হযরত মুয়াবীয়া ইবনে হায়দাতা আল-কুশাইরী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিন বলিয়াছেন, আমি বলিলামঃ ইয়া রাসূল! আমার নিকট কে অধিক ভাল ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী? তিনি বলিলেনঃ তোমার মা। আমি বলিলামঃ তাহার পর কে? বলিলেনঃ তোমার মা। ইহার পর আমি বলিলামঃ তাহার পর কে? বলিলেনঃ তোমার মা। ইহার পর আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলামঃ অতঃপর কে? বলিলেনঃ অতঃপর তোমার পিতা এবং তাহার পর যে অতি নিকটবর্তী, যে তাহার পর অতি নিকটবর্তী সে।
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ সাধারণভাবে সমাজের সমস্ত মানুষকে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্কের দুচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধিয়া দেওয়ার খোদায়ী বিধান পর্যায়ে এই হাদীসটি অতীব গুরুত্বপুর্ণ। এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে। নাসায়ী ও দারেমী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে। বায়হাকী ও বগাভী নিজ নিজি গ্রন্হে (এই হাদীসটি) উদ্ধৃত করিয়াছেন হযরত আয়েশা (রা) হইত এবং তিরমিযীর গ্রন্হে অপর একটি স্থানে উদ্ধৃত হইয়াছে হযরত আবুদ দারদা (রা) হইতে। আবূ দায়ূদ গ্রন্হেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে। হাদীসটির বর্ণণা যে কত ব্যাপক ও মজবুত সনদ ভিত্তিক, তাহা এই কথা হইতে সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায়।
মূল হাদীসের প্রশ্ন হইল ***** অর্থ **** অর্থ *** ‘ভাল ব্যবহার, সঠিক আচরণ, দয়া অনুগ্রহ ইত্যাদি। পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়ের হক বা অধিকার পর্যায়ে এই শব্দটি ***** এর বিপরীত অর্থ সম্পন্ন। আর **** শব্দের অর্থঃ পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের সহিত অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার বা দুর্ব্যবহার করা এবং তাহাদের অধিাকর বিনষ্ট করা।
***** শব্দের আর একটি অর্থ হইলঃ **** ‘ছিলায়ে রেহমী’ করা। রক্ত সম্পর্ক সম্পন্ন লোকদের পরস্পরের উপর যে অধিকার ও কর্তব্য-দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাহা পুরাপুরি যথাযথভাবে ও মাত্রায় আধায় করা এবং এই সম্পর্কে লোদের সহিত সর্বাধিক ভাল ব্যবহার করা, নম্রতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, আন্তরিকতা ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার গ্রহণই এই শব্দটির মৌলিক ভাবধারা। ইহার বিপরীত শব্দ **** রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দে সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাহাদের অধিকার আদায় না করা, তাহাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন, তাহাদে সহিত দুর্ব্যবহার ও অপমানকর ব্যবহার গ্রহণ। মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর বর্ণনায় এই প্রশ্নটি তিন প্রকারের শব্দ সংযোজন ও বাক্য গঠনের মাধ্যমে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
প্রথম বর্ণনাঃ
****************************************
লোকদের মধ্যে কোন লোক আমার উত্তম ও মহত সাহচর্য-সংস্পর্শ ও সহযোগিতা পাওয়ার অধিক অধিকার সম্পন্ন?
দ্বিতীয় বর্ণনায় এই বাক্যটি এই ভাষায় বর্ণিত ও উদ্ধৃতঃ
****************************************
ইহাতে **** শব্দটি নাই।
তৃতীয় বর্ণনায় আবার এই বাক্যের ভাষা হইলঃ
****************************************
এক হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর বর্ণনাটি একমাত্র মুসলিম শরীফেই এই রূপ বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য সংগঠনে উদ্ধৃত হইয়াছে।
হাদীসটিতে উদ্ধৃত প্রশ্নের জওয়াবে একবার নয়-পর-পর তিনবার নবী করীম (স) একটি শব্দই বলিয়াছেন, তাহা হইল **** ‘তোমার মা’।
ইমাম নববী বলিয়াছেন, এই হাদীসে রক্ত সম্পর্কে দিক দিয়া আনুপাতিকভাবে সর্বাধিক নিকটবর্তী ব্যক্তির হক ও অধিকার আদায় করার জন্য অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভংগীতে তাকীদ জানানো হইয়াছে। এই দিক দিয়া- আলোচ্য হাদীস অনুযায়ী- মা-ই সর্বাধিক ও সব্যগ্রগণ্য অধীকারের মালিক ইহার কান হইল, মা-ই সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসব, লালন- পালন, স্নেহ-মমতা ও আদর-যত্ন দান ইত্যাদির ব্যাপারে সর্বাধিক কষ্ট ভোগ করিয়া থাকে। মা সন্তানকে যতটা স্নেহ যত্ন ও মায়অ মমতা দেয় এবং যতবেশী খেদমত করে উহার সহিত অন্য কাহারও অবদানের কোন তুলনা হইতে পারে না। বস্তুত মা-ই যদি সন্তান গর্ভধারণ করিতে ও প্রসবের প্রাণান্তকর যন্ত্রণা সহ্য করিতে ও আদর যত্ন সহারে শিশুকে লালন পালন করিতে প্রস্তুত না হইতেন- বরং তাহা করিতে অস্বীকার করিতেন, তাহা হইলে এই দুনিয়ায় মানব বংশের রক্ষা পাওয়া ও লালিত পালিত হইয়া বড় হওয়া পরিণামে মানবংশের বিস্তার লাভ করা কখনই সম্ভবপর হইত না।
মা’র এই দুইটি বিরাট ও তুলনাহীন-দৃষ্টান্তহীন অবদানের কথা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাও উদাত্ত ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেন। বলিয়াছেনঃ
****************************************
মা সন্তানকে অতিশয় কষ্ট সহকারে গর্ভে দারণ ও বহন করিয়াছে। তাহাকে প্রসব করিয়াছন প্রাণান্তকর কষ্ট সহকারে। এই গর্ভে ধারণ ও দুগ্ধ সেবন করানোর ত্রিশটি মাস অতিবাহিত হইয়াছে।
অপর এক আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
****************************************
তাহার মা তাহাকে বহন করিয়াছে দুর্বলতার উপর দুর্বলতা সহ্য করিয়া।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে পিতামাতার প্রতি ভাল ব্যবহারের কথা বলা প্রসঙ্গে মার কথাই বলা হইয়াছে সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে।
রাসূলে করীম (স) তিন তিন বারের প্রশ্নের জওয়াবে কেবল মার অধিকারের কথাই বলিয়াছেন। ইহার কাণ হইল, তিনটি কাজ কেবল মাত্র মার-ই অবদান। তাহা হইল, গর্ভধারণের কষ্ট, প্রসব যন্ত্রণা ভোগের কষ্ট এবং দুগ্ধ সেবন করানো- লালন-পালন করার কষ্ট। এই তিনওটি অত্যন্ত দুঃসহ ও প্রাণান্তর কষ্ট। কাজে যে কষ্ট মাকে ভোগ করিতে হয়, তাহা কোন ভাষা দিয়া প্রকাশ বা বর্ণণা করা সম্ভব নয় এবং এই তিনওটি বড় বড় কষ্ট কেবল মাকেই ভোগ করিতে হয়। এই কষ্ট ভোগে তাহার সহিত অন্য কেহ শরীক থাকেনা।
কিন্তু কেবল মার অধিকারের কথা বলিয়াই হাদীসটি শেষ করা হয় নাই। ইহার পর আরও দুইটি অধিকারের কথা বলা হইয়াছে। তাহা হইল মার পরে পরেই সর্বাধিক অধিকার হইতেছে পিতার। কেননা মা’র উপরোক্ত তিনওটি কাজ তিনও পর্যায়ের কষ্ট স্বীকার সম্ভব হয় পিতার বাস্তব সাহায্য সহযোগিতা ও আনুকূল্যের ফলে। এই ক্ষেত্রে পিতার অবদান কোন অংশে কম নয়। কেননা মা’র পক্ষে উক্ত কাজ সমূহের কোন একটি কাজও পিতা ছাড়া সম্ভত নয়। পিতা না হইলে মা’র গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও লালন-পালন, দুগ্ধ সেবন করানোর কোন প্রশ্ন উঠিতে পারে না। তাই আল্লাহ তাৱআলা মা’র বিশেষ অবদানের কথা স্বতন্ত্র গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করিলেও কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে সন্তানের প্রতি পিতা মাতার অধিকার ও পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য একটি শব্দে ও একই সঙ্গে বলিয়াছেন।
সূরা বনী ইসরাঈলে আল্লাহর বন্দেগী করার চূড়ান্ত ফরমান দেওয়ার পরই বলিয়াছেন পিতা-মাতার প্রতি ‘ইহসান’ করার কথা।
****************************************
তোমার রব ফরমান জারী করিয়াছেন যে, তোমরা কেবল মাত্র তাঁহারই বন্দেগী করিবে- তাঁহাকে ছাড়া আর কাহারও দাসত্ব করিবে না এবং পিতা-মাতার সহিত খুবই উত্তম ব্যবহার ও আচরণ অবলম্বন করিবে।
সূরা লূক্কমানএ আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে ও ভাষায় বলিয়াছেনঃ
****************************************
মানুষকে তাহার পিতা-মাতার ব্যাপারে শক্ত বিধান পালনের নির্দেশ দিয়াছি। অতএব তুমি শোকর করিবে আমার এবং তোমার পিতা-মাতার, শেষ পরিণতি তো আমার নিকটই হইবে।
এই আয়াতেও প্রথমে আল্লাহর শোকর আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হইয়ছে এবং ইহার পরই এক সঙ্গেই পিতা-মাতার শোকর আদায় করিতে বলা হইয়াছে। ইহাই আল্লাহ তা’আলার চূড়ান্ত ফরমান। কিন্তু এতদ্বসত্বেও মা’র অধিকার পিতার তুলনায় অধিক হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত থাকিতে পারে না। হারেস আল-মুহাসিবী বলিয়াছেনঃ
****************************************
পিতার তুলানয় মা’র ভাল ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী হওয়া সম্পর্কে সমস্ত শরীয়াতবিদ সম্পূর্ণ একমত। তেব কেহ কেহ দুইজনার অধিকার সমান বলিয়াছেন। কিন্তু আলোচ্য হাদীসের দৃষ্টিতে তাহা ঠিক নয়।
কিন্তু ব্যক্তির উপর কেবল পিতা-মাতারই হক থাকে না, হক থাকে অন্যান্য নিকটাত্মীয়দেরও। এই পর্যায়ে অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালনে একটি মলূনীতি ও ফর্মূলা স্বয়ং নবী করীম (স) বলিয়াছেন। তাহা হইল ******* রক্ত সম্পর্কে যে প্রথম নিকটাবর্তী সে এই দিক দিয়াও নিকটবর্তী, যে তাহার পর নিকটবর্তি, সে এই দিক দিয়া অতঃপর নিকটবর্তী। এইভাবে সমাজের সমস্ত মানুষকে পরস্পরের সাথে আত্মীয়তা এবং অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালনের বন্ধনে বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে। যে সমাজে এই সম্পর্ক পুরাপুরি রক্ষিত হয় এবং অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালন যথাযথভাবে পালন করা হয়, সে সমাজ যে শান্তি ও সুখের সমাজ হইবে এবং এই সমাজের মানুষও যে সর্বাধিক সুখী মানুষ হইবে, তাহাতে কি একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ আছে?
বস্তুত ইসলামের পুর্ণাঙ্গ বিধানের মানসিকতা ও সর্বাধিক কল্যাণকরতার বৈশিষ্ট্য এই দৃষি।টতেই বিচার্য।