দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা জনশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি নানাবিধ সমস্যাও বাড়িয়ে চলেছে। জন্মহার কমানোর জন্য সরকার হাতে নিয়েছে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি খুবই কার্যকরী ও সময়োপযোগী একটি রাস্তা। তবে বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে মানুষের মনে নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এখানে প্রচলিত ও সহজলভ্য কিছু পদ্ধতি ও তাদের বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হল -
এটি বর্তমানে একটি জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। এতে মূলত এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরণ নামক দুই ধরনের হরমোন থাকে। এই পদ্ধতিতে জরায়ুর মিউকাস এর ঘনত্ব বাড়ে ফলে শুক্রাণুর চলনক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়। পাশাপাশি গর্ভাশয়ের ভিতরের আবরণ ডিম্বাণু প্রতিস্থাপনের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
সুবিধা অসুবিধা
ডাক্তার অথবা স্বাস্থ্যকর্মীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করলে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির কার্যকারিতা প্রায় ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এই পদ্ধতি অনিয়মিত মেন্সট্রুয়াল সাইকেল বা রজ:চক্র নিয়মিত করতে সাহায্য করে। রক্তপাত চলাকালীন ব্যথা, অস্বস্তি দূর করতেও এর ব্যবহার করা হয়।
কার্যকরী এই পদ্ধতির বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। সাময়িক বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি, মাথা ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি ছাড়াও এই পিল ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, পরিবারে অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধা ঘটিত কোনো অসুখ থাকলে, মাইগ্রেন, হেপাটাইটিস কিংবা ব্রেস্ট অথবা এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের কোনো হিস্ট্রি থাকলে সে ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার না করাই ভালো।
এই ধরনের হরমোনাল পিল তাদের জন্য যারা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কারণে এস্ট্রোজেন ব্যবহার করতে পারেন না। অন্যান্য বড়ির মতই এই প্রজেস্টেরণ অনলি পিলও একটি কার্যকরী পদ্ধতি।
সুবিধা অসুবিধা
শতকরা ৯০ শতাংশ কার্যকর প্রজেস্টেরণ অনলি পিলে এস্ট্রোজেন না থাকার কারণে এতে এস্ট্রোজেন ঘটিত কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে না। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিয়মিত ফোঁটা ফোঁটা স্রাব কখনো কখনো অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েদের জন্য এই পিল উপযুক্ত। এছাড়াও যেসব মহিলারা উচ্চ রক্তচাপ, ফাইব্রেয়েড, ডায়াবেটিস, এপিলেপ্সি সংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রেও এটি খুবই উপযোগী একটি পন্থা।
প্রজেস্টেরণ অনলি পিলের চেয়ে উচ্চমাত্রায় প্রজেস্টেরণ নিশ্চিত করার জন্য এই ইনজেকশন দেয়া হয়। প্রতি বারো সপ্তাহে একটি করে ইনজেকশন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দিতে হবে। এভাবে এক বছর ইনজেকশন দেবার পর শতকরা ৫০ জন মহিলার রজ:স্রাব আপনাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সুবিধা অসুবিধা
এটি ৯৯ দশমিক ৭ ভাগ কার্যকর পদ্ধতি। যেসব মহিলারা এস্ট্রোজেন ব্যবহার করতে পারেন না, এই পদ্ধতিটি তাদের জন্য। এর ফলে এন্ড্রোমেট্রিওসিসের উপসর্গ কমে এবং এন্ড্রোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। অপরদিকে এই পদ্ধতিতে অনিয়মিত রক্তপাত, ওজন বেড়ে যাওয়া, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাবার মত সমস্যা হতে পারে। তবে ইনজেকশন নেওয়া বন্ধ করলেই এই সমস্যা আর থাকে না।
সপ্তাহে মাত্র একবার ব্যবহার করতে হয়। মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের প্রথম দিন স্তনগ্রন্থি ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় এটি বসানো হয়। এটিও একই সাথে এস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরণ দুই ধরনের হরমোন বহন করে।
সুবিধা অসুবিধা
শতকরা ৯৯ দশমিক ৭ ভাগ কার্যকর এই পদ্ধতি মেন্সট্রুয়াল ক্রাম্পিং কমায় এবং রজ:চক্র নিয়মিত করে। তবে অনিয়মিত রক্তপাত, ফোঁটা ফোঁটা স্রাব, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব হতে পারে।
এই T আকৃতির ডিভাইসটি ডিম্বাশয়ের অভ্যন্তরে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এতে লিভোনরজেসট্রেল নামক হরমোন থাকে। একবার প্রতিস্থাপিত করার পর এটি ৫ বছরের জন্য কার্যকর থাকে।
সুবিধা অসুবিধা
এই সিস্টেমে এস্ট্রোজেন থাকে না ফলে এস্ট্রোজেন ঘটিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও থাকে না। শুরুর দিকে রক্তপাত এবং ক্রাম্পিং বেড়ে গেলেও আস্তে আস্তে এই উপসর্গগুলো কমতে থাকে।
অনেক সময় প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ে আঘাত লাগতে পারে, ডিম্বাশয় ও ডিম্বনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এর ফলে কোনো স্থায়ী ক্ষতি হবার আশঙ্কা নেই।
এক্ষেত্রেও উপরোক্ত সিস্টেমের মত একটি T আকৃতির ডিভাইস ডিম্বাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। সাথে একটি কপার ওয়ার থাকে, যা স্খলিত শুক্রাণুর সঞ্চালনে বাধা সৃষ্টি করে।
সুবিধা অসুবিধা
কপার T শতকরা ৯৯ শতাংশ কার্যকর একটি পদ্ধতি। এতে কোনো হরমোন থাকে না। তাই হরমোন সংক্রান্ত শারীরিক মানসিক পরিবর্তন এড়ানো সম্ভব হয়। তবে কপার T ব্যবহারকালীন রক্তপাত ও ক্রাম্পিং বেড়ে যায়। অনিয়মিত রক্তপাতও হতে পারে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় পারফোরেশনের মত ঘটনা ঘটে থাকে।
সিলিকনের তৈরি ডায়াফ্রাম দৈহিক মিলনের অন্তত ছয় ঘন্টা আগে জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। তবে ২৪ ঘন্টার আগেই ডায়াফ্রামটি জরায়ু থেকে সরাতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন চিকিৎসক অথবা স্বাস্থ্য কর্মীর সাহায্য নিতে হবে।
সুবিধা অসুবিধা
এটি ৮০ থেকে ৯৪ শতাংশ কার্যকর পদ্ধতি। যেহেতু এতে কোনো হরমোন থাকে না, তাই সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েদের ব্যবহারের জন্য উপযোগী। তবে কখনো কখনো এটি মূত্রনালির সংক্রমণ ঘটাতে সাহায্য করে।
বহুল ব্যবহৃত এই পদ্ধতি মূলত পুরুষদের জন্য। স্খলিত শুক্রাণু যেন জরায়ুতে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
সুবিধা অসুবিধা
ব্যবহার করা সহজ ও সুলভ। অনেক ধরনের যৌনরোগের বিরুদ্ধেও এটি অত্যন্ত কার্যকর। অন্যান্য পদ্ধতির মত বার বার চিকিৎসকের কাছে যাবার দরকার হয় না। আবার হরমোন সংক্রান্ত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবারও ভয় নেই। তবে যেহেতু এটি রাবার, সিলিকন অথবা পলিইউরেথিনের তৈরি, অনেকের এতে এলার্জি থাকতে পারে।
এটিও দৈহিক মিলনের পূর্বে ফোম বা জেলী সহযোগে জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত করা হয়। ভিতরে ও বাহিরে দুইটি রিং থাকে। কনডমই একমাত্র পদ্ধতি যার সাহায্যে যৌন বাহিত রোগ ব্যাধি প্রতিরোধ করা যায়।
সুবিধা অসুবিধা
হরমোন সংক্রান্ত কোনো অসুবিধা নেই। তবে অনেক মহিলাই ঠিকভাবে এটি জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করতে পারেন না বলে কার্যকারিতা কম। সঠিকভাবে স্থাপন করতে পারলে শতকরা ৯৫ ভাগ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
সিলিকন ক্যাপ যা জরায়ুতে বসানো হয়। এর ভিতরে স্পার্মিসাইড বা শুক্রাণু মেরে ফেলতে সক্ষম এমন পদার্থ থাকে।
সুবিধা অসুবিধা
ডায়াফ্রাম এবং কনডমের মতই এতেও কোনো হরমোনের বালাই নেই, সেই সাথে এটিও দৈহিক মিলনের আগে বসাতে হবে। তবে কার্যকারিতা কম হওয়ায় সারভাইকাল ক্যাপ খুব একটা ব্যবহার হয় না।
নরম ফোমের মত এই স্পঞ্জ মূলত পলিইউরেথিন দিয়ে তৈরি। স্পঞ্জ জরায়ুর ভিতরে স্পার্মিসাইড সহযোগে বসানো হয়। ১২ ঘন্টা পর্যন্ত এটি কার্যকারী থাকে।
সুবিধা অসুবিধা
এর কার্যকারিতা মূলত স্পঞ্জ ঠিকভাবে স্থাপন করা হয়েছে কিনা তার উপরে নির্ভর করে। এখানেও হরমোন থাকে না। তবে স্পঞ্জ ব্যবহারে জরায়ুতে ফাংগাল ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা থাকে। এ থেকে অস্বস্তি, চুলকানি হতে পারে।
এটি একটি অকার্যকর পদ্ধতি। কারণ শুক্রাণু স্খলন হবার আগে প্রি ইজাকুলেট নির্গত হয় এবং তাতেও স্বল্প পরিমাণে শুক্রাণু উপস্থিত থাকে।
রজ:চক্রের প্রথম ও শেষ দিকে ডিম্বনালিতে কোনো পরিপক্ক ও নিষেকযোগ্য ডিম্বাণু থাকে না। ফলে গর্ভধারণ করা সম্ভব নয়। এই সময়টাকে সেইফ পিরিয়ড বা নিরাপদ সময় বলা হয়। এটি সহজ পদ্ধতি হলেও যেসব মহিলাদের রজ:চক্র অনিয়মিত তারা এটি ব্যবহারের উপযোগী নন।
যাদের পরিবার সম্পূর্ণ অর্থাৎ পরিবারে ২ টি বা তার অধিক সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান রয়েছে অথবা যাদের ১ টি সুস্থ সন্তান আছে কিন্তু তারা আর সন্তান নিতে আগ্রহী নন তাদের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি উপযোগী।
মহিলাদের দুই দিকের ফেলোপিয়ান নালি বা ডিম্ব নালির অংশ কেটে বেধে দেয়া হয় যেন শুক্রাণু ভিতরে প্রবেশ না করতে পারে। একে টিউবাল লাইগেশন বা টিউবেকটমি বলা হয়।
পুরুষদের ক্ষেত্রে উভয় দিকের শুক্রনালি কেটে বেধে দেয়া হয় যেন শুক্রাণু বাইরে আসতে না পারে। এই পদ্ধতির নাম ভ্যাসেকটমি। মহিলাদের টিউবেকটমির তুলনায় ভ্যাসেকটমি অত্যন্ত সহজ ও নিরাপদ পদ্ধতি।
ডাক্তার কিংবা রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টের পরামর্শ নিন। অপরিকল্পিত গর্ভধারণ এড়াতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাধারণত এক বা দুই ডোজ কনট্রাসেপটিভ পিল নিতে হয়।
বর্তমানে জনসংখ্যা সমস্যা দেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। সমগ্র পৃথিবীতেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করে জন্মহার কমানোর চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে কিন্তু অজ্ঞতা ও ভুল ধারনার বশবর্তী হয়ে অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির উপর আস্থা রাখতে পারেন না। অনেকের ধারণা শুধুমাত্র কনডম কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলই হয়ত একমাত্র পদ্ধতি। আমাদের এই সীমিত আয়ের দেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হবার আগেই আমাদের সবার সঠিক ও উপযোগী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।