল্য করিবে, ইহাই স্ত্রীর কর্তব্য। কিন্তু স্বামীকে এই মর্যাদা দিতে স্ত্রী যদি প্রস্তুত না হয়, সে যদি ক্রমাগত স্বামীর সহিত অবাধ্যতা করিতে থাকে, স্বামীর প্রবর্তিত পারিবারিক নিয়ম শৃঙ্খলা ভংগ করে, এই বিষয়ে স্বামীর দেওয়া যুক্তিসংঘত ও শরীয়ত সম্মত আদেশ-নিষেধ লংঘন করে, স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করার পরিবর্তে ক্রমাগত ঘৃণাই করিতে থাকে। তাহা হইলে স্বামীর মন কিছুতেই সুস্থির থাকিতে পারে না। তাহাকে তো দাম্পত্য শৃংখলা ও সংসার সংস্থাকে রক্ষা করিতেই হইবে। তাহা হইলে তখন সে কি করিবে? উপরোক্ত আয়াতে তাহার জন্য সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। আয়াতে বলা হইয়াছে, স্ত্রী এই বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা দেখিয়া তুমি নীরব দর্শক হইয়া থাকিও না। তোমরা দায়িত্ব পালনার্থে তোমাকে পুরাপুরি কর্তব্য করিতে হইবে। আর তাহা হইল, সর্বপ্রথম স্ত্রীকে বুঝাইবে, উপদেশ দিবে, নছীহত করিবে। এই ব্যাপারে আল্লাহর দেওয়া বিধানের কথা তাহাকে স্মরণ করিয়াই জানাইয়া দিবে। দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও স্থিতি স্থায়ীত্ব রক্ষার্তে স্বামীর ন্যায়-সংগত সব কাজেই তাহাকে পুর্ণ আনুকূল্য ও আনুগত্য দিতে হইবে- দেওয়া কর্তব্য এবং এই ক্ষেত্রে স্বামীর প্রাধান্য মানিয়া চলা তাহার জন্য দ্বীনী ফরয, একথা সবিস্তারে তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিবে। যদি ইহাতেও সে নরম ও অনুগত না হয়, তাহা হইলে দ্বিতীয় কর্মপন্হা রূপে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
রাত্রিকালীন শয্যা গ্রহণে তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন কর’।
শযায় সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ ঘুমাইবে একই শয্যায়- যেমন তোমাদের সাধারণ নিয়ম; কিন্তু শয্যায় শুইয়া স্ত্রীর সহিত কোন সম্পর্ক স্থাপন করিবে না। তাহার দিকে ফিরিয়া নয়, পিঠ ফিরাইয়া ঘুমাইবে। আর তাহার সহিত শৃংগার ও সঙ্গম করিবে না। শয্যায় দূরত্ব রক্ষা করিয়া থাকিবে। কেননা এইরূপ করা হইলে স্ত্রীর হৃদয়মনে স্বামীর প্রতি যদি একবিন্দু ভালবাসা থাকে, তাহা হইলে সে তাহার স্বামীর এই অনীহা ও বিতৃষ্ণার কারণ দূর করিতে ও তাহার সহিত মীমাংসা করিয়া ফেলিতে আগ্রহান্বিত হইবে। আর ইহাতেও যদি তাহার অনমনীয়তা দূরীভূত না হয় তাহা হইলে শেষ উপায় হিসাবে তাহাকে মারিবে। এই মার হয়ত স্ত্রীকে পথে আনিতে অনেক সাহায্য করিবে। বিদ্রোহী অসহযোগী অনমনীয় স্ত্রীকে পথে আনার ইহাই ইসলামের শিক্ষা দেওয়ার উপায় ও পদ্ধতি। ইহার কারণ এই যে, বিদ্রোহাত্মক ভাবধারা লক্ষ্য করিয়া যদি এই পন্হা গ্রহণ করা না হয়, তাহা হইলে তো হয় তাহাকে তখনই তালাক দিতে হয়, না হয় স্ত্রীকে বিনা তালাকেই বাপের বাড়ি বা অন্যত্র পাঠাইয়া ফেলিয়া রাখিতে হয়। কিন্তু ইহার কোনটাই ইসলাম সম্মত নয়। ইসলামের কাম্যও ইহা নয়। পরিবার সংস্থার অক্ষুণ্নতা ও শান্তি-সম্প্রীতি ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই ইসলাম এই ক্রমিক পদ্ধতি পেশ করিয়াছে।
কিন্তু স্ত্রীকে মারিবার এই অনুমতি নিরংকুশ বা শর্তহীন নয়। প্রথমতঃ এই মারটা হইবে ******* আদব ও নিময় শৃঙ্খলা শিক্ষা প্রদান উদ্দেশ্যে দেওয়া অকঠিন অশক্ত মার। আর ******* ‘এই মার না হাড় ভাঙিবে, না কোন জখম করিবে’। কেননা এস্থলে মারাটাই আসল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হইতেছে স্ত্রীকে সংশোধন করা। আলোচ্য হাদীসে তাই বলা হইয়াছেঃ মুখের উপর মারিবে না। অর্থাৎ কোন সময় স্ত্রীকে পথে আনার জন্য অন্যান্য সব উপায় ব্যর্থ হওয়অর পর যদি এই পর্যন্ত পৌঁছিতেই হয় এবং ইহা ছাড়া আর কোন উপায়ই হাতে না থাকে, তাহা হইলে সর্বশেষ উপায় হিসাবে স্ত্রীকে মারিতে পার। কিন্তু সে মারের কোন আঘাত যেন মুখমণ্ডলের উপর না পরে। কেননা মুখমণ্ডল মানব দেহের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইহাতে নাক, চোখ, কপোল, মুখ, দাঁত ইত্যাদি অত্যন্ত নাজুক প্রত্যংক রহিয়াছে। মুখে মারিলে ইহার যে কোন একটা আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে। আর তাহা হইলে ইহা অত্যন্ত বীভৎস ব্যাপার হইয়া দাড়াইবে।
(*************)
ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, চারটি কারণে স্ত্রীকে মারার স্বামীর অধিকার আছে। তাহা হইল (১) স্ত্রীর সাজ-সজ্জা পরিহার করা- অথচ স্বামী তাহা চাহে, (২) সঙ্গমে আহবান করার পর বিনা কারণে অস্বীকৃতি (৩) নামায না পড়া (হাদীসের কোন কোন বর্ণনা অনযায়ী) (৪) স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে ঘরের বাহিরে যাতায়াত।
ইমাম মুহাম্মদ বলিয়াছেন, নাময তরক করিলে, অপবিত্রতার হায়যের গোসল না করিলে স্ত্রীকে মারার স্বামীর কোন অধিকার নাই।
(************)
ইসলাম স্বামীকে অধিকার দিয়াছে স্ত্রীকে মার ধর করার। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা ও পারিবারিক রীতি-নীতি এই ব্যাপারে জনমনে বিশেষ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাইবার ও জনগণকে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বানাইবার জন্য এই ব্যাপারটিকে একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান রূপে গ্রহণ করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে প্রকৃত পক্ষে বিভ্রান্তির কিছুই নাই। উপরন্তু এই ব্যবস্থাকে বর্বরতা বলারও কোন যৌক্তিকতা নাই। কেননা আধুনিক মনস্তাত্ববিজ্ঞান এই ব্যবস্থার যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়াছে। আধুনিক মনস্তত্বের পারদর্শীগণ বলিয়াছেনঃ কোন কোন মানসিক রোগ এমন থাকিতে পারে যাহাতে দৈহিক শাস্তি দান ছাড়া রোগীর চিকিৎসার অন্য কোন পন্হাই কার্যকর হয় না। কোন কোন স্ত্রীলোক মার না খাওয়া পর্যন্ত পথে আসে না, বশ মানেনা। অনেক পুরুষও এমন রোগে আক্রান্ত হইতে পারে। তখন স্ত্রীকেই উহার ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হয় এবং এই উপায়েই তাহাকে শায়েস্তা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা। ফলে ইসলামের এই পথ-নির্দেশ কিছু মাত্র বিস্ময়কর বা আপত্তিকর হইতে পারে না।
হাদীসের চতুর্থ কথাঃ ****** ইহার অর্থ, স্ত্রীকে খারাপ রূঢ় অশ্লীল ও নির্মম কথা বলিও না, তাহাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিওনা, মন্দ বলিও না। অশালীন, অসৌজন্য মূলক ও অপমানকর কথা বলিও না। ******* আল্লাহ তোমাকে মন্দ বা ধ্বংস করুন বলিও না। ইত্যাদি ধরনের কথাবার্ত পারিবারিক জীবনের সব পবিত্রতা ও মাধুর্যকে বিনষ্ট করে।
বস্তুত স্ত্রীও যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা, তাহারও আত্মমর্যাদা আছে, আছে আত্মমর্যাদা বোধ, বরং অনেক পুরুষের অপেক্ষাও অনেক বেশী ও তীব্র, সে কথা অনেক স্বামীই বেমালুম ভুলে যায়। স্ত্রীকে দাসী-বান্দী কিংবা জন্তু-জানোয়ার ও ইতরপ্রাণী মনে করা বর্বর ঘোঁড়া প্রকৃতির লোকদের স্বভাব। ইহা যেমন ঘৃণ্য, তেমনি পারস্পরিক পারিবারিক দাম্পত্য জীবনের শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে হুমকি স্বরূপ। তাই ইহা অবশ্যই পরিত্যজ্য। পরস্পরের মর্যাদা-স্বাতন্ত্র্যের সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া কথা-বার্তা বলা একান্তই আবশ্যক। ইহাও ইসলামেরই একটা বিশেষ অবদান।
উদ্ধৃত হাদীসে রাসূলে করীম (স) এর পঞ্চম ও শেষ কথাটি হইল, স্ত্রীকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিও না। তাহাকে শাসন করার উদ্দেশ্যে কোন পর্যায়ে যদি তাহাকে যে শাসনই করিতে হয়, তাহা ঘরের মধ্যে রাখিয়াই করিবে। সাধারণত দেখা যায়, স্বামী একটু অসন্তুষ্ট হইলেই ক্রদ্ধ হইয়া স্ত্রীকে গলা ধাক্কা দিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দেয় কিংব স্ত্রীর বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেয়। ইহা নিতান্তই মুর্খতামূলক, নিতান্তই বর্বরতা। ইহার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
(**************)
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বর্ণনা করিয়াছেন হযরত নবী করীম (স) হইতে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্বামী যখন তাহার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আসিবার জন্য আহবান জানাইবে তখন যদি সে আসিতে অস্বীকার করে, তাহা হইলে ফেরেশতাগণ সকাল হওয়া পর্যন্ত তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন।
(বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ স্বামী যখন তাহার স্ত্রীকে তাহার নিজের শয্যায় আসিবার জন্য আহবান জানায় ইহা ইংগিত মূলক কথা। ইহার অর্থ, স্বামী যখন স্ত্রীর নিকট সঙ্গম ইচ্ছা প্রকাশ করে ও সে জন্য ভাবে, এই সময় স্ত্রী যদি অস্বীকৃতি জানায়, স্বামীর ইচ্ছাপূরণে প্রস্তুত না হয়, তাহা হইলে সকাল হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রীর উপর অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন। ফেরেশতাগণ অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন, তাহার কারণ হইল, স্বামীর ইচ্ছাপূরণ করা স্ত্রীর বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিবাহিত জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে ইহা অন্যতম। কিন্তু স্ত্রী অস্বীকৃতিতে এই কর্তব্যও পালন হয় না এবং এই উদ্দেশ্যও ব্যাহত ও ক্ষুণ্ন হয়। আসলে যৌন সঙ্গম যদিও স্বামীর স্ত্রী উভয়েরই যুগপৎ বাসনা ও ইচ্ছার ব্যাপার আর এক জনের ইচ্ছা জাগিলে সেই সময় অন্যজনও ইচ্ছুক হইবে, এমন কোন কথাও নাই। কিন্তু তবুও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্যের মধ্যে ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য যে, একে অপরের বাসনা চরিতার্থ করিবে। এতদ্ব্যতীত স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষের ইচ্ছা অনেক সময় অদম্য হইয়া থাকে এবং উহার চরিতার্থতা হইয়া পড়ে অপরিহার্য। কাজেই তাহার ইচ্ছা পুরণে স্ত্রীর বাধ্য ও প্রস্তুত হওয়া উচিত। ইহা পরস্পরের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষা বা কষ্ট স্বীকারে প্রস্তুত থাকার ব্যাপার। দাম্পত্য জীবনের একজনের জন্য অপর জনের কষ্ট স্বীকার-অনিচ্ছা সত্ত্বেও সঙ্গম কার্যে প্রবৃত্ত ও প্রস্তুত হওয়া এবং এই ব্যাপারে পরস্পর সহযোগিতা করা গভীর দাম্পত্য প্রেম ও মনের ঐকান্তিক দরদ ও সহানুভূতির ব্যাপারও। কিন্তু কোন কারণ ব্যতীতই স্ত্রী যদি স্বামীর আহবানকে অগ্রাহ্য করে, তাহা হইলে স্বামীল মন স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত ও অনাসক্ত হইয়া পড়িতে পারে। আর ইহা দাম্পত্য জীবনের স্থায়ীত্বের পক্ষে মারাত্মক। এমনকি, অনেক সময় ইহার দরুনই স্বামী স্ত্রীকে হঠাৎ রাগের বশবর্তী হইয়া তালাক পর্যন্ত দিয়া বসিতে পারে। সে অন্য স্ত্রীলোকের নিকট গমন করিতে পর্যন্ত বাধ্য হইয়া পড়িতে পারে। শুরু হইতে এই পরিণতি পর্যন্ত প্রত্যেকটি ব্যাপারই অবাঞ্ছিত এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টিরও কারণ। স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণ হওয়ার কারণও ইহাই। বলা বাহুল্য, ‘অভিশাপ’ কথাটি তীব্র ক্ষোভ ও রোষ বুঝায়। আর যে ফেরেশেতাদের আনুকূল্য ও সহযোগিতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কর্মে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে জরুরী, তাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া যাওয়া চরম দুর্ভাগ্যের কারণ। *************** সকাল বেলা হওয়া পর্যন্ত। অর্থাৎ ফেরেশতারেদ এই অভিশাপ বর্ষণ সকাল হওয়া পর্যন্ত চলিতে থাকে। এই কথা দ্বারা বুঝা যায়, সকাল বেলা হইলেই ফেরেশতা তাহাদের অভিশাপ বর্ষণ বন্ধ করিয়া দেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নয়। সারারাত্রি ধরিয়া অভিশাপ বর্ষণ করা ও সকাল বেলা হইলেই রাত্রির অবসান হইলেউ উহারও অবসান হইয়া যাওয়ার এই কথাটি সাধারণ রীতি অনুযায়ীই বলা হইয়াছে। কেননা স্বামী স্ত্রীকে সঙ্গম কাজের জন্য সাধারণত রাত্রি বেলাই আহবান করিয়া থাকে। দিনের বেলা ইহার সুযোগ সব স্বামীর জন্য সব সময় হয় না। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এইরূপ স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাদের অভিশাপ-ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ সেই রাত্রিকাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে না, উহা থাকে সমগ্র রাত্রি ও দিন ব্যাপী। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি বর্ণনা হইতে এই কথা স্পষ্ট ও অধিক সমর্থিক হইয়াছে। সে বর্ণনাটির ভাষা এইঃ রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
****************************************
যাঁহার মুষ্ঠির মধ্যে আমার প্রাণ তাহার শপথ, যে লোকই তাহার স্ত্রীকে তাহার শয্যায় আহবান জানাইবে, কিন্তু যে আহবানে সাড়া দিতে স্ত্রী অস্বীকৃত হইবে, তাহার প্রতিই আকাশ লোকে অবস্থানকারী ক্ষুব্ধ-অসন্তুষ্ট হইয়া যাইবে- যতক্ষণ না সেই স্বামী তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হইবে।
(মুসলিম)
এই হাদীসটির শেষ শব্দ ********* অর্থ যতক্ষণ না সেই স্বামী তাহার (স্ত্রীর) প্রতি সন্তুষ্ট হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আকাশলোকে অবস্থানকারী আল্লাহর ফেরেশতাগণও তাহার প্রতি ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট থাকিবেন। ইহাতে ঘটনার রাত্রি পর্যন্তই সে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি সীমাবদ্ধ থাকার কথা নাই, স্বামীর সন্তুষ্টি লাভ করা পর্যন্ত সে ক্ষোভের সীমা বলা হইয়াছে। এমনও হইতে পারে যে, রাত্রির প্রথম বা মধ্যম প্রহরে স্বামীর আহবানে সাড়া না দেওয়ার ফলে স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাদের ক্ষোভ সূচিত হইল্ আর শে প্রহরে সাড়া দেওয়ার ফলে সে ক্ষোভের অবসান হইয়া গেল। ইহা এতদাপেক্ষাও দীর্ঘায়িত ও বিলম্বিত হইতে পারে। ইহা কতক্ষণ বা কতদিন থাকিবে তাহা নির্ভর করে শুধু স্বামীর ডাকে স্ত্রীর সাড়া দেওয়ার উপরই নহে, বরং স্বামীর সন্তুষ্টি পুনর্বহাল হওয়ার উপর।
হযরত জাবির (রা) হইতে মরফু (স্বয়ং রাসূলের কথা- সে পর্যন্ত সনদ সহ) হাদীস বর্ণিত হইয়াছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
****************************************
তিনজন লোকের নামায কবুল হয় না ও কোন নেক আমল ঊর্ধ্বলোকে উত্থিত হয় না। তাহারা হইলঃ পলাতক ক্রীতদাস- যতক্ষণ না সে ফিরিয়া আসে, নেশাপানে অস্থির মস্তিষ্ক- যতক্ষণ না সে পূর্ণ সুস্থতা পায় এবং সেই স্ত্রীলোক যাহার স্বামী তাহার প্রতি ক্ষুব্ধ-ক্রদ্ধ অসন্তুষ্ট- যতক্ষণ না সে স্বামী সন্তুষ্ট হয়।
এই হাদীসটিতে বলা কথা অধিকতর কঠোর ও ভয়-উদ্দীপক। কেননা মুসলমানের প্রধান ইবাদত নামায যদি আল্লাহর নিকট কবুলই না হয় আর এতদ্ব্যতীত অন্যান্য নেক আমলও যদি আল্লাহর নিকট স্বীকৃতি না পায়- নেক আমল হিসাবে যদি আমল নামায় লিপিবদ্ধ না হয়, তাহা হইলে উহাপেক্ষা মারাত্মক ক্ষতি তাহার পক্ষে আর কি হইতে পারে।
এই হাদীসটিতেও মেয়েলোকটির দুর্ভাগ্য যে রাত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, তাহা বলা হয় নাই। বরং ইহা দিন রাত্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে অপর এক সূত্রে বর্ণিত এই পর্যায়েল হাদীসটিও এখানে উল্লেখ্য। তাহা এইঃ হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামী সঙ্গম উদ্দেশ্যে আহবান করিলে যে স্ত্রী বলেঃ হ্যাঁ, শীঘ্রই হইবে, আর যে বলে যে, আমি ঋতুবতী- অথচ সে ঋতুবতী নয়, এই দুইজন স্ত্রীলোকের প্রতি রাসূলে করীম (স) অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন।
ইহা হইতে প্রমাণিত হইল যে, মুসলমান গুনাহগার ব্যক্তিকে ভয় দেখাইয়া হেদায়াতের পথে আনিবার উদ্দেশ্যে অভিশাপ দেওয়া জায়েয। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ইহা আল্লাহর রহমত হইত কাহাকেও দূরে লইয়া যাওয়া ও উহা হইতে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত নয়। ইহা হইবে তাহাকে হেদায়াতের দিকে ফিরাইয়া আনা ও তওবা করিতে রাযী করানোর উদ্দেশ্যে।
(**************)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ একটি মেয়েলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল এবং জিজ্ঞাসা করিলঃ
****************************************
হে রাসূল! স্ত্রীর উপর স্বামীর কি কি অধিকার আছে?
জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
স্ত্রী তাহার স্বামীকে তাহার ইচ্ছা পূরণ হইতে নিষেধ করিবে না, যদি তাহা অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ সহকারেও হয়।
অন্য একটি বর্ণনায় এই হাদীসটি ভাষা এইঃ
****************************************
সে তাহার স্বামীকে তাহার ইচ্ছা পূরণ হইতে বিরত রাখিবে না- যদি তাহার (স্ত্রীর) চুলার উপর রান্না কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায়ও হয়।
আর তালক ইবনে আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামী যদি তাহার যৌন প্রয়োজন পূরণার্থে তাহার স্ত্রীকে ডাকে, তাহা হইলে তাহার চলিয়া আসা উচিত- যদিও সে চুলার কাছে রান্না কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকা অবস্থাও হয়। ইহাতে যদি স্বামীল কোন মাল-সম্পদ নষ্ট হইয়া যায়, তবুও তাহার পরোয়অ করা চলিবে না। কেননা স্বামীর ক্রোধের উদ্রেক করা অপেক্ষা কিছু জিনিস নষ।ট হওয়া অনেক সহজ।
ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণের কথাটি এইআলোকে বুঝিতে হইবে যে, ফেরেশতারা খোদানুগত বান্দাহদের জন্য দোয়া করেন যখন তাহারা খোদানুগত্যমূলক কাজে নিমন্গ থাকে। আর পাপী নাফরমান লোকদের জন্য বদদোয়া করিতে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তাহারা নাফরমানী ও পাপ কাজে লিপ্ত থাকে। ইহাই তাঁহাদের কাজ।
ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণ এবং হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর হাদীস অনুযায়ী রাসূলে করীম (স)-এর অভিশাপ বর্ষণ হইতে একথা বুঝা যায় যে, মুসলমান ব্যক্তি যখন নাফরমানী করিতে শুরু করে তখন তাহাকে ভীত সতর্ক ও উহা হইতে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করা জায়েয। আর যদি নাফরমানী করিয়াই বসে তাহা হইলে তাহাকে তওবা ও হেদায়াতের পথ অবলম্বনের আহবান জানাইতে হইবে এবং ইহা যাহাতে সে করে সেজন্য তাহার অনুকূলে দোয়া করিতে হইব।
(******************)
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত এই পর্যায়ের অপর একটি হাদীসের ভাষা হইলঃ
****************************************
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ স্ত্রী যদি তাহার স্বামীর শয্যা ত্যাগ করিয়া রাত্রি যাপন করে, তাহা হইলে ফেরেশতাগণ তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকে- যতক্ষণ না সে ফিরিয়অ আসে।
অর্থাৎ স্ত্রী নিজের ইচ্ছা ও নিজের বশবর্তী হইয়া যদি স্বামীর সংসর্গ ত্যাগ করে, স্বামীর শয্যা ত্যাগ করিয়া অন্যত্র শয্যা গ্রহণ করিয়া রাত্রি যাপন করে, তবে তাহার উপর ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষণ চলে যতক্ষণ না সে স্বামীর শয্যায় প্রত্যাবর্তণ করে। আর স্বামীই যদি নিজের ইচ্ছা ও স্ত্রীর কোন অপরাধের কারণ ব্যতীত স্ত্রীর শয্যাত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়, তবে তাহাতে স্ত্রীর উপর অভিশাপ পড়িবে না। ইহা হইতে জানা যায়, ফেরেশতাণ গুনাহগার লোকদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করিয়া থাকেন।
ফেরেশতাদের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিতে পারে, ইহারা কোন ফেরেশতা? রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ফেরেশতা, না অন্যরা?
ইহার জওয়াবে বলা যাইতে পারে, এই দুইটি কথারই সম্ভাব্যতা আছে। তবে এই কাজে নিযুক্তি কিছু সংখ্যক ফেরেশতাও হইতে পারে।
আসল কথা হইল, আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের বহু প্রকারের ও বহু ধরনের কাজে নিয়োজিত করিয়া রাখিয়াছেন। তাঁহাদের সকলেই কিংবা বিশেষ একটি বিভাগে নিযুক্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ বর্ষণ করিয়া থাকিতে পারেন।
এই হাদীস হইতে বুঝা যায়, স্বামীর সহিত সহযোগিতা করা স্ত্রীর কর্তব্য। সেই সেই কাজ করিতে সতত চেষ্টিত হওয়া উচিত যে যে কাজে স্বামী সন্তুষ্ট হয়- যদি তাহা শরীয়াত বিরোধী না হয়। দ্বিতীয়তঃ স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষদের সঙ্গম ইচ্ছা অদমনীয়। তাৎক্ষণিকভাবে তাহা চরিতার্থ না হইলে অনেক সময় এই ইচ্ছা পুরুষদিগকে পাপের পথে ঠেলিয়া দিতে পারে। এই কারণে রাসূলে করীম (স) স্ত্রীদিগকে স্বামীদেরক সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য আহবান জানাইয়াছেন। এই সব হাদীসের মাধ্যমে।
(***************)
এই পর্যায়ে আর একটি হাদীস স্মরনীয়ঃ
****************************************
হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে স্ত্রী এমন অবস্থায় রাত্রি যাপন ও অতিবাহিত করে যে, তাহার স্বামী তাহার প্রতি সন্তুষ্ট, সে বেহেশতে প্রবেশ করিবে।
(তিরমিযী)
হাদীসটি হইতে বুঝা যায়, একজন স্ত্রীলোকের বেহেশত লাভ যে সব জিনিসের উপর নির্ভরশীল; কিংবা যে সব আমলের দৌলতে একজন স্ত্রী বেহেশত লাভ করিবে, স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা ও তাহার প্রতি স্বামীর খুশী থাকা তাহার মধ্যে একটি। এই হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, যে স্ত্রী রাত্রি যাপন করে এমন অবস্থায় যে, তাহার প্রতি তাহার স্বামী সন্তুষ্ট- এই রাত্রি যাপন বিশেষ কোন রাত্রি নিশ্চয়ই নয়। বরং বিবাহিত জীবনের প্রতিটি রাত্র অর্থাৎ স্বামীকে অসন্তুষ্ট করা বা অসন্তুষ্ট হইলে তাহাকে সেই অবস্থায় থাকিতে দেওয়া, তাহার অসন্তুষ্টি দূর করিয়া সন্তষ্টির উদ্রেক করিতে চেষ্টা না করা ও বেপরোয়া হইয়া নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করা স্ত্রীর জান্নাতে যাওয়ার অনুকূল হইতে পারে না।
ইবনে মাজাহ গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। তবে উহাতে ***** অর্থ এর স্থান ****** শব্দ বলা হইয়া।ইহার অর্থ মৃত্যুবরণ করিল। ইহা হইতে বুঝা যায়, স্ত্রীর মৃত্যুকালে স্বামী যদি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তবে সে বেহেশত লাভ করিবে। এই দুইটি বর্ণনা হইতে একই কথা জানিতে পারা যায়। আর তাহা হইল, বিবাহিত জীবনে স্বামীকে সব সময় সুখী ও তাহার প্রতি সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করা এবং কখনই অসন্তুষ্ট না করা- অসন্তুষ্ট হইলে তাহার অসন্তুষ্টি দূর করিয়া দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। শুধু মৃত্যু কালীন সন্তুষ্টির জন্যও প্রয়োজন সারাটি দাম্পত্য জীবন ভরিয়া স্বামকে সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করা। যে স্ত্রী স্বামীর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি পরোয়া করে না, তাহার পক্ষে বেহেশতে যাওয়া কঠিন।
কেননা সে হয়ত আল্লাহর হক আদায় করিয়াছে; কিন্তু স্বামীর হক অগ্রাহ্য করিয়াছে। অথচ স্বামীর হক হক্কুল ইবাদ। হাক্কুল ইবাদ আদায় না করিলে হক্কুল্লাহও আদায় হয় না। পরিণামে উহার কোন মূল্যই হইবে না।