মালিক ইবনে সিনানের কন্যা ফুরাইয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি জানাইয়াছেন যে, তিনি রাসূলে করীম (স) কে এই কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিলেন যে, তিনি বনু খুদরা বংশে অবস্থিত তাঁহার পারিবারবর্গের নিকট ফিরিয়া যাইবেন কিনা। কেননা তাঁহার স্বামী তাহার পালাইয়া যাওয়া ক্রীত দাসগণের সন্ধানে বাহির হইয়াছিল, তিনি যখন ‘তরাফূল কুদুম’ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন উহারা তাঁহার নিকট আসিয়া তাঁহাকে হত্যা করিয়া ফেলিয়াছে। ফুরাইয়া বলেন, আমি রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি আমার পিতৃ বংশের লোকদের নিকট ফিরিয়া যাইব কিনা? কেননা আমার স্বামী আমার জন্য এমন কোন ঘরবাড়ী রাখিয়া যায় নাই (কিংবা আমাকে এমন গরে রাখিয়া যায় নাই) যাহার সে মালিক এবং খরচ পত্রেরও কোন ব্যবস্থা করিয়া যায় নাই। ফুরাইয়া বলেন, আমার এই কথা শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ হ্যাঁ। ফুরাইয়অ বলিয়াছেন, অতঃপর আমি ফিরিয়া যাইতে লাগিলাম।
পরে আমি হুজরা কিংবা মসজিদের মধ্যে থাকিতেই রাসূলে করীম (স) আমাকে ডাকিলেন কিংবা আমাকে ডাকার জন্য আদেশ করেন, ফলে আমি ডাকিত হই। পরে রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ তুমি কিসের কথা বলিলে? ফুরাইয়া বলেন, অতঃপর আমি আমার স্বামী সম্পর্কে ইতিপূর্বে যাহা বলিয়াছিলাম সেই সমস্ত কাহিনী আবার বলি। সবকিছু শুনিয়া নবী করীম (স) বলিলেনঃ তুমি তোমার ঘরে অবস্থান কর যতক্ষণ না ইদ্দাতের মেয়াদ সম্পূর্ণ হয়। ফুরাইয়া বলিয়াছেন, অতঃপর আমি আমার থাকার ঘরে চার মাস দশদিন ইদ্দাত পালন করি। ফুরাইয়া বলেন, হযরত উসমান যখন খলীফা হলেন, তখন তিনি আমার নিকট লোক পাঠাইয়া আমাকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাঁহাকে সব খবর জানাইয়া দেই। তখন তিনি পূর্ব সিদ্ধান্তই অনুসরণ করেন এবং উহারই ফয়সালা করিয়াছেন।
(মুয়াত্তা মালিক, তিরমিযী, আবূ দায়ূদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী)
ব্যাখ্যাঃ এই দীর্ঘ হাদীসটিতে স্বামী মরিয়া যাওয়া এক স্ত্রীর ইদ্দাত পালন কালানী অবস্থান সমস্যার বিবরণ এবং রাসূলে করীম (স) কর্তৃক দেওয়া উহার সমাধান বিস্তারিত ভাবে বিবৃত হইয়াছে।
স্ত্রী লোকটির নাম ফুরাইয়া। তিনি একজন মহিলা সাহাবী ছিলেন। বনু খুদরা নামক এক প্রখ্যাত গোত্রের কন্যা এবং প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ সায়ীদ খুদরির ভগ্নি ছিলেন। তাহার সম্পর্কিত এই দীর্ঘ বিবরণ জয়নাব বিনতে কায়াব কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। ফুরাইয়ার স্বামীর নাম না মূল হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে, না হাদীসটির কোন ব্যাখ্যাকারী তাহা বলিয়াছেন। ফুরাইয়া তাঁহার স্বামীর নিহত হওয়ার কাহিনী নিজেই বলিয়াছেন। তাঁহার স্বামীর অনেকগুলি ক্রীতদাস ছিল। তাহারা পালাইয়া গিয়াছিল। স্বামী তাহাদের সন্ধানে ঘর হইতে বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। ঘুরিয়া ফিরিয়অ মদীনা শহর হইতে ছয় মাইল অবস্থিত ‘তরফুল কুদুম’ (অগ্রসর হইয়া আসার দিক) নামক স্থানে পৌঁছিয়াছিল, তখন সেই ক্রীতদাসগুলি তাহাকে হত্যাক করে। ইহাতে ফুরাইয়া বিধবা হইয়া যায়। অতঃপর তাঁহাকে স্বামীর ইদ্দাত চার মাস দশ দিন পর্যন্ত পুনর্বিবাহের অপেক্ষায় থাকিতে হইবে। কিন্তু এই সময় তিনি কোথায় অবস্থান করিবেন, তাহাই ছিল সমস্যা। তিনি তাঁহার এই সমস্যার কথা বলার ও ইহার সমাধান পাওয়ার উদ্দেশ্যেই নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। তিনি তাঁহাকে তাঁহার স্বামীল নিহত হওয়ার কাহিনী বলার পর বলিলেন, তাঁহার স্বামীর নিজের মালিকানায় কোন ঘর নাই এবং খরচ পত্রেরও কোন ব্যবস্থা নাই, এমতাবস্থায় তিনি তাঁহার পিতৃবংশের লোকদের নিকট ফিরিয়া যাইবে কিনা তাহা জানিতে চাহিলেন। নবী করীম (স) প্রথমে তো বলিলেন হ্যাঁ! অর্থাৎ যাও। কিন্তু ফুরাইয়ার মসজিদে নববী হইতে বাহির হইয়া চলিয়া যাওয়ার পূর্বেই আবার তাঁহাকে ডাকিয়া তিনি বলিলেনঃ তুমি যে ঘরে এতকাল ধরিয়া অবস্থান করিতেছিলে, এখনও সেই ঘরেই থাক ও অবস্থান কর। যতক্ষণ না কুরআনের লিখিয়া দেওয়া ফরয করিয়া দেওয়া তোমার ইদ্দাত খতম হয়। হাদীসের ভাষা হইলঃ ********* ইহার শাব্দিক তরজমা হয়ঃ যতক্ষণ না ‘লেখা’ উহার মিয়াদ পর্যন্ত পৌঁছায়। ইহার অর্থ ইদ্দাত কাল শেষ হওয়া। ইদ্দাত কালকে ‘কিতাব’ বলা হইয়াছে, কেননা এই ইদ্দাত- অর্থাৎ স্বামী মরিয়া গেলে স্ত্রীর ইদ্দাত পালনের এই কথাটি আল্লাহর কিতাবে লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং চার মাস দশ দিনের মেয়াদে ইদ্দাত পালন করা আল্লাহ তা’আলা ফরয করিয়া দিয়াছেন।
এই বিবরণ হইতে স্পষ্ট ভাবে জানা গেল, স্বামী মরিয়া গেল স্ত্রীকে মৃত্যু জনিত ইদ্দাত পালন করিতে হইবে। কিন্তু এই ইদ্দাতের কালে সে কোথায় অবস্থান করিবে এই সময়টা সে কোথায় থাকিয়া কাটাইবে, ইহা ফিকাহশাস্ত্রের একটা বিতর্কিত বিষয়। ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেনঃ
****************************************
নবী করীম (স)-এর সাহাবীদের মধ্যে যাঁহারা বিশেষজ্ঞ তাঁহারা ও অন্যান্যরা এই হাদীস অনুযায়ী আমল করিয়াছেন। তাঁহারা ইদ্দাত পালনারী স্ত্রীর পক্ষে ইদ্দাত সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বামীর ঘর ছাড়িয়া যাওয়ার অনুকুলে মত প্রকাশ করেন নাই।
তিনি আরও লিখিয়াছেন যে, সুফিয়ান সওরী, ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ ও ইসহাক প্রমুখ ফিকাহবিদগণও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তবে অন্য কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সাহাবীগণ ও কতিপয় ফিকাহবিদ এই মতও দিয়াছেন যে, স্বামী মরা স্ত্রীর যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকিয়াই ইদ্দাত পালন করিতে পারে। স্বামীর গরে থাকিয়া ইদ্দাত পালন না করিলেও কোন দোষ নাই। ইমাম তিরমিযীর কথা এই পর্যন্তই।
শরহহিস সুন্নাহ গ্রন্হে বলা হইয়াছে, স্বামী মরা স্ত্রীর ইদ্দাত পালন কালীন অবস্থান সম্পর্কে ফিকাহবিগণ বিভিন্ন মত দিয়াছেন। এই পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ীর দুইট কথা বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার সহীহতম কথা হইল, স্বামী মরা স্ত্রীকে ইদ্দাত পালন কালে অবস্থানের জন্য স্থান দিতে হইবে। হযরত উমর হযর উসমান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এবং ইমাম আবূ হানীফা প্রমুখ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদর বক্তব্য হইল, উপরোদ্ধৃত হাদীসে নবী করীম (স) ফুরাইয়াকে প্রথমে বাপের বাড়ি চলিয়া যাওয়ার অনুমতি দিয়াছিলেন; কিন্তু পরে বলিয়াছেনঃ ********* ‘তুমি তোমার বর্তমান ও এ যাবত কালের অবস্থানের ঘরেই বসবাস কর’। ইহাতে এই শেষোক্ত কথাটি দ্বারা তাঁহার প্রথম কথাটি মনসুখ ও বাতিল হইয়া গিয়াছে। ইহার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ
****************************************
এই ঘটনায় একথার দলীল রহিয়াছে যে, শরীয়াতের দেওয়া কোন হুকুম অনুযায়ী আমল করার পূর্বেই উহাকে মনসুখ করা সম্পূর্ণ জায়েয।
এই বিষয়ে ইমাম শাফেয়ীর দ্বিতীয় কথা এই যে, স্বামী-মরা স্ত্রীকে ইদ্দাত কালে বসবাসের স্থান দেওয়া জরুরী নয়। সে যেখানে ইচ্ছা ইদ্দাত পালন করিতে পারে। হযরত আলী হযরত ইবনে আব্বাস হযরত আয়েশা (রা) এই মত দিয়াছেন। তাঁহাদের দলীল হইল, নবী করীম (স) ফুরাইয়াকে তাঁহার পিতৃ ঘরে ফিরিয়া যাওয়ার অনুমতি দিয়াছিলেন। এই অনুমতির অর্থ হ ইল, বসবাসের স্থান স্বামীর নিকট হইতে পাওয়ার তাহার অধিকার নাই। আর পরে যে তিনি ফুরাইয়াকে তাঁহার স্বামীর ঘরে থাকিয়া ইদ্দাত পালন শেষ করার নির্দেশ দিয়াছিলেন, এই নির্দেশ মুস্তাহাব পর্যায়ের। কিন্তু ইহা সহীহ কথা মনে হয় না।
হাদীসবিদ মুল্লা আলী আল কারী লিখিয়াছেন, স্বামী মরা স্ত্রীকে যে স্বামীর ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইত হইবে না, তাহাতো কুরআন মজীদেই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। কুরআনের সে আয়াতটি এইঃ
****************************************
তোমাদের মধ্যে যাহারা মরিয়া যায় ও স্ত্রীদের রাখিয়া যায় তাহারা যেন তাহাদের স্ত্রীদের জন্য অছীয়াত করিয়া যায় এক বৎসর কালের জীবন-জীবিকা দেওয়ার, ঘর হইতে বাঞ্ছিত না করার অবস্থায়।
মুল্লা আলী আল কারী বলিয়াছেন, এই আয়াত হইতে প্রমাণিত হয় যে, স্বামী মরা স্ত্রীর তাহার স্বামীর ঘরে অবস্থান করিবে এবং সেখান হইত তাহাকে বহিষ্কৃত করা চলিবে না। পরে অবশ্য এক বৎসর কালের কথাটি মনসুখ হইয়া গিয়াছে এবং সেখানে চার মাস দশ দিন ইদ্দাত কাল নির্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু তাহাকে যে ঘর হইতে বাহির করা যাইবে না, এই কথাটি মনসুখ হয় নাই। ইহা অপরিবর্তিত রহিয়া গিয়াছে।
ইবনুল কাতান বলিয়াছেন, এই হাদীসিট সহীহ। ইবনে আবদুল বার বলিয়াছেন, ইহা এক প্রখ্যাত হাদীস। কাজেই ইহাকে অবশ্যই গণ্য ও গ্রহণ করিতে হইবে এবং এই অনুযায়ী আমলও করিতে হইবে। এই পর্যায়ে দারে কুতনীর একটি বর্ণনার কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। তাহাতে নবী করীম (স) স্বামী মরা এক স্ত্রীকে নির্দেশ দিয়াছিলেনঃ ************ সে যেখানে ইচ্ছা ইদ্দাত পালন করিতে পারে। দারে কুতনী বলিয়াছেন, এই হাদীসের সনদে আবূ মালিক নখয়ী যয়ীফ। ইবনুল কাতান বলিয়াছেন, ইহা অপর একজন বর্ণনাকারী মাহবুব ইবনে মুহরাজও যয়ীফ। আতা ইবনে আবদ সংমিশ্রণকারী আর আবূ বকর ইবনে মালিক সর্বাধিক যয়ীফ। ইমাম শওকানী লিখিয়াছেন, ফুরাইয়ার হাদীসটি হইতে প্রমাণিত হয় যে, যে ঘরে থাকা অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনিতে পায়, তাহার সেই ঘরেই অবস্থান করা উচিত এবং উহা হইতে বাহির হইয়া অর্থাৎ সেই ঘর ত্যাগ করিয়া সে অন্যত্র চলিয়া যাইবে না।