হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, রাসূলে করীম (স)-এর নিকট এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার নিকট জিহাদে যোগদান করার অনুমতি চাহিল। নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছে কি? লোকটি বলিল, জ্বি হ্যাঁ, তাহারা দুই জনই জীবিত আছেন। তখন নবী করীম (স) বলিলেন, তাহা হইলে সেই দুইজনের খেদমতে জিহাদ করার কাজে নিযুক্ত থাক।
(বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
ব্যাখ্যাঃ ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ কোন উদ্দেশ্যের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া চরম প্রচেষ্টা চালানো। দ্বীন-ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া চালানো হয়,ইসলামী পরিভাষায় তাহাকেই জিহাদ বলা হয়। ফিকাহর ফয়সালা অনুযায়ী জিহাদের কাজ মুসলমানদের জন্য ফরয হইলেও এই কাজে অন্যান্য বহু লোক নিয়োজিত থাকিলে তখন অন্যান্য মুসলমানদের জন্য উহা ‘ফরযে কেফায়া’ পর্যায়ের হইয়া যায়। এই সময় কাহারও পিতা-মাতা যদি বৃদ্ধ অক্ষম হয়, তাহা হইলে বিশেষ করিয়া এই অবস্থায় পিতা-মাতার খেদমত করা সন্তান বিশেষ করিয়া পুত্র সন্তানের উপর ‘ফরযে আইন’ হইয়া যায়। রাসূলে করীম (স)-এর নিকট লোকটি জিহাদে যোগদানের অনুমতি চাহিলে জিজ্ঞাসা করিয়া যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, লোকটির পিতা-মাতা জীবিত তখন হয়ত তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এই লোকটির জিহাদে যোগদান অপেক্ষা বৃদ্ধ-অক্ষম ও সন্তানের খেদমতের মুখাপেক্ষী পিতা-মাতার খেদমতে নিযুক্ত থাকা-ই উত্তম এবং জরুরী। তাই তিনি তাহাকে নির্দেশ দিলেনঃ ********** তোমার পিতা-মাতার খেদমতেই তুমি জিহাদ কর- সর্বাত্মক চেষ্টা চালাইয়া যাও। অর্থাৎ জিহাদের তুলনায় পিতা-মাতার খেদমতে লাগিয়া থাক-ই তোমার অধিক কর্তব্য। বস্তুত ইহা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। নবী করীম (স) জিহাদে লোক নিয়োগ কালে প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া কাহার জিহাদে যাওয়া উচিত, কাহার ঘরে থাকিয়া পি তা-মাতার খেদমত করিয়া যাওয়া উচিত এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা গ্রহণ করিতেন। সেই অসংখ্য ঘটনাবলীর মধ্যে ইহাও একটি। বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হইতে এই হাদীসটি এ ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-কে বলিলেনঃ আমি জিহাদ করিব। রাসূলে করীম (স) তাহাকে জিজ্ঞাসু হইয়া বলিলেনঃ তোমার পিতা-মাতা আছে? লোকটি বলিলেন হ্যাঁ। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ ‘তাহা হইলে তুমি সেই দুইজনের খেদমতে নিয়োজিত থাকিয়া জিহাদ কর।
তাবারানী উদ্ধৃত একটি হাদীসের ভাষা এইরূপঃ
****************************************
এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট আসিল এবং বলিলঃ আমি আল্লাহর পথে জিহাদ যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক। রাসূলে করীম (স) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমার মা কি জীবিত? লোকটি বলিলেন, হ্যাঁ, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তাহার পায়ে লাগিয়া থাক। সেখানেই জান্নাত অবস্থিত।
পায়ে লাগিয়া থাকা অর্থ, তাহার খেদমতে স্থায়ীভাবে নিয়োজিত থাক।
অপর একটি বর্ণনায় আলোচ্য হাদীসটির ভাষা এইরূপঃ
****************************************
একটি লোক রাসূলে করীম (স)-এর দিকে অগ্রসর হইয়া গিয়া বলিলঃ আমি আপনার নিকট হিজরত ও জিহাদের ‘বয়আত’ করিতেছি। ইহা করিয়া আমি আল্লাহ তা’আলার নিকট হইতে শুভ পূণ্যফল পাইতে চাহি। বলিলেনঃ অতঃপর তুমি তোমার পিতা-মাতার নিকট ফিরিয়া যাও এবং পরে তাহাদের দুইজনের উত্তম সাহচর্য অবলম্বন কর।
কিন্তু মুসনাদে আহমাদ গ্রন্হে এই হাদীসটি যে ভাষা উদ্ধৃত হইয়াছে তাহাতে এই পর্যায়ে সমস্ত কথা স্পষ্ট হইয়া যায়। হাদীসটি এইঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেনঃ
****************************************
‘একটি লোক’ নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত ইলেন, অতঃপর বলিলেনঃ আমি আপনার নিকট বায়আত করিবার উদ্দেশ্যে আসিয়াছি। আমি আমার পিতা-মাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রাখিয়া আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তাহাদের নিকট ফিরিয়া যাও এবং তুমি তাহাদিগকে যেমন কাঁদাইয়াছ, তেমনি গিয়া হাসাও। আর তিনি তাহাকে বায়আত করিতে অস্বীকার করিলেন।
লোকটি কিসের বায়আত করিতে আসিয়াছিল, উপরোক্ত বর্ণনার ভাষায় তাহার উল্লেখ নাই। তবে আবূ দায়ূদ ও মুসনাদে আহমাদের অপর এক বর্ণনায় ***** শব্দটির উল্লেখ হইয়াছে। আর এই হিজরাতও যে জিহাদেরই উদ্দেশ্যে তাহা সহেজই বুঝিতে পারা যায়। ইমা খাত্তাবী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ
****************************************
জিহাদের উদ্দেশ্যে যে লোক ঘর-বাড়ি ও আত্মীয়-স্বজন ছাড়িয়া বাহির হইয়া দূরে চলিয়া যায়, তাহা যদি তাহার জন্য নফল পর্যায়েল হইয়া থাকে, তাহা হইলে পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত ইহা জায়েয হইবে না। কিন্তু এই জিহাদ যদি ফরযে আইন করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে উহাতে যাওয়ার জন্য পিতা-মাতার অনুমতির অপেক্ষা রাখার প্রয়োজন হইবে না।
(**************)
এই সব হাদীসের ভাষা ও বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন হইলেও মূল কথা ও প্রতিপাদ্য এক ও অভিন্ন। আর তাহা হইল, পিতা-মাতার খেদমতে নিযুক্ত থকার বিরাট ফযীলত- মর্যাদা, গুরুত্ব ও সওয়াব আল্লাহ ও রাসূল কর্তৃক স্বীকৃত এবং উচ্চস্বরে বিঘোষিত। উপরন্তু অবস্থা বিশে ষ ইহা জিহাদের তুলানায়ও অধীক গুরুত্বপুর্ণ ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বিশেষজ্ঞগণ এই সব হাদীসের ভিত্তিতেই বালিয়াছেন, পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে যোগদান করা জায়েয নয়, অবশ্য যদি সে পিতা মাতা মুসলিম ইসলামী মতানুসারী হয়। অন্যথায় এই কাজের অনুমতি লওয়ার শর্ত নাই। ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য ফিকাহবিদরা এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তবে ইহাও সেই সময়ের কথা, যখন জিহাদে শরীফ হওয়ার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে সাধারণ নির্দেশ দেওয়া ও সেজন্য আহবান জানানো হয় নাই। যদি সে রূপ আহবান জানানো হয় ও নির্দেশ দেওয়া হয় তাহা হইলে তাহাদের অনুমতি ব্যতিরেকেই জিহাদে যোগদান করিতে হইবে।