প্রজননের মাধ্যমে মানুষসহ সকল জীব নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যযুক্ত অপত্য বংশধর সৃষ্টি করে। শুক্রাণু ডিম্বাণুর উৎপাদন, নারীদেহের রজঃচক্র, গর্ভাধান, সন্তান জন্মদান - এই সব কিছুই প্রজনন স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রজনন স্বাস্থ্য ও প্রজনন ক্ষমতা সম্পর্কে বেশকিছু ধারণা আমাদের মধ্যে রয়েছে যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে ঠিক বলে মনে হলেও আসলে সেগুলো সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আসুন তাহলে সেইসব ভ্রান্ত ধারণা ও তার প্রকৃত ব্যাখ্যা জেনে নিই -
গর্ভধারণের কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই এ কথা সত্যি। তবে মহিলাদের গর্ভধারণের জন্য একটি অনুকূল বয়স সীমা রয়েছে।
অনেক দম্পতির ধারণা পুষ্টিকর ডায়েট এবং সক্রিয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বজায় রাখলে পঁয়ত্রিশ ও তার চেয়ে বেশি বয়সেও গর্ভধারণ করা যায়। পড়াশুনা, ক্যারিয়ার, বিয়ের মত বিষয় গুলো সামলে পরিবার পরিকল্পনা শুরু করতে দেরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে মহিলাদের জন্য অনুকূল সময় হল ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়স। ৩৫ এর পর থেকে মহিলাদের গর্ভধারণ করার সম্ভাবনা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ৩৫ বা তার পরে গর্ভধারণ করলে তাতে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন -
গর্ভপাত
একটোপিক প্রেগনেন্সি
গর্ভাবস্থায় শিশুর মৃত্যু
শিশুর ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা
সিজারিয়ান সেকশন
মা ও শিশু উভয়েরই অস্ত্রোপচার পরবর্তী সুদীর্ঘ জটিলতা
গর্ভধারণ করার জন্য প্রথমে ওভারি বা ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বপাত হতে হবে। মহিলাদের ডিম্বাশয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু থাকে যা বয়সের সাথে সাথে কমতে থাকে। ৩৫ বছর বয়সের পর অবশিষ্ট ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান দুইই কমতে শুরু করে। এ জন্যই নানান জটিলতা সৃষ্টি হয়।
প্রায়ই পত্রিকায় ৪০ বা তার চেয়েও বেশি বয়সে সন্তান জন্মদানের ঘটনা দেখা যায়। বিশেষ করে তারকা দম্পতির ক্ষেত্রে পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ বছর বয়সে সন্তান গ্রহণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাহলে তারা কিভাবে এইসব জটিলতা মোকাবিলা করেন? পৃথিবীতে নানা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে এটা সত্যি। তবে অনেক সময়েই দেখা যায় এসব ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণ করা হয়। শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণু ডোনেশন অথবা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মত ব্যয়বহুল পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
অনেক মহিলা মনে করেন অতিরিক্ত ওজন গর্ভধারণের জন্য কোনো বাধাই না। আসলে স্থূলতা সন্তান ধারণ ও জন্মদানের একটি প্রধান অন্তরায়। আবার অতিরিক্ত কম ওজনও গর্ভধারণের পক্ষে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। সম্প্রতি আমেরিকান সোসাইটি ফর রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিনের এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, প্রতি ১০০ জন অনুর্বর মহিলার মধ্যে অন্তত ১২ জন মহিলা অতিরিক্ত বেশি অথবা অতিরিক্ত কম ওজনের কারণে সন্তান ধারণে ব্যর্থ হন। আপনার ওজন যদি অতিরিক্ত কম হয়, সেক্ষেত্রে নিয়মিত পিরিয়ড হবার জন্য, প্রতি মাসে ডিম্বপাত হবার জন্য শরীরে যে ফ্যাট থাকা দরকার তা থাকে না। হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বডি ফ্যাটের প্রয়োজন। যাদের অনিয়মিত ডিম্বপাত হয়, তাদের গর্ভধারণের হার শূন্য না হলেও আশঙ্কাজনক ভাবে কম।
আবার শরীরে অতিরিক্ত বডি ফ্যাট থাকলে তা ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স ঘটায়, যা ডিম্বপাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্থূলকায় মহিলাদের PCOS অর্থাৎ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। PCOS রজঃচক্রকে অনিয়মিত করে এবং ওভুলেশন বা ডিম্বপাতে বিঘ্ন ঘটায়।
এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে ওজন বাড়ানো কিংবা কমানোর জন্য আপনি চিকিৎসক কিংবা একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন। গর্ভধারণ করার জন্য এবং গর্ভাবস্থায় সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য সঠিক ওজন বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
ডিম্বাণু এবং স্খলিত শুক্রাণুর জীবনকাল নিয়ে মানুষের মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, স্খলনের পর শুক্রাণু গড়ে ৪৮ ঘন্টা জীবিত থাকতে পারে। কিছু কিছু শুক্রাণুর জীবনকাল এর চেয়েও বেশি হতে পারে। অপরদিকে ডিম্বপাতের পর ডিম্বাণু শরীরের অভ্যন্তরে ৩৬ ঘন্টা কার্যক্ষম থাকে। তাই দৈহিক মিলনের অনেকক্ষণ পরেও গর্ভধারণ করা সম্ভব।
ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন এমন দম্পতিদের ডিম্বপাত হবার তিন থেকে পাঁচদিন আগে দৈহিক মিলনের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। তবে যাদের রজঃচক্র অনিয়মিত, তাদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি তেমন কার্যকর হবে না।
ফিট থাকা আর স্বাস্থ্যবান ও প্রজননক্ষম থাকা - দুটো দুই জিনিস। আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, বাইরে থেকে ফিট দেখালেই তাকে আমরা 'ভালো স্বাস্থ্য'র তকমা দিয়ে দিই।
রোজ ব্যায়াম করা, নিয়মিত ওজন চেক করা স্বাস্থ্য সচেতনতার লক্ষণ। কিন্তু অতিরিক্ত এক্সারসাইজ ডিম্বপাতে বাধা দেয় এবং প্রজেস্টেরণ নামক হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা বজায় রাখার জন্য প্রজেস্টেরণ খুবই জরুরি একটি হরমোন।
গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নেবার পর পরই ব্যায়াম করার যেসব যান্ত্রিক উপায় রয়েছে তা বাদ দিতে হবে। রোজ কয়েক কিলোমিটার দৌঁড়ানো, ট্রেডমিল ব্যবহার করা, ওয়েট লিফটিং করা একেবারে বন্ধ করতে হবে। তার বদলে হালকা জগিং, মেডিটেশন, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা যেতে পারে।
বর্তমানে খাদ্য নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে, তত নতুন নতুন তথ্য আমাদের সামনে আসছে। আমাদের রোজকার খাদ্য তালিকার আলু, পটল, শিম, কুমড়ায় যে কত কত পুষ্টিগুণ রয়েছে তা এখন আর আমাদের অজানা নেই। তবে শুধুমাত্র ডায়েট অবলম্বন করে প্রজনন ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করলে আপনাকে আশাহত হতে হবে বৈকি !
তবে গর্ভধারণে আগ্রহী মহিলাদের নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার, ফল, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মাংস, কলিজা, খাদ্য শস্য খেতে বলা হয়। যেন শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ও সাম্যাবস্থা বজায় থাকে। পরবর্তী সময়ে গর্ভজাত শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্যও এটি দরকার।
সমস্ত মহিলাদের চক্র দৈর্ঘ্য সমান হয় না। তবে এটি সত্য যে ডিম্বস্ফোটনের কয়েক দিন আগে এবং পরের দিন পর্যন্ত মহিলারা সবচেয়ে উর্বর হয়। ডিম্বস্ফোটন কোনও মহিলার মাসিকের ১১ তম দিন থেকে শুরু করে ২১ তম দিনের মধ্যে যে কোনও সময় ঘটতে পারে। পুরুষের শুক্রাণু আপনার দেহে পাঁচ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, যখন ডিমটি বের হওয়ার পরে প্রায় ১২-২৪ ঘন্টা বেঁচে থাকে। শুক্রাণু ডিম ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করবে, তাই আপনার উর্বরতার সময়কালে যদি আপনি সহবাস করেন তবে আপনি গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবেন।
অনেকে মনে করেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করলে পরে গর্ভধারণ করতে সমস্যা হয়। অনেকে এও ভাবেন যে, পিল ব্যবহার বন্ধ করার পরও অনেকদিন শরীরে এর প্রভাব থাকে। কয়েক মাস এমনকি বছর খানেক হয়ত গর্ভধারণ করা যায় না। জানিয়ে রাখছি, এটি আগাগোড়া একটি ভুল ধারণা।
যদি আপনার বয়স ৩৫ বা তার কম হয় এবং পিল শুরু করার আগে নিয়মিত প্রতি মাসে রজঃস্রাব হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিত থাকুন, পিল বন্ধ করার মাস খানেকের মধ্যেই আপনি সন্তান ধারণের উপযোগী হয়ে উঠবেন। তবে অন্যান্য জন্ম নিরোধক পদ্ধতি যেমন ডেপো প্রভেরা ইনজেকশন যা প্রতি তিন মাস পর পর দেয়া হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে ১২-১৪ সপ্তাহ পর্যন্ত এর প্রভাব কার্যকর থাকে। আর স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা ফিরে পেতে ১০ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মেনোপজ। ৪৫ - ৫০ বছর বয়সের মধ্যে সাধারণত শেষবার রজঃস্রাব হয় যাকে মেনোপজ বলে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়ের মেনোপজের বয়সসীমার উপর মেয়ের মেনোপজ নির্ভর করে। যদি কারো মায়ের মেনোপজ নির্দিষ্ট বয়স সীমার আগেই হয়ে গিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তার নিজেরো 'আর্লি মেনোপজ' বা সময়ের আগেই মেনোপজ হবার সম্ভাবনা থাকে। আর 'আর্লি মেনোপজ' এর কারণে প্রজনন ক্ষমতাও দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। গর্ভধারণ ও গর্ভাবস্থা দুইই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এ নিয়ে কথা বলতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। বাংলাদেশে বিশেষ করে আমাদের গ্রামীণ সমাজে এখনো এসব বিষয় অনেকটাই উপেক্ষিত। ফলাফল - মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, বন্ধ্যাত্ব। এসব রোধ করতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মা, বোন, দাদী, নানী নন; পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরও এ বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যাও বাদবাকি অন্যান্য শারীরিক সমস্যার মতই সমান গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার।