সন্তান জন্মাবার পর মায়ের দুধই শিশুর প্রথম ও প্রধান খাদ্য। শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত অন্য কোনো খাবার এমনকি এক ফোঁটা পানিও খাওয়াবার দরকার পড়ে না। সন্তানের জন্য এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে মায়ের যেকোন অসুস্থতা এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। এ সময় মায়েদের কানের ইনফেকশন, সাইনাস ইনফেকশন, দাঁতের সমস্যা এবং স্তনের প্রদাহের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে। যেহেতু মায়ের রক্তে উপস্থিত যেকোন ঔষধ বুকের দুধের মাধ্যমে সন্তানের শরীরে স্থানান্তরিত হয়, তাই যেকোন ঔষধ বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক খাবার আগে মাকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আপনার সন্তান যদি আপনার বুকের দুধ পান করে এবং সাথে আপনাকে ঔষধ সেবন করতে হচ্ছে তবে আপনার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলি জানা দরকার-
রক্তে উপস্থিত প্রায় সকল ঔষধই বুকের দুধের মধ্যে দিয়ে স্থানান্তরিত হয়। তবে বেশির ভাগ সময়ই তার পরিমাণ এত অল্প থাকে যে তাতে শিশুর কোনো রকম ক্ষতি হয় না। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিছু কিছু ঔষধ বুকের দুধে কনসেন্ট্রেটেড হয় অর্থাৎ ঔষধের ঘনত্ব বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি ঔষধ আলাদা আলাদা ভাবে বিবেচনা করতে হবে।
৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই শিশুর প্রথম ও একমাত্র খাদ্য। কিন্তু কিছু কিছু ঔষধ মায়ের শরীর থেকে বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে স্থানান্তরিত হয়। সেটা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন। অথবা দিনের যে সময়ে ঔষধের ঘনত্ব কম থাকবে তখন ব্রেস্ট ফিডিং করাতে পারেন।
কখনও কখনও আপনার চিকিৎসক আপনাকে অস্থায়ীভাবে বা স্থায়ীভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করার পরামর্শ দিতে পারে যেটা নির্ভর করে আপনাকে ঔষধটি কত সময় ধরে খেতে হবে তার উপর।
যদি আপনাকে স্থায়ীভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হয় যা সাধারণত দেখা যায় না, সেক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসককে বুকের দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি সম্পর্কে এবং দুধ ছাড়ানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুন।
সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়টায় রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একজন মা নিম্নোক্ত ঔষধগুলি খেতে পারেন -
পেইনকিলার বা ব্যথা নিবারণকারী ঔষধ
এসিটামিনোফেন, ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ঔষধ
ফ্লুকোনাজল, মাইকোনাজল, ক্লোট্রাইমাজল (ইস্ট ও ফাংগাল ইনফেকশনের জন্য দেয়া হয়)
পেনিসিলিন জাতীয় ঔষধ
এরাইথ্রোমাইসিন (ত্বক ও শ্বাসনালীর সংক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়)
সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক (ফুসফুস, নাক, ত্বক, মূত্রনালী, হাড়ের সংক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়)
অ্যান্টি কোঅ্যাগুল্যান্টস
ওয়ারফেরিন, হেপারিন ( রক্ত তঞ্চন ঘটিত সমস্যায় ব্যবহার করা হয়)
অ্যান্টিহিস্টামিন
ফেক্সোফেনাডিন, লোরাটিডিন (অ্যালার্জি ও ঠাণ্ডা ঘটিত সমস্যা এবং 'হে ফিভার' নামক রোগে ব্যবহার করা হয়)
ডিকনজেসটেন্ট
সিউডোফেডরিন (এটি নাকের সাইনাসের আয়তন কমিয়ে সর্দি হ্রাস করে। এটি সাবধানতার সাথে ব্যবহার করতে হবে কারণ সিউডোফেডরিন দুধের সরবরাহ হ্রাস করতে পারে)
জন্মবিরতিকরণ পিল
প্রজেস্টেরণ অনলি পিল বা POP
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ঔষধ
ফ্যামোটিডিন
সিমেটিডিন
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস
প্যারোক্সেটিন
সেরট্রালিন
কোষ্ঠকাঠিন্যের ঔষধ
অন্যান্য
ইনহেলার, ব্রনকোডায়লেটর, কর্টিকোস্টেরয়েড (অ্যাজমার জন্য ব্যবহৃত হয়)
যদিও বেশিরভাগ ঔষধই কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি করে না, তবুও এ সময়ে মায়েদের অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত কোনো ঔষধ খাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে কোনো হার্বাল বা ভেষজ ঔষধ, কোনো ধরনের সাপ্লিমেন্ট, হাই ডোজ ভিটামিন এড়িয়ে চলা উচিত।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ও আমাদের যত ভুল ধারণা
ঔষধের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করুন, সুস্থ থাকুন
যদিও ঔষধ খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের মতামতই শেষ কথা, তবে যেসব মায়েরা ব্রেস্টফিডিং করান তাদের পক্ষে নিম্নোক্ত ঔষধগুলো এড়িয়ে চলাই নিরাপদ হবে -
অ্যাসিবিউটলল, অ্যাটিনলল
উচ্চ রক্তচাপ এবং অ্যাবনরমাল হার্ট রিদমের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়
ক্লোরথালিডন
এক ধরনের ডাই ইউরেটিক যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ব্যবহার করা হয়
সিটালোপ্রাম
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট যা মায়ের দুধের মাধ্যমে বাচ্চার শরীরে পৌঁছে বাচ্চার ড্রাউসিনেস বা তন্দ্রাচ্ছন্ন করতে পারে
ডক্সেপিন
ডিপ্রেশন কমাতে এই ঔষধ দেয়া হয়
আরগোটামাইন
মাইগ্রেনের জন্য ব্যবহার করা হয়
এথোসাক্সিমাইড
এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়
মায়েরা অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স চলাকালীন শিশুর খাওয়া ও ঘুমের প্যাটার্নের দিকে লক্ষ রাখুন। শরীরে কোনো ধরনের র্যাশ বের হলে কিংবা হঠাৎ করেই শিশুর মলমূত্রের পরিমাণ ও রঙের পরিবর্তন চোখে পড়লে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব শিশুর বয়স, ওজন, শারীরিক অবস্থার নির্ভর করে। প্রিম্যাচিওর এবং সদ্যোজাত শিশুর উপর স্বাভাবিকভাবেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব বেশি হয়ে থাকে। জন্মের পর শিশুর কিডনী ও লিভারের গঠন সম্পূর্ণ হতে অন্তত দুই মাস সময় লাগে। তাই এই সময়ে শিশুর উপর অ্যান্টিবায়োটিকের সাইড ইফেক্ট সবচেয়ে বেশি হয়।
এ ছাড়াও ড্রাগ কম্বিনেশনের উপর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব নির্ভর করে। নিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিক অন্যান্য ঔষধের সাথে নেয়া হলে কখনো কখনো তা শিশুর জন্য ক্ষতিকর উপাদান তৈরি করতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিকে ব্যবহৃত উপাদান সমূহের উপর এর প্রভাব নির্ভর করে। মায়ের দুধে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন থাকে। অ্যান্টিবায়োটিকে যদি এমন কোনো উপাদান থাকে, যার প্রোটিনের প্রতি আসক্তি বেশি, তাহলে সেই অ্যান্টিবায়োটিক মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে অধিক মাত্রায় প্রবেশ করে এবং প্রতিক্রিয়া ঘটায়।
পেট খারাপ
মায়েরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, তাদের অ্যান্টিবায়োটিক চলাকালীন সময়ে শিশুর পেট খারাপ বা ডায়রিয়ার উপসর্গ দেখা যায়। যেহেতু অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কারণে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস হয়ে যায় তাই শিশুর পেট খারাপের মত হতে পারে। সাধারণত কোনো ওষুধ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ হবার পরই এই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।
সেপসিস
বাচ্চাদের ইমিউন সিস্টেম সাধারণের তুলনায় দুর্বল হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে শিশুর দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কার্যকর হয়, ফলে শরীরের অন্যান্য সুস্থ টিস্যু ধ্বংস হয়। তখন তাকে সেপসিস বল।
থ্রাশ
বাচ্চা বা বাচ্চার মায়ের থ্রাশ হতে পারে। এটা এক ধরনের ফাংগাল ইনফেকশন। এক্ষেত্রে বাচ্চার ডায়রিয়া, র্যাশ, জিহ্বা এবং মুখের ভেতরের দিকে সাদা আস্তরণ পরার মত সমস্যা হতে পারে। মায়েদের স্তনে সংক্রমণ হতে পারে। এই সমস্যা এড়ানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চলাকালীন সময়ে প্রবায়োটিক খেতে পারেন।
মেজাজে পরিবর্তন
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে শিশুটি কিছুটা অশান্ত এবং অস্বস্তি বোধ করতে পারে।
মায়েদের যেকোন ঔষধ খাবার আগে বাচ্চার চিকিৎসকের (পেডিয়াট্রিসিয়ানের) সাথে আলোচনা করে নেয়া উচিত। বিশেষ করে সন্তান জন্মের পর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত। ঔষধটি আপনার সন্তানের পক্ষে কতটুকু নিরাপদ, কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, প্রবায়োটিক সেবন করার দরকার আছে কি নেই ভালো করে জেনে নিতে হবে। প্রয়োজন হলে আগের ঔষধ বদলে অলটারনেটিভ কোনো ঔষধ খেতে পারেন।
তবে কখনো কখনো অলটারনেটিভ ঔষধ পাওয়া নাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সন্তানকে বিকল্প খাবার খাওয়াতে হবে। ঔষধের কোর্স শেষ হবার পর আবার ব্রেস্টফিডিং চালু করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব এড়ানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া। কিন্তু অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে এই উপায়গুলি কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন -
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মুখে খাওয়ার পরিবর্তে একই ঔষধ ক্রিম বা অয়েন্টমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বুকের দুধের মাধ্যমে সন্তানে স্থানান্তরিত হবার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে ঔষধের ওরাল বায়োঅ্যাভেইলেবিলিটি জেনে নিন। যেসব ঔষধের ওরাল বায়োঅ্যাভেইলেবিলিটি কম, সেসব ঔষধ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
অ্যান্টিবায়োটিক সেবন ও ব্রেস্টফিডিং এর মধ্যে সর্বোচ্চ টাইম গ্যাপ নিশ্চিত করুন।
জন্মের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাইটাল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি তখনো বিকশিত হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তত শক্তিশালী নয়। এ অবস্থায় মায়ের শালদুধ ও গাট ফ্লোরা বা আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকর প্যাথোজেনের পাশাপাশি এই গাট ফ্লোরার উপর প্রভাব ফেলে। এ সময় মায়ের বুকের দুধই শিশুর একমাত্র খাদ্য। আর বুকের দুধের মাধ্যমে মা থেকে সকল ঔষধ সন্তানের দেহে পৌঁছায়। তাই অ্যান্টিবায়োটিকসহ যেকোন ঔষধ ব্যবহারে মায়ের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।