সন্তানদের প্রতি পিতার অর্থনৈতিক কর্তব্য শিশু বিকাশ ও পারিবারিক পরিবেশ

হযরত সায়াদ ইবনে আবূ অক্কাচ (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স) আমাকে দেখিবার জন্য আসিলেন। এই সময় আমি মক্কায় অবস্থান করিতেছিলাম। তিনি যে স্থান হইতে হিজরত করিয়া গিয়াছেন, সেই স্থানে মৃত্যুবরণ করাকে অপছন্দ করিতেছিলেন। রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ আল্লাহ তা’আলা ইবনে আফরাকে রহমত দান করুন। আমি বলিলামঃ হে রাসূল! আমি আমার সমস্ত ধন-সম্পদ অছিয়ত করিতেছি। তিনি বলিলেন, না। আমি বলিলাম, তাহা হইলে অর্ধেক? বলিলেন, না। বলিলাম, এক তৃতীয়াংশ, বলিলেনঃ হ্যাঁ, এক তৃতীয়াংশ করিতে পার এবং ইহা অনেক। তুমি যদি তোমার উত্তরাধিকারীদিগকে সচ্চল ও ধনশালী রাখিয়া যাইতে পার তবে তাহা তাহাদিগকে  নিঃস্ব দরিদ্র ও লোকদিগকে জড়াইয়া ধরিয়া ভিক্ষাকারী বানাইয়া রাখিয়া যাওয়া অপেক্ষা অনেক উত্তম। আর তুমি যাহা কিছুই ব্যয় কর, তাহা সাদকা হইবে। এমন কি, যে খাদ্যমুঠি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলিয়া দাও তাহাও। আল্লাহ ততোমাকে শীঘ্র ভাল করিয়া দিবেন। অতঃপর তোমার দ্বারা বহু লোক উপকৃত হইবে এবং অন্যান্য বহু লোক ক্ষতিগ্রস্থ হইবে। এই সময় হযতর সায়াদ ইবনে অক্কাচের একটি কন্যা ছাড়া আর কোন সন্তান ছিল না।

 

(বুখারী, মুসলিম, আবূ দায়ূদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

 

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সায়াদ ইবনে আবূ অক্কাচ (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি নিজেই রাসূলে করীম (স)-এর একটি কর্থা বর্ণনা করিয়াছেন। মূল কথাটি বর্ণনা প্রসঙ্গে কথাটির পটভূমিও তিনি বলিয়াছেন। এই হাদীস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম বুখারী তাঁহার একই গ্রন্হের অন্তত দশটি প্রসঙ্গে ও স্থানে এই হাদীসটি বিভিন্ন বর্ণনাকারী সূত্রে উদ্ধৃত করিয়াছেন। সিহাহ সিত্তার প্রত্যেক গ্রন্হেই ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে।

 

হাদীসটির পটভূমি স্বরূপ জানা গিয়াছে, বিদায় হজ্জ উপলক্ষে নবী করীম (স) লক্ষাধিকক সাহাবী সমভিব্যহারে মক্কা শরীফ গমন করিয়াছেন। এই সময় হযরত সায়াদ ইবনে আবূ আক্কাচ (রা) কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া পড়েন। এই রোগের প্রকৃত রূপ কি ছিল? তাহা অপর একটি বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে। রোগের রূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে হযরত সায়াদ (রা) বলিয়াছেনঃ ***************** ‘আমি এই রোগের দরুন মৃত্যুমুখে উপনীত হইয়া গিয়াছি’। অর্থাৎ এই রোগের অতিশয্যে তিনি জীবনে বাঁচিয়া থাকার ব্যাপারে সন্দিহান এবং নিরাশ হইয়া গিয়াছিলেন। এই সময় রাসূলে করীম (স) তাঁহাকে দেখিবার জন্য তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। এইখানে মূল হাদীসে একটি বিচ্ছিন্ন বাক্য বলা হইয়াছে। তাহা হইলঃ তিনি যে স্থান হইতে হিজরত করিয়া চলিয়া গিয়াছেন সেই স্থানে মৃত্যু বরণ করিতে তিনি নিতান্ত অপছন্দ করিতেছিলেন। এই তিনি বলিয়া কাহাকে বুজানো হইয়াছে? জওয়াবে বলা যায়, ‘তিনি’ বলিতে স্বয়ং নবী করীম (স) ও হইতে পারেন, হইতে পারেন হযরত সায়াদ। কেহ কেহ বলিয়ানে, বাক্যটি যেভাবে বলা হইয়াছে তাহাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এই অপছন্দকারী নবী করীম (স)। তিনি হযরত সায়াদের রোগাক্রান্ত হওয়ার কথা জানিতে পারিয়া বিশেষ উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন, কেননা মৃত্যু অবধারিত ও সময় নির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও একবার ত্যাগ করিয়া যাওযা এই স্থানে-মক্কায়- হযরত সায়াদ কিংবা তাঁহার ন্যায় অন্য কোন মুহাজির সাহাবী মৃত্যু বরণ করুক তাহা নবী করীম (স) পছন্দনীয় হইত পারে না। কিংবা  এই স্থানটি জন্মভূমি হইলও এখন তাঁহার স্থায়ী বাসস্থান মক্কা নয়-মদীনা। মক্কা হইতে তো তিনি হিজরত করিয়া গিয়াছিলেন। হজ্জব্রত উদযাপনের উদ্দেশ্যে এখানে কিছুদিনের জন্য আসিয়াছেন মাত্র। ইহা এখন তাঁহাদের জন্য বিদেশ। এই বিদেশ বেভূঁইয়ে প্রবাসী অবস্থায় কাহারও মৃত্যু হউক, তাহা কাহারওই পছন্দনীয় হইতে পারে না। এই হইল এই বাক্যটির তাৎপর্য।

 

এই অপছন্দকারী হযরত সায়াদও হইতে পারেন। কেননা মুসলিম শরীফে এই হাদীসটিতে উদ্ধৃত হইয়াছে, তিনি নবী করীম (স)কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

 

****************************************

 

হে রাসূল যে স্থান হইতে আমি হিজরত করিয়া গিয়াছি সেখানেই আমার মৃত্যু হয় নাকি, যেমন সায়াদ ইবনে খাওলা’র মৃত্যু হইয়াছিল, আমি ইহাই ভয় করিতেছি।

 

অপছন্দকারী হযরত সায়াদ তাহাই এ উদ্ধৃত হইতে স্পষ্ট ভাষায় জানা গেল। রাসূলে করীম (স) হযরত সায়াদের রোগাক্রান্ত অবস্থা দেখিয়া বলিলেনঃ

 

****************************************

 

আল্লাহ ইবনে আফরাকে রহমত দান করুন।

 

ইবনে আফরা- আফরা’র পুত্র- বলিতে হযরত সায়াদ (রা)কেই বুঝাইয়াছেন। তাহা হইলে ‘আফরা’ কে? দায়ূদী বলিয়াছেন, ইহা অরক্ষিত শব্দ। হাফেয দিমইয়াতী বলিয়াছেন, ভূল বশতঃ এই রূপ বলা হইয়াছে। নাসায়ী গ্রন্হে ‘সায়াদ ইবনে খাওলা’ বলা হইয়াছে। কেননা তিনি মদীনা হইতে মক্কায় আসিয়অ মৃত্যু বরণ করিয়াছিলেন। আল্লামা আইনী লিখিয়াছেন, ইহা হযরত সায়াদের মায়ের নাম হইতে এবং এই হিসাবেই রাসূলে করীম (স) এই বাক্যটি বলিয়াছেন।

 

হযরত সায়াদ রাসূলে করীম (স) কে বলিলেনঃ ************** ‘আমি আমার সমস্ত ধন-সম্পদ দান করিয়া দিব’। বাক্যটি সংবাদমূলক। অর্থাৎ হযরত সায়াদ (রা) তাঁহার সমস্ত দান করিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাসূলে করীম (স)কে জানাইলেন। কিন্তু অপর একটি বর্ণনায় এই বাক্যটি জিজ্ঞাসা সূচক। তা হইলঃ ************* ‘হে রাসূল আমি আমার সমস্ত মাল-সম্পদ দান করিয়া দিব’? রাসূলে করীম (স) ইহার জওয়াবে বলিলেনঃ না। অর্থাৎ সমস্ত মাল-সম্পদ দান করিয়া দেওয়া তোমার উচিত নয়। অতঃপর তিনি অর্ধেক মাল-সম্পদ কিংবা দুই তৃতীয়াংশ দান করার অনুমতি চাহেন। রাসূলে করীম (স) ইহার জওয়াবেও ‘না’ বলেন। পরে তিনি জিজ্ঞাসা করেনঃ এক তৃতীয়াংশ দিতে পারি? রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ ********** ‘হ্যাঁ তুমি এক তৃতীয়াংশ দিতে পার। আর যাবতীয় মাল-সম্পদের এক তৃতীয়াংশে তো অনেক। অপর বর্ণনায় **** এর স্থানে ***** উদ্ধৃত হইয়াছে। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ সম্পদ বেশ বড়।

 

এখানে প্রশ্ন উঠে, হযরত সায়াদ তাঁহার ধন-সম্পত্তি দান করিয়া দেওয়ার জন্য এতটা ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন কেন? ইহার জওয়াব তিনি নিজেই দিয়াছেন। এতদসংক্রান্ত প্রশ্নের পূর্বেই তিনি বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আমার রোগ যন্ত্রণা চরমে পৌঁছিয়া গিয়াছে। (অতঃপর বাঁচিব সে আশা খুবই কম) অথচ আমি একজন ধনশালী ব্যক্তি। কিন্তু আমার একমাত্র কন্যা ছাড়া আর কেহই উত্তরাধিকারী নাই।

 

এই বর্ণনাটি বুখারী গ্রন্হেই অন্য এক প্রসঙ্গে সায়াদ ইবনে ইবরাহীম বর্ণনাকারী সূত্রে উদ্ধৃত হইয়াছে। আর উপরোদ্ধৃত বর্ণনাটির শেষে বর্ণনাকারীর উক্তি হিসাবে বলা হইয়াছেঃ ****** ‘এই সময় তাঁহার একটি কন্যা ছাড়া (সন্তান  বা উত্তরাধীকারী হইবার মত) আর কেহই ছিল না’। এই কন্যার নাম ছিল আয়েশা। তিনি ও সাহাবী ছিলেন বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এই কথার সার নির্যাস হইল, হযরত সায়াদ (রা) অসুখের যন্ত্রনায় জীবনে বাচিয়া থাকা হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছিলেন। তখন তাঁহার ধন-সম্পত্তি সম্পর্কে কি নীতি গ্রহণ করিবেন, তাহা লইয়া তাঁহার মনে দুশ্চিন্তার উদয় হইয়াছিল। এই বিষয়ে তিনি নবী করীম (স)কে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তিনি তাঁহার সম্পদ-সম্পত্তি দান করিয়া যাইবেন কিনা। নবী করীম (স) তাঁহাকে মাত্র এক তৃতীয়াংশ অসিয়ত বা দান করার অনুমতি দিলেন। ইহার অধিক দান বা অসিয়ত করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিলেন। ইহার কারণ স্বরূপ তিনি বলিলেনঃ তুমি যদি তোমার উত্তরাধিকারীদিগকে সচ্চল ও ধনশালী করিয়া রাখিয়া যাইতে পার তাহা হইলে তোমার মৃত্যুর পর তাহারা জনগণের হাতে পায়ে জড়াইয়া ধরিয়া ভিক্ষাকারী নিঃস্ব ফকীর হইবে-এইরূপ অবস্থায় তাহাদিগকে রাখিয়া যাওয়া অপেক্ষা ইহা অনেক বেশী উত্তম কাজ। ইহা এক তৃতীয়াংশের অধিক অসিয়ত বা দান করিতে নিষেধ করার কারণ। এই কথাটির বিস্তারিত রূপ এইঃ তুমি এক তৃতীয়াংশের অধিকক দান বা অসিয়াত করিও না। কেননা এখন তুমি যদি মরিয়া দাও, তাহা হইলে তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদিগকে সচ্ছল ও ধনশালী বানাইয়া রাখিয়া যাইতে পারিবে। আর তুমি যদি জীবনে বাঁচিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি দানও করিতে থাকিবে, ব্যয়ও করিতে পারিবে এবং তাহাতে তুমি শুভ কর্মফল লাভ করিতে পারিবে জীবনে মরণে উভয় অবস্থায়। আর তুমি যদি প্রয়োজনে ব্যয় কর, তবে এই ব্যয় দান সদকার ন্যায় সওয়াব পাওয়ার মাধ্যম হইবে। এই দান যে কোন ক্ষেত্রে এবং যে কোন রকমেরই হউক না কেন। অপর দুইটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

কেননা তুমি যে কোন ধরনের ব্যয় বহন কর না কেন, উহার দায়িত্ব তুমি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি পাইতে ইচ্ছা কর তাহা হইলে উহার দরুন তোমাকে বিপুল সওয়াব দেওয়া হইবে।

 

এখানে ব্যয়কে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছা বা নিয়্যতের সহিত শর্তযুক্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছে সওয়াব লাভের ব্যাপারে অর্থাৎ ব্যয় করা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে না হয়, তাহা হইলে সওয়াব পাওয়া যাইবে না। সেই উদ্দেশ্যে হইলে তবেই সওয়াব পাওয়া সম্ভব হইবে।

 

হাদীসটিতে একটি কথা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বলা হইয়াছে। তাহা হইলঃ

 

****************************************

 

এমন কি সেই খাদ্যমুঠি যাহা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলিয়া দাও….।

 

অর্থাৎ ইহাও তোমার দান বিশেষ এবং ইহাতেও তোমার সওয়াব হইবে। এই বাক্যটি অপর একটি বর্ণনায় উদ্ধৃত হইয়াছে এই ভাষায়ঃ ***********এমনকি তুমি যাহা তোমার স্ত্রীর মুখে রাখ। উভয় বাক্যের মৌল তাৎপর্য একই এবং অভিন্ন।

 

এখানে প্রশ্ন উঠে, অসিয়ত প্রসঙ্গে পারিবারিক ব্যয়ের প্রসঙ্গে আনা হইয়াছে কেন? ইহর জওয়াব এই যে, হযরত সায়াদের জিজ্ঞাসা হইতে যখন জানা গেল যে, তিনি বেশী বেশী সওয়াব পাওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী অথচ নবী করীম (স) এক তৃতীয়াংশের অধিক অসিয়ত করিতে নিষেধ করিয়া দিলেন। তখন তাঁহাকে সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে নবী করীম (স) একথা বলার প্রয়োজন বোধ করিলেন যে, তোমার ধন-মাল তুমি যাহাই কর না কেন উহার কিছু অংশ অসিয়ত কর ও কিংবা স্ত্রী ও সন্তানের জন্য ব্যয় করনা কেন, এমন কি কর্তব্য পর্যায়ের খরচও যদি কর, তাহা হইলেও তুমি তাহাতেই সওয়াব পাইতে পার। তবে শর্ত এই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ উহার মূলে নিহিত উদ্দেশ্য হইতে হইবে। এই প্রসঙ্গে স্ত্রীর কথা বিশেষভাবে বলা হইল কেন, এই প্রশ্নও উঠিতে পারে। জওয়াবে বলা যাইতে পারে যে, যেহেতু স্ত্রীর ব্যয়বার বহন স্বামীর স্থায়ী কর্তব্যভুক্ত, অন্যান্য ব্যয় সেরূপ নহে আর এই স্থায়ী খরচপত্রে কোন সওয়াব হইবার নয় বলিয়া কাহারও ধারণা জাগিতে পারে, এই কারণে নবী করীম (স) প্রসঙ্গত এই কথাটি বলিয়া এ পর্যায়ের ভূল ধারণা দূর করিতে চাহিয়াছেন।

 

হাদীসটির শেষাংশে যে বাক্যটি উদ্ধৃত হইয়াছে তাহা হযরত সায়াদের জন্য নবী করীম (স)-এর বিশেষ দোয়া। এই দোয়া তিনি করিয়াছিলেন হযরত সায়াদের জীবন সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করার পরে। তিনি অসুখের তীব্রতার দরুন ভয় পাইয়া গিয়াছিলেন এবং মনে করিয়াছিলেন যে, তিনি হয়ত বাচিবেন না, এই ব্যাগ করিয়া চলিয়া যাওয়া স্থানেই বুঝি মৃত্যু বরণ করিতে হইবে। তিনি নবী করীম (স) প্রশ্ন করিয়াছিলেনঃ ************ ‘হে রাসূল! আমি কি আমার সঙ্গীদে পিছনে এখানে পড়িয়া থাকিব’? অর্থাৎ হজ্জ সংক্রান্ত সমস্ত কাজ-কর্মে সমাপ্ত হইয়া যাওয়অর পর সব মুহাজির সাহাবী তো মক্কা হইতে মদীনায় চলিয়া যাইবেন। তখন কি আমি এখানে একা পড়িয়া থাকিতে বাধ্য হইব? ইমাম কুরতুবী লিখিয়াছেনঃ হযরত সায়াদ মক্কাতে তাঁহার মৃত্যু হইয়া না যায়, এই ভয়ে ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন। এই কারণেই তিনি এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন। ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ

 

‘আল্লাহ তোমাকে শীঘ্র ভাল করিয়া দিবেন’। অর্থাৎ এখনই তোমার মৃত্যু হইবে না। বরং তোমার জীবন দীর্ঘ হইবে। কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, এই হাদীসের আলোকে মনে হয়, মক্কা বিজয়ের পরও হিজরতের অর্থাৎ মক্কা ত্যাগ করার পূর্বে নির্দেশ বহাল ও কার্যকর ছিল। তবে ইহাও বলা হইয়াছে, যাহারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে হিজরত করিয়াছিলেন এই নির্দেশ কেবল তাঁহাদের জন্যই বলবত ছিল। যাহারা উহার পর হিজরত করিয়াছেন তাহাদের জন্য নয়। আর হযরত সায়াদ (রা) মক্কা বিজয়ের পূর্বেই হিজরতকারী ছিলেন। রাসূলে করীম (স)-এর দোয়ার শেষাংশে বলা হইয়াছেঃ ‘তোমার দ্বারা বহু লোক উপকৃত হইবে এবং ক্ষতিগ্রস্থ হইবে অন্য বহু লোক।

 

এই দোয়াটির তাৎপর্য হইল, হযরত সায়াদ এই রোগে মরিবে না। ইহা হইতে মুক্তি লাভ করিয়া তিনি দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিবেন- ছিলেনও তাই। চল্লিশ বৎসরেরও বেশী। এই বৎসরগুলিতে তাঁহার বহু পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। উপরন্তু তাঁহাকে যখন ইরাক অভিযানে সেনাধক্ষ নিযুক্ত করা হয়, তখন তিনি এমন বহু লোকের সাক্ষাৎ পাইলেন যাহারা মুর্তাদ (ইসলাম ত্যাগকারী) হইয়া গিয়াছিল ও ইসলামী রাষ্ট্রের বিদ্রোহী হইয়া গিয়াছিল। হযরত সায়াদ (রা) তাহাদিগকে তওবা করিয়া পুনরায় দ্বীন-ইসলাম কবুল করার আহবান জানাইয়া ছিলেন। তাহাদের অনেকেই তাহাই করে। যাহারা তওবা করিয়া দ্বীন-ইসলাম কবুল করিতে প্রস্তুত হয় নাই, তাহাদিগকে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তাঁহার এই কাজের ফলে বাস্তবিকই বহুলোক উপকৃত হয় এবং বহু লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। [হাদীসের কথাঃ ‘অতঃপর তোমার দ্বারা বহু লোক উপকৃত হইব এবং অন্যান্য বহু লোক ক্ষতিগ্রস্থ হইবে’ কথাটির একটি ব্যাখ্যা হইল, মুসলমান জনগণ তোমার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে বিজয়ী হইয়া বিপুল পরিমাণ গণীমতের মাল-সম্পদ লাভ করিবে, আর বহু সংখ্যক মুশরিক তোমার হাতে নিহত পর্যুদস্ত হইয়া বিরাট ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। ইবনুত্তীন বলিয়াছেনঃ তাঁহার দ্বারা উপকৃত হওয়ার কথার তাৎপর্য হইল, হযরত সায়াদ (রা)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত কাদেসীয়া ইত্যদি যুদ্দে বিজয় লাভ। ইহা এক ঐতিহাসিক ব্যাপার। মূলত ইহা নবীকরীম (স)-এর একটি বিস্ময়কর মু’জিজা। তিনি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বহু পূর্বেই এই আগাম সংবাদ জানাইয়া দিয়াছিলেন আল্লাহর নিকট হইতে পাওয়া ইংগিতের ভিত্তিতে।] ইহার মাধ্যমেই নবী করীম (স)-এর দোয়ার বাস্তবতা প্রকট হইয়া উঠে।

 

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেন, এই হাদীসটি যে সর্বোতভাবে সহীহ সে বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ সম্পূর্ণ একমত। ইহাতে অসীয়ত করার সে সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, ফিকাহবিদদের নিকট ইহাই অসিয়তের মৌল মানদণ্ড। আর তাহা হইল, মুমুর্ষ ব্যক্তির মালিকানাধীন ধন-সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ মাত্র। ইহা অধিকের জন্য অসিয়াত করা কাহারও পক্ষেই জায়েয নয়। বরং উহারও কম পরিমাণের জন্য অসিয়ত করাই বিশেষজ্ঞদের মতে বাঞ্ছনীয়। ইমাম সওরী বলিয়াছেন, বিশেষজ্ঞদের মত হইল অসিয়তের পরিমাণ এক তৃতীয়াংশে কম এক চতুর্থাংশ কিংবা এক পঞ্চমাংশ হওয়াই উচিত, উহার অধিক নহে। ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ এমত হইয়া বলিয়াছেন, মুমূর্ষ ব্যক্তির যদি উত্তরাধিকারী পুত্র সন্তান কিংবা পিতা-মাতা বা ভাই-চাচা থাকে, তাহা হইলে এক তৃতীয়াংশের অধিকের জন্য অসিয়ত করা কোন প্রকারেই জায়েয নয়। আর যদি তাহা না থাকে তাহা হইলে হযরত ইবনে মাসউদের (রা) মতে সম্পূর্ণ সম্পত্তি অন্য কাহারও জন্য অসিয়ত করিয়া যাইতে পারে। হযরত আবূ মূসা, মসরুক, উবাইদা, ইসহাক, প্রমুখ ফিকাহদিগণও এইমত সমর্থন করিয়াছেন।

 

হযরত আবূ হুরাইয়রা (রা) হইতে বর্ণিত অপর একটি যয়ীফ হাদীস ইহার সমর্থনে উদ্ধৃত হইয়াছে। হাদীসটি হইল, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ধন-মালের এক তৃতীয়াংশে অসিয়ত বিধিবদ্ধ করিয়া দিয়া তোমাদের আমল সমূহে প্রাচুর্য ও আধিক্য সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন। অতএব সন্তানদিগকে নিঃস্ব সর্বহারা করিয়া রাখিয়া না যাওয়ার জন্য আন্তরিক চেষ্টা চালানো পিতার প্রধান কর্তব্য।

 

এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, মুসলিম সমাজের কেহ রোগাক্রান্ত হইয়া পড়িলে তাহার ইয়াদাতের জন্য যাওয়া এবং রোগীর দীর্ঘজীবনের দোয়া করা ও উৎসাহ ব্যাঞ্জক কথা বলা সুন্নাত। ইহা ছাড়া জায়েয উপায়ে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করা যে নাজায়েয নয়, তাহাও এই হাদীস হইত অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]