হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) হইত বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোকের তিনটি ভগ্নি আছে; কিংবা আছে দুইটি কন্যা, অথবা দুইট বোন এবং সে তাহাদের সহিত উত্তম সম্পর্ক-সাহচর্য রক্ষা করিয়াছে ও তাহাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করিয়াছে, সে জান্নাত লাভ করিবে।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসে তিনটি বোন বা দুইটি বোন অথবা দুইটি কন্যার কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু এই সংখ্যাটাই এখানে কোন মুখ্য বা অপরিবর্তনীয় ও নিশ্চিত রূপে নির্দিষ্ট বিষয় নয়। সম্ভবত রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটির মূল উদ্দেশ্য হইল কন্যা সন্তান কিংবা ভগ্নিদের ভাল ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও শুভ পন্হায় লালন-পালন করার গুরুত্ব বোঝানো ও এই কাজে লোকদিগকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা-সংখ্যা তাহাদের যাহাই হউক না কেন। তবে মেয়েদের লালন-পালন ও রক্ষণা-বেক্ষণ এমনতেই খুব জটিল ব্যাপার। তাহাতে যদি একাধিক মেয়ে বা একাধিক বোন থাকে, তবে তাহাদের লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ অধিকতর জটিল ও দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে। একের অধীক সংখ্যক বোন বা কন্যার কথা বলিয়া রাসূলে করীম (স) এই অধিক জটিলতার কথা বুঝাইতে চাহিয়াছেন মাত্র।
বস্তুত মেয়েদের লালন-পালন ও রক্ষণা-বেক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রহিয়াছে। তাহাদিগকে শুধু খাওয়া-পরা দিলেই তাহাদের লালন-পালন দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আদায় হয় না। বিশেষত মেয়ে কিংবা বোন যে-ই হউক, তাহাকে বিবাহ দিতে হইবে, পিতা বা ভাইর ঘর হইতে চলিয়া গিয়া তাহাকেক ভিন্ন তর এক পরিবার ও পরিবেশে স্বামীর সহিত ঘর বাঁধিতে ও জীবন কাটাইতে হইবে। তাহার গর্ভজাত সন্তানকে কেন্দ্র করিয়া বংশের একটা নূতন ধারা সূচিত ও নূতন সমাজের সদস্য গঠিত হইয়া উঠিবে। তাহাদের প্রথমে স্ত্রী, গৃহবধু এবং পরে সন্তানের মা হইতে হইবে। কাজেই এই দৃষ্টিতেই সুসম্পন্ন করিতে হইবে তাহাদের লালন-পালন ও শিক্ষণ প্রশিক্ষণ।
শুধু শিক্ষাদান করা-ই তো নয়, সর্বোপরি তাহাদের রক্ষণাক্ষেণ অত্যন্ত দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। মেয়েরা চোট বয়সের থাকা অবস্থায় একরকমের নাজুকতার সম্মুখীন হইতে হয়, আর বয়স বৃদ্ধির ও তাহাদের যৌবনে পদার্পন করার পর এই নাজুকতা শতগুণ বৃদ্ধি পাইয়া যায়। নবী করীম (স) আলোচ্য কথাটি বলিয়া কন্যাদের পিতা বা ভাইদের অতিশয় কঠিন দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া ও সে বিষয়ে তাহাদিগকে সদা সচেতন সতর্ক থাকার কথা বলিয়াছেন, ************ ‘তাহাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করিল’ কথাটির অর্থ ইহাই। এই দিক দিয়া হাদসটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাহারা যদি এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিতে পারে, তবে তাহাদের পক্ষে বেহেশতে যাওয়া সহজ হইবে। অন্যথায় অন্যান্য হাজারও নেক আমল থাকা সত্ত্বেও বেহেশতের পথে ইহাই বিরাট বাধা হইয়া দাঁড়াইতে পারে।
এই হাদীসটির অপর একটি বর্ণনার ভাষা এইরূপঃ
তোমাদের কাহারও তিনটি কন্যার কিংবা তিনটি ভগ্নি থাকিলে ও তাহাদের কল্যাণ সাধন করিলে সে জান্নাতে যাইব্
বুখারীর আদাবুল মুফরাদের উদ্ধৃত বর্ণনায় অতিরিক্ত শব্দ হইল ***** ‘তাহাদের ব্যাপারে সে ধৈর্য ধারণ করিল’। ইবন মাজাহার বর্ণনায় অতিরিক্ত শব্দগুলি হইলঃ
****************************************
তাহাদিগকে খাওয়াইল, পান করাইল ও কাপড় পোশাক পরিতে দিল।
আর তাবারানী গ্রন্হে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর বর্ণনায় অতিরিক্ত শব্দ হইলঃ
****************************************
তাহাদের জন্য ব্যয় করিল, তাহাদিগকে বিবাহ দিল এবং তাহাদিগকে উত্তম আদব-কায়দা ও স্বভাব চরিত্র শিক্ষা দিল।
এই হাদীস হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, পিতার অবর্তমানে পিতার কন্যান-অর্থাৎ বোনদের লালন পালনের দায়িত্ব ভাইদের উপর অর্পিত হয়।
(********)
কন্যা সন্তানের ব্যাপারে অগ্নি পরীক্ষা
****************************************
যে লোক কন্যাদের ব্যাপারে বিপদগ্রস্থ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হইবে এবং তাহাদের ব্যাপারে হইবে অবিচল ধৈর্যশালী, এই কন্যারা তাহার জন্য জাহান্নাম হইতে আবরণ হইয়া দাঁড়াইবে।
(তিরমিযী)
মূল হাদীসের শব্দ হইতেছে **** এই শব্দটি **** হইতে বানানো হইয়াছে। এখানে ইহার যথার্থ তাৎপর্য কি সে বিষয়ে নানা কথা উদ্ধৃত হইয়াছে। প্রশ্ন হইয়াছে, **** শব্দের মূল অর্থ বিপদগ্রস্থ হওয়া। পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার সঠিক তাৎপর্য কি? ইহা কি তাহাদের অস্তিত্বের কারণে?.... কাহারও কন্যা সন্তান হওয়াটাই কি বিপদের কারণ?..... কন্যা হওয়াই যদি পিতার পক্ষে বিপদের কারণ হয়, তাহা হইলে দুনিয়ায় মানব বংশের ধারা চলিবে কি ভাবে? উপরন্তু ইহা কি সাধারণভাবে কন্যামাত্রের ব্যাপারেই প্রযোজ্য, না বিশেষ বিশেষ কন্যার ক্ষেত্রে? কিংবা কন্যাদের কারণে পিতাকে যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হয়, অথবা কন্যাদের যেসব আচরণ ও চরিত্র সাধারণতঃ হইয়া থাকে, এই কথাটি সেই জন্য?
ইবনে বাত্তাল এ বিষয়ে বলিয়াছেন, এই ব্যাপারটি ***** বলা হইয়াছে এই জন্য যে, জাহিলিয়াতের যুগে আরব সমাজের লোকেরা সাধারণত কন্যা সন্তানদেরকে ঘৃণা করিত, কাহারও ঘরে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করিলে তাহার মনে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির উদ্রেক হইত এবং তাহাদিগকে হত্যঅ করিতে উদ্যত হইত। এ কালেও কন্যা সন্তানের জন্ম হইলে পিতা-মাতা বা নিকটাত্মীয়রা খুব উৎফুল্ল ও উল্লাসিত হইয়া উঠে, এমন কথা বলা যায় না। বরং বিভিন্ন দেশের গর্ভবতীয়রা গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ জানিতে অত্যাধুনিত যন্ত্রপাতির সাহায্যে চেষ্টা করিতেছে। তাহার ফলে গর্ভে কন্যা সন্তানের উদ্ভব হইয়াছে জানিতে পারিলে ভারতীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ও চৈনিক বৌদ্ধ সমাজতান্ত্রিবাদী সমাজের এক শ্রেণীল মেয়েরা গর্ভপাত করিয়া উহাকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দেয়। রাসূলে করীম (স)-এর এই শব্দ প্রয়োগ এই প্রেক্ষিতে হইয়াছে বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। এই রূপ বলিয়া তিনি আসলে লোকদিগকে এই মানসিকতা পরিহার করিতে এবং কন্যাদের প্রতি অস্থাশীল হইবার জন্য তাহাদের জীবনের শক্র না হইয়া তাহাদের কল্যাণকামী হওয়ার আহবান জানাইয়াছেন। সেই সঙ্গে তাহাদের অযত্ন করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও তাহাদের হত্যা করা হইতে বিরত রাখিতে চাহিয়াছেন।
হাফেয ইরাকী বলিয়াছেন, ***** শব্দের অর্থ এখানে হইতে পারে ***** যাচাই করা বা পরীক্ষা গ্রহণ। অর্থাৎ কাহারও ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম তাহার জন্য একটা বিশেষ পরীক্ষা। একজনকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাহাকে কন্যা সন্তান দেওয়া হয়। সে পরীক্ষা এই ব্যাপারে যে, সে কন্যা সন্তানের প্রতি বিরুপ ব্যবহার করে, যত্ন করে কি অযত্ন, তাহার সঠিক লালন-পালন করে, না তাহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শণ করে, তাহাকে বন্য পশু সন্তানের মত লাগাম শূণ্য করিয়া ছাড়িয়া দেয়, না গৃহপালিতের মত বাঁধিয়া-ছাঁদিয়াও রাখে ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করে। আর বিশেষ ভাবে কন্যা-সন্তান যে পিতার জন্য এই দিক দিয়া একটা কঠিন পরীক্ষার ব্যাপার তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ নাই। হযরত আবূ সায়ীদ (রা) বর্ণিত আলোচ্য হাদীসে এই কারণেই ****** বলিয়া কন্যাদের ব্যাপারে ভয় করিয়া চলার কথা বলা হইয়াছে। বস্তুত যে লোক আল্লাহকে ভয় করে, সেই কন্যা সন্তানের সুষ্ঠু ও সঠিক লালন-পালন ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব আন্তরিক ভাবে পালন করে এবং তাহা করিয়া সে আল্লাহর নিকট হইতে অশেষ সওয়াবের অধিকারী হয়। তাই এই হাদীসটিতে বলাহ হইয়অছে, ****** ‘এই কন্যারাই তাাহর জাহান্নামে যাওয়ার পথে প্রধান অন্তারায় হইয়া দাঁড়াইবে’। পক্ষান্তরে যদি কোন পিতা কন্যা-সন্তানের প্রতি গুরুত্ব না দেয় যথার্থ লালন-পালন না করে, তাহাকে যদি সৎ শিক্ষা দিয়া চরিত্রবতী না বানায়, অসৎ সংসর্গে পড়িয়া উচ্ছৃংখল হইবার জন্য যদি তাহাকে উম্মুক্ত করিয়া ছাড়িয়া দেয়, উপযুক্ত সময়ে ভাল ছেলের সহিত তাহার বিবাহ না দেয়, তাহা হইলে এই কন্যারাই তাহার জাহান্নামে যাওয়ার বড় কারণ হইয়া দাঁড়াইবে, ইহাতে কোনই সন্দেহ নাই।
আলোচ্য হাদীসে কন্যা সন্তানদের হক ও অধিকার যে অনেক বেশী এবং তাহাদের ব্যাপারে পিতার দায়িত্ব ও কর্তব্য যে অধিক তীব্র ও গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বিশেষ বলিষ্ঠ ভংগীতে বলা হইয়াছে। হাদীসে বহু বচন ব্যবহৃত হইতে দেখিয়া কাহারও মনে এই ধারণা আসা উচিত নয় যে, একাধিক কন্যা হইলেই বুঝি তাহা বিপদের কারণ হয় এবং তাহাদের দ্বারা তাহার পরীক্ষা হইতেছে বলিয়া মনে করা যাইতে পারে, একটি কন্যা হইলে তুমি এই কথা প্রযোজ্য নয়। না-ইহা ঠিক নয়। কেননা কন্যা মাত্রই গুরুদায়িত্ব ও কঠিন পরীক্ষার ব্যাপার। একাধিক হইলে এই গুরুদায়িত্বের মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পাইয়া যায় এবং পরীক্ষাও হয় অধিক তীব্র ও কঠিন। তখন তাহা হয় কঠিন অগ্নি পরীক্ষা।
কন্যাদের ব্যাপারে এইরূপ বলার একটা নৃতাত্বিক কারণও আছে। তাহা এই যে, কন্যা সন্তান পুত্র সন্তানের তুলনায় জন্মগতভাবেই দুর্বল হইয়া থাকে। কেননা একটা ছেলে সাধারণভাবে দশ বার বৎসর বয়সে যতটা কর্মক্ষম হয়, একটা মেয়ে তাহা হয় না। দৈহিক সংস্থা সংগঠনের জন্মগত পার্থক্যের কারণেই এই কথা অনস্বীকার্য।
(*****************)
সন্তানদের প্রতি স্নেহ বাৎসল্য
****************************************
হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনুজ্জুবাইরকে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলেন মক্কা শরীফে থাকা অবস্থায়। তিনি বলিয়াছেন, আমি মক্কা হইতে যখন হিজরত করার উদ্দেশ্যে বাহির হইলাম, তখন আমি গর্ভমাসসমূহ পুর্ণ করিতেছিলাম। পরে মদীনায় আসিয়া আমি কুবা’য় অবস্থান গ্রহণ করিলাম এবং এই কুবা’য়ই আমি তাহাকে প্রসব করিলাম। পরে আমি তাহাকে লইয়া রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলাম এবং তাহাকে তাঁহার কোলে রাখিয়া দিলাম। তিনি একটি খেজুর আনিতে বলিলেন। তিনি খেজুরটি চিবাইয়া তাহার মুখের মধ্যে ঢুকাইয়া দিলেন। আবদুল্লাহর পেট সর্বপ্রথম যে জিনিস প্রবেশ করিল, তাহা হইল রাসূলে করীম (স)-এর মুখের পানি। অতঃপর তিনি খেজুরটিকে ‘তাহনীক’ করিলেন। ইহার পর তিনি তাহার জন্য দোয়া করিলেন। তাহার জীবনে বরকত হওয়ার জন্যও দোয়া করিলেন। আবদুল্লাহই ছিলেন প্রথম সন্তান, যে ইসলামের যুগে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহাতে সকল লোক খুব বেশী উৎফুল্ল আনন্দিত হইয়াছিল। কেননা তাহাদিগকে বলা হইয়াছিল যে, ইয়াহুদীরা তোমাদের উপর যাদু করিয়াছে, ফলে তোমাদের ঘরে আর সন্তান জন্মগ্রণ করিবে না।
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ সদ্য প্রসূত আবদুল্লাহ ইবনুজ্জুবাইরকে রাসূলে করীম (স) কিভাবে গ্রহণ করিলেন এবং তাহাকে লইয়া তিনিক কি কি করিলেন, উপরোদ্ধৃত হাদীসটিতে তাহারই বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। ইহা হইতে জানা যায়, নবী করীম (স) প্রথমে তাহাকে নিজের কোলে লইলেন। তাহার পর একটি খেজুর আনিতে বলিলেন। তিনি খেজুরটি প্রথমে নিজে মুখে রাখিয়া খুব করিয়া চিবাইলেন ও উহাকে নরম ও দ্রবীভূত করিলেন। ইহার পর তিনি সদ্যজাত শিশুর মুখে নিজের মুখের পানি দিয়া ভিজাইয়া দিলেন। ইহা করার পর তিনি চিবানো খেজুরটি দিয়া ‘তাহনীক’ ***** করিলেন। তাহার পর তিনি আবদুল্লাহর জন্য দোয়া করিলেন, তাহার প্রতি ‘তাবরীক’ করিলেন। তাবরীক করা অর্থ জীবনে ও জীবনের সব কাজে-কর্মে ‘বরকত’ হওয়ার জন্য বলা। আর ‘বরকত’ অর্থ শ্রীবৃদ্ধি। এই দুইটি দোয়া পর্যায়ের কাজ। অর্থাৎ রাসূলে করীম (স) তাহার সাধারণ কল্যাণ সাধিত হওয়ার জন্য দোয়া করার পর তাহার জীবনে-জীবনের যাবতীয় কাজে-কর্মে বিপুলভাবে শ্রী-বৃদ্ধি সাধিত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করিলেন।
বস্তুত মুসলিম সমাজে সদ্যজাত শিশুর প্রতি কিরূপ আচারণ করা বাঞ্ছনীয়, তাহার মোটামুটি দিগদর্শন এই হাদীসটি হইতে লাভ করা যায়। এক কথায় এই সমস্ত কাজকে বলা হয়, ‘তাহনীক’। এই পর্যায়ের কাজের মধ্যে প্রথম কাজ হইল, সদ্যজাত শিশুকে সমাজের কোন শ্রদ্ধাভাজন সম্মানিত ব্যক্তির-পুরুষ বা মহিলার- কোলে দিতে হইবে। সে ব্যক্তি প্রথমে শিশুটির মুখে নিজের মুখের পানি দিবেন। পরে একটি খেজুর ভাল ভাবে চিবাইয়া নরম করিয়া শিশুটির মুখের তালুতে চাপিয়া বসাইয়া ও লাগাইয়া দিবেন এবং তাহার পর উহার সাধারণ সঠিক কল্যাণ এবং জীবনের সর্বকাজে সর্বক্ষেত্রে শ্রী-বৃদ্ধি হওয়ার জন্য মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করিবেন। সদ্যপ্রসূত শিশুর সহিত এইরূপ আচরণ তাহার প্রতি প্রকৃত ও সত্য নিষ্ঠ স্নেহ-বাৎসল্যের প্রতীক। বস্তুত ইহাই ইসলামী সংস্কৃতি সমৃদ্ধ আচরণ।
বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন, সদ্য জাত শিশুর প্রতি এইরূপ আচরণ করা মুস্তাহাব- অতীব উত্তম কাজ ও আচরণ। এই কাজে সর্বত্র খেজুর ব্যবহার করিতে হইবে এমন কোন ধরাবাঁধা কথা নাই। খেজুর না পাইলে তৎপরিবর্তে অনুরূপ অন্য যে কোন জিনিস ব্যবহার করা যাইতে পারে, তবে তাহা প্রথমতঃ মিষ্ট হইতে হইবে এবং দ্বিতীয়তঃ চিবাইয়া নরম করা ও গলাইয়া দিতে হইবে- সে জিনিসটির এই রকমই হইতে হইবে। খেজুর পাওয়া না গেলে এতদ্দেশ্যে সাধারণ ভাবে প্রাপ্য উত্তম চকোলেট এই কাজে ব্যবহৃত হইতে পারে। এই জিনিসটি শিশুর মুখের তালুতে লাগাইয়া দিলে মুখের পানির সহিত উহা গলিয়া গলিয়া ধীরে ধীরে মিলিয়া মিশিয়া যাইতে থাকিবে। ফলে শিশুটি দীর্ঘক্ষণ স্বয়ংক্রিয় ভাবে মিষ্টতা পান করিতে পারিবে। এই কাজটি করিবেন এমন নেক ব্যক্তি নিকটে উপস্থিত না থাকিলে শিশুটিকে তাহার নিকটে লইয়া যাইতে হইবে এবং সদ্যজাত শিশুকে পাইয়া সংশ্লিষ্ট সকলেরই আনন্দিত ও উৎফুল্ল উল্লাসিত হইয়া উঠা বাঞ্ছনীয়। তাহাতে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি যেমন সন্তুষ্টি প্রকাশিত হইবে, তেমনি প্রকাশ পাইবে বিশ্ব মানবতা ও মানব বংশবৃদ্ধির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা। ইহা ইসলামী ভাবধারার একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক। রাসূলে করীম (স) নিজে সদ্য জাত শিশুর প্রতি এইরূপ আচরণ করিতেন। এই কারণে এরূপ করার সর্বসম্মতিক্রমে রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত।
হযরত আনাস (রা) বলিয়াছেন, ‘হযরত আবু তালহা আনসারীর পুত্র আবদুল্লাহ যখন জন্মগ্রহণ করিলেন, তখন আমি তাঁহাকে লইয়া নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি খেজুর আনিতে বলিলেন এবং খেজুর নিজের মুখে পুরিয়া চিবাইতে লাগিলেন। পরে শিশুটির মুখ খুলিয়া উহার তালুতে লাগাইয়া দিলেন। শিশুটি জিহবা নাড়িয়া চাটিতে ও মিষ্টতা পান করিতে লাগিল।
(মুসলিম)
সন্তানের শিক্ষা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব
****************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিতেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে সন্তানই জন্মগ্রহণ করে তাহার জন্ম হয় স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম ও ভাবধারার ভিত্তিতে। পরে তাহার পিতা-মাতা তাহাকে ইয়াহুদী বানায়, বানায় খৃষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক। ইহা ঠিক তেমন যেমন চতুষ্পদ জন্তু পূর্ণাঙ্গ, সুগঠিক দেহ সংস্থা সম্পন্ন বাছুর প্রসব করে। তোমরা কি উহার মধ্যে কোন অঙ্গহানী বা কর্তিত অঙ্গ দেখিতে পাও? অতঃপর আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেন, তোমার ইচ্ছা হইলে পড়ঃ আল্লাহর সৃষ্টি ব্যবস্থা ও ভাবধারা, যাহার উপর ভিত্তি করিয়া আল্লাহ তা’আলা মানুষ জাতিকে সৃষ্টি করিয়াছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন রূপ পরিবর্তন নাই।
(মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ ইহা একটি অতীব প্রসিদ্ধ ও দার্শনিক তত্ত্ব সমৃদ্ধ হাদীস। হাদীসটি সাধারণভাবে সমস্ত জীব সন্তানের এবং বিশেষভাবে মানব সন্তানের জন্ম সংক্রান্ত মৌলিক নিয়ম ও ভাবধারার কথা বলা হইয়াছে এবং উহার পর দেখানো হইয়াছে, উত্তম কালে উহার দেহে বা চরিত্রে প্রবৃত্তিতে কিভাবে পরিবর্তন বা বিকৃতি আসে।
রাসূলে করীম (স)-এর প্রথম কথা হইল, মানব শিশু-সন্তান আল্লাহর স্থায়ী নিয়মে ও স্বভাবজাত ভাবধারায়ই জন্মগ্রহণ করে। ইহার পর তাহার পিতা-মাতারই কর্তব্য ও দায়িত্ব হয় তাহারা এই শিশুকে কিভাবে গড়িয়া তুলিবে। তাহারা যেভাবে গড়িতে চাহিবে, শিশু ধীরে ধীরে সেই ভাবে গড়িয়া উঠিবে। ইহাই স্বাভাবিক।
এই মূল কথাটি বুঝাইবার জন্য নবী করীম (স) একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়াছেন। দৃষ্টান্তটি সমাজের আশ-পাশ হইতে গৃহীত ও সহজবোধ্য। কোন জটিল তত্ত্ব নয়। মানুষের চারি পাশে যে সব জন্তু-জানোয়ার থাকে, তাহাতে দেখা যায় সে জন্তু-জানোয়ার যে সব বাছুর প্রসব করে, তাহা সম্পূর্ণ নিখুঁত হইয়া জন্ম গ্রহণ করে। উহাতে কোন অঙ্গহানি দেখা যায় না, হাত-পা নাক-কানে কোন কাটা-ছেড়াও লক্ষ্য করা যায় না। দেখা যায় না কোন রূপ অসম্পূর্ণতা বা আঙ্গিক ও দৈহিক কোনরূপ ক্রটি-বিচ্যুতি। ইহাই সৃষ্টির সাধারণ নিয়ম। মানব সন্তানও ঠিক এইরূপ। জন্তু-সন্তান যেমন দৈহিক দিক দিয়া ক্রটিহীন ও খুঁতমুক্ত হইয়া জন্মগ্রহণ করে, মানব-সন্তান নৈতিকতা বা ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়া অনুরূপ নিখুঁত ও ক্রটিহীত অবস্থায় জন্ম নেয়। যাহা স্বাভাবিক, যাহা স্বভাবের নিয়ম ও ভাবধারা সম্পন্ন, মানুষের স্বভাব প্রকৃতিও সেইরূপ থাকে। সমগ্র বিশ্ব-স্বভাবের মর্মকথা যে আল্লাহ বিশ্বাস ও আল্লাহর আনুগত্য, মানব সন্তানও সেই ভাবধারাসম্পন্ন থাকে উহার জন্ম মুহূর্তে। জন্তু-সাবকের দৈহিক ক্রটিহীনতার দৃষ্টান্ত দিয়া মানব-সন্তানের নৈতিক ও প্রকৃতিগত ক্রটিহীনতা বুঝাইতে চাওয়া হইয়াছে এই হাদীসটিতে। কিন্তু ইহার পর জন্তু-জানোয়ারের দেহে যেমন বিকৃতি ও ক্রটি সূচিত হয়, মানব-শিশুর ক্রমশ বড় হইতে থাকাকালে তাহার স্বভাব, চরিত্র, প্রবণতা ও হৃদয়-বৃত্তিতে বিকৃতি ও বিচ্যুতি সংঘটিত হয়। জন্তুর সন্তানের দেহে বিকৃতি আসে সমাজের লোকদের হাতে প্রচলিত নিয়ম-প্রথার প্রভাবে ও কারণে। আর তাহা এই যে, উহার কান চিড়িয়া দেওয়া হয়, নাক ছেঁদা করা হয়। হাতে পায়ে নানাভাবে কাটার চিহ্ন অংকিত করা হয়। এইরূপ করা ছিল তদানীন্তন আরব জাহিলিয়াতের জামানায় মুশরিক লোকদের দেব-দেবী পূজার একটা বিশেষ পদ্ধতি। তাহাদের উপাস্য দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই তাহারা এইরূপ করিত। এইরূপ করা না হইলে সে জন্তু শাবক চিরকাল অক্ষত, নিঃখুত ও ক্রটিহীন দেহ লইয়াই বাঁচিয়া থাকিতে পারে। মানব শিশু সন্তানের নৈতিকতা স্বভাব প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি-প্রবণতার অনুরূপ বিকৃতি ও বিচ্যুতি আসে পরিবার ও সমাজ পরিবেশ, দেশ চলিত প্রথা ও রাষ্ট্রীয় আইন কানুনের কারণে। আর তাহার সূচনা হয় পিতা মাতার নিকট হইতে। কেননা পিতা-মাতার ঔরসে ও গর্ভে তাহার জন্ম। জন্ম মূহূর্ত হএত সে মায়ের বুকের অপত্য স্নেহ সুধা ও স্তন-দুগ্ধের অমৃত লাভ করে, লাভ করে পিতার অসীম আবেগ মিশ্রিত স্নেহ বাৎসল্য বরা ক্রোড়। এই কারণে শিশু সন্তান পিতা-মাতার নিকট হইতে সামাজিক ও নৈতক প্রভাবও গ্রহণ করে গভীর ভাবে। তখন পিতা-মাতা শিশু সন্তানকে যেরূপ আদর্শে ও ভাবধারায় গড়িয়া তুলিতে ইচ্ছুক হয়, সন্তান ঠিক সেই ভাবধারা লইয়াই লালিত-পালিত ও বড় হইয়া উঠে। এই প্রেক্ষিতেই বলা হইয়াছে, তাহার পিতা-মাতা তাহাকে ইয়াহুদী বানায়, খৃস্টান বানায় বা অগ্নিপূজক বানায়। পিতা-মাতা ইয়াহুদী বানায়, অথচ ইয়াহুদী হইয়া সে জন্মায় নাই, ইয়াহুদী হইয়া সত্য দ্বীন-বিদ্বেষী বা ইসলামের দুশমন হইয়া জীবন যাপন করিবে এ উদ্দেশ্যে তাহাকে সৃষ্টি করা বা তাহার জন্ম অনুষ্ঠিত হয় নাই। পিতা মাতা খৃস্টান বানায় অথচ সে শিশু বড় হইয়া ত্রীত্ববাদে বিশ্বাসী হইবে, হযরত ঈসা (আ) কে আল্লাহর নবী-রাসূল বিশ্বাস করার পরিবর্তে (নায়ুযুবিল্লাহ) আল্লাহর পুত্র বলিয়া বিশ্বাস করিবে, অথবা, এক আল্লাহর বান্দেগী করার পরিবর্তে আগুনের পূড়া ও উপাসনা করিবে কিংবা নিজ হাতে গড়া মূর্তি বা চাঁদ সূর্য পাহাড় বৃক্ষের পূড়া করিবে- এই জন্য তাহার জন্ম হয় নাই। তাহাকে তো সৃষ্টি করা হইয়াছে এক আল্লাহর বান্দেগী করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই ইহা করিবে না- করিতে জানে না শুধু এই কারণে যে, তাহার পিতা-মাতা তাহাকে স্বভাব নিয়ম ও প্রকৃতি অনুযায়ী এক আল্লাহর বান্দাহ বানাইবার পরিবর্তে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্ম বা মতাবলম্বী বানাইয়া দিয়াছে। শিশু বড় হইয়া কি হইবে তাহা পিতা-মাতার উপর নির্ভরশীল। অতএব শিশুদের উত্তম চরিত্রগঠন ও ইসলামী আদর্শবাদী বানাইয়া তোলা পিতা-মাতার উপর অর্পিত কঠিন দায়িত্ব। এই দায়িত্ব শুরু হইতেই তাহাদিগকে পালন করিতে হইবে। অন্যথায় তাহাদিগকে আল্লাহর নিকট কিয়ামতের দিন কঠিন জওয়াবদিহির সম্মুখীন হইতে হইবে। এই হাদীসের যথার্থতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কুরআন মজীদের যে আয়াতটির উদ্ধৃতি দিয়াছেন, আলোচনায় লিখিত সমস্ত কথাই সেই প্রেক্ষিতে লেখা। ইহা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, মূলত হাদীসটি কুরআন নিঃসৃত ও কুরআন সমর্থিত। কুরআনের এই আয়াতটিরই সাধারণ বোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা হইতেছে এই হাদীসটি। আয়াতটি স্বয়ং আল্লাহর বাণী; আর হাদীসটি রাসূল (স)-এর মুখে উহারই ব্যাখ্যা।
****************************************
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক আমাদের শিশু ও ছোট বয়সের লোকদিগকে স্নে বাৎসল্য দেয় না, আমাদের মধ্যে যাহরা বেশী বয়সের তাহাদিগকে সম্মান করে না এবং ভাল কাজের আদেশ করে না ও মন্দ কাজ হইতে নিষেধ করে না, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।
(মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ)
ব্যাখ্যাঃ ছোট শিশু আর বয়স্ক বালক-বালিকাদের প্রতি দয়া ও স্নেহ-বাৎসল্য প্রদর্শন সাধারণভাবে সব মানুষেরই কর্তব্য। অনুরূপ কর্তব্য হইতেছে পরিবারের ও সমাজের বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন। সাধারণ ভাবে ইহাই সমস্ত মানুষের জন্য রাসূল (স)-এর উপদেশ। এই প্রেক্ষিতে শিশু সন্তানের প্রতি গভীর স্নেহ মমতা পোষণ করা সেই শিশু সন্তানের পিতা-মাতার পক্ষে যে কতবড় দায়িত্ব ও কর্তব্য তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। পিতা মাতার শুধু জৈবিক কর্তব্যই ইহা নয়, ইহা তাহাদের নৈতিক দায়িত্বও।
শিশু বালকদের প্রতি স্নেহ আর বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান মূলত একই ভাবধারার এপিঠ ওপিঠ, শুরু অবস্থা ও পরিণত অবস্থা। আজ যে শিশু সকলের ছোট, কালই সে অনেকের তুলনায় বড় এবং ৩০-৪০ বৎসর পর তাহারাই সমাজের বড় ও বয়স্ক ব্যক্তি। যে সমাজে শিশু বালকদের প্রতি স্নেহ মমতা থাকে, সে সমাজে বয়োঃবৃদ্ধদের প্রতিও থাকে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ। পক্ষান্তরে যে সমাজে প্রথমটি থাকে না, সে সমাজে দ্বিতীয়টিরও প্রচণ্ড অভাব ও অনুপস্থিতি অনিবার্য। যে সমাজ মানব শিশু অবাঞ্ছিত, সে সমাজে বয়োঃবৃদ্ধরা চরমভাবে উপেক্ষিত, নিদারূন দুর্দশাগ্রস্থ, নিরুপায়, অসহায় ও লাঞ্ছিত।
রাসূলে করীম (স) যে সমাজ-আদর্শ পেশ করিয়াছেন, তাহাতে মানুষের সার্বিক মর্যাদা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। সে মানুষ সদ্যজাত শিশু কিংবা অল্প বয়স্ক বালক অথবা বয়োঃবৃদ্ধ, উপার্জন-অক্ষম- যাহাই হউক না কেন। সে স মাজে কোন অবস্থায় মানুষ উপেক্ষিত ও অবহেলিত হইতে পারে না। মানবতার প্রতি ইহা নির্বিশেষে ও সুগভীর মমত্ব ও শ্রদ্ধাবোধেরই প্রমাণ। এই মানবতাবাদী ও মানব কল্যাণকামী ভাবধারার কারণেই ন্যায়ের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ইসলামী সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তির কর্তব্য। এই কর্তব্য ব্যক্তিগতভাবে ও এ কর্তব্য সামষ্টিভাবেও। মানুষকে ভাল বাসিতে হইবে, এই জন্যই মানুষকে ভাল কাজ করার পথ দেকাইতে হইবে। ভাল কাজের উপদেশ দিতে হইবে ও ব্যাপক প্রচার চালাইত হইবে, কল্যাণকর পথে পরিচালিত করিতে হইবে ব্যাপক বিপুল জনতাকে। কেননা ভাল কাজ করা ও কল্যাণকর পথে চলার ইহকালীন পরিণাম যেমন কল্যাণময়, তেমনি পরকালীন পরিণতিও। অনুরূপভাবে মানুষকে ভালবাসিতে হইবে বলিয়াই অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে হইবে, অন্যায়ের যে অন্যায়ত্ব তাহা সকলের সম্মুখে বিশ্লেষণ করিতে হইবে। লোকদের বুঝাইয়া দিতে হইবে, প্রচার করিতে হইবে যে, ইহা অন্যায়, ইহা করা উচিত নয়। সে অন্যায় হইতে লোকদিগকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিতে হইবে এবং তাহা হইত বিরত রাখিতে হইবে। বস্তুত শিশুদের প্রতি স্নহ মমতা দান, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান প্রদর্শন, ন্যায়ের প্রচার আদেশ ও প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ বিশ্লেষণ, নিষেদ ও প্রতিরোধ- এই চারওটি কাজ পরস্পর সম্পৃক্ত, সম্পূরক ও একই ধারাবাহিকতার শৃংকলে আবদ্ধ। এই চারওটি কাজ সামাজিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইহা যেমন পরিবারের ক্ষুদ্র সংকীর্ণ পরিবেশের মধ্যে হইতে হইবে, তেমনি হইতে হইবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। যে সমাজ বা রাষ্ট্র শিশু সন্তানের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে না, সে সমাজে ও রাষ্ট্রে বয়োবৃদ্ধদের চরম দূর্গতি অবশ্যম্ভাবী। পরন্তু সে সমাজ-রাষ্ট্র ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা না হইয়া হয় ন্যায়ের প্রতিরোধকারী। অন্যায়ের প্রতিরোধ করা উহার পক্ষে সম্ভব হয় না, অন্যায় ও পাপের সয়লাবে সমস্ত মানবীয় মূল্যবোধ ও মানবিকতার পয়মাল হইতে দেওয়াই হয় উহার একমাত্র পরিচয়।
তাই রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ এই চারটি কাজ যে করে না, সে আমার মধ্যে গণ্য নয়। হাদীসের শব্দ হইল *****। ইহার সঠিক তাৎপর্য কি? হাদীসবিদদের মতে ইহার একটি অর্থ হইল; ***************** ‘সে (লোক-সমাজ ও রাষ্ট্র) আমার নীতি আদর্শ ও পন্হা বা পথ অনুসারী নয়। ‘কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, সে রাসূলের দ্বীন হইতে বহিষ্কৃত হইয়া গিয়াছে বা বাহির করিয়া দেওয়া বা দিতে হইবে। এতটা কড়া অর্থ ইহার নয়। কিন্তু এইরূপ বলার তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। ইহাতে তীব্র শাসন ও তিরষ্কার নিহিত। পিতা যেমন পুত্রের কোন কাজে অসন্তুষ্ট হইয়া বলেঃ তোর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই’ কিংবা তুই যদি এই কাজ কর তাহা হইলে তুই আমার ছেলে নয়। রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটিও তেমনি। পিতার উক্তি কথায়ই যেমন পিতা-পুত্রের সম্পর্ক চিরতরে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়া উদ্দেশ্য হয় না- ইহাও তেমনি। কিন্তু তাহা সত্বেও এই চারটি কাজ না করিলে রাসূলে করীম (স)-এর আদর্শ লংঘিত হয় তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
অন্য কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহার অর্থ ************* ‘সে আমার উপস্থাপিত পূর্ণ দ্বীন-ইসলামরে অনুসারী নয়’। অর্থাৎ সে রাসূলের উপস্থাপিত দ্বীনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বা শাখাকে অমান্য করিয়াছে, যদিও মূল দ্বীন এখন পর্যন্ত অস্বীকৃত হয় নাই। ইহা সত্ত্বেও রাসুলে করীম (স) তাহাকে নিজের উম্মতের মধ্যে গণ্য করেন নাই। ইহা অতীব সাংঘাতিব কথা।
(************)
সন্তানের উত্তম প্রশিক্ষণ দান
****************************************
হযরত সায়ীদ ইবনুল আ’চ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ পিতা সন্তানকে উত্তম স্বভাব-চরিত্রের তুলনায় অধিক উত্তম ভাল কোন দান-ই দিতে পারে না।
(মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ রাসূলে করীম (স)- এর ইন্তেকালের সময় সায়ীদ ইবনুল আ’চ মাত্র নয় বৎসরের বালক ছিলেন। তিনি নিজের কর্ণে রাসূলে করীম (স)-এর এই কথাটি শুনিয়াছেন এমন কথা মনে করা যায় না। ফলে এই হাদীসটি সনদের দিক দিয়া ‘মুরসাল’- যে সাহাবী এই হাদীসের প্রথম ও মূল বর্ণনাকারী তাঁহার নাম এখানে উহ্য। কিন্তু এহা যে নবী করীম (স)-এর বাণী তাহাতে একবিন্দু সন্দেহ নাই। কেননা এই মর্মের ও এই প্রসঙ্গের বহু বাণী সাহাবীদের সনদে বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, যাহা তাঁহারা সরাসরিভাবে রাসূলে করীম (স)-এর মুখে শুনিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
হাদীসটির সংক্ষিপ্ত কথনে নবী করীম (স) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়াছেন। পিতা স্বাভাবিক ভাবে পুত্র-কন্যার জন্য অনেক বিত্ত সম্পত্তি রাখিয়া যাইডতে চাহে ও চেষ্টা করে। কিন্তু বিত্ত-সম্পত্তি দেওয়া পিতার বিশেষ কোন দেওয়া নয়। এই দেওয়া কোন কৃতিত্বের দাবি রাখে না। যদি সন্তানকে উত্তম চরিত্র ও ভাল আদব কায়দা শিক্ষা দিতে না পারে, তবে তুলনামূলকভাবে ইহাই তাহার সর্বোত্তম ও ভাল আদব-কায়দা সম্পন্ন সন্তানের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইবে না। চরিত্রহীন ছেলের হাতে যদি বিপুল ধন-সম্পদ রাখিয়অ যায়, তাহা হইলে সে কেবল ধন-সম্পদই বিনষ্ট করিবে না, নিজেকেও ধ্বংস করিবে। তাই চরিত্র শিক্ষাদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা সর্বাধিক।