বাংলা পরিভাষা রচনার ইতিহাস
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে যখন প্রয়োজন দেখা দেয় তখনই সৃষ্টি হয় পরিভাষার। ওই যে একটি কথা বলা
হয় যে, প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী একথাটি যেন পরিভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরো বেশি সত্যি বলে মনে হয়। যে দেশ বা
জাতি নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় যত বেশি নিবেদিত তাদের জন্য পরিভাষার প্রয়োজন তত বেশি এবং তারা তৈরি করেন বা
করতে বাধ্য হন নতুন সব শব্দ। বিগত দুশো বছরে দেশি ও বিদেশি প্রশাসক, সাহিত্যিক ও বিশেষজ্ঞদের সমবেত চেষ্টায়
গড়ে উঠেছে বাংলা পরিভাষা এবং এখনো সেই চেষ্টা শেষ হয়নি। এদেশে প্রথমে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত হয় মাদ্রাজ,
বোম্বাই ও বঙ্গপ্রদেশে। শাসনযন্ত্রকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ বিচার ব্যবস্থা এদেশে চালু করার প্রয়োজন দেখা
দেয়। ফলে বৃটিশ আইন বাংলায় অনুবাদ করা শুরু হয়। ইংরেজি ভাষায় রচিত বৃটিশ আইন বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়েই
অনুবাদকেরা অনুভব করেন পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা। এজন্য বলা যায়, আইন অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা থেকেই বাংলা
পরিভাষা চর্চার সূত্রপাত ঘটে। ১৭৮৪ সালে জনাথান ডানকান ‘মপসল দেওয়ানী আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানী
আদালতে বিচার ও ইনসাফ চলন হইবার কারণ ধারা ও নিয়ম’ বাংলা ভাষায় ও বাংলা হরফে ছেপে প্রকাশ করেন।
ডানকানের পর এডমন স্টোন, ফরস্টার, উইলিয়াম কেরী প্রমুখের অনুবাদের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইংরেজি আইন বাংলায়
রূপান্তর ঘটে। এই সকল বিদেশিদের প্রয়োজনের হাত ধরেই বাংলা ভাষায় আইনের আলোচনায় পরিচিত হয়ে ওঠে
হাকিম, আদালত, ইজারা, জজ, তহশীল, তহশীলদার প্রভৃতি পারিভাষিক শব্দ। ইংরেজ অনুবাদকদের হাতে সৃষ্ট ওই সব
পারিভাষিক শব্দ এখন বাংলা ভাষার প্রায় নিত্য পরিচিত শব্দে পরিণত হয়েছে।
আইনের অনুবাদের মাধ্যমে পরিভাষা তৈরির যে সূচনা ঘটে বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় তার পরবর্তী পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়।
বাংলায় বিজ্ঞান পুস্তক রচনা ও বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরির প্রাথমিক কৃতিত্বের দাবিদার ফেলিকস্ কেরী। তিনি বাংলাতে
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার খানিকটা বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘বিদ্যাহারাবলি’ নাম দিয়ে। তাঁর অপর মূল্যবান গ্রন্থ
‘ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা’ প্রকাশিত হয় ১৮২৩ সালে। ওই বইতে তিনি যে সকল পরিভাষা তৈরি করেছিলেন সেগুলো এখনো
আমরা ব্যবহার করছি। কয়েকটি উদাহরণ :
Anatomy ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা Solid ঘন
Muscle মাংস পেশী Surgery অস্ত্রচিকিৎসাবিদ্যা
Nerve নাড়ী Vein শিরা।
ফেলিকস কেরীর পর বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় অন্য যাদের অবদান রয়েছে তাঁরা হচ্ছেন জন ম্যাক, পীটার বৃটন, পীয়ারসন
প্রমুখ।
বাঙালিদের মধ্যে যিনি বিজ্ঞান বিষয়ক পরিভাষা তৈরিতে মনোযোগী হন তিনি অক্ষয় কুমার দত্ত। উনিশ শতকের প্রথম
পঞ্চাশ বছরে তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানমনস্ক সাহিত্যিক। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক যে চারটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন সেগুলো হচ্ছে :
১। ভ‚গোল (১৮৪১); ২। বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (প্রথম ভাগ ১৮৫১, দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৪, তৃতীয়ভাগ
১৮৫৯); পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬)। এসব বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে তিনি তৈরি করেন বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক
পারিভাষিক শব্দ। তাঁর সৃষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ক কয়েকটি পারিভাষিক শব্দের নমুনা এখানে দেওয়া হলোÑ
Magnet চুম্বক Compass দিগ্দর্শন
Solid কঠিন Biology প্রাণিবিদ্যা
Microscope অনুবীক্ষণ যন্ত্র ইBotany উদ্ভিদবিদ্যা
Telescope দূরবীক্ষণ যন্ত্র Southpole কুমেরু
Astrology জ্যোতিষ North pole সুমেরু
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ বা প্রবন্ধ রচনা বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্ত সর্বাগ্রগণ্য। তাঁর সৃষ্ট
বৈজ্ঞানিক পরিভাষার অধিকাংশই পরবর্তীকালে গৃহীত ও ব্যবহৃত হয়েছে আজো ব্যবহৃত হচ্ছে।
অক্ষয়কুমার দত্তের পর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনবিহারী দাস, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যোগেশচন্দ্র
রায়, বি.এন.শীল, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ গুণীব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বিভিন্ন শব্দের বাংলা
পরিভাষা সৃষ্টি করেছেন। এঁদের প্রত্যেকের মধ্য দিয়ে বাংলা পরিভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা
ভাষা।
শুধু ব্যক্তিগত ভাবেই নয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও বাংলা পরিভাষা প্রণয়নের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই।
পরিভাষা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা প্রথম শুরু করে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর যোগ্য
নেতৃত্বে একদল কৃতবিদ্য বাঙালি সম্মিলিতভাবে পরিভাষা তৈরির যে চেষ্টা করেছিলেন তা দীর্ঘ ৪২ বৎসর যাবত (১৮৯৪-
১৯৩৫) পরিষদের মুখপত্র ‘সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা’য় মুদ্রিত হয়েছিল। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শেষ দিকে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সমিতি গঠনে করে (১৯৩৪) বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন পরিভাষা তৈরি করে খÐে খÐে তা
প্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাজনের পর পশ্চিম বঙ্গ সরকার গঠন করে পরিভাষা সংসদ (১৯৪৮)। সংসদ বিভিন্ন
ধরনের পরিভাষা নির্মাণের আত্মনিয়োগ করে। অন্যদিকে পূর্ববাংলার ভাষা কমিটি (১৯৪৮), বাংলা একাডেমি (১৯৫৭),
কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড (১৯৬৩), সরকারি শিক্ষা বিভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষার উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি
গ্রহণ করে। এই সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বাংলা পরিভাষা বহুলভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা কমিটিও (১৯৭৪) বাংলা পরিভাষা তৈরিতে বড় রকমের ভ‚মিকা রেখেছেন।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন পরিভাষা তৈরি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিদিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ ঘটছে নতুন নতুন
শব্দের, আর আমরা পরিচিত হচ্ছি সে সব শব্দের সঙ্গে। ফলে প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে শব্দটির একটি বাংলা পরিভাষার।
যখনই প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে তখনই হয়তো আমরা তৈরি করছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি নতুন একটি পরিভাষা তৈরিতে। সঙ্গে
সঙ্গে যোগ হচ্ছে আমাদের ভাষায় একটি নতুন শব্দ এবং সবার অজান্তেই ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে।
পরিভাষা তৈরির নিয়ম ও পদ্ধতি
যে কোনো পারিভাষিক শব্দেরই থাকতে হয় চারটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য। সেগুলো হচ্ছে : সর্বজনস্বীকৃতি, স্বাভাবিকতা, বিশিষ্টার্থ
প্রয়োগ, আড়ষ্টহীনতা। কিন্তু এই সব গুণসম্পন্ন শব্দ তৈরি করতে হলে, যিনি পরিভাষা তৈরি করবেন, তাঁকে অবশ্যই মেনে
নিতে হয় ভাষাবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলো। তা ছাড়া ভাষাবিবর্তনের ঐতিহাসিক পটভ‚মি সম্পর্কেও পরিভাষা সৃষ্টিকারীর
থাকতে হয় পরিষ্কার ধারণা। এই ধারণার সাহায্যেই তিনি নির্বাচন করবেন এমন শব্দ যা সহজেই সমাজে গৃহীত হবে।
দুরূহ ও দুরুচ্চার্য শব্দে পরিভাষা তৈরি হলে তা জনসাধারণের কাছে গৃহীত হয় না। তাছাড়া, আমরা আগেই বলেছি যে
শব্দটি পরিভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হবে তার থাকবে সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ অর্থ এবং স্পষ্ট তাৎপর্য। প্রত্যেকটি শব্দই একটি
নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হতে হবে তাকে দ্বিতীয় কোনো অর্থে প্রয়োগ করা যাবে না।
পদ্ধতি
যে কোনো ভাষাতেই পরিভাষা তৈরি হয় সাধারণত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। পদ্ধতি তিনটি হলো : ঋণ, ঋণ-অনুবাদ
ও নির্মাণ। আসুন আমরা ঐ তিনটি পদ্ধতি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।
১। ঋণ
ভাষার ঋণ মানুষকে ধনী ও সমৃদ্ধ করে। যে ভাষায় যতো বেশি ঋণকৃত শব্দ আছে সে ভাষা ততো সমৃদ্ধ। বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানে অন্য সকলের মতো বাঙালিরও সমান অধিকার আছে। তাই যে ভাষা থেকে আমরা জ্ঞান আহরণ করব তার শব্দ,
ভাব, প্রেরণা আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। উগ্র স্বাদেশিকতা দ্বারা তাড়িত হয়ে হাইড্রো
অক্সাইডকে ‘অ¤øজানমূলক উদ্বায়ী গ্যাস’, টেলিফোনকে ‘দূরালাপনী’, বুনসেন বার্নারকে ‘পিনাল-দাহক’, ইনকেজশনকে
‘সূচিকাভরণ’ না লেখাই সঙ্গত। আজকাল আমরা সবাই লোডশেডিং, চ্যারিটি বা ওয়ার্মআপ ম্যাচ, বাস, স্টেশন, অক্সিজেন
এসব পারিভাষিক শব্দ অপরিবর্তিত ভাবেই গ্রহণ করেছি। অর্থাৎ এসব শব্দ আমরা ঋণ করে বাংলা ভাষায় নিয়ে এসেছি
এবং ঋণ শোধ না করলেও কেউ কখনো তাগাদা দিতে আসবে না; বরং বাংলা ভাষাকে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ করবে।
২। ঋণ-অনুবাদ
পুরনো, ভুলে যাওয়া কোনো বাংলা শব্দকে তুলে এনে নতুন অর্থে ব্যবহার করেও পরিভাষা তৈরি করা যায়। শব্দের আগের
অর্থটা জানা থাকলে বা বহাল থাকলেও ধীরে ধীরে নতুন অর্থটাই সবার কাছে পরিচিতি পেয়ে, নতুন অর্থ ধারণ করে
ফেলে। ঋণ-অনুবাদ হতে পারে দু-ধরনের। সংস্কৃত বা দেশি এমন অনেক শব্দ পাওয়া যাবে যেগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত
হয়; অর্থাৎ অর্থ একটিই কিন্তু শব্দ অনেক। এ ধরনের শব্দগুলোর ভেতর থেকে একটি বেছে নিয়ে আমরা নতুন অর্থে
প্রয়োগ করে গড়ে তুলতে পারি একটি পরিভাষা। ‘বিজ্ঞান’, ইতিহাস, পদার্থ প্রভৃতি শব্দ এমন ধরনের ঋণ অনুবাদের
উদাহরণ। বিজ্ঞান শব্দটি বোঝাতো বিশেষ জ্ঞানÑ তা সে যে কোনো জ্ঞানকেই বোঝাতো কিন্তু এখন পরিভাষা হিসেবে
আমরা বিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার করছি।
৩। নির্মাণ
শব্দ নির্মাণের মতো পরিভাষা নির্মাণের বেলাতেও ভাষার মূল প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। বাংলা ভাষার
শব্দসম্ভার অর্থাৎ তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি থেকে উপাদান মিশিয়ে পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা যায়। কোনো কোনো
ক্ষেত্রে তৎসম শব্দ হতে গৃহীত পরিভাষা, যেমন : ‘দ্রাঘিমা’, ‘বিষুবরেখা’, ‘লসাগু’, ‘গসাগু’ ইত্যাদি শব্দ পরিভাষা হিসেবে
অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত হয়েছে।
পরিভাষিক শব্দ-প্রয়োগ বিধি
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা সর্বস্তরে চালু করার নির্দেশ দেয়া হলে সেই নির্দেশ অনুসারে বাংলা ভাষা
সর্বস্তরে ব্যবহারের প্রয়াস অব্যাহত থাকে। কিন্তু বাংলা ভাষা ব্যবহারের কিছু সমস্যা দেখা যায়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে
অফিস-আদালত ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার বহুল প্রচলন থাকায় কতিপয় শব্দ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় যা
আমাদের বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রচলনের ক্ষেত্রে দীনতারই পরিচায়ক। বহুল প্রচলিত এই সকল ইংরেজি শব্দ যার বাংলা
প্রতিশব্দ উদ্ভব হয়নি বা কিছু কিছু শব্দ বাংলায় রূপান্তর হলেও তার ব্যবহার করা হয় সেগুলোকেই পরিভাষা বলা হয়।
প্রয়োগ বিধি
পরিভাষা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। সেগুলো নি¤œরূপ:
(১) মূল ভাষায় প্রতিশব্দ না থাকলে পরিভাষায় প্রয়োগ করা যায়। যেমন : পুলিশ চোরকে ধরতে এসেছে। পুলিশের
প্রতিশব্দ নেই।
(২) মূলভাষায় টেকসই প্রতিশব্দ না থাকলে পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়। যেমন :- ছেলেমেয়েরা টেলিভিশন দেখছে ।
টেলিভিশন শব্দের প্রতিশব্দ দূরদর্শন, তবে এ শব্দটি টেকসই নয়।
(৩) মূল ভাষায় প্রতিশব্দটি অপ্রচলিত হলে পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়। যেমন : টেবিলে কলমটা রাখো। টেবিলের প্রতিশব্দ
চৌপায়া এটি প্রচলিত নয়।
(৪) মুল ভাষার প্রতিশব্দটি সর্বসাধারণের বোধগম্য না হলে পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। যেমন : গতকাল সর্বোচ্চ
তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ডিগ্রীর প্রতিশব্দ মান নির্ণয়ক বিশেষ বলে অভিহিত করা হয়। তাই ডিগ্রী
লেখাই শ্রেয়।
(৫) পৌনঃপুনিক ব্যবহারের কারণে প্রতিশব্দ থাকলেও পরিভাষা প্রয়োগ করা যায়। যেমন : একাউনটেন্ট পদে লোক
নিয়োগ করা হবে। একাউনটেন্ট এর প্রতিশব্দ হিসাব রক্ষক। কিন্তু একাউনটেন্ট এর ব্যবহার বহুল ও সর্বজনগ্রাহ্য।
(৬) সহজে গ্রহণযোগ্য পরিভাষা প্রয়োগ করা যায়। যেমন : টেলিফোন নষ্ট হয়ে গেছে। টেলিফোনের প্রতিশব্দ দূরালাপনি
কিন্তু টেলিফোন শব্দটি সহজে গ্রহণযোগ্য।
(৭) অফিস আদালতে ব্যবহার্য শব্দ পরিভাষিক হওয়াই উত্তম। যেমন : বিল জমা দেয়া হোক। এখানে বিলের পরিবর্তে
অন্য কোনো শব্দ প্রয়োগ তেমন অর্থবহ নয় না।
অনাকাক্সিক্ষতভাবে মূলভাষার প্রতিশব্দ সৃষ্টি করে শব্দের সার্বজনীনতা নষ্ট না করাই বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে পরিভাষা প্রয়োগ
করা শ্রেয়। যেমন : স্কুল খোলা নেই। স্কুলের পরিবর্তে বিদ্যালয় শব্দ প্রয়োগ করলে সার্বজনীনতা ক্ষুণœ হয়।
সারসংক্ষেপ :
ব্রিটিশ আইন বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়েই বাংলা পরিভাষা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বাংলা পরিভাষা
প্রণয়নের প্রথম উদ্যোক্তা ি সেবে জনাথান ডানকানের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। আইনের অনুবাদের পর বিজ্ঞান
বিষয়ক বাংলা গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে সৃষ্টি হয় বাংলা বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরিতে প্রাথমিক
কৃতিত্বের দাবীদার ফেলিকস্ কেরী। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ও বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরিতে
অক্ষয়কুমার দত্ত অগ্রগণ্য। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক চারটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ওই চারটি বইতে তিনি যে সকল
বৈজ্ঞানিক পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তা আমরা এখনও সাদরে গ্রহণ ও ব্যবহার করে থাকি। অক্ষয়কুমার
দত্তের পর ব্যক্তিগতভাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর প্রমুখ গুণীব্যক্তি বিভিন্ন প্রয়োজনে অসংখ্য পরিভাষা সৃষ্টি করেছেন। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি যে সকল
প্রতিষ্ঠান পরিভাষা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছেন ও রাখছে সেগুলো হল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি প্রভৃতি।
যে কোনো ভাষাতেই পরিভাষা তৈরি হয় সাধারণত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। পদ্ধতি তিনটি হলো : ঋণ, ঋণঅনুবাদ ও নির্মাণ। কিছু শব্দ আমরা ঋণ করে বাংলা ভাষায় নিয়ে এসেছি। পুরনো ভুলে যাওয়া কোনো বাংলা শব্দকে
তুলে এনে নতুন অর্থে ব্যবহার করেও পরিভাষা তৈরি করা যায়। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার অর্থাৎ তৎসম, তদ্ভব, দেশি,
বিদেশি থেকে উপাদান মিশিয়ে পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা যায়। পরিভাষা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা অনুসরণ
করা হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন :
১। বাংলা পরিভাষা রচনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে পারবেন।
২। পরিভাষা তৈরির নিয়ম ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
৩। পরিভাষার প্রয়োগবিধি লিখতে পারবেন।
৪। পরিভাষা তৈরির তিনটি পদ্ধতির বর্ণনা দিন।
৫। টীকা লিখুন
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, অক্ষয়কুমার দত্ত, ফেলিকস্ কেরী, বাংলা একাডেমি।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ