পড়া মনে রাখার গোপন কৌশল বই পড়া মনে রাখার সহজ উপায় দ্রুত পড়া মনে রাখার সহজ ৬ টি বৈজ্ঞানিক উপায়!

পরিশ্রমই সৌভাগ্যের চাবিকাঠি" স্কুলে পড়া রচনা, ভাবসম্প্রসারণের একটি বহুল ব্যবহৃত লাইন এটি। প্রত্যেক পরীক্ষাগুলোতেও ঘুরে ফিরে এ সম্পর্কিত কিছু একটা থাকতোই। এর উদ্দেশ্য নিশ্চই মহৎ, ছাত্রদের পরিশ্রমী ও অধ্যাবসায়ি করে গড়ে তোলা। তবে আমি এই লাইনটির সাথে সম্পুর্ণভাবে একমত নই। দিনের পর দিন গাধার  মত পরিশ্রম করে কেউ সফল হতে পারে না। পরিশ্রমের সাথে বুদ্ধিমত্তার মিশ্রনে কোন কাজকে সহজ ও সুন্দরভাবে কম সময়ে করার দক্ষতা অর্জনই একজন সফল ব্যক্তির বৈশিষ্ট।

আমরা ছোটবেলা স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই পড়াশোনার করে আসছি। এরমাঝে অনেক গুলো বছর কেটেছে, মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু সে অনুপাতে আমারদের শেখার দক্ষতা খুব বেশি বাড়ে নি। দেখা যায় ঠিক মতোই পড়ছি, কিন্তু পরীক্ষার হলে বা কাজের সময় তা  আর মনে করতে পারছি না। এই সমস্যাটিতে আমরা প্রায় সবাই ভুগেছি। কোন কিছু তে সময় ব্যায়ের পরও যদি মনে রাখতে পারা না যায়, তবে তা একজন শিক্ষার্থীর মনবল ভেঙে দিতে যথেষ্ট। আজ এই একবিংশ শতাব্দিতে তে যেখানে সারা বিশ্বের তথ্য উপাত্ত আমারদের হাতের মুঠোয়, সেখানে গতানুগতিক পদ্ধতিতে পড়ালেখার ইতি টানাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

হারম্যান এভিংগাস (Hermann Ebbinghaus)

এভিংগাস ছিলেন একজন জার্মান সাইকোলোজিস্ট যিনি মূলত মানুষের স্মৃতিশক্তি সম্পর্কিত বেশ কিছু তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। তিনি  ১৮৫০ সালে জার্মানীর বর্মানে জন্মগ্রহণ করেন ও ১৯০৯ সাল জার্মানীর হেলে শহরে মারা যান। তাঁর আরেকটি পরিচয় হলো তিনি বিখ্যাত দার্শনিক জুলিয়াস এভিংগাস এর পিতা।

এভিংগাসের ভুলে যাবার গ্রাফ

এভিংগাস দীর্ঘদিন মানুষের মনে রাখা ও ভুলে যাবার উপরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি উপাত্ত তৈরি করেন। তার গবেষণা মতে, কোন কিছু পড়ার,

১ ঘন্টা পর প্রায় ৪৪% অংশ মনে থাকে।

১ দিন পর মনে থাকে মাত্র ৩০% অংশ এবং

১ সপ্তাহ পর যা গিয়ে দাঁড়ায় ২০% এ।

অর্থাৎ কোনকিছু পড়ার এক সপ্তাহ পরে ৮০% ই আমরা ভুলে যাই। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো ঠিক কিভাবে পড়লে আমরা সবচেয়ে কার্যকরী ভাবে মনে রাখতে পারব? এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। এভিংগাসের থিউরির ফলাফলের সাথে মনে রাখার বৈজ্ঞানিক তথ্য গুলোর সংমিশ্রণই হবে মনে রাখার ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি কার্যকরী পদ্ধতি। তবে চলুন, এভিংগাসের পরামর্শ জাননার আগে, মনে রাখার অন্যান্য প্রভাবক গুলো জেনে আসা যাক।

কোন কিছু মনে রাখার অন্যান্য প্রভাবক সমুহ

১) একটানা পড়বেন না বিরতি দিয়ে?

 ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের কিছু গবেষক সময়ের সাথে মানুষের মনে রাখার ক্ষমতা কমে আসার ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা করে একটি উপাত্ত তৈরি করেন। ধরুন, আপনি কোন কিছু এক ঘন্টা যাবৎ পড়ছেন, এই এক ঘন্টাকে ১০ মিনিট করে ৬ ভাগে ভাগ করলে প্রথম ১০ মিনিটে মোট ২৭ লাইন মনে রাখতে পারেন। পরের দশ মিনিটে ২১ লাইন মনে রাখতে পারেন। পরের অংশ গুলোতে যথাক্রমে ১৩, ৮, ৬ ও ৪ লাইন পড়া হয়। তাহলে মোট পড়া হয় ৭৮-৮০ লাইন। অন্যদিকে যদি আপনি প্রতি ১০ মিনিট পর ৫ মিনিট ব্রেক দিয়ে দিয়ে পড়েন, তবে মনে রাখতে পারবেন ১০৪-১০৬ লাইন। অর্থাৎ একটানা পড়ার চাইতে ছোট ছোট বিরতি দিয়ে পড়াই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

২) পোমোডারো টাইমার ম্যাথড

অনেকের কাছে মনে হতে পারে ১০ মিনিট পড়ে করে ৫ মিনিট ব্রেক কি আসলেও কাজ করবে? অনেকে আছে একবার কোন কাজে মনোযোগ আসলে আর সহজে উঠতে ভালো লাগে না। আবার উঠলে বসতে বসতে মনোযোগটা আর তেমন থাকে না। আমাদের পড়ালেখা ও মনোযোগ দেবার পদ্ধতি সবার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যদি ১০ মিনিটের পর ব্রেক নিতে না চান, তবে ২০ মিনিটের পর ৫ মিনিট ব্রেক নিতে পারেন। 

সেক্ষেত্রে আরেকটি জনপ্রিয় লার্নিং টেকনিকের সাথে এটি মিলে যায় যার নাম পমোডারো টাইমার মেথড। ২০ মিনিট কোন নির্জন জায়গায় সম্পুর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়বেন তারপর ৫ মিনিট বিরতি নিবেন। আবার ২০ মিনিট পড়বেন ৫ মিনিট বিরতি দেবেন। এভাবে ৪ টি সার্কেল শেষ করলে একটে বড় ২০ মিনিটের বিরতি নেবেন। এতে করে দেখা যায়, পড়া বা কাজ করার গতি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ পদ্ধতি ভালোভাবে ব্যবহারের জন্য একটা এলার্ম ঘড়ি সবচেয়ে কার্যকরী। প্লে স্টোরে পোমোডারো টাইমার এপ পাওয়া যায়, তবে পড়ার সময় ফোন আসেপাশে না রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

৩) বিরতিতে কি করবেন?

দেখা যাচ্ছে যে পদ্ধতিই অবলম্বন করেন না কেন, পড়ার মাঝে বিরতি দিতেই হবে। এই বিরতির সময়ে প্রশান্তিময় কিছু করুন। যেমন চোখ বুঁজে একটি পছন্দের গান শুনুন। হেঁটে আসুন, ওয়াশরুম সেরে আসুন। হালকা ব্যায়াম করুন। একটু হালকা খাবার ও পানি অথবা চা পান করুন। সোস্যাল মিডিয়াতে না ঢোকার চেষ্টা করবেন। অনেক সময় দেখা যায়, এ মেসেজ ও মেসেজ করতে করতে দিনটাই হুট করে পার হয়ে যায়। 

৪) মনে রাখার ক্ষেত্রে ঘুমের ভুমিকা

পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মনে রাখার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘুম আমাদের পড়া তথ্যগুলো শর্ট টার্ম ম্যামরি থেকে লং টার্ম ম্যামরিতে স্থানান্তর করে। দেখা গেছে একজন শিক্ষার্থীর জন্য ৭ ঘন্টা ঘুমই সবচাইতে ভালো কাজ করে।

ঘুমের পরিমানের থেকে ঘুমের সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেছে রাত নটা-সাড়ে নটা থেকে চারটা-সাড়ে চারটা হলো ঘুমানোর জন্য সবচাইতে সঠিক সময়। 

কঠিন কিছু মনে রাখার ক্ষেত্রেও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঘুম। ঘুম থেকে ওঠার পর ভালো হয় যেটা আপনার কাছে সবচাইতে কঠিন মনে হয় সেই বিষয়টি পড়া শুরু করা। যত বেশি সময় পড়বেন আস্তে আস্তে সহজ টপিকে চলে আসা একটি অত্যান্ত কার্যকরী পদ্ধতি। ক্লান্ত মস্তিষ্ক কঠিন পড়া পড়ার সময় এমন একটি ইলিউশান তৈরি করে যাতে আপনার মনে হবে পড়া তো হয়ে গেছে, কিন্তু আসলে মস্তিষ্ক তথ্যটি শর্ট টার্ম ম্যামরিতে রেখে এই ভ্রমের সৃষ্টি করে।

৫) মনে রাখতে খাবারের ভূমিকা

কিছু খাবার আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা অনেকগুন বাড়িয়ে তোলে। ছাত্রজীবনে নিন্মক্ত খাবার গুলো খাদ্যাভাসে রাখা আপনার ফলাফলে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

ফান ফ্যাক্ট: একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা পরীক্ষার হলে পানি পান করে তারা অন্তত ২% বেশি মার্ক পায়।

 

যে খাবার খেলে বাড়বে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (পর্ব - ১)

 

৬) মনে রাখতে রক্ত সঞ্চালনের ভুমিকা

শুষ্ঠভাবে রক্ত সঞ্চালন ব্রেইনকে সঠিক ভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। এক জায়গায় অনেক্ষন বসে পড়বেন না। বিরতির সময় হেঁটে আসুন ও হালকা স্ট্রেচিং করুন। প্রার্থনা মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। পড়ালেখার ফাঁকে নামাজ পড়লে মন বেশ প্রশান্ত হয় সাথে রক্ত সঞ্চালনও সঠিকভাবে হয়ে থাকে। সেই সাথে শারিরীক পরিশ্রম এরও প্রয়োজন রয়েছে। ঘরে থেকে ব্যায়াম করা যেতে পারে। সারাদিন একটানা বসে না থেকে একটু সময় করে হালকা ঘুমিয়ে নেওয়া ও বাইরে থেকে হেঁটে আসাও নতুন করে পড়ার শক্তি যোগাবে।

ফান ফ্যাক্ট: যে স্থানে সবুজ পরিবেশ দেখা যায় সেখানে পড়া আড়াইগুন পর্যন্ত বেশি মনে রাখা যায়।

এভিংগাসের পরামর্শ ও মনে রাখার প্রভাবক গুলোর সংযুক্তি

এভিংগাস এর মতে, 

এতে করে কম সময়ে ও কম পরিশ্রমে অনেক কিছু একসাথে মনে রাখা সম্ভব হবে। 

এই পদ্ধতি গুলো মেনে চলে আপনি আপনার পড়ালেখার গতি প্রায় দ্বিগুন বাড়িয়ে ফেলতে পারেন আশা করা যায়।

 

পরিশেষে বলব, যতই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি থাকুক, উপভোগ করে পড়া হলো একটি সার্বজনীন ও সর্বউৎকৃষ্ট উপায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি হয় না বললেই চলে। তবে পড়া যেটাই হোক নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে পড়তে থাকলে এটি একটি তুলনামূলক উপভোগ্য খেলার মত হয়ে দাঁড়ায়। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আপনার সফলতা কামনা করে প্রবন্ধটির ইতি টানছি। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু ছড়িয়ে দিতে পারেন।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]