বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক তত্বাবধানে শুরু হয়েছে হাম-রুবেলা টিকাদান কর্মসূচি। গত ১২ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে শুরু হয়েছে এই কর্মসূচি যা ছয় সমাপ্তব্যাপী ধরে চলে শেষ হবে নতুন বছরের ২৪ জানুয়ারি।
হাম নির্মূল ও রুবেলা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ক্যাম্পেইন চলাকালে সারা দেশে ৯ মাস থেকে ১০ বছরের নিচের প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে ১ ডোজ এমআর টিকা দেওয়া হবে। চলমান করোনা মহামারি বিবেচনা করে দেশে বিদ্যমান শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরিধান করা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার পালন ও সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয়া ইত্যাদি স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক নিয়মাবলি যথাযথ প্রতিপালন সাপেক্ষে ক্যাম্পেইনটি পরিচালিত হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) ১৯৭৯ সাল থেকে শিশুদের বিভিন্ন সংক্রামক রোগজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।
ইপিআইয়ের অন্য লক্ষ্যসমূহের মধ্যে ২০২২ সাল নাগাদ জাতীয় পর্যায়ে হাম-রুবেলা টিকার কাভারেজ শতকরা ৯৫ ভাগে উন্নীতকরণ এবং ২০২৩ সাল নাগাদ হাম-রুবেলা দূরীকরণ অন্যতম। হাম-রুবেলা রোগ ও এর জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো সঠিক সময়ে শিশুকে হাম-রুবেলা (এমআর) টিকা প্রদান করা। নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে শিশুদের ৯ মাস ও ১৫ মাস বয়সে মোট ২ ডোজ এমআর টিকা প্রদান করা হয়ে থাকে।
এটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ যার কারণে জ্বর এবং সারা শরীরে এক ধরণের ফুসকুরি হয়।
কাদের হাম হয়?
টিকা নেয়নি এমন যেকোন বয়সের মানুষের হাম হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ, জটিলতা ও মৃত্যু বেশি দেখা যায়।
কিভাবে ছড়ায়?
হামের ভাইরাস সংক্রামিত শিশু বা ব্যক্তির নাক এবং গলার শ্লেষ্মায় উপস্থিত থাকে। যখন সেই শিশু বা ব্যক্তিটি হাঁচি বা কাশি দেয় তখন ভাইরাস বাইরে ছড়িয়ে পরে এবং অন্য কোন সুস্থ শিশু বা ব্যক্তি নিশ্বাসের সাথে ভাইরাসটি গ্রহণ করতে পারে। হামের ভাইরাস বাতাসে ২ ঘন্টা পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। হামের ভাইরাস এতই সংক্রামক যে, যদি কোন শিশু বা ব্যক্তির এই রোগ হয় তবে তার আশেপাশের ৯০ ভাগ মানুষ এতে আক্রান্ত হবে যদি না তাদের এটি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকে।
লক্ষণ বা উপসর্গগুলি কি কি?
১-৩ দিনঃ
প্রচণ্ড জ্বর, সর্দি, কাশি এবং
চোখ লাল হয়ে যায়
চতুর্থ দিনঃ
জ্বর কমে আসে
মখে ও শরীরে লালচে দানা দেখা দেয়
হামের দানা উঠার ৩-৪ দিন পরঃ
দানা কালচে খুসকির মত হয়ে ঝড়ে যায়
ভাইরাস নিশ্বাসে গ্রহণের দশ থেকে বার দিনের মধ্যে সাধারণত উপসর্গগুলি দেখা যায়। তবে খুব তাড়াতাড়ি হলে ৭ দিন এবং দেরিতে হলে ২১ দিনেও শুরু হতে পারে।
একজন ব্যক্তির কি একবারের বেশি হাম হতে পারে?
সাধারণত একজন ব্যক্তির হাম একবারই হয়। কারণ প্রথমবার হওয়ার পর তার শরীরে হামের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে।
হামের ভয়াবহতা কেমন হতে পারে?
হাম হলে শিশু ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও পুষ্টিহীনতায় ভুগতে পারে। কান পাকা রোগ হতে পারে। শিশুর রাতকানা রোগ দেখা দিতে পারে, এমনকি চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। হামের নানা জটিলতার কারণে শিশু মারাও যেতে পারে।
গর্ভপতি মহিলাদের ক্ষেত্রে, হামের কারণে গর্ভপাত ও সময়ের পূর্বে প্রসব হতে পারে।
হামের চিকিৎসা আছে কি?
হামের ভাইরাস ধ্বংস করার কোন ঔষধ নেই তবে কিছু উপসর্গ কমানোর জন্য ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে, যেমন বেশি জ্বর কমানোর ঔষধ।
হাম কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
হাম প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হল টিকাদান। হামের টিকাটি MR বা এমআর (মিসেলস ও রুবেলা) নামক একটি টিকায় রুবেলা টিকার সাথে সমন্বিত থাকে।
টিকা দেওয়ার সঠিক সময় কখন?
৯ মাস পূর্ণ হলে ১ ডোজ এমআর (হাম-রুবেলা) টিকা এবং ১৫ মাস পূর্ণ হলে হামের ২য় ডোজ টিকা দিয়ে শিশুকে হাম রোগ থেকে প্রতিরোধ করা যায়।
হামের টিকা কোথায় পাওয়া যায়?
সরকার অনুমোদিত আপনার নিকটবর্তী টিকাকেন্দ্রে হামের টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
রুবেলা একটি ভাইরাসজনিত অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। এই রোগের জীবাণু প্রধাণত বাতাসের সাহায্যে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে সুস্থ্য শরীরে প্রবেশ করে এবং রুবেলা রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। গর্ভপতি মায়েরা গর্ভের প্রথম তিন মাসের সময় রুবেলা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে মা থেকে গর্ভের শিশু আক্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হতে পারে অথবা জন্মগত বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে যা কনজেনিটাল রুবেলা সিন্ড্রোম (সিআরএস) নামে পরিচিত।
কিভাবে ছড়ায়?
রুবেলা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে রুবেলার জীবাণু বাতাসের সাহায্যে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
লক্ষণসমূহ কি কি?
গোলাপী রং-এর হালকা দানা দেখা যায়। প্রথমে দানা মুখমণ্ডলে বের হয়ে পরবর্তী ৫-৭ দিনের মধ্যে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
ঘাড়ের গ্রন্থি ফুলে যায়
অল্প জ্বর, সর্দি ও কাশি, গলা ব্যথা ও মাথা ব্যথা থাকতে পারে
চোখ লাল হয়ে যাওয়া
ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধি ব্যথা হতে পারে
অস্বস্তি বোধ করা
রুবেলার ভয়াবহতা কিরকম হতে পারে?
কনজেনিটাল রুবেলা সিন্ড্রোম
নাক দিয়ে রক্ত পড়া
প্রসাবের সাথে রক্ত যাওয়া
অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
মস্তিষ্কের ঝিল্লিতে প্রদাহ
অন্ত্রে রক্তক্ষরণ
এই রোগের জটিলতা শিশুদের তুলনায় বড়দের বেশি দেখা যায়। জটিলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে “কনজেনিটাল রুবেলা সিন্ড্রোম (সিআরএস)”। গর্ভপতি মায়েরা রুবেলায় আক্রান্ত হলে গর্ভের শিশু মারাত্মক জতিলতা বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। যেমন- বধির, চোখের ছানি, হৃদপিণ্ডের জটিলতা এবং মানসিক প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি, যাকে কনজেনিটাল রুবেলা সিন্ড্রোম (সিআরএস) বলে।
রুবেলার চিকিৎসা আছে কি?
রুবেলার ভাইরাস ধ্বংস করার কোন ঔষধ নেই তবে কিছু উপসর্গ কমানোর জন্য ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে এবং জটিলতা কমানোর জন্য চিকিৎসা করা হয়, যেমন চোখের ছানির শল্য চিকিৎসা করা হয়।
রুবেলা কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
শিশুদের
৯ মাস বা ২৭০ দিন বয়স পূর্ণ হলে এক ডোজ এমআর (হাম-রুবেলা) টিকা দিয়ে শিশুকে রুবেলা থেকে প্রতিরোধ করা যায়।
কিশোরীদের
১৫ বৎসর পূর্ণ হলে সকল কিশোরীদের এক ডোজ এমাআর টিকা এক ডোজ টিটি টিকার সাথে দিতে হবে। পরবর্তীতে টিটি টিকার সময়নূসারে পাঁচ ডোজ টিটি টিকা সম্পন্ন করতে হবে।
শিশুর নিয়মিত টিকাদান দেশ ও জাতির কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। শিশুরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেশের কল্যাণ নির্দেশ করে। তাই আমরা যেন আমাদের সন্তানকে টিকা দিতে ভুলে না যাই এবং অন্যকেও টিকা দিতে উৎসাহ দিব।
তথ্যসুত্রঃ
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই),
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার