খোলা তালাক খোলা তালাকের ইদ্দত কতদিন খোলা তালাকের হলফনামা খোলা তালাক দেওয়ার পর সংসার করার উপায়

হযরত সহল ইবনে আবূ হাসমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, সহল কন্যা হাবীবা সাবিত ইবতে কাইস ইবনে শিমাস আল-আনসারীর স্ত্রী ছিল। পরে সে (স্ত্রী) তাহাকে (স্বামীকে) ঘৃণা করিতে লাগিল। কেননা সে (সাবিত) একজন কুৎসিত বীভৎস চেহারা ও খারাপ আকার-আকৃতির লোক ছিল। এই সময় সে (হাবীবা) নবী করীম (স)-এর নিকট আসে ও বলেঃ ইয়া রাসূল! আমি লোকটিকে দেখি বটে। কিন্তু মহান আল্লাহর ভয়ই যদি না থাকিত, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তাহার মুখের উপর থুথু নিক্ষেপ করিতাম। তখন রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কি তাহার সেই বাগানটা তাহাকে ফিরাইয়া দিবে, যাহা সে তোমাকে মহরানা বাবদ দিয়াছিল? সে বলিল, হ্যাঁ, দিব। তখন রাসূলে করীম (স) তাহার নিকট লোক পাঠায়া তাহাকে ডাকিয়া আনাইলেন। হাবীবা তাহার বাগানটি তাহাকে ফিরাইয়া দির। অতঃপর রাসূলে করীম (স) তাহাদের দুইজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দিলেন। হাদীসটির বর্ণনাকারী বলিয়াছেন, ইসলামে ইহাই ছিল প্রথম সংঘটিত খোলা তালাক।

 

(মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে বাজ্জার, তাবারানী- কবীর)

 

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির মোটামুটি বক্তব্য হইল, স্বামী যদি স্ত্রীর অপছন্দ হয়, স্ত্রী যদি স্বামীর সহিত থাকিতে অরাযী হয় এবং তাহার মূলে কোন বাস্তব কারণ বর্তমান থাকে, তাহা হইলে স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাহিতে পারে। এই রূপ প্রস্তাবনার পর স্বামী তালাক দিলে শরীয়াতের পরিভাষায় এই তালাককে খোলা তালাক ***** বলা হয়। অভিধানের দৃষ্টিতে খোলা তালাকের কয়েকটি সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে। তন্মধ্যে একটি হইলঃ

 

****************************************

 

ধনমালের বিনিময়ে এক ব্যক্তির তাহার স্ত্রী হইত বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া।

 

অথবাঃ ************ অর্থ সম্পদের বিনিময়ে স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া। ইহা আরবী কথন ****** ‘কাপ খুলিয়া ফেলা’ হইতে গৃহীত। কেননা কুরআনে ঘোষণাঃ

 

****************************************

 

স্ত্রীরা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক।

 

এই অনুযায়ী স্ত্রী তাৎপর্যগতভাবে স্বামীর পোশাক। কাজেই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া ও গায়ের পোশাক খুলিয়া ফেলা একই ধরনের কাজ। ইসলামী শরীয়াতের বিশেষজ্ঞগণ একমত হইয়া বলিয়াছেনঃ এই পন্হায় স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করিতে পারে। ইহা শরীয়াত সম্মত এবং সত্যিকার ও বাস্তব কারণে এই পন্হায় তালাক গ্রহণ করা হইলে তাহাতে গুনাহ হইবে না।

 

কিন্তু এই সংজ্ঞা উত্তম ও যথার্থ নয় কেননা ইহাতে খোলা তালাকের বিনিময়ে নগদ ধন-মাল হওয়াকে শর্ত করা হইয়াছে। কোন রূপ ঋণ বা শাস্তির কারণে ‘খোলা’ হইয়া থাকিলে তাহাও এই সংজ্ঞার দৃষ্টিতে সহীহ বলিয়া মনে করিতে হয়। অথচ তাহা ঠিক নয়। বরং স্বামী কোনরূপ ধন-মাল গ্রহণ না করিলেও ‘খোলা তালাক’ হইতে পারে। এই কারণে মুল লক্ষ্য লাভের উপরই গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে, গ্রহণ করার উপর নয়। অন্যান্যরা বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

স্বামী স্ত্রীকে যাহা কিছু দিয়াছে তাহার বিনিময়ে স্ত্রীত্ব খতম করিয়া দেওয়াই হইল ‘খোলা তালাক’।

 

আল্লামা নাসাফী বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

ধন-মাল গ্রহণের বিনিময়ে ‘খোলা’ শব্দ প্রয়োগ সহকারে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোই হইল ‘খোলা তালাক’।

 

ইহার শর্ত তাহাই যাহা সাধারণতঃ তালাকের শর্ত। আর ইহার পরিণতি হইল ‘বাঈন তালাক’ সংঘটিত হওয়া। ইহা স্বামীর দিক দিয়া ‘কসম’ পর্যায়ের কাজ। আর স্ত্রীর দিক দিয়া ওদল-বদল করণ।

 

‘খোলা তালাক’ কিভাবে সংঘটিত হয়? কেবল বিনিময় গ্রহন করা হইলেই কি তালাক আপনা-আপনি সংঘটিত হইয়া যাইবে? না মুখের শব্দের কিংবা নিয়্যতে তালাক বলিলেই তবে তালাক সংঘটিত হইবে? এই বিষয়ে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। হানাফী মাযহাবের ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন, উহা খোলা ও তালাক উভয় শব্দেই সংঘটিত হইতে পারে। তবে তাহাতে ধন-মালের বিনিময় হইতেই হইবে এবং ইহা বাঈন তালাক হইবে। ইমাম শাফেয়ীর প্রাচনী কতা হইল, ইহা ঠিক তালাক নহে, ইহা বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়া মাত্র। হযরত ইবনে আব্বাস (রা)ও এই মত প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেনঃ যদি একই স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকবার খোলা করা হয় তবুও তাহাদের মধ্যে অন্য স্বামী গ্রহণ ছাড়াই বারবার বিবাহ হইতে পারিবে। ইমাম আহমাদও এইমত সমর্থন করিয়াছেন। ইমাম শাফেয়ীর আর একটি মত হইল, ইহা রিজয়ী তালাক। তবে তাঁহার তৃতীয় একটি মতও আছে। আর তাহা হইল, ইহা এক তালাক বাঈন। হানাফী মাযহাবের মতও ইহাই। ইহার ভিত্তি হইল নবী করীম (স)এর উক্তিঃ

 

****************************************

 

‘খোলা’ এক তালাক বাঈন মাত্র।

 

হযরত উমর, আলী ও ইবনে মাসউদ (রা) এই মতই দিয়াছেন।

 

এই ব্যাপারে আরও দুইটি কথা আছে। একটি, ইহা এক তালাক বাঈন। হযরত উসমান, আলী ও ইবনে মাসউদ (রা) ইহা বলিয়াছেন। ইহাতে যদি তিন তালাক বলা হয়, তবে তাহাই হইবে। ইহা ইমাম মালিক, সওরী, আওজায়ী ও কুফী ফিকাহবিদদের মত।আর দ্বিতীয় কথা হইল, ইহা তালাক নয়, ইহা ফিসখ। অর্থাৎ বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়া মাত্র। অবশ্য তালাকের নিয়্যত করা হইলে তাহাই হইবে। ইবনে আব্বাস, তায়ূস, ইকরামা, ইমাম আহমাদ, শাফেয়ী, ইসহাক, আবূ সওর প্রমুখ ফিকাহবিদদের এই মত। হানাফী মতের ভিত্তি যে হাদীসের উপর, তাহা হইল, হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

নবী করীম (স) খোলাকে এক তালাক বাঈন গণ্য করিয়াছেন।

 

কিন্তু ইহার সনদে দুর্বলতা রহিয়াছে। ইমাম বুখারী এই হাদীসটি গ্রহণ করেন নাই। ইমাম নাসায়ী বলিয়াছেন, ইহার একজন বর্ণনাকারী পরিত্যক্ত। শু’বা বলিয়াছেনঃ এই হাদিসটি তোমরা পরিহার কর। দারে কুতনী ইহার সনদ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেন নাই। তবে ইবনে আব্বাস (রা) হইতে আরও একটি উক্তি উহাতে উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহা হইলঃ ********** ‘খোলা বিচ্ছিন্নকরণ মাত্র’। -ইহা তালাক নয়।

 

আর সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব হইতেবর্ণিত হইয়াছেঃ

 

****************************************

 

নবী করীম (স) খোলা’তে এক তালাক হয় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।

 

বস্তুত ‘খোলা’- তালাকের ব্যবস্থা রাখা ও মূল তালাকের সুযোগ রাখার মতই ইসলামী শরীয়াত ও সমাজ ব্যবস্থার এক গুরুত্বপুর্ণ অবদান। বিবাহ হইয়া গেলে জীবন দুর্বিসহ  হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের কোন পথ উন্মুক্ত না থাকা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ব্যবস্থা। তাহা মানবোপযোগী ব্যবস্থা হইতে পারে না, তাই বস্তুনিষ্ঠ ও অনিবার্য কারণের ভিত্তিতে তালাক দেওয়া বা নেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া ইসলাম বিশ্ব মানবতার অবর্ণনীয় কল্যাণকর অদান রাখিয়াছেন, একথা বলিষ্ঠ কণ্ঠেই বলিতে হইবে।

 

দাম্পত্য জীবনের জন্য একান্তই অপরিহার্য হইতেছে, পারস্পরিক নিবিড় শান্তি, স্বস্থি, প্রেম-ভালবাসা, গভীর প্রীতি, আন্তরিক দরদ, সহানুভূতি, সহযোগিতা, উত্তম আচার-আচরণ এবং প্রত্যেকেরই অপরের অধিকার আদায়ের জন্য অতন্ত্র প্রহরীর মত সদা সচেতন ও সদাজাগ্রত হইয়া থাকা। এইরূপ না হইলে দাম্পত্য জীবন মরুভূমির উপর দিয়া নৌকা বাওয়া কিংবা সমুদ্রের উপর দিয়া রেলগাড়ী চালানার মতই অসম্ভব, অচল। তাই দাম্পত্য জীবনে সাধারণত এইরূপ অবস্থারই বিরাজমাতনা কাম্য এবং লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, উক্তরূপ সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ সুমধুর দাম্পত্য জীবনেও বিপর্যয় আসে। আর যখন বিপর্যয় আসিয়াই পড়ে তখন আর একসঙ্গে জীবন যাপনের কথা চিন্তা না করিয়া পরস্পর হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের উপায় কি হইতে পারে তাহাই প্রধান চিন্তা ও বিবেচনার বিষয়। ইসলাম এ অবস্থায় যে ব্যবস্থা উপস্থাপিত করিয়াছে তাহাকেই বলা হয় খোলা তালাক।এই তালাকের দুইটি দিক। কখনও স্বামী ইহার প্রয়োজন বোধ করে। ফলে সে-ই উদ্যোগী হইয়া নিজ হইতেই তালাক দিয়া দেয়। আবার এমন কারনের উৎপত্তি হওয়াটাও কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয় যে, স্বামী হয়ত তালাক দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না, কিন্তু স্ত্রী এই স্বামীর ঘর কিরিতে পারে না- এই স্বামীর ঘর করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। তখন স্ত্রী উদ্যোগী হইয়া স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করিতে সচেষ্ট হয়। এই দ্বিতীয় প্রকারের তালাক গ্রহণই হইল ‘খোলা তালাক’।

 

উপরোদ্ধৃত হাদীসৈ যে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হইয়াছে, তাহার সার কথা হইল, হাবীবা সাবিতের স্ত্রী ছিল। বিবাহটা উভয়ের পছন্দ ও সম্মতিক্রমে হইয়াছিল কিনা, এই বর্ণনায় তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু বিবাহিত জীবনে হাবীবা সাবিতকে পাইয়া কিছুমাত্র সুখী হয় নাই। সুখী না হওয়ার একটি মাত্র কারণেরই উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহা হইল, সে তাহার স্বামীকে অপছন্দ ও ঘৃণা করিত। আর এই অপছন্দ ও ঘৃণা করার কারণ হইল, সে ছিল ‘দমীম’। আরবী ***** শব্দের অর্থ *********** ‘দেখিতে কুৎসিত ও দৈহিক আকার আকৃতিতে ক্ষুদ্র, বেঁটে’। এই শব্দটির মূল হইল *****। ইহার অর্থ ****** ‘ক্ষুদ্রকায় পিপিলিকা’। আর একটি লোককে ***** বলার অর্থ, সে আকার আকৃতিতে ক্ষুদ্র। অর্থাৎ স্বামীর কুৎসিত বীভৎস চেহারা ও আকার-আকৃতির ক্ষুদ্র্বের কারণে হাবীবা তাহাকে পছন্দ করিতে পারে নাই। বরং সে তাহাকে ঘৃণা করে। স্বামীর প্রতি তাহার এই ঘৃণা কতখানি তীব্র ও উৎকট ছিল তাহা তাহার পরবর্তী কথা হইতেই স্পষ্ট বুঝা যায়। সে নিজেই রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাহার বিবাহের ফয়সালা প্রার্থনা করে এবং তাহার তালাক চাওয়ার কারণ প্রদর্শণ করিতে গিয়া সে নিজেই বলিয়া উঠেঃ আমি তাহাকে দেখি বটে; কিন্তু আল্লাহর ভয় না থাকিলে আমি তাহার মুখের উপর-ই থুথু নিক্ষেপ করিতাম। বস্তুত কোন কিছুর প্রতি থু থু নিক্ষেপ করা সেই জিনিসের প্রতি প্রবল তীব্র ও উৎকট ঘৃণার চরমতম প্রকাশ। এই ঘৃণা তাহার মন মগজে শক্ত হইয়া বসিয়াছিল এবং ইহাকে পছন্দে ও আকর্ষনে পরিবর্তিত করার কোনই উপায় নাই। রাসূলে করীম (স) তাহার এই কথা শুনিয়াই মূল অবস্থাটা নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং সেই সঙ্গে ইহাও তাঁহার নিকট প্রতিবাত হইয়া পড়িয়াছিল যে, এই দম্পত্তির স্থিতি অসম্ভব। ইহাদের মধ্যে বিচ্ছেদ অনিবার্য, অপরিহার্য এবং তাহা যত শীঘ্রই হয় ততই মঙ্গল। তাই নবী করীম (স) এ বিষয়ে অধিক আর কোন কথা-বার্তা বলার প্রয়োজন মনে করিলেন না। বরং কি ভাবে এই বিচ্ছেদ ঘটিতে পারে অনতিবিলম্বে সেই দিকেই নজর দিলেন।

 

ইহা হইতে নিঃসেন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, স্বামীর চেহারা-ছুরত ও দৈহিক আকার-আকৃতি স্ত্রীর পছন্দ ও মনোমত হওয়া দাম্পত্য জীবনের স্থিতি ও স্থায়ীত্বের জন্য একান্তই জরুরী। ইহা না হইলে স্ত্রীর অকীকার আছে স্বামীর সহিত থাকিতে অস্বীকার করা এবং তাহার নিকট তালাক চাওয়া। আলোচ্য হাদীসের বর্ণনায় রাসূলে করীম (স) শুধু এই কারণেই হাবীবার অভিযোগের যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়া লইলেন এবং তাহার তালাক চাওয়ার আবেদনকে অগ্রাহ্য করিলেন না।

 

তিনি এই তালাক সংঘটিত হওয়ার পন্হা উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে হাবীবাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমাকে সে মহরানা বাবদ যে বাগানটি দিয়াছিল, তাহা কি তুমি ফিরাইয়া দিতে প্রস্তুত আছ? ইহার অর্থ, খোলা তালাকে- স্ত্রীর ইচ্ছা ও উদ্যোগে স্বামী যে তালাক দেয় তাহাতে স্বামীর মহরানা বাবদ দেওয়া মাল-সম্পদ ফিরাইয়অ দিতে হয়। উহা ফেরত দেওয়ার বিনিময়েই স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে তালাক গ্রহণ করে।

 

কিন্তু স্বামী মহরানা বাবদ স্ত্রীকে যাহা কিছু দিয়াছিল তাহা ফিরাইয়া লওয়া ও উহার বিনিময়ে তালাক দেওয়া পর্যায়ে শরীয়াত বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত উদ্ধৃত হইয়াছে। আবূ বকর ইবনে আবদুল্লাহ আল মুজানী তাবেয়ী এ সম্পর্কে বলিয়াছেন, স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার বিনিময়ে তাহার নিকট হইতে স্বামীর কোন কিছুই গ্রহণ করা উচিত নয়- তাহার জন্য তাহা হালালও নয়। কেননা কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা ইহা করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন। দলীল হিসাবে তিনি এই আয়াতটি পেশ করিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

তোমরা যদি এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক হও এবং তোমরা  তাহাদের কাহাকেও বিপুল পরিমাণ সম্পদও দিয়া থাক, তাহা হইলে তোমরা তাহা হইতে কিচুই গ্রহণ করিও না।

 

(আন-নিসা- ২০)

 

এই আয়াতটি হইতে তালাকের বিনিময়ে স্ত্রীর নিকট হইতে স্বামীর কিচুই গ্রহণ করা নিষেধ জানা যায়।

 

কিন্তু কুরআন মজীদেরই অপর একটি আয়াত হইতে ইহার বিপরীত কথা জানা যায়। আয়াতটি এইঃ

 

****************************************

 

তোমরা যদি আশংকাবোধ কর যে, স্বামী স্ত্রী আল্লাহর সীমা সমূহ কায়েম ও রক্ষা করিতে পারিবে না (বা করিবে না), তাহা হইলে স্ত্রী যে বিনিময় মূল্য দিবে, তাহার ভিত্তিতে (বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত করার) তাহাদের দুই জনের গুনাহ হইবে না। এই আয়াতটি হইতে বিনিময় গ্রহণ করা স্বামীর জন্য জায়েয প্রমাণিত হয়।

 

(আল-বাকারাঃ  ২৯)

 

আবূ বকর ইবনে আবদুল্লাহ মনে করিয়াছেন যে, সূরা বাকারা এই শেষোক্ত আয়াতটি সূরা নিসার উরোদ্ধৃত আয়াতটি দ্বারা মনসুখ হইয়া গিয়াছে। অতএব তালাকের বদলে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে কোন কিছু গ্রহণ করিতে পারিবে না- এই হুকুমই বলবত রহিয়াছে।

 

ইবনে জায়দ প্রমুখ বলিয়াছেন, আবূ বকররের কথা যথার্থ নয়। বরং সূরা বাকারার যে আয়াতটি দ্বারা সূরা নিসার আয়াতটিই মনসুখ হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলঃ

 

****************************************

 

তোমরা স্ত্রীদের যাহা কিছু দিয়াছ তাহা হইতে কিছু গ্রহণ করা- হে স্বামীরা- তোমাদের জন্য হালাল নয়।

 

অতএব তালাকের বিনিময়ে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে মাল-সম্পদ গ্রহণ করিতে পারিব।

 

কিন্তু মনসুখ হওয়া সম্পর্কে এই দুইটি কথাই ঠিক নয়। কেননা প্রকৃত পক্ষে এই কোনটিই আয়াত কয়টিই কোনটি কর্তৃক মনসুখ বা বাতিল হইয়া যায় নাই। বরং আয়াতত্রয়ের প্রত্যেকটি স্ব স্ব স্থানে অনড়, অবিচল, অপরিবর্তিত- *****। আসল ব্যাপার হইল ইহাদের প্রত্যেকটি আয়াতই এক একটা বিশেষ পরিপেক্ষিতে প্রযোজ্য। ইমাম তাবারী বলিয়াছেন, আবূ বকরের কথার কোন অর্থ নাই। কেননা স্ত্রী দিতে প্রস্তুত হইলে স্বামীর পক্ষে তাহা গ্রহণ করা স্বয়ং নবী করীম (স) কর্তৃকই জায়েয ঘোষিত হইয়াছে। যে মূল হাদীসটি লইয়া এই আলোচনা। তাহাই ইহার অকাট্য প্রমাণ। ইহাতে নবী করীম (স) সাবিতের জন্য তাহার দেওয়া বাগানটি তাহার স্ত্রী হাবীবকে তালাক দেওয়ার বিনিময়ে ফিরাইয়া আনিয়া দিয়াছেন।

 

এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হইতে যে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে তাহা এখানে উল্লেখ্য। হাদীসটি এইঃ

 

****************************************

 

সাবিত ইবনে কাইসের স্ত্রী নবী করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিলঃ ইয়া রাসূল! কাইসের পুত্র সাবিত সম্পর্কে তাহার চরিত্র ও দ্বীনদারীর দিক দিয়া আমি কোন দোষারোপ করিব না। কিন্তু আসল কথা হইল, ইসলামে কুফীরকে আমি ঘৃণা করি। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কি তাহার বাগানটি ফিরাইয়া দিবে? সে বলিল, হ্যাঁ, দিব। তখন নবী করীম (স) কাইসের পুত্র সাবিতকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেনঃ তুমি বাগানটি গ্রহণ কর এবং উহাকে  (স্ত্রী হাবীবাকে) এক তালাক দাও।

 

এ বর্ণনায় সাবিতের স্ত্রী নাম বলা হয় নাই। কিন্তু বুখারীর-ই অপর একটি বর্ণনায় তাহার নাম বলা হইয়া জমীলা বিনতে ইবনে সলুল। বর্ণনায় বলা হইয়াছে, জমীলা সাবিতের পূর্বে হানজালা ইবনে আবূ আমেরের স্ত্রী ছিল। পরে সাবিতের সঙ্গে বিবাহ হয়। ইবনে মাজার বর্ণনায়ও এই নামই বলা হইয়াছে।

 

প্রথমোদ্ধৃত হাদীসটির শেষ কথাটিতে দাবিকরা হইয়াছে যে, সাবিত হাবীবাকে যে খোলা তালাক দিয়াছিল, তাহাই ছিল ইসলামী সমাজের প্রথম খোলা তালাক। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর একটি বর্ণনায় ভিন্ন কথা বলা হইয়াছে। সে বর্ণনাটি এইঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর ভগ্নির খোলা তালাকই ইসলামী সমাজের প্রথম ঘটনা। সে নবী করীম (স)-এর নিকট আসিল ও বলিল ইয়া রাসূল! আমার ও তাহার মাথা কখনও একত্রিত হয় না। আমি তাঁবুর এক পাশ খুলিয়া তাকাইয়া দেখিলাম সে কয়েকজন লোক সমভিব্যহারে চলিয়া আসিতেছে। বুঝিতে পারিলাম, সে সঙ্গের অন্যান্য সব লোকের তুলনায় অধিক উৎকৃষ্টভাবে কৃষ্ণবর্ণ, আকৃতিতে সকলের অপেক্ষা ছোট ও বেঁটে এবং চেহারার দিকদিয়া সকলের তুলনায় অধিক কুৎসিত ও বীভৎস। তখন নবী করীম (স) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কি তাহার দেওয়া বাগানটি ফেরত দিবে? সে বলিল, হ্যাঁ, দিব। সে তাহারও বেশী চাহিলে তাহাও তাহাকে দিব। পরে নবী করীম (স) এই দুইজনের মধ্যে বিচ্ছেধ ঘটাইয়া দেন।

 

(আল-কুরতুবী)

 

আল্লাম কুরতুবী বলিয়াছেন, ‘খোলা তালাক’ পর্যায়ে এইটিই আসল হাদীস- মূল ভিত্তি। জমহুর ফিকাহবিদগণেরও এই মত। ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ শরীয়াতবিদদের নিকট হইতে আমি সব সময় এই কথাই শুনিয়া আসিতেছি। আর বস্তুতও এই মতটি সর্বসম্মত।

 

এই সব আয়াত ও হাদীস হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, স্বামী যদি স্ত্রীকে কোন কষ্ট না দেয়, কোনরূপ খারাপ বা ক্ষতিকর আচরণ না করে, সে তালাক দিতে ইচ্ছুকও না হয়, তাহা সত্ত্বেও এরূপ অবস্থায় কেবল স্ত্রীই যদি স্বামী হইতে তালাক দিতে উদ্যোগী হয়, তাহা হইলেঃ

 

****************************************

 

তালাকের বদলে স্ত্রী যাহা কিছুই দিতে প্রস্তুত হইবে, তাহা সবই গ্রহণ করা স্বামীর জন্য সম্পূর্ণ হালাল- যেমন নবী করীম (স) ইহা করাইয়াছেন।

 

পক্ষান্তরে দুর্ব্যবহার ও খারাপ আচরণ যদি স্বামীর হয়, সে যদি স্ত্রীকে কষ্ট দেয়, তাহার ক্ষতি করে, তাহা হইলে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে যাহা কিছু গ্রহণ করিয়াছে, তাহা সে ফেরত দিতে বাধ্য হইবে, সেই সঙ্গে তালাকও দিবে।

 

কিছু লোকের মতে খোলা তালাক লওয়া জায়েয হইবে কেবল মাত্র তখন যখন উভয়ের মধ্যে চরম বিরোধ ও ক্ষতিকর অবস্থার উদ্ভব হইবে। খোলা তালাদের জন্য ইহাই শর্ত। সাবিত সম্পর্কিত আলোচ্য ঘটনা সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণনাটির ভাষা হইল সমর্থক। তাহা হইল, হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

সহল তনয়া হাবীবা সাবিত ইবনে কায়সের স্ত্রী ছিল। সে তাহাকে মারধর করে এবং তাহার কাঁধ চূর্ণ করিয়া দেয়। সকাল বেলা সে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইহার অভিযোগ করে। নবী করীম (স) সাবিতকে ডাকিয়া বলিলেনঃ তুমি ইহার নিকট হইতে তাহার কিছু মাল-সম্পদ গ্রহণ কর ও তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দাও।

 

এই বর্ণনাটি হইতেও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর নিকট হইতে ধন-মাল লইয়া তাহাকে তাহার প্রস্তাব অনুযায়ী তালাক দেওয়া জায়েয। এই বর্ণনার শেষে বলা হইয়াছে, সাবিত নবী করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

 

****************************************

 

ইহা আমার জন্য ভাল হইবে, ইয়া রাসূল?

 

তিনি বলিলেন হ্যাঁ, তখন সাবিত বলিলেনঃ

 

****************************************

 

আমি তাহকে দুইটি বাগান মহরানা স্বরূপ দিয়াছি এবং সে দুইটই তাহার হাতে রহিয়াচে।

 

নবী করীম (স) বলিলেনঃ ******** এই দুইটি বাগানই তুমি ফিরাইয়া লও এবং তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দাও।

 

বস্তুত ইহাই জমহুর ফিকাহবিদদের মত। তাঁহারা বলিয়াছেনঃ

 

****************************************

 

স্বামীর কোন রূপ ক্ষতিকর আচরণের অভিযোগ ছাড়াই খোলা তালাক লওয়া জায়েয।

 

এ ক্ষেত্রে সূরা বাকারার আয়অতটির ভিত্তিতে বিপরীত কথা বলা যাইতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা’আলা উহাকে শর্ত হিসাবে পেশ করেন নাই। খোলা তালাকের সাধারণ প্রচলিত নিয়মের ও অবস্থার দৃষ্টিতেই সে কথাটি বলা হইয়াছে। এ সম্পর্কে আল্লাহর একথাটিও স্মরনীয়ঃ

 

****************************************

 

স্ত্রী যদি নিজ হইতেই কোন কিছু দেয় তবে তোমরা তাহা খুব স্বাদ লইয়াই খাইবে।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]