গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে মা ও শিশুর যে সমস্যা হতে পারে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায় গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস এর লক্ষন

গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরে অনেক ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। কিছু পরিবর্তন স্বাভাবিক, আবার কিছু পরিবর্তন অস্বাভাবিক। ডায়াবেটিস হলো গর্ভকালীন সময়ের অন্যতম একটি অস্বাভাবিকতা বা জটিলতা, যা অনেক নারী ও তাঁদের বাচ্চাদের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির কারণ। অনেক সময় গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয়, অনেক সময় বাচ্চা জন্মায় অনেক বেশি ওজন নিয়ে। আবার, অনেক সময় শুধুমাত্র ডায়াবেটিসের কারণেই নরমাল ডেলিভারিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। 

এসব সমস্যা এড়িয়ে যেতে হলে প্রেগন্যান্সির র পুরোটা সময় সাবধানতা অবলম্বন করা ও ডাক্তারের পরামর্শ মতো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় কিভাবে ডায়াবেটিস হয়, এর ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো, এটি নির্ণয় এবং প্রতিকারের জন্য করণীয়সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা থাকছে আমাদের আজকের আর্টিকেলে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের জটিলতা 

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, যার ফলে মা ও বাচ্চা উভয়েই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হতে পারেন।.

ক) গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস এর কারনে শিশুর যে সমস্যা হতে পারে

১) অস্বাভাবিক বেশি ওজন

গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিসের কারণে বাচ্চা অনেক সময় অস্বাভাবিক বেশি ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওজন বৃদ্ধির কারণে বাচ্চা আকারেও বৃদ্ধি পায়। ফলে জন্মের সময় বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। 

আবার, ওজন যদি ৯ পাউন্ডের বেশি হয়ে যায়, তখন অনেক সময় নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হয়না, অপারেশনের প্রয়োজন হয়।

২) অপরিপক্ক বাচ্চা

বাচ্চা আকারে বড় হওয়ার কারণে স্বাভাবিক সময়ের আগেই অনেক সময় বাচ্চার জন্ম হয়, ফলে বাচ্চা অপরিপক্ক হয়ে জন্ম নেয়।

৩) শ্বাস-প্রশ্বাসে জটিলতা

অপরিপক্ক হয়ে বাচ্চা জন্ম নিলে তার শ্বসনতন্ত্র পুরোপুরি গঠিত হয়না, ফলে তারা Respiratory Distress Syndrome নামক জটিলতায় আক্রান্ত হয় যা শ্বাস-প্রশ্বাসে জটিলতা সৃষ্টি করে।

৪) হাইপোগ্লাইসেমিয়া

অনেকসময়, জন্মের পরপরই বাচ্চার শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যেতে পারে, যাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। এই সমস্যা বেড়ে বাচ্চার খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। ইন্ট্রা ভেনাস গ্লুকোজ দিয়ে এসময় বাচ্চার শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দূর করা যেতে পারে। 

৫) স্থুলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস 

মায়ের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চার স্থুলতা দেখা দিতে পারে, এমনকি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও তাদের অনেক বেড়ে যায়। বাচ্চাদের যে ডায়াবেটিস হতে পারে সেটাই অনেক মা বাবা জানেন না। ফলে বাচ্চার ডায়াবেটিস থাকলেও তার চিকিৎসা না হওয়ার ফলে সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

৬) শিশুমৃত্যু

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যদি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের না করা হয়, তাহলে মা মৃত শিশুর জন্ম দিতে পারেন, অথবা শিশু জন্মের পরপরই মারা যেতে পারে। 

সুতরাং, মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শিশুর বিভিন্ন ধরনের রোগ, জটিলতা, এমনকি অকাল মৃত্যুও ঘটাতে পারে।

খ) গর্ভবতী মা যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন

গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারণে যেসব জটিলতা দেখা দেয় তা হলো: 

১) অপারেশন

গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বাচ্চার নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা কমে যায়, তখন অপারেশনের মাধ্যমে, অর্থাৎ সি-সেকশনে বাচ্চা জন্ম দিতে হতে পারে।

২) পরের প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস

প্রথমবার যদি মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়, তাহলে পরের বার বাচ্চা নেওয়ার সময়েও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও মায়ের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৩) উচ্চরক্তচাপ এবং প্রিক্লাম্পশিয়া

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণে মায়ের উচ্চরক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও প্রিক্লাম্পশিয়া নামক একধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেখানে একইসাথে উচ্চরক্তচাপ এবং অন্যান্য লক্ষনও দেখা দেয় যার কারণে বাচ্চা এবং মা উভয়েরই জীবন-নাশের আশঙ্কা থাকে। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর কারণ কি? 

রক্তে যখন গ্লুকোজ আসে, তখন ইনসুলিন নামক হরমোন এসে সেই গ্লুকোজকে পরিপাক করে এবং তা কোষের মধ্যে ঢুকতে সহায়তা করে। অর্থাৎ, ইনসুলিন না থাকলে গ্লুকোজ ভেঙে কোষের মধ্যে যেয়ে শক্তি জোগাতে পারেনা। কোনো মহিলা গর্ভবতী হলে তাঁর শরীর অনেক সময় গ্লুকোজের ব্যাবহারে পরিবর্তন আনে, যার কারণে হতে পারে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। 

গর্ভকালীন সময়ে প্লাসেন্টা নামক একটি নালীর সাহায্যে শিশু মায়ের শরীর থেকে সব ধরনের পুষ্টি পেয়ে থাকে। এই প্লাসেন্টা বিভিন্ন হরমোনও তৈরী করে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে প্লাসেন্টা থেকে সৃষ্ট হরমোন ইস্ট্রোজেন, ল্যাক্টোজেন, কর্টিসোল ইত্যাদি ইনসুলিন হরমোনকে কাজ করতে বাঁধা দেয়, বা ব্লক করে ফেলে। ফলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে।

যে সমস্যাগুলোর কারনে আপনার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হতে পারে  

ডাক্তার যেভাবে বুঝবেন আপনি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত 

গর্ভাবস্থায় সাধারণত ২৪-২৮ তম সপ্তাহে ডায়াবেটিস দেখা দেয়, এবং এই ডায়াবেটিস শতকরা ৪% মহিলাদের মধ্যে দেখা দেয়।

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, যেসব মহিলা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাঁদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য স্ক্রিনিং টেস্ট করা উচিত গর্ভধারনের আগেই। আর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য ২৪-২৮ তম সপ্তাহে স্ক্রিনিং টেস্ট করা উচিত। 

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন প্রেগন্যান্ট মহিলাদের রক্তের গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, এবং তা হলো:

ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট এর মাধ্যমে ডাক্তার বুঝতে পারবেন মা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কিনা। এজন্য মা কে প্রথমে ৫০ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানো হয়, যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একঘন্টা পর রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় সুগারের মাত্রা। আবার, ডাক্তার মা কে ১২ ঘন্টা না খেয়ে থাকার পর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ দিয়েও রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করতে পারেন। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে করনীয় কি? 

ডায়াবেটিস, সেটা যে-ধরনেরই হোক না কেন, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে এবং সুস্থভাবে জীবনযাপন করলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব একটা কঠিন নয়। এর জন্য ডাক্তারের পরামর্শ ও ওষুধের পাশাপাশি প্রাথমিক কিছু নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হবে, যেমন:

গর্ভাবস্থায় নিয়মিত শরীরচর্চা

আমাদের দেশে একটি ভুল ধারনা প্রচলিত আছে যে, গর্ভাবস্থায় বেশি নড়াচড়া করা যাবেনা বা বেশি কাজ করা যাবেনা। বরং গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন হালকা কিছু শরীরচর্চা করলে সেটা মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ভালো। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করলে পিঠের ব্যাথা, দুর্বলতা দূর হয়। 

অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটাহাঁটি, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটলে অনেকটাই সুস্থ বোধ করবেন মায়েরা। তবে আপনি যদি আগে থেকেই ভারী কাজ, জিম, অথবা ইনটেন্স ব্যায়াম করে থাকেন, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না। ডাক্তার বুঝবেন গর্ভাবস্থায় আপনি ভারী কাজ করতে পারবেন কিনা। 

তাছাড়া, ব্যায়াম করলে শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এজন্য হাতের কাছে সবসময় গ্লুকোজ-পানি বা চকলেট রাখা উচিত। 

গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যসম্যত খাবার গ্রহন করা

ডায়াবেটিস থাকলে ডাক্তার আপনাকে অবশ্যই একটি খাদ্যতালিকা তৈরী করে দিবেন, যাতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট, অর্থাৎ কেক, পাউরুটি, বিস্কিট, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি যেসব খাবারে চিনি থাকে তা বর্জন করে প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি খাবার খেতে পারেন, যেমন, ফলমূল, গাজর ইত্যাদি। এর সাথে প্রোটিন এবং ফ্যাট জাতীয় খাবারও খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে। 

চেষ্টা করুন দিনে তিনবার অল্প করে খাবার খেতে এবং বেশি বেশি শাকসবজি, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খেতে। তবে হাতের কাছে গ্লুকোজ-পানি রাখতে ভুলবেন না, হঠাৎ করে রক্তে গ্লুকোজ কমে গেলে এটির দরকার পড়ে।

ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় যাদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তাদের নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখা উচিত। ডাক্তার যদি ইনসুলিন বা অন্য কোনো ওষুধ দেন তাহলে তা নিয়মিত খাওয়া উচিত।

উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন সহজেই এবং বাচ্চা এবং মা উভয়েই সুস্থ থাকবেন। 

পরিশেষে

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস অনেক ক্ষেত্রেই সাধারন বিষয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে সাধারণত মা এবং বাচ্চার কারো কোনো ক্ষতি হয়না। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত থাকলে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এবং ইনসুলিন স্বাভাবিক না থাকলে মা এবং বাচ্চা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে পারে, এমনকি এর কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একারণে মা, বাচ্চার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি।

FOR MORE CLICK HERE

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]