হযরতআলী ইবনে আবূ তালিব (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত ফাতিমা (রা) নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট একজন খাদেম চাহিলেন। নবী করীম (স) বলিলেনঃ আমি কি তোমাকে তোমার জন্য ইহাপেক্ষাও অধিক কল্যাণকর একটা উপায় বলিয়া দিব? তাহা হইলঃ তুমি যখন ঘুমাইতে যাইবে তখন ৩৩ বার আল্লাহর তসবীহ করিবে, ৩৩ বার আল্লাহর হামদ করিবে এবং ৩৪ বার আল্লাহর তাকবীর বলিবে। সুফিয়ান বলিলেনঃ এই তিন প্রকারের মধ্যে এক প্রকারের ৩৪ বার। অতঃপর আমি উহা কখনও বাদ দেই নাই। কেহ জিজ্ঞাসা করিল, ছিফফীন যুদ্ধের রাত্রেও নয়? তিনি বলিলেনঃ ছিফফিন যুদ্ধের রাত্রেও নয়।
(বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসের কথা গুলি হইতে বুঝা যায়, হযরত ফাতিমা (রা) গৃহকর্মের অপারগ হইয়া তাঁহার পিতা হযরত রাসূলে করীম (স)-এর নিকট একজন খাদেম বা চাকর রখিয়া দিবার জন্য অনুরোধ জানাইলেন। নবী করীম (স) তাঁহাকে কোন চাকররে ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন বা দেন নাই, এ বিষয়ে উদ্ধৃত হাদীসে কোন কথাই বলা হয় নাই। তবে নবী করীম (স) এই প্রার্থনার জওয়াবে দোয়া তসবীহ করার নিয়ম শিক্ষা দিলেন। বলিলেন, ঘুমাইবার সময় ৩৩ বার সুবহান-আল্লাহ ৩৩ বার আলহামদুল্লিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলিবে।
ইমাম ইবনে জারীর তাবারী বলিয়াছেন, ইহা হইতে বুঝা যায়, যে স্ত্রীর সামর্থ্য আছে রান্না-বান্না, চাউল তৈরী করা ইত্যাদি গৃহকর্ম তাহার নিজেরই করা উচিত। সেজন্য স্বামীল উপর দায়িত্ব চাপাইয়া দেওয়া উচিত নয়। আর ইহাই সাধারণ প্রচলন। উপরোদ্ধৃত হাদীস হইতে জানা যায়, হযরত ফাতিমা (রা) তাঁহার পিতার নিকট গৃহকর্মে সাহায্যকারী খাদেম চাহিলেন। কিন্তু নবী করীম (স) তাহার প্রিয়তমা কন্যার জন্য একজন খাদেমের ব্যবস্থা না নিজে করিয়া দিলেন, না তাঁহার সম্মানিত জামাতা হযরত আলী (রা)কে খাদেম রাখিয়া দিবার জন্য নির্দেশ দিলেন। অন্তত এ হাদীসে উহার উল্লেখ নাই। তাহা করা যদি হযরত আলী (রা)-এর আর্থিক সামর্থ্যে কুলাইত, তাহা হইলে তিনি অবশ্যই উহা করার জন্য নির্দেশ দিতেন। ইমাম মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
স্বামীর আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল হইলে ঘরের কাজকর্ম করা স্ত্রীর কর্তব্য- সে স্ত্রী যতই সম্মান ও মর্যাদাশীলা হউক না কেন।
এই কারণেই নবী করীম (স) হযরত ফাতিমা (রা) কে গৃহকর্ম করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর সাহায্য লাভর একটা উপায়ও শিখাইয়া দিলেন। তিনি এ কথা বলিলেন না যে, তুমি যদি গৃহকর্ম করিতে না পার, তাহা হইলে তাহা করিও না। কিংবা হযরত আলী (রা) কে বলিলেন না, আমার কন্যার কষ্ট হইতেছে, যে রকমই হউক, গৃহকর্মের জন্য তুমি একজন চাকরে ব্যবস্থা করিয়া দাও। এইরূপ আদেশ তিনি অবশ্যই দিতে পারিতেন, তাহাতে সম্মানিত জামাতার যত কষ্টই হউক না কেন। কিন্তু তিনি হযরত আলীর আর্থিক সামর্থ পুরাপুরি অবহিত ছিলেন। তিনি জানিতেন যে, হযরত আলী (রা)-এর পক্ষে তাঁহার মহা সম্মানিতা স্ত্রীর গুহকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন খাদেম নিয়োগ করা সম্ভব নয়। ইহা সত্ত্বেও নির্দেশ দিলে হযরত আলী (রা)-এর পক্ষে তাহা পালন করা সম্ভবপর হইত না। ফলে তিনি ভয়ানক কষ্টে পড়িয়া যাইতেন। এ কথা নবী করীম (স) ভাল ভাবেই জানিতেন এবং জানিতেন বলিয়াই তিনি তাঁহাকে এই কষ্টে ফেলিলেন না। সম্ভবত কোন শ্বশুরই নিজের জামাতাকে এই ধরনের অসুবিধায় ফেলে না। কোন কোন হাদীসবিদ বলিয়াছেন, এই হাদীস ছাড়া অন্য কোন দলীল হইত আমরা জানিতে পারি নাই যে, নবী করীম (স) হযরত ফাতিমা (রা)-কে কোন আভ্যন্তরীণ গৃহ খেদমতের ফায়সালা দিয়াছিলেন। তাঁহারা যে ভাবে জানেন, ব্যাপারটি সেই ভাবে তাঁহাদের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছিল। ইহাই দাম্পত্য জীবনের উত্তম আচরণ বিধি। উচ্চতর নৈতিকতার দাবিও ইহাই। স্ত্রীকে ঘরের কাজে বাধ্য করা যাইতে পারে এমন কোন শরীয়াতী বিধান নাই। বরং বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত মত এই যে, স্বামীই স্ত্রীর যাবতীয় ব্যাপারের জন্য দায়িত্বশীল। ইমাম তাহাভী বলিয়াছেন, স্ত্রীর খেদমকের যাবতীয় খরচ বহন করা স্বামীর কর্তব্য। কূফার ফিকাহবিদ এবংইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন, স্ত্রীর এবং তাহার খাদেমের-যদি সে খেদমতের কাজে নিযুক্ত থাকে- যাবতীয় খরচ স্বামীকে বহন করিতে হইবে।
হাদীসের ভাষা ****** অতঃপর সুফিয়ান বলিলেন’। এই সুফিয়ান হইলেন সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা। তিনি আলোচ্য হাদীসের একজন বর্ণনাকারী। কোন বাক্যটি কতবার পড়িতে হইবে, এ বিষয়যাবতীয় খরচ স্বামীকে বহন করিতে হইবে।
হাদীসের ভাষা ********* ‘অতঃপর সুফিয়ান বলিলেন’। এই সুফিয়ান হইলেন সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা। তিনি আলোচ্য হাদীসের একজন বর্ণনাকারী। কোন বাক্যটি কতবার পড়িতে হইবে, এ বিষয়ে তাঁহার মনে দ্বিধা ছিল সম্ভবতঃ সেই কারণেই তিনি শেষে এই রূপ বলিয়াছেন। হাদীসের শেষাংশের উদ্ধৃত আমি উহা কখনও বাদ দেই নাই। অর্থাৎ আমি রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ হইতে এই হাদীসের জনৈক শ্রোতা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ছিফফীন যুদ্ধের ভয়াবহ রাত্রিতেও কি উহা পড়িয়াছেন? তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ হ্যাঁ সেই ভয়াবহ রাত্রিতেও আমি ইহা না পরিয়া ছাড়ি নাই। ‘ছিফফীন’ সিরীয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর সহিত হযতর আলী (রা)-এর ইতিহাস খ্যাত যুদ্ধ এই স্থানেই সংঘটিত হইয়াছিল, ইহা ৩৬ হিজরী সনের কথা। এই কথাটি দ্বারা হযরত আলী (রা) বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, এই রাত্রের ভয়াবহতা সত্ত্বেও তিনি নবী করীম (স) (স)-এর শিক্ষা দেওয়া এই তাসবীহ তাকবীর হামদ পড়া ছাড়িয়া দেন নাই। তিনি ইহার পুরাপুরি পাবন্দী করিয়াছেন। রাসূলে করীম (স) এর দেওয়া শিক্ষাকে সাহাবায়ে কিরাম (রা) কতখানি দৃঢ়তার সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহার এই কথা হইতে তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।
(**************)
গৃহ কর্মে স্বামীর অংশ গ্রহণ
****************************************
আসওয়াদ ইবনে ইয়াজীদ হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি হযরত আয়েশা (রা) কে জিজ্ঞাসা করিলাম, নবী করীম (স) ঘরে থাকিয়া কি করিতেন? জওয়াবে হযরত আয়েশা (রা) বলিলেন, তিনি ঘরে থাকার সময় গৃহের নানা কাজে ব্যস্ত থাকিতেন। ইহার মধ্যে যখন-ই আযানের ধ্বনি শুনিতে পাইতেন, তখনই ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেন।
(বুখারী, তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ হাদসটি বুখারী শরীফে এই একই মূল বর্ণনাকারী আসওয়াদ হইতে তিনটি স্থানে উদ্ধৃত হইয়াছে এবং এই তিনটি স্থানে উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষায় কিছুটা পার্থক্য আছে। কিন্তু সে পার্থক্যের দরুন মূল বক্তব্যে কোনই পার্থক্য সূচিত হয় নাই। নবী করীম (স) যখন ঘরে থাকিতেন তখন তিনি কি করিতেন, ইহাই ছিল মূল প্রশ্ন। ইহার জওয়াবে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা) বলিলেনঃ তিনি ঘরে থাকার সময় ঘরের লোকদের কাজে ব্যস্ত থাকিতেন। হাদীসের শব্দ ***** ইহার অর্থ খেদমত। ইমাম বুখারীর উস্তাদ আদম ইবনে আবূ ইয়াস এই অর্থ বলিয়াছেন। ইমাম আহমাদ ও আবূ দায়ূদ তায়লিসীও এই হাদীসটি নিজ নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং এই শব্দ হইতে তাহারাও এই অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন।
‘আল মুহকাম’ গ্রন্হ প্রণেতা এই শব্দটির একটা বিশেষ অর্থ করিয়াছেন এই ভাষায় ******* অর্থাৎ এই শব্দটির অর্থ শুধু খেদমত নয়। ইহার অর্থ, খেদমত ও যাবতীয় কাজ-কর্মে দক্ষতা ও কুশলতা। কোন কোন বর্ণনায় ইহার ভাষা হইলঃ ************* ‘তাঁহার পরিবার বর্গের ঘরের কাজ কর্মে….। ইহার মূল অর্থে কোন পার্থক্য হয় না। ***** বলিতে নিজেকে সহ ঘরে অবস্থানকারী সব লোকই বুঝায়। শামায়েলে তিরমিযীতে উদ্ধৃত হইয়াছে, হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স) সাধারণ মানুষের মধ্যে গণ্য একজন মানুষ ব্যতীত আর কিছুই ছিলেন না। এই হিসাবে তিনি তাঁহার কাপড় পরিষ্কার করিতেন, ছাগী দোহন করিতেন এবং নিজের অন্যান্য কাজ কর্ম করিতেন।
আর মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে হাব্বানে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
তিনি তাঁহার কাপড় ধোলাই করিতেন ও জুতার তালি লাগাইতেন।
বুখারীরই একটি বর্ণনার ভাষা ****** হইতে বুঝা যায় যে, ইহা নবী করীমের স্থায়ী নীতি ও কর্ম তৎপরতা ছিল। আর ***** বাক্যংশের অর্থ হাদীস বর্ণনাকারী নিজেই বলিয়াছেনঃ ************* তাঁহার পরিবার বর্গের কাজ-কমৃ নবী করীম (স) করিতেন।
এই হাদীস হইতে কয়েকটি কথা স্পষ্ট রূপে জানা যায়। প্রথম এই যে, নবী করীম (স) একজন মানুষ ছিলেন দুনিয়ার আর দশজন মানুষের মত। তাঁহার ঘর গৃহস্থলী ছিল। তিনি দুনিয়া ত্যাগী বৈরাগী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুসলমানদের শাহান শাহ; কিন্তু তাঁহার মন মেজাজে অহংকার আহমিকতা বলিতে কিছু ছিল না। এই সব মৌলিক মানবীয় গুণ ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ খোদানুগত বান্দাহ। তিনি ছিলেন আল্লাহর ওহী গ্রহণকারী নবী ও রাসূল।
তিনি যে আদর্শ স্বামী ছিলেন, এই হাদীসে তাহার প্রমাণ স্বরূপ বলা হইয়াছে, তিনি ঘরে আসিয়া অলস বিশ্রামে সময় কাটাইতেন না, ঘরের কাজ কর্ম করিতেন, ঘরের লোকদের কাজে সাহায্য সহযোগিতা করিতেন। বস্তুত দুনিয়অর সব স্বামীরও এই গুণ ও পরিচয় থাকা আবশ্যক। নতুবা ঘরের সমস্ত কাজ যদি কেবলমাত্র স্ত্রীর উপর ন্যাস্ত করিয়া দেওয়া হয় এবং সে কাজ সম্পাদনে স্বামী কিছু মাত্র অংশ গ্রহণ না করে, তাহা হইলে তাহা হইবে স্ত্রীর প্রতি জুলূম একদিকে এবং অপর দিকে স্বামীতে স্ত্রীতে দূরত্ব ও ব্যবধান বিরোধ সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
শুধু তাহাই নয়, রাসূলে করীম (স) ছিলেন একজন আদর্শ খোদানুগত মুসলমান। ইহারই প্রমাণ স্বরূপ হাদীসে বলা হয়েছেঃ
****************************************
তিনি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় যখনই নামাযের আযান শুনিতে পাইতেন নামাযের জামায়াতে শরীক হওয়ার জন্য তখনই ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেন।
বুখারীর-ই অন্যত্র এই বাক্যটির ভাষা হইলঃ
****************************************
যখন নামায উপস্থিত হইত, তিনি নামাযের জন্য বাহির হইয়া যাইতেন।
বস্তুত ইহাই আদর্শ মুসলমানের নিয়ম ও চরিত্র। তাহারা যেমন আল্লাহর হক আদায় করেন তেমনি আদায় করেন মানুষের হকও।