সদ্যজাত শিশুর প্রতি কর্তব্য

হযরত আবূ রাফে (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স) কে হযরত আলী ইবনে আবূ তালিবের (রা) পুত্র হাসান-এর কানে নামাযের আযান দিতে দেখিয়াছি। যখন হযরত ফাতিমা (রা) তাঁহাকে প্রসব করিয়াছিলেন।

 

(তিরমিযী, আবূ দায়ূদ)

 

ব্যাখ্যাঃ সন্তান প্রসব হওয়ার পরই তাহার প্রতি নিকটাত্মীয়দের কর্তব্য কি, তাহা এই হাদীসটি হইতে জানা যাইতেছে। ইহাতে বলা হইয়াছে, হযরত ফাতিমা (রা) যখন হযরত হাসান (রা) কে প্রসব করিয়াছিলেন ঠিক তখনই নবী করীম (স) তাহার দুই কানে আযান ধ্বনী উচ্চারণ করিয়াছিলেন এই আযান পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযানেরই মত ছিল, উহা হইতে ভিন্নতর কিছু ছিল না। ইহা হইতে সদ্যজাত শিশুর কানে এইরূপ আযান দেওয়া সুন্নাত প্রমাণিত হইতেছে। ইহা ইসলামী সংস্কৃতিরও একটি অত্যন্ত জরুরী কাজ। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মানব শিশু যাহাতে তওহীদবাদী ও আল্লাহর অনন্যতম বিশ্বামী ও দ্বীন-ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হইয়া গড়িয়া উঠিতে পারে, সেই লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছে। সদ্যজাত শিশুর কর্ণে সর্বপ্রথম- দুনিয়ার অন্যান্য বিচিত্র ধরনের ধ্বনি ধ্বনিত হইতে না পারে তাহার পূর্বেই এই আযান ধ্বনি তাহার কর্ণে ধ্বনিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বস্তুত আযানের বাক্য সমূহে ইসলামের মৌলিক কথাগুলি সন্নিবেশিত রহিয়াছে। ইহাতে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ট হওয়া, আল্লাহরই একক ও অনন্য মাবুদ হওয়া এবং হযরত মুহাম্মদ (রা)-এর আল্লাহর রাসূল হওয়ার কথা ঘোষিত হইয়াছে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও চূড়ান্ত ভাবে। আর ইহা হইল ইসলামী বিশ্বাসের মৌলিক ও প্রাথমিক কথা সমূহ। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওজিয়া বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

সদ্যজাত শিশুর কর্ণে সর্বপ্রথম আল্লাহর তাকবীর- নিরংকুশ শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, আল্লাহ ছাড়া কেহ ইলাহ বা মা’বুদ নাই এবং মুহাম্মদ (স) আল্লাহর রাসূল- এই উদাত্ত সাক্ষ্য ও ঘোষণার ধ্বনি সর্বপ্রথম যেন ধ্বনিত হইতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছে।

 

****************************************

 

হযরত হাসান ইবনে আলী (রা) হইতে নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ যাহার কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবে, পরে উহার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত উচ্চারিত হইলে ‘উম্মুসসিবইয়ান উহার কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না।

 

(বায়হাকী, ইবনুস-সনী)

 

ব্যাখ্যাঃ হযরত হাসান (রা) বর্ণিত এই হাদীসটিতে ডান কানে আযান ও বাম কানে ইক্বামত বলার কথা হইয়াছে, যদিও ইহার পূর্বে উদ্ধৃত হাদীসটি কানে শুধু আযান দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে। বাহ্যত দুইটি হাদীসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য মনে হয়। কিন্তু মূলত এই দুইটির মধ্যে কোন মৌলিক বিরোধ নাই। প্রথম হাদীসটিতে রাসূলে করীম (স) এর নিজের আমল বা কাজের বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে। আর দ্বিতীয় হাদীসটিতে রাসূলে করীম (স)-এর নিজের কথা বর্ণিত হইয়াছে। এই দ্বিতীয় হাদীসটি হযরত আব্বাস (রা)-এর সূত্রেও বর্ণিত ও হাদীস গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে।

 

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম বলিয়াছেন, সদ্যজাত শিশুর এক কানে আযান ও অপর কানে ইক্কামতের শব্দগুলি উচ্চারিত ও ধ্বনিত হইলে তাহা তাহার উপর ইসলামী জীবন গঠনের অনুকূল প্রভাব বিস্তার করিবে। কি ধ্বনিত হইল সে বিষয়ে যদিও শিশুটির চেতনা নাই। সে শব্দ বা বাক্য সমূহের তাৎপর্য অনুধাবন করিতে পারে না, একথা সত্য। কিন্তু ইহার কোন কোন প্রভাব তাহার মনে মগজে ও  চরিত্র মেজাজে অবশ্যই পড়িবে, তাহা সম্পুর্ণ নিস্ফল ও ব্যর্থ হইয়া যাইতে পারে না। দুনিয়ায় তাহার জীবনের প্রথম সূচনা কালের ‘তালকীন’ বিশেষ, যেমন মূমূর্ষাবস্থায়ও তাহার কানে অনুরূপ শব্দ ও বাক্য সমূহ তালকীন করা হয়। ইহাতে সূচনা ও শেষ এর মধ্যে একটা পূর্ণ সামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি সদ্যজাত শিশুকে আয়ত্তাধীন ও প্রভাবাধীন বানাইবার জন্য শয়তান ধাবিত হইয়া আসিতেই যদি আযান ইক্কামতের ধ্বনি শুনিতে পায়, তাহা হইলে উহার দ্রুত পালাইয়া যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। ফলে সদ্যজাত শিশুটি শয়তানের মারাত্মক অসওয়াসা থেকে রক্ষা পাইয়া যায়। উম্মুসসিবইয়ান বলিয়া সদ্যজাত শিশুর গায়ে লাগা ক্ষতিকর বাতাস বোঝানো হইয়াছে। অর্থাৎ শিশুর কানে আযান ইক্বামত দেওয়া হইলে সাধারণ প্রাকৃতিক কোন ক্ষতিকর প্রবাব উহার উপর পড়িবেনা। পড়িলেও কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না।

 

(*****************)

শিশুদের প্রতি স্নেহ-মমতা

 

****************************************

 

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) হযরত আলী (রা)-এর পুত্র হাসান ও হুসাইন (রা)কে স্নেহের চুম্বন করিলেন। এই সময় আকরা ইবনে হাবিস আত-তামীমী (রা) তাহার নিকট উপস্থিত ছিলেন। তিনি উহা দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, আমার দশটি সন্তান রহিয়াছে। কিন্তু আমি তাহাদের কোন একজনকেও কখনও আদায়ের চুম্বন দেই নাই। তখন রাসূলে করীম (স) তাঁহার দিকে তাকাইলেন এবং পরে বলিলেনঃ যে লোক নিজে (অন্যদের প্রতি) দয়া-মায়া স্নেহ পোষণ করে না, তাহার প্রতিও দয়া-মায়া স্নেহ পোষণ করা হয় না।

 

(বুখারী)

 

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি ইহতে নিজ বংশের শিশু সন্তানদের প্রতি অকৃত্রিম ও নির্মল স্নেহ-মায়া-দরদ বাৎসল্য পোষণ ও প্রকাশ করার প্রেরণা সৃষ্টি করে এবং পর্যায়ে বিশ্বমানবের জন্য আল্লাহর রহমত হযরত নবী করীম (স) তাঁহার নিজ কন্যা হযরত ফাতিমা (রা)-এর গর্ভজাত দুই সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইনের প্রতি যে অসীম স্নেহ-মমতা-মায়া পোষণ করিতেন এবং তাঁহাদিগকে স্নেহময় চুম্বন দিয়া যে বাস্তব নিদর্শন স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহারই বিবরণ উদ্ধৃত হইয়াছে আকরা (*********) ইবনুল হাবেস- যিনি জাহিলিয়াতের যুগের একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন এবং পরে ইসলাম কবুল করিয়াছিলেন- সেখানে উপস্থিত থাকিয়া নিজ চক্ষে এই পবিত্রতাময় দৃশ্য দেখিতে পাইয়াছিলেন। এই সময় তিনি যে উক্তিটি করিয়াছিলেন, তাহা জাহিলিয়াতের যুগে মানুষদের মানসিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র উদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছে। তিনি দশটি সন্তানের পিতা হইয়াও কোন দিন কোন মুহূর্তে স্নেহের বশবর্তী হইয়া কোন একটি শিশু সন্তানকেও চম্বন করেন নাই। কতখানি নির্মম ও পাষাণ হৃদয় হইলে ইহা সম্ভব হইতে পারে, তাহা ভাবিলেও শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে।

 

এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) যাহা বলিলেন, তাহা যেমন মানবিক তেমনি ইসলামী ভাবধারারই পূর্ণ অভিব্যক্তি। বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহই হইলেন একমাত্র রহমতদানকারী। মানুষকে সৃষ্টি করিয়া তিনি তাহার মধ্যে স্বভাবগত স্নেহ-ভালোবাসা ও দয়া-মায়া রাখিয়া দিয়াছেন। ইসলামের নবী (স) মানুষের প্রতি সেই দয়া-মায়া ও স্নেহ পোষণ করিবে, তাহা হইলে সেই পিতা-মাতাও সন্তানের মায়া-মমতা পাইবে। শুধু তাহাই নয়, আল্লাহর রহমত লাভ করারও ইহাই পন্হা।

 

বস্তুত পিতা-মাতার অপত্য স্নেহ-মমতা পাওয়া সন্তানের প্রধান মৌল অধিকার। বিশেষ করিয়া এই জন্য যে, মানব-সন্তান পিতা-মাতার অপত্য স্নেহ-মমতা ও আদরযত্নে যথারীতি ও পুরাপুরি মাত্রায় না পাইলে তাহাদের বাঁচিয়া থাকা ও বড় হওয়া প্রায় অসম্ভব। মানব শিশু পশু শাবকদের মত নয়। পশু-শাবক প্রাথমিক কয়েক মুহূর্তের সামান্য আদর যত্ন ও সংরক্ষণ পাইলেই ইহারা নিজস্বভাবে চলা-ফিরা ও খাদ্য গ্রহণে সক্ষম হইয়া যায়। কিন্তু মানব শিশু যেহেতু সর্বাধিক দুর্বল অক্ষম হইয়া জন্মগ্রহণ করে এবং বড় ও স্বয়ং সম্পূর্ণ হইতে নিরবচ্ছ্নিভাবে অন্তত ৫-৭ বৎসর পর্যন্ত পিতা-মাতার স্নেহ-যত্ন ও মায়া-মমতার প্রশ্ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিম্ব মানবতার কল্যাণ বিধায়ক ইসলামে এবং স্বয়ং ইসলামের নবী-রাসূল হযরত মুহাম্মদ (স) দ্বারা ইহার বাস্তবায়ন এমনভাবে হইয়াছে, যাহার কোন দৃষ্টান্ত মানবেতিহাসে পাওয়া যাইতে পারে না।

 

উপরিউক্ত হাদীসে দয়া-স্নেহ প্রসঙ্গে নবী করীম (স) যাহা বলিলেন, তাহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, ইহা মানুষের একটি স্বভাবজাত ব্যাপার এবং ইহা প্রত্যেক মানুষেরই করা উচিৎ। বড়রা ইহা না করিলে তাহারাও কখনই দয়া স্নেহ পাইবেনা। ইহা শিশুদের অধিকার, শিশুদের প্রতি ইহা কর্তব্য। এই মায়া-স্নেহ-দয়ার বন্ধনেই মানব সমাজের ব্যক্তিরা ওতোপ্রোত বন্দী। এই দয়া-স্নেহের উপরই মানব সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত। হযরত আকরা (রা)-এর বিস্ময় বোধ হইতে প্রমাণিত হয় যে, জাহিলিয়াতের যুগে আরব দেশের লোকেরা বস্তুতঃই নির্মম, দয়া-মায়াহীন ছিল। নতুবা তাহারা নিজেরা নিজেদেরই সন্তানদের হত্যা করিত কিভাবে? রাসূলে করীম (স) যে মানবিক আদর্শ আল্লাহর নিকট হইতে লইয়া আসিয়াছিলেন, তাহাতে এই নির্মমতার কোন স্থান নেই। সেখানে আছে দয়া স্নেহ-বাৎসল্য ও মমতার দুশ্ছেদ্য বন্ধন।

 

এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা) হইতে একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

একজন বেদুঈন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল। বলিল, আপনি তো শিশুদের চুম্বন করেন; কিন্তু আমরা তাহা করি না। জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তোমার দিল হইতে আল্লাহ যদি দয়া-স্নেহ-মমতা রাহির করিয়া লইয়া গিয়া থাকেন তাহা ইলে আমি তাহার কি করিতে পারি?

 

অর্থাৎ মানুষের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা স্বভাবতঃই যে স্নে-মমতা-বাৎসল্যেয় পবিত্র ভাবধারা সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন, তাহারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিশুদের চুম্বন করায়। তোমরা যদি শিশূদের চুম্বন না কর, তাহা হইলে প্রমাণিত হয় যে, তোমাদের দিলে আল্লাহ তা’আলা এই স্নেহ-মমত-বাৎসল্য সৃষ্টিই করেন নাই। আর তিনিই যদি তাহা সৃষ্টি না করিয়া থাকেন তবে কাহার কি করিবার থাকিতে পারে।

 

অন্য কথায় শিশুদের স্নেহসিক্ত চুম্বন করা ও তাহাদের প্রতি নির্মম না হওয়া তোমাদের কর্তব্য। আমরা ইসলামে বিশ্বাসীরা নির্মম নহি বলিয়াই আমরা আমাদের শিশুদের স্নেহের ও আদরের চুম্বন করিয়া থাকি।

 

রাসূলে করীম (স) সম্পর্কে সাহাবীর উক্তি  হাদীসে উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

পরিবার পরিজনের লোকদের প্রতি রাসূলে করীম (স) সর্বাধিক দয়াশীল ছিলেন। তাঁহার অধিক দয়াশীল আমি আর কাহাকেও দেখি নাই।

 

এই কারণেই তিনি মুসলমানদের নির্দেশ দিয়াছেন এই বলিয়াঃ

 

****************************************

 

তোমরা তোমাদের সন্তানকের সম্মান ও আদর যত্ন কর এবং তাহাদিগকে উত্তম আদব কায়দা শিক্ষা দাও।

 

নিজেদের ঔরসজাত সন্তানদেরও একটা সম্মান ও মর্যাদা রহিয়াছে, এই সম্মান তাহাদের প্রতি পিতা-মাতা মুরব্বীদের অবশ্যই জানাইতে হইবে, ইহাই রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ। কেননা তাহারাও সেই মানবতারই অন্তর্ভুক্ত যাহার স্থান ও মর্যাদা গোটা সৃষ্টি লোকের সব কিছুর উর্ধ্বে। কাজেই তাহা কোনকমেই এবং কোন অবস্থায়ই অস্বীকৃত হইতে পারে না।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]