আমাদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার তাগিদেই আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ,নতুন নতুন ওষুধ। এই আর্টিকেল পড়ে আপনি জানতে পারবেন প্রাচীন যুগের সফল কিছু চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার সম্পর্কে। চলুন তাহলে জেনে নেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ৭টি অবাক করা তথ্য।
সাক্কারা হচ্ছে মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে প্রায় ২০ মাইল দক্ষিণে বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট, যা পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয় শহর মেমফিসের সমাধিক্ষেত্র ছিল। এই অঞ্চলে পৃথিবীর প্রাচীনতম ভবনের একটি অবস্থিত যার নাম "দ্যা স্টেপ পিরামিড অফ জেসর"।
এটির কাছাকাছি একটা সমাধিসৌধে ‘মেরিট পিটাহ’ নামক এক মহিলার চিত্র পাওয়া গেছে। এই মেরিট পিটাহকে বলা হয় প্রথম মহিলা ডাক্তার। তিনি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ সালে এই অঞ্চলে বাস করতেন এবং সমাধির হায়ারোগ্লাইফ এর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি প্রধান চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিলালিপি থেকে তার জীবনের বিস্তারিত জানা যায়।
প্রায় ২০০বছর পর অন্য এক ডাক্তার ‘পিসেসহেট’ এর কথা জানা যায় তার পুত্র আখেট-হেটেপ এর সমাধির স্মৃতিসৌধতে। আখেট-হেটেপ ছিলেন উঁচু স্তরের পুরোহিত। এখান থেকে জানা যায় পিসেসহেট ছিলেন মহিলা চিকিৎসকদের অধ্যক্ষ। তিনি ছিলেন মহিলা চিকিৎসকদের সংস্থা অথবা তাদের প্রশিক্ষনের পরিচালক।
প্রাচীন চিকিৎসা পাঠ্যপুস্তকগুলোর মধ্য একটি হলো ভারতের সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘সুশ্রুত সংহিতা’। সুশ্রুত উত্তর ভারতীয় বেনারসে কর্মরত একজন চিকিৎসক এবং শিক্ষক ছিলেন বলে ধারনা করা হয়। তার এই বইটি থেকে ওষুধ, সার্জারি, ফার্মাকোলজি এবং রোগী পরিচালনার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। ।
এই বইয়ে বর্ণিত অনেকগুলো শল্য চিকিৎসার বর্ণনার মধ্যে চোখের ছানি অপারেশনের বর্ণনাও ছিল। বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনী দিয়ে চোখের পাতাগুলি ধরে চোখের পাতাকে পাশ থেকে ছিদ্র করার জন্য সূচের মতো যন্ত্র ব্যাবহার করা হত। এরপর এতে বুকের দুধ ছিটিয়ে দেওয়া হতো এবং ভেষজ ঔষধ দিয়ে মুছে দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা ছানি লেন্সগুলো পরিষ্কার করার জন্য একটি যন্ত্র ব্যাবহার করতেন যতক্ষন না চোখে সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি ধরা না দেয়।
আরোগ্যকালে রোগীকে হাঁচি, কাশি বা চোখে চাপ সৃষ্টি করে এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হত। অপারেশন সফল হলে রোগী কিছু কার্যকর দৃষ্টি ফিরে পেত। তবে অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টি ফোকাসবিহীন থাকত।
১৫৩৬ সালে স্টাডাকোনার (বর্তমানে কানাডার কুইবেক সিটি) কাছে ফ্রান্সের বিখ্যাত নাবিক জ্যাক কারটিয়ারের জাহাজ বরফে আটকে গিয়েছিল। ফলে নাবিকদের তাজা খাবারের অভাব দেখা দিয়েছিল। তারা যখন এই আটকে থাকা অস্থায়ী দূর্গ থেকে নেমে এসেছিল তখন দেখা গেল তাদের মুখ দুর্গন্ধযুক্ত , দাঁতের গোড়া এবং মাড়িগুলো পচে গেছে এবং খসে পড়ছে। এই রোগটিই বর্তমানে স্কার্ভি নামে পরিচিত এবং আমরা জানি এটি ভিটামিন সি এর অভাবে হয়ে থাকে। কিন্ত সেই সময় কার্টিয়ারের এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলনা।
১৫৩৪ সালে স্টাডাকোনায় প্রথম যাত্রার সময় কার্টিয়ার দুজন যুবক ডোম আগায়া এবং তাইগোনোগিনিকে অপহরণ করেছিলেন । তিনি যে ঐ অঞ্চল আবিষ্কার করেছিলেন তার প্রমাণ হিসেবেই যুবকদের অপহরণ করে ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে স্থানীয় জনগণ কার্টিয়ারকে বিশ্বাসঘাতক ভাবতে লাগলো।
এই বিরুপ মনোভাবের পরও ডোম আগাইয়া কার্টিয়ারকে দেখিয়েছিল কিভাবে ‘আনেদদা’ নামক একটি গাছ এই রোগে কাজে লাগে। তবে ফরাসীরা প্রথমে ভেবেছিল ডোম আগায়া তাদেরকে বিষ দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করছে তবুও কয়েকজন এটি সেবন করলো এবং কয়েকদিনের মাথায় সুস্থ হয়ে গেলো। এরপর এই ওষুধের এতটাই চাহিদা ছিল যে এর জন্য তারা একে অপরকে হত্য করতে প্রস্তত ছিল।
আনেদদা গাছটির পরিচয় নিশ্চিত করা না গেলেও পূর্বাঞ্চলের সাদা সিডার এবং সাদা স্প্রস সহ বেশ কয়েকটা গাছকে ধারণা করা যায়। যে গাছই হোক এটা নাবিকদের পুরোপুরিভাবে সুস্থ্য হতে সাহায্য করেছিল।
তবে স্কার্ভি নিরাময়ের এই পদ্ধতি খুব বেশি জায়গায় পরিচিত লাভ করতে পারেনি, ফলে রোগটি আরো ২০০ বছরেরও বেশিসময় ধরে নাবিকদের প্রাণ নাশ করে চলছিল।
প্রাচীন কালে একজন রাজা হওয়া ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রাজাকে মেরে ফেলার জন্য প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ ষড়যন্ত্র করত। কিংবদন্তী অনুযায়ী পোন্টাসের (তুরস্কের কালো সাগরের তীরে) রাজা ষষ্ঠ মিঠ্রাডেটস ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান ডোজ গ্রহণ করে বিষের প্রতিরোধী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বন্দীদের উপর বিভিন্ন বিষ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার এই পরীক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে এমন এক ওষুধের আবিষ্কারের মাধ্যমে যা সকল কিছুর প্রতিষেধক হিসেবে পরিচিত ছিল।
তবে এটি রোমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করেনি যখন খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬ সালে মিথ্রাডেটস সামরিক নেতা পম্পেইয়ের কাছে পরাজিত হয়েছিল এবং রেসিপিটি তখন রোমে পৌঁছে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সম্রাট নেরোর চিকিৎসক অ্যাান্ড্রোম্যাচাস এটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে ৬৪ উপাদানের একটি রেসিপি বিকাশ করেছিলেন যা ‘থেরিয়াক’ নামে পরিচত। বেশিরাভাগ উপাদানই ছিল বিভিন্ন উদ্ভিদ (আফিম সহ), তবে ভাইপারের মাংসও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান ছিল।
প্রাথমিক সংশয় থাকা সত্বেও থেরিয়াক ব্যায়বহুল প্রতিষেধক ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে ভেনিস ছিল শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারী এবং ইরোপিয়ান, এরাবিয়ান এবং চাইনিজ মেডিসিনে উচ্চ মাত্রায় ব্যবহৃত হতো।
১৭৪৫ সালে উইলিয়াম হেবারডেন থেরিয়াকের কার্যকারিতা মিথ্যা প্রমাণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, রোমানরা তাদের নিজস্ব লাভের জন্য এটি সম্পর্কে অতিরঞ্জিত গল্প বলেছিল। তবুও থেরিয়াক উনিশ শতকের শেষ অবধি কিছু ইউরোপীয়ো ফার্মাকোপিয়ায় রয়ে গিয়েছিল।
সিশু হানাওকা (১৭৬০-১৮৩৫) তদকালীন জাপানের কিয়োটাতে চিকিৎসা নিয়ে পড়ালেখা করছিলেন এবং নিজের শহর হীরায়ামায় প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি অ্যাানাস্থেসিয়া বা অবচেতনকারী ওষুধের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন এই কারণে যে, তৃতীয় শতাব্দীর চীনা সার্জন হুয়া তিও এমন একটি যৌগিক ওষুধ তৈরি করেছিলেন যা রোগীদের ব্যাথার মধ্যেও ঘুমাতে সাহায্য করে।
হানাওকা অনুরূপ সুত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে ‘সুসানসান’ নামে একটি শক্তিশালী গরম পানীয় তৈরি করে। এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল কারণ এটি যদি অতিরিক্ত মাত্রায় এবন করা হয় তাহলে রোগী মারা যাবে তবে পরিমিত মাত্রায় সেবন করলে রোগী ছয় থেকে চব্বিশ ঘন্টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকবে যা শল্য চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট।
১৮০৪ সালের ১৩ ই অক্টোবর, হানাওকা ‘কান অয়ার’ নামক একজন মহিলার স্তনের টিউমার অ্যাানাস্থেসিয়া্র সাহায্য নিয়ে নির্মূল করেছিলেন। এরপরও হানাওকা দেড়শতাধিক স্তন ক্যান্সারের রোগী এবং অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের নিয়ে কাজ করেন।
চিকিৎসায় জোঁক হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এখনো অস্ত্রোপচারের পর রক্তনালীর পুনরায় সঞ্চালনের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ঊনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে জোঁকের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
ফরাসী চিকিৎসক ফ্রান্সোসাইস জোসেফ ভিক্টর ব্রোসাইস (১৭৭২-১৮৩৮) বলেছিলেন যে , ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ থেকে উদ্ভুত সকল রোগ রক্তক্ষরণ এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। জোঁকের ক্রেজের কারণে বন্য জোঁকের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল এবং ব্যাপক হারে জোঁকের খামার গড়ে উঠছিল।
সুই ব্যাবহার করে রক্তক্ষরণের চেয়ে জোঁক ব্যাবহার করে রক্তক্ষরণের বেশ কয়েকটা সুবিধা ছিল, যেমন রক্তক্ষরণের পরিমাণ কম হত এবং তুলনামূলক ব্যাথা কম লাগত।
উনিশ শতকের চিকিৎসক ব্রাউসাইস এর অনুসারীরা অন্যান্য সকল রোগের চিকিৎসায় এই জোঁক থেরাপির ব্যাবহার শুরু করলেন। ১৮২২ সালে, রিস প্রাইস নামে একজন ব্রিটিশ সার্জন এই জোঁক থেরাপির নাম দেন ‘সাঙ্গুই-সাকশন’।
শতাব্দী ধরে মানুষ জেনে আসছিল যে, সিজারিয়ান অপারেশনে মা এবং শিশুর উভয়ের জীবন বাঁচায়, তবে এন্টিসেপটিক পদ্ধতি এবং অ্যাানাস্থেসিয়া প্রবর্তনের পরেও সিজারিয়ান পদ্ধতি একটি বিপজ্জনক শেষ অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই, রবার্ট ফেলকিন নামক একজন মিশনারী চিকিৎসকের একটি সফল অপারেশন সম্পর্কে বক্তৃতা শুনে এডিনবার্গ সার্জনরা অবাক হয়েছিল যা তিনি পাঁচ বছর আগে উগান্ডার বুনিওরো কিতারাত নামক স্থানে দেখতে পেয়েছিলেন ।
ফেলকিন জানিয়েছিল, মা ও সন্তান দুজনেরই জীবন বাঁচানোর অভিপ্রায় নিয়ে অপারেশনটি শুরু হয়েছিল। বানানা ওয়াইন দিয়ে মাকে আংশিক অ্যাানেস্থেসাইজ করা হয়েছিল। সার্জন নিজের হাত এবং অস্ত্রোপাচারের স্থান ধোয়ার জন্য এই ওয়াইন ব্যাবহার করেছিলেন। তিনি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থার ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন। তারপরে তিনি পেটের প্রাচীর এবং জরায়ু প্রাচীরের কিছু অংশ পেরিয়ে একটি উল্লম্ব চির তৈরি করেছিলেন, যেন শিশুটিকে বাইরে আনার জন্য জরায়ুকে আরো বিভাজন করতে না হয়। এই অপারেশনে প্লাসেন্টা অপসারণ এবং জরায়ু সংকোচনের সাথেও জড়িত ছিল।
সার্জন সাতটি পালিশ করা লোহার স্পাইক ব্যাবহার করে অপারেশনের ক্ষত স্থানের প্রান্তগুলো একত্রিত করে দিয়েছিল। তারপর ছাল ও কাপড়ের দড়ি দিয়ে জায়গাটা বেঁধে রেখেছিলেন। তারপর সেখানে ভেষজ পেস্ট ঘন করে লাগিয়ে একটি কলা পাতা দিয়ে ঢেকে ব্যান্ডেজ করেছিলেন।
ফেলকিনের ভাষ্যমতে ১১দিন পর যখন তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে আসছিলেন তখন দেখেছিলেন মা এবং শিশু উভয়ই সুস্থ হওয়ার পথে।
আধুনিক বিজ্ঞানের অবদানে চিকিতসাক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং ক্রমে ক্রমে চিকিৎসা বিজ্ঞান আরো উন্নতি করছে। তবে চিকিৎসার এই বিকাশ যে আধুনিক পৃথিবী থেকে শুরু তা বললে ভুল হবে। চিকিৎসার বিকাশ শুরু হয়েছে হাজার বছর আগের প্রাচীন পৃথিবীতে মেরিট পিটাহ এবং পিসেসহেট এর মতো চিকিৎসকদের মাধ্যমে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের রয়েছে ব্যাপক সমৃদ্ধ ইতিহাস। যুগে যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি যুক্ত হয়ে আজকের এই অবস্থায় পৌঁছেছে। চলুন তাহলে জেনে নেই প্রাচীন এনেমা থেকে টেপওয়ার্মের ডাক্তার পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই সমৃদ্ধ ইতিহাসের ৭টি উল্লেখযোগ্য তথ্য।
১৮৬৫ সালে আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক ইফ্রাইম জর্জ স্কুইয়ার একটী প্রাচীন মেক্সিকান খুলি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০-১৫০০ সালের খুলিটির সামনের অংশে একটি আয়তাকার গর্ত ছিল। স্কুইয়ার এবং নিউ ইয়র্ক একাডেমি অফ মেডিসিন এবং ফরাসি নিউরো বিজ্ঞানী পল ব্রোকার একত্রে এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেন। গবেষণারর পর তারা জানিয়েছিলেন , ব্যাক্তিটি বেঁচে থাকা অবস্থায় খুলিতে গর্তটি ইচ্ছে করে করা হয়েছিল।
প্রাচীন এই পদ্ধতি ট্র্যাপেনিং নামে পরিচিত যা খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ সাল আগে থেকে শুরু হয়েছিল।
এক গবেষণায় অনেকগুলো সভ্যতায় খুলিতে এমন আয়তাকার খাঁজ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্ত তারা কেন এমন করেছিল? ব্রোকারের ধারণা অনুয়ায়ী, প্রাচীন এই সভ্যতাগুলোর লোকেরা নিজেদেরকে প্রেতাত্মা থেকে বাঁচাতে এরকম করত। এটি একটি তত্ব এবং আজও এটি জনপ্রিয়। তবে এই সংস্কৃতিটি সম্পুর্ণ অবৈজ্ঞানিক।
তবে এটাও সম্ভব যে, এই ট্র্যাপেনিং হল ফ্র্যাকচার চিকিৎসা করার একটি কার্যকর পদ্ধতি। কোনভাবে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হলে রোগীর মৃত হাড় অপসারণ করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হত যদি না এর মধ্যে রোগী মারা না যেত।
প্রাচীন মিশরে রোগের চিকিৎসা করা হত ধর্ম, যাদু এবং বিজ্ঞানের মিশ্রণে। সাধারণত পুরোহিতরা চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করত, আবার তারা জাদুকরও ছিল।
ঊনিশ শতকের গোঁড়ার দিকের হাইরোগ্লাইফগুলি ডিকোড করার পর মিশরের চিকিৎসা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। চিকিৎসকদের রোগ সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান ছিল এবং তাদের ভেষজ, প্রাণী পণ্য ও খনিজ পদার্থ সম্পর্কে ফার্মাকোপিয়া ছিল। প্রেসক্রিপশনে বড়ি, মলম, এনেমা, ইনহ্যালেশন এবং এগুলো তৈরি করার উপাদান এবং প্রস্ততপ্রাণালীর বিবরণ দেওয়া থাকত।
এই এনেমাগুলো পরিচালনায় দক্ষ একচজন চিকিৎসক ছিলেন ইরেনখতি। তিনি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২১৫০অব্দে বাস করতেন। তিনি রাজপ্রাসাধের ডাক্তার ছিলেন এবং এছাড়াও “নেড়ু পেহুত-হার্ডসম্যান অব দ্যা আনুস” পদে অধিষ্টিত ছিলেন।
অসুস্থতা, যুদ্ধ ও মারামারি জনিত কোন কারণে নাক ভেঙ্গে গেলে প্লাস্টিক সার্জনরা নাককে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল।
ইন্ডিয়ান সার্জন সুশ্রুত (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০অব্দ) রোগীর গাল থেকে চামড়া নেওয়ার জন্য একটি উদ্ভিদ পাতা ব্যাবহার করতেন। এটি পেডিকল নামক একটি স্ট্রিপ দিয়ে আটকানো হত। এটিকে মোচড়াতে থাকলে ক্ষতের পৃষ্ঠটি নিচের দিকে চলে যেত। সুশ্রুত এটিকে আহত সেই নাকের জায়গায় বসিয়ে দিত এবং নাসিকার যায়গায় ছোট ছোট নলের টিউব বসিয়ে দিত।
একই ধরণের পদ্ধতি রেনেসাঁ যুগের ইতালিতে পুনরায় উদ্ভুত হয়েছিল। সার্জন পরিবার ব্র্যাংকাস এবং ভায়ানিওস রোগীদের বাহুর ত্বক থেকে নতুন নাক তৈরি করার পদ্ধতিগুলো আবিষ্কার করেছিল। তবে এই পদ্ধতিটি সার্জনরা গোপন রাখত। তবে ১৫৯৭ সালে বলোগনার এনাটমির অধ্যাপক গ্যাসপেয়ার টেগলিয়াকোজি, “দে কার্টোরাম চিরুগিয়া পার ইনসিশিওনেম” এর মাধ্যমে এই পদ্ধতিটি প্রকাশ করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল রাইনোপ্লাস্টি (নাকের অস্ত্রোপচার) বৈজ্ঞানিক ভাবে বর্ণনা করা এবং এটা পড়ে অন্যান্য সার্জনরা যেন শিখতে পারে।
সিগারেট এবং স্বাস্থ্য দুটি সম্পূর্ণ দুই মেরুর শব্দ। হাঁপানির জন্য উনিশ শতকের মেডিকেল সিগারেটগুলো ইনহেলেশন থেরাপির দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ যা আজকের ইনহেলারগুলোতেও দেখা যায়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী হাঁপানির কারণ সম্পর্কে ধারণাগুলো পরিবর্তিত হয়ে আসছিল। পুরোনো ধারণাগুলো বদলে যাওয়ার পর ইনহেলেশন হিসেবে ভেষজ ধূমপানের প্রচলন শুরু হয়েছিল। আঠারো শতকের শেষের দিকে হাঁপানি একটি “নার্ভাস” রোগ হিসেবে বিবেচিত হত। গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হতে লাগল ডেটুরা স্ট্রোমোনিয়াম উদ্ভিদ।
প্রথমদিকে স্ট্রোমিনিয়ামটি সাধারণ তামাকের পাইপগুলোর মধ্যে ভরে ধূমপানে ব্যাবহার করা হত। তবে এগুলিতে বিপজ্জনক মাদক প্রভাব ছিল। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সিগার এবং পরে সিগারেট প্রবর্তনের মাধ্যমে ধূমপান সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া শুরু হয়েছিল। ডাক্তাররা হাঁপানির কারণে সৃষ্ট শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে ধূমপানের পরামর্শ দিতেন এবং এতে বাণিজ্যিক ভাবে সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পনিগুলো লাভবান হতে শুরু করল।
বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে হাঁপানির স্পসমোডিক মডেল, অ্যাালার্জি প্রদাহের ধারণাটি দেয় এবং এতে চিকিৎসায় ধূমপানের উপযোগীতা কমে যায়। একই সময় এফিড্রিনের মতো নতুন ওষুধগুলো সম্ভাব্য হ্যালুসিনেজিক স্ট্রোমোনিয়ামের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
রেবেকা ক্রাম্পলার হচ্ছেন প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা চিকিৎসক যিনি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্যে অবস্থা উন্নয়নে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
তার জন্ম ১৮৩১ সালে ডেলাওয়ারের ক্রিস্টিয়ানাতে। তিনি ১৮৫২ সালে ওয়াট লিকে বিয়ে করে ম্যাসাচুয়েটস এর চার্লসটাউনে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি স্থানীয় চিকিৎসকদের নার্স হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং তারা তাকে নিউ ইংল্যান্ড মহিলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে সহযোগিতা করেছিলেন। ১৮৬৩ সালে তার স্বামী যক্ষ্ণা রোগে মারা যান । তবে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং পরের বছর ডক্ট্রেস অফ মেডিসিন হিসেবে স্নাতক হন। তিনি বোস্টনে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সেখানে ১৮৬৫ সালের মে মাসে আর্থার ক্রাম্পলারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাকে এখন রেবেকা লি ক্রাম্পলার হিসেবে স্মরণ করা হয় তবে তার দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি লি নামটি ব্যাবহার করেছিলেন বলে মনে হয় না। দুঃখের বিষয় হল তার কোন সনাক্তকারী ফটো পাওয়া যায়নি।
আমেরিকান গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্রাম্পলার ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে গিয়েছিলেন ফ্রিডম্যান্স ব্যুরোতে কাজ করার জন্য। এটি প্রাক্তন কনফেডারেট রাজ্যের মুক্ত দাস এবং দরিদ্র শ্বেত মানুষদের সহায়তা করার একটি সরকারি সংস্থা। তার ডিগ্রী থাকা সত্বেও তিনি নার্স হিসেবে রেকর্ডে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন এবং প্রতি মাসে ১০ ডলার পারিশ্রমিক পেতেন।
আফ্রিকান-আমেরিকান লেখকদের প্রথম দিকের প্রকাশিত বই গুলোর মধ্যে তার একটি বই ছিল যার নাম "এ বুক অফ মেডিকেল ডিসকোর্স"। এই বইটি বিশেষ করে মহিলা পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। ক্রাম্পলার বুঝতে পেরেছিলেন জ্ঞানই শক্তি এবং এটি মহিলা এবং তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যে সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।
বিফ টেপওয়ার্ম বা গরুর ফিতা কৃমি, ‘টেনিয়া সাগিনাটা’ মানব অন্ত্রে ২০ মিটার দীর্ঘ লম্বা হতে পারে। এরা হজম প্রক্রিয়ার উপাদানগুলো থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে এবং বছরের পর বছর ধরে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করতে পারে , যতক্ষন না পর্যন্ত তার হোস্ট এটিকে তাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নেয়। ঊনিশ এবং বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে আমেরিকাতে যারা টেপওয়ার্ম চিকিৎসার প্র্যাক্টিস করত তাদের জন্য এটা বেশ লাভজনক ক্যারিয়ার তৈরি করেছিল। টেপওয়ার্ম বিশেষজ্ঞদের ইতিহাস চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসকে খুব বেশি প্রভাবিত না করলেও গ্রামীন সম্প্রদায়ের জন্য তৎকালীন স্বাস্থ্য সেবার চিত্র প্রকাশ পায়।
কৃমি চিকিৎসরা চিকিৎসা করার সময়, পরজীবীটিকে ক্ষুদার্ত করার জন্য আপনাকে একদিনের উপোস করতে হবে। তারপর এক কাপ গরম দুধে এক চামচ পুরুষ ফার্নের তেল দিতে হবে। তারপর আপনাকে কয়েকঘন্টা শুয়ে থাকতে হবে। তারপর ক্যাস্টর অয়েল, টারপেনটাইন এবং ক্রোটন অয়েলের মিশ্রণ সেবন করতে হবে। এটি মারাত্মক কার্যকরী একটি রেচক। এর প্রভাবগুলো সহজেই কল্পনা করা যায়।
"প্লেগ" শব্দটি মধ্যযুগীয় শোনালেও পৃথিবী তৃতীয় প্লেগ মহামারীর স্মৃতি এখনো ভুলেনি। পূর্ববর্তী মহামারীতে নির্বিচারে সবাই আক্রান্ত হলেও এটি দরিদ্রদেরকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল এবং বিশ্ব ব্যাপী স্বাস্থ্য বৈষম্য তৈরি করেছিল।
তৃতীয় মহামারীটি ১৮৫০সালে চীনে উত্থিত হয়েছিল এবং ১৮৯০এর দশকে আন্তজার্তিক সীমানা অতিক্রম করেছিল। ১৮৯৪ সালে হংকং থেকে প্লেগ বহনকারী ইঁদুরগুলো ঔপনিবেশিক জাহাজগুলোতে চড়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বংশ বৃদ্ধি করছিল। এতে প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া প্রতিটি মহাদেশের বাসিন্দাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
আলেকজান্দ্রে ইয়ারসিন এবং কিতাসাতো শিবাসাবুরি একই বছর (১৮৯৪সাল) এই ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পান। ১৮৯৮ সালে পল লুইস সিমন্ড ইঁদুরের দেহে ভেক্টর বা ট্রান্সমিটার লাগাতে সক্ষম হন। এই রোগটি আন্তর্জাতিক বন্দরে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ,জনস্বাস্থ্য কর্মীরা এই রোগটির সংক্রমণ কমাতে আক্রান্ত রোগীদের সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছিলেন।
ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কঠোর পদক্ষেপের ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছিল। রোগের উৎস চীনে হওয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া বিরোধী মনোভাব দেখানো শুরু করেছিল। প্লেগ ১৯০১ সালে আর্জেনটিনা হয়ে কেপটাউনে পৌঁছালে প্রথম আক্রান্ত হয় কৃষ্ণাঙ্গ ডক ওয়ার্কাররা। দক্ষিন আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সরকার আক্রান্তদেরকে সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে জোর করে নগরীর বাইরে রেখে এসেছিল।
তৃতীয় মহামারীতে প্রায় ১.৫ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল যার বেশিরভাগ ছিল আফ্রিকা এবং ভারতের। মহামারীটির অবস্থা ১৯৫৯ সালে নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও প্লেগ কখনো পুরোপুরি নির্মুল করা সম্ভব হয়নি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বদৌলতে বহু রোগের নিরাময় হলেও নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে প্লেগ কিংবা করোনার মত মহামারীগুলোকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব। এগুলো নির্মূলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ব্যাপক হারে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।