নু’মান ইবনে বশীর হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তাঁহার পিতা (বশীর) তাঁহার এক পুত্রকে একটি দাস দান করিলেন। অতঃপর তিনি নবী করীম (স)কে এই কাজের সাক্ষী বানাইবার উদ্দেশ্যে তাঁহার নিকট আসিলেন। তিনি শুনিয়া জিজ্ঞাসা বরিলেনঃ তোমার সব কয়জন সন্তানকেই কি এই রূপ (দাস) দান করিয়াছ? বশীর বলিলেন, না। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তাহা হইলে তোমার এই দাস প্রত্যাহার কর ও ফিরাইয়া লও।
(তিরমিযী, মুসলিম, বুখারী, বায়হাকী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসের শব্দ *** অর্থ দান করা, হেবা করা, কোন রূপ বিনিময় এবং কোন রূফ অধিকার ছাড়াই কাহাকেও কিছু দেওয়া। হযরত বশীর (রা) তাঁহার কোন সন্তানকে তাঁহার দাস দান করিয়া রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন ও বলিলেনঃ আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি আমার এই দাসটিকে আমার এই সন্তানকে দান করিলাম। ইহার জওয়াবে রাসূলে করীম (স) যাহা বলিলেন, তাহার বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃত ভাষা হইলঃ
****************************************
তুমি কি তোমার সমস্ত সন্তানকে এইরূপ দিয়াছ?
উত্তরে তিনি যখন বলিলেন-না, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
****************************************
তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার সন্তানদের মধ্যে দানের ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা কর।
বুখারী মুসলিমের-ই অপর একটি বর্ণনায় রাসূলে করীম (স)-এর জওয়াবের ভাষা এইঃ
****************************************
আমি জুলুম ও অবিচারের সাক্ষী হইবো না।
এই একই ঘটনার বিভিন্ন ভাষায় উদ্ধৃত বর্ণনা হইতে হাদীসটির ব্যাপকতা অধিক স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। বস্তুত সন্তাদের মধ্যে বস্তুগত সামগ্রী দানের ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করা পিতা-মাতার কর্তব্য। তাহা করা না হইলে- কাহাকেও বেশী কাহাকেও কম; কিংবা কাহাকেও দান করা ও কাহাকেও বঞ্চিত করা স্পষ্টরূপে জুলুম। ইহা কোনক্রমেই ইসলাম সম্মত কাজ নহে। ইমাম তিরমিযী উপরোদ্ধৃত হাদীসটির ভিত্তিতে বলিয়াছেন, দ্বীন-বিশেষজ্ঞগণ সন্তানদের মধ্যে পূর্ণ সমতা রক্ষা করাই পছন্দ করেন। এমনকি স্নেহ-বাৎসল্য ও দান-হেবা সর্বক্ষেত্রেই মেয়ে সন্তান ও পুরুষ সন্তাদের মধ্যে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব বেশী কম বা অগ্রাধিকার ও বঞ্চনার আচরণ আদৌ করা যাইবে না।
পুত্র সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ ন্যায়পরতা ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য নবী করীম (স) বিশেষভাবে তাকীদ করিয়াছেন। এই পর্যায়ের হাদীসঃ
****************************************
নুমান ইবনে বশীর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ তোমরা তোমাদের পুত্র সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ সুবিচার ও নিরপেক্ষ ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠিত কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে পুর্ণ সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠিত কর, তোমাদের পুত্র সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে পুর্ণ সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠিত কর।
(মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হাব্বান)
ব্যাখ্যাঃ এখানে উদ্ধৃত হাদীসটিতে শুধু পুত্র সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে ন্যায়পরতা, পক্ষপাতহীনতা ও পূর্ণ নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নবী করীম (স) পরপর তিনবার একই কথা বলিয়া তাকীদ দিয়াছেন। একই কথা পর পর তিনবার বলার উদ্দেশ্য মূল বিষয়টির উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ বুঝায়।
আর ইহারও পূর্বে উদ্ধৃত হাদীসটিতে **** শব্দ ব্যবহার করিয়া নবী করীম (স) শুধু পত্র সন্তানদের মধ্যেই নয় বরং পুত্র কন্যা নির্বিশেষে সকল সন্তানদের প্রতিই পুর্ণ সমতা ও নিরপেক্ষতা ভিত্তিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করার নির্দেশ দিয়াছেন। কেননা দুনিয়ায় একমাত্র দ্বীন-ইসলামই সকল পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে ও ব্যাপারে সকলের প্রতি ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠাকামী একমাত্র জীবন বিধান। কুরআন মজীদে নিঃশর্ত ভাবে হুকুম হইয়াছেঃ
****************************************
তোমরা সকলে সুবিচার ও পূর্ণ ন্যায়পরতা-নিরপেক্ষতা স্থাপন কর। কেননা তাহাই আল্লাহ ভয়ের অতীব নিকটবর্তী নীতি।
অন্তরে ঈমান ও আল্লাহর ভয় থাকিলে উহার সহিত অতীব ঘনিষ্ঠ ও সামঞ্জস্যশীল আচরণ নীতি হইল পূর্ণ নিরপেক্ষ ভারসাম্যপূর্ণ সূবিচার। এই ভারসাম্যপূর্ণ সুবিচার ও ন্যায়পরতার উপরই প্রতিষ্ঠিত হইয়া আছে গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা। অতএব মানুষের জীবন যাত্রায়- বিশেষ করিয়া পারিবারিক জীবনেও তাহা পুরামাত্রায় প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর হইতে হইবে।
পারিবারিক জীবনে পিতা-মাতার সন্তান হিসাবে পুত্র ও কন্যা সর্বতোভাবে অভিন্ন। সকলেরই দেহে একই পিতা-মাতার রক্ত প্রবাহমান। কাজেই স্নেহ-বাৎসল্য, আদর-যত্ন ও কর্ম সম্পাদনে এই সমতা-অভিন্নতা ও ন্যায়পরতা ও সুবিচার অশ্যই প্রতিষ্ঠিত থাকিতেই হইবে। ইহা এক বিন্দু লংঘিত হইলে গোটা পরিবার-পরিবেশ বিপর্যস্ত হইবে, বিনষ্ট হইবে পারিবারিক জীবনে যাবতীয় শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুখ।
অতএব এই গুরুত্বপুর্ণ দিকটির দিকে পিতা-মাতাকে সদা জাগ্রত ও অতন্দ্র প্রহরী হইয়া থাকিতে হইবে।