পরিবারবর্গের লালন-পালন ও ব্যয়ভার বহন পরিবার ও পারিবারিক জীবন

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ অতি উত্তম দান তাহাই যাহা ধনী লোক নিজ হইতে ছাড়িয়া দিবে। আর উপরের হাত  নীচের হাতের তুলনায় উত্তম। দেওয়া শুরু কর তোমার পরিবারবর্গ হইতে। স্ত্রী বলেঃ হয় আমাকে খাইতে দাও, না হয় আমাকে তালাক দাও। দাস বা খাদেম বলেঃ আমাকে খাইতে দাও ও আমাকে কাজে খাটাও। আর পুত্র বলেঃ আমাকে খাইতে দাও, তুমি আমাকে কাহর হতে ছাড়িয়া দিবে?.... লোকেরা বলিল, হে আবূ হুরায়রা , তুমি কি এই সব কথা রাসূলে করীম (স)-এর নিকট শুনিয়াছ? আবূ হুরায়রা বলিলেনঃ না, ইহা আবূ হুরায়রার পাত্র বা মেধা হইতে পাওয়া কথা।

 

(বুখারী, নাসায়ী)

 

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসটিতে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। প্রথম কথা, উত্তম দান তাহাই যাহা ধনী ব্যক্তি নিজ হইতে ছাড়িয়া দেয়। ‘নিজ হইত ছাড়িয়া দেয়’ অর্থ যাহা দিতে দাতার কোনরূপ অসুবিধা হয় না, যাহা দেওয়া তাহার পক্ষে সহজ। বস্তুত ইসলামে অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনের পরও সাধারণভাবে সমাজের দারিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্য দান-খয়রাত করার এক বিশাল অবকাশ ও ব্যবস্থা রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে সচ্ছল অবস্থায় ব্যক্তি নিজ হইতে নিজের ইচ্ছা ও বিবেচনাক্রমে যাহা দিবে, যতটুকু দিবে, তাহাই সর্বোত্ম দান বিবেচিত হইবে। গ্রহীতার উচিত তাহাই গ্রহণ করা ও গ্রহণ করিয়া সন্তুষ্ট থাকা। অতিরিক্ত পাওয়ার জন্য তাহার উপর কোনরূপ চাপ সৃষ্টি করা বা বল প্রয়োগ করা অনুচিত। তাহা করা হইলে তাহা আর ‘দান’ থাকিবে না। তাহা হইবে ডাকাতি। আর ডাকাতি যে কোন ক্রমেই জায়েয নয়, তাহা বলার প্রয়োজন হয় না।

 

দ্বিতীয় বলা হইয়াছে, উপরে হাত নীচের হাতের তুলনায় উত্তম। উপরের হাত দাতার হাত, আর নীচের হাত দান- গ্রহীতার হাত। রাসূলে করীম(স)-এর এই কথাটি বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য। যে লোক দান গ্রহণ করে ভিক্ষাবৃত্তি চালায়, এই কথাটি দ্বারা তাহার মর্যাদার কথা বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছে। যে দান গ্রহণ করে তাহার মনে করা উচিত সে মোটেই ভাল কাজ করিতেছে না। সে অত্যন্ত চীন ও হীন কাজ করিতেছে। তাহার এই কাজ যতশীঘ্র সম্ভব পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। আর যে লোক দান করে, রাসূলে করীম (ষ)-এর এই কথানুযায়ী সে উচ্চ মর্যাদায় আসীন। তাহার অর্থনৈতিক কাজ-কর্ম এমন ভাবে করিয়া যাওয়া উচিত, যেন তাহার এই সম্মানজনক স্থান সে কখনও হারাইয়া না ফেলে। অতএব বেহুদা খরচ হইতে তাহার বিরত থাকা ও বেশী বেশী আয় করার জন্য চেষ্টা চালাইয়া যাইতে থাকা তাহার কর্তব্য।

 

তৃতীয় কথা, তোমার পরিবার বর্গ হইতেই দেওয়া শুরু কর। অর্থাৎ তোমার নিজের প্রয়োজন পরিপূরণের পর সর্বপ্রথম তোমার দায়িত্ব হইল তোমার পরিবার বর্গ ও তোমার উপর নির্ভরশীল লোকদের (Dependents) যাবতীয় ব্যয়ভার বহন ও প্রয়োজন পূরণ করা। তাহার পরই তুমি অন্য লোকদের প্রতি দৃষ্টি ফিরাইতে পার। নিজের উপর নির্ভরশীল লোকদের প্রতি লক্ষ্য না দিয়া ও তাহাদের নিম্নতম প্রয়োজন পূরণ না করিয়া অন্য লোকদের মধ্যে বিত্ত সম্পত্তি বিলাইয়া দেওয়া তোমার নীতি হওয়া উচিত নয়।

 

এখানে প্রশ্ন উঠে, তবে কি নবী করীম (স) স্বার্থপরতার শিক্ষা দিয়াছেন? জওয়াবে বলা যাইতে পারে, হ্যাঁ স্বার্থপরতার শিক্ষাই তিনি দিয়াছেন। কেননা স্বার্থপরতাই পরার্থপরতার মূল। আর একটু উদার দৃষ্টিতে দেখিলে বোঝা যাইবে, ইহা সেই স্বার্থপরতা নয়, যাহা নিতান্তই অমানবিক, অসামাজিক এবং হীন ও জঘন্য। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই জীবন-যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য চেষ্টা চালাইতে হইবে এবং একাজে অন্যদেরও সাহায্য সহযোগিতা করিতে হইবে।  ইহা এক সঙ্গে দ্বিবিধ দায়িত্ব। নিজেকে বাঁচাইতে পারিলেই অন্যদের বাঁচাইবার জন্য করা একজনের পক্ষে সম্ভব। তাই নিজেকে বাঁচাইবার ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে আর যাহাদের বাঁচাইবার জন্য কাজ করিতে হইবে, তাহারা হইল ব্যক্তির পরিবার বর্গ, ব্যক্তির উপর একান্ত নির্ভরশীল লোক। এইভাবে প্রত্যেক উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি নিজের ও নিজের পরিবার বর্গের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব নেয়, তাহা হইলে সমাজে এমন লোকের সংখ্যা বেশী থাকিবে না যাহাদের দায়িত্ব কেহই বহন করিতেছে না। [ইসলামে যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উপস্থাপিত করিয়াছে তাহার বিস্তারিক রূপ জানিবার জন্য পাঠ করুন এই গ্রন্হকারের লেখা ‘ইসলামের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’। উহাতে উক্ত মূলনীতির ভিত্তিতে ইহার ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে।]

 

পরিবারবর্গ ও নির্ভরশীল লোকদের ভরণ-পোষদেনর দায়িত্ব পালন কেবল কর্তব্যই নয়, ইহা অতিবড় সওয়াবের কাজও। রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

মুসলিম ব্যক্তি যখন সচেতনভাবে ও বুঝে-শুনে তাহার পরিবার বর্গের জন্য অর্থব্যয় করে তখন উহা তাহার সাদকা ইহয়া যায়।

 

এই হাদীসটির দুইটি কথা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। একটি ***** বলিতে কোন সব লোক বুঝায় এবং ****** এর জন্য ব্যয় করিলে তাহা ‘সাদকা’ বা দান হইয়া যায় কিভাবে।

 

প্রথম কথাটির ব্যাখ্যায় বলা হইয়াছে, ***** বলিতে বুঝায় ব্যক্তির স্ত্রী ও উপার্জন অক্ষম সন্তান। অনুরূপ ভাবে তাহর ভাই-বোন, পিতা-মাতা, চাচা-চাচাতো ভাই পর্যন্ত। যদি কোন বালক তাহার ঘরে লালিত হইতে থাকে, তবে সেও ***** বা পরিবার বর্গের মধ্যে পণ্য।

 

দ্বিতীয় কথাটির ব্যাখ্যা এই যে, এই খরচ বহন তাহার উপর ওয়াজিব হইলেও সে যদি এই কাজের বিনিময়ে পরিবার বর্গের প্রয়োজন পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর নিকট হইতে সওয়াব পাইবরও নিয়্যত করে তাহা হইলে সে সেকাজের জন্য সওয়াবও পাইবে। এই হিসাবেই এই কাজ তাহার জন্য ‘সাদকা’ হইয়া যায়। এই কথা বলার উদ্দেশ্যে হইল, লোকটি খরচ করিতে করিতে মনে করিতে পারে যে, এই কাজ করার যে বুঝ কোন সওয়াবই পাইবে না, ইহা বুঝি তাহার বলদের বোঝা টানার মতই নিস্ফল কাজ। এই মনোভাব দূর করার ও এই ব্যয়ে তাহাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই এই কথাটি বলা হইয়াছে। মুহল্লাব বলিয়াছেন, পরিবার বর্গের ভরণ পোষণে ব্যয় করা ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব বা ফরয। ইহা সর্ব সম্মত কথা। তাবারী বলিয়াছেন, সন্তানরা ছোট ছোট থাকার সময় পর্যন্ত তাহাদের ব্যয়ভার বহন করা পিতার জন্য ফরয। সন্তান বড় হইয়া গেলে তখনও সে যদি উপার্জন-অক্ষম থাকে, তখনও তাহার খরচ বহন করা পিতার কর্তব্য।

 

(******************)

 

উদ্ধৃত হাদীসটির পরবর্তী অংশে ব্যক্তির পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটা চিত্র তুলিয়া ধরা হইয়াছে। দেখান হইয়াছে, একটা পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তির উপর চারিদিক হইত কি রকম চাপ আসে, কত লোকের দাবি পূরণ করা তাহার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হইয়া পড়ে। পরিবার সম্পন্ন ব্যক্তির ঘরে থাকে তাহার স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, চাকর-বাকর- কাজের লোক। সকলেরই খাবার চাহিদা, সকলের মৌল প্রয়োজন পুরণের দায়িত্ব তাহার উপর বর্তায়। তাহাকে অবশ্যই স্ত্রীর দাবি ও প্রয়োজন পূরণ করিতে হয়। ইহাত ব্যত্যয় ঘটিলে স্ত্রী স্বভাবতই বলেঃ হয় আমাকে খাইতে দাও, না হয় আমাকে তালাক দিয়া ছাড়িয়া দাও। তুমি আমাকে বিবাহ করিয়া তোমার ঘর সংসার সামলানোর এবং তোমার সন্তান গর্ভের ধারণ, প্রসব করণ ও লালন-পালনের দায়িত্ব তোমাকে গ্রহণ করিতে হইবে। আর যদি আমার ভরণ-পোষনের দায়িত্ব আমাকেই বহন করিতে হয় তাহা হইলে তোমার ঘর-সংসার সামলানো, গর্ভে সন্তান ধারণ ও লালন-পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব হইবে না। এক দিকে গেলে অন্যদিকে অনুপস্থিতি অনিবার্য। যাহারা এই সব করিয়াও কামাই-রোজগার ও চাকরী-বাকরী করিতে যায়, তাহারা হয় তাহাদের ঘরের দায়িত্ব ফাঁকি দেয়, নতুবা ফাঁকি দেয় চাকরীর দায়িত্ব। এমতাবস্থায় আমাকে তালাক দাও। কোন একদিকে ফাঁকি দেওয়ার চাইতে ইহা উত্তম। কিন্তু স্ত্রীকে তালাক দিলে ব্যক্তির ঘর-সংসার ও পরিবার চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়, ইহাও সে বরদাশত করিতে পারে না। অতএব স্ত্রীর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা তাহার প্রথম কর্তব্য হইয়া পড়ে। চাকর-বাকরদের ব্যাপারেও এই কথা। এই কথা সন্তানদের ক্ষেত্রেও।

 

ইসমাঈলীর বর্ণনায় হাদীসটির এখানকার ভাষা এইঃ

 

****************************************

 

তোমার ক্রীতদাস-চাকর-বাকররা বলেঃ আমাকে খাইতে দাও, নতুবা আমাকে বিক্রয় করিয়া ছাড়িয়া দাও। অন্যত্র কাজ করিয়া জীবন বাঁচানো সুযোগ করিয়া দাও।

 

লোকেদের প্রশ্ন ছিলঃ হে আবূ হুরায়রা, তুমি এই সব কথা রাসূল (স)-এর মুখে বলিতে শুনিয়াছ কিনা? ‘এইকথা’ এই শেষৈর কথাগুলি- যাহাতে পারিবারিক চাপ দেখানো হইয়াছে-বুঝাইয়াছেন।

 

ইহার জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ

 

****************************************

 

না, ইহা আবূ হুরায়ার থলে হইতে বাহির করা কথা।

 

হাদীস ব্যাখ্যাতা কিরমানী বলিয়াছেনঃ *****অর্থ*****  পাত্র, থলিয়া। আর পাত্র বলিতে হযরত আবূ হুরাইয়ার ‘স্মৃতি ভান্ডার, বোঝানো হইয়াছে। অর্থাৎ রাসূলে করীম (স)-এর নিকট হইতে প্রত্যক্ষ শুনিতে পাওয়া যেসব কথা আমার স্মৃতি পাত্রে অক্ষয় হইয়া রহিয়াছে, এই কথাগুলি সেখান হইতেই বাহির করিয়া আনা হইয়াছে। এই অর্থে এই গোটা হাদীসটিই- হাদীসটির শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কথাই রাসূলে করীম (স)-এর কথা বলিয়া মনে করিতে হইবে। এই প্রেক্ষিতে হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর উপরোক্ত জওয়াবের তাৎপর্য হইলঃ

 

****************************************

 

যাহা বলিলাম তাহা রাসূলে করীম (স)-এর নিকট শুনা কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

তিন জওয়াবে ***- ‘না’ বলিয়াছেন, তাহা নেতিবাচক হইলেও উহার তাৎপর্য ইতিবাচক। নেতিবাচক কথার দ্বারা ইতিবাচক অর্থ বুঝাইতে চাওয়া হইয়াছে। আরবী ভাষায় ইহার যথেষ্ট প্রচলন রহিয়াছে।

 

ইহার আরও একটি অর্থ হইতে পারে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) তাঁহার উক্ত জওয়াব দ্বারা বুঝাইয়াছেন যে, হাদীসের শেষাংশের কথাগুলি রাসূলে করীম (স)-এর নয়। ইহা হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কতৃক, মুল হাদীসের সহিত নিজ হইত শামিল করিয়া দেওয়া ***** কথা। এই দৃষ্টিতে এই জওয়াবটি ইতিবাচক, নেতিবাচক নয়। অর্থাৎ হাদীসের শেষ অংশটি হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এর নিজের সংরক্ষিত পাত্র হইতে উৎসারিত তাঁহার নিজের কথা। কোন কোন বর্ণনায় ***** শব্দ উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহার অর্থঃ ********** ‘ইহা আবূ হুরায়রা’র বিবেক-বুদ্ধি নিঃসৃত কথা। ইমাম বুখারী নিজেও এই দিকে ইংগিত করিয়াছেন। তাহা হইলে হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষা অনুযায় ইহাকে বলা হইবে ***** রাসূল (স)-এর কথার সহিত মুল বর্ণনাকারীর শামিল করিয়া দেওয়া নিজের কথা। ইহাতেও হাদীসের মর্যাদা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় না। কেননা সাহাবী যাহা নিজে বলেন, তাহা আসলে তাঁহার নিজের কথা নয়। তাহা কোন-না-কোন সময় রাসূলে করীম (স) এর নিকট শোনা। অথবা বলা যায়, হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এই কথাটি বলিয়া রাসূলে করীম (স)-এর মূল কথাটিরই ব্যাখ্যা দিয়াছেন, নীতি কথার একটা বাস্তব চিত্র তুলিয়া ধরিয়াছেন। কিন্তু মুসনাদে আহমাদ ও দারেকুতনী হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত এই হাদীসটি যে ভাষায় উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহাতে এই ধরনের কোন কথাই নাই। তাহাতে ইহার সমস্ত কথাই নবী করীম (স)-এর বানী রূপে উদ্ধৃত। হাদীসটির এই অংশের ভাষা তাহাতে এইভাবে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

কেহ বলিলেন, হে রাসূল! আমি কাহার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বহন করিব? তিনি বলিলেন, তোমার স্ত্রী-ই এমন যাহার ভরণ পোষণ তুমি করিবে। কেননা সে-ই বলে যে, আমাকে খাইতে দাও, অন্যথায় আমাকে বিচ্ছিন্ন কর। তোমার ভরণ-পোষণের লোক তোমার চাকর-চাকরাণী। কেননা সে বলেঃ আমাকে খাইতে দাও ও আমাকে কাজে লাগাও। তৃতীয়, তোমার ভরণ পোষণ পাইবার অধিকারী তোমার সন্তন। কেননা সে-ই বলেঃ আমাকে তুমি কাহার নিকট ছাড়িয়া দিতেছ?

 

এই হাদীসের সমস্ত কথা তাহাই যাহা বুখারী উদ্ধৃত হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, কিন্তু ইহার কোন অংশই হযতর আবূ হুরায়রা (রা)-এর নিজের নয়। সবই রাসূলে করীম (স)-এর কথা। শুধু তাহাই নয়, ইহা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলারও নির্দেশ। ফিকাহবিদগণ কুরআনের আয়াত ও হাদীস সমূহের ভিত্তিতে বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

এই দলীল সমূহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলিতেছে যে, স্ত্রীর খরচ বহন স্বামীর কর্তব্য এবং সন্তানের খরচ বহন তাহাদের উপর অর্পিত।

 

আমাদের আলোচ্য মূল হাদীসটিতে কয়েকটি আইনের কথা বলা হইয়াছেঃ প্রথম, ব্যক্তির নিজের প্রয়োজন সর্বোগ্রে পূরণ করা দরকার। অন্যদের হক ইহার পর। দ্বিতীয়, স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের ভরণ পোষণ ও যাবতীয় মৌল প্রয়োজন পূরণ ব্যক্তির দ্বিতীয় কর্তব্য- ফরয। ইহাত কোন দ্বিমত নাই।

 

তৃতীয়, খাদেম- চাকর-কামলাদের ব্যয়ভার বহন করাও তাহারই দায়িত্ব। ঘরের কাজ-কামের জন্য খাদেম নিয়োজিত করা যাইতে পারে। করা হইলে তাহার প্রয়োজনও পূরণ করিতে হইবে।

 

চতুর্থ, স্ত্রীর কথাঃ ‘হয় আমাকে খাইতে দাও, না হয় আমাকে তালাক দাও’- হইতে কোন কোন ফিকাহবিদ এই মত রচনা করিয়াছেন যে, স্বামী যদি বাস্তবিকই স্ত্রীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব পালনে অর্থনৈতিক দিকদিয়া অক্ষম হইয়া পড়ে এবং সেই অবস্থায় স্ত্রী তালাক নিতে চায় ও দাবি করে, তাহা হইলে সে তালাক পাইবার অধিকারী।

 

অনেকের মতে ইহাই জমহুর আলিম ও ফিকাহবিদদের মত। আর কুফা’র ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

এইরূপ অবস্থা দেখা দিলে স্ত্রীর কর্তব্য ধৈর্যধারণ এবং স্বামী-সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য লোকদের সহিত মিলিত থাকিয়া কষ্ট স্বীকার করা। অবশ্য ব্যয়ভার বহন ও প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব তো স্বামীরই থাকিবে।

 

অর্থাৎ এখন তাহা দিতে না পারিলে পারে সচ্ছল অবস্থা ফিরিয়া আসিলে তখন দিতে হইবে।

 

জমহুর আলিম ও ফিকাহবিদদের যাহা মত তাহার দলীল হিসাবে তাঁহারা কুরআন মজীদের এই আয়াতটির উল্লেখ করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

স্ত্রীগণকে আটকাইয়া রাখিও না তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া ও তাহাদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, এই রূপ করিয়া তোমরা সীমালংঘন করিবে, এই উদ্দেশ্যে।

 

কেননা খাইতেও দিবে না আর সে অন্যত্র যাইয়া নিজের খোরাক-পোশাকের ব্যবস্থা করিবে, তাহার সুযোগও দিবে না তাহাকে তালাক দিয়া, ইহা তো নিতান্তই সীমালংঘনমূলক কাজ।

 

বিপরীত মতের আলিমগণ ইহার জওয়াবে বলিয়াছেন, এইরূপ  অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো যদি ওয়াজিবই হইত, তাহা হইলে স্ত্রীর ইচ্ছানুক্রমেও বিবাহ অক্ষুণ্ন রাখা জায়েয হইত না। অথচ স্ত্রী কষ্ট করিতে রাযী হইলে বিচ্ছেদ করাই বরং জায়েয নয়। আর এই অবস্থায়ও স্ত্রী স্বামীর সহিত থাকিতে রাযী হইলে বিবাহ অক্ষুণ্নই থাকিবে- এ ব্যাপারে পুরাপুরি ইজমা হইয়াছে। তাহা হইলে আয়াতের সাধারণ নিষেধ সত্ত্বেও স্ত্রীর রাযী থাকার কারণে বিবাহ অক্ষুণ্ন রাখা এই আয়াতের পরিপন্হী নয়। ইহা ছাড়াও নিতান্ত মানবিকতার ও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কের দিক দিয়াও স্বামীর এই অক্ষমতার দরুন তালাক হইয়া যাওয়া কোন ক্রমেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না। ইহা তো ক্রীতদাস ও জন্তু-জানোয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নীতি। তাহা হইল, ক্রীতদাস ও গৃহপালিত জন্তু-জানোয়ারের খাবার দিতে মালিক অক্ষম হইলে তাহাকে উহা বিক্রয় করিয়া দিতে  শরীয়াতের দৃষ্টিতেই বাধ্য করা হইবে। উপরন্তু এইরূপ বিধান হইলে পরিবার রক্ষা করাই কঠিন হইয়া পড়িবে।

 

কূফী ফিকাহবিদদের এই মত সমর্থন করিয়াছেন আতা ইবনে আবূ রাফে, ইবনে শিহাব জুহরী, ইবনে শাবরামাত, আবূ সুলাইমান ও উমর ইবনে আবদুল আজীজ প্রমুখ প্রখ্যাত শরীয়াবিদগণ। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)ও এই মত দিয়াছেন বলিয়া বর্ননা করা হইয়াছে। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) সেনাধৈক্ষদের নাম এই নির্দেশ লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, তোমরা অমুক অমুক লোককে বাহিনী হইতে মুক্ত করিয়া দাও। ইহারা এমন লোক যে, তাহারা মদীনার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে এবং এখাত হইতে চলিয়া গিয়াছে। এখন হয় তাহারা তাহাদের স্ত্রী-পুত্রদের নিকট ফিরিয়া আসুক, না হয় তাহাদের খরচ পত্র পাঠাইয়া দিক। আর তাহাও না হইলে তাহারা তাহাদের স্ত্রীদিগকে তালাক দিয়া দিক ও অতীত দিনগুলির পাওনা খরচপত্র পাঠাইয়া দিক।

 

(শাফেয়ী, আবদুর রাজ্জাক, ইবনুল মুনযির)

 

হযরত উমর (রা) এই নির্দেশ নামায় মাত্র তিনটি উপায়েল কথা বলিয়াছেন। ইচা ছাড়া চতুর্থ কোন উপায়ের নির্দেশ করেন নাই। প্রথম দুইটি উপায় সম্পর্কে তো কাহারও কিছু বলিবার নাই। এই দুইটি কাজের একটিও করা না হইলে তালাক দিতে বলিয়াছেন। স্ত্রীদের ‘ছবর’ অবলম্বন করিয়া থাকিতে বলেন নাই। আর তাহাদের যদি ‘ছবর’ করিয়া থাকিতে হইবে, তাহা হইলে এইরূপ ফরমান পাঠাইবার কোন প্রয়োজনই ছিল না। ইহা খাবার-দিতে অক্ষম স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অভিমত প্রমাণকারী বলিষ্ঠ ও অকাট্য দলীল।

 

এই মতের বিপরীত পন্হীরা বলিয়াছেন, দলীল হিসাবে কুরআনের যে আয়াতটির উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা, এই আয়াতটি বারবার তালাক দিয়াও বারবার পুনরায় গ্রহণ করিয়া স্ত্রীকে অন্য স্বামী গ্রহণ হইতে বিরত রাখা ও তাহাকে কঠিন কষ্টে নিক্ষেপ করার জাহিলিয়াতকালীন সমাজের রেওয়াজের প্রতিবাদে নাযিল হইয়াছিল। ইহাকে ‘খাবার দিতে অক্ষম’ স্বামীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্পূর্ণ অবান্তর। এই কারণে এ প্রসঙ্গে তাঁহাদের এই দলীল গ্রহণ যোগ্য নয়। দ্বিতীয়, ক্রীতদাস ও জন্তু-জানোয়ার সংক্রান্ত শরীয়াতী আইনের দোহাই দেওয়াও এক্ষেত্রে অচল। কেননা জন্তু জানোয়ার ও ক্রীতদাস এবং স্ত্রী কখনও এক পর্যায়ে পড়ে না। ক্রীতদাস ও জন্তু জানোয়ারগুলির নিজস্ব কিছু নাই। উদর ভর্তি খাবার খাওয়াই ইহাদের একমাত্র কাজ। ইহারা না খাইয়া থাকিতেই পারে না, মালিকের জন্য ইহাদের এমন প্রেম ভালবাসা হওয়ারও প্রশ্ন নাই, যাহার তাকীদে তাহারা না খাইয়া ও কষ্ট স্বীকার করিয়াও মালিক বা মনিবের নিকট থাকিয়া যাইবে। কিন্তু স্ত্রীর কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সে ধৈর্য ধারণ করিতে পারে, খাবার দতি অক্ষম স্বামীর জন্য সে কষ্ট স্বীকার করিতে রাযী হইতে পারে। স্বামীর কথা বলিয়া সে কাহারও নিকট ধার আনিতে বা ঋণ করিতে পারে। এতদ্ব্যতীত এইরূপ অবস্থায় যদি সরকারী ক্ষমতায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে স্ত্রীর দাবি করিবার কিছুই থাকে না। অথচ বিবাহ অক্ষুণ্ন থাকিলে স্ত্রীর অধিকারও অক্ষুণ্ন থাকে, যাদিও তাহা স্বামীর সচ্ছলতা ফিরিয়অ আসার পরই আদায় করা সম্ভব হইবে। আর সম্পূর্ণ বাতিল হইয়া যাওয়অর পরিবর্তে বিলম্বে পাওয়ার আশা যে অনেক উত্তম, তাহাতে আর সন্দেহ কি?

 

(**********)

 

হযরত (রা) সম্পর্কে বলা যাইতে পারে যে, যে সব লোক সম্পর্কে উক্ত ফরমান দেওয়া হইয়াছিল তাহারা স্ত্রীর খাওয়া-পরা জোগাইতে অক্ষম হইয়া পড়িয়াছে, সে কথা উহা হইতে বুঝা যায় না। সম্ভবত ইহা ছিল তাহাদের পারিবারিক দায়িত্ব পালনে উপেক্ষা ও গাফিলতী। আর সে উপেক্ষা ও গাফিলতীর আচরণ ছিন্ন করাই ছিল হযরত উমর (রা)-এরই তাকিদী ফরমানের মূল লক্ষ্য। তাই এইরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীতে বিচ্ছেদই ঘটাইতে হইবে এমন কথা জোর করিয়া বলা যাইতে পারে না।

 

কিন্তু এই সমস্ত কথা কেবলমাত্র তখন পর্যন্ত যতক্ষণ স্ত্রী-স্বামীর আর্থিক ধৈন্যের দরুন তালাক না চাহিবে। সে যদি তালাক চাহে, তাহা হইলে কুরআনের উপরোক্ত আয়াত, রাসূলে করীম (স)-এর বানী এবং হযরত উমরের ফরমানের ভিত্তিতেই তালাকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে। সেক্ষেত্রে কুরআনের উপরোদ্ধৃত আয়াত সম্পর্কে এই দৃষ্টিতে বিবেচনা করিতে হইবে যে, ইহা বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে নাজিল হইলেও ইহার অর্থ ও প্রয়োগ অতীব সাধারণ ও ব্যাপক এবং সর্বাত্মক। ইসলামী আইন দর্শনে পারদর্শীগণ এই পর্যায়ে যে মূলনীতি রচনা করিয়াছেন তাহা হইলঃ  * ****************** কুরআনের আয়াতের ভিত্তিতে আইন রচনা কালে উহার শব্দ সমূহের সাধারণ অর্থই গ্রণ করিতে হইবে। যে বিশেষ প্রেক্ষিতে উহা নাযিল হইয়াছে, তাহার মধ্যেই উহাকে বাঁধিয়া রাখা যাইবে না। কাজেই যেখানেই স্ত্রীর কষ্ট হইবে ও কষ্ট হইতে মুক্তি লাভের জন্য স্ত্রীই তালাক চাহিবে, সেখানেই এই আয়াতের প্রয়োগ যথার্থ হইবে। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর প্রত্যক্ষ ফয়ছালাও বিভিন্ন হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি হাদীস এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

 

****************************************

 

যে ব্যক্তি তাহার স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করিতে অক্ষম, তাহার সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন, এই দুইজনের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাইত হইবে।

 

এই হাদীসের ভিত্তিতে জমহুর শরীয়াত পারদর্শীগণ বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

স্বামী যদি দারিদ্র বশত স্ত্রীর খরচ বহন করিতে অক্ষম হয় এবং এই অবস্থায় স্ত্রী তাহার স্বামী হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে ইচ্ছুক হয়, তহাহা হইলে অবশ্যই দুইজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দেওয়া হইবে।

 

(************)

 

স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা

 

ইসলামের একের অধিক চারজন পর্যন্ত স্ত্রী এক সঙ্গে রাখার অনুমতি রহিয়াছে। এই পর্যায়ে সর্ব প্রথম দালীল হইল কুরআন মজীদের আয়াত ********* কিন্তু এই আয়াতাংশের পর পরই ও সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা বলিয়া দিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

কিন্তু তোমরা যদি ভয় পাও এই জন্য যে, তোমরা সুবিচার করিবে পারিবে না তাহা হইলে এক জন-ই। …. ইহাই অবিচার ও না-ইনসাফী হইতে রক্ষা পাওয়ার অধিক নিকটবর্তী পন্হা।

 

এই আয়াতটির তিন ধরনের তাফসীর খুবই পরিচিত। প্রথম তাফসীরটি হযরত আয়েশা (রা) হইত বর্ণিত এবং বুখারী, মুসলিম, সুনানে নাসায়ী ও বায়হাকী ইত্যাদি গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত উরওয়া ইবনুজ্জুবাইর (রা) তাঁহার খালাম্মা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা) এর নিকট এই আয়াতটির তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি তাহা বলিয়াছেন। হযরত আয়েশা (রা)-এর এই তাফসীল হইতে প্রমাণিত হয় যে, আয়াতটি মুলত ইয়াতীম কন্যাদের অধিকার সংরক্ষণ পর্যায়ে নাযিল হইয়াছে। কিন্তু প্রসঙ্গত এক সঙ্গে স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে চার সংখ্যা পর্যন্ত সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

 

উক্ত আয়াতাংশের দ্বিতীয় তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস (রা) ও তাঁহার ছাত্র ইকরামা হইতে বর্ণিত। আর তৃতীয় তাফসীরটি বর্ণিত হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর, কাতাদাহ ও অন্যান্য মুফাসসিরীন হইতে।

 

এই তিনওটি তাফসীরে পার্থক্য এই যে, প্রথম দুইটি তাফসীরে আয়াতটি মূলত ইয়াতীম ছেলে-মেয়েদের উপর জুলুম করা হইতে নিষেধ করার উদ্দেশ্যে নাজিল হইয়াছে। আর তৃতীয় তাফসীরের দৃষ্টিতে আয়াতটি প্রকৃত ও মূলত স্ত্রীলোকদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে নাযিল হইয়াছে।

 

উপরোক্ত আয়াতাংশে একাধিক স্ত্রী একসঙ্গে গ্রহণ করার ব্যাপারে যেমন চারজনের সীমা নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, তেমনি স্ত্রীদের মধ্যে ‘সুবিচার’ করার শর্ত আরোপ করা হইয়াছে। এক্ষণে প্রশ্ন উঠিয়াছে যে, এই সুবিচার কিসে- কোন ব্যাপারে শর্ত করা হইয়াছে? স্ত্রীদের নিকট অবস্থান করা, তাহাদের খোরপোশ ও অন্যান্য যাবতীয় ব্যয় বহনে সাম্য ও মমতা রক্ষা করা জরুরী, না দিলের ঝোঁক ও প্রেম-ভালবাসায় সাম্য রক্ষা করা আবশ্যক? আমাদের মতে এই সূরা নিসাব ১২৯ আয়াতেই ইহার জওয়াব পাওয়া যায়। আয়াতটি এইঃ

 

****************************************

 

স্ত্রীদের মধ্যে পুরা মাত্রায় সুবিচার রক্ষা করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তোমরা যদি তাহা চাহও, তবুও তাহা করিতে তোমরা সক্ষম হইবে না। অতএব (একাধিক স্ত্রী থাকিলে) তোমরা একজন স্ত্রীর প্রতি এমন ভাবে ঝুঁকিয়া পড়িবে না, যাহাতে অন্যান্য স্ত্রীদের ঝুয়িরা থাকা অবস্থায় রাখিয়া দিবে। তোমরা যদি নিজেদের কর্মনীতি সুষ্ঠু ও সঠিক রাখ এবং আল্লাহকে ভয় করিয়া চলিতে থাক, তাহা হইলে আল্লাহই গুনাহ সমূহ মাফ দানকারী ও অতিশয় দয়াবান।

 

আয়াতটি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছে যে, একাধিক স্ত্রীর স্বামীর সুবিচার করার দায়িত্ব শুধু ততটা যতটা তাহাদের সাধ্যে রহিয়াছে। যাহা তাহাদের সাধ্যের বাহিরে, তাহা করা তাহাদের দায়িত্ব নয়। হযরত আয়েশা (রা)-এর একটি বর্ণনা হইতে আয়াতটির সহীহ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাহা এইঃ

 

****************************************

 

হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। নবী করীম (স) তাঁহার স্ত্রীগণের মধ্যে (অধিকার সমূহ) বন্টন করিতেন, তাহাতে তিনি পূর্ণমাত্রায় সুবিচার করিতেন। আর সেই সঙ্গে এই বলিয়া দোয়া করিতেন, হে আল্লাহ! আমার বন্টন তো এই, সেই সব জিনিসে, যাহার মালিক আমি। কাজেই তুমি আমাকে তিরষ্কৃত করিও না সে জিনিসে যাহার মালিক তুমি, আজি নহি।

 

রাসূলে করীম (স)-এর এই দোয়ার শেষাংশে ‘আমি যাহার মালিক নহি তাহাতে আমাকে তিরষ্কৃত করিও না’ বলিয়া যে দিকে ইংগিত করিয়াছেন, তাহা হইলে দিলের ভালবাসা, মনের টান ঝোঁক ও প্রবণতা। বস্তুত এই ব্যাপারে মানুষের নিজের ইখতিয়ার খুব কমই থাকে। অতএব একাধিক স্ত্রীর স্বামীর যে সুবিচার করার দায়িত্ব তাহার স্ত্রীদের মধ্যে, তাহা এই বিষয়ে নিশ্চয়ই নয়। তাহা যৌন সঙ্গম ও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বন্টনের ব্যাপারে হইতে হইবে।

 

একটি আয়াতে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি এবং সেই সঙ্গে তাহাদের মধ্যে সুবিচার করার শর্ত আরোপ- আবার অপর আয়াতে ‘তোমরা চাহিলেও সেই সুবিচার তোমরা করিতে পরিবে না’ বলিয়া ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে। ইহাতে কি প্রমাণিত হয় না যে, আল্লাহ তা’আলা একবার অনুমতি দিলের এবং অপর আয়াতে সেই অনুমতিই ফিরাইয়া লইয়াছেন?.... আর তাহা হইলে তো চারজন পর্যন্ত স্ত্রী এক সঙ্গে গ্রহণের কোন অবকাশই থাকে না?

 

কোন কোন অর্বাচিন ও কুরআনের বক্তব্য বুঝিতে অক্ষম ব্যক্তিদের পক্ষ হইতে এই ধরনের প্রশ্ন উঠিয়াছে এবং তাহারা সিদ্ধান্ত দিতে চাহিয়াছে যে, আসলে কুরআন একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতিই দেয় নাই।

 

কিন্তু ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত পুরাপুরি ভিত্তিহীন। কেননা আসলেই আয়াতদ্বয়ের বক্তব্য তাহা নয় যাহা কেহ বলিতে চেষ্টা পাইয়াছে। বস্তুত প্রথম আয়াতে এক সঙ্গে চারজন স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেওয়ার ফলে যে বাস্তব সমস্যার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব বলিয়া মনে করা হইয়াছে, দ্বিতীয় আয়াতটিতে উহারই সমাধান বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রথম অনুমতি সংক্রান্ত আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম (রা)-এর মধ্যে যাহারা একাধিক স্ত্রীর স্বামী ছিলেন তাঁহারা স্ত্রীগণের মধ্যে পূর্ণমাত্রার এবং পূর্ব হইতেও অনেক বেশী করিয়া সুবিচার করিতে শুরু করেন। এই চেষ্টায় তো তাঁহারা সাফল্য লাভ্য করেন। কিন্তু অন্তরের প্রেম-ভালবাসা ও ঝোঁক প্রবণতার ক্ষেত্রে তাঁহাদের ব্যর্থতা ছিল মানবীয় দুবর্লতার ফল এবং অবধারিত। সতর্ক চেষ্টা সত্বেও তাহারা সবকয়জন স্ত্রীদের প্রতি সমান মাত্রায় ভালবাসা দিতে পারিলেন না। এই অবস্থায় তাহাদের মানবিক উদ্বেগ ও অস্থিরতা তীব্র হইয়া দেখা দেয়। তখন তাঁহাদের মনে জিজ্ঞাসা জাগিল, তাঁহারা আল্লাহর নাফরমানী করিতেছেন না তো? প্রেম-ভালবাসায় ‘সুবিচার’ করিতে না পারার দরুন তাঁহারা কঠিন শাস্তি ভোগ করিতে বাধ্য হইবেন না তো? সাহাবীদের মনের এই তীব্র ও দুঃসহ উদ্বেগ বিদূরিত করার উদ্দেশ্যেই এই দ্বিতীয় আয়াতটি নাযিল হয় এবং রাসূলে করীম (স) নিজের আমল দ্বারাই উহার বাস্তব ব্যাখ্যা পেশ করিলেন।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]