হযরত উম্মে সালমা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, একজন স্ত্রীলোক রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলঃ ইয়া রাসূল! আমার মেয়ের স্বামী মরিয়া গিয়াছে। এখন তাহার চক্ষুদ্বয় রোগাক্রন্ত হইয়া পড়িয়াছে। এমতাবস্থায় আমরা কি তাহাকে সুর্মা ব্যবহার করাইব? জওয়াবে রাসূলে করীম (স) বলিলেন, না। দুইবার কি তিনবার জিজ্ঞাসার প্রত্যেক বারের জওয়াবে তিনি না-ই বলিতে থাকিলেন। পরে বলিলেন,ইহাতো ইদ্দাতের চার মাস দশদিনের ব্যাপার মাত্র। অথচ জাহিলিয়াতের জামানায় তোমাদের এক-একজন বৎরের মাথায় গিয়া উষ্ট্রীর গোবর নিক্ষেপ করিতে।
(তিরমিযী, বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ যে স্ত্রীর স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে, সে কতদিনের ইদ্দাত পালন করিবে এবং ইদ্দাত কালে কি করিত পারিবে, কি পারিবে না, হাদীসটিতে সেই বিষয়ে কথা বলা হইয়াছে। হাদীসটির শেষাংশে ইসলাম পূর্ব কালে স্বামী মরা স্ত্রীরা কি করিত সে দিকে ইংগিত করা হইয়াছে।
বস্তুত স্বামীর মৃত্যু জনিত ইদ্দাত চার মাস দশ দিন। ইহা সুনির্দিষ্ঠ। এই মেয়াদ নির্দিষ্ট করার মূলে গর্ভে সন্তান সঞ্চার হওয়ার জন্য জরুরী সময়ের যৌক্তিকতা রহিয়াছে। মূলত ইদ্দাত পালনের একটি উদ্দেশ্য হইল, স্বামীল মৃত্যুতে শোক পালন। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, স্ত্রীর গর্ভে কোন সন্তান আছে কিনা তাহা দেখা। প্রজনন বিদ্যা পারদর্শীদের মতে মা’র গর্ভে সন্তান পুরাপুরি দানা বাঁধিয়া উঠিতে এবং উহাতে প্রাণের সঞ্চার হইতে অন্তত একশত বিশ দিন অর্থাৎ চারটি পূর্ণ মাস সময় প্রয়োজন। আর সতর্কতাবলম্বনের উদ্দেশ্যে আর মাত্র দশটি দিন অতিরিক্ত ধরা হইয়াছে। কেননা চন্দ্র মাস বেশী ক ম হইতে পারে বিধায় কখনও কম হইয়া গেলে এই অতিরিক্ত ধরা দশটি দিন দ্বারা সেই কমতি পূরণ করা হইবে। কুরআন মজীদে এই মেয়াদের ইদ্দাত কার মূলে নিহিত হইই কারণ। বলা বাহুল্য, চার মাস দশ দিনের সঙ্গে উহার রাত্র গুলিও অবশ্যই ইদ্দতের মধ্যে গণ্য করিতে হইবে। এই কারণে পরবর্তী স্বামী একাদশ রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তাহার সহিত সঙ্গম করিতে পারিবে না।
(**********)
হাদীসটিতে যে সুর্মা লাগানো ব্যাপারটির উল্লেখ হইয়াছে উহার কারণ হইল স্বামী-মৃত্যুর কারণে স্ত্রীর শোক পালন। কিন্তু সুর্মা লাগানো বিশেষত মেয়েদের জন্য যেহেতু বিলাসিতা ও সাজ-শয্যার উদ্দেশ্যে প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহারের মধ্যেও গণ্য হইতে পারে। এই কারণে উহা ইদ্দাত কালে ব্যবহার করা জায়েয কিনা, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়াছে। আর এই বিষয়ে শরীয়াতের ফয়সালা কি তাহাই এই হাদীসটির আলোচ্য
কাযী ইয়ায বলিয়াছেন, জাহিলিয়াতের যুগে কোন স্ত্রীলোকের স্বামী মরিয়া গেলে সে একটি সংকীর্ণ ঘরে প্রবেশ করিত, নিকৃষ্ট ধরনের পোশাক পরিধান করিত। কোনরূপ সুগন্ধি ব্যবহার করাও তাহার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এতদ্ব্যতীত কোন রূপ প্রসাধন দ্রব্য বা অলংকারাদি ব্যবহার করারও তাহার জন্য অনুমতি ছিল না। এই ভাবে দীর্ঘ একটি বৎসর কাল অতিবাহিত হইয়া যাইত। পরিশেষে একটি বশেষ অনুষ্ঠান পালনের পরই সে কোনরূপ সুগন্ধী ব্যবহার করিতে পারিত। কিন্তু ইসলাম এই সব বদ রসম বাতিল করিয়া দিয়াছে।
ইসলামে স্বামী মরা স্ত্রীর জন্য মাত্র চার মাস দশ দিন ইদ্দাত পালনের মেয়াদ নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। রাসূলে করীম (স)-এর কথা হইর, জাহিলিয়াতের জামানার কষ্টকর ও দীর্ঘ মেয়াদী অপেক্ষার পরিবর্তে এখন মাত্র এই সময়টুকুও অপেক্ষা করা তোমাদের পক্ষে কষ্টকর বোধ হইতেছে, ইহা কেমন কথা! এই স্বল্প সময়টুকুর মধ্যে আবার তোমরা চোখের সামান্য কষ্টের জন্য ইসলামের সহজ নিয়মাদিও পালন করিতে প্রস্তুত হইতে চাহেনা। অথচ অপেক্ষার সময় কাল চারমাস দশ দিনের বেশী নয়। কাজেই এই সংক্ষিপ্ত মেয়াদের মধ্যে তোমরা চোখে সুর্মা লাগাইবা রকাজ করিবা না। স্বামী মরা যে স্ত্রী লোকটির চোখে সুর্মা লাগাইবার এই বর্ণনা,- ইবনে অহব তাঁহার ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হে বলিয়াছেন- তাহার নাম আতেকা বিনতে নয়ীম ইবনে আবদুল্লাহ।
(*******)
হযরত উম্মে আতীয়াতা (রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম (স) সুর্মা ব্যবহার করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়া বলিয়াছেনঃ ********* ‘তুমি সুর্মা ব্যবহার করিও না’। এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, স্বামী মরা স্ত্রীর পক্ষে ইদ্দাত কালে সুর্মা ব্যবহার করা হারাম। উহার প্রয়োজন দেখা দিক আর না-ই দিক, কোন অস্থায়ই সুর্মা ব্যবহার করা যাইবে না।
হযরত উম্মে সালমা বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর কথাটি এই ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
****************************************
তুমি রাত্রি বেলা সুর্মা লাগাও, আর দিনের বেলা উহা মুছিয়া ফেল।
এই কথা হইতে ইদ্দাত কালে সুর্মা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ ও সার্বিক ভাবে হারাম প্রমাণিত হয় না। বরং রাত্রি বেলা উহা ব্যবহার করার সুস্পষ্ট অনুমতি ঘোষিত হইয়াছে। যদিও দিনের বেলা উহা মুছিয়া ফেরার নির্দেশও সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছে। ফলে এই দুই ধরনের হাদীসে স্পষ্ট বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যাইতেছে।
উক্ত দুই প্রকারের কথার মাঝে সংগতি ও সামঞ্জস্য সৃষ্টির পর্যায়ে হাদীসবিদগণ বলিয়াছেন, স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত পালন কালে যদি রোগের চিকিৎসার্থে সুর্মা ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহা হইলে এই শেষোক্ত হাদীস অনুযায়ী কেবলমাত্র রাত্রি বেলা তাহার ব্যবহার করা জায়েয হইবে, দিনের বেলায় নয়। আর প্রয়োজন ব্যতীত তাহা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারামই থাকিবে। আর প্রয়োজন বশত যদি কেহ রাত্রি বেলা উহা ব্যবহার করেও, তবুও দিনের বেলা উহা সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলা কর্তব্য হইবে। তবে প্রয়োজন দেখা দেওয়া সত্ত্বেও যদি উহার ব্যবহার না করিয়া পারে এবং উহার ব্যবহার করা হইতে বিরত থাকে, তবে তাহাই উত্তম।
এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী অনুমতি দেওয়ার হাদীসটি হইতে বুঝিতে হইবে যে, মূলত উহা ব্যবহার করার অনুমতি না থাকিলেও কেবল মাত্র প্রয়োজনের কারণে ব্যবহার করা হারাম হইবে না এবং তাহাও কেবলমাত্র রাত্রি বেলার জন্য। আর যে হাদীসে স্পষ্ট নিষেধ উদ্ধতৃ হইয়াছে, সে হাদীসটি সম্পর্কে মনে করিতে হইবে যে, ইহা কোনরূপ প্রয়োজন না হওয়া অবস্থার জন্য শরীয়াতের ফয়সালা। উপরন্তু যে হাদীসে চোখের অসুখ হওয়ার কথা বলা সত্বেও নিষেধ উদ্ধৃত হইয়াছে, মনে করিতে হইবে যে, এই নিষেধ তানজীহী মাত্র। অর্থাৎ কাজটি মূলত হারাম নয়; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও উহা করিতে নিষেধ করা হইয়াছে কেবলমাত্র স্বামীর মৃত্যুর কারণে স্ত্রীর শোক পালনের নিয়ম হিসাবে। অন্যান্য ফিকাহবিদদের মতে এই নিষেধ কেবলমাত্র সেই সুর্মা সম্পর্কে যাহা নিছক প্রসাধন দ্রব্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যাহা ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এই নিষেধ সে সম্পর্কে নয়্
এই প্রেক্ষিতেই স্বামী-মৃত্যুর শোক পালন রত ও ইদ্দত পালনকারী স্ত্রীল পক্ষে সুর্মা বা কোন রূপ সুগন্ধী ব্যবহার পর্যায়ে ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে। সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, সুলাইমান ইবনে ইয়ামার এবং ইমাম মালিক হইতে একটি বর্ণনানুযায়ী চোখের ব্যাপার বড় বকমের ক্ষতির আশংকা দেখা দিলে সুগন্ধীহীন সুর্মা ব্যবহার করা জায়েয। অনেক ফিকাহবিদ বলিয়াছেন, প্রয়োজন হইলে উহা ব্যবহার করা জায়েয- উহাতে সুগন্ধী থাকিলে দোষ হইবে না। কেবল শরীয়াতের আইনে প্রকৃত প্রয়োজন রক্ষার স্পষ্ট অনুমতি রহিয়াছে, তাহাতে হারাম জিনিস ব্যবহার করিতে হইলেও। ইমাম শাফেয়ীর মতে প্রয়োজন হইলে সুগন্ধীহীন সুর্মা ব্যবহার করা যাইবে কেবলমাত্র রাত্রি বেলা, দিনের বেলা নহে।
রাসূলে করীম (স)-এর কথাঃ ********** ইহা মাত্র চার মাস দশ দিনের ব্যাপার- ইহার বেশী নয়। ইহা হইতে প্রমাণিত হইল যে, জাহিলিয়াতের জামানার দীর্ঘ এক বৎসর কাল ইদ্দাত পালনের প্রচলনকে ইসলাম মনসুখ ও বাতিল করিয়া দিয়াছে। জাহিলিয়াতের জামানায় স্ত্রী লোকদের ইদ্দাত পালন ছিল অত্যন্ত কঠোরও কষ্টসাধ্য এক কৃচ্ছ সাধনার ব্যাপার। এই পর্যায়ে হযরত উম্মে সালমারই অপর একটি বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ
****************************************
জাহিলিয়াতের জামানায় কোন মেয়েলোকের স্বামী মরিয়া গেলে সে একটি ঝুপড়ি কিংবা তাঁবুতে প্রবেশ করিত, নিকৃষ্টতম কাপড় পরিধান করিত, কোনরূপ সুগন্ধি ব্যবহার করিতে পারিত না- কোন জিনিসই না, এই ভাবে দীর্ঘ একটি বৎসর অতিবাহিত হইয়া যাইত। পরে একটি গাধা বা ছাগল কিংবা একটি পাখী তাহার নিকট দেওয়া হইত। সে উহার উপর পানি ছিঁটাইত।
ইবনে কুতাইবা হিজাজ বাসীদের কথার আলোকে এই কথাটির ব্যাখ্যা দিয়াছেন এইভাবে যে, ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের জামানায় ইদ্দাত পালনকারী স্ত্রী গোসল করিতে পারিত না, পানি ছুঁইতে পারিত না। নখ কাটিতে পারিত না। এই অবস্থায় একটি বৎসর কাল কাটাইয়া দেওয়ার পর অত্যন্ত বীভৎস চেহারা ও আকার-আকৃতি লইয়া তাঁবু হইতে বাহির হইত, পরে একটি পাখী বা ছাগী কিংবা কোন জন্তুর সাহায্যে ইদ্দাত ভঙ করিত। তাহা এই ভাবে যে, প্রথমে সেটি পানি দ্বারা গোসল করাইত, পরে সে নিজেও গোসল করিত। ইমাম মালিক বলিয়াছেন, পানি দ্বারা উহার পক্ষ ও পালক বা গাত্র মুছিয়া দিত। ইবনে অহাব বলিয়াছেন, স্ত্রী লোকটি নিজের সিক্ত হাত দ্বার উহার পিঠ মালিশ করিয়া দিত। অপর লোকদের জন্তু বা পাখীকে গোসল করাইবার পর সে নিজেও সেই পানি দ্বারা গোসল করিত। এবং পরে সে ভাল পানি দ্বারা গোসল করিয়া নিজের শরীরকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করিয়া লইত। ইহার পর সে ঘর হইতে বাহির হইত। তখন তাহার হাতে গোবর তুলিয়া দেওয়া হইত। সে উহা নিক্ষেপ করিত। এই রূপ ঘৃণ্য পন্হায় ইদ্দাত কাল অতিক্রম করাই ছিল জাহিলিয়াতের সময়ের সাধারণ প্রচলিত নিয়ম। অর্থাৎ ইসলাম পূর্ব কালে স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত কাল ছিল পুর্ণ একটি বৎসর। ইসলাম তাহা বাতিল করিয়া মাত্র চার মাস দশ দিন ইদ্দাতের মেয়াদ নির্দিষ্ঠ করিয়া দিয়াছে।