বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, কুরআন ও হাদিসের আলোকে শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
শবে বরাত শব্দের অর্থ কি
কোরআনের আলোকে শবে বরাত
শবে বরাতের হাদিস সমূহ
১. শবে বরাতে বিশেষ ক্ষমা সংক্রান্ত হাদীস
২. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীস
৩. শবে বরাতের দোয়া সংক্রান্ত হাদীস
৪. শবে বরাতে কবর জিয়ারত সংক্রান্ত হাদীস
৫. শবে বরাতের নামাজ ও দোয়া সংক্রান্ত হাদীস অনির্ধারিত পদ্ধতিতে
৬. শবে বরাতের নামাজ সংক্রান্ত হাদীস নির্ধারিত পদ্ধতিতে
কিছু সনদ বিহীন বানােয়াট কথা
১. শবে বরাতের গােসল
২. শবে বরাতের হালুয়া রুটি
৩. শবে বরাতের রোজা
প্রচলিত আরাে কিছু ভিত্তিহীন কথা
সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত ও কর্ম
শবে বরাতের আছার সমূহ
চার ইমাম ও অন্যান্য ফকীহের মতামত
শবে বরাতের হাদীসগুলির প্রতিপাদ্য
মুমিন জীবনের প্রতিটি রাতই শবে বরাত
শবে বরাত শব্দের অর্থ কি
ফার্সী ভাষায় শব শব্দটির অর্থ রাত বা রজনী আর বরাত শব্দটির অর্থ ভাগ্য; তাই শবে বরাত শব্দের অর্থ হলো ভাগ্য রজনী; আরবীতে একে লাইলাতুল বারাআত বলা হয়; লাইলাতুল অর্থ রাত বা রজনী আর বারাআত শব্দটির অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কচ্ছিন্নতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি; ফার্সী শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী আরবী লাইলাতুল বারাআত বা বিমুক্তির রজনী বলতে আরবী বছরের ৮ম মাস অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যম রজনীকে বুঝানাে হয়।
কুরআন ও হাদীসে কোথাও লাইলাতুল বারাআত পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়নি; সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগেও এ পরিভাষাটির ব্যবহার জানা যায় না; এ রাতটিকে হাদীস শরীফে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য-শাবানের রজনী বলা হয়েছে; সাহাবী তাবিয়ীগণের যুগের অনেক পরে এ রাতটিকে লাইলাতুল বারাআত বা বিমুক্তির রজনী বলে আখ্যায়িত করার প্রচলন দেখা দেয়।
এ রাতটিকে ফার্সী ভাষায় শবে বরাত বাংলা ভাষায় ভাগ্য রজনী বলা হলেও কুরআন ও হাদিসে কোথাও বলা হয়নি যে এ রাতটি শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী; অর্থাৎ এই রাতে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় বলে যে ধারণা মানুষের মধ্যে রয়েছে তা বানোয়াট বা মিথ্যা।
আমরা জানি, পরিভাষার বিষয়টি প্রশস্ত, তবে মুমিনের জন্য সর্বদা কুরআন সুন্নাহ ও সাহাবীগণের ব্যবহৃত পরিভাষা ব্যবহার করাই উত্তম; তাই আমরা এ রাতটির জন্য লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান পরিভাষাটিই ব্যবহার করব যার বাংলা অর্থ হলো শাবান মাসের মধ্য রজনী।
কোরআনের আলোকে শবে বরাত
শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত পরিভাষা কুরআন কারীমে কোথাও ব্যবহৃত হয়নি; লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রজনী পরিভাষাটিও কুরআন কারীমে কোথাও ব্যবহৃত হয়নি; তবে কুরআন কারীমের একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসিরগণ শবে বরাত প্রসঙ্গ আলােচনা করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন: আমি তাে তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তাে সতর্ককারী; এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।
মুবারক রজনীর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ী বলেছেন যে, এ রাতটি হলাে লাইলাতুল ক্বদর বা মহিমান্বিত রজনী; সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবনু আব্বাস (রা) ও ইবনু উমার (রা) থেকে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে; তাবেয়ীগণের মধ্য থেকে আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হি), মুজাহিদ বিন জাবুর (১০২ হি), হাসান বসরী (১১০ হি), ক্বাতাদা ইবনু দি’আমা (১১৭ হি) ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম (১৮২ হি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য; তারা সকলেই বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ লাইলাতুল ক্বদর।
এ সকল সাহাবী-তাবিয়ীর মতের বিপরীতে একজন তাবিয়ী মত প্রকাশ করেছেন যে, এ আয়াতে বরকতময় রাত্রি বলতে শবে বরাত বুঝানাে হয়েছে । সাহাবী ইবনু আব্বাস (মৃ. ৬৮ হি)-এর খাদেম তাবিয়ী ইকরিমাহ (মৃ. ১০৪ হি) বলেন, এখানে মুবারক রজনী’ বলতে মধ্য শাবানের রাতকে বুঝানাে হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এই রাতে গােটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
অধিকাংশ বর্ণনাকারী এ বক্ত্যবটি ইকরিমার বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন; দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন বর্ণনাকারী বক্তব্যটি ইবনু আব্বাসের বক্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন; আন-নাদর বিন ইসমাঈল (১৮২ হি) নামক একব্যক্তি বলেন, তাকে মুহাম্মদ বিন সুক্কা বলেছেন, তাকে ইকরিমাহ বলেছেন ইবনু আব্বাস থেকে, তিনি উপরে উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: মুবারক রজনী হলাে মধ্য-শাবানের রাত; এতে মৃত্যু বরণকারীদের নাম বর্ণনা করা হয়, হাজ্বীদের তালিকা তৈরি হয়, অতঃপর কোনাে বাড়তি-কমতি করা হয়না।
এ সনদের রাবী আন নাদ ইবনু ইসমাঈল (১৮২ হি) কুফার একজন গল্পকার ওয়ায়েয ছিলেন; তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সৎ হলেও হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার ভুলের কারণে মুহাদ্দিসগণ তাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন; আবুল হাসান ইজলি বলেছেন, এ ব্যক্তি বিশ্বস্ত; ইয়াহয়িয়া বিন সাঈদ বলেছেন, সে একেবারেই অগ্রহণযােগ্য ও মূল্যহীন; ইমাম নাসায়ী ও আবু যুর আ বলেছেন, সে শক্তিশালী বা গ্রহণযােগ্য নয়; ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন বলেছেন: নাদর বিন ইসমাঈল সত্যবাদী তবে সে কি বর্ণনা করে তা নিজেই জানে না; ইমাম বুখারী ইমাম আহমদের বরাত দিয়ে বলেন, এ ব্যক্তি সনদ মুখস্থ রাখতে পারত না; ইবনু হিব্বান বলেন, তার ভুল খুব মারাত্মক, যে কারণে তিনি পরিত্যক্ত বলে গণ্য হয়েছেন।
আন-নাদ ইবনু ইসমাঈলের অবস্থা অবলােকন করলে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি ভুল বশত ইকরিমার বক্তব্যকে ইবনু আব্বাসের বক্তব্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন; তিনি সম্ভবত মুহাম্মাদ ইবনু সূকাকে বলতে শুনেছেন ইবনু আব্বাসের মাওলা ইকরিমা থেকে; তিনি ভুলে বলেছেন ইকরিমা থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে; এভাবে মাকতু হাদীস বা তাবিয়ীর বক্তব্য মাওকুফ বা সাহাবীর বক্তব্যে পরিণত হয়েছে; ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বস্ত অনেক রাবীই স্মৃতির দুর্বলতা, নিয়মিত চর্চা ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের অভাবে এভাবে অনেক সময় মাকতু হাদীসকে মাওকুফ বা মাওকুফ হাদীসকে মারফু রূপে বর্ণনা করেছেন; অন্যান্য রাবীদের বর্ণনার সাথে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ এ সকল ভুল নির্ধারণ করেছেন।
উপরের আলােচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, তাবিয়ী ইকরিমা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি সূরা দুখানে উল্লিখিত মুবারক রজনী বলতে মধ্য শাবানের রজনী বুঝতেন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
উল্লেখ্য যে, মুফাসসিরগণ ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি; প্রসিদ্ধ মুফাসিরদের মধ্যে কেউই ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি; কোনাে কোনাে মুফাসসির দুটি মত উল্লেখ করেছেন এবং কোনােটিরই পক্ষে কিছু বলেন নি; আর অধিকাংশ মুফাসসির ইকরিমার মতটি বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন এবং অন্যান্য সাহাবী-তাবিয়ীর মতটিই সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন; তারা বলেন যে, সঠিক মত হলাে, এখানে মুবারক রজনী বলতে লাইলাতুল ক্বাদরকে বুঝানাে হয়েছে; মহান আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন সে রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল ক্বাদর বা মহিমান্বিত রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন; অন্যত্র এ রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন; এবং এ রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘােষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন; এথেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়; তাদের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ এবং লাইলাতুল ক্বাদর’ একই রাতের দুটি উপাধি।
এ সকল মুফাসসিরের মধ্যে রয়েছেন মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (মৃ. ৩১০ হি), আবু জাফর আহমদ ইবনু মুহাম্মদ আন-নাহহাস (৩৩৮ হি), আবুল কাসেম মাহমুদ ইবনু উমর আয-যামাখশারী (৫৩৮ হি), ইবনুল আরাবী, আবু বকর মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ (৫৩৪ হি), আবু মুহাম্মদ আব্দুল হক ইবনু আতিয়্যা (৫৪৬ হি), আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু আহমদ আল-কুরতুবী (৬৭১ হি), আবু হাইয়্যান মুহাম্মদ ইবনু ইউসুফ গারনাতী (৭৫৪ হি), ইসমাঈল ইবনু উমার আবুল ফিদা, ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি), আবুস সাউদ মুহাম্মদ ইবনু মুহাম্মদ আল ইমাদী (৯৫১ হি), মুহাম্মদ ইবনু আলী আল শাওকানী (১২৫০ হি), সাইয়্যেদ মাহমুদ আলুসী (১২৭০ হি), আশরাফ আলী থানবী (১৩৬২ হি), মুহাম্মদ আমীন আল-শানকৃতী (১৩৯৩ হি), মুফতী মুহাম্মদ শফী, মুহাম্মদ আলী আল-সাবুনী প্রমুখ।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার এ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
সঠিক মত হলাে তাদের মত যারা বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রাত্রি হলাে লাইলাতুল কদর বা মর্যাদার রাত্রি।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
অতঃপর তিনি বলেন যে, বরকতময় রাত্রির ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফয়সালার বিষয়েও আলিমগণ মতভেদ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এ হলাে “লাইলাতুল কদর”, এ রাত্রিতেই পরবর্তী বছরের জন্ম, মৃত্যু, উন্নতি, অবনতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারণ করা হয় । হাসান বসরী, কাতাদা, মুজাহিদ, আবু আব্দুর রাহমান আস-সুলামী, উমার মাওলা গাফরা, আবূ মালিক, হিলাল ইবনু ইয়াসাফ প্রমুখ তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ী থেকে উদ্ধৃত করেন যে, এদের সকলের মতেই লাইলাতুল কদরে এ সকল বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। এরপর তিনি ইকরামা থেকে উদ্ধৃত করেন যে, তার মতে লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বানে এ সকল বিষয়ের ফয়সালা করা হয়।
অতঃপর তিনি বলেন: এতদুভয়ের মধ্যে সঠিকতর মত হলাে যারা বলেছেন যে, লাইলাতুল কাদরে এ সকল বিষয়ের ফয়সালা হয়; কারণ আমরা বলেছি যে, এখানে লাইলাতুম মুবারাকা বলতে তাে লাইলাতুল কাদরকেই বুঝানাে হয়েছে।
এ বিষয়ে আল্লামা আবু বাকর ইবনুল আরাবী (মৃত্যু ৫৪৩ হি) বলেন: অধিকাংশ আলিম বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রজনী হলাে লাইলাতুল কাদর। কেউ কেউ বলেছেন, তা হলাে মধ্যশাবানের রজনী। এ মতটি বাতিল; কারণ মহান আল্লাহ তার সন্দেহাতীভাবে সত্য গ্রন্থে বলেছেন: রামাদান মাস যার মধ্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এ কথাটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছে যে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় রামাদান মাস। অত জানিয়ে বলা হয়েছে বরকতময় রাত্রিতে। কাজেই কেউ যদি মনে করে যে, এ বরকতময় রাত্রিটি রামাদান ছাড়া অন্য কোনাে মাসে তাহলে সে আল্লাহর নামে মহা মিথ্যা বানিয়ে বললাে।
আল্লামা কুরতুবী (৬৭১হি) বলেন: লাইলাতুম মুবারাকা অর্থাৎ বরকতময় রজনী হলাে লাইলাতুল ক্বাদর। ইকরিমাহ বলেছেন, এখানে বরকতময় রজনী বলতে মধ্য-শাবানের রজনী বুঝানাে হয়েছে। প্রথম মতটিই সঠিকতর।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
আল্লামা ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি) নিশ্চিত করেন যে, বরকমতয় রজনী বলতে লাইলাতুল কাদরই বুঝানাে হয়েছে। অতঃপর তিনি বলেন: ইকরিমাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, বরকতময় রাত্রিটি শাবানের মধ্যম রজনী। এমতটি একটি অসম্ভব ও অবাস্তব মত। কারণ কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এ রাত্রটি রামাদানের মধ্যে।
আশরাফ আলী থানবী (১৩৬২ হি) বলেন: অধিকাংশ তাফসিরকারকই লাইলাতুম মুবারাকাকে এখানে শবে ক্বাদর বলিয়া তাফসীর করিয়াছেন এবং এ সম্মন্ধে হাদীসও যথেষ্ট রহিয়াছে। আর কেহ কেহ লাইলাতুম মুবারাকা এর তাফসীর করিয়াছেন শবে বরাত। কেননা শবে বরাত সম্মন্ধেও বহু হাদীস বর্ণিত হইয়াছে যে, শবে বরাতে বৎসরের যাবতীয় কার্যের মীমাংসা হইয়া থাকে। কিন্তু যেহেতু শবে বরাতে কোরআন নাযিল হইয়াছে বলিয়া কোনাে রেওয়ায়াত নাই এবং শবে ক্বদরে নাযিল হইয়াছে বলিয়া স্বয়ং কোরআনের নিশ্চয় আমি তা লাইলাতুল কাদরে অবতীর্ণ করেছি আয়াতেই উল্লেখ রহিয়াছে; সেই হেতু শবে বরাত বলিয়া লাইলাতুম মুবারাকা-এর তাফসীর করা শুদ্ধ নহে বলিয়া মনে হয়।
ইকরিমার মতটি প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে মুফাসসিরগণের এরূপ ঐকমত্যের কারণ হলাে, ইকরিমার এ মতটি কুরআনের স্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র বলা হয়েছে যে, একটি মুবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত স্পষ্ট অর্থ হলাে, আল্লাহ রামাদান মাসের এক রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সে রাত্রটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মুবারক রজনীর ব্যাখ্যায় মধ্য শাবানের রজনীর উল্লেখ করার অর্থ হলাে এই আয়াতগুলির স্পষ্ট অর্থ বিভিন্ন অপব্যাখ্যা ও ঘােরপ্যাচের মাধ্যমে বাতিল করা।
শবে বরাতের হাদিস সমূহ
কুরআন কারীমে শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান সম্পর্কে কোনােরূপ নির্দেশনা নেই। তবে এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মধ্য শাবানের রজনী বা শবে বরাত সম্পর্কে প্রচলিত হাদীসগুলিকে সেগুলির অর্থ ও নির্দেশনার আলােকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
১. শবে বরাতে বিশেষ ক্ষমা সংক্রান্ত হাদীস
২. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীস
৩. শবে বরাতের দোয়া সংক্রান্ত হাদীস
৪. শবে বরাতে কবর জিয়ারত সংক্রান্ত হাদীস
৫. শবে বরাতের নামাজ ও দোয়া সংক্রান্ত হাদীস অনির্ধারিত পদ্ধতিতে
৬. শবে বরাতের নামাজ সংক্রান্ত হাদীস নির্ধারিত পদ্ধতিতে
১. শবে বরাতে বিশেষ ক্ষমা সংক্রান্ত হাদীস
মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলতে বর্ণিত প্রথম প্রকারের হাদীসগুলিতে এ রাতের বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ রাতের মর্যাদা বা ফযীলত অর্জনের জন্য বিশেষ কোনাে কর্ম বা আমলের নির্দেশ দেয়া হয় নি। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলির সারমর্ম এই যে, আল্লাহ্ তায়ালা এ রাতে বান্দাদের খোঁজ খবর নেন, তাদের প্রতি দৃকপাত করেন এবং শির্ক এ লিপ্ত, বিদ্বেষে লিপ্ত, আত্মহননকারী ইত্যাদি কয়েক প্রকারের মানুষ ব্যতীত সকল মানুষের পাপ মার্জনা করে দেন। এ অর্থের হাদীস সমূহ বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে যা সামগ্রিক বিচারে হাদীস বিশারদগণের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ বলে প্রমানিত হয়েছে। এ অর্থের হাদীসগুলি নিম্নে আলােচনা করা হলাে।
হাদীস নং ১:
আবু মূসা আশআরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন,
মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পােষনকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
এ হাদীসটি ইমাম ইবনু মাযাহ একাধিক সনদে ইবনু লাহীয়ার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের মিশরীয় মুহাদ্দিস ইবনু লাহীয়া (১৭৪ হি) কখনাে বলেছেন, তাকে দাহ্হাক ইবনু আইমান, দাহ্হাক ইবনু আব্দুর রাহমান থেকে, তিনি আবু মূসা আশআরী (রা) থেকে হাদীসটি বলেছেন । কখনাে তিনি বলেছেন, তাকে যুবাইর ইবনু সুলাইম, দাহ্হাক ইবনু আব্দুর রাহমান থেকে, তিনি আবু মূসা (রা) থেকে হাদীসটি বলেছেন।
উক্ত ইবনু লাহীয়া (আব্দুলাহ্ বিন লাহীয়া আল হারামী, আবু আব্দুলাহ আল মিসরী) একজন তাবে-তাবেয়ী, বিশিষ্ট আলিম, ফক্বীহ, ক্বারী ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। কিন্তু হাদীস মুখস্থ করা ও রেওয়ায়েত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দুর্বল । বিশেষত তার পাণ্ডুলিপিগুলি পুড়ে যাওয়ার পর। এ কারণেই আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ বিন আবী বা আল বুসিরী (৮৪০ হি) বলেছেন: আব্দুলাহ বিন লাহীয়া-এর দূর্বলতার কারণে আবু মূসা আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের সনদটি দুর্বল।
হাদীস নং ২:
আউফ ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন,
মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন। অতঃপর শিরকে লিপ্ত অথবা বিদ্বেষে লিপ্ত ব্যতীত সকলকে মাফ করে দেন।
এ হাদীসটি আবু বকর আহমদ বিন আমর আল বার তার সনদে ইবনু লাহীয়া থেকে, তিনি তাঁর শায়খ আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউম থেকে, তিনি তার সনদে আউফ বিন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন।
এই সনদটিও ইবনু লাহীয়া ও তার শায়খ আব্দুর রহমানের দূর্বলতার কারণে দূর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । হাফিয নূরুদ্দীন আলী বিন আবি বকর আল-হায়সামী (৮০৭ হি) বলেন: “এ সনদের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউমকে আহমদ বিন সালেহ নির্ভরযােগ্য বলেছেন, পক্ষান্তরে অধিকাংশ ইমাম তাকে দুর্বল হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর ইবনু লাহীয়াও দুর্বল। এছাড়া সনদের অন্যান্য রাবীগণ নির্ভরযােগ্য।
হাদীস নং ৩:
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন,
আল্লাহ তাআলা মধ্য-শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে দৃকপাত করেন। অতঃপর বিদ্বেষী ও আত্মহননকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
এ হাদীসটি ইমাম আহমদ তার সনদে ইবনু লাহীয়া থেকে, তিনি তাঁর শায়খ হুয়াই বিন আব্দিলাহ আল মু’আফেরী থেকে, তিনি আবু আব্দুর রাহমান আল-হাবলী থেকে, তিনি আব্দুলাহ্ বিন আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনু লাহীয়ার দুর্বলতার কারণে এ হাদীসের দুর্বলতা স্পষ্ট। আল্লামা হাইসামী বলেন: এ হাদীসের সনদে ইবনু লাহীয়া রয়েছেন। তিনি দুর্বল, এছাড়া বাকি রাবীগণ নির্ভরযােগ্য।
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস নাসির উদ্দীন আলবানী বলেছেন, ইবনু লাহীয়া এককভাবে এ হাদীস বর্ণনা করেননি, বরং রিশদীন বিন সাদ বিন হুয়াই নামক অন্য রাবীও ইবনু লাহীয়ার উস্তাদ হুয়াই বিন আব্দিলাহ থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ফলে হাদীসটি হাদীস বিশারদদের পরিভাষায় হাসান লি গাইরিহী হিসেবে গণ্য হবে।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
হাদীস নং ৪:
মুয়ায ইবনু জাবাল (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন,
মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী ব্যতীত সকলকে মাফ করে দেন।
এ হাদীসটি ইবনু আবি আসিম তাঁর সনদে মাকহুল থেকে, তিনি মালেক বিন ইউখামের থেকে, তিনি মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন; আল্লামা হায়সামী বলেন, ইমাম তাবারানী এ হাদীসটিকে তাঁর কাবীর ও আওসাত গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন; উক্ত উভয় বর্ণনার রাবীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটির সনদের রাবীগণ নির্ভরযােগ্য; তবে সনদটি বিশুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হবে যদি মালেক বিন ইউখামের থেকে মাকহুলের শ্রবণ প্রমাণিত হয়; মাকহুল তাবেয়ী; তিনি ১১২ হি. অথবা তার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন; মালেক বিন ইউখামেরও তাবিয়ী; তিনি ৭০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন; তার মৃত্যুর সময় মাকহুলের বয়স বিশের কোঠায় ছিল বলে মনে হয়; কাজেই তার সাথে মাকহুলের সাক্ষাত ও শিক্ষা গ্রহণ অসম্ভব নয়; কিন্তু আল্লামা যাহাবী (৭৪৮ হি) মনে করেন মাকহুল মালেক বিন ইউখামের থেকে শ্রবণ করেননি, বরং তিনি অন্য কারাে মাধ্যমে মালিক-এর হাদীস শুনেছেন; বর্ণনার সময় তিনি উক্ত ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন-রূপে মালিক-এর নামে হাদীস বর্ণনা করেছেন; ইমাম যাহাবীর মতানুসারে হাদীসটির সনদ মুনকাতি বা বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল।
হাদীস নং ৫:
আবু সালাবা আল-খুশানী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন,
যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ্ তায়ালা তার সৃষ্টি জীবের প্রতি দৃকপাত করেন; অতপর মুমিনদেরকে মার্জনা করে দেন; আর হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায় লিপ্তদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন।
এ হাদীসটি ইবনু আবী আসিম আহওয়াস বিন হাকিম থেকে তার সনদে আবু সা’লাবা আল-খুশানী (রা) থেকে বর্ণনা করেন; আহওয়াস ব্যতীত এ সনদের সকল রাবী বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য; আহওয়াস সম্বন্ধে ইবনু হাজার (৮৫২হি) বলেন, তিনি তাবিয়ী ছিলেন, আবেদ ছিলেন, তবে তার স্মরণ শক্তি দুর্বল ছিল; এ ধরনের রাবীর বর্ণনা কিছুটা দুর্বল বলে গণ্য হলেও একই অর্থে অন্যান্য রাবীর বর্ণনা থাকলে তা শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়; শাইখ আলবানী এ হাদীসের টীকায় বলেছেন, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ; এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য, শুধুমাত্র আহওয়াস ব্যতীত; তিনি মুখস্ত শক্তিতে দুর্বল; তবে তার মত রাবীর বর্ণনা সমার্থক অন্যান্য রেওয়ায়েত দ্বারা শক্তিশালী বলে গণ্য হবে।
এছাড়া এ হাদীসটি ইমাম তাবারানী ও বায়হাক্বী তাঁদের সনদে মাকহুল থেকে, তিনি আবু সালাবা (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ টিউ থেকে বর্ণনা করেন; ইতােপূর্বে আমরা দেখেছি যে, মাকহুল তাবেয়ী; সাহাবাদের মধ্য থেকে যাঁদের মৃত্যু ৭০ হিজরী সনের পরে হয়েছে; তাঁদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে; আবু সালাবা (রা) ৪০ হিজরী সনে অথবা তার অল্প কিছু পরে ইন্তেকাল করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, হাদীসটির সনদ মুনকাতে বা বিচ্ছিন্ন; আবু সা’লাবা (রা) -এর সাথে মাকহুলের সাক্ষাত হয়নি; তিনি অন্য কারাে মাধ্যমে হাদীসটি শুনেছেন, যার নাম তিনি উল্লেখ করেন নি; এজন্য বায়হাক্বী বলেন, হাদীসটি মাকহুল ও আবু সালাবা -এর মাঝখানে বিচ্ছিন্ন এবং মুরসাল বা বিচ্ছিন্নরূপে হাদীসটি শক্তিশালী।
হাদীস নং ৬:
আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ কি বলেছেন:
যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ্ তায়ালা মুশরিক-অংশীবাদী অথবা বিদ্বেষী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন।
এ হাদীসটি ইমাম বাযযার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হিশাম বিন আব্দুর রহমানের সনদে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন । হিশাম অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি হওয়ার কারণে এ সনদটি দুর্বল। আল্লামা হায়সামী বলেন, এ সনদে হিশাম বিন আব্দুর রহমান সম্বন্ধে কোন কিছু জানা যায়না, তবে সনদের অন্যান্য রাবী নির্ভরযােগ্য।
হাদীস নং ৭:
আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন:
যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ্ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবরতণ করেন। অতঃপর তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে শিরকে জড়িত অথবা নিজের ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পােষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
এ হাদীসটি ইমাম বযযার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক ইবনু আব্দুল মালেকের সনদে আবু বাকর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা হায়সামী বলেন, এ সনদের আব্দুল মালেক ইবনু আব্দুল মালেককে ইবনু আবি হাতিম (রা) তার ‘আল-জারহু ওয়াত তাদীল’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তবে তার কোনাে দুর্বলতা উল্লেখ করেন নি। এছাড়া সনদের রাবীগণ নির্ভরযােগ্য। কিন্তু ইমামুল মুহাদ্দিসীন ইমাম বুখারী (রা) উক্ত আব্দুল মালেক ইবনু আব্দুল মালেক এবং তার এ সনদকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হাদীস নং ৮:
আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:
মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতপর কালব সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লােককে ক্ষমা করে দেন।
হাদীসটি ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন। ১৬ নং হাদীসের আলােচনায় আমরা এর সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব।
হাদীস নং ৯:
তাবিয়ী কাসীর ইবনু মুররা বলেন, রাসূলুল্লাহ কি বলেছেন:
তােমাদের প্রতিপালক মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃকপাত করেন এবং শিরকে লিপ্ত অথবা সম্পর্কছিন্নকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করেন।
এ হাদীসটি হারিস ইবনু উসামা (২৮২ হি) তাঁর মুসনাদে খালেদ ইবনু মাদান থেকে, তিনি কাসীর ইবনু মুররা থেকে মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেন। ইমাম বায়হাক্বীও হাদীসটি তাঁর সনদে মাকহুল থেকে, তিনি কাসীর ইবনু মুররা থেকে বর্ণনা করেন। হাদীসটি উদ্ধৃত করে বাইহাকী বলেন, এটি শক্তিশালী মুরসাল।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
উপরের ৯টি হাদীস একই অর্থ নির্দেশ করে। তা হলাে, এ রাতের মর্যাদা। হাদীসগুলির আলােকে আমরা বুঝতে পারি যে, এ রাত্রের মর্যাদা ও এ রাত্রে মহান আল্লাহ কর্তৃক বান্দাদের ক্ষমা করার বিষয়টি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। শায়খ মুহাম্মদ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (১৩৫৩ হি) উল্লিখিত হাদীসগুলির মধ্য থেকে কতিপয় হাদীস উল্লেখ পূর্বক বলেন, এ হাদীসসমূহ সার্বিক ভাবে ঐ সকল লােকের বিরুদ্ধে একটি শক্ত দলীল যারা মনে করেন যে, মধ্য শাবানের রাতের মর্যাদা সম্পর্কে কোন হাদীস প্রমাণিত হয়নি।
তাঁর সংগে কণ্ঠ মিলিয়ে শাইখ মুহাম্মাদ নাসির উদ্দীন আলবানী বলেন, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ। হাদীসটি অনেক (৮ জন) সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।
সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জামাল উদ্দীন কাসিমী (১৩৩২ হি/১৯১৪ খৃ) ও অন্যান্য কতিপয় আলিম বলেন যে, মধ্য শাবানের ফযীলত সম্বন্ধে কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই । এর প্রতিবাদ করে আলবানী বলেন, বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ায় এবং কঠিন দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকায় হাদীসটি নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই শায়খ কাসিমীর উপরােক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। এছাড়া অন্য যে আলিমই এ ধরনের ঢালাও মন্তব্য করেছেন তাদের সকলের কথাই অগ্রহণযােগ্য। ব্যস্ততা বা গভীর অনুসন্ধানের অভাবের কারণেই তারা এরূপ মন্তব্য করেছেন।
২. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীস
মধ্য-শাবানের রাত্রি বা লাইলাতুল বারাআতের ফযীলতে বর্ণিত দ্বিতীয় প্রকার হাদীসগুলিতে এ রাত্রিতে হায়াত-মওত ও রিযক নির্ধারণের কথা উলেখ রয়েছে। এই অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে রয়েছে:
হাদীস নং ১০:
জন্ম-মৃত্যু লিখা, কর্ম উঠানাে ও রিযিক প্রদান
আয়েশার (রা) সূত্রে কথিত যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সঃ তাকে বলেন, তুমি কি জান আজকের রাত্রিটি কোন রাত্রি? তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ রাত্রে কি আছে? তখন তিনি বলেন,
এ রাতে চলতি বছরে জন্মগ্রহণকারী আদম সন্তানদের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা। হয়। এ রাতে আদম সন্তানদের আমল উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের রিযক অবতীর্ণ হয়।
হাদীসটি খতীব তাবরিযী (৭৫০ হি) “মিশকাতুল মাসাবীহ” গ্রন্থে উদ্ধৃত করে বলেন, বায়হাক্বী তার ‘আদ-দাওয়াতুল কাবীর’ নামক গ্রন্থে হাদীসটি সংকলন করেছেন। ইমাম বাইহাকী নিজেই বলেছেন যে, হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী রয়েছে। উপরন্তু হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী “আন-না ইবনু কাসীর”। এ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোনাে সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয় নি। তিনিই দাবি করেছেন যে, তিনি হাদীসটি নাদর ইবনু কাসীর ইয়াহইয়া ইবনু সা’দ থেকে, তিনি উরওয়া ইবনু যুবাইর থেকে তিনি আয়েশা (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইবনু হাজার বলেন: আন-নার ইবনু কাসীর তাবি-তাবিয়ী যুগের একজন রাবী । মুহাদ্দিসগণ তাকে দুর্বল বলেছেন । ইমাম আহমদ বলেন, এ ব্যক্তি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল । ইমাম বুখারী বলেন: সে অত্যন্ত দুর্বল বা মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছে। তিনি আরাে বলেন: তার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। একেবারে দুর্বল বা মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারীদের বিষয়েই ইমাম বুখারী বলেন যে, “তার বিষয়ে আপত্তি আছে”। ইমাম নাসাঈ বলেন: লােকটি চলনসই । ইমাম ইবনু হিব্বান বলেন: এ ব্যক্তি নির্ভরযােগ্য রাবীদের থেকে জাল হাদীস বর্ণনা করতেন । উকাইলী, দোলাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও তাকে দুর্বল ও অনির্ভরযােগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল।
হাদীস নং ১১:
চার রাত্রিতে ভাগ্য লিখন।
আয়েশার (রা) সূত্রে কথিত যে, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন:
মহান আল্লাহ চার রাতে হায়াত, মওত ও রিযক লিপিবদ্ধ করেন। মধ্য শাবান, ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিতর ও আরাফার রাতে।
এ হাদীসটি ইবনু হাজার আসক্বালানী (৮৫৫ হি) তার যয়ীফ ও মিথ্যাবাদী রাবীদের জীবনীগ্রন্থ লিসানুল মীযান এ উল্লেখ করেছেন। তিনি আহমদ ইবনু কা’ব আল ওয়াছেতী নামক ৪র্থ হিজরী শতাব্দীর একজন দুর্বল ও অগ্রহণযােগ্য রাবীর জীবনীতে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আহমদ ইবনু কা’ব বর্ণিত বাতিল ও মুনকার হাদীসগুলির মধ্যে এ হাদীসটি অন্যতম। ইবনু হাজার আরাে বলেন: ইমাম দারাকুতনী (৩৮৫ হি) তার ‘গারাইব মালিক’ নামক গ্রন্থে এ হাদীসটি আহমদ বিন কাব হতে, ইমাম মালিকের সূত্রে আয়েশা (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, এ হাদীসটি গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ এর সনদের মধ্যে ইমাম মালেকের পরে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সকলেই দুর্বল বা অনির্ভরযােগ্য বর্ণনাকারী।
হাদীস নং ১২:
রিযিক অবতরণ ও হাজীদের তালিকা প্রণয়ন
আয়েশার (রা) সূত্রে কথিত যে, রাসুলুল্লাহ সঃ বলেছেন,
মহান আল্লাহ মধ্য-শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতপর কালব সম্প্রদায়ের মেষপালের সমান সংখ্যক অথবা মেষপালের পশমের সমান সংখ্যক লােককে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করেন এবং বছরের রিযিক নির্ধারণ করেন ও হাজীদের তালিকা লিপিবদ্ধ করেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী অথবা শিরকে জাড়িত অথবা বিদ্বেষী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
এ হাদীসটি আহমদ বিন ইবরাহীম আবু বকর আল ইসমাঈলী (মৃত্যু-৩৭১ হি.) তাঁর মু’জামুশ শুহূখ’ বা শিক্ষকদের জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি তাঁর শায়খ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনু হুসায়ন ইবনু হাফস আল-আশনানী আলকুফীর জীবনিতে বলেন, আমাদেরকে আবু জাফর আশনানী হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি আব্বাদ ইবনু আহমদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-আরজামী থেকে, তিনি তাঁর চাচা (মুহাম্মদ ইবনু আব্দুর রহমান আল আরজামী) থেকে তিনি তাঁর বাবা (আব্দুর রহমান আল আরজামী) থেকে, তিনি মুতাররেফ থেকে, তিনি শা’বী থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন।
এ হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল এবং বানােয়াট পর্যায়ের। একদল অত্যন্ত যয়ীফ ও পরিত্যক্ত রাবীর নামে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আব্বাদ বিন আব্দুর রহমান, তাঁর চাচা মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান ও তার পিতা আব্দুর রহমান আল- আরজামী সকলেই অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী । ইমাম দারাকুতনী তাদের সম্পর্কে বলেন, মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মদ আল-আরজামী: তিনি, তাঁর পিতা ও তাঁর দাদা সকলেই দুর্বল ও পরিত্যক্ত, অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযােগ অভিযুক্ত।
ইমাম বুখারী বলেন, তাকে (মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান) ইবনুল মুবারক ও ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন পরিত্যাগ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, আরজামী পরিত্যাহ্য, আমরা তাঁকে গ্রহণ করি না । ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন বলেন, মুহাম্মদ বিন উবায়দুলাহ আল আরজামী দুর্বল। তার হাদীস লিপিবদ্ধ করা ঠিক নয়। ইমাম দারাকুতনী বলেন, আববাদ বিন আহমদ আল আরজামী- যার কাছ থেকে আলী বিন আব্বাস রেওয়ায়েত করেছেন- পরিত্যাহ্য বা মিথ্যা হাদীস বলার অভিযােগে অভিযুক্ত।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
হাদীস নং ১৩:
মালাকুল মাউতকে মৃতদের নাম জানানাে
তাবিয়ী রাশিদ ইবনু সা’দ থেকে বর্ণিত, রাসুলুলাহ (সাঃ) বলেছেন,
মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ মৃত্যুর ফিরিশতাকে উক্ত বছরে যাদের মৃত্যু নির্ধারিত তাদের সম্পর্কে অবহিত করেন।
হাদিসটি ইমাম সুয়ুতী (৯১১ হি) ইমাম দীনাওরীর ‘আল-মুজালাসা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ‘আল-জামি’ আস-সাগীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, হাদীসটি দীনাওরী রাশিদ ইবনু সা’দ থেকে মুরসালরূপে সংকলন করেছেন। সুয়ূতী হাদীসটি যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানীও হাদীসটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।
মধ্য শাবানের রাতে ভাগ্য লিখন বিষয়ে এই চারটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, হাদীসগুলি সবই অত্যন্ত যয়ীফ। এখানে উল্লেখ্য যে, মধ্য শাবানের রাত বা শাবান মাসের অন্য কোনাে দিন বা রাত নির্ধারিতভাবে উল্লেখ না করে সাধারণভাবে শাবান মাসে হায়াত, মওত ও রিযক নির্ধারনের ব্যাপারে আরাে কতিপয় হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
৩. শবে বরাতের দোয়া সংক্রান্ত হাদীস
পূর্বোক্ত দুপ্রকারের হাদীসে মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বা মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় বলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলিতে এ রাতে বিশেষ কোনাে নেক আমলের নির্দেশ বা উৎসাহ প্রদান করা হয়নি। মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলিতে এ রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে দোয়া করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য আকুতি জানানাে এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
হাদীস নং ১৪:
এ রাত্রির দোয়া-ইসতিগফার কবুল হয়
উসমান ইবনু আবিল আস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ কি বলেছেন:
যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে তখন একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন যাচনাকারী আছে কি? আমি তাকে দান করব। ব্যাভিচারিনী ও শিরকে জড়িত ব্যতীত যত লােক যা কিছু চাইবে সকলকেই তাদের প্রার্থনা পূরণ করে দেয়া হবে।
এ হাদীসটি ইমাম বায়হাক্বী তাঁর শায়খ আবুল হুসাইন বিন বিশরান থেকে, তিনি আবু জাফর বাযযায় থেকে, তিনি মুহাম্মদ বিন আহমদ রিয়াহী থেকে, তিনি জামে বিন সাবীহ রামলী থেকে, তিনি মারহুম বিন আব্দুল আজিজ থেকে, তিনি দাউদ বিন আব্দুর রহমান থেকে, তিনি হিশাম বিন হাস্সান থেকে, তিনি হাসান বসরী থেকে, তিনি সাহাবী উসমান বিন আবিল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেন।
এই হাদীসে মধ্য-শাবানের রাতে আল্লাহর কাছে পাপ মার্জনা ও দুনিয়া ও আখেরাতের প্রয়ােজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করার সুস্পষ্ট উৎসাহ দেয়া হয়েছে। শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটি দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হাদীসটির সনদ অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, হাদীসটির সনদ কিছুটা দুর্বল হলেও তা বানােয়াট, বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল পর্যায়ের নয়।
এ হাদীসের দুর্বলতার তিনটি দিক রয়েছে।
প্রথমত, সাহাবী ও তাবিয়ীর মধ্যে সনদের বিচ্ছিন্নতা। সাহাবী উসমান ইবনু আবীল আস ৫১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন । হাসান বসরী ২১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তিনি উসমান ইবনু আবীল আস থেকে সরাসরি হাদীস শিক্ষা করেছেন কি না সে বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ রয়েছে। সাধারণভাবে মুহাদ্দিসগণ মনে করেন যে, হাসান বসরী উসমান ইবনু আবিল আস থেকে সরাসরি কোনাে হাদীস শ্রবন করেননি। এজন্য হাদীসটির সনদ মুনকাতি’ বা বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য। তবে আমরা দেখি যে, ইমাম তিরমিযী উসমান বিন আবিল আস থেকে হাসানের বর্ণনাকে সহীহ বা বিশুদ্ধ বলে গণ্য করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সন্দেহ। হাসান বসরী থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন হিশাম বিন হাস্সান আল আযদী আবু আব্দুলাহ্ আল-বাসরী (১৪৭ হি)। তিনি অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য রাবী। বুখারী ও মুসলিম-সহ সকল মুহাদ্দিস তার বর্ণনা বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কোনাে কোনাে মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাসান বসরী থেকে তিনি যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন সেগুলি তিনি সরাসরি হাসান বসরী থেকে শুনেন নি। বরং তা শাহর ইবনু হাওশাবের পাণ্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ করে হাসান বসরীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আর শাহর ইবনু হাওশাব দুর্বল । সে হিসেবে হাসান বসরী থেকে হিশামের রেওয়ায়েত বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল। অপর দিকে ইয়াহয়িয়া ইবনু সাঈদ আলকৃাত্তান (১৯৫ হি), আব্দুর রহমান বিন মাহদী (১৯৫ হি) ও অন্যান্য অনেক হাদীস বিশারদ হাসান বসরী থেকে হিশামের বর্ণনাকে বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ইমাম তিরমিযী, হাকিম নিশাপুরী, যাহাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাসান বসরী থেকে হিশামের বর্ণনাকে বিশুদ্ধ হিসেবে গণ্য করেছেন।
তৃতীয়ত, বর্ণনাকারীরর দুর্বলতা। এই হাদীসের সনদে উল্লিখিত সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযােগ্য ও সুপরিচিত মুহাদ্দিস । একমাত্র ব্যতিক্রম জামে ইবনু সাবীহ। তার গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। জামি ইবনু সাবীহকে ইবনু আবি হাতিম আল-জারহু ওয়াত তাদীল’ গ্রন্থে উলেখ করেছেন, কিন্তু তার সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করেননি। ইবনু হিব্বান তাকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে ইবনু হাজার আসকালানী উল্লেখ করেছেন যে, আব্দুল গণী ইবনু সাঈদ আল আযদী তার রচিত ‘মুশতাবাহ’ গ্রন্থে ‘জামি’-কে দুর্বল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। জামি’ ব্যতীত সনদের সকল রাবী সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযােগ্য।
হাদীস নং ১৫:
পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না।
আবু উমামা (রা)-এর সূত্রে, রাসূলুল্লাহ -এর নামে কথিত আছে যে:
পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয়না। রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, জুমআর রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত।
হাদীসটি ইবনু আসাকির (৫৭১ হি) তার তারীখ দিমাশক গ্রন্থে আবু সাঈদ বুনদার বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ রূইয়ানির সূত্রে, তিনি ইবরাহীম বিন আবি ইয়াহরিয়া থেকে, তিনি আবু কানাব থেকে, তিনি আবু উমামা বাহেলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। ইমাম সুয়ুতী তাঁর “আল জামে আল সাগীর” গ্রন্থে ইবনু আসাকিরের উদ্ধৃতি দিয়ে হাদীসটি যয়ীফ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। শাইখ আলবানী হাদীসটিকে বানােয়াট হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ হাদীসের মূল ভিত্তি হলাে ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবী ইয়াহরিয়া (১৮৪ হি) নামক একজন মুহাদ্দিস।
ইমাম মালিক, আহমদ, বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইয়াহইয়া আল-কাত্তান, নাসাঈ, দারাকুতনী, যাহাবী, ইবনু হিব্বান ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে রাফেযী, শিয়া, মুতাযেলী ও কৃাদরিয়া আক্বীদায় বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত করেছেন এবং মিথ্যাবাদী ও অপবিত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম শাফিয়ী প্রথম বয়সে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিধায় কোনাে কোনাে শাফিয়ী মুহাদ্দিস তার দুর্বলতা কিছুটা হাল্কা করার চেষ্টা করেন। তবে শাফিয়ী মাযহাবের অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ এবং অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এক কথায় তাকে মিথ্যাবাদী ও পরিত্যক্ত বলে ঐকমত্য পােষণ করেছেন।
ইমাম শাফিয়ী নিজেও তার এ শিক্ষকের দুর্বলতা ও অগ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি পরবর্তী জীবনে তার সূত্রে কোনাে হাদীস বললে তার নাম উল্লেখ না করে বলতেন, আমাকে বলা হয়েছে, বা শুনেছি বা অনুরূপ কোনাে বাক্য ব্যবহার করতেন। এ হাদীসটির ক্ষেত্রেও ইমাম শাফিয়ী বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আগের যুগে বলা হতাে, পাঁচ রাতে দোয়া করা মুস্তাহাব। ইমাম শাফিয়ী বলেন, এ সকল রাতে যে সব আমলের কথা বলা হয়েছে সেগুলােকে আমি মুসতাহাব মনে করি ।
প্রকাশ থাকে যে, যে হাদীস এ ধরণের মিথ্যাবাদী একক ভাবে বর্ণনা করেন, অন্য কোনাে বিশ্বস্ত রাবী তা বর্ণনা করেন না, সে হাদীসটি বানােয়াট হিসেবেই বিবেচিত হবে। এছাড়া সনদের অন্য রাবী আবু সাঈদ বুনদার বিন উমরও মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারী বলে পরিচিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুর রাজ্জাক সানআনী এ হাদীসটি অন্য একটি সনদে ইবনু উমারের রাঃ নিজস্ব বক্তব্য হিসাবে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, আমাকে একব্যক্তি বলেছেন, তিনি বাইয়ালমানীকে বলতে শুনেছেন, তার পিতা বলেছেন, ইবনু উমার বলেছেন, পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না।
এ সনদে আব্দুর রাযযাককে যিনি হাদীসটি বলেছেন, তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। যার নাম, পরিচয় ও গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে কিছুই জানার কোনাে পথ নেই। আব্দুর রাযযাক তার নাম বলেন নি । এরূপ অজ্ঞাত পরিচয় রাবীর বর্ণিত হাদীস একেবারেই দুর্বল বলে গণ্য। সনদের পরবর্তী রাবী মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান বিন বায়লামানী মিথ্যা হাদীস জালিয়াতি করার অভিযােগে অভিযুক্ত। ইমাম বুখারী তার হাদীস পরিত্যক্ত বা বানােয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। ইয়াহয়িয়া ইবনু মাঈন, ইবনু হিব্বান ও ইবনু আদী তাকে মিথ্যা হাদীস বানােয়াটকারী বলে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মদের পিতা, সনদের পরবর্তী রাবী, আব্দুর রহমান বিন বায়লামানীও দুর্বল, যদিও তিনি তার পুত্রের চেয়ে উত্তম।
৪. শবে বরাতে কবর জিয়ারত সংক্রান্ত হাদীস
হাদীস নং ১৬:
গােরস্থান যিয়ারত ও মৃতদের জন্য দোয়া
আয়েশা (রা) বলেন,
এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সঃ কে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি বাকীতে (আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে) রয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশংকা করছিলে যে, আল্লাহ ও তার রাসুল (সঃ) তােমার উপর অবিচার করবেন! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। তখন তিনি বলেন, মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবনের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গােত্রের মেষপালের পশমের অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন ।
এ হাদীসটি তিরমিযী, ইবনু মাজাহ এবং আহমদ বিন হাম্বল একই সনদে আহমদ ইবনু মানী থেকে, তিনি ইয়াযিদ ইবনু হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনু আরত্ব থেকে, তিনি ইয়াহয়িয়া ইবনু আবি কাসীর থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেন।
এ হাদীসে কোনাে আমলের নির্দেশ বা উৎসাহ দেওয়া না হলেও এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক মৃত মুসলিমদের মাগফেরাতের জন্য তাঁদের কবর যিয়ারত করার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে হাদীসটির সনদ বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল।
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে এর দুর্বলতা বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টিকে আরাে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আয়েশার (রা) হাদীস হাজ্জাজের এ সনদ ব্যতীত অন্য কোনভাবে আমরা অবগত নই। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারীকে) এ হাদীসের দুর্বলতা বর্ণনা করতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ইয়াহয়িয়া বিন আবি কাসীর উরওয়াহ থেকে শ্রবণ করেননি এবং হাজ্জাজ ইয়াহরিয়া বিন আবি কাসীর থেকে শ্রবণ করেনি। এ হাদীসের সমার্থক একটি হাদীস অন্য সনদে আয়শা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু সে সনদে মিথ্যবাদী বর্ণনাকারী বিদ্যমান।
হাদীসটি ইবনুল জাওযী ভিত্তিহীন বর্ণনা সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। ইবনুল জাওযী তার সনদে আতা ইবনু আজলান থেকে, তিনি ইবনু আবি মুলায়কা থেকে, তিনি আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। এ সনদের রাবী আতা ইবনু আজলানকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস জালিয়াতি ও মিথ্যা বলায় অভিযুক্ত করেছেন। ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন, বুখারী, আবু হাতিম রাযী ও ইবনু হিব্বান সকলেই এ ব্যাপারে ঐকমত্য পােষণ করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ রাত্রির ফযীলত বিষয়ক অধিকাংশ বানােয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীসে এ হাদীসের মূল ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জালিয়াতগণ মূলত এ পরিচিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রঙ চড়িয়ে গল্প বা ফযীলতের কাহিনী বানিয়েছেন, যা আমরা পরবর্তী আলােচনায় দেখতে পাব।
৫. শবে বরাতের নামাজ ও দোয়া সংক্রান্ত হাদীস অনির্ধারিত পদ্ধতিতে
মধ্য শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে সালাত আদায় ও দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে এ রাত্রির সালাতের জন্য কোনাে নির্ধারিত রাকআত, সূরা বা পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণভাবে এ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া করার বিষয়টি এ সকল হাদীস থেকে জানা যায়।
হাদীস নং ১৭:
মধ্য শাবানের রাত্রিতে নামাজ ও দিবসে সিয়াম পালন
আলী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেন,
যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তােমরা রাতে (সালাতে) দণ্ডায়মান থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ; ঐ দিন সুর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব । কোন রিযক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিযক প্রদান করব । কোন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি। সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।
এ হদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর উস্তাদ হাসান বিন আলী আল-খাল্লাল থেকে, তিনি আব্দুর রাজ্জাক থেকে, তিনি ইবনু আবি সাবাহ থেকে, তিনি ইবরাহীম বিন মুহাম্মদ থেকে, তিনি মুয়াবিয়া বিন বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি তাঁর পিতা আব্দুলাহ বিন জাফর থেকে, তিনি আলী ইবনু আবী তালিব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
এ হাদীসে মধ্য শাবানের রাত সালাত-ইবাদতে কাটানাের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দিনের বেলা সিয়াম পালনের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এ হাদীসে। কিন্তু হাদীসের ইমামগণের মত অনুযায়ী এ হাদীসটি বানােয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। কারণ এ হাদীসটি একমাত্র ইবনু আবি সাবাহ বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেননি। এ হাদীস আলী ইবনু আবি তালিব থেকে তাঁর কোন ছাত্র বর্ণনা করেননি। আব্দুলাহ বিন জাফর থেকেও তার কোন ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেননি। এমনকি মুয়াবিয়া ও ইবরাহিম বিন মুহাম্মদ থেকেও তাদের কোনাে ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র ইবনু আবি সারাহ দাবী করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম থেকে উক্ত সনদে হাদীসটি শ্রবণ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন।
ইবনু আবি সারাহ (১৬২ হি) -এর পূর্ণনাম আবু বকর বিন আব্দুলাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সারাহ। তিনি মদীনার একজন বড় আলিম ও ফক্বীহ ছিলেন । কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা ও বিচারের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন । ইমাম আহমদ, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, বুখারী, ইবনু আদী, ইবনু হিব্বান ও হাকিম নিশাপুরী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যা ও বানােয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। এরই আলােকে আল্লামা শিহাব উদ্দীন আহমদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি) এ হাদীসের টীকায় বলেছেন, ইবনু আবি সাবরাহর দুর্বলতার কারণে এ সনদটি দুর্বল । ইমাম আহমদ ও ইবনু মাঈন তাকে হাদীস বানােয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাঃ) বলেছেন, হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বা বানােয়াট । তিনি আরাে বলেন, সনদটি বানােয়াট।
হাদীস নং ১৮:
রাত্রিকালীন সালাত আদায় ও সাজদায় দোয়া
ইমাম বায়হাক্কী বলেন, আমাকে আমার উস্তাদ আবু আব্দুল্লাহ হাফিয ও মুহাম্মাদ ইবনু মূসা বলেছেন, তাদেরকে আবুল আব্বাস মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব বলেছেন, তাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা ইবনু হাইয়ান বলেছেন, তাদেরকে সাল্লাম বিন সুলায়মান থেকে, তিনি সালাম আত-তাবীল থেকে, তিনি উহাইব আল-মক্কী থেকে, তিনি আবু রুম থেকে বর্ণনা করেন । আবু রুম বলেন, আবু সাঈদ খুদরী (রা) আয়েশার (রা) কাছে গেলেন । তখন কথা প্রসঙ্গে আয়েশা (রা) তাকে বলেন,
রাসুলুলাহ (সঃ) আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর পােশাকাদি খুলে রাখলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার তা পরিধান করলেন। এতে আমার মনে কঠিন ক্রোধের উদ্রেক হয়। কারণ আমার মনে হলাে যে, তিনি আমার কোন সতীনের নিকট গমন করছেন। তখন আমি বেরিয়ে তাঁকে অনুসরণ করলাম এবং দেখতে পেলাম যে, তিনি বাকৃী’ গােরস্থানে মুমিন নরনারী ও শহীদদের পাপমার্জনার জন্য দোয়া করছেন। আমি (মনেমনে) বললাম, আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবানী হউন, আমি আমার জাগতিক প্রয়ােজন নিয়ে ব্যস্ত আর আপনি আপনার রবের কাজে ব্যস্ত। অতঃপর আমি ফিরে গিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করলাম, তখন আমি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে হাঁপাচ্ছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আগমন করে বললেন, আয়েশা, তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন? আয়শা বললেন, আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবানী হউন, আপনি আমার কাছে আসলেন এবং কাপড় খুলতে শুরু করে তা আবার পরিধান করলেন। ব্যাপারটি আমাকে খুব আহত করল। কারণ আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি আমার কোন সতীনের সংস্পর্শে গিয়েছেন। পরে আপনাকে বাক্বীতে দোয়া করতে দেখলাম।
তিনি বললেন, হে আয়শা, তুমি কি আশংকা করেছিলে যে, আল্লাহ ও তদীয় রাসুল (সঃ) তােমার উপর অবিচার করবেন? বরং আমার কাছে জিবরাঈল (আ) আসলেন এবং বললেন, এ রাত্রটি মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ তায়ালা এ রাতে কালব’ সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চাইতে অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন। তবে তিনি শিরকে লিপ্ত, বিদ্বেষী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, কাপড় ঝুলিয়ে (টাখনু আবৃত করে) পরিধানকারী, পিতা মাতার অবাধ্য সন্তান ও মদ্যপায়ীদের প্রতি দৃষ্টি দেন না।
অতঃপর তিনি কাপড় খুললেন এবং আমাকে বললেন, হে আয়শা, আমাকে কি এ রাতে ইবাদত করার অনুমতি দিবে?। আমি বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হােন! অবশ্যই। অতপর তিনি সালাত আদায় করতে লাগলেন এবং এমন দীর্ঘ সাজদা করলেন আমার মনে হলাে যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন । অতঃপর আমি (অন্ধকার ঘরে) তাকে খুঁজলাম এবং তাঁর পদদ্বয়ের তালুতে হাত রাখলাম। তখন তিনি নড়াচড়া করলেন। ফলে দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম । আমি শুনলাম, তিনি সিজদারত অবস্থায় বলছেন: আমি আপনার কাছে শাস্তির পরিবর্তে ক্ষমা চাই, অসন্তুষ্টির পরিবর্তে সন্তুষ্টি চাই। আপনার কাছে আপনার (আজাব ও গজব) থেকে আশ্রয় চাই। আপনি সুমহান। আপনার প্রশংসা করে আমি শেষ করতে পারি না। আপনি তেমনই যেমন আপনি আপনার প্রসংশা করেছেন।
আয়েশা (রা) বলেন, সকালে আমি এ দোয়াটি তার কাছে উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন, হে আয়শা, তুমি কি এগুলাে শিখেছ? আমি বললাম, হঁা। তখন তিনি বললেন, হে আয়শা তুমি এগুলাে ভাল করে শিখ এবং অন্যকে শিক্ষা দাও। জিবরাঈল (আ) আমাকে এগুলাে শিক্ষা দিয়েছেন এবং সিজদার ভিতরে বারবার আওড়াতে বলেছেন।
এ হাদীসে মধ্য শাবানের রাতে রাত জেগে নামায আদায় করা, নামাজের সিজদায় বিভিন্ন দোয়া করা এবং মৃতদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে সুস্পষ্ট উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তবে হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল ও বাতিল। ইমাম বায়হাক্বী হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর বলেন, এ সনদটি দুর্বল।
সনদের দুর্বলতা বুঝার জন্য আমাদের বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানতে হবে। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণনাকারী রাবী আবু রুহুম সুবাঈ’- আহযাব বিন আসাদ- তাবেয়ী ও বিশ্বস্ত। তার কাছ থেকে বর্ণনাকারী উহাইব আল-মীও বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযােগ্য। তার কাছ থেকে বর্ণনাকারী সালাম আত-তাবীল (সালাম বিন সুলাইম বা সালাম বিন সুলায়মান তামিমী) অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। তিনি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন হাদীস রচনায় অভিযুক্ত। তাঁর দুর্বলতা ও অগ্রহণযােগ্যতার বিষয়ে সকল ইমাম একমত। ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন, আহমদ ইবনু হাম্বাল, বুখারী, নাসায়ী ও ইবনু হিব্বান সকলেই তাঁর মিথ্যাচার ও দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তার ছাত্র সালাম বিন সুলায়মানও দুর্বলতার দিক থেকে তার কাছাকাছি। আবু হাতিম, উকাইলী ও ইবনু আদী তার হাদীসকে পরিত্যাহ্য ও অত্যন্ত দুর্বল হিসেবে ঘােষনা করেছেন। তার ছাত্র মুহাম্মদ বিন ঈসা বিন হাইয়্যান আল মাদায়েনীও (২৭৪ হি) দুর্বল বলে গণ্য। পরবর্তী রাবীগণ গ্রহণযােগ্য।
এ থেকে স্পষ্ট যে, হাদীসটি অত্যন্ত দূর্বল ও পরিত্যাহ্য। বরং হাদীসটি বানােয়াট বলে গণ্য। কারণ সালাম আত-তাবীল ছাড়া আর কেউই এই হাদীসটি বলেন নি। শুধু তিনিই হাদীসটি উহাইব থেকে শুনেছেন বলে দাবী করেছেন । উহাইব-এর আর কোনাে ছাত্র হাদীসটি উহাইব বলেছেন বলে উল্লেখ করেন নি। সালাম আত-তাবীল হাদীস জালিয়াতি করার অভিযােগে অভিযুক্ত। আর যে হাদীস এরূপ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই বলেন না সে হাদীসটি জাল বলে গণ্য।
হাদীস নং ১৯:
রাত্রিকালীন নামায আদায় ও দীর্ঘ সাজদা
ইমাম বায়হাক্বী বলেন, আমাদেরকে বলেছেন আবু নসূর ইবনু কাতাদাহ্, তিনি আবু মানসুর মুহাম্মদ ইবনু আহমদ আযহারী থেকে, তিনি ইমরান ইবনু ইদরীস থেকে, তিনি আবু উবায়দুল্লাহ থেকে, তিনি তাঁর চাচা ইবনু ওয়াহাব থেকে, তিনি মুয়াবিয়া ইবনু সালিহ থেকে, তিনি আলা ইবনুল হারিস থেকে। তিনি বলেন, আয়শা (রা) বলেছেন:
রাসূলুল্লাহ সঃ একদা রাতে সালাত আদায় করছিলেন। তিনি সাজদায় যেয়ে দীর্ঘ সময় সাজদায় থাকলেন। এমনকি আমার মনে হল যে, তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। আমি যখন এমনটি দেখলাম তখন শয়ন থেকে উঠে তার বৃদ্ধাংগুলি নাড়া দিলাম, ফলে তিনি নড়ে উঠলেন। তখন আমি (বিছানায়) ফিরে গেলাম । অতঃপর যখন তিনি সাজদা থেকে মস্তক উঠালেন এবং নামায শেষ করলেন তখন বললেন, হে আয়শা, তুমি কি মনে করেছিলে যে, নবী (সঃ) তােমার সাথে প্রতারণা করেছেন? আমি বললাম, আলাহর শপথ, আমি এমনটি মনে করিনি। বরং আপনার দীর্ঘ সিজদার কারণে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার ওফাত হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, তুমি কি জান এটি কোন রাত? আমি বললাম আল্লাহ ও তার রাসুল সঃ ই সম্যক জ্ঞাত। তিনি বললেন, এটি মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ তা’য়ালা এ রাতে বান্দাদের প্রতি দৃকপাত করেন। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করেন, যারা দয়া প্রার্থনা করে তাদেরকে দয়া করেন এবং যারা বিদ্বেষী তাদেরকে তাদের অবস্থাতেই রেখে দেন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
এ হাদীসে মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায় এবং দয়া ও ক্ষমা প্রার্থনার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সঃ বছরের প্রত্যেক রাতেই এভাবে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন এবং দীর্ঘ সাজদায় আল্লাহর কাছে কাদাকাটা করে দোয়া করতেন। তা সত্ত্বেও হাদীসটি সহীহ বলে প্রমাণিত হলে এ রাত্রির বিশেষ সাজদা ও দোয়ার ফযীলত প্রমাণিত হয়।
কিন্তু হাদীসটি দুর্বল। তাবিয়ী আলা ইবনুল হারেস আয়েশা (রা) থেকে কোনাে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। বরং আয়েশার মৃত্যুর পরে তাঁর জন্ম। আলা ইবনুল হারেস মধ্যম পর্যায়ের গ্রহণযােগ্য রাবী । তার মুত্যু হয়েছে ১৩০ হি. সনে । তিনি ৭০ বছর বেঁচে ছিলেন। সে হিসেবে তাঁর জন্ম সাল হবে ৬০ হি.। অপরদিকে হযরত আয়শার মৃত্যু হয়েছে ৫৭ হিজরী সালে। এভাবে আমরা দেখছি যে, ‘আলা অন্য কারাে মাধ্যমে হাদীসটি শুনেছেন কিন্তু তার নামােল্লেখ করেন নি। এ অনুল্লিখিত ব্যক্তির গ্রহণযােগ্যতা অজ্ঞাত থাকার কারণে হাদীসটি দুর্বল। এ ছাড়া সনদের অন্যান্য বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ততার দিক দিয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় পর্যায়ের, যাদের বর্ণনা গ্রহণযােগ্য।
হাদীস নং ২০:
সাজদায় ও সাজদা থেকে উঠে বসে দোয়া
ইমাম বায়হাক্বী তার সনদে সুলায়মান বিন আবি কারীমা থেকে, তিনি হিশাম বিন উরওয়াহ্ থেকে, তিনি তাঁর পিতা উরওয়াহ্ থেকে, তিনি আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
মধ্য শাবানের রাতে রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমার ঘরে ছিলেন; কারণ সে রাতটি আমার জন্য বরাদ্দ ছিল। রাতের মধ্যভাগে আমি তাকে বিছানায় পেলাম না। স্বভাবতই একজন নারীর যেমনটি হয়ে থাকে তেমনিভাবে আমি আহত ও ক্রুদ্ধ হলাম । অতঃপর আমি চাদর মুড়ি দিলাম এবং বের হয়ে তার স্ত্রীগণের কামরাসমূহে খোজ নিলাম। তাকে কোথাও না পেয়ে আমার নিজের কামরায় ফিরে গেলাম। গৃহে যেয়ে দেখি তিনি একটি পতিত কাপড়ের ন্যায় সাজদায় যেয়ে বলছেন, আপনার জন্য সাজদাবনত হয়েছে আমার মুখমণ্ডল এবং আমার দেহ। আপনার উপর বিশ্বাস এনেছে আমার অন্তর । আমার হাত এবং আমার হাতে আমি আমার আত্মার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছি তা আপনার নিকট উপস্থিত। হে মহান, সকল মহান কর্মে আপনারই আশা করা হয় । হে মহান, আপনি মহা-পাপ ক্ষমা করে দিন। আমার মুখমণ্ডল সাজদা করেছে তারই জন্য যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি প্রদান করেছেন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
অতঃপর তিনি মস্তক উঠালেন। এরপর আবারাে তিনি সাজদা করলেন এবং বললেন: আপনার ক্রোধ থেকে আমি আপনার সন্তুষ্টির আশ্রয় গ্রহণ করছি। আপনার শাস্তি থেকে আমি আপনার ক্ষমার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আমি আপনার থেকে আপনারই আশ্রয় গ্রহণ করছি। আপনি আপনার যেরূপ প্রশংসা করেছেন আপনি সেরূপই। আমার ভাই দাউদ যা বলেছেন আমিও তাই বলি: আমি আমার নেতা ও প্রভুর জন্য আমার মুখমণ্ডলকে ধুলায় লুটিয়েছি এবং আমার নেতা ও প্রভুর অধিকার আছে যে, তার জন্য সাজদা করতে হবে। অতঃপর তিনি মস্তক উঠালেন এবং (বসা অবস্থায়) বললেন: হে আল্লাহ আপনি আমাকে প্রদান করুন একটি অন্তর যা অকল্যণ এবং দুর্ভাগাও নয়।
এরপর তিনি নামায শেষ করলেন এবং আমার কথার মধ্যে প্রবেশ করলেন, তখন আমি বড়বড় নিশ্বাস নিয়ে হাপাচ্ছিলাম। রাসুলুল্লাহ সঃ বললেন, হুমাইরা (আয়েশা), তােমার এ অবস্থা কেন? আমি তাঁকে ঘটনাটি খুলে বললাম। অতঃপর তিনি তাঁর হস্তদ্বয় দ্বারা আমার হাটু যুগলকে মুছতে লাগলেন এবং বললেন, এ হাটু যুগলের দুর্ভাগ্য! কত কষ্টই না পেল! আজ হলাে মধ্য শাবানের রাত। আল্লাহ্ তায়ালা এ রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং শিরকে জড়িত ও বিদ্বেষে লিপ্ত ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল । কারণ সুলায়মান বিন আবি কারীমা একক ভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেন । তিনি ছাড়া আর কেউই হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। হিশাম ইবনু উরওয়ার অগণিত ছাত্রদের কেউই বলেন নি যে, এ অর্থে কোনাে হাদীস তিনি কখনাে বলেছেন। শুধুমাত্র সুলাইমান ইবনু আবী কারীমাই এ দাবী করছেন। তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। আবু হাতিম রাযি তাকে দুর্বল হিসেবে নিশ্চিত করেছেন। ইবনু আদী বলেন: তাঁর বর্ণিত হাদীস সমূহ অধিকাংশই পরিত্যাহ্য। এ কারণেই ইবনুল জাওযী এ হাদীসটিকে ভিত্তিহীন ও পরিত্যাহ্য হাদীস সমূহের মধ্যে গণনা করেছেন।
হাদীস নং ২১:
সালাতের সাজদায় ও সাজদা থেকে উঠে দোয়া
হাদীসটি ইবনুল জাওযী বাতিল বর্ণনাসমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার সনদে সাঈদ ইবনু আব্দিল করিম ওয়াসিতী থেকে, তিনি আবু নুমান সাদী থেকে, তিনি আবু রাজা আল উত্বারেদী থেকে, তিনি আনাস ইবনু মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: নবী সঃ আমাকে আয়েশার (রা) কাছে পাঠালেন। আমি তাকে বললাম, আপনি দ্রুত আমাকে ছেড়ে দিন । আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) -কে মধ্য শাবানের রাত সম্পর্কে আলােচনারত অবস্থায় রেখে এসেছি। তিনি বললেন, হে আনাস, তুমি বস, আমি তােমাকে মধ্য শাবানের রাত সম্বন্ধে বলব,
সে রাতটি আমার জন্য বরাদ্দ ছিল। রাসূলুল্লাহ সঃ আমার কাছে এসে আমার লেপের ভিতরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর রাতে আমি জাগ্রত হয়ে তাকে পেলাম না। তখন তাঁর স্ত্রীগণের গৃহগুলিতে অনুসন্ধান করেও তাকে পেলাম না। আমি ধারণা করলাম, তিনি তার দাসী মারিয়া কিবতিয়ার ঘরে গিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি বের হয়ে মসজিদে গেলাম। তখন আমার পায়ের সাথে তার দেহ মােবারকের স্পর্শ হলাে। সে সময় তিনি সিজদারত অবস্থায় বলছিলেন, “আপনার জন্য সাজদাবনত হয়েছে আমার দেহ ও আমার ছায়া। আপনার উপর বিশ্বাস এনেছে আমার অন্তর । আমারই দুই হাতের মধ্যে, যে হস্তদ্বয় দ্বারা আমি আমার আত্মার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছি। তাই হে মহান, আপনি মহাপাপ ক্ষমা করার যােগ্যতা রাখেন। আপনি কঠিন পাপরাশি ক্ষমা করে দিন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
অতঃপর তিনি মস্তক উঠালেন এবং বললেন: হে আল্লাহ আপনি আমাকে প্রদান করুন একটি অন্তর যা অকল্যণ থেকে পবিত্র এবং যা অবিশ্বাসী নয় এবং দুর্ভাগাও নয়। অতঃপর তিনি আবার সাজদা করলেন এবং বললেন: “আমার ভাই দাউদ (আ) যা বলেছেন আমিও তাই বলি: হে আমার নেতা, আমি আমার মুখমণ্ডলকে ধুলায় লুটিয়েছি এবং আমার নেতার অধিকার আছে যে, তার জন্য মুখমণ্ডলগুলি ধুলায় লুটাবে। অতঃপর তিনি মস্তক উঠালেন। আমি (আপন মনে) বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবানী হউন! আপনি এক জগতে আর আমি অন্য জগতে।
তখন রাসুল (সঃ) আমার পদধ্বনি শুনে আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং বললেন হে আয়েশা, তুমি কি জান এটি কোন রাত? এটি মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা কালব সম্প্রদায়ের মেশপালের পশমের সমপরিমান মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। তবে ছয় ব্যক্তি উক্ত ক্ষমার আওতায় পড়বেনা । তারা হলাে: মদ্যপায়ী, পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, বারংবার ব্যাভিচারে লিপ্ত ব্যক্তি, সম্পর্ক ছিন্নকারী, প্রাণীর ছবি অংকনকারী এবং যে ব্যক্তি একের কথা অপরের কাছে লাগায়।
এ হাদীস থেকেও পূর্ববর্তী হাদীসের ন্যায় উক্ত রাতে সালাত আদায়, সাজদারত অবস্থায় ও বসা অবস্থায় দোয়া করার উৎসাহ পাওয়া যায় । কিন্তু হাদীসটি একেবারেই বাতিল ও অগ্রহণযােগ্য। কারণ সাঈদ বিন আব্দুল করিম এককভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি ছাড়া আর কেউই এই হাদীসটি বলেন নি। তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত বা মিথ্যা হাদীস বানানাের অভিযােগে অভিযুক্ত। এধরণের রাবী যে হাদীস এককভাবে বর্ণনা করে তা ভিত্তিহীন বা বাতিল হিসেবে বিবেচিত । এজন্য ইবনুল জাওযী বলেন, এ সনদটি গ্রহণযােগ্য নয় । হাফিয আবুল ফাতহ আযাদী বলেছেন: সাঈদ ইবনু আব্দিল করিম পরিত্যক্ত। তার সাথে ইমাম যাহাবী এবং ইবনু হাজার আসকালানীও এ ব্যাপারে একমত পােষণ করেছেন।
হাদীস নং ২২:
বাকী গােরস্থানে সাজদারত অবস্থায় দোয়া
ইমাম যাহাবী মিথ্যাবাদী ও দুর্বল রাবীদের জীবনী গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন ইয়াহয়িয়া ইবনু ইসমাঈল’ নামক তৃতীয় শতকের একজন অনির্ভরযােগ্য রাবীর জীবনী আলােচনাকালে তার বর্ণিত বাতিল হাদীসের নমুনা হিসাবে হাদীসটি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া নামক এই ব্যক্তি তার সনদে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
মধ্য-শাবানের রাতে আমার প্রিয়তম রাসূলুল্লাহ সঃ আমার কাছে আসলেন এবং তাঁর বিছানায় গেলেন; অতঃপর শােয়া থেকে উঠে গােসল করলেন এবং দ্রুত বেরিয়ে গেলেন; আমি তার পদাংক অনুসরণ করলাম; যেয়ে দেখি তিনি বাকীতে সাজদারত অবস্থায় দোয়া করছেন, হে প্রভু, আপনার জন্য সাজদাবনত হয়েছে আমার দেহ ও আমার মন।
ইমাম যাহাবী বলেন, এ হাদীসটি এ ব্যক্তির বর্ণিত বাতিল হাদীসগুলির অন্যতম।
হাদীস নং ২৩:
দুই ঈদ ও মধ্য-শাবানের রাত্রিভর ইবাদত
হাদীসটি ইমাম যাহাবী বাতিল ও মাউযু হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ঈসা ইবনু ইবরাহীম ইবনু তাহমান নামক দ্বিতীয় হিজরী শতকের এক ব্যক্তি বলেন, তাকে সালামা ইবনু সুলাইমান বলেছেন, মারওয়ান ইবনু সালিম থেকে, তিনি ইবনুল কুরদাউস থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন,
যে ব্যাক্তি মধ্য শাবানের রাত ও দু ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবেনা যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে।
এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী উপযুক্ত ঈসা ইবনু ইবরাহীম ইবনু তাহমান বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সুপরিচিত। ইমাম বুখারী, নাসায়ী, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত ও মিথ্যাবাদি রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ের রাবী কতৃক এককভাবে বর্ণিত হাদীস ভিত্তিহীন বা বানােয়াট হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া ঈসা ইবনু ইবরাহীম নামক এ ব্যক্তি তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন সেই সালামা বিন সুলাইমান দুর্বল রাবী বলে পরিচিত। আর তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই ‘মারওয়ান বিন সালিম মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযােগে অভিযুক্ত। এভাবে আমরা দেখছি যে, এ হাদীসটির সনদের রাবীগণ অধিকাংশই মিথ্যাবাদি বা অত্যন্ত দুর্বল। এরা ছাড়া কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেননি। কাজেই হাদীসটি বানােয়াট পর্যায়ের।
এখানে উল্লেখ্য যে, আবু উমামা (রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে একাধিক দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যাক্তি দু ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবেনা যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে। এ সকল বর্ণনায় দু ঈদের রাতের সাথে মধ্য শাবানের রাতকে কেউ যুক্ত করেন নি।
হাদীস নং ২৪:
পাঁচ রাত্রি ইবাদতে জাগ্রত থাকার ফযীলত
মুয়ায ইবনু জাবাল (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সঃ এর নামে বর্ণিত হয়েছে:
যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত প্রাপ্য হবে: যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত্রি, ৯ তারিখের (আরাফার) রাত্রি, ১০ তারিখের (ঈদুল আযহার) রাত্রি, ঈদুল ফিতরের রাত্রি ও মধ্য শাবানের রাত্রি।
হাদীসটি ইস্পাহানী তারগীব গ্রন্থে সুওয়াইদ ইবনু সাঈদ-এর সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। সুওয়াইদ আব্দুর রাহীম আলআম্মী থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ওয়াহ্ ইবনু মুনাব্বিহ থেকে, তিনি মুয়ায (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ।
হাদীসটির রাবী আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-আম্মী (১৮৪ হি) জাল-হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন, আহমদ ইবনু হাম্বাল, আবু হাতিম রাযী, আবু দাউদ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এ ব্যক্তির মিথ্যাবাদিতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য এ হাদীসটি মাওযু বা জাল হাদীস বলে গণ্য । ইবনুল জাওযী, ইবনু হাজার আসকালানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলােচনা করেছেন ।
হাদীস নং ২৫:
এ রাত্রিতে রহমতের দরজাগুলি খোলা হয়।
আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মদ ইবনু ইরাক আল-কিনানী (৯৬৩ হি) তার জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস সংকলনের গ্রন্থে ইবনু আসাকিরএর বরাত দিয়ে বানােয়াট ও ভিত্তিহীন হাদীস হিসেবে নিমের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। উবাই ইবনু কা’ব (রা) এর সূত্রে কথিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ স বলেন,
মধ্য শাবানের রাত্রে জিবরাঈল (আ) আমার নিকট আগমন করে বলেন, আপনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ুন এবং আপনার মাথা ও হস্তদ্বয় উপরে উঠান। আমি বললাম, হে জিবরাঈল, এটি কোন্ রাত? তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ, এ রাতে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং রহমতের ৩০০ দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বাকী গােরস্থানে গমন করেন। তিনি যখন সেখানে সাজদারত অবস্থায় দোয়া করছিলেন, তখন জিবরাঈল সেখানে অবতরণ করে বলেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি আকাশের দিকে মাথা তুলুন। তিনি তখন তাঁর মস্তক উত্তোলন করে দেখেন যে, রহমতের দরজাগুলি খুলে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক দরজায় একজন ফিরিশতা ডেকে বলছেন, এই রাত্রিতে যে সাজদা করে তার জন্য মহা সুসংবাদ।
হাদীসটি উল্লেখ করে ইবনু ইরাক বলেন, এ হাদীস একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যে সূত্রে উল্লিখিত বর্ণনাকারীগণ সকলেই অজ্ঞাত পরিচয়। ফলে হাদীসটি বানােয়াট ও ভিত্তিহীন হিসেবে বিবেচিত।
উক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শবে বরাতের সালাত ও দোয়া সংক্রান্ত সমস্ত হাদিসই দুর্বল।
৬. শবে বরাতের নামাজ সংক্রান্ত হাদীস নির্ধারিত পদ্ধতিতে
শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত অন্য কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকআত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিস ও আলিমগণের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এ অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানােয়াট ও ভিত্তিহীন, যা হিজরী চতুর্থ শতকের পরে রাসুলুলাহ সঃ এর নামে রচনা করে বানােয়াট সনদ তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে জালিয়াতি নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা একমত যে, শবে বরাতের রাত্রিতে নির্দিষ্ট রাক’আত নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে পাঠ করার অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই বানােয়াট এবং গল্পকার ওয়ায়েযদের মস্তিস্কপ্রসূত কথা । নিম্নে হাদীসগুলাে আলােচনা করা হল। যেহেতু এগুলি সবই রাসূলুল্লাহ সঃ এর নামে প্রচারিত বানােয়াট কথা যা তিনি কখনােই বলেন নি বলে মুহাদ্দিসগণ একমত।
হাদীস নং ২৬:
৩০০ রাক’আত, প্রতি রাকআতে ৩০ বার ইখলাস
যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকাতে ৩০বার সুরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকাত সালাত আদায় করবে জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।
হাদীসটি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উলেখ করেছেন।
হাদীস নং ২৭:
১০০ রাক’আত, প্রতি রাকআতে ১০ বার ইখলাস
মধ্য শাবানের রজনীতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী চতুর্থ শতকের পরে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে । মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম এ রাত্রিতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়।
এ সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী গল্পকার ওয়ায়েজ এ অর্থে কিছু হাদীস বানিয়ে বলেন। এ অর্থে ৪টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানােয়াট ও ভিওিহীন। প্রথমটি আলী (রা) এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (আঃ) -এর নামে প্রচারিত:
যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহা ও ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়ােজনের কথা বলবে আল্লাহ তার সকল প্রয়ােজন পূর্ণ করবেন। লাওহে মাহফুজে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে, আল্লাহ তার কাছে ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপ রাশি মুছে দেবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে, এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ‘আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লক্ষ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা জান্নাতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রােপন করবে। যে ব্যক্তি এ সালাত আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আলাহ তায়ালা তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন।
হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানােয়াট ও জাল । এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত।
হাদীস নং ২৮:
১০০ রাকআত, প্রতি রাকআতে ১০ বার ইখলাস
এটি ১০০ রাকাত সংক্রান্ত ২য় হাদীস। ইবনু ওমর (রা) এর সূত্রে রাসুল সঃ এর নামে বর্ণনা করা হয়েছে:
যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে এক শত রাকাত সালাতে এক হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ১০০ জন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপত্তার সুসংবাদ প্রদান করবে, ত্রিশজন তাকে ভুলের মধ্যে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং দশজন তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জবাব দিবে।
হাদীসটি বানােয়াট। সনদের অধিকাংশ রাবী অজ্ঞাতপরিচয়। বাকীরা মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।
হাদীস নং ২৯:
১০০ রাক’আত, প্রতি রাকআতে ১০ বার ইখলাস
এটি ১০০ রাকাত সংক্রান্ত ৩য় হাদীস। জাল হাদীস বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদীগণ এ হাদীসটি বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ আল বাকের (১১৫ হি) থেকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর বরাতে বর্ণনা করেছে:
যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাতে ১০০০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা তার কাছে ১০০ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। ৩০ জন তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিবে, ৩০ জন তাকে দোজখের আগুন থেকে মুক্তি দিবে, ৩০ জন তার ভুল সংশােধন করবে এবং ১০ জন তার শত্রুদের নাম লিপিবদ্ধ করবে।
এ হাদীসটিও বানােয়াট। সনদের কিছু রাবী অজ্ঞাতপরিচয় এবং কিছু রাবী মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।
হাদীস নং ৩০:
১০০ রাকআত, প্রতি রাকআতে ১০ বার ইখলাস।
এটি ১০০ রাকাত সংক্রান্ত ৪র্থ হাদীস। আমরা দেখেছি যে, ১০০ রাকাত সংক্রান্ত এ বিশেষ পদ্ধতিটি হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন গল্পকার ওয়াযেযের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং যুগে যুগে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভারতীয় ওয়ায়েযগণ এ পদ্ধতির মধ্যে প্রত্যেক দুই রাকাতের পরে “তাসবীহুত তারাবীহ”র প্রচলন করেন এবং ১০০ রাকাত পূর্ণ হওয়ার পর কতিপয় সাজদা, সাজদার ভিতরে ও বাইরে কতিপয় দোয়া সংযুক্ত করেছেন।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৬ হি) বানােয়াট হাদীসসমুহের মধ্যে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হলাে,
মধ্য শাবানের রাতে পঞ্চাশ সালামে ১০০ রাকাত সালাত আদায় করতে হবে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতেহার পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। প্রত্যেক দুই রাকাত পর তাসবীহুত তারাবীহ পাঠ করবে, এর পর সাজদা করবে। সাজদার মধ্যে কিছু নির্ধারিত বানােয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর সাজদা থেকে মাথা তুলবে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর উপর দরূদ পাঠ করবে ও কিছু নির্ধারিত বানােয়াট দোয়া পাঠ করবে । অতঃপর দ্বিতীয় সাজদা করবে এবং তাতে কিছু নির্ধারিত বানােয়াট দোয়া পাঠ করবে।
হাদীস নং ৩১:
৫০ রাকআত সালাত
ইমাম যাহাবী এ হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানােয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন সাঈদ আল-মীলী আততাবারীর জীবনীতে উলেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল-বাজালীর সনদে আনাস (রা) থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেন:
যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ৫০ রাকাত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার কাছে যত প্রকার প্রয়ােজনের কথা বলবে তার সবই পূরণ করে দেয়া হবে। এমনকি লাওহে মাহফুজে তাকে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে তাকে সৌভাগ্যবান করা হবে। এবং আল্লাহ তা’আলা তার কাছে ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার নেকী লিপিবদ্ধ করবে, অপর ৭লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার জন্য বেহেশতে প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং ৭০ হাজার একত্ববাদীর জন্য তার সুপারিশ গ্রহন করা হবে।
ইমাম যাহাবী এ জাল হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, যে ব্যাক্তি এ হাদীসটি বানিয়েছে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঞ্চিত করুন।
হাদীস নং ৩২:
১৪ রাকআত সালাত
ইমাম বায়হাক্বী তাঁর সনদে আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
আমি রাসুলুলাহ সঃ কে মধ্য-শাবানের রাতে ১৪ রাকাত সালাত আদায় করতে দেখেছি। সালাত শেষে বসে তিনি ১৪ বার সূরা ফাতিহা, ১৪ বার সূরা ইখলাছ, ১৪ বার সূরা ফালাক, ১৪ বার সূরা নাস, ১ বার আয়াতুলকুরসী এবং সূরা তাওবার শেষ দু আয়াত তেলাওয়াত করেছেন, এ সব কাজের সমাপ্তির পর আমি তাকে এগুলাে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি সঃ বললেন: তুমি আমাকে যে ভাবে করতে দেখেছ এভাবে যে করবে তার আমল নামায় ২০টি কবুল হজ্বের সাওয়াব লিখা হবে এবং ২০ বছরের কুবুল সিয়ামের সাওয়াব লিখা হবে। পরদিন যদি সে সিয়াম পালন করে তবে দু বছরের সিয়ামের সাওয়াব তার আমল নামায় লিখা হবে।
হাদীসটি উল্লেখ করার পর ইমাম বায়হাক্বী বলেন: ইমাম আহমদ বলেছেন যে, এ হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যাক্ত, জাল ও বানােয়াট বলে প্রতীয়মান হয়। হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।
অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করার বিষয়ে ইমাম বাইহাকীর সাথে ঐকমত্য পােষণ করেছেন। ইবনুল জাওযী ও জালালুদ্দীন সুয়ুতী বলেন: হাদীসটি বানােয়াট, এর সনদ অন্ধকারাচ্ছন্ন। সনদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন মুহাজির রয়েছেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেনঃ মুহাম্মদ বিন মুহাজের হাদীস বানােয়াটকারী।
হাদীস নং ৩৩:
১২ রাক’আত, প্রত্যেক রাকআতে ৩০ বার ইখলাস
জালিয়াতগণ আবু হুরায়রা (রা) পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরী করে তার সূত্রে রাসূলুল্লাহ সঃ থেকে বর্ণনা করেছে :
যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১২ রাকআত সালাত আদায় করবে এবং প্রত্যেক রাকআতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, সালাত শেষ হওয়ার পূর্বেই বেহেশতের মধ্যে তার অবস্থান সে অবলােকন করবে। এবং তার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে জাহান্নামের আগুন নির্ধারিত হয়েছে এমন দশ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।
এ হাদীসের সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। এছাড়াও সনদের মধ্যে কতিপয় দুর্বল ও পরিত্যাহ্য বর্ণনাকারী রয়েছে।
এভাবে আমরা দেখছি যে, মধ্য শা’বানের রাতে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট রাকআত সালাত আদায় সংক্রান্ত হাদীসগুলি বানােয়াট ও ভিত্তিহীন । মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু কতিপয় নেককার ও সরলপ্রাণ ফকীহ ও মুফাসসির তাঁদের রচনাবলিতে এগুলির জালিয়াতি ও অসারতা উল্লেখ ব্যতীতই এসকল ভিত্তিহীন এগুলি উল্লেখ করেছেন। এমনকি কেউ কেউ এগুলাের উপর ভিত্তি করে ফতােয়া প্রদান করেছেন ও তদানুযায়ী আমল করেছেন, যা পরবর্তীতে এ রীতি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। আল্লামা ইবনুল জাওযী বলেন, মসজিদের অজ্ঞ ইমামগন জনসাধারণকে একত্র করা ও নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফাঁদ হিসেবে এ সকল সালাত, সালাতুর রাগায়েব ও অনুরূপ অন্যান্য বানােয়াট পদ্ধতির সালাতকে ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন গল্পকার বর্ননাকারী তাদের মাহফিল জমানাের জন্য এগুলাে বর্ণনা করেন যার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
মােল্লা আলী কৃারী (১০১৪ হি) শবে বরাতের সালাতের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলির অসারতা উল্লেখ পূর্বক বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলাে যে, যারা সুন্নতের ইলমের সন্ধান পেয়েছেন তারা এগুলাে দ্বারা প্রতারিত হন কি করে! এ সালাত চতুর্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে । এ ব্যাপারে অসংখ্য জাল হাদীস তৈরী করা হয়েছে যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযােগ্য নয়। তিনি আরাে বলেন, হে পাঠক, এ সকল ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীস কুতুল কুলুব’, ‘ইহয়িয়া-উ- উলুমিদ্দীন’ ও সালাবীর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ থাকার কারণে আপনারা প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হবেন না। ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ আজলুনীও (১১৬২ হি) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।
কিছু সনদ বিহীন বানােয়াট কথা
পূর্বে আমরা মধ্য-শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলি আলােচনা করেছি। এগুলি বিভিন্ন সনদে হাদীসের গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলির গ্রহণযােগ্যতার পর্যায় নির্ধারণ করেছেন। এগুলি ছাড়াও আমাদের সমাজে শবে বরাত বিষয়ে আরাে কিছু কথা হাদীস নামে প্রচলিত, যেগুলির কোনােরূপ কোনাে সনদ বা ভিত্তি পাওয়া যায় না। যে হাদীসের সনদ আছে তা নিরীক্ষার মাধ্যমে সহীহ, যয়ীফ বা জাল বলে নির্ধারণ করেছেন মুহাদ্দিসগণ। আর যে হাদীসের কোনােরূপ সনদই পাওয়া যায় না, কেবল লােকমুখে হাদীস বলে প্রচলিত, তা সন্দেহাতীতভাবে জাল ও ভিত্তিহীন বলে গণ্য। এ জাতীয় কিছু কথা উল্লেখ করছি ।
১. শবে বরাতের গােসল
প্রচলিত সনদ-বিহীন কথাগুলির অন্যতম হলাে এ রাতে গােসল করার ফযীলত। বিষয়টি যদিও ভিত্তিহীন ও বানােয়াট কথা, তবুও আমাদের সমাজে তা ব্যাপক প্রচলিত। আমদের দেশের প্রচলিত প্রায় সকল পুস্তকেই এ জাল কথাটি লিখা হয় এবং ওয়াযে আলােচনায় বলা হয়। প্রচলিত একটি বই থেকে উদ্ধৃত করছি: একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে এবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গােসল করিবে, সে ব্যক্তির গােসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমল নামায় ৭০০ রাকাত নফল নামাযের ছওয়াব লিখা যাইবে। গােসল করিয়া দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।
এ মিথ্যা কথাটি দ্বারা প্রভাবিত ও প্রতারিত হয়ে কঠিন শীতের রাতেও অনেকে গােসল করেন। উপরন্তু ফোটা ফোটা পানি পড়ার আশায় শরীর ও মাথা ভাল করে মােছেন না। এর ফলে অনেকে, বিশেষত, মহিলারা ঠাণ্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হন। আর এ কষ্ট শরীয়তের দৃষ্টিতে বেকার পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়। বরং বিদআত।
২. শবে বরাতের হালুয়া রুটি
এ রাত্রিতে হালুয়া-রুটি তৈরি করা, খাওয়া, বিতরণ করা ইত্যাদি সবই বানােয়াট ও ভিত্তিহীন কর্ম। এ রাত্রিতে এ সকল কর্ম করলে কোনাে বিশেষ সাওয়াব পাওয়া যাবে মর্মে কোনাে হাদীস বর্ণিত হয় নি। মুর্খ লােকেরা বলে যে, রাসূলুল্লাহ সঃ যখন উহুদ যুদ্ধে আহত হন এবং তার মুবারক দাঁত ভেঙ্গে যায় তখন তিনি হালুয়া খেয়েছিলেন। এজন্য শবে বরাতে হালুয়া বানাতে হয়। কথাটি একেবারেই ভুল। আর উহদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল শাওয়াল মাসে।
৩. শবে বরাতের রোজা
প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ সিয়াম পালন সুন্নাত নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (%) শাবান মাসে বেশি বেশি সিয়াম পালন করতেন। সাধারণত তিনি শাবানের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত রােযা রাখতেন এবং অনেক সময় প্রায় পুরাে শাবানই সিয়ামরত থাকতেন। এজন্য শাবানের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ অথবা অন্তত ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ সিয়াম পালন সুন্নাত সম্মত গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। তবে শুধু ১৫ই শাবান সিয়াম পালনের বিষয়ে কোনাে গ্রহণযােগ্য হাদীস পাওয়া যায় না। আলী (রা) থেকে বর্ণিত (১৭ নং) হাদীসে এ দিনে সিয়ামের কথা বলা হয়েছে। তবে হাদীসটির সনদ নির্ভরযােগ্য নয় । ১৪ রাকআত বিষয়ক (৩২ নং) হাদীসেও সিয়াম পালনের ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীসটি জাল। এ বিষয়ক আরেকটি সনদবিহীন কথা: যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করবে, জাহান্নামের আগুন কখনােই তাকে স্পর্শ করবে না।
প্রচলিত আরাে কিছু ভিত্তিহীন কথা
আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে একসাথে মিশ্রিত করেন। অনেক সময় সহীহ হাদীসেরও অনুবাদে অনেক বিষয় প্রবেশ করান যা হাদীসের নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। অনেক সময় নিজেদের খেয়াল-খুশি মত বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থের নাম ব্যবহার করেন। এগুলির বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়ােজন । মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের লেখকগণের পরিশ্রম কবুল করুন, তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক দান করুন। শবে বরাত বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি। প্রায় সকল পুস্তকেই এই কথাগুলি কম বেশি লিখা হয়েছে।
হাদীসে আছে, যাহারা এই রাত্রিতে এবাদত করিবে আল্লাহ তাআলা আপন খাছ রহমত ও স্বীয় অনুগ্রহের দ্বারা তাহাদের শরীরকে দোজখের অগ্নির উপর হারাম করিয়া দিবেন। অর্থাৎ তাহাদিগকে কখনও দোজখে নিক্ষেপ করিবেন না। হযরত সঃ আরও বলেন- আমি জিবরাইল (আঃ) এর নিকট শুনিয়াছি, যাহারা শাবানের চাঁদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহারা শবে ক্বদরের এবাদতের সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।
আরও একটি হাদীসে আছে, হযরত (সঃ) বলিয়াছেন, শাবানের চাঁদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে এবাদতকারী আলেম, ফাজেল, অলী, গাউছ, কুতুব, ফকীর, দরবেশ, ছিদ্দীক, শহীদ, পাপী ও নিস্পাপ সমস্তকে আল্লাহ তাআলা মার্জনা করিবেন। কিন্তু যাদুকর, গণক, বখীল, শরাবখাের, যেনাকার, নেশাখাের ও পিতা-মাতাকে কষ্টদাতা এই কয়জনকে আল্লাহ তাআলা মাফ করিবেন না।
আরও একটি হাদীসে আছে, আল্লাহ তাআলা শাবানের চাদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে ৩০০ খাছ রহমতের দরজা খুলিয়া দেন ও তাহার বান্দাদের উপর বে-শুমার রহমত বর্ষণ করিতে থাকেন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
কালইউবী কিতাবে লিখিত আছে, একদিন হযরত ঈসা (আ) জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন হে খােদাতাআলা! এ যামানায় আমার চেয়ে বুজুর্গ আর কেহ আছে কি? তদুত্তরে আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হাঁ, নিশ্চয়ই। সম্মুখে একটু গিয়াই দেখ। ইহা শুনিয়া ঈসা (আ) সম্মুখের দিকে চলিতে লাগিলেন, তখন বৃদ্ধ বলিলেন, আমি এতদ্দেশীয় একজন লােক ছিলাম। আমার মাতার দোওয়ায় আল্লাহ তাআলা আমাকে এই বুযুর্গী দিয়াছেন। সুতরাং আজ ৪০০ বৎসর ধরিয়া আমি এই পাথরের ভিতরে বসিয়া খােদা তাআলার এবাদত করিতেছি এবং প্রত্যহ আমার আহারের জন্য খােদা তাআলা বেহেশত হইতে একটি ফল পাঠাইয়া থাকেন। ইহা শুনিয়া হযরত ঈসা (আঃ) ছেজদায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হে ঈসা (আ)! জানিয়া রাখ যে, শেষ যমানার নবীর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি শাবানের চাদের পনরই তারিখের রাত্রে ইবাদত বন্দেগী করিবে ও সেদিন রােযা রাখিবে নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি আমার নিকট এই বৃদ্ধের চেয়েও বেশী বুযুর্গ এবং প্রিয় হইতে পারিবে। তখন ঈসা (আ) কাদিয়া বলিলেন, হে খােদা তাআলা! তুমি আমাকে যদি নবী না করিয়া আখেরী যমানার নবীর উম্মত করিতে তাহা হইলে আমার কতই না সৌভাগ্য হইত! যেহেতু তাহার উম্মত হইয়া এক রাত্রিতে এত ছওয়াব কামাই করিতে পারিতাম।
হাদীসে আছে, শাবানের চাঁদের চৌদ্দ তারিখের সূর্য অস্ত যাইবার সময় এই দোওয়া (লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) ৪০ বার পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে সূরা ফাতেহার পর প্রত্যেক রাকাতেই সূরা এখলাছ দশবার করিয়া পাঠ করিবে ও এই নিয়মেই নামায শেষ করিবে । হাদীসে শরীফে আছে,- যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের চারিটি হাজত পুরা করিয়া দিবেন ও তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। তৎপর ঐ রাত্রিতে দুই দুই রাকাত করিয়া আরও চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ক্বদর একবার ও সূরা এখলাছ পঁচিশবার পাঠ করিবে এবং এই নিয়মে নামায শেষ করিবে।হাদীস শরীফে আছে, মাতৃগর্ভ হইতে লােক যেরূপ নিস্পাপ হইয়া ভুমিষ্ট হয়, উল্লিখিত ৪ রাকাত নামায পড়িলেও সেইরূপ নিস্পাপ হইয়া যাইবে। (মেশকাত)
হাদীস শরীফে আছে, যাহারা এই নামায পাঠ করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ মার্জনা করিয়ে দিবেন। (তিরমিজী) | আরও হাদীসে আছে,- যাহারা উক্ত রাত্রে বা দিনে ১০০ হইতে ৩০০ মরতবা দরূদ শরীফ হযরত সঃ এর উপর পাঠ করিবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের উপর দোজখ হারাম করিবেন । হযরত সঃ ও সুপারিশ করিয়া তাহাদিগকে বেহেশতে লইবেন । (সহীহ বােখারী)
আর যাহারা উক্ত রাত্রিতে সূরা দোখান সাতবার ও সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করিবে, আল্লাহ তাহাদের তিনটি মকছুদ পুরা করিবেন । যথাঃ (১) হায়াত বৃদ্ধি করিবেন। (২) রুজি-রেজক বৃদ্ধি করিবেন। (৩) সমস্ত পাপ মার্জনা করেবেন।
উপরের কথাগুলি বানােয়াট ও ভিত্তিহীন। সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হলাে, গ্রন্থকার এখানে মেশকাত, তিরমিযী ও বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভিত্তিহীন কিছু কথার জন্য, যে কথাগুলি এ গ্রন্থগুলি তাে দূরের কথা কোনাে হাদীসের গ্রন্থেই নেই । এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সরলপ্রাণ বাঙালি পাঠক। বস্তুত এই জাতীয় প্রচলিত পুস্তকগুলি জাল ও মিথ্যা কথায় ভরা । মহান আল্লাহ এ সকল লেখকের নেক নিয়্যাত ও খিদমাত কবুল করুন এবং আমাদেরকে ও তাদেরকে ক্ষমা করুন।
সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত ও কর্ম
পূর্বে আলােচিত হাদীসগুলি মারফু বা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নামে বর্ণিত ও প্রচারিত হাদীস। আমরা দেখেছি যে, সেগুলির মধ্যে কিছু হাদীস নির্ভরযােগ্য বা সহীহ ও হাসান, যেগুলি রাসূলুল্লাহ -এর বাণী বা কর্ম বলে প্রমাণিত। বাকী হাদীসগুলি অত্যন্ত দুর্বল বা বানােয়াট। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ হাদীসগুলি রাসূলুল্লাহ সঃ এর বাণী বা কর্ম নয়। ৩য়/৪র্থ হিজরী শতকে বা পরবর্তীকালে কতিপয় মিথ্যাবাদী রাবী বানােয়াট সনদ তৈরি করে এ সকল কথা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নামে চালানাের চেষ্টা করেছে। যদিও মুহাদ্দিসগণ সহজেই তাদের জালিয়াতি ধরে ফেলেছেন, কিন্তু অনেক সাধারণ মুসলিম বা কোনাে কোনাে ফকীহ ও মুফাসসির তাদের জালিয়াতি দ্বারা ধোকাগ্রস্থ হয়েছেন ।
সাহাবী ও তাবিয়ীগণের মতামত ও কর্মকেও মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (স) এর নামে প্রচারিত হাদীসকে হাদীস মারফু সাহাবীর মতামত বা কর্ম হিসাবে বর্ণিত হাদীসকে হাদীস মাওকুফ ও তাবিয়ীর মতামত ও কর্ম হিসাবে বর্ণিত হাদীসকে হাদীস মাকতু বলে অভিহিত করা হয়। মাওকুফ ও মাকতু উভয় প্রকারের হাদীসকে আসার বলা হয়। এখানে আমরা শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত মাওকুফ ও মাকতু হাদীসগুলি আলােচনা করব।
উল্লেখ্য যে, মধ্য শাবানের রাতের ফযীলত সম্মন্ধে সাহাবাগণ থেকে যয়ীফ সনদে কতিপয় হাদীস বা আসার বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু উক্ত রাতে একাকী বা সম্মিলিতভাবে কোন ইবাদত পালনের ব্যাপারে তাঁদের থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হাদীস ও আসারের আলােকে সুস্পষ্ট যে, কোনাে সাহাবী ব্যক্তিগতভাবে বা সামষ্টিকভাবে কখনােই এ রাত্রিতে কোনাে বিশেষ ইবাদত করেন নি। সাহাবীগণের যুগে এ রাতটি ব্যক্তিগত বা সামাজিক কোনােভাবেই উদযাপিত বা পালিত হয় নি।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
পরবর্তী প্রজন্ম তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ রাতে ইবাদত বন্দেগি করার বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তাবেয়ীগণ থেকে দুধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। সিরিয়া বাসী কতিপয় তাবেয়ী এ রাতে বিশেষভাবে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এদের মধ্যে ছিলেন, প্রখ্যাত তাবিয়ী আবু আবদুল্লাহ মাকহুল (১১২ হি), প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ফকীহ খালিদ বিন মাদান, আবু আবদুল্লাহ হিমসী (১০৩ হি) ও তাবিয়ী লুকমান ইবনু আমির। কথিত আছে যে, ইহূদীদের মধ্যে প্রচলিত কতিপয় ইসরাঈলী রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে তারা এরূপ করতেন। তাদের এ কর্ম যখন প্রচার লাভ করে তখন অন্যান্য আলিম ও সাধারণ লােকদের মধ্যে একদল তাদের সাথে একমত পােষণ করেন এবং অন্যদল আপত্তি করেন।
হিজায বা মক্কা ও মদীনার অধিকাংশ আলিম এ রাত্রিতে বিশেষ কোনাে ইবাদত পালনের ঘাের আপত্তি করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত ফকীহ ও আবিদ তাবেয়ী আতা ইবনু আবি রাবাহ কুরাশী (১১৪ হি), সুপ্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আবিদ আব্দুল্লাহ ইবনু ওবাইদুল্লাহ ইবনু আবি মুলায়কা আল-মাদানী (১১৭ হি)। এ বিষয়ে সাহাবী ও তারেয়ীগণের মাওকুফ ও মাকতু হাদীস বা আসারগুলি আলােচনা করা হল।
শবে বরাতের আছার সমূহ
আছার নং ১:
সাহাবী ইকরিমা রাঃ
ইতােপূর্বে আমরা দেখেছি যে, মধ্য-শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন বিষয়ক একটি বক্তব্য ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ বক্তব্যটি কোনাে কোনাে রাবী ইবনু আব্বাসের (রা) বক্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা সনদ পর্যালােচনা করে দেখেছি যে, বক্তব্যটি ইবনু আব্বাসের বক্তব্য নয়, বরং ইকরিমার বক্তব্য।
আছার নং ২:
তাবিয়ী আতা ইবনু আবী রাবাহ
মধ্য শাবানের রাতে হায়াত-মওত লিপিবদ্ধ করা হয়। এমনকি কোন ব্যক্তি ভ্রমনে বের হয় আর তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তর করা হয়। এবং কোন ব্যক্তি বিবাহ অনুষ্ঠানে থাকে আর তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃত্যুদের তালিকায় স্থানান্তরিত করা হয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা ইবনু আবী রাবাহ ইয়াছার (১০৩ হি) এর উক্তি হিসেবে দুর্বল সনদে এ আসরটি বর্ণিত হয়েছে । ইমাম আবদুর রাজ্জাক সানয়ানী ইবনু উয়ায়না থেকে, তিনি মিস’আর থেকে, তিনি এক ব্যক্তি থেকে, তিনি আতা থেকে বক্তব্যটি বর্ণনা করেন।
আমরা দেখছি যে, আতা থেকে যিনি বক্তব্যটি বর্ণনা করেছেন তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। এজন্য আসারটি দুর্বল ও অগ্রহণযােগ্য।
আছার নং ৩:
তাবিয়ী উমার ইবনু আব্দুল আযীয
চার রাতের ব্যাপারে তুমি যত্নবান হও। আল্লাহ তায়ালা ঐ রাতগুলিতে তাঁর রহমত বর্ষণ করেন। রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত ও ঈদুল আজহার রাত।
বর্ণিত আছে যে, এ বাক্যটি বিশিষ্ট তাবেয়ী উমার বিন আব্দুল আযীয (১০২ হি) তাঁর নিয়ােজিত একজন গভর্নর তাবিয়ী আদি ইবনু আরতার (১০২হি) নিকট লিখে পাঠান। আল্লামা হাফিয ইবনু রাজাব (৭৫০ হি) আসারটি উল্লেখ করে বলেন, এর সনদের গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে আপত্তি আছে।
আছার নং ৪:
তাবিয়ী খালিদ ইবনু মাদান
বছরের মধ্যে পাঁচটি রাত আছে, যে ব্যক্তি পূণ্য লাভের আশায় এবং এ রাতগুলির ক্ষেত্রে প্রদত্ত ওয়াদাকে সত্য মনে করে নিয়মিতভাবে ঐ পাঁচ রাতে ইবাদত করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। রজব মাসের প্রথম রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আজহার রাত, আশুরার রাত ও মধ্য-শাবানের রাত।
এই বক্তব্যটি বিশিষ্ট তাবেয়ী খালিদ বিন মাদান থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিরিয়ার যে সকল তাবিয়ী এ রাতটি ইবাদতে কাটাতেন তাদের অন্যতম ছিলেন খালিদ ইবনু মাদান।
আছার নং ৫:
তাবিয়ী ইবনু আবী মুলাইকা
ইমাম আব্দুর রাজ্জাক সানআনী তার উস্তাদ মামার ইবনু রাশিদ থেকে, তিনি আইয়ুব থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবনু আবি মুলায়কার কাছে বলা হলাে যে, যিয়াদ নুমায়রী -তিনি একজন গল্পকার ওয়ায়েয ছিলেন- তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাতের ফযীলত লায়লাতুল কদরের ফযীলতের সমান; তখন ইবনু আবি মুলায়কা বলেন, আমি যদি তাকে এ কথা বলতে শুনতাম আর আমার হাতে লাঠি থাকত আমি তাকে প্রহার করতাম।
তাবিয়ী ইবনু আবী মুলাইকার বক্তব্যটির সনদ অত্যন্ত সহীহ; সনদটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ। কারণ সনদের রাবী আব্দুর রাজ্জাক বিন হাম্মাম আল-হিমইয়ারী (২১১ হি) বিশ্বস্ত ও হাদীসের অন্যতম ইমাম; তার শায়খ মামার বিন রাশেদ আল-আযদী (১৫৪ হি) বিশ্বস্ত ও হাদীসের ইমাম; তার শায়খ আইয়ুব ইবনু আবি তামিমা কাইছান আল- সিখতিয়ানী (মৃত্যু-১৩১হি) বিশিষ্ট ফক্বীহ, আবিদ ও বিশ্বস্ত রাবী। বক্তব্যদাতা আব্দুল্লাহ বিন উবায়দুল্লাহ বিন আব্দুলাহ বিন আবি মুলায়কা আল-তায়মী আল-মাদানী (১১৩ হি) বিশিষ্ট তাবেয়ী যিনি ৩০ জনেরও বেশি সাহাবী থেকে হাদীস শিক্ষা করেছেন এবং হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য ছিলেন।
এঁদের সকলের হাদীস ইমাম বুখারী ও মুসলিম গ্রহণ করেছেন; এভাবে আমরা দেখছি যে, ইবনু আবী মুলাইকার বক্তব্যটি বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত; এ বর্ণনায় যিয়াদ নুমাইরী নামক যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের ফযীলত লাইলাতুল কদরের ফযীলতের সমান বলে দাবী করেছেন তিনি হচ্ছেন যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নুমায়রী; তিনিও একজন তাবেয়ী; তিনি ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও নেককার লােক ছিলেন; কিন্তু হাদীস সংরক্ষণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে ছিলেন দুর্বল; হাদীস বর্ণনায় তিনি অনেক ভুল করতেন।
শবে বরাতের ফজিলত গুরুত্ব ও আমল সম্পর্কে হাদিস
আর এ কারণে ইয়াহয়িয়া বিন মাইন তাকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন; আবু হাতিম রাযী বলেছেন, যিয়াদ নুমায়রীর হাদীস নিরীক্ষার জন্য লেখা যাবে, তবে তা দলীল হিসাবে গ্রহণযােগ্য নয়; ইবনু হিব্বান তার বিষয়ে বলেন, তিনি ভুল করতেন এবং আবিদ ছিলেন; অন্যত্র তিনি বলেন, তার বর্ণিত হাদীস অগ্রহণযােগ্য ও পরিত্যাহ্য; তার বর্ণনা দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যায় না; ইবনু হিব্বান আরাে বলেছেন, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন তাকে (যিয়াদকে) পরিত্যাগ করেছেন এবং বলেছেন, সে কিছুই না; এমনিভাবে ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী ও অন্যন্য ইমাম তাকে দুর্বল হিসেবে অভিহিত করেছেন; ইবনু আদি বলেছেন, যিয়াদের কাছ থেকে কোন বিশ্বস্ত রাবী হাদীস বর্ণনা করলে সমস্যা নেই; ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেছেন, যিয়াদ ইবনু আব্দুল্লাহ নুমাইরী দুর্বল।
উল্লিখিত আসার থেকে আমাদের কাছে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে; প্রথমত, মধ্য শাবানের রাতের মর্যাদা নিয়ে অতিরঞ্জিত বক্তব্য হিজরী দ্বিতীয় শতকে তাবেয়ীদের যুগে কতিপয় গল্পকার ওয়ায়েজদের পক্ষ থেকে প্রচারিত হয়েছে; যেমনটি আমরা উক্ত যিয়াদের বক্তব্যে লক্ষ্য করেছি; তিনি মধ্য শাবানের রাত ও কদরের রাতকে সমমর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে দাবি করেছেন; তবে তিনি তার এই দাবীকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বা সাহাবীর মত বা বক্তব্য বলে দাবি করেন নি, বরং তার নিজের মত বলেই প্রচার করেছেন; দ্বিতীয়ত, অনেক প্রবীন তাবেয়ী মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ তাঁদের এ বাড়াবাড়িকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আছার নং ৬:
মদীনার তাবিয়ীগণের মতামত
তাবি-তাবিয়ী আব্দুর রহমান বিন যায়দ বিন আসলাম (১৮২ হি) বলেন,
আমি আমাদের (মদীনার) ফকীহগণকে এবং আমাদের উস্তাদ মাশাইখগণকে দেখেছি যে, তাদের মধ্যে কেউই মধ্য শাবানের রাতের প্রতি কোনাে ভ্রুক্ষেপ করতেন না; তাঁদের কাউকেই আমরা মাকহুলের হাদীস বর্ণনা করতে শুনিনি; তারা কেউই বছরের অন্য সাধারণ রাতগুলির উপরে এই রাতের কোন বিশেষ ফযীলত বা মর্যাদা আছে বলে মনে করতেন না; তিনি বলেন (মদীনার) ফকীহগণ এ রাত্রির ইবাদত বন্দেগি কিছুই করতেন না।
মুহাম্মদ বিন ওয়াদ্দাহ আল কুরতুবী (২৮৬ হি) হারূন বিন সাঈদ থেকে, তিনি ইবনু ওয়াহাব থেকে, তিনি আব্দুর রহমান বিন যায়দ বিন আসলাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এ কথাটি বলেন।
তাবি-তাবিয়ী আব্দুর রহমান বিন যায়দ- এর এই বক্তব্যটির সনদ তার পর্যন্ত বিশুদ্ধ; সনদের রাবী হারূন বিন সাঈদ (২৫৩ হি) বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য রাবী; তাঁর শায়খ আব্দুলাহ বিন ওয়াহাব বিন মুসলিম আল-কুরাশী (১৯৭ হি) ফিক্হ ও হাদীসের ইমাম ছিলেন এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত রারী ও আবিদ ছিলেন।
বক্তব্যদাতা হচ্ছেন উমর (রা) -এর গােলাম আসলামের পৌত্র আব্দুর রহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৮২ হি); তিনি মদীনার একজন বিশিষ্ট আলিম ও তাবে তাবেয়ী; তিনি মদীনার অনেক তাবেয়ী ও আলিমের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন; তবে তিনি হাদীস মুখস্ত, সংরক্ষণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন।
এ আছারগুলি থেকে বুঝা যায় যে, তাবেয়ীদের যুগে মধ্য শাবানের রাতের বিশেষ ইবাদত প্রসিদ্ধি লাভ করেনি; পূর্বেই দেখেছি যে, সিরিয়ার তাবিয়ী মাকহুল উক্ত রাতের ফযীলত সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদীস বর্ণনা করেছেন; এই হাদীসগুলি এবং এই রাতে ইবাদত করার প্রচলন এই সময়ে প্রচার ও প্রসিদ্ধি লাভ করেনি।
চার ইমাম ও অন্যান্য ফকীহের মতামত
আব্দুর রহমান বিন যায়দ-এর বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, মদীনার তাবেয়ী আলিমগণ শবে বরাতের আমলের প্রতি কোনােরূপ ভক্ষেপ করতেন না; পরবর্তী যুগে ফক্বীহ ও আলিমগণ উক্ত রাতের মর্যাদা নিয়ে মতভেদ করেছেন; মদীনার আলিমকুল শিরােমণি ইমাম মালিক (১৭৯ হি) ও তাঁর অনুসারী ফকীহ ও ইমামগণ উক্ত রাতের বিশেষ ইবাদত পালন করতে নিষেধ করেছেন; তাঁরা বলেন, এ রাতের গুরুত্ব দেওয়া, এ রাত্রিতে বিশেষ ইবাদত পালন করা বা এ রাত্রি উদযাপন করা বিদআত ও নিষিদ্ধ।
পক্ষান্তরে তৎকালীন যুগের সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আব্দুর রাহমান ইবনু আমর আল-আউযায়ী (১৫৭ হি) মনে করতেন যে, এ রাত্রিতে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদত ও দোয়া মুনাজাতে রত থাকা মুস্তাহাব; ইমাম শাফেয়ীও (২০৪ হি) অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন; সিরিয়ার কোনাে কোনাে ফকীহ এ রাত্রিতে মসজিদে এসে ইবাদত বন্দেগি করাকে ভাল বলে মনে করতেন; ইমাম আবু হানিফা (১৫০ হি) ও ইমাম আহমদ (২৪১ হি) এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি।
পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ হাম্বলী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবনু রাজাব (৭৫০ হি) ও অন্যান্য অনেক হাম্বলী ও হানাফী ফকীহ ইমাম আওযায়ী ও শাফিয়ীর মতের সমর্থন করেছেন; তারা ব্যক্তিগতভাবে এ রাত্রিতে কিছু দোয়া-মুনাজাত ও ইবাদত করাকে ভাল মনে করতেন; তবে তারা এ রাত্রিতে ইবাদত করার জন্য সমবেত হওয়া বা আনুষ্ঠানিকভাবে রাত্রিটি পালন করাকে অপছন্দ করতেন ও মাকরূহ বলে উল্লেখ করেছেন; প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা হাসান ইবনু আম্মার শুরুবুলালী (১০৬৯হি) উল্লেখ করেছেন যে, দু ঈদের রাত্রি, যিলহাজ্জ মাসের দশ রাত্রি ও মধ্য-শাবানের রাত্রি ইবাদত বন্দেগিতে কাটানাে মুস্তাহাব, তবে এজন্য মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া মাকরূহ; তিনি বলেন: এ সকল রাত্রি ইবাদতে কাটাতে মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া মাকরূহ; কারণ রাসূলুল্লাহ সঃ এরূপ করেন নি, এবং তাঁর সাহাবীগণও এরূপ করেন নি; প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা ইবনু নুজাইম (৯৭০ হি), আল্লামা আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ তাহতাবী (১২৩১হি) প্রমুখ একই কথা বলেছেন।
শবে বরাতের হাদীসগুলির প্রতিপাদ্য
মধ্য শাবানের ফযীলত, মর্যাদা ও ইবাদত বন্দেগি সম্পর্কে বর্ণিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত সহীহ, যয়ীফ ও মাউযু হাদীসগুলি আমরা পূর্বে আলােচনা করলাম; হাদীস বিষয়ক গ্রন্থসমূহে এ বিষয়ে আর কোনাে মূল হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই; তবে একেবারে সনদহীনভাবে আরাে অনেক কথাই বিভিন্ন ওয়ায, গল্প বা ফযীলতের গ্রন্থে পাওয়া যায়, যেগুলি একেবারেই ভিত্তিহীন এবং সনদ না থাকার কারণে হাদীসতাত্ত্বিকভাবে সেগুলির বিচারও সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, সহীহ হাদীসের জন্য গ্রন্থ, সনদ বা রেফারেন্সের প্রয়ােজন হয়; জাল বা বানােয়াট হাদীসের জন্য গ্রন্থ ও রেফারেন্সের প্রয়ােজন হয় না; অনেক সময় আমরা দেখি যে, কোনাে প্রচলিত পত্র পত্রিকায়, বইয়ে বা বক্তব্যে কোনােরূপ সনদ, গ্রন্থ বা সূত্র উল্লেখ না করেই ‘হাদীসে আছে’ বা ‘হাদীস শরীফে বলা হয়েছে বা অনুরূপ শিরােনামে অনেক কথা বলা হয় যা কোনাে হাদীসের গ্রন্থে পাওয়া যায় না; বস্তুত অতীত যুগে জালিয়াতগণকে জাল হাদীস বানানাের জন্য বানােয়াট সনদ তৈরি করতে হতাে; কিন্তু বর্তমানে হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন বা অনুরূপ কিছু বললেই সকলেই মেনে নেয়; এরূপ একেবারে সনদবিহীন ভিত্তিহীন কথাবার্তা বাদ দিয়ে মধ্য শাবানের রজনী সম্পর্কিত প্রচলিত ও বর্ণিত হাদীসগুলি আমরা আলােচনা করলাম; এ আলােচনার ভিত্তিতে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি তা হলো:
১. সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, এ রাত্রিতে আল্লাহ মুশরিক ও বিদ্বেষে লিপ্ত মানুষ ছাড়া অন্যদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এ রাত্রিতে বিশেষ কোনাে আমল করতে হবে বা এ রাত্রির ক্ষমা লাভের জন্য বান্দাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে বলে কোনাে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি।
২. এ রাত্রিতে ভাগ্য লিখা হয় মর্মে রাসুলুল্লাহ সঃ ও সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত সকল হাদীস বানােয়াট, মিথ্যা বা দুর্বল।
৩. এ রাত্রিতে কবর যিয়ারত করা, মৃতদের জন্য ক্ষমা চাওয়া, নিজের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা এবং সালাত আদায় করার উৎসাহ প্রদান করে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সমস্ত হাদীসগুলির সনদেই দুর্বলতা আছে এবং সাহাবীগণ এসব আমল করেছেন এমনটি জানা যায় না। তাই এগুলি থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
৪. এ সকল ইবাদত দলবদ্ধভাবে আদায় করা, সে জন্য মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া, উক্ত রাতে বিশেষ ভাবে গােসল করা, নির্দিষ্ট সূরা পাঠের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে নামায আদায় করা, হালুয়া-রুটি তৈরী ও বিতরণ করা, বাড়ি, গােরস্থান বা কবরে আলােকসজ্জা করা ইত্যাদি কর্ম একেবারেই ভিত্তিহীন, সুন্নাত বিরােধী এবং নব-উদ্ভাবিত কর্ম অর্থাৎ বিদআত, যা একেবারেই ভ্রষ্টতা।
৫. ১৫ই শাবানের দিবসে সিয়াম পালনের ফযীলতে কোনাে নির্ভরযােগ্য হাদীস বর্ণিত হয়নি; তবে শাবান মাসে বেশি বেশি সিয়াম পালন, বিশেষত প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত সিয়াম পালন রাসূলুল্লাহ সঃ এর সুপরিচিত সুন্নাত; এ ছাড়া প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ সিয়াম পালনও সুন্নাত নির্দেশিত গুরুত্বপর্ণ মুসতাহাব ইবাদত; এজন্য সম্ভব হলে শাবানের প্রথম ১৫ দিন, না হলে অন্তত ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ সিয়াম পালন উচিত।
৬. সূরা দুখানে উল্লিখিত মুবারাক রজনী বলতে শবে বরাত বুঝানাে হয় নি, বরং শবে কদর বুঝানাে হয়েছে; কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সমন্বিত অর্থ ও সাহাবী-তাবিয়গণের ব্যাখ্যার আলােকে এ কথা নিশ্চিত যে, মুবারক রজনী বলতে লাইলাতুল ক্বাদর বুঝানাে হয়েছে; কাজেই সূরা দুখানের আয়াতগুলি মধ্য-শাবানের রজনীর জন্য প্রযােজ্য নয়; তবে মধ্য শাবানের রজনীর পৃথক মর্যাদা রয়েছে আর তা হচ্ছে এই রাতটি বিশেষ ক্ষমার রাত।
মুমিন জীবনের প্রতিটি রাতই শবে বরাত
সবচেয়ে বড় কথা হলাে, মুমিন যদি একটু আগ্রহী হন তবে প্রতি রাতই তার জন্য শবে বরাত। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য ইমাম সংকলিত সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সঃ বলেন:
প্রতি রাতে রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে বলেন, আমিই রাজাধিরাজ, আমিই রাজাধিরাজ; আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছ কি? তাকে আমি ক্ষমা করব। প্রভাতের উন্মেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে তিনি বলতে থাকেন।
অন্যান্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, মধ্যরাতের পরে এবং বিশেষত রাতের দু-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পরে তাওবা কবুল, দুআ কবুল ও হাজত মেটানাের জন্য আল্লাহ বিশেষ সুযােগ দেন।
তাহলে আমরা দেখছি, লাইলাতুল বারাআতের যে ফযীলত ও সুযােগ, তা মূলত প্রতি রাতেই মহান আল্লাহ সকল মুমিনকে প্রদান করেন; লাইলাতুল বারাআত বিষয়ক যয়ীফ হাদীসগুলি থেকে বুঝা যায় যে, এ সুযােগ শবে বরাতের সন্ধ্যা থেকে; আর উপরের সহীহ হাদীসগুলি থেকে জানা যায় যে, প্রতি রাতেই এ সুযােগ শুরু হয় রাতের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩/৪ ঘন্টা রাত অতিবাহিত হওয়ার পরে, রাত ১০/১১ টা থেকে; কাজেই মুমিনের উচিত শবে বরাতের আবেগ নিয়ে প্রতি রাতেই সম্ভব হলে শেষ রাত্রে, না হলে ঘুমানাের আগে রাত ১০/১১ টার দিকে দুচার রাকআত সালাত আদায় করে মহান আল্লাহর দরবারে নিজের সকল কষ্ট, হাজত, প্রয়ােজন ও অসুবিধা জানিয়ে দুআ করা, নিজের যা কিছু প্রয়ােজন আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং সকল পাপ-অন্যায় থেকে ক্ষমা চাওয়া ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও মেনে চলার তাওফীক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমীন।