আকীকাহ্ বিধান সন্তানের খাতনা করা

আমর ইবনে শুয়াইব তাঁহার পিতা হইতে- তাঁহার দাদা হইতে (রা) বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ রাসূলে করীম (স)-কে ‘আকীকাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘উক্কুক্ক’ পছন্দ করেন না। ….. সম্ভবত তিনি এই নামটাকে অপছন্দ করিয়াছেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসূল! আমাদের একজনের ঘরে সন্তান জন্ম হইলে কি করিতে হইবে, সেই বিষয়ে আমরা আপনার নিকট জিজ্ঞাসা করিতেছি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ যদি কেহ নিজের সন্তানের নামে যবেহ করা পছন্দ করে, তাহা হইলে তাহা তাহার করা উচিত। পুত্র সন্তান জন্মিলে দুইটি সমান সমান আকারের ছাগী এবং কন্যা সন্তান জন্মিলে তাহার পক্ষ হইতে একটি ছাগী যবেহ করিতে হয়।

 

(মুসনাদে আহমাদ, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী, মুয়াত্তা মালিক)

 

ব্যাখ্যাঃ *********** শব্দের মূল হইল ******* ইহার অর্থ কর্তন করা, কাটিয়া ফেলা। আচমায়ী বলিয়াছেন, সন্তান মাথায় যেসব চুল লইয়া জন্ম গ্রহণ করে, মূলত উহাকেই ‘আকীকাহ’ বলা হয়। সন্তানের জন্ম গ্রহণের পর উহার নামে যে জন্তু যবেহ করা হয়, প্রচলিত কথায় উহার নাম রাখা ‘আকীকাহ’। ইকার কারণ হইল, এই জন্তু যবেহ করার সময় সদ্যজাত শিশুর প্রথমে মাথা মুন্ডন করা হয় ও জন্মকালীন মাথার চুল কামাইয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। এই কারণেই হাদীসে বলা হইয়াছেঃ ********** ‘উহার কষ্টদায়ক ও ময়লাযুক্ত চুল দূর করিয়া দাও’।

 

আবূ উবাইদ বলিয়াছেন, যে সব চুল লইয়া জন্তু শাবক জন্ম গ্রহণ করে উহাকেও ‘আকীকাহ’ বলা হয়; কিংবা বলা হয় ******। আর এই শব্দগুলির মূল অভিন্ন।

 

আজহারী বলিয়াছেন, **** শব্দের আসল অর্থ হইল **** চূর্ণ বা দীর্ণ করা। সন্তানের জন্মকালীন মাথার চুলকে ‘আকীকাহ’ বলা হয় এই জন্য যে, উহা কামাইয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। সদ্যজাত সন্তানের নামে যবেহ করা জন্তুটিতে ‘আকীকাহ’ বলা হয় এই জন্য যে, সে সন্তানের নামে বা উহার তরফ হইতে জন্তুটির গলা কাটা হয়, গলার রগ ছিন্ন করিয়া ফেলা হয়। উহাকে ***** বলা হয়। এই শব্দটির মূল **** উহার অর্থ **** দীর্ণ বা চূর্ণ বা চূর্ণ বা ছিন্ন করা।

 

‘আল-মুহকাস’ গ্রন্হ প্রণেতা বলিয়াছেন, আরবী ভাষায় বলা হয় ***** তাহার সন্তানের পক্ষ হইতে সে ‘আকীকাহ’ করিয়াছে’। ‘তাহার মাথার চুল কামাইয়া ফেলিয়াছে; কিংবা তাহার পক্ষ হইতে একটি ছাড়ীী যবেহ করিয়াছে। এই দুইটি অর্থই বুঝা যায়’, সে ‘আকীকাহ’ করিয়াছে, কথাটি হইতে। আচমায়ী ও অন্যান্যরা ‘আকীকাহ’ শব্দের ব্যাখ্যায় এই যাহা কিছু বলিয়াছেন, ইমাম আহমাদ তাহা মানিয়অ লইতে অস্বীকার করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, এসক কথা যথার্থ নয়। আসলে এই শব্দটির অর্থ যবেহ করা। আবূ আমর বলিয়াছেন, ইহাই ঠিক কথা। পরবর্তীকালের ভাষাবিদগণও বলিয়াছেন, ইহা এক সুপরিচিত পারিভাষিক শব্দ। ইহার অর্থ কর্তন করা। কাজেই সোজাসুজিভাবে ‘আকীকাহ’ হইল সদ্যজাত সন্তানের নামে ও তাহার পক্ষ হইত জন্তু যবেহ করা।

 

(**************)

 

ইমাম খাত্তাবী বলিয়াছেনঃ ‘আকীকাহ’ বলা হয় সেই জন্তুটিকে যাহা সদ্যজাত সন্তানের পক্ষ হইতে যবেহ করা হয়। উহাকে এই নাম দেওয়া হইয়াছে এই কারণে যে, উহার যবেহকারী উহার গলা কাটিয়া ছিন্ন করিয়া দেয়।

 

(***************)

 

আল্লামা জামাখশারীর মতে আকীকাহ আসল অর্থ শিশুর জন্মকালীন মাথার চুল। আর সদ্যজাত শিশুর জন্য যবেহ করা জন্তুকে যে ‘আকীকাহ’ বলা হয় তাহা ইহা হইতে গ্রহীত-বানানো অর্থ।

 

(**********)

 

মূল হাদীসে বলা হইয়াছেঃ রাসূলে করীম (স) কে ‘আকীকাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ আল্লাহ তা’আলা ***** অপছন্দ করেন না।

 

‘আকীকাহ’ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি শব্দের মূলের ঐক্য ও অভিন্নতার কারণে। কেননা **** আকীকাহ শব্দের যাহা মূল, তাহাই ***** শব্দেরও মূল। আর ইহার অর্থ হইল পিতা-মাতার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা- একটা বিশেষ পরিভাষা হিসাবে। অর্থের এই সামঞ্জস্যতার সুযোগে রাসূলে করীম (স) যে কথাটি বলিলেন, তাহার দুইটি তাৎপর্য হইতে পারে। একটি এই যে, সদ্যজাত সন্তানের নামে যে জন্তু যবেহ করা হয়, উহাকে ‘আকীকাহ’ বলা তিনি পছন্দ করেন না। কেননা উহাতে পিতা-মাতার সহিত সন্তানের সম্পর্ক ছিন্ন করার ‘ভাব’ রহিয়াছে। এই হাদীসের কোন একজন বর্ণনাকারী এই কারণেই হাদীসের সঙ্গে নিজের এই মত শামিল করিয়া দিয়া বলিয়া ফেলিয়াছেনঃ **** এই  জন্তুর আকীকাহ নামকরণ তিনি পছন্দ করেন নাই। আর দ্বিতীয় তাৎপর্য এও হইতে পারে যে, তিনি এই কথাটি বলিয়া ‘আকীকাহ’র গুরুত্ব বুঝাইতে চাহিয়অছেন আর তাহা এই ভাবে যে, সন্তানের পিতা-মাতার সম্পর্ক ছিন্ন করাটা আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন না। এই জন্যই সন্তানের জন্মের পর তাহার নামে জন্তু যবেহ করা পিতামাতার কর্তব্য। তাহা তাহারা না করিলে মনে করিতে হইতে পারে, তাহারাই সন্তানের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। আর সন্তানের সহিত পিতা কর্তৃক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া আল্লাহর নিকটও মোটেই পছন্দনীয় কাজ নয়।

 

‘নেছায়া’ গ্রন্হে বলা হইয়াছে, রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি হইতে একথা মনে করা যাইবে না যে, তিনি ‘আকীকা’র সুন্নাতী প্রথাটির অপমান করিয়াছেন; কিংবা এই প্রথাটিকে বাতিল করিয়া দিয়াছেন। বড় জোর এতটুকু বলা যায় যে, শব্দটির অর্থের একটা খারাপ দিকও আছে বলিয়া তিনি এই নামকরণটা পছন্দ করেন নাই। বরং তিনি ইহা হইতেও একটি উত্তম অর্থবোধক নাম দেওয়ার পক্ষপাতী।  বস্তুত খারাপ অর্থবোধক নাম বদলাইয়া ভাল তাৎপর্যপূর্ণ শব্দে ব্যক্তির, কাজের ও জিনিসের নামকরণ তাঁহার একটা বিশেষ সুন্নাত।

 

হাদীসবিদ তুরেপুশতী বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর উক্তিটির সঙ্গে সঙ্গে ‘তিনি এই নাম পছন্দ করেন নাই’ বলিয়া যে কথাটুকু হাদীসের বর্ণনাকারী মূল হাদীসের সহিত শামিল করিয়া দিয়াছেন, ইহা যথার্থ কারণ হয নাই। এই বর্ণনাকারীকে তাহা অবশ্য চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয় নাই। আসলে এই কথাটি বর্ণনাকারীর নিজের ধারণা মাত্র। আর লোকদের ধারণা শুদ্ধও হইতে পারে যেমন, তেমনি ভূলও হইতে পারে। তবে এখানে মনে হয়, ইহা করিয়া ভূল করা হইয়াছে। কেননা বহু কয়টি সহীহ হাদীসে এই ‘আকীকাহ’ শব্দটি  প্রচুর প্রয়োগ ও উল্লেখ হইয়াছে। রাসূলে করীম (স)ই যদি এই নামটি পছন্দ না করিতেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ইহা কোন হাদীসে ব্যবহৃত হইত না। সাহাবায়ে কিরাম এই শব্দটি বলিয়া সেই সংক্রান্ত বিধান জানিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার নিকট প্রশ্ন করিতেন না। রাসূলে করীম (স্য) পূর্বেই ইহা পরিবর্তন করিয়া দিতেন। কেননা খারাপ নাম বদলাইয়া ভাল নাম রাখা তাঁহার স্থায়ী নীতি। রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটির এই তাৎপর্য নয় যে, তিনি ‘আকীকাহ’ বলাকে অপছন্দ করিয়াছেন। বরং তিনি এই রূপ বলিয়া একথা বুঝাইয়াছেন যে, পিতা-মাতার হক নষ্ট করা যেমন সন্তানের জন্য ****-বড় পাপ, তেমনি সন্তানের নামে আকীকাহ করা পিতার উপর সন্তানের হক। আকীকাহ না দিলে সন্তানের সে হক শুধু নষ্ট নয় অস্বীকার করা হয়। ইহাও আল্লাহ তা’আলা বিন্দুমাত্র পছন্দ করেন না। অতএব ‘আকীকাহ’ করার গুরুত্ব সম্পর্কে তোমরা সাবধান হইয়া যাও।

 

হাদীসের ভংগী হইতে বুঝা যায়, প্রশ্নকারীরা রাসূলে করীম (স)-এর কথার এই সূক্ষ্ম তাৎপর্য বুঝিতে পারেন নাই। তাই তাঁহারা পুনরায় অন্য ভাষায় প্রশ্ন রাখার প্রয়োজন মনে করিয়াছেন, প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন এবং নবী করীম (স)ও অতঃপর সেই মূল প্রশ্নের জওয়াব দিয়াছেন।

 

এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের মধ্যে যে লোক তাহার সন্তানের পক্ষ হইতে জন্তু যবেহ করিতে ইচ্ছুক হয় বা পছন্দ করে, তাহার তাহা করা উচিত। কথার এই ধরন হইতে স্পষ্ট হয় যে, ‘আকীকাহ’ করা ফরয বা ওয়াজিব নয়। ইহাকে সুন্নাত বলা যাইতে পারে। হযরত সালমান ইবনে আমের আজুরী (রা) বলিয়াছেন, আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ

 

****************************************

 

সন্তান মাত্রের জন্যই আকীকাহর ব্যবস্থা রহিয়াছে। অতএব তোমরা উহার পক্ষ হইতে রক্ত প্রবাহিত কর ও উহার দেহ হইতে ময়লা দূর কর।

 

****** শব্দটি বাচ্চা ও যুবক উভয়ই বুঝায়।

 

হাদীসটির শেষাংশের নবী করীম (স) ‘আকীকাহ’ সংক্রান্ত নিয়ম বলিয়া দিয়াছেন। এই ভাষায় যে, পুত্র সন্তান হইলে দুইটি সমান সামন আকারের ছাগী যবেহ করিতে হইবে এবং কন্যা সন্তানের নামে করিতে হইবে একটি মাত্র ছাগী।

 

সমান সমান আকারের ছাগী অর্থ প্রায় একই বয়সের ছাগী হইতে হইবে, যে ছাগী কুরবানী করা চলে, তাহাই আকীকাহ রূপে যবেহ করিতে হইবে।

 

(**************)

 

****************************************

 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন (রা)-এর পক্ষ থেকে একটি ছাগী আকীকাহ দিয়াছেন।

 

(আবূ দায়ুদ, ইবনে খাজাইমা)

 

‘আকীকাহ’ সংক্রান্ত নিয়ম পর্যায়ে ইহা আর একটি হাদীস। ইহাতে পুরুষ সন্তানের আকীকাহ দুইট পরিবর্তে একটি করিয়া যবেহ করার কথা  জানানো হইয়াছে। পুর্বোদ্ধৃত হাদীসে পুত্র সন্তানের আকীকায় দুইটি যবেহ করার সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর মুখের কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। আর এই হাদীসটিতে উদ্ধৃত হইয়াছে রাসূলে করীম (স)-এর নিজের কাজ। এই দুইটির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট।

 

কিন্তু এই আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত ও নাসায়ী গ্রন্হে উদ্ধৃত অপর একটি বর্ণনায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

রাসূলে করীম (স) উভয়ের নামে আকীকাহ করিয়াছেন দুইট করিয়া ছাগল (বা ভেড়া) দ্বারা।

 

মুয়াত্তা ইমাম মালিক গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

সাহাবী হযরত উরওয়া ইবনুজ জুবাইর (রা) তাঁহার পুত্র ও কন্যা সন্তানের আকীকাহ করিতেন একটি একটি ছাগী দিয়া।

 

এই বিষয়ে ইমাম মালিক (রা)-এর কথা হইলঃ

 

যে-ই আকীকাহ করিবে, সে যেন পুত্র ও কন্যা উভয় ধরনের সন্তানের নামে একটি করিয়া ছাগী যবেহ করে। তবে ‘আকীকাহ’ দেওয়া ওয়াজিব (বা ফরয) নয়। ইহা করা মুস্তাহাব- খুবই ভালো ও পছন্দনীয় কাজ। ইহা এমন একটি কাজ যাহা- আমার মতে মুসলমান জনগণ চিরকালই করিয়া আসিয়াছেন। যদি কেহ আকীকাহ করে তবে তাহা কুরবানীর সমতুল্য কাজ হইবে। ইহাতে পঙ্গু, অন্ধ, খোড়া, দুর্বল, অংগ ভাংগা, রোগাক্রান্ত জন্তু যবেহ করা যাইবে না। উহার গোশত বা চামড়া আদৌ বিক্রয় করা যাইবে না। বিক্রয় করা হইলে লব্ধ মূল্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করিতে হইবে। উহার হাড় চূর্ণ করা যাইবে। উহার গোশত পরিবারের লোকজন খাইবে। আত্মীয় স্বজন ও গরীবদের উহার গোশতের অংশ দেওয়া যাইবে। উহার একবিন্দু রক্তও শিশুর গায়ে মাথায় মাখা যাইবে না।

 

(******)

 

হযরত আয়েশা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

হযরত নবী করীশ (স) হযরত হাসান ও হুসাইনের (রা) নামে তাঁহাদের জন্মের সপ্তম দিনে আকীকাহ করিয়াছেন।

 

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত এই হাদীসটিরই অপর একটি বর্ণনা এইরূপঃ

 

****************************************

 

নবী করীম (স) হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন (রা)-এর নামে তাঁহাদের জন্মের সপ্তম দিনে ‘আকীকাহ করিয়াছেন, তাঁহাদের দুইজনের নাম রাখিয়াছেন এবং তাঁহাদের দুইজনের মাথার আবর্জনা দূর করার আদেশ দিয়াছেন।

 

(বায়হাকী, হাকেম, ইবেন হাব্বান)

 

এ পর্যায়ে হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীস এইঃ

 

****************************************

 

হযরত নবী করীম (স) হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (রা)-এর নামে সপ্তম দিনে আকীকাহ করিয়াছেন এবং তাঁহাদের দুইজনের খাতনা করাইয়াছেন।

 

(বুখারী)

 

অপর একটি বর্ণনায় ইহার সহিত নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলিও রহিয়াছেঃ

 

জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা আকীকাহর রক্তে চুল ভিজাইয়া উহা শিশুর মাথায় রাখিত। ইহা দেখিয়া নবী করীম (স) রক্তের পরিবর্তে রক্ত মিশ্রিত সুগন্ধি লাগাইবার নির্দেশ দিলেন্

 

এই সমস্ত হাদীস হইতে অকাট্যভাবে জানা যায় যে, ‘আকীকাহ’ করা একটি শরীয়াত সম্মত ও ইসলামী পদ্ধতির কাজ। তবে ইহার গুরুত্ব কতটা সে বিষয়ে বিভিন্ন মত জানা যায়। জমহুর ফিকাহবিদদের মতে ইহা সুন্নাত। দায়ূদ যাহেরী এবং তাঁহার অনুসারীগণের মতে ইহা ওয়াজিব। জমহুর ফিকাহবিদগণ দলীল হিসাবে বলিয়াছেন, নবী করীম (স) নিজে এই কাজ করিয়াছেন। তাঁহার এই করা হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইহা সুন্নাত। এই পর্যায়ে হাদীসের এই ভাষাও উল্লখ্যঃ *********** যে লোক নিজের সন্তানের নামে যবেহ করিতে পছন্দ করে- ভাল বাসে, তাহার তাহা করা উচিৎ বা সে যেন তাহা করে। ইহাতে প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট কোন আদেশ নাই। ইহা লোকের ইচ্ছাধীন ব্যাপার। আর দায়ূদ যাহেরীর দলীল হইল হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসের ভাষাঃ ***************** ‘নবী করীম (স) লোকদিগকে আদেশ করিয়াছেন’। ইহা হইতে সুস্পষ্ট রূপে আদেশ বুঝায় এবং নবী করীম (স) কোন কাজের আদেশ করিলে তাহা যে ওয়াজিব হইয়া যায় তাহা তো সর্বজন স্বীকৃত।

 

প্রায় হাদীসেই আকীকাহর জন্য সপ্তম দিনের স্পষ্ট উল্লেখ হইয়াছে বলিয়া মনে করা হইয়াছে যে, ইহাই আকীকার জন্য নির্দিষ্ট দিন ও সময়। কাজেই উহার পূর্বেও ইহা করা যাইবে না, পারেও না। কিন্তু ইমাম নববী বলিয়াছেন *************** সপ্তম দিনের পূর্বেও আকীকাহ করা যায়।

 

সপ্তম দিন ছাড়া আকীকাহ করা যাইবে না, এই কথাটির বিপরীত কথা প্রমাণের জন্য একটি হাদীস পেশ করা হয়। তাহা হইলঃ

 

****************************************

 

নবী করীম (স) নবুয়্যত লাভের পর নিজের আকীকাহ নিজে করিয়াছেন।

 

কিন্তু এই বর্ণনাটি ‘মুনকার’। তাই ইহা গ্রহণ যোগ্য নয় এবং ইহা কোন কথার দলীলও নয়। ইমাম নববীও এই বর্ণনাটিকে ‘বাতিল’ বলিয়াছেন।

 

(**************)

 

মোটকথা, শিশুর জন্মের সপ্তম দিনের মধ্যে আকীকাহ করা, মাথা মুন্ডন করা, নাম রাখা ও খতনা করাই ইসলামের প্রবর্তিত নিয়ম। পারিবারিক জীবনে ইহা ইসলামী সংস্কৃতির অঙ্গ। ইহার বরখেলাফ কাজ হওয়া উচিত নয়।

সন্তানের খাতনা করা

 

****************************************

 

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ পাঁচটি কাজ স্বভাব সম্মত। তাহা হইল খতনা করা, নাভির নীচে ক্ষুর ব্যবহার, মোচ কাটা, নখ কাটা এবং বগলের পশম উপড়ানো।

 

(বুখারী, মুসলিম)

 

ব্যাখ্যাঃ সুস্থ সভ্য ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য জরুরী কার্যাবলী বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (স) নির্দেশ করিয়াছেন। এই কার্যাবলী স্বভাব সম্মত এবং পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবনের জন্য অপরিহার্য। এই সকল কাজ কিংবা ইহার কোন একটি না করা হইলে তাহার পক্ষে সভ্য ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন সম্ভব হইতে পারে না। উদ্ধৃত হাদীসে এই পাচঁটি কাজের উল্লেখ করা হইয়াছে।

 

তন্মধ্যে প্রথমেই বলা হইয়াছে, খাতনা’ করার কথা। ‘খাতনা’ বলা হয় শিশু বা বালকের পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের বাড়তি চামড়া কাটিয়া ফেলা। এই কাজ বিশেষ ভাবে শৈশব বা বাল্য জীবনে সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় ইহাতে ময়লা আবর্জনা পুঞ্জীভূত হইয়া নানা রোগ সৃষ্টির কারণ হইতে পারে। এই কাজ শৈশব কালে সহজেই হওয়া সম্ভব। অন্যথায় যৌবন কালে ‘খাতনা’ করা খুবই কষ্টদায়ক হইতে পারে।

 

উদ্ধৃত হাদীসটিতে মাত্র পাঁচটি কাজের উল্লেখ করা হইয়াছে। রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

কুলিকুচি করা, নাশারন্দ্রের অভ্যন্তর পরিষ্কার করা, মোচ বা গোঁফ কর্তন করা, মিসওয়াক করা, নখ কাটা, বগলের চুল উপড়ানো, নাভির নীচের পশম কামানো এবং খাতনা করা।

 

প্রথমোক্ত হাদীস ও এই শেষোক্ত হাদীসের উল্লেখ সংখ্যার পার্থক্য, ইহা উল্লেখের পার্থক্য, কোন মৌলিক পার্থক্য নহে। রাসূলে করীম (স) একটি হাদীসে মাত্র পাঁচটি কাজের উল্লেখ করিয়াছেন। আর অপর একটি হাদীসে আটটি কাজের উল্লেখ করিয়াছেন। মূলত এই সব কয়টি কাজই স্বাভাবিক কাজ, স্বভাব সম্মত কাজ। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের এই কাজগুলি করা বাঞ্ছনীয়।

 

হাদীসের ****** সহজাত বা জন্মগত (Innate)। মানুষ এই কাজ স্বাভাবিকভাবে করে বা করা উচিত। ইহার অন্যথা বা ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়, কাম্যও নয়। ইহার প্রত্যেকটি সম্পর্কে চিন্তা করিলেই ইহার প্রয়োজনীয়তা সহজেই বুঝিতে পারা যায়।

 

বস্তুত ইসলাম মানুসের যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদর্শ উপস্থাপিত করিয়াছে, তাতে এই স্বাভাবিক ও সহজাত কার্যাবলীর অপরিসীম গুরুত্বের কথা বলা হইয়াছে। ইসলামী পরিভাষায় *********** দুই প্রকারের। একটি **** ঈমানী ফিতরাত। ইহার সম্পর্ক মানুষের দিল-হৃদয় ও অন্তরের সহিত। যেমন অন্তরে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের চেতনা ও তাঁহার প্রতি ঈমান। আর দ্বিতীয়টি হইল ****** হাদীসে উল্লেখিত কাজ সমূহ এই পর্যায়ে গণ্য। প্রথম প্রকারের **** সহজাত প্রবণতা ‘রূহ’ বা আত্মাকে পবিত্র, পরিশুদ্ধ ও সতেজ করে। আর দ্বিতীয় প্রকারের **** মানুষের দেহ ও অবয়বকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ নিরোগ বানাইয়া রাখে। মূলত দ্বিতীয় প্রকারের- ফিতরাত প্র্রথম প্রকারের ফিতরাত বা সহজাত কাজেরই ফসল। ঈমান প্রথম ও প্রধান, দৈহিক পরিচ্ছন্নতা উহার ফল।

 

দেহকে পরিচ্ছন্ন ও নিরোগ বানাইয়া রাখে যে সব সহজাত কাজ, উপরে উদ্ধৃত হাদীসদ্বয়ে সেই কাজসমূহের উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহার প্রত্যেকটি কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুলকুচি করিলে মুখে খাদ্যের কণা জমিয়া থাকিতে পারে না। দাঁত সুস্থ থাকে। নাক বা নাসারন্দ্রে ধুলি ময়লা জমে বাহির হইতে আর ভিতরের দিক হইতে- মস্তিস্ক হইতে নামে নিষ্ঠাবান এবং নাসারন্দ্রের মুখে ময়লা জমিয়া যায়। ইহা পরিষ্কার করিলে দেহের মধ্যে ক্ষতিকর জিনিস জমিতে বা প্রবেশ করিতে পারে না। এই কারণে এই দুইটি কাজ প্রতি অযুর মধ্যে শামিল করা হইয়াছে, যেন অন্তত, পাঁচবারের নামাযের পূর্বেকৃত অযুর সময় এই দুইটি কাজ সম্পন্ন হয়। ইহার পর গোঁফ কাটা। ইসলামে গোঁফ খাটো রাখা ও শ্মশ্রু বা দাড়ি লম্বা রাখা রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ইহার আদেশ করিয়াছেন। হযরত ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

গোঁফ ধারণ ও কর্তন কর এবং দাঁড়ি ছাড়িয়া দাও।

 

অপর হাদীসে বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

মুশরিকদের বিরুদ্ধতা কর। তাই মোচ কাট এবং শ্মশ্রু পুর্ণ কর।

 

অতএব গোঁফ রাখা অন্ততঃ উহাকে উপর ওষ্ঠের বাহিরে আসিতে না দেওয়া এবং শ্মশ্রু বা দাড়ি বাড়িতে দেওয়া ইসলামী শরীয়াতের অন্তর্ভূক্ত। ইহার বিপরীত দাড়ি মুন্ডন ও গোঁড় বড় রাখা মুশরিকদের কাজ, মশরিকী রীতি।

 

দাঁত পরিষ্কার রাখা ও উহাতে ময়লা জমিতে না দেওয়া স্বাস্থ্য রক্ষঅর জন্য অপরিহার্য। অন্যথায় মুখে দুর্গদ্ধের সৃষ্টি হয় এবং খাদ্য হজমে বিশেষ অসুবিধা দেখা দেওয়া নিশ্চিত। নখ কাটা সভ্যতার লক্ষণ। বড় বড় নখ রাখা পশু ও পাখীর কাজ, মানুষের নয়। দুই হাতের নিম্নভাগের গোড়ায়- বগলে- পশম থাকে, তা এবং নাভির নীচের অংশে- যৌন অঙ্গকে কেন্দ্র করে যে পশম জন্মে তা নিয়মিত মুন্ডন করা একান্তই আবশ্যক। হাদীসে ইহাকে সুন্নাতে ইবরাহীমী বলা হইয়াছে। অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আ) সর্ব প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই কাজগুলি করার রীতি-নিয়ম প্রবর্তিত করিয়াছেন।

 

তবে এই পর্যায়ের সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে খতনার উপর। খাতনা করা সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাব, ফিকহর দৃষ্টিতে এই পর্যায়ে দুইটি প্রবল মত রহিয়াছে। ইমাম হাসান আল বসরী, ইমাম আবূ হানীফা এবং কয়েকজন হাম্বলী আলিম বলিয়াছেন, ইহা সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। ইহার দলীল হইল রাসূলে করীম (স)-এর একটি কথা। শাদ্দাদ ইবনে আওস নবী করীম (স)-এর এই কথার বর্ননা করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

পুরুষ ছেলের খতনা করানো সুন্নাত এবং মেয়েদের জন্য সম্মানের ব্যাপার।

 

দ্বিতীয়তঃ নবী করীম (স) খাতনা করানোর কথা অন্যান্য সুন্নাত সমূহের সহিত এক সাথে বলিয়াছেন।

 

ইমাম শবী, রবীয়া, আওজায়ী, ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী, মালিক, শাফেয়ী ও আহমাদ খাতনার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করিয়াছেন। ইমাম মালিক বলিয়াছেন, যে লোক খাতনা করায় নাই, তাহার ইমামতি করা জায়েয নয়। আর হাদীসের দলীল হিসাবে তাঁহারা সকলেই বলিয়াছেন, এক ব্যক্তি নূতন ইসলাম কবুল করিলে রাসূলে করীম (স) তাহাকে বলিলেনঃ

 

****************************************

 

তোমার কুফরী চুল মুন্ডন কর এবং খাতনা করাও।

 

জুহরী বর্ননা করিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

যে লোকই ইসলাম কবুল করিয়াছে সে যেন খতনা করায়, বয়সে বড় হইলেও।

 

এই বর্ণনাটি সনদের দিক দিয়া দুর্বল হইলেও অন্য বহু কয়টি হাদীসের অনুরূপ বর্ণনার কারণে ইহা শক্তিশালী হইয়া  গিয়াছে। এই হাদীস হইতে মনে হয়, তদানীন্তন আরবে সাধারণ ভাবে খাতনা করার প্রচলন ছিল না। অন্যথায় বড় বয়সে ইসলমা গ্রহণকারীকে খাতনা করাইতে বলার এই নির্দেশ দেওয়ার কারণ ছিল না। ইহার জন্য তাকীদ এতই যে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ‘যে খাতনা করায় নাই, তাহার নামায কবুল হইবে না, তাহার যবেহ করা জন্তুর গোশত খাওয়া যাইবে না’।

 

(ইবনে আব্বাস)

 

ইমাম খাত্তাবী বলিয়াছেন, খাতনার কথা যদিও সুন্নাত কাজ সমূহের মধ্যে শামিল করিয়া হাদীসে উল্লেখ করা হইয়াছে তবুও বহু সংখ্যক শরীয়াত বিশেষজ্ঞ (আলিম) বলিয়াছেন, ইহা ওয়াজিব। ইহা দ্বীন-ইসলামের বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। কে মুসলিশ আর কে কাফির, তাহার পার্থক্য নির্ধারক এই খতনা। বহু সংখ্যক খাতনাহীন লোকদের লাশের মধ্যে একজন খাতনা সম্পন্ন লোক পাওয়া গেলে বুঝিতে হইবে, সে মুসলমান। তাহার জানাযা পড়িতে হইবে এবং তাহাকে মুসলমানকের কবরস্থানে দাফন করিতে হইবে।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]