হযরত উসামা ইবনে জায়দ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একটি লোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিলঃ আমি আমার স্ত্রীর সহিত ‘নিস্ফল সঙ্গম’ করিয়া থাকি। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি এই রূপ কর কেন? লোকটি বলিলঃ আমি আমার স্ত্রীর সন্তান- কিংবা সন্তানগুলির- জন্য ভয় পাইতেছি। ইহা শুনিয়া নবী করিম (স) বলিলেনঃ ইহ যদি ক্ষতিকর হইত তাহা হইলে পারস্যবাসী ও রোমবাসীসেরও ক্ষতি করিত।
(মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ যে বিষয়টি লইয়া এই হাদীস, তাহা হইল ******* [***** শব্দের ইংরেজী করা হইয়াছেঃ Coitusinterruptus; স্বেচ্ছাপূর্বক রতিক্রিয়ায় ক্ষান্তি।] ‘স্ত্রী সঙ্গম করার শেষ প্রান্তে শুক্র নিষ্ক্রমণের পূর্বেই পুংলিঙ্গ বাহির টানিয়া লওয়া। তদানীন্তন আরব জাহানে এই কাজ করার প্রচলন ছিল। বহু সাহাবীও ইহা করিতেন। ইহা করা হইত শুধু এই ভয়ে যে, শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভিতরে নিস্কৃতি হইলে উহা জরায়ুতে গমন করিয়া গর্ভের সঞ্চার হইতে পারে। সন্তান যাহাতে না হইতে পারে, তাহাই হইল এই কাজের মূল প্রেরণা। কিন্তু সন্তান না হইবে কেন? ইহার জওয়াবে বলা যায়, ইহার নানাবিধ কারণ ছিল। কোন স্ত্রীর হয়ত খুব ঘন ঘন সন্তান হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া গিয়াছে। স্বামীর ইচ্ছা, বেশী সময় ফাঁক দিয়া সন্তান হউক। তাই এক সন্তানের জন্মের পর হয়ত ইহা করিতে শুরু করিল। কোন কোন স্বামী মনে করিত, একদুদ্ধ পোষ্য সন্তানের অবস্থিতিতে আবার গর্ভের সঞ্চার হইলে এই সন্তানের স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যাইতে পারে যেমন আলোচ্য হাদীসে বলা হইয়াছে, সন্তানের ক্ষতি হওয়ার আশংকায় পিতা এইরূপ করিত। তদানীন্তন আরব সমাজে ক্রীতদাসীর সহিত সঙ্গম করার ব্যাপক রেওয়াজ ছিল। অনেকে ক্রীতদাসীর সহিত এইরূপ করিত এই ভয়ে যে, গর্ভে সন্তান জন্মিলে সে ‘উম্মে ওলাদ’ ‘সন্তানের মা’ হইয়া যাইবে। আর সন্তানের মাকে বিক্রয় করা যাইবে না। দাস-প্রথা ভিত্তিক তদানীন্তন অর্থনীতির বিচারে ইহা একটা বিশেষ ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়াইত। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বর্ণিত ও বুখারূ মসিলম উদ্ধৃত হাদীসে এই কথাই বলা হইয়াছে।
কারণ যাহাই হউক, **** অর্থাৎ যৌন মিলনের শেষভাগে শুক্রকীট স্ত্রী অঙ্গের অভ্যন্তরে যাহাতে প্রবিষ্ট হইতে না পারে তদুদ্দেশ্যে উহা নিষ্ক্রমনের পূর্বেই পুরুষাঙ্গ বাহিরে টানিয়া লওয়া। ইহা এক প্রকারের জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া। আধুনিক বিজ্ঞান এই উদ্দেশ্যে অনেক যন্ত্র, উপায় প্রক্রিয়া ও অনেক ঔষধ ইত্যাদিত আবিস্কার করিয়াছে। একালে এই সবের দ্বারা যাহা করিতে চাওয়া হয়, তাহা মোটামুটি তাহাই। যাহা প্রাচীন কালের লোকেরা এই (*****) প্রক্রিয়ার সাহায্যে করিত। আর তাহা হইল স্ত্রীগর্ভে সন্তানের সঞ্চার না হওয়া। এই কারণে মূল হাদীসের ***** শব্দের অনুবাদ করিয়াছে নিস্ফল যৌন সঙ্গম- যে সঙ্গমে সন্তান হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হইল, ইহা করা ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয কি না?
ইসলামী শরীয়াতে ইহা জায়েয কিনা, সে বিষয়ে কুরআন মজীদ হইতে কোন স্পষ্ট কথা জানা যায় নাই। তবে এই পর্যায়ের হাদীসে বুহ কথাই উদ্ধৃত হইয়াছে। এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর বহু কথা ও উক্তি সাহাবীগণ কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে। আমরা প্রথমে রাসূলে করীম (স)-এর সেই উক্তি সময়হ যতটা আমার পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হইয়াছে- এক সঙ্গে পর পর সাজাইয়া পেশ করিব। অতঃপর উহার আইনগত দিক (ফিকাহ) সম্পর্কে বক্তব্য রাখিব।
হযরত জাবির (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমরা রাসূলে করীম (স)-এর জীবদ্দশায় ‘আজল’ করিতেছিলাম। আর কুরআনও নাযিল হইতেছিল। (বুখারী, মুসলিম)
তাঁহার আর একটি উক্তি হইলঃ
****************************************
আমরা রাসূলে করীম (স)এর সময়ে ‘আজল’ করিতেছিলাম এই খবর তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদিগকে তাহা করিতে নিষেধ করেন নাই। (মুসলিম)
হযরত জাবিরের অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছে, একটি লোক নবী করীম (স)-কে বলিলেন, ‘আমার একটি দাসী আছে। সে আমাদের সেবার কাজ করে এবং খেজুর ফসল কাটার কাজে সাহায্য করে। আর আমি তাহার সহিত সঙ্গমও করি। কিন্তু তাহার গর্ভ হউক আমি পছন্দ করি না। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
তুমি তাহার সহিত ‘আজল’ কর- যদি তুমি চাও। তবে জানিয়া রাখ, তাহার জন্য যে সন্তান নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, তাহা তাহার হইবেই।
(মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম, আবূ দায়ূদ)
হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)-এর সহিত বনুল-মুস্তালিকের যুদ্ধে বাহরি হইয়া গেলাম। সেখানে আমরা কিছু সংখ্যক স্ত্রী বন্দী লাভ করিলাম। আমরা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত স্ত্রী হইতে বিচ্ছিন্ন বলিয়া স্ত্রী সঙ্গমের ইচ্ছা আমাদের মধ্যে প্রবল হইয়া দেখা দিল। কিন্তু ইহাতে আমরা ‘আজল’ করা সমীচীন মনে করিলাম। এই বিষয়ে আমরা তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম। জওয়াবে তিনি আমাদিগকে বলিলেনঃ
****************************************
আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করিবেন তাহাতো তিনি লিখিয়াই রাখিয়াছেন, কাজেই তোমরা যদি ইহা (*****) না কর, তাহা হইলে তোমাদের কি অসুবিধা হইবে?
(বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী হইতে আরও বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
ইয়াহুদীরা বলে, ‘আজল’ ছোট আকারের নরহত্যা। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলিয়াছে। মহান আল্লাহ যদি কোন কিছু সৃষ্টি করিতেই চাহেন তাহা হইলে উহার প্রতিরোধ করার-সাধ্য কাহারও নাই। (মুসনাদে আহমাদ, আবূ দায়ুদ)
আবূ সায়ীদ খুদরী অপর এক হাদীসে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ ‘তুমি কি মানুষ সৃষ্টি কর? তুমি কি সন্তানকে রিযিক দাও?... উহাকে (গর্ভে) যথাস্থানেই অক্ষত রাখ ও থাকিতে দাও। মূলত ইহা তকদীর- আল্লাহর নির্ধারিত প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।
জুযামা বিনতে ওহাব আল-আসাদীয়া বলিয়াছেনঃ আমি কিছু সংখ্যক লোক সমভিব্যাহারে রাসূলে করীম(স)-এর নিকট উপস্থিত হইলাম। সেখানে লোকেরা তাঁহার নিকট আজল’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেন। জওয়াবে তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
উহা গোপন নরহত্যা। আর ইহার কথাই বলা হইয়াখে কুরআনের এই আয়াতে (যাহা অর্থ): বিনাদোষে নিহত সন্তানকে যখন জিজ্ঞাসা করা হইবে। (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) স্বাধীনা (ক্রীতদাসী নয় এমন) স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে তাহার সহিত ‘আজল’ করিতে নিষেধ করিয়াছেন।
‘আজল’ (*****) সম্পর্কে উদ্ধৃত বহু সংখ্যক হাদীসের মধ্য হইতে বেশ কয়েকটি হাদীস উপরে উদ্ধৃত করা হইল। এই হাদীসটির প্রমাণ্যতা সম্পর্কে বলা যায়, হযরত আবূ সায়ীদ (রা) বর্ণিত হাদীসটি তিরমিযী ও নাসায়ী গ্রন্হেও উদ্ধৃত হইয়াছে। আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী বলিয়াছেন, ইহার বর্ণনাকারীগণ সিকাহ-বিশ্বাস্য। আর মাজমাউজ্জাওয়ায়িদ গ্রন্হেও ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে। বাজ্জার ইহা উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, ইহার একজন বর্ণনাকারী মূসা ইবনে অরদান। তিনি সিকাহ। কিন্তু কেহ কেহ তাঁহাকে যয়ীফ বলিয়াছেন। অবশিষ্ট বর্ণনাকারী সিকাহ। হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে ইমাম তাহাভী দুঢ়তার সহিত বলিয়াছেন, উহা মনসুখ- বাতিল হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ইবনে হাজাম ইহার বিপরীত মত প্রকাশ করিয়াছেন। হযরত উমর (রা) বর্ণিত হাদীসের সনদে ইবনে লাহইয়া একজন বর্ণনাকারী। তাঁহার সম্পর্কে অনেক আপত্তি জানানো হইয়াছে, যাহা সর্বজনবিধিত। আবদুর রাজ্জাক ও বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হইতে এই বর্ণনাটি এ ভাষায় উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
****************************************
স্বাধীনা স্ত্রীর সহিত তাহার অনুমতি ছাড়া ‘আজল’ করিতে নিষেধ করিয়াছেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নিজে তাঁহার ক্রীতদাসীর সহিত ‘আজল’ করিতেন বলিয়া ইবনে আবূ শাইবা বর্ণনা করিয়াছেন। বায়হাকীও এইরূপ কথা বর্ণনা করিয়াছেন হযরত ইবনে আব্বাস সম্পর্কে।
এই পর্যায়ে হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম(স)-এর নিকট ‘আজল’ করা সম্পর্কে জিজ্ঞসা করিলেন। নবী করীম (স) বলিলেনঃ যে শুক্র হইতে সন্তান হইবে উহা যদি তুমি প্রস্তর খন্ডের উপরও নিক্ষেপ কর, তাহা হইলেও আল্লাহ তা’আলা উহা হইতে একটা সন্তান বাহির করিয়া আনিবেন।
(মুসনাদে আহমাদ, বাজ্জার, ইবনে হাব্বান)
হযরত জাবির (রা)-এর কথাঃ “আমরা ‘আজল’ করিতে ছিলাম, তখন কুরআন নায়িল হইতেছিল” বাক্যটি হইতে বুঝাইতে চাওয়া হইয়াছে যে, এই কাজ নিষিদ্ধ বা হারাম নয়। যদি তাহা হারাম হইত, তাহা হইলে হয় রাসূলে করীম (স) নিজে না হয় স্বয়ং আল্লাহর ওহীর মাধ্যমে ইহা নিষেধ করিয়া দিতেন। কিন্তু তাহা করা হয় নাই। তবে উপরোদ্ধৃত হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী রাসূলে করীম (স)-এর নিষেধ না করার কথায় একটা ফাঁক রহিয়া গিয়াছে। তাহা এই যে, যে সময়ে হযরত জাবির (রা) উক্ত উক্তিটি করিয়াছেন, সেই সময় পর্যন্ত রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ করিতে নিষেধ করেন নাই, একথা সত্য। কিন্তু তাহার পর নিষেধ করেন নাই, এমন কথা তো উহাতে বলা হয় নাই। আর সেই সময় পর্যন্ত নিষেধ না করার তো অনেক কারণই থাকিতে পারে। হযত তখন পর্যন্ততিনি উহার ব্যাপকতা ও তীব্রতা অনুভব করেন নাই। হইতে পারে, তখন পর্যন্ত তিনি এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে কোন জ্ঞান- কোন পথনির্দেশ পান নাই বলিয়াই নিষেধ করেন নাই। হযরত জাবির (রা) এই সব দিক ইংগিত করিয়া কথাটি বলেন নাই এবং তাঁহার বর্ণিত কথাটুকু হইতেও এই প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায় না। ইসলামী আইনের মূলনীতি নির্ধারকগণ এক বাক্যে বলিয়াছেন, কোন সাহাবী যখন রাসূলে করীম (স)-এর সময়ে কোন কাজ করা বা না- করার কথা উল্লেখ করেন, তখন বুঝিতে হইবে, ইহা ‘মরফু’ হাদীসের সমতুল্য। কেননা এইরূপ কথা হইতে বাহ্যতঃ ইহাই বুঝা যায় যে, বনী করীম (স) উহা জানিতেন এবং তিনি উহার প্রতিবাদ করিয়াছেন কিংবা করেন নাই। বিশেষত এই কারণেও যে, সাহাবীগণ বারে বারে নানা বিষয়ে শরীয়াতের হুকুম জানিবার জন্য রাসূল (স)-এর নিকট সওয়াল করিতেন, ইহা তো জানা কথা-ই। শুধু তাহাই নয়, বহু কয়টি বর্ণনা হইতে স্পষ্ট জানা যায় যে, নবী করীম (স) সাহাবীদের এই ‘আজল’ সম্পর্কে পুরাপুরি অবহিত ছিলেন। হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসঃ
****************************************
আমরা রাসূলে করীম(স)-এর জীবদ্দশায় আজল করিতাম ইহার সংবাদ নবী করীম (স)-এর নিকট পৌঁছিল, কিন্তু তিনি আমাদিগকে নিষেধ করেন নাই।
(মুসলিম)
হযরত জাবির বর্ণিত অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছে, নবী করীম (স) জৈনিক সাহাবীকে ‘আজল’ করার অনুমতি দিয়া বলিয়াছেনঃ
****************************************
তুমি ইচ্ছা করিলে ক্রীতদাসীর সহিত ‘আজল’ করিতে পার।
কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ কথা নয়, হাদীসটি এই কথাটুকু দ্বারাই শেষ করা হয় নাই। বরং ইহার পরই এই কথা রহিয়াছেঃ
****************************************
তবে মনে রাখিও, উহার জন্য যে কয়টি সন্তান নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, তাহা তাহার অবশ্যই হইবে।
এই সম্পূর্ণ কথা হইতে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, নবী করীম(স) সন্তান হওয়া বন্ধ করার পর্যায়ে ‘আজল’ করাকে সম্পূর্ণ নিস্ফল ও অর্থহীন মনে করিতেন। আর এই জন্য যদি তিনি ‘আজল’ করিতে নিষেধ না-ও করিয়া থাকেন, তাহাতে কিছুই যায় আসে না।
‘আজলৱ করার অনুমতি দান সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদীসের শেষ কথা হইল উক্ত সাহাবীই কিছু দিন পর দরবারে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, আমি যে দাসীটির সহিত ‘আজল’ করার অনুমতি চাহিয়াছিলাম, সে গর্ভবতী হইয়াছে। ইহা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ ********* আমি তো তোমাকে সেকথা পূর্বেই বলিয়াছিলাম। বস্তুত বাস্তবতার দৃষ্টিতেও প্রমাণিত হইল যে, ‘আজল’ সন্তান হওয়া বন্ধ করিতে পারে না।
‘আজলৱ সম্পর্কিত হাদীসে এখানেই শেষ হইয়া যায় নাই এই পর্যায়ের আরও হাদীস রহিয়াছে। [আধুনিক যৌন বিজ্ঞানেও বলা হইয়াছে যে, সমস্ত শুক্রকীট হইতে সন্তান হয় না এবং একটি শুক্রকীট কোনভাবে গর্ভধারে পৌঁছিতে পারিলেই তাহাতেই গর্ভ হইতে পারে এবং টেস্ট টিউবের সন্তান এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে।]
একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ সম্পর্কিত প্রশ্নের জওয়াবে বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা যদি ইহা না কর তাহা হইলে তোমাদের কি অসুবিধা হয়?
বুখারী শরীফে এই বাক্যটির ভাষা হইলঃ
****************************************
‘না, এই কাজ না করাই তো তোমাদের কর্তব্য।
ইবনে শিরীন বলিয়াছেনঃ *************** ‘রাসূলের উক্ত কথাটি প্রায় নিষেধ পর্যায়ের’।
আর হাসান বসরী বলিয়াছেনঃ
****************************************
আল্লাহর শপথ, ‘আজল’ কাজের ব্যাপারে ইহা রাসূলে করীম (স)-এর তীব্র হুশিয়ারী- হুমকি ও ধমক মাত্র। অর্থাৎ কঠোর ভাষায় নিষেধ।
আল্লামা কুরতুবী বলিয়াছেন, এই মনীষীগণ হাদীসের ****- না কথাটি হইতে স্পষ্ট নিষেধই বুঝিয়াছেন। সাহাবীগণ যে বিষয়ে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তাহার উত্তরে **- না বলার অর্থ হইল, সেই কাজটি জায়েয নয়। তিনি সে কাজ করিতে সাহাবীগণকে নিষেধ করিয়াছেন। অর্থাৎ তিনি যেন বলিয়াছেনঃ
****************************************
তোমরা ‘আজল’ করিও না। ‘আজল’ না করাই তোমাদের কর্তব্য।
এই শেষের বাক্যাংশ প্রথম কথার না-র তাকীদ হিসবেই বলা হইয়াছে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর উক্ত কথাটির অর্থঃ
****************************************
এই কাজ যদি তোমরা না কর। তাহা হইলে তোমাদের কোন ক্ষতি বা অসুবিধা হইবে না।
কেননা সন্তান না হওয়ার উদ্দেশ্যে ‘আজল’ করিলে তাহাতে কোন ফায়দাই পাওয়া যাইবে না। যেহেতু সন্তান হওয়া ‘আজল’ দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব নহে।
তিরমিযী শরীফে এই পর্যায়ে আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হইতে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে বলা হইয়াছেঃ একদা রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে আজল সম্পর্কে কথা উঠিলে নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
তোমাদের কোন লোক এই কাজ করিবে কেন! কেননা সৃষ্টি হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সব প্রাণী বা মানব সত্তাকেই আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করিবেন।
ইবনে আবূ উমর এই হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ‘আজল’ প্রসঙ্গে *** ****** তোমাদের কেহ এই কাজ করিবে না, বলেন নাই। ইহার অর্থ, উক্ত হাদীসটিতে ‘আজল’ করাকে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেন নাই। হ্যাঁ, নিষেধ করেন নাই, এ কথা ঠিক। কিন্তু উহার অনুমতিও দেন নাই।
উক্ত হাদীসটি বলার সময় পর্যন্ত তিনি ‘আজল’ করিতে স্পষ্টভাষায় নিষেধ করেন নাই বটে; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই কাজ যে তিনি সম্পূর্ণ অপছন্দ করিয়াছেন- কিছুমাত্র ভালো মনে করেন নাই তাহাতেও সন্দেহ নাই। বরং প্রথম দিকের কথা সমূহ থেকে মনে হয়, তিনি মনে করিবেন যে, এই কাজটি সম্পূর্ণ অথীহীন, নিষ্ফল। উহা করিয়া নারীর গর্ভে সন্তাতেনর অস্তিত্ব গড়িয়া উঠাকে কোন ক্রমেই বন্ধ করা যাইবে না। তাহাতে তাঁহার একবিন্দু সন্দেহ ছিল না। ইহা নিতান্ত অর্থহীন ও নিস্ফল কাজ।
ইবনে হাব্বান আহমাদ ও বাজ্জার হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন, একব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট ‘আজল’ সম্পর্কে প্রশ্ন করিলেন। জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ যে শুক্রে সন্তান হইবে, তাহা প্রস্তর খন্ডের উপর নিক্ষেপ করিলেও তাহা হইতে আল্লাহ অবশ্যই সন্তান সৃষ্টি করিবেন।
তাবারানী ইবনে আব্বাস (রা) হইতে এবং ‘আল-আওসাত’ ইবনে মাসউদ (রা) হইতে উপরোক্ত কথার সমর্থক হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই সব হাদীস হইতে নিঃসন্দেহে ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, গর্ভ নিরোধ কাজে ‘আজল’ সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও নিস্ফল। উহা জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন প্রক্রিয়া হিসাবে সেকালেও কার্যকর ছিল না, একালেও হইতে পারে না। বরং উহা করিয়া নিজেকেও নিজের স্ত্রীকে যৌন সঙ্গমের চূড়ান্ত স্বাদ গ্রহণের অধিকার হইতে নিতান্তই অকারণ বঞ্চিত করা হয়। এই ‘আজল’কে জায়েয প্রমাণ করিয়া যাহারা একালের জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে বৈধ বা শরীয়াত সম্মত প্রমাণ করিতে বৃথা চেষ্টা করিতেছে, তাহারা অমানু, মিথ্যাবাদী ও সুস্পষ্ট ধোঁকাবাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাসূলে করীম (স)-এর কথা, ‘আজল’ না করিলে তোমাদের কোন ক্ষতি নাই, ইহার সহজ অর্থ, আজল’ করিলে নিশ্চয়ই ক্ষতি আছে। বুঝা গেল, ‘আজল’ করিলে ক্ষতি হওয়া সুনিশ্চিত। কেননা এই কাজ করিলে কোন ক্ষতি নাই বলিবার ইচ্ছা থাকিলে তিনি বলিতেনঃ
****************************************
না তোমাদের কর্তব্য এই যে, তোমরা ইহা কর। অথবা (ইহার অর্থ) ইহা করিলে তোমাদের কোন ক্ষতির আশংকা নাই।
কিন্তু নবী করীম (স) কথাটি এভাবে ও এভাষায় বলেন নাই। অতএব হাদীস সমূহের এই বিশ্লেষণ হইতে বুঝা গেল, নবী করীম (স) এই কাজ সমর্থন করেন নাই।
ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেন, শরীয়াত বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একতম যে, স্বাধীনা স্ত্রীর সহিত এইরূপ করা তাহার অনুমতি ব্যতীত জায়েয নয়। কেননা স্বামীর সহিত সঙ্গম কাজের চূড়ান্ত তৃপ্তি লাভ তাহার অধিকার। এই অধিকার যথাযথ না পাইলে সে ইহার দাবি জানাইতে পারে। কিন্তু সঙ্গম বলিতে যাহা বুঝায় ‘আজল’ করা হইলে তাহা হয় না। ইবনে হুরাইরা বলিয়াছেন, এ ব্যাপারে ইজমা অনুষ্ঠিত হইয়াছে। শাফেয়ী মাযহাবের মতের একটা উদ্ধৃতি ভিন্নতর হইলেও উহার সুস্পষ্ট ঘোষণা হইল, স্বাধীনা স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া এই কাজ করা আদৌ জায়েয নয়। কোন ক্রীতদাসী যদি বিবাহিতা স্ত্রী হয় তাহা হইলে তাহার ব্যাপারেও একই কথা।
যে হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলিতেন, ইহা হইতে কেহকে **** জায়েয প্রমাণ করিতে চাহিয়াছে। তিরমিযী গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে।
তাহাতে রাসূল (স)-এর কথাটির ভাষা এইঃ
****************************************
ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলিয়াছে। আল্লাহ যদি সৃষ্টিই করিতে চাহেন, তাহা হইলে তাহা রদ করার ক্ষমতা কাহারও নাই।
ইহা হইতে বুঝা যায়, নবী করীম (স) ‘আজল’ কাজটিকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, নিস্ফল ও অর্থহীন মনে করিয়াছেন। ‘আজল’ করিলে সন্তান হয় না বলিয়া যাহারা মনে করে, তাহারা মিথ্যাবাদী। উহা করা হইলে কাহাকেও হত্যাও করা হয়না। কিন্তু উহা করা হইলেও আল্লাহর সৃষ্টি-ইচ্ছা কক্ষণই প্রতিহত হইবে না। আজলও করা হইবে। গর্ভেরও সঞ্চার হইবে, সন্তানও জন্মগ্রণ করিবে। তাহা কেহ বন্ধ করিতে পারিবে না্
কিন্তু এই কথাটিরও প্রতিবাদ হইয়াছে হযরত জুযামা বর্ণিত হাদীসে। তাহাতে নবী করীম (স) নিজে বলিয়াছেনঃ ******** ‘কাজটি গোপন নরহত্যা বিশেষ’। দেখা যায়, নবী করীম (স)-এর উক্তিকে কোথাও অনুমতি আছে কোথাও না করিলে দোষ নাই’ আছে। কোথাও তুমি কি সৃষ্টি কর- তুমিকি রিযিক দাও? বলিয়া ধমক আছে। আর কোথাও উহাকে স্পষ্টভাষায় গোপন নরহত্যা বলিয়া অভহিত করিয়াছেন। আর নরহত্যা- তাহা যে ভাবেই হউক- সম্পূর্ণ হারমা, উহা তো কুরআনের স্পষ্প অকাট্য ঘোষণা।
এই বিভিন্ন কথার মধ্যে কেহ কেহ সামঞ্জস্য ও সংগতি বা সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে বলিয়াছেন, ‘আজল’ করা মাকরূহ তানজীহ। বায়হাকী এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। কেহ কেহ জুযামা’র এই হাদীসটিকে যয়ীফ ব লিতে চাহিয়াছেন শুধু এই কারনে যে, ইহা অধিক সংখ্যক বর্ণনার বিপরীত কথা। কিন্তু এই ভাবে নিতান্ত অমূলক ধারণার ভিত্তিতে সহীহ হাদীসকে রদ ও প্রত্যাখ্যান করার নীতি হাদীস শাস্ত্রবিশারদের নিকট আদৌ সমর্থণীয় নয়। জুযামা বর্ণিত হাদীসটি যে সম্পুর্ণ সহীহ তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ইবনে হাজার আল-আসকালানী এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। আর যাহারা ইহাকে মনসূখ বা বাতিল বলিয়াছেন, তাহারা হাদীসের তারীখ জানেন না। অতএব তাঁহাদের এই রূপ উক্তি গ্রহণীয় নয়। জুযামা বর্ণিত হাদীসটিকে অনেক বিশেষজ্ঞই অগ্রাধিকার দিয়াছেন কেননা উহা সহীহ হাদীস। উহার বিপরীত কথা প্রমাণিত হয় যে সব হাদীস হইতে, সনদের দিক দিয়া তাহাতেই বরং কোন না কোন ক্রটি রহিয়াছে।
আল্লামা ইবনে হাজাম এই বিভিন্ন ধরনের হাদীসের মধ্যে সমন্বয় বিধানের জন্য বলিয়াছেনঃ জুযামা বর্ণিত হাদীসটি অনুযায়ী আমল করিতে হইবে। কেননা উহার বিপরীত কথার হাদীস সমূহ হইতে বড়জোর এতটুকু জানা যায় যে, উহা মূলত মুবাহ। ইহা প্রথম দিকের কথা। কিন্তু জুযামা বর্ণিত হাদীস আসিয়া উহাদে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছে। এখন যদি কেহ দাবি করে যে, প্রথমে নিষেধ করা হইয়াছিল, পরে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে তবে এই কথা প্রমাণের জন্য তাহার উচিত অকাট্য দলীল পেশ করা। কিন্তু তাহা কেহ করিতে পারে না।
কেহ কেহ বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ‘আজল’ করাকে ******** ‘গোপন হত্যা’ বলিয়াছেন। ইহা একটা দৃষ্টান্ত মুলক কথা। ইহাতে প্রমাণিত হয় না যে, ইহা করা সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু ইহা যে শরীয়াতের মূল লক্ষ্যকে ভূলিয়া যাওয়অর পরিণতি, তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম এই পর্যায়ে বলিয়াছেনঃ নবী করীম (স) ইয়াহুদীদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়াছেন এই কথায় যে, তাহাদের ধারণা ছিল ‘আজল’ করিলে গর্ভের সঞ্চার হয় না। ইহা বস্তুতই মিথ্যা কথা। কেননা ইহা করিলেও গর্ভ হওয়া সম্ভব। একথা স্বয়ং নবী করীম (স) অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলিয়াছেন। তাঁহার কথার তাৎপর্য হইল, ইয়াহুদীরা যে মনে করিয়াছে, ‘আজল’ করিলে সন্তান জন্মিবে না ইহা সম্পূর্ণ অসত্য। আল্লাহ ইচ্ছা করিলে এতদসত্বেও সন্তান গর্ভে আসিবে ও জন্ম হইবে। আর তিনি যদি সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা না করেন, তাহা হইলে উহা করা গোপন হত্যা হইবে না।
হযরত জুযামা’র হাদীসে ‘আজল’কে গোপন হত্যা বলা হইয়াছে এই কারণে যে, স্বামী ‘আজল’ করে গর্ভ সঞ্চার হওয়ার ভয়ে, এই কথা মনে করিয়া যে, ইহা করা হইলে সন্তান জন্মিবে না। স্বামী-স্ত্রী সঙ্গম হইবে যথারীতি এবং যৌন স্বাদ উভয়েরই আস্বাদন হইবে (যদিও চূড়ান্ত স্বাদ গ্রহণ হইবে না) অথচ সন্তান হইবে না। ইহার চাইতে সুখের বিষয় আর কি আছে! আর এই মানসিকতাই সন্তান হত্যার নামান্তর মাত্র। তবে পার্থক্য এই যে, প্রকাশ্য নর হত্যার পিছনে থাকে ইচ্ছা সংকল্প ও বাস্তব পদক্ষেপ। আর ‘আজল’-এ থাকে শুধু ইচ্ছা সংকল্প ও সামান্য কাজ। ইহার ফলে অতি গোপন পন্হায় সন্তান হওয়ার পথ বন্ধ করাই তাহর লক্ষ্য। এই লক্ষ্যের কারণেই উহাকে হাদীসে ‘গোপন হত্যা’ (***********) বলা হইয়াছে। বস্তুত হাদীস সমূহের এইরূপ সমন্বয় অত্যান্ত যুক্তিযুক্ত।
মুহাদ্দিস ইবনে হাব্বান হযরত জুযামার বর্ণিত এই হাদীসটির ভিত্তিতে ‘আজল’ করিতে নিষেধ করিয়াছেন। আর ইহার ফলে যে স্বামী-স্ত্রী সঙ্গমের চূড়ান্ত তৃপ্তি লাভ হয় না এবং ইহা আল্লারহ নিয়ামত ইহতে এক প্রকারের বঞ্চনা, উপরন্তু ইহা আত্মবঞ্চনা যেমন, স্ত্রীকেও বঞ্চিত করা হয় তেমনই, ইহাতেও কোনই সন্দেহ নাই।
(**************)
উদ্ধৃত হাদীস সমূহ লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে ‘আজল’ করার অনুমতি সংক্রান্ত হাদীস কেবলমাত্র একজন সাহাবী হইতে বর্ণিত। তিনি হইতেছেন হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা)। আর এই কাজের নিষেধ স্পষ্ট বা অস্পষ্ট বর্ণিত হইয়াছে নয়জন সাহাবী হইতে। এই কথা হইতেও বিষয়টি সম্পর্কে শরীয়াতের মূল লক্ষ্য প্রতিভাত হইয়া উঠে।
‘আজল’ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজম বলিয়াছেন, ইহা সম্পূর্ণ হারাম। তিনি দলীল হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন ইমাম মুসলিম বর্ণিত নবী করীম (স)-এর উক্তি ******* ‘উহা গোপন হত্যা কাণ্ড বিশেষ’। তিনি আরও কতিপয় হাদীসের উল্লেখ করিয়াছেন, যাহার সনদ সূত্র নবী করীম(স) পর্যন্ত পৌঁছায় নাই, যাহা সাহাবীগণের উক্তিরূপে বর্ণিত। নাফে বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ‘আজল’ করিতেন না। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
আমার কোন সন্তান ‘আজল’ করে, জানিতে পারিলে আমি তাহাকে কঠিন শাস্তি দিব।
হাজ্জাজ ইবনুল মিনহাল হইতে বর্ণিত হযরত আলী (রা) ‘আজল’ করাকে মাকরূহ (মাকরূহ তাহরীমী) মনে করিতেন।
হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসঃ ‘আমরা আজল করিতেছিলাম’ অথচ তখন কুরআন নায়িল হইতেছিল’ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজম বলিয়াছেন, ইহা মনসুখ-বাতিল। [*******************] আর হানাফী মুহাদ্দিস ইমাম বদরুদ্দীন আইনী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহর (রা) কথার জওয়াব দিয়াছেন এই বলিয়া, ‘আজল’এর ব্যাপারে সেই রকম অবস্থাই যেমন কবর আযাবের ক্ষেত্রে হইয়াছে। ইয়াহুদীরা বলিয়াছিলঃ *************** ‘মৃত ব্যক্তিকে কবরে আযাব দেওয়া হয়। তখন নবী করীম (স) তাহাদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। কেননা এই সমিয় পর্যন্ত তিনি এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে কিছুই জানিতে পারেন নাই। পরে আল্লাহই যখন তাঁহাকে জানাইয়া ছিলেন যে, কবরে আযাব হওয়ার কথা সত্য, তখন তিনি কবর আযাব হওয়ার কথার সত্যতা স্বীকার করিলেন এবং না জানিয়া বলার কারণে তিনি আল্লাহর নিকট পানাহ চাহিলেন। এখানেও সেই রকমই হইয়াছে। (অর্থাৎ তিনি না জানিতে পারা পর্যন্ত ‘আজল’ করিতে নিষেধ করেন নাই। পরে আল্লাহর নিকট হইতে জানিয়া উহা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন)। দ্বিতীয়, ইমাম তাহাভী যে হযরত জাবির বর্ণিত হাদীস দ্বারা হযরত জুযামা বর্ণিত হাদীস মনসুখ হইয়াছে বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন, এই কথা ঠিক হইতে পারে না। কেননা হযরত জুযামা ইসলাম কুবল করিয়াছেন দশন হিজরী সনে। কাজেই তাঁহার বর্ণিত হাদীস সর্বশেষের। অতএব তাঁহার হাদীসটিই মনসুখ করিয়াছে হযরত জাবির বর্ণিত হাদীসকে। অবশ্য কেহ কেহ এও বলিয়াছেন যে, তিনি অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম কবুল করিয়াছেন। আবদুল হক বলিয়াছেন, ইহাই সহীহ কথা। (তবুও তাঁহার বর্ণিত হাদীস দ্বারা হযরত জাবির বর্ণিত হাদীসটির মনসুখ হইয়া যাওয়া ঠিকই থাকে) [************************] ইমাম ইবনুল কাইয়্যেমও লিখিয়াছেনঃ ‘আজল’ মুবাহ বা অ-নিষিদ্ধ হওয়ার কথাটি বর্ণনা হিসাবে সহীহ হইলেও উহা ‘আজল’ নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বের বর্ণনা। পরে উহা হারাম ঘোষিত হইয়াছে। ফলে হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে যাহা প্রমাণিত হইয়াছে তাহা নাকচ-রহিত- হইয়া গিয়াছে। [জাদুল মায়াদ, ৫ম খণ্ড, ১৪০-১৪৬ প্রঃ]
বুখারী শরীফের শারাহ লেখক প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইবনে হাজার আল-আস কালানী ‘আজল’ সম্পর্কিত হাদীস সমূহের আলোচনায় লিখিয়াছেনঃ ‘ইবরাহীম ইবনে মুসা সুফিয়ান হইতে- হযরত জাবির (রা) হইতে যে হাদীসটির বর্ণনা করিয়অছেন, তাহাতে নিজ হইত এই কথাটুকু বাড়াইয়া বলিয়াছেনঃ ************** অর্থাৎ ‘আজল’ করা যদি হারাম হইত, তাহা এই বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাযিল হইত।
ইমাম মুসলিম ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর মুখে সুফিযান হইতে বর্ণিত হাদীসে এই কথাটি এভাবে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
‘আজল’ কাজে নিষেধের কিছু থাকিলে কুরআন আমাদিগকে তাহা করিতে অবশ্যই নিষেধ করিত।
ইহা হইতে স্পষ্ট হয় যে, সুফিয়ানের এই কথাটি মূল হাদীস হইত নির্গলিত তাৎপর্য হিসাবে বলা হইয়াছে। ইহা আরও প্রমাণ করে যে, তাহাদের ‘আজল’ করার কাজকে কুরআন অব্যাহত রাখিয়াছে। রাসূলে করী (স) এই কাজকে অস্বীকার বা বন্ধ করেন নাই। ইহার অর্থ হিসাবে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
শরীয়াত রচিত হওয়ার সময়ে আমরা এই কাজ করিয়াছি। যদি ইহা হারাম হইত, তাহা হইলে শরীয়াত ইহা নিশ্চয়ই স্থায়ী থাকিতে দিত না।
কিন্তু হযরত জাবির (রা) এর এই কথা শরীয়াত রচনা কালের প্রাথমিক পর্যায়ের অথচ এই কালের মেয়াদ অন্ত দশটি বৎসর দীর্ঘ।
শাফেয়ী মাযহাবপন্হী ইমাম গাজালী ‘আজল’ জায়েয মনে করিয়াছেন। কিন্তু সেই শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী মুহাদ্দিস ইবনে হাব্বান বলিয়াছেনঃ
****************************************
হাদীসমূহ প্রমাণ করে যে, ‘আজল-এর এই কাজটি নিষিদ্ধ, এজন্য হুমকি ও ধমক দেওয়া হইয়াছে। অতএব এই কাজটি করা কখনই মুবাহ হইতে পারে না।
ইহার পর তিনি হযরত আবূ যার (রা) বর্ণিত রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
****************************************
উহাকে (শুক্রকীট) উহার হালাল অবস্থায়ই রাখিয়া দাও, হারাম হইতে উহাকে দূরে রাখ এবং উহাকে স্থিত হইত দাও। অতঃপর আল্লাহ চাহিলে উহা হইতে জীবন্ত সত্তা সৃষ্টি করিবেন, নতুবা উহাকে মারিয়া ফেলিবেন। মাঝখানে তোমার জন্য সওয়াব লেখা হইবে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘আজল’ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করিয়া গর্ভবতী স্ত্রীর সহিত ‘আজল’ করা হইলে উহার পরিণতিতে গর্ভ বিনষ্ট হইতে পারে। কেননা এই অবস্থায় যৌন সঙ্গমে যে বীর্য স্থলিত হয়, তাহাই ভ্রূণের খাদ্য। ভ্রূণ সে খাদ্য না পাইলে উহার মৃত্যু বা দৈহিক দুর্বলতা বা অঙ্গহানি হইতে পারে। তাহাতে উহার মৃত্যু হওয়া অবশ্যম্ভাবী। রাসূলে করীম (স) হয়ত এই জন্যই ‘আজল’কে গোপন হত্যা’ বলিয়াছেন। ইহার ফলে বংশের ধারাও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইতে পারে। ইহাতে সন্তান জন্মের পন্হাটিই বিনষ্ট হইই যায়।