হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যাহার দুইজন স্ত্রী রহিয়াছে, সে যদি তাহাদের একজনের প্রতি অন্যজনের তুলনায় অধিক ঝুঁকিয়া পড়ে, তাহা হইলে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আসিবে যে, তাহার দেহের একটি পাশ নীচের দিকে ঝুঁকিয়া পড়া থাকিবে।
(তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাক-হাকেম)
ব্যাখ্যাঃ ইসলামে এক সঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। ইহার জন্য মোটামুটি দুইটি শর্ত। প্রথম শর্ত- যাহা ইসলামের সাধারণ ব্যবস্থা নিহিত ভাবধারা হইতে বুঝা যায়- এই যে, ইহা কেবলমাত্র অনিবার্য কারণেই করা যাইবে। কেহ যদি মনে করে যে, তাহার বর্তমান একজন স্ত্রীর দ্বারা চলিতেছে না, আরও একজন দরকার, নতুবা তাহার চরিত্র কলূষিত হওয়ার ও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশংকা রহিয়াছে। যেহেতু ইসলামে ব্যভিচার অতিবড় অপরাধ, ইসলাম কোন অবস্থাতেই ব্যভিচারকে বরদাশত করিতে প্রস্তুত নয়। তাই কেবলমাত্র এইরূপ অবস্থায়ই একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করিতে পারে।
ইহার দ্বিতীয় শর্ত এই যে, বিবাহের পূর্বে তুমি তোমার নিজেকে যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিবে যে, তুমি একাধিক স্ত্রীর মধ্যে **** সুষ্ঠু ও নিরংকুশ নিরপেক্ষতা ও সুবিচার করিতে পারিবে কিনা। তাহা পারিবে এই বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিলেই কেবলমাত্র তখনই একজন স্ত্রীর বর্তমান থাকা অবস্থায় আরও একজন-চারজন পর্যন্ত গ্রহণ করিতে পারিবে। কিন্তু এই একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সর্বাধিকক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হইল, তাহাদের মধ্যে আজীবন পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতা ও আচার আচরণের ভারসাম্য রক্ষা করা। এই পর্যায়ে কুরআন মজীদেদ যাহা কিচু বলা হইয়ায়ে, তাহাই এই সব কথার ভিত্তি।
প্রথমেই এই আয়াতটি আমাদের সামনে আসেঃ
****************************************
তোমরা যদি আশংকা বোধ কর যে, তোমরা ইয়াতীমদের প্রতি সুবিচার ও পক্ষপাতহীনতা রক্ষা করিতে পরিবে, তাহা হইলে তোমরা বিবাহ কর যাহা তোমাদের মন চাহে- দুইজন, তিনজন ও চারজন। আর যদি সুবিচার ও পক্ষপাতহীনতা বজায় রাখিতে না পারার আশংকাবোধ কর, তাহা হইলে, একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করিবে।
ঘরে লালিতা পালিতা পিতৃহীন মেয়েদের প্রতি সুবিচার করিতে না পারার আশংকায় তাহাদের পরিবর্তে অন্যত্র দুই-দুইজন, তিন-তিনজন, চার-চারজন, করিয়া বিবাহ করার অনুমতি এই আয়াতটিতে দেওয়া হইয়াছে। এই কথাটি হাদীস হইতেও অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
গাইলান ইবনে উমাইয়াতা আস-সাকাফী যখন ইসলাম কবুল করেন, তখন তাহার দশজন স্ত্রী বর্তমান ছিল। কেননা জাহিলিয়াতের জামানায় বহু কয়জন স্ত্রী একসঙ্গে রাখার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
নবী করীম (স) তাহাকে বলিলেনঃ
****************************************
তুমি তাহাদের মধ্য হইতে মাত্র চরজন স্ত্রী বাছিয়া লও। আর অবশিষ্ট সব কয়জনকে ত্যাগ করিতে হইবে। (মুয়াত্তা মালিক, নাসায়ী, দারে কুতনী)
হারেস ইবনে কাইস বলিয়াছেনঃ ***************** আমি যখন ইসলাম কবুল করিলাম, তখন আমার ৮ জন স্ত্রী ছল। আমি এই কথা রাসূলে করীম (স) কে বলিলে তিনি নির্দেশ দিলেনঃ ********** তুমি ইহাদের মধ্য হইতে মাত্র চারজন বাছিয়া লইয়া রাখ।
এক সঙ্গে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখার অনুমতির উপর ইজমা হইয়াছে। সমস্ত সাহাবী, তাবেয়ী ও আজ পর্যন্তকার ইসলামী শরীয়াত অভিজ্ঞ সমস্ত আলিম- সমস্ত মুসলমান এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। ইহার বিপরীত অন্য কোন মত মুসলিম সমাজ কর্তক আজ পর্যন্ত গৃহীত হয় নাই। হ্যাঁ এই ইজমা চূড়ান্ত ও স্থায়ী এবং একজন স্ত্রী থাকা অবস্থায় শরীয়াত সীমার মধ্যে থাকিয়া আরও এক-দুই বা তিনজন বিবাহ করিতে হইবে, সে প্রথম একজন স্ত্রীর নিকট হইতে অনুমতি গ্রহণের কোন শর্ত নাই।
একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের দ্বিতীয় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হইল তাহাদের মধ্যে ***** করা। অর্থাৎ মনের ঝোঁক-প্রবণতা, প্রেম-ভালবাসা, সঙ্গম, একত্র থাকা, একত্রে থাকার রাত্রি বিভক্ত ও নির্দিষ্ট করণ- এই সব দিক দিয়া স্ত্রীদের মধ্যে ***** সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও সুবিচার রক্ষা করিতে হইবে। আর তাহা করিতে পারিবে না মনে করিলে একজন মাত্র স্ত্রী রাখিবে, একজনের বেশী গ্রহণ করিবে না। গ্রহণ করিয়া থাকিলে তাহাদের মধ্যে ইনসাফ বলবত রাখিবে। আর রাখিতে অপারগ হইয়ে একজন বাছিয়া লইয়া অবশিষ্টদের ত্যাগ করাই উচিত। এই আয়াত হইতে প্রমতানিত হইতে যে, ***** করা ওয়াজিব। এই সুবিচার যাহারা রক্ষা করিবে না, তাহাদের পরকালীন চরম দুর্গতির করুণ চিত্র উপরোদ্ধৃত হাদীসে অংকিত হইয়াছে।
তিরমিযী ও হাকেম-এর বর্ণনায় এই হাদীসটির এখানকার ভাষা হইলঃ ****** ‘তাহার এক পার্শ্ব ঝুঁকিয়া পড়া’ মনে হইবে তাহার দেহের অর্ধেক ভাঙিয়া পড়িয়াছে, পংগু হইয়াছে। সে যে জীবনে একজন স্ত্রীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করিয়াছে, তাহার দেহের এই অবস্থা সেই কথাটিই সকলের নিকট প্রকট করিয়া তুলিবে। প্রমাণ করিবে, সে বর্তমানে যেমন অসুস্থ, ভারসাম্যহীন, দুনিয়ায় তাহার পারিবারিক জীবনও এমনিই অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন ছিল।
বর্ণনাটির এই অংশের আর একটি ভাষা হইলঃ
****************************************
তাহার দুইটি অংশের একটিকে নিম্নে পতিত কিংবা ঝুঁকিয়া থাকা অবস্থায় টানা হেঁচড়া করিয়া চলিতেছে।
ইমাম শওকানী এই হাদীসটির আলোচনায় লিখিয়াছেনঃ
এই হাদীস একথার দলীল যে, দুইজন স্ত্রীর মধ্যে একজনকে বাদ দিয়া অপরজনের দিকে স্বামীর ঝুঁকিয়া পড়া সম্পূর্ণ হারাম। অবশ্য ইহা সেই সব ব্যাপারে যাহাতে স্বামীর ক্ষমতা রহিয়াছে- যেমন দিন ও সময় বন্টন এবং খাওয়া-পরা ও সাধারণ আচার-আচরণ ইত্যাদি। কিন্তু যে সব ব্যাপারে স্বামীর কোন হাত নাই- যেমন প্রেম-ভালবাসা, অন্তরের টান ইত্যাদি- তাহাতে স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা স্বামীর জন্য ওয়াজিব নয়। মূলত তা ***** এর আওতার মধ্যেও পড়ে না।
অধিকাংশ ইমাম বলিয়াছেনঃ স্ত্রীগণের মধ্যে দিন সময় বন্টন ওয়াজিব।
এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা) এর একটি কথা উল্লেখ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************
রাসূলে করীম (স) দিন বন্টন করিয়া স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করিতেন এবং বলিতেন, হে আল্লাহ! ইহা আমার বন্টন যাহা করার ক্ষমতা আমার আছে তাহাতে। অতএব তুমি যাহাতে ক্ষমতা রাখ, আমি রাখি না, তাহাতে আমাকে তিরষ্কার করিও না।