হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, উতবার কন্যা হিন্দ আসিল ও বলিলঃ ইয়া রাসূল! আবূ সুফিয়ান অত্যন্ত কৃপণ ব্যক্তি। এমতাবস্থায় আমি তাহার সম্পদ হইতে আমার সন্তানদিগকে যদি খাওয়াই-পরাই, তাহা হইলে কি আমার কোন দোষ হইবে? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ না, তবে প্রচলিত নিয়মে ও নির্দোষ পন্হায়।
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির মূল ব্ক্তব্য হইল সন্তানদের খোরাক পোশাক জোগাইবার দায়িত্ব পালন। পিতা এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করিলে স্ত্রীকেই অগ্রসর হইয়া দায়িত্ব পালন করিতে হইবে। হাদীসটির প্রতিপাদ্য ইহাই। এই হাদীসটি মাত্র দুইজন সাহাবী হইতে বর্ণিত হইয়াছে। একজন হইলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা), আর দ্বিতীয় জন হইলেন হযরত ওরওয়া ইবনু-জ্জুবাইর। হিন্দু বিনতে উতবা হযরত আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী এবং হযরত আমীর মুয়াবিয়ার জননী। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন। আবূ সুফিয়ান তাঁহার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ফলে এই দুই জনের বিবাহ নবী করীম (স) অক্ষণ্ন ও বহাল রাখিয়াছিলেন। হিন্দু হযরত নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট তাঁহার স্বামী আবূ সুফিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করিলেন ও সমস্যার সমাধানে পথের নির্দেশ চাহিলেন। অভিযোগে বলিলেনঃ ************** আবূ সুফিয়ান একজন অতিশয় কৃপণ ব্যক্তি। ‘কৃপণ ব্যক্তি’ বলিতে বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, তিনি এই কার্পণ্যের দরুন নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবারবর্গের খোরাক-পোশাকও ঠিক মত দিতেছেন না। ফলে পরিবার বর্গের লোকেরা- তাঁহার স্ত্রী-পুত্র-পরিজন- খুবই অভাব, দারিদ্র ও অসুবিধার মধ্য দিয়া দিনাতিপাত করিতে বাধ্য হইতেছে। এমতাবস্থায় শরীয়াতের আইনের দৃষ্টিতে স্ত্রী কি করিতে পারে? সে কি কি ভাবে তাহার ছেলে মেয়ে লইয়া জীবনে বাঁচিয়া থাকিবে- তাহাই জিজ্ঞাসা।
মুসলিম শরীফে এই হাদীসটির ভাষা এইরূপঃ
****************************************
আবূ সুফিয়ান অত্যন্ত কৃপন ব্যক্তি। তিনি আমার ও আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে খরচ পত্র দেন না। তবে আমি তাঁহার অজ্ঞাতে যাহা গ্রহণ করি তাহা দিয়াই প্রয়োজন পূরণ করিয়া থাকি। ইহাতে কি আমার কোন গুণাহ হইবে? রাসূলে করীম (স) বলিলেন, তুমি সম্পদ তাহার অর্থ-সম্পদ হইতে তোমার ও তোমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট হইতে পারে এমন পরিমাণ সম্পদ প্রচলিত নিয়মে গ্রহণ কর।
অপর একটি বর্ণনায় হিন্দের কথার ভাষা এই রূপঃ
****************************************
তবে আমি যাহা গোপনে- তিনি জানেন না এমনভাবেগ্রহণ করি। (শুধু তাহা দিয়াই আমাকে যাবতীয় খচর চালাইতে হয়)
অর্থাৎ তিনি নিজে যাহা দেন তাহা যথেষ্ট হয় না। পরে তাহাকে না জানাইয়া গোপনে আমাকে অনেক কিছু লইতে হয়।
ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স)-এর কথা এই ভাষায় বর্ণিত হইয়াছেঃ
তুমি যদি প্রচলিত নিয়মে সন্তানদিগকে খাওয়াও, পরাও, তবে তাহাতে তোমার কোন দোষ হইবে না।
অন্যান্য সিহাহ গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহাতে ইহার ভাষা ভিন্ন ধরনের। একটি বর্ণনার ভাষা এইরূপঃ
****************************************
আবূ সুফিয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি। তিনি আমাকে এমন পরিমাণ খোরাক-পোশাক দেন না যাহা আমার ও আমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট হইতে পারে। তবে আমি যদি তাহাকে না জানাইয়া গ্রহণ করি, তবেই আমার ও আমার সন্তানদের খরচ বহন হইতে পারে।
ইহার জওয়াবে নবী করীম (স)-এর কথাটি এ ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
তুমি প্রচলিত মান অনুযায়ী তোমার ও তোমার সন্তানের জন্য যে পরিমাণ যথেষ্ট হইতে পারে তাহা গ্রহণ কর।
বুখারী মুসলিমেই অপর একটি বর্ণনায় এই জওয়াবের ভাষা এইরূপঃ
****************************************
যাহা তোমার জন্যও যথেষ্ট হইতে পারে, যথেষ্ট হইতে পারে তোমার সন্তানের জন্যও।
হাদীসে ব্যবহৃত ***** শব্দটি ******* ‘কৃপণ’ হইতেও অধিক ব্যাপক অর্থবোধক। ইহার অর্থ ****** ‘কৃপণ ও লোভী’। শুধু ‘বখীল’ বা কৃপণ বলিতে বুঝায়, সে তাহার ধন সম্পদ ব্যয় করে না। যাহার যাহা প্রাপ্য তাহাকে তাহা দেয় না। আর ***** অর্থঃ সর্বাবস্থায় সব রকমের জিনিসই আটক করিয়া রাখা ও কাহাকেও কিছু না দেওয়া এবং সেই সঙ্গে আরও অধিক পাইবার জন্য বাসনা পোষণ করা। ফলে ***** শব্দের অর্থ হয়, কৃপণ-লোভী।
হিন্দ যে ভাবে অভিযোগটি পেশ করিয়াছেন, তাহাতে স্পষ্ট বুঝা যায়, আবূ সুফিয়ান পারিবারিক খরচপত্র চালাইবার জন্য যাহা দেন, তাহা যথেষ্ট হয় না বলে তিনি স্বামীর অজ্ঞাতসারে ও লুকাইয়া গোপনে আরও বেশী গ্রহণ করেন এবং তাহার দ্বারা নিজের ও সন্তানাদির প্রয়োজন পূরণ করিয়া থাকেন। এখন তাঁহার জিজ্ঞাসা এই যে, তাঁহার এই কাজটি শরীয়াত সম্মত কিনা, ইহাতে কি তাঁহার কোন গুনাহ হইবে?
এই পর্যায়ে মনে রাখা আবশ্যক, এই সময় হযরত আবূ সুফিয়ান (রা) মদীনায় অনুপস্থিত ছিলেন না। তাই ইহাকে ‘স্বামীর অনুপস্থিত থাকাকালীন পারিবারিক সমস্যা’ মনে করা যায় না। সমস্যা ছিল তাঁহার কার্পণ্য, পরিবার বর্গের প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করিবার জন্য না দেওয়া। তবে স্বামী-স্ত্রী পুত্র পরিজনের প্রয়োজন আদৌ পূরণ করেন না এমন কথা বলা হয় নাই। তাহাদিগকে অভুক্ত থাকিতে বাধ্য করেন এমন কথাও নয়। কেননা তাহা হইলে এতদিন পর্যন্ত তাহারা বাঁচিয়া থাকিল কিভাবে? হযরত আবূ সুফিয়ান নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তিও ছিলেন না। পরিবারবর্গকে যথেষ্ট পরিমাণে জীবিকা দারিদ্রের কারণে দিতে পারিতেন না এমন কথা নয়। তিনি শুধু কৃপণতা বশতই তাঁহার আর্থিক সামর্থ্যানুপাতে স্ত্রী-পুত্রকে উপযুক্ত মানে ও যথেষ্ট পরিমাণে জীবিকা দিতেছিলেন না। ইহাই ছিল তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ।
নবী করীম (স) এই মামলার রায় দান প্রসঙ্গে শুধু একটি কথাই বলিয়াছেন। তাহা হইল, তুমি যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করিতে পার না। গ্রহণ করিতে পার শুধু প্রচলিত মান পরিমাণ। অন্য কথায় স্বামীর দেওয়া সম্পদে মৌল প্রয়োজন অপূরণ থাকিয়া গেলে স্বামীর অজ্ঞাতসারে তাহার সম্পদ হইতে সেই প্রয়োজন পূরণ হইতে পারে শুধু এতটা পরিমাণই গ্রহণ করা যাইতে পারে, উহার অধিক লইয়া যথেচ্ছ ব্যয় বাহুল্য ও বিলাসিতা করিবে, শরীয়াতে তাহার কোন অনুমতি নাই। সব কৃপণ স্বামীর ক্ষেত্রে সব স্ত্রীর জন্যই ইসলামের এই বিধান। রাসূলে করীমের জওয়াবটির অর্থ এই ভাষায় করা হইয়াছেঃ *************** ‘বেহুদা খরচ করিবে না। নিতান্তও প্রচলিত নিয়ম বা মান মাফিক ব্যয় করিতে পার।
(***********)
নবী করীম (স)-এর এই জওয়াব সম্পর্কে আল্লামা কুরতুবী বলিয়াছেনঃ
****************************************
ইমা এমন আদেশসূচক কথা যাহা ইহতে বুঝা যায় যে, এই কাজটি করা মুবাহ- জায়েয।
বুখারীর অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ ****** ‘তাহাতে দোষ নাই’। আল্লামা শাওকানী লিখিয়াছেণঃ
****************************************
স্ত্রীর যাবতীয় খরচ বহন করা যে স্বামীর কর্তব্য, এই হাদীসটি হইতে তাহা স্পষ্ট অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় এবং ইহা সর্বসম্মত মত।
কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহা নবী করীম(স)-এর ফতোয়া। কোন বিচার ফয়সালা বা ***** নয়।অতএব ইহার ভিত্তিতে শরীয়াতের বিধান রচনা করা যায় না।
কিন্তু এই কথা স্বীকৃতব্য নয়। কেননা নবী করীম (স) ফতোয়া দিয়া থাকিলেও সে ফতোয়া দ্বীন-ইসলামেরই অন্যতম ভিত্তি।
এই হাদীসের ভিত্তিতে একথাও বলা হইয়াছে যে, ঠিক যে পরিমাণ সম্পদে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ-থাকন সুসম্পন্ন হয়, সেই পরিমাণ দেওয়াই স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব, তাহার বেশী নয়। কিন্তু এই মত-ও সর্ববাদী সম্মত নয়। কেবল মাপিয়অ গুণিয়া ততটুকু পরিমাণ দ্বারা আর যাহাই চলুক, স্ত্রী-পুত্র লইয়া ঘর-সংসার চালানো যায় না।