বিদেশ হইতে আগত স্বামীর গৃহে প্রবেশের নিয়ম

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি নবী করীম (স) সঙ্গে একটি যুদ্ধে শরীক ছিলাম। আমরা যখন যুদ্ধ হইতে ফিরিয়া আসিলাম ও মদীনার নিকটে পৌঁছিয়া গেলাম, তখন একটি মন্হর গতির জন্তযান আরোহী হইয়া আমি তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতে লাগিলাম। তখন পিছন হইত আর একজন জন্তুযান আরোহী লোক আসিয়া আমার সহিত মিলিত হইল। তখন আমি তাহার দিকে ফিরিলাম। সহসা দেখিলাম, আমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট দাঁড়াইয়া রহিয়াছি। তখন তিনি আমাকে বলিলেনঃ কি ব্যাপার! তুমি খুব তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতেছ কেন? আমি জওয়াবে বলিলামঃ আমি নব বিবাহিত, খুব অল্পদিন হয় বিবাহ করিয়াছি, তাই। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কুমারী মেয়ে বিবাহ করিয়াছ, না পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে? বলিলাম, পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে। তিনি বলিলেনঃ কুমারী মেয়ে বিবাহ করিলে না কেন?  তাহা হইলে তুমি তাহার সহিত খেলা করিতে এবং সে তোমার সহিত খেলা করিত? হযতর জাবির (রা) বলেন, অতঃপর আমরা অগ্রসর হইলাম এবং মদীনায় প্রবেশ করিতে যাইতেছিলাম। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তোমরা অপেক্ষা করিতে থাক। রাত্র হইলে অর্থাৎ এশার নামাযের সময় হইলে তখন প্রবেশ করিও। যেন বিস্রস্ত চুলধারী স্ত্রী চুল আচড়াইয়া লইতে পারে ও দীর্ঘদিন স্বামী বঞ্চিতা স্ত্রী পরিচ্ছন্নতা লাভ করিতে পারে।

 

(বুখারী, মুসলিম, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী)

 

ব্যাখ্যাঃ এই দীর্ঘ হাদীসটিতে বহু দিন বাহিরে ও বিদেশে অতিবাহিত করিয়া ফিরিয়া আসা স্বামী স্ত্রীর নিকট যাওয়ার সৌহার্দ ও সৌহৃদ্য বৃদ্ধি কারী পন্হা বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। হাদীসটি হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা)-এর জবানীতে বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে।

 

হযরত জাবির (রা) বিবাহ করার পর কিছু দিনের মধ্যে যুদ্ধে চলিয়া গিয়াছিলেন। ইহা ইসলামের জন্য সাহাবায়ে কেরামের অসাধারণ ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়। নব বিবাহিত ব্যক্তির পক্ষে স্ত্রীকে ঘরে রাখিয়া যুদ্ধে গমন করা সাধারণত খব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়। বস্তুত সাহাবীদের এইরূপ বিরাট ত্যাট ও অতুলনীয় ধৈর্য সহিষ্ণুতার ফলেই দ্বীন ইসলাম দুনিয়ায় বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গী সাথী এইরূপ দৃষ্টান্ত-হীন ত্যাগ তিতিক্ষার গুণে বিভূষিত ছিলেন বলিয়ই তাঁহার মিশন এত অল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য মণ্ডিত হইতে পারিয়াছিল।

 

যুদ্ধ শেষে সকলের সঙ্গে হযরত জাবিরও যখন গৃহাভিমুখে ফিরিয়া আসিলেন, তখন স্বভাবতই তিনি অনতিবিলম্বে ঘরে পৌঁছিয়া যাইবার জন্য উদ্বুদ্ধ হইলেন। কেননা তাঁহার নব বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতিও তাঁহার কর্তব্য রহিয়াছে, সে দিকে তিনি  কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে পারেন না। বিশেষত ইহা হইতেও বৃহত্তর কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়া তো ফিরিয়া আসিলেনই। কাজেই এখন আর বিলম্ব করা উচিত নয় বরং যতশীঘ্র সম্ভব স্ত্রীর সম্মুখে উপস্থিত হওয়া কর্তব্য বলিয়া মনে করিলেন। এই জন্য তিনি দ্রুত গতিতে জন্তুযান চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। তাঁহার এই তাড়াহুড়া দেখিয়া রাসূলে করীম (স)-এর মনে প্রশ্ন জাগিয়া ছিল। তাই এই তাড়াহুড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ ‘আমি বিবাহ করিয়াছি খুব বেশী দিন হয় নাই। ইহার পরই আমাকে এই যুদ্দে গমন করিতে হইয়াছিল। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ কুমারী মেয়ে বিবাহ করিয়াছ না এমন মেয়ে পূর্বে যাহার স্বামী ছিল? উত্তরে তিনি দ্বিতীয় ধরনের মেয়ে বিবাহ করার কথা জানাইলেন। এই সময় নবী করীম (স) বলিলেন, ‘তুমি কোন কুমারী মেয়ে কেন বিবাহ করিলে না? তাহা যদি করিতে, তাহা হইলে তুমি তাহাকে লইয়া খেলা করিতে পারিতে এবং সেও তোমাকে লইয়া খেলা করিতে পারিত’। এই খেলা করার অর্থ কি? পূর্বে স্বামীপ্রাপ্তা মেয়ে বিবাহ করিলে তাহার সহিত খেলা করা যায় না? রাসূলে করীম (স)-এর এই কথা হইতে বুঝা যায় যে, অবিবাহিত পুরুষের উচিত কুমারী মেয়ে বিবাহ করা। কুমারী মেয়ে বিবাহ করিলে তাহার নিকট স্বামী যে সুখ শান্তি ও প্রেম মাধুর্য লাভ করিতে পারে তাহা পূর্বে স্বামীপ্রাস্তা বিধবা তালাক দেওয়া মেয়ে বিবাহ করিলে তাহা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কুমার ছেলে ও কুমারী মেয়ে  জীবনের শুরুতে যখন প্রথমবার মিলিত হয়, তখন তাহারা পরস্পরের নিকট হইতে আনন্দ ও আন্তরিক শান্তি সুখ লাভ করিতে পারে। তাহা পূর্বে স্বামী প্রাপ্তা মেয়ের নিকট হইতে পাওয়া যাইতে পারে না। এই দুই জনার মধ্যে হৃদয় মনের গভীরতর সম্পর্ক ঐকান্তিকতা ও নিবিড় একাত্মতা সংস্থাপিত হওয়াও অনেক ক্ষেত্রে  সুদৃঢ় পরাহত হইয়া পড়ে। বিশেষত এই জন্যও যে, এহেন স্ত্রী তখন পূর্ববর্তী স্বামীর কথা এবং তাহার সহিত অতিবাহিত দিন গুলির স্মৃতিচারণ করিতে ও এই দুই জন স্বামীর মাঝে তুলনা করিতে বাধ্য হয়। এই তুলনায় দ্বিতীয় স্বামী যদি কোন একটি দিক দিয়াও প্রথম স্বামীর তুলনায় নগণ্য ও হীন প্রমাণিত হয়, তাহা ছাড়া প্রথম স্বামীর প্রতি তাহার মনে প্রেম ও তীব্র আকর্ষণও থাকিতে পারে, তাহাকে  হারাইয়া তাহার মনে দুঃখ ও ক্ষোভও থাকিতে পারে। তাহা হইলে তাহার পক্ষে দ্বিতীয় স্বামীকে গভীর ভাবে ভালবাসা দান সম্ভব নাও হইতে পারে। শুধু তাহাই নয়, তাহার মনে যে হাতাশা ব্যর্থতা ও খুঁতখুঁত ভাব দেখা দিবে, তাহা কেহই রোধ করিতে পারে না। ফলে এই স্বামীর জন্য তাহার ভালবাসা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

 

দ্বিতীয়তঃ স্বামীর মনেও দ্বিধা-সংকোচ দেখা দেওয়া বিচিত্র নয় এই জন্য যে, আজ সে যাহাকে স্ত্রীরূপে পাইয়াছে, সে পূর্বে অন্য একজনের স্ত্রী ছিল। ছিল তাহার ভোগের পাত্রী। সে এই দেহ লইয়া অনেক খেলা খেলিয়াছে। এই কারণে সে যে গভীরতর আন্তরিকতা দিয়া একজন কুমারী মেয়েকে গ্রহণ করিতে পারিত এই স্ত্রীকে সেরূপ গ্রহণ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর হইবে না। সম্ভবত এই কারণেই নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

তোমাদের উচিত কুমারী মেয়ে বিবাহ করা। কেননা তাহারাই অধিক তীব্র ও গভীরভাবে স্বামীকে ভালবাসিতে পারে এবং প্রতারণা ও ধোঁকা বাজিতেও তাহারা কম পটু হয়।

 

বস্তুত একবার যে মেয়ে বিবাহিতা হইয়াছ, সে তো স্ত্রীত্বের প্রশিক্ষণ পাইয়াছে, সে যদি এমন কোন ছেলেকে স্বামীরূপে পায় যাহার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই, তাহাকে সে সহজেই প্রতারিত করিতে পারে। এই সব কারণেই রাসূলে করীম (স)-এর পক্ষে এ ধরনের কথা বলার প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল এবং ইহা যে শ্বাশত- দাম্পত্য রহস্যের গভীরতর তত্ত্ব এবং এই রূপ বলা যে অন্য কোন সমাজ-দার্শনিক বা সমাজ-সংস্কারকের পক্ষে সম্ভবপর হয় নাই, তাহা বলাই বাহুল্য।

 

কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, বিধবা বা তালাক প্রাপ্তা মেয়েদের বিবাহই হইবে না। না, তাহাদের বিবাহ অবশ্যই হইবে এবং তাহা অনুরূপ কোন পুরুষের সঙ্গে সহজেই হইতে পারে।

 

হাদীসটির শেষ ভাগে বিদেশাগত স্বামীর গৃহ প্রবেশ সম্পর্কে হেদায়াত দেওয়া হইয়াছে। সে হেদায়াত এই যে, বিদেশগামীর গৃহে প্রত্যাবর্তনের সংবাদ দেওয়ার পর ঘরের স্ত্রীদের কিছুটা অবকাশ দেওয়া বাঞ্ছনীয়; যেন তাহাদের স্বামীকে সাদরে বরণ করিয়া লইবার জন্য মানসিক ও বাহ্যিকে উভয় দিকদিয়া প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে পারে।

 

এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিয়াছেন, তাহার সারমর্ম এই যে, স্বামী বিদেশে চলিয়া গেলেও বেশী দিন বিদেশে থাকিলে গৃহ বধুরা এই সময় নিজেদের দেহ ও সাজ-সজ্জার ব্যাপারে স্বভাবতই উদাসীন হইয়া পড়ে। কেননা স্ত্রীদের সাজ-সজ্জা প্রধানত স্বামীদের সুখী করার জন্য। সেই স্বামীরাই যখন বাড়ীতে অনুপস্থিত, তখন হয়ত তাহারা গৃহের কাজকর্মে বেশী মনোযোগী হইয়া থাকে। হয়ত এই সময় তাহারা পরিচ্ছন্ন কাপড়ড় পড়ে না। মাথার চুলও আচড়ায় না। এই কারণে স্বামীর বাড়ীতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর ফিরিয়া আসিয়া হঠাৎ করিয়া গৃহে প্রবেশ করা উচিত নয়। প্রত্যাবর্তনের খবর আগাম পৌছাইয়অ দেওয়র পরও কিছুটা সময় তাহাদের প্রস্তুতির জন্য দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

হাদীসে বলা হইয়াছে, যেন স্ত্রীরা মাথার বিসৃস্ত চুল আচড়াইয়া লইতে পারে ও নাভির নিম্নদেশে পরিস্কার ও লোমশূণ্য করিয়া লইতে পারে। ইহা যেমন স্বামীদের জন্য জরুরী, তেমনি জরুরী স্ত্রীদের জন্যও। এই কথা দ্বারা প্রকারান্তরে একথাই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, দীর্ঘদিন পর স্বামী যখন গৃহে ফিরিয়া আসে, তখন তাহাকে সাদর সম্বর্ধনা করা ও তাহার জন্য গৃহে ও নিজে দেহে পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালানো স্ত্রীর কর্তব্যভুক্ত। এইরূপ হইলে দাম্পত্য জীবনের সুখ ও সম্প্রীতি এতই গভীর হইবে, যাহা অন্যভাবে হইতে পারে না।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]