সদ্যজাত সন্তানের মধ্যে এতটুকু অস্বাভাবিকতা দেখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা বাবা অস্থির হয়ে পড়েন। একটু বেশি মলমূত্র ত্যাগ করলে, কান্নাকাটি করলে, বমি করলেই মা বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়। তেমনিভাবে, বাচ্চার গ্যাসের সমস্যা দেখা দিলেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেক বাবা মা।
নবজাতকের ক্ষেত্রে গ্যাসের সমস্যা হওয়া একটি সাধারণ বিষয়। খাবারের সাথে বেশি পরিমাণে বাতাস গিলে ফেলার কারণেই সাধারণত গ্যাসের সমস্যা হয়ে থাকে। তবু অনেক সময় বাচ্চা ভালো অনুভব করেনা, কান্নাকাটি করে। আজ আমরা বাচ্চার গ্যাসের সমস্যার কারণ, প্রতিকার ও আরও কিছু তথ্য আপনাদের জানানোর চেষ্টা করবো।
যদিও গ্যাস হওয়া বাচ্চাদের একটি সাধারণ সমস্যা, তারপরেও বাচ্চাদের জন্য এটি স্বস্তিদায়ক নয়, কারণ গ্যাস খাদ্যনালীতে গিয়ে হজমশক্তিকে নষ্ট করে দেয় এবং পেট ফুলে যায়। ফলে তারা অস্থির হয়ে থাকে, কখনো কখনো ঘুমাতেও পারেনা। বিভিন্ন কারণে বাচ্চাদের গ্যাসের সমস্যা হতে পারে-
অতিরিক্ত বাতাস খেয়ে ফেলা
নবজাতকের গ্যাস হওয়ার সবচেয়ে সাধারন কারণটি হলো কান্না করার সময় অথবা খাওয়ার সময় অতিরিক্ত বাতাস খেয়ে ফেলা। সাধারণত খুব দ্রুত বা আস্তে খেলে এই সমস্যা দেখা দেয়। অনেক বাচ্চা ঘুমানোর সময় মুখ হাঁ করে রাখে। এতে বাতাস শ্বাসনালীর সাথে সাথে খাদ্যনালীতেও প্রবেশ করে, যা থেকে পরবর্তীতে গ্যাসের সৃষ্টি হয়।
অপরিপক্ক পাচনতন্ত্র
সদ্যজাত শিশুদের পাচনতন্ত্র মোটেও পরিপক্ব নয়। শিশু যত বড় হয় ধীরে ধীরে পাচনতন্ত্রসহ শরীরের অন্যান্য তন্ত্রগুলোও সুগঠিত হয়। এই অপরিপক্ক পাচনতন্ত্র সব খাদ্য ভালোমতো হজম করতে পারেনা, যার কারণে গ্যাস সৃষ্টি হয়।
ফরমুলা মিল্ক
অনেক সময় বাচ্চাদের ফরমুলা মিল্ক খাওয়ানোর কারণেও গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে। বাচ্চাদের ফরমুলা মিল্ক খাওয়ানো সবসময় নিরুৎসাহিত করা হয়, কারণ এতে কিছু না কিছু কেমিক্যাল অবশ্যই থাকে। ফরমুলা মিল্কের কোনো উপাদানে যদি বাচ্চার হাইপার সেন্সিটিভিটি বা অ্যালার্জি থাকে, সেক্ষেত্রেও গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
ফিডারে ফেনা থাকলে
বাচ্চাকে ফরমুলা দুধ খাওয়ানোর সময় ফিডার বা বোতল বেশি ঝাঁকালে তাতে ফেনে তৈরি হয় যা খাওয়ালে পেটে গ্যাস হতে পারে। তাই ফরমুলা দুধ প্রস্তুত করার করার পর কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। তারপর ফেনা কমলে খাওয়াতে হবে।
চুষনি বা প্যাসিফায়ার
অনেক সময় বাচ্চাদের মুখে প্যাসিফায়ার দিয়ে রাখেন মা বাবা। এই প্যাসিফায়ার চুষতে থাকার সময় অতিরিক্ত বাতাস গিলে নেয় শিশু, এতে করে গ্যাস সৃষ্টি হয়।
নির্দিষ্ট কিছু খাবার খাওয়া
বাচ্চার বয়স ৬ মাস হলে মায়ের দুধ এবং ফরমুলা মিল্ক এর পাশাপাশি বাড়তি খাবার দেওয়া হয় যাতে থাকে বিভিন্ন ধরণের সবজি। তবে মটরশুটি, ব্রকলি এবং ফুলকপির মতো সবজিগুলি শিশুর পেটে গ্যাস সৃষ্টি করতে পারে।
জুস পান করা
জুসে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে, যা গ্যাস, এমনকি ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। জুস পান করলে শিশুর পেট পূর্ণভাব থাকে যা তাকে পুষ্টিকর খাবার খেতে বাঁধা দেয়। এছাড়াও, এটি দাঁতকে চিনিযুক্ত করে ক্ষতিসাধন করে। যদিও শিশুর বয়স ১২ মাস না হওয়া পর্যন্ত জুস দেওয়া উচিৎ নয়।
পর্যাপ্ত পানি পান না করা
পানি পান করলে গ্যাসের সমস্যা দূর হবে না। কিন্তু তরল খাওয়ার পরিমাণ বাড়ালে শিশু কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে পারে, যা প্রায়ই সময় গ্যাস এবং পেটে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যেভাবে বুঝবেন শিশুর গ্যাস হয়েছেনবজাতকের গ্যাস হওয়া যদিও স্বাভাবিক, তবে স্বাভাবিক এর থেকে বেশি গ্যাস হলে কিছু লক্ষ্মণ দেখা যায়, যেমন:
আপনার বাচ্চা অনেক কান্না করবে। এটা বেশিরভাগ বাচ্চার ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। গ্যাসের সমস্যা হলে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা, এমনকি সারাদিনও কাঁদতে পারে। এতে চিন্তার কিছু নেই, তবে এই সমস্যা যদি প্রতিদিনই হতে থাকে এবং না কমে, তাহলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
আপনার বাচ্চাকে বেশিরভাগ সময় বিরক্ত মনে হবে। বাচ্চা হাসতে ও খেলতে পছন্দ করবে না। সবসময় অস্বস্তি নিয়ে থাকবে। এটিও অতিরিক্ত গ্যাস সৃষ্টি হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
বাচ্চা ঠিকমতো খেতে চাইবে না, ঘুমাতে পারবে না। বাচ্চাদের অনেক রকম সমস্যার কারণে খাওয়া ও ঘুমের বিঘ্ন ঘটে, তারমধ্যে গ্যাসের সমস্যা অন্যতম।
বাচ্চা কাঁদলে তার চোখমুখ লাল হয়ে যাবে। বাচ্চাকে দেখলে আপনার মনেহবে সে কোনো কারণে ব্যাথা পাচ্ছে বা তার খারাপ লাগছে।
নবজাতকের অতিরিক্ত গ্যাসের সমস্যা দূর করার জন্য কিছু ঘরোয়া উপায় বেশ কাজে দেয়। এসব টোটকা ব্যাবহার করে দেখতে পারেন, এতে বাচ্চা অনেকটা আরাম পাবে।
বাচ্চাকে সোজা করে শুইয়ে দিন। হাঁটু দুটো ভাঁজ করে পা উপরে উঠিয়ে সাইকেলের মতো গোল করে ঘুরাতে থাকুন। এতে করে বাচ্চার পেটে জমে থাকা গ্যাস সহজেই বপর হয়ে যাবে।
বেশিরভাগ বাচ্চা বাইরে ঘুরতে এবং নতুন নতুন জিনিস দেখতে পছন্দ করে। বাচ্চাকে রিকশা বা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ান। গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনি শরীরে জমে থাকা গ্যাস বের হতে সাহায্য করবে।
আপনার বাচ্চাকে ভালোমতো কাঁথা বা চাদর দিয়ে শক্ত করে মুড়িয়ে রাখুন। এতেও গ্যাসের সমস্যা কমে যেতে পারে। তবে বাচ্চা যদি এটা পছন্দ না করে তবে অন্য উপায় অবলম্বন করুন।
বুকের দুধসহ যেকোনো খাবার খাওয়ানোর সময় বাচ্চার মাথা উঁচু করে রেখে খাওয়ান, যেন পাকস্থলীর চেয়ে বাচ্চার মাথা উপরে থাকে।
বাচ্চার পেটে আলতো হাতে মালিশ করে দিন। আস্তে করে বৃত্তাকার ভাবে আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মালিশ করুন এবং হালকা চাপ দিন। বাচ্চার সমস্যা না হলে একটু চাপ বাড়াতে পারেন।
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরুন এবং মাথাটা নিচের দিকে করে রাখুন। হালকাভাবে মাথাটা উপরে তুলুন। খেয়াল রাখবেন যেন মুখে বা নাকের উপর কোনো কাপড় বা অন্যকিছু না থাকে।
বাচ্চাকে ঢেকুর তুলতে সাহায্য করুন। হালকা হাতে বাচ্চার পিঠে থাবা দিলে পেটে জমে থাকা গ্যাস বের হয়ে আসবে সহজেই।
একটু বড় বাচ্চারা গ্যাসের কারণে সৃষ্ট ব্যাথায় অনেক বেশি কান্না করে, আবার কেউ কেউ বেশি অস্বস্তি বোধ করে। তাদেরকে গ্যাসের ব্যাথা ভুলিয়ে রাখার জন্য মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর ব্যাবস্থা করা যেতে পারে। যেমন, তাদের সাথে খেলাধুলা করা, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, বা অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
বাচ্চাকে তার পেটের উপর ভর দিয়ে উপুড় করে শুইয়ে দিন। এতে করে তার শরীরের উপরিভাগের মাংসপেশি জোর পাবে। বাচ্চা মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করবে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকলে শরীরে জমে থাকা গ্যাস বের হতে পারবে।
বাচ্চাকে লিকুইড ওষুধ দিতে পারেন। কয়েক ড্রপ অ্যান্টাসিড বাচ্চাকে খাওয়ালে অনেক আরাম পায় বাচ্চা, গ্যাসের সমস্যাও অনেকটা দূর হয়। তবে এটা একেবারেই শেষ উপায় হিসাবে রাখবেন। নবজাতক শিশুকে একটুতেই ওষুধ দেওয়া মোটেও উচিত নয় এবং অবশ্যই তা ডাক্তারের পরামর্শে।
প্রোবায়োটিকস্ বাচ্চার গ্যাস দূর করার আরেকটি উপায়। তবে এটি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। গ্যাসের সমস্যা যদি অনেক বেশি হয় এবং দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
অনেক সময় বাচ্চার মধ্যে গ্যাস সৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়, কিন্তু আদৌ সেটি গ্যাসের সমস্যা নয়, বরং অন্য কোনো সমস্যার লক্ষণ। সিলিয়াক ডিজিজ এর কারণেও গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। এটি একধরনের রোগ, যা গ্লুটেন এর প্রতি অসহিষ্ণুতা তৈরি করে।
যদি বাচ্চার শারীরিক গঠন ব্যাহত হয়, পাকস্থলীতে অস্বস্তি, বমি, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রকট আকার ধারণ করে, তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ এমন একাধিক সমস্যা শুধুমাত্র গ্যাসের কারণে তৈরী হয়না।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?কিছুক্ষণ আগে বাচ্চাদের গ্যাস সৃষ্টির উপসর্গ ও লক্ষণ সম্পর্কে বলেছি। এবার জেনে নিন ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ সম্পর্কে, যা বাচ্চার মধ্যে দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে তাকে নেওয়া উচিত।
আপনার বাচ্চার মধ্যে যদি গ্যাসের লক্ষণগুলো, অর্থাৎ ব্যাথা, অস্বস্তি, কান্নাকাটি ইত্যাদি জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেও ভালো না হয়, তাহলে তার কোনো এক বা একাধিক খাবারে অ্যালার্জি থাকতে পারে। অথবা খাদ্যতন্ত্রের অন্যান্য সমস্যাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শের বিকল্প নেই।
এছাড়া আপনার শিশু রক্ত বা সবুজ বা হলুদ তরল বমি করলে, মলে রক্ত আসলে, পেট প্রসারিত এবং তা ব্যথা সৃষ্টি করে বলে মনে হলে অতিশীঘ্রই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরোয়া উপায়গুলো অবলম্বন করলে বাচ্চার গ্যাসের সমস্যা কমে যায়। নবজাতকের জন্য এটি খুব সাধারণ বিষয়, ফলে বাচ্চার সাধারণত কোনো ক্ষতি হয়না। তবে উপসর্গগুলো দীর্ঘস্থায়ী হলে বা অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই উচিত।