শিশুর মানসিক বিকাশঃ পিতামাতা হিসেবে আপনার করনীয় ও বর্জনীয় শৈশবে বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রারম্ভিক যত্ন |

১৩ বছরের শিশু ফাহিম, প্রচন্ড চঞ্চল, পড়ালেখায় ভীষন অমনোযোগী, কোন কাজই শেষ করতে পারে না। ফলাফল, স্কুলে খারাপ রেজাল্ট, শিক্ষকদের অভিযোগ আর পিতামাতার কঠোর অবস্থান। দুঃখের বিষয় হল ফাহিমের উচ্চ শিক্ষিত এবং স্বনামধন্য ব্যাংকে চাকুরিরত বাবা-মা কখনো অনুধাবনই করতে পারেননি যে তাদের সন্তানের অতিরিক্ত চঞ্চলতা, কথা না শোনা, অমনোযোগীতা এক ধরনের আচরণগত সমস্যা (এডিএইচডি) এবং সময়মত এর চিকিৎসা হওয়া জরুরি। 

এই সমস্যা শুধু ফাহিমের পিতামাতারই নয় বরং আমাদের দেশের সিংহভাগ পিতামাতারই রয়েছে। তারা শিশুর জন্মের পর থেকে শুধুমাত্র শারীরিক বিকাশের প্রতি নজর দেন কিন্তু সন্তানের মানসিক বিকাশের মত গুরুত্বপূর্ন বিষয়টিকে বেমালুম ভুলে যান। শিশুর চমৎকার ব্যক্তিত্ব, সততা, উন্নত আচার আচরন সব কিছুই নির্ভর করে ছোটবেলায় পিতামাতার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার উপর। 

ভালো প্যারেন্টিং কেন গুরুত্বপূর্ণ

২০১৩ সালে নিজ গৃহে পিতামাতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা কিশোরী ঐশীর কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। ২০১৭ সালের ৫ জুন বিজ্ঞ হাইকোর্ট ঐশীর মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজা শোনান। এই রায় প্রদানকালে বিজ্ঞবিচারক মন্ডলী ঐশীর লালনপালনে তার পিতামাতার ভূমিকার প্রতিও প্রশ্ন তোলেন। 

তারা বলেন যে, সন্তানের জন্য বাবা-মা এবং অবিভাবকই প্রথম শিক্ষক এবং সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা, পর্যাপ্ত সময় দেয়া এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা তাদের দায়িত্ব ছিল। এই ঐতিহাসিক রায় থেকে ভালো প্যারেন্টিং এর গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়।

সন্তানের মানসিক বিকাশ, নৈতিক শিক্ষা, সততার জ্ঞান ইত্যাদির বেশিরভাগটাই নির্ভর করে পিতামাতার প্রদত্ত শিক্ষার উপর তাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের অনৈতিক আচরনের দায় অনেকটায় পিতামাতার উপরেও বর্তায়।   

ভালো প্যারেন্টিং শিশুর  ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের ধরন, নৈতিকতা, সততা, পছন্দ এবং সামগ্রিক আচরণের ভিত্তি স্থাপন করে এবং তাদের ভবিষ্যতে সৎ, ভারসাম্যপূর্ন ও সুন্দর জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। 

ভালো প্যারেন্টিং এর গুরুত্ব নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, এখন চলুন এর সুবিধাগুলো দেখি-

১) জন্ম থেকে যে সব শিশুরা তাদের পিতামাতার সাথে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে তারা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে সহজেই অন্যদের সাথে সুখী এবং আনন্দময় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

২) যে সব শিশুরা তাদের পিতামাতার সাথে নিরাপদ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বড় হয় তারা মানসিক চাপের মধ্যে এবং কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। 

৩) ভালো প্যারেন্টিং শিশুর মানসিক, ভাষাগত এবং আবেগ প্রবনতার সঠিক বিকাশ ঘটায়।  

৪) ভালো প্যারেন্টিং শিশুকে আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করে। 

৫) সন্তান ও পিতামাতার মধ্যে স্বাস্থ্যকর, সাবলীল ও বন্ধুত্বপূর্ন সম্পৃক্ততা সন্তানের সামাজিক ও শিক্ষাগত দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করে। 

৬) পিতামাতা শিশুর সাথে নিরাপদ সংযোগ স্থাপন করতে পারলে উভয়ের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক সহজে গড়ে ওঠে এবং শিশুরা কঠিন সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে। 

 

আরও পড়ুনঃ সন্তান হতাশাগ্রস্ত হবার ৮ টি লক্ষণ ও দ্রুত মুক্তির উপায়!

 

শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে পিতামাতার করনীয় 

শিশুর শারীরিক বিকাশের মত মানসিক বিকাশেও পিতামাতার ভুমিকাই সবচেয়ে বেশী। তবে স্কুল, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব, এবং স্কুলের ভুমিকাও অস্বীকার করা যায় না। মহামারীর এই সময়ে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরদের মানসিক বিপর্যয় একটা মারাত্বক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর এর ফলস্বরুপ অল্পবয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

জুলাই ২০২১ সালের তথ্যমতে করোনাকালীন ১৫ মাসে ১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে যেটা আগের বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুন বেশী। মর্মান্তিক বিষয় হল এই ১৫১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৩ জনই ছিল স্কুল পড়ুয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারন ছিল তাদের একাকিত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও সামাজিক দুরুত্ব বাধ্যতামূলক করায় তারা একা হয়ে পড়েছিল। এর অর্থ হল এইসব শিশুকিশোরদের পিতামাতারা সন্তানদের একাকিত্ব দূর করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কিংবা বলা ভালো যে তদের সন্তান যে একাকিত্বে ভুগছে সেটা তারা অনুধাবনই করতে পারেন নি। 

করোনাকালীন আত্মহত্যার এই ভয়ংকর ও মর্মান্তিক চিত্র মনঃচিকিৎসক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। এবং ঘুরে ফিরে সিংহ ভাগ দায়িত্ব পিতামাতার ঘাড়েই পড়েছে। তবে এটাও সত্যি যে গুড প্যারেন্টিং সন্তান ও পিতামাতার মধ্যে একটি নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি করে তা সন্তানদের যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলতে পারে। চলুন দেখি শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে পিতামাতার করনীয় কাজগুলো কি কি-

১) নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন

হ্যা, আপনি যদি আপনার সন্তানকে মানসিক ভাবে সুস্থ্য দেখতে চান তবে আপনার নিজেরই মানসিকভাবে সুস্থ্য হতে হবে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সবার আগে তার জন্য স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে আর এর জন্য আপনাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে।

২) সম্পর্কে বিস্বস্ততা আনুন

পিতামাতা হিসেবে নিঃসন্দেহে আপনিই হলেন আপনার সন্তানের সবচেয়ে নির্ভরতার স্থান। এই বিষয়টি আপনার সন্তানকে অনুধাবন করতে দিন। আপনার বিস্বস্ততা আপনার সন্তানকে সাহায্য করবে আপনার সামনে নিজেকে মেলে ধরতে। 

৩) শিশুসুলভ আচরন মেনে নিন

একটা কথা মাথায় রাখুন, শিশু শিশুর মতই আচরন করবে, তার কাছ থেকে আপনি বড়দের মত আচরন আশা করতে পারেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে একটি শিশুর মস্তিস্ক  পরিপূর্ন বিকশিত হতে প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। তাই তাদের অপরিণত আচরনে ধৈর্য্যহারা হলে চলবে না। তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে হবে এবং তা থেকে সম্ভাব্য ক্ষতির ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। 

৪) যথাযথ সম্মান প্রদান করতে হবে

মনে রাখতে হবে যে, শিশুদের আত্মসম্মানবোধ অনেক প্রবল হয় তাই তাদের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে কিছু বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভুল বা অসফলতাকে উপহাস করা যাবে না। বরং উৎসাহ দিতে হবে যেন আত্মবিশ্বাস না কমে যায়।

৫) শিশুর বেড়ে উঠার ধাপগুলো জানুন

জন্ম থেকে শুরু করে শিশুরা বিভিন্ন ধাপে বেড়ে ওঠে। এই ধাপগুলো সম্পর্কে জানুন এবং সে অনুযায়ী শিশুর সাথে আচরন করুন। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে শিশুর প্রতি বেশী সংবেদনশীল হোন।

৬) শিশুকে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতে দিন

আপনার অভিমত, ইচ্ছা সবসময় শিশুর উপর চাপিয়ে দিবেন না। তাদের নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতে দিন, সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে দিন। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

৭) স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন

শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস খুব কার্যকর। যেমন প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য শরীর চর্চা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো এবং জেগে উঠা, প্রতিবেশির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ন আচরণ ইত্যাদি আপনার সন্তানের মানসিক বিকাশে বিশাল ভুমিকা রাখবে।

৮) প্রয়োজনে মনঃচিকিৎসকের সাহায্য নিন

আমাদের দেশে মনঃচিকিৎসকের স্বরনাপন্ন হওয়াকে অনেকবেশী নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। মানুষ কি বলবে এই চিন্তাতে অনেক পিতামাতাই সন্তানের মানসিক ইস্যুগুলকে দিনের পর দিন উপেক্ষা করে চলে। এর ফলে শিশুর মানসিক সমস্যার তেমন বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান হয় না যার ফল অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়। তাই প্রয়োজন হলে অবশ্যই মনঃচিকিৎসকের সাহায্য নিন। 

৯) শিশুকে প্রচুর সময় দিন

দিনশেষে সন্তান আপনার তাই দায়িত্বও আপনারই। আমাদের দেশে চাকুরিজীবী পিতা-মাতারা তাদের সন্তানের দায়িত্ব দাদা-দাদী, নানা-নানী অথবা কাজের লোকের হাতে ন্যাস্ত করে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেন। কিন্তু সন্তানের প্রকৃত মানসিক চাহিদার খেয়াল রাখেন না। এভাবে সন্তানের সাথে বিশাল দুরুত্বের সৃষ্টি হয়। সন্তানকে প্রচুর সময় দিন, তাকে বোঝান যে আপনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন আপনার সব মনোযোগ আপনার সন্তানের প্রতিই আছে। 

 

আরও পড়ুনঃ সন্তান লালন পালনে মতবিরোধ! বাবা-মা কি করবেন?

 

বেশিরভাগ পিতামাতা যে ভুল গুলো করেন

এ কথা সত্যি যে সন্তান যেমন চোর বা খুনি হয়ে জন্মগ্রহন করে না, ঠিক তেমনি পিতামাতাও প্যারেন্টিং শিখে জন্মগ্রহন করে না। একটা শিশুর জন্মের সাথে সাথে দু-জন পিতামাতারও জন্ম হয়। ফলে সন্তান লালনপালনে বেশীরভাগ পিতামাতা সচরাচর যে ভুলগুলো করেন সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরি। 

১) সন্তানকে অতিরিক্ত চোখে চোখে রাখা

আপনার সন্তানকে অতিরিক্ত চোখে চোখে রাখলে সে নিজের জগত তৈরি করতে পারবে না। এতে তার আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে।

২) অন্যের সাথে তুলনা করা

আমাদের দেশের অধিকাংশ পিতামাতাই তাদের সন্তানদের অন্য শিশুদের সাথে তুলনা করেন। এমনকি একাধিক সন্তানের মধ্যেও গুনগত তুলনা করতে ছাড়েন না। এতে সন্তানের মনে হিংসাত্মক মনোভাবের জন্ম নেয়।

৩) পিতামাতা হিসেবে ভুল স্বীকার না করা

অনেক পিতামাতাই নিজদের করা ভুল স্বীকার করতে চান না, এতে সন্তানরাও নিজের ভুল স্বীকার অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। 

৪) অতিরিক্ত প্রশংসা বা অতিরক্ত শাসন করা

আপনি অতিরিক্ত প্রশংসা বা অতিরক্ত শাসন যেটাই করুন না কেন, আপনার সন্তানের উপর অবশ্যই বিরুপ প্রভাব ফেলবে।

৫) সন্তানকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া

আপনার মিথ্যা আশ্বাস আপনার সন্তানকে মিথ্যাবাদী এবং আপনার প্রতি বিশ্বাসহীন করে তুলবে।

৬) দাম্পত্যে টানাপোড়েন 

অনেক পিতামাতাই এটা বোঝে না যে, তাদের দাম্পত্য কলহ তাদের সন্তানের মানসিক বিকাশকে মারাত্বকভাবে ব্যহত করে। এক্ষেত্রে সন্তানেরা পারিবারিক সম্পর্কের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।

৭) শিশুকে অতিরিক্ত ভয় দেখানো

শিশুকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য অনেক পিতামাতাই অতিরক্ত ভয় দেখায় যেমন, মারের ভয়, স্কুলে খারাপ রেজাল্টের ভয় এমনকি ভুতের ভয়। এতে শিশুরা ছোট থেকেই মানসিকভাবে দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে না।

৮) অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা

অনেক পিতামাতাই সন্তানকে প্রতিযোগিতার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ দিয়ে থাকেন। তাদের সারাদিনের সময়সুচি এমনভাবে সাজান যেখানে খেলাধুলা বা রিল্যাক্সের তেমন সময় থাকে না। এতে শিশুদের পড়ালেখার কিছুটা উন্নতি হলেও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

 

সন্তানকে ভালোবাসা মানে বস্তুগত চাহিদা মেটানো বা অতিরিক্ত খাবার প্রদান করা নয়। মনে রাখতে হবে যে বস্তুগত কিছু দিয়ে সন্তানকে সঙ্গ না দেয়ার ঘাটতি কখনোই পূরন হয় না। সন্তানকে শুধু আপনার সন্তান করে না রেখে সুনাগরিক করে গড়ে তোলা আপনারই দায়িত্ব। তাই তার শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশেরও বিশেষ যত্ন নিন। মনে রাখবেন শিশু বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়েও পারিবারীক শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]