আপনার ছোট্ট খুদেটি কি খুব কান্নাকাটি করে শিশুদের অতিরিক্ত চিৎকার করার ৯টি কারণ

একটি নবজাতক শিশু ভূমিষ্ট হবার পর প্রথম যে কাজটি করে তা হল কেঁদে ওঠা। পরবর্তীতে কথা বলতে শেখার আগে পর্যন্ত এই কান্নাই হয় তার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। তাই শিশুর কান্না খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কারণ এই কান্নার মাধ্যমে শিশুটি বোঝাতে চায় যে তার কি প্রয়োজন।

কখনও কখনও এই কান্না আমাদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত মনে হতে পারে। আবার কখনও মনে হতে পারে যে আপনার শিশু অকারণেই কাঁদছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা কখনই অকারণে চিৎকার বা কান্নাকাটি করে না। তাই যখন আপনার কাছে মনে হচ্ছে যে আপনার শিশু সম্পূর্ণ অকারণেই কান্না করছে, তখনও তাদের কান্নার কোন না কোন কারণ আছে যা আপনি হয়ত ধরতে পারছেন না। তাই আসুন জেনে নেয়া যাক শিশুরা ঠিক কি কি কারণে চিৎকার করতে পারে এবং তখন তাকে কিভাবে শান্ত করা যায়।

শিশুর অতিরিক্ত চিৎকার করার কারণসমূহ ও তার প্রতিকার

১. ক্ষুধা

শিশুর কান্নাকাটির প্রথম এবং প্রধান কারণ হল ক্ষুধা। শিশুদের যখন ক্ষুধা অনুভূত হয় তখন তারা আঙ্গুল চুষতে থাকে, হাত মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, বা চিৎকার জুড়ে দেয়। শিশুদের পাকস্থলির আকার থাকে খুবই ছোট। ওখানে খুব বেশী পরিমাণ খাবার জমিয়ে রাখতে পারে না। তাই ওদের ঘন ঘন ক্ষুধা লাগে। বিশেষত যেসব শিশু অতিরিক্ত হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে খেলা করে তাদের ক্ষুধার পুনরাবৃত্তি ঘটে অন্যান্যদের চেয়ে দ্রুত। তাই পেট ভরে খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যদি আবার আপনার শিশু কান্নাকাটি শুরু করে তার মানে এই না যে ওর ক্ষুধা লাগতে পারে না। বরং দেখুন ও খেতে চাচ্ছে কিনা। তাহলে খেতে দিলেই কান্না নিমিষে থেমে যাবে।

২. ভেজা ডায়াপার/কাঁথা

আপনার শিশুকে কাঁথা বা ডায়াপার যেটাই পরিয়ে রাখুন না কেন, মাঝে মাঝেই খেয়াল করতে হবে যে ওটা ভিজে গিয়েছে কিনা। কাঁথার ক্ষেত্রে এটা চেক করা খুব সহজ হলেও ডায়াপারের ক্ষেত্রে এটা ভুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। তাই সাধারণ নিয়ম হল ব্র্যান্ডভেদে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা অন্তর ডায়াপার বদলে দেয়া। তবে আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা থাকলে ২ ঘণ্টার আগেও ডায়াপার বদলানো লাগতে পারে কারণ তখন হিসু তুলনামূলক বেশীবার হয়। আবার কখনও ডায়াপার বদলে দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশু কেঁদে উঠতে পারে, তখন খেয়াল করে দেখতে হবে তিনি হাগু করেছেন কিনা।

৩. ঘুম এবং ক্লান্তি

আপনার শিশুর যখন ঘুম আসবে তখন সে কান্নাকাটি করতে পারে। তখন সাধারণত বিছানায় শুইয়ে বুকের উপর আলতো করে একটু থাবা দিতে থাকলে বা মাথার বালিশটা ধরে নির্দিষ্ট মাত্রায় নাড়াতে থাকলে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে। তবে অনেকসময় ক্লান্তির কারনেও বাচ্চারা চিৎকার করতে পারে। কারণ অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাচ্চাদের ঘুম আসে না। তখন তারা এটাও বুঝতে পারে না যে তাদের কি করা উচিৎ। তাই তারা চিৎকার করে তাদের অস্বস্তি জানান দেয়া শুরু করে। এসময় তাদেরকে একটু কোলে নিয়ে হাঁটলে বা দুলুনি দিলে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। যদি শুধু দুলুনিতে কাজ না হয় তাহলে মৃদু স্বরে ঘুমপাড়ানি গান গাওয়া যেতে পারে।

৪. অতিরিক্ত অথবা কম উদ্দীপনা

শিশুরা সাধারণত আশেপাশের পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপক যেমন আলো, শব্দ, স্পর্শ ইত্যাদির মাধ্যমে শেখে। তবে কখনও কখনও এই উদ্দীপনা তাদের কাছে অতিরিক্ত মনে হতে পারে। তখন তাদের মস্তিষ্ক একসাথে এতোকিছু শনাক্ত করতে পারে না এবং তারা চিৎকার অথবা কান্না করা শুরু করে। আবার এর উল্টোটাও ঘটতে দেখা যায়। যেমন বেশী অ্যাকটিভ বাচ্চারা ঘরে তেমন একটা বসে থাকতে চায় না। তারা চায় বাইরে বের হতে, নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে। তাই তারা কান্নাকাটি করে বাইরে যাবার জন্য। এমন হলে তাদেরকে কিছুটা সময় বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলে তারা শান্ত হবে। আর যদি উদ্দীপনা বেশী হয়ে যায় তখন বাবুকে একটা শান্ত পরিবেশে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে ঘরের আলো কমিয়ে দিতে হবে এবং জানালা-দরজা বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাইরের কোন কর্কশ ধ্বনি ঘরে প্রবেশ না করে। এসময় বাচ্চার সাথে মৃদু স্বরে কথা বলা যেতে পারে।

৫. অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরম

আমাদের দেশে খুব সাধারণ একটা চিত্র হচ্ছে শিশুকে সবসময় কাঁথায় মুড়ে রাখা। বিশেষ করে নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বেশী ঘটতে দেখা যায়। আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা থাকলে এতে কোন সমস্যা হয় না। তবে যদি আবহাওয়া হালকা গরম থাকে তাহলে কাঁথার কারণে শিশুর অতিরিক্ত গরম লাগতে পারে। তখন শিশু কান্নাকাটি শুরু করবে। আবার কিছু কিছু শিশুর শরীরে মেটাবলিজম হয় বেশী। এমন শিশুদের ঘাড়, মাথার পিছনভাগ, এবং পিঠ সবসময় বেশী গরম থাকে। উপরন্তু ফাইবার তুলায় বানানো বালিশের কারনেও শিশুর গরম লাগতে পারে। তাই মেটাবলিজম যাদের বেশী তাদের মাঝে মাঝেই শোয়ার স্থান পরিবর্তন করে দিতে হবে এবং কাত করে শুইয়ে দিতে হবে যাতে পিঠে বাতাস লাগতে পারে। আর চেষ্টা করতে হবে শিমুল তুলা অথবা জুট তুলার বালিশ ব্যাবহার করার। একইভাবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশুর অতিরিক্ত শীত না করে। এজন্য কাঁথা, কম্বল, বা ক্ষেত্রবিশেষে রুম হিটার ব্যাবহার করতে হবে।

৬. গ্যাস

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে গ্যাস খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। শিশু যখন মায়ের দুধ অথবা ফীডার খায় তখন না চাইতেও কিছুটা বাতাস গিলে ফেলে। এই বাতাস পেটে যেয়ে ওদের অস্বস্তি তৈরি করে। এজন্য খাবার পর বাচ্চাকে খাড়াভাবে কোলে নিয়ে পিঠে আলতো করে চাপড় দিয়ে ঢেঁকুর তুলিয়ে দিতে হবে। অনেকসময় খাওয়ানোর সাথে সাথে ঢেঁকুর তোলাবার চেষ্টা করলে ঢেঁকুর উঠতে চায় না। তবু খাওয়ানোর পর মিনিটখানেক শিশুকে খাড়া করে রাখা ভালো। তবে বিপত্তি বাঁধে যখন ঘুমের মধ্যে খাওয়ানো হয়। তখন বাচ্চা খেয়ে নিলেও ওকে ঘুম ভাঙিয়ে খাড়া করে রাখলে বরং কান্নাকাটি শুরু করতে পারে। এজন্য শিশু গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডাঃ রানা কুমার বিশ্বাস বলছেন, “ঘুমের মধ্যে খাবার খাওয়ালে শিশুকে কাত করে শুইয়ে দিয়ে পিঠে আলতো করে চাপড় দিন। তাতে বাচ্চার গ্যাস বেরিয়ে যাবে এবং ভালো ঘুম হবে।”

৭. আদর

শিশুরা সাধারণত কখনও একা থাকতে চায় না। জন্মাবার পর থেকে সে মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে মা-বাবার সান্নিধ্যে থাকতেই বেশী পছন্দ করে। তাই শিশু যদি বেশ কিছু সময় বাবামায়ের সান্নিধ্য না পায় তখন চিৎকার করতে পারে। এমতাবস্থায় শিশুকে তার বাবা অথবা মায়ের কোলে নিয়ে আদর করতে হবে।

৮. কলিক

আপনার শিশুর যদি কাঁদতে কাঁদতে চেহারা লাল হয়ে যায়, তার যদি হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকে, পা ভাঁজ করে পেটের কাছে নিয়ে আসে, এবং কান্নার সময় পিঠ উঁচু করে দেয়, তার মানে হচ্ছে ও কলিক এ ভুগছে। এই কলিক কেন হয় সে বিষয়ে শিশুবিশেষজ্ঞদের হাতে তেমন কোন শক্ত কারণ নেই। কেউ কেউ মনে করেন যে এটা হয়ত কোন অ্যালার্জি, কোষ্ঠকাঠিন্য, বা রিফ্লাক্সের সাথে জড়িত। আবার কারও মতে এটা স্রেফ শিশুদের একটা স্বাভাবিক ডেভেলপমেন্টাল স্টেজ। কারণ যাই হোক, কলিক এর কারণে বাচ্চারা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে পারে যা একজন নতুন মায়ের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। এক্ষেত্রে বাচ্চাকে কোলে উঠিয়ে দুলুনি দেয়া, কুসুম গরম পানিতে গোসল করিয়ে দেয়া, মৃদু স্বরে গান বাজানো, বা ওর মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া বেশ কাজে আসতে পারে।

৯. অসুস্থতা

বাচ্চারা যদি অসুস্থ বোধ করে সেটা জানান দেয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কান্না বা চিৎকার। এজন্য বাচ্চা কান্না শুরু করলে যদি অন্য কোন কারণ খুঁজে না পান তখন খেয়াল করতে হবে বাচ্চা অসুস্থ কিনা। এজন্য প্রথমেই বাচ্চার তাপমাত্রা পরীক্ষা করুন। তাপমাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর বেশী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বাচ্চাদের অন্যান্য অসুস্থতার মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়ের কামড়ে অ্যালার্জি, খাবারে অ্যালার্জি, স্টমাক ইনফেকশন, অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি), ইত্যাদি।

আপনার শিশুর অ্যালার্জি হয়েছে কিনা সেটা বোঝার জন্য ওর শরীরে র‍্যাশ উঠেছে কিনা খেয়াল করুন। স্টমাক ইনফেকশন বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে বাচ্চার হাগুর রঙ খেয়াল করা। রঙ যদি কালো, গাঢ় খয়েরি, বা গাঢ় সবুজ রঙের হয় তাহলে বুঝতে হবে ইনফেকশন হয়েছে। 

তবে এএসডি সম্পর্কে বোঝার জন্য বাবা-মাকে একটু বেশী যত্নশীল হতে হবে। খুব খেয়াল করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে শিশু স্বাভাবিক খেলাধুলা বা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে কিনা, কোন শব্দ হলে তার উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে কিনা, কোন জিনিস হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে কিনা, হাসছে কিনা, ইত্যাদি। এগুলোর অনুপস্থিতি দেখলে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 

মনে রাখবেন, শিশুদের ক্ষেত্রে রোগ খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এতে ঘাবড়ে না গিয়ে বরং ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিকারের চেষ্টা করুন, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।

কান্নাকাটি বা চিৎকার হচ্ছে শিশুদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তাই ওদের চিৎকারে বিরক্ত না হয়ে বরং সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিন। শিশুর প্রয়োজনের দিকে মনোযোগ দিন। ওদেরকে বেশী বেশী করে বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনার আদর, ভালোবাসা, আর প্রচেষ্টায় দেখবেন ওদের এই কান্নাকাটির অভ্যাস আস্তে আস্তে কমে আসবে।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]