কোনো বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনকেই অভিজ্ঞতা বলা হয়। অভিজ্ঞতাকে ইংরেজিতে ঊীঢ়বৎরবহপব বলে।
কোনোকিছু শিখনের মধ্য দিয়ে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। মানুষ সাধারণত দুইভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
প্রথমটি হলো ইন্দ্রিয়জাত অনুভবেব মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়টি দেখেশুনে ও হাতেকলমে। কাজেকর্মে সংযুক্ত হলে মানুষকে
ভালোমন্দ নানারকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এই অভিজ্ঞতা তাকে ভবিষ্যতে সঠিক সচেতনভাবে চলতে সাহায্য
করে।
কোনো বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনকেই অভিজ্ঞতা বলা হয়।
অভিজ্ঞতা বর্ণনের কলাকৌশল
১. একটি অখÐ ভাবের মধ্যে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে হয়।
২. বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়।
৩. অভিজ্ঞতা বর্ণনায় ভূমিকা, মূল অংশ ও উপসংহার থাকতে পারে। আলাদাভাবে লেখা যেতে পারে, একসঙ্গে
একটি অখÐ ভাবের মধ্যেও প্রকাশ করা যেতে পারে।
৪. অভিজ্ঞতা বর্ণনার ভাষা হবে সহজ-সরল-সাবলীল।
শিলাইদহের আলোকিত দিনে
শিলাইদহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নামটি জড়িত একথা আমাদের ভালোভাবেই জানা ছিল। কবির লেখায় কুষ্টিয়ার শিলাইদহ
গভীরভাবে জড়িত। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কুষ্টিয়ার সুনাম রয়েছে। বাউল সাধক লালনের জন্ম ও সাধনা এই শিলাইদহের
মাটিতে। অমর রচনা ‘বিষাদÑসিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের পৈত্রিক ভিটা কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ায়। এর পাশেই
রয়েছে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের বসতভিটা। এক শীতের সকালে বন্ধু অতনু ও আমি মিলে রওনা
হলাম কুষ্টিয়ার উদ্দেশে। আগে কখনো যাওয়া হয়নি তাই কেমন যেন একটা শঙ্কা কাজ করছিল বুকের ভেতর। যাত্রাপথে
বাসের ভেতর দারুণ কাটছিল। সঙ্গে নানারকম টুকিটাকি খাবার, আচার, বিস্কুট নিয়েছিলাম। বিকেল নাগাদ ঢাকা থেকে
কুষ্টিয়া বাস টার্মিনালে গিয়ে পৌঁছলাম। ঝটপট কাছের একটি হোটেল ‘রজনীগন্ধায়’ দুজনের জন্য ডাবল একটি কক্ষ ভাড়া
নিয়ে নিলাম। রুম ভাড়া ঢাকার তুলনায় অনেক সস্তা, হোটেলে খাবারের দামও তুলনামূলকভাবে কম। পদ্মার টাটকা ইলিশ
দিয়ে ভাত খেতে দারুণ লাগছিল। হোটেল ম্যানেজারকে শিলাইদহে যাবার উপায় জিজ্ঞাসা করলে বললেন যে, আজ সন্ধ্যা
হয়ে গেছ্ েএখন গিয়ে তেমন কিছু দেখা যাবে না। বরং আজ রাতে বিশ্রাম নিয়ে একেবারে তরতাজা হয়ে আগামীকাল
সকালে বেরিয়ে পড়–ন। বাসে কুষ্টিয়া শহর থেকে শিলাইদহে যেতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। আমরা আগেই ঠিক
করেছিলাম যে, সারাদিন আজ শিলাইদহের সমস্ত বিখ্যাত জায়গা ঘুরে দেখব। সকাল নয়টার দিকে বাসে উঠে পড়লাম।
গড়াই সেতু পার হয়ে চলেছিÑ দুধারে গ্রামের পর গ্রাম, অবারিত সবুজ, বয়ে চলা গড়াই নদী। শীতের সময় গড়াইতে
তেমন পানি না থাকলেও ধুধু বালিরাশি এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। গড়াই সেতু পার হবার আরও আধা ঘণ্টা পর
শিলাইদহে গিয়ে পৌঁছলাম। ভাবছিলাম কবি রবীন্দ্রনাথ যখন এখানে এসেছিলেন তখন তো এরকম সুন্দর রাস্তাঘাট কিছুই
ছিল না। কত কষ্ট করে নদীপথে নৌকায় করে কবিকে যাতায়াত করতে হয়েছে। কুঠিবাড়ির সামনেই বিশাল মাঠÑ এই
মাঠের পথেই হয়ত গগন হরকরা হেঁটে আসতেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান গাইতে গাইতেÑ ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার
মনের মানুষ যে রে Ñ’। দশ টাকায় টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। মনটা আনন্দে ভরে গেল। কী বিশাল বাসভবন, কী
চমৎকার সিঁড়ি। দোতলায় উঠে কবির ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র দেখলাম। পদ্মার বুকে যে বোটে করে কবি চলাচল করতেন
সেই বোটটিও দেখলাম। দোতলার ঘরে বসেই তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি। এ ছাদে দাঁড়িয়েই তিনি
বি¯তৃত পদ্মার রূপ দেখতেন। সবচেয়ে অবাক হলাম কবির আঁকা অনেক ছবি দেখে। এত ছবি তিনি এঁকেছেন তার কিছুই
আমরা জানতাম না। এখানেই ‘সোনার তরী’ ‘মানসী’ কাব্যের অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, ছিন্নপত্রের পাতায় লেখা
হয়েছে কবির বিচিত্র অনুভূতির কথা। কুঠিবাড়ির সীমানা প্রাচীরটিও দেখার মতো। পদ্মার ঢেউয়ের মতো প্রাচীরটি ঢেউ
খেলানো। কুঠিবাড়ির পেছনেই পদ্মার ঘাটে একসময় কবির ‘পদ্মা’ নামক বোটটি এসে ভিড়ত। এখন এই ঘাটে কত নৌকা
এসে ভিড় করে। এই পদ্মাবোটে বসে কবি গ্রামের সহজ-সরল মানুষের জীবনকে দেখেছেন, তাঁর লেখায় চিত্রিত হয়েছে
সেইসব নরনারীর ছোট ছোট সুখ-দুঃখের কাহিনি। বন্ধু অতনু আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালো; জোর করে ওকে এখানে
নিয়ে আসার জন্য। এখানে না আসলে নাকি ওর জীবন অসম্পূর্ণই থেকে যেত। বিকেলে শিলাইদহ থেকে ফেরার পথে মীর
মশাররফ হোসেনের ভিটেমাটি, তাঁর বসতগৃহ, তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ¯ু‹ল দেখার সৌভাগ্য হলো। কাঙাল হরিনাথের সেই
বিখ্যাত ছাপাযন্ত্রটিও দেখলাম তাঁর বসতবাড়িতে। তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র কয়েকটি পুরনো কপি দেখে নিজেকে খুবই
সৌভাগ্যবান বলে মনে হলো। দুদিনের কুষ্টিয়া সফরের তরতাজা স্মৃতি নিয়ে পরদিন ঢাকার পথে রওনা হলাম।
ছিটমহলের পথে পথে
দাসিয়ার ছড়া একটি ছিটমহলÑ উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলায় এটি। মিডিয়া আর পত্রপত্রিকার কল্যাণে এই ছিটমহলের নাম
সবার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। এখানকার মানুষের কথা, তাদের জীবনযাপনের কথা, সুখদুঃখের কথা এতবার শুনেছি যে,
সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম একবার ওখানে যাব। সব ঠিকঠাক করে গত সপ্তাহে রওনা দিলাম কুড়িগ্রামের পথে। যমুনা নদীর
ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। উত্তরবঙ্গে আগে কখনো যাইনি আমি। কেমন সেখানকার পথঘাট, পরিবেশ কিছুই
জানা ছিল না। দাসিয়ার ছড়াটি একেবারে ফুলবাড়ি সীমান্ত এলাকায় বলে শুনেছি কিন্তু সেটা যে আসলে কতদূর কোনো
ধারণাই ছিল না। যাদের সে ধারণা ছিল তারা বলেছিল ৭ ঘণ্টার পথ। কিন্তু রওনা হবার পর মনে হলো পথ আর শেষ হয়
না। সঙ্গে ছিল আবির ও প্রবীর। আমার চেয়েও বেশি উৎসাহী তারা। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হবার আধা ঘণ্টা পরে একটি
রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতি দেয়া হলো। মাথা ঝিমঝিম আর বমি বমি ভাব লাগছিল। তেমন কিছুই খেলাম না। শুধু এক কাপ
গরম চা খাবার পরে মাথা ধরাটা ছেড়ে গেল বলে মনে হলো। বিরতির পর আবারও ছুটল গাড়ি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে
থাকতে থাকতে বুঝলাম কেন উত্তরবঙ্গকে শস্যভাÐার বলা হয়। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। কোথাও সবুজ
ক্ষেতের কোনো কমতি নেই। বাতাসে সবুজ-সোনালি শস্যের মাথা দোলানি না দেখলে বোঝার উপায় নেই কেন বাংলাদেশ
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অনেকগুলো জেলা পেরিয়ে গেলাম একে একে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পরই উত্তরবঙ্গের
প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ। সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জন্ম এই জেলায়। সিরাজগঞ্জের পরই শেরপুর হয়ে
মহাস্থানখ্যাত বগুড়ায় প্রবেশ করলো আমাদের বাসটি। ইতিহাসের বিখ্যাত পুÐ্রবর্ধন নগরী এই বগুড়ার মহাস্থান নামক
জায়গায়। এর পাশ দিয়ে বাসটি যাবার সময় মনে হচ্ছিল আমরা সেই প্রাচীন ইতিহাসে ফিরে গেছি। কতোকাল আগে এই
জনপদেই গড়ে উঠছিলে সমৃদ্ধ এক সভ্যতা। বইয়ে পড়েছি এখানে প্রাপ্ত বৌদ্ধবিহারসহ নানা স্থাপত্য নিদর্শনের কথা।
বগুড়ার পরই ঢুকলাম রঙ্গপুর তথা রংপুরে। মনে পড়লো রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথাÑ এই রংপুরের পায়রাবন্দে
জন্মে যিনি বিখ্যাত হয়েছেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে। সন্ধ্যার পর আমাদের বাসটি সীমান্ত এলাকা ফুলবাড়িতে
গিয়ে পৌঁছল। ছোট একটি হোটেলে উঠে সেদিনের মতো বিশ্রামে গেলাম। পরদিন গেলাম সেই বহুল আলোচিত দাসিয়ার
ছড়া ছিটমহলে। ফুলবাড়ি সদর থেকে দাসিয়ার ছড়ার দূরত্ব ৬ কিমি। ওখানে পৌঁছানোর পর এক অন্যরকম অনুভূতি হলো
আমাদের। দীর্ঘদিনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে তারাÑএকটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হবার চরম আনন্দে তারা
আত্মহারা। ঘরে ঘরে অনেকের সঙ্গে কথা বললাম, তাদের চোখেমুখে চরম খুশির উচ্ছ¡াস। এখন আর তাদের কারো কাছে
মাথা নত করতে হবে না, নিজের পরিচয় নিয়ে আর কোনো ভয় থাকবে না, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবে,
ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ালেখা করতে পারবে, এলাকার উন্নতি হবেÑ এইসব কথা মনে করে তাদের আনন্দ দেখে কে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছে কয়েকটি জায়গায়। দু-একটিকে অফিস বা ক্লাবঘর ধরনের মনে হলো।
নেতাগোছের কয়েকজনকে দেখলাম রাস্তায় বাজারে সঙ্গীসাথিসহ কী যেন সব বলছে। কিন্তু আমাদের এই অভিজ্ঞতা আর
একরকম রইল না। এক জায়গায় খুব কান্নাকাটি শুনে সেখানে এগিয়ে গেলাম। দেখি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে দুজন মেয়ে-
পুরুষ কাঁদছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওরা ভারতে চলে যাবে, তাই আজন্মের ভিটামাটি ছেড়ে চলে যাবার সময় এই
বুকফাটা কান্না। এরকম আরও কয়েকজনকে দেখেছি নানা কারণে তারা ভারতে যেতে বাধ্য হচ্ছে বটে কিন্তু এদেশ ছেড়ে
চলে যেতে তাদের কোনো ইচ্ছাই ছিল না। স্বদেশভূমির টান যে কত গভীর এই প্রথম কাছ থেকে দেখলাম। জন্ম থেকে যে
ভিটায় বড় হয়েছেÑ সেই ভিটা, ঘর, পুকুর, জমি, গাছপালা, গরুছাগল ছেড়ে যেতে কে-ই বা চায়। এক অদ্ভুত বিষণœতা
নিয়ে আমরা সেদিন রাতে হোটেলে ফিরে আসলাম। মনে হলো পত্রিকা বা মিডিয়ায় দাসিয়ার ছড়া নিয়ে অনেক উচ্ছ¡াস
দেখা গেলেও তার আড়ালে কত মানুষের কান্না আর দীর্ঘশ্বাসও মিশে আছে। বুকের ভেতর দারুণ এক কষ্ট আর আনন্দ
নিয়ে ফিরে চললাম নিজ ঠিকানায়।
লোকশিল্প জাদুঘর
সোনারগাঁওয়ের নাম শুনেছি সেই কবে। ঘুরে বেড়ানোর নেশাটাও আমার পুরোনো। হুট করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা
তিনজন। ছাত্র হিসেবে তুখোড় নই, ভ্রমণকারী হিসেবে কিছুটা নাম আছে। সেই নামের মর্যাদা রাখতে সোজা গিয়ে হাজির
হলাম সোনারগাঁওয়ে। সোনারগাঁও প্রাচীন বাংলার রাজধানী। এ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন ঈশা খাঁ। ঈশা খাঁর স্ত্রীর নাম
ছিল সোনাবিবি। এই সোনাবিবির নামানুসারে এর নাম হয় সোনারগাঁও। সেই সোনারগাঁওয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার
লোকশিল্প জাদুঘর। ১৯৭৫ সালে এই ঐতিহাসিক স্থানে জাদুঘরটি গড়ে উঠে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের একান্ত আগ্রহ ও
চেষ্টায়। এই জাদুঘরে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। লোকশিল্প গড়ে ওঠে সাধারণ
অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের দ্বারা। তাদের কল্পনা ও দক্ষতার স্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। কত বিচিত্র
জিনিস তারা তৈরি করেছে, না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই। মাটির মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভার স্বাক্ষর
এইসব শিল্পকর্ম। মাটি, বাঁশ ও বেত দিয়ে কত জিনিস তারা তৈরি করেছে। কাঠ ও মাটির পুতুল, মুখোশ, নানা ধরনের
শৌখিন পাত্র, অলংকারÑ সবকিছুই নিখুঁতভাবে তৈরি হয়েছে। সৌন্দর্য আর লাবণ্যে ভরপুর সব জিনিস। নিরক্ষর হওয়া
সত্তে¡ও আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তারা এগুলো সৃষ্টি করেছে। তাদের নৈপুণ্য দক্ষতা, ধৈর্য ও কল্পনাশক্তির তুলনা নেই।
নকশিকাঁথার এক বিপুল সম্ভার দেখলাম এই জাদুঘরে। গ্রামগঞ্জে তৈরি আরও নানারকম সূচিকর্ম দিয়ে সাজানো জাদুঘরটি।
নগরজীবনে থেকে আমরা হয়ত অনেকেই এইসব লুকানো প্রতিভার মূল্য বুঝি না। এরপর ঢুকলাম ‘জয়নুল আবেদীন
সংগ্রহশালায়’। জয়নুলের আঁকা বিচিত্র ছবির এই সংগ্রহটি আমাদের অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি ছবিতে রয়েছে শিল্পীর
দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। অপূর্ব তাঁর তুলির কাজ। জয়নুলের ছবিতে সমগ্র বাংলাদেশ তার প্রকৃতি নিয়ে
জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দুর্ভিক্ষের ওপর আঁকা তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘ম্যাডোনাÑ৪৩’ দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ স্মৃতিকেই মনে করিয়ে
দেয়। ‘বিদ্রোহী’ ছবির ষাঁড়টি যেন দড়ি ছিঁড়ে এখনি তাড়া করবে আমাদের। ভাওয়াইয়া গানের গাড়িয়াল ভাইয়ের সেই
গাড়ির চিত্র দেখে মন ভরে গেল। মনে হলো শহরের মধ্যে আমরা একটুকরো গ্রামকে খুঁজে পেলাম। বাংলার ইতিহাসঐতিহ্য-সংস্কৃতির উজ্জ্বল ছবি ধরা পড়েছে এই লোকশিল্প জাদুঘরে। বাঙালি হিসেবে আমিও এই গৌরবের অধিকারীÑ এই
ভেবে হৃদয় আনন্দে হেসে উঠল।
যানজটের দীর্ঘ সারি
যানজটে কাহিল হতে হয় প্রতিনিয়ত। ঢাকা এখন যানজটের শহর। যানজট এখানে উৎসবের মতো। মেসে থেকে কলেজে
পড়াশুনা করি। প্রতিদিনই যাতায়াতে জ্যামে পড়তে হয়, এ আর নতুন কী ? কিন্তু সেদিনের সেই যানজটের অভিজ্ঞতা
মনের পাতায় তুলে রেখেছি। বাড়ি থেকে খবর এসেছে মা অসুস্থ। যেতে হবে রংপুর। মাথা কাজ করছিল না একদম।
দুপুরে নাকেমুখে একটু খাবার গুঁজে রওনা দিলাম গাবতলির দিকে। ওখান থেকেই বগুড়ার বাস ধরব। আরামবাগ থেকে
দুপুর দুটায় লোকাল গাড়িতে উঠলাম। কিন্তু মনে হলো হেঁটে রওনা হলে ভালো করতাম। একদম গাড়ি নড়ছে না। একটু
এগোয় আবার স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মনটা একদম ভালো ছিল না। বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছিল। কত কষ্ট করে তিনি
আমাকে শহরে পাঠিয়েছেন পড়ালেখার জন্য। মায়ের একটিই স্বপ্নÑ ভালো রেজাল্ট করে পছন্দমতো কোনো জায়গায় ভর্তি
হই। কোনোকিছুই মা জোর করে আমার ওপর চাপিয়ে দেন না। আমার ওপর মায়ের অগাধ বিশ্বাস। সেই মাকে গিয়ে সুস্থ
দেখতে পাব তো? আরামবাগ থেকে শাহবাগ আসতেই বিকেল চারটা। সারি সারি গাড়ির ভিড়। অসহ্য গরমে ঘেমেনেয়ে
উঠেছে সবাই। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে গরম আরও তীব্র মনে হলো। কেউ কেউ পত্রিকা দিয়ে বাতাস করছে।
এসবের মধ্যে দুএকজন দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। গালাগালি চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ আসছে আশপাশ থেকে।
বাইরে তাকিয়ে দেখি ফুলবালিকাÑ প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে উঁকি মারছে। হাতে গাঁদা ফুলের মালা আর রজনীগন্ধার
স্টিক। কতভাবে কাকুতিমিনতি করছে ফুল বিক্রির জন্য। এই বয়সে যাদের স্কুলে যাবার কথা তারা ফুল ফেরি করছে,
যাদের হাতে থাকার কথা বইপুস্তক, কলম-খাতা তাদের হাতে ফুলের গাদা। কেউ কেউ ফুল কিনল ওদের কাছে নিরুপায়
হয়ে, অনেকে ভীষণ রাগ দেখালো। শামুকের গতিতে এগোচ্ছে বাসটি। ফুটপাতের দিকে চোখ গেল। নানা বয়সী ভিক্ষুকের
মেলা। বিচিত্র ভঙ্গিতে চিৎকার করে তারা ভিক্ষা করছে। অনেকেই দেখলাম ভিক্ষা দিচ্ছে। অধৈর্য হয়ে অনেকে গালিগালাজ
করছে ট্রাফিক পুলিশকে, কেউবা জোরে জোরে হর্ন বাজাচ্ছে মেজাজ খারাপ করে। হোটেল শেরাটন পার হয়ে বাংলা
মোটরের দিকে যেতে যেতে দেখি একজন ফুটপাত দিয়ে খুব জোরে দৌঁড়াচ্ছে। শুনলাম ছিনতাইকারী, কার যেন সোনার
চেইন টান দিয়ে দৌড়। তাকে ধরার জন্য পিছে পিছে কয়েকজন দৌঁড়াচ্ছে। জ্যাম ছাড়া এখন আর ঢাকা শহরকে কল্পনা
করা যায় না। কিন্তু সেদিনের জ্যাম সব রেকর্ডকেই বুঝি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। রাগে গজড়াতে গজড়াতে অনেকে গাড়ি থেকে
নেমে পায়ে হাঁটা ধরল। কোন একজন ভিআইপি নাকি এই পথ দিয়ে যাবেনÑ তাই এই অবস্থা। একটুপর বাস আস্তে আস্তে
চলতে শুরু করলো। যখন গাবতলি গিয়ে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট গাড়ি ছেড়ে গেছে। অতএব নিরুপায় আমি পরের ট্রিপের জন্য
বসে রইলাম একাকী।
লালবাগ কেল্লা
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ইতিহাসের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তে। ঢাকা
শহরের লালবাগ কেল্লার কথা বইয়ে পড়েছি। এবার শীতের ছুটিতে ঠিক করলাম আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ঢাকায় বেড়াতে
যাব এবং লালবাগ কেল্লা মন ভরে দেখবো। রাজশাহী থেকে আমরা তিন বন্ধু ঢাকায় চাচার বাড়িতে এসে উঠলামÑ দুদিন
থাকব, আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। চাচার বাসার একটি কক্ষে আমাদের তিনজনের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন চাচা-চাচি।
বিকেলে ঢাকায় পৌঁছে রাতে বিশ্রাম নিলাম। চাচার কড়া নির্দেশ না বলে-কয়ে যেন ঢাকায় কোথাও না যাই। গেলে নাকি
হারিয়ে যাবার ভয় আছে। সঙ্গে টাকাপয়সা কীভাবে রাখতে হবে, কীভাবে ছিনতাইকারির হাত থেকে দূরে থাকতে হবে
এরকম নানা পরামর্শ দিয়ে চললেন। চাচা-চাচির ধারণা যে, প্রথম ঢাকায় এসেছি, না জানি কী হয়।
সব পরামর্শ মাথায় রেখে সকালবেলা আমরা তিন বন্ধু টিকেট কেটে লালবাগ কেল্লায় প্রবেশ করলাম। পুরোনো ঢাকার
রিয়াজউদ্দিন রোডে এই কেল্লা।
কী বিশাল কেল্লার তোরণ বা ফটক। বড় ফটকটা দিয়ে ঢুকলাম। অন্য দুটি দরজা বন্ধ। গেরুয়া রঙের প্রাচীর, ফটক
সহজেই নজর কাড়ে। তোরণ দিয়ে ঢুকেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। সামনেই বিশাল সুসজ্জিত বাগানÑ ফুলে ফুলে
সাজানো। হরেক রকমের ফুলের মধ্যে গোলাপের সমারোহই বেশি চোখে পড়লো। একটু এগিয়ে গেলেই সামনে পরীবিবির
সমাধিসৌধ। ইতিহাসখ্যাত সুবেদার শায়েস্তা খাঁয়ের প্রিয়তম কন্যা পরীবিবি। কত সালে কীভাবে তার মৃত্যু হয় সেটা জানা
না গেলেও ধারণা করা হয় ১৬৮৭Ñ১৬৮৮ সালে পরীবিবির মৃত্যু হয়। প্রিয় কন্যার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য শায়েস্তা খাঁ
এই অপূর্ব ইমারত নির্মাণ করেন। মূল্যবান পাথর, কষ্টি পাথর এবং নানারকম ফুল-লতা-পাতায় শোভিত টালি দিয়ে
ইমারতটি অলংকৃত। এই ইমারতের ভেতরে নয়টি কক্ষ আছে। কক্ষগুলোর ওপরের অংশ গম্বুজাকৃতি এবং কষ্টিপাথরে
শোভিত। সমাধিসৌধের মূল গম্বুজটি দামি তামার পাত দিয়ে আবৃত। আরও সমাধি আছে এখানে, আছে ফোয়ারা,
পাহাড়ের মতো উঁচু টিলা এবং সুড়ঙ্গ পথ। কেল্লার দক্ষিণ দিকে রয়েছে তোপমঞ্চ। কেল্লার পূর্বদিকে রয়েছে ঘাট বাঁধানো
পুকুর, চমৎকার সিঁড়ির ব্যবস্থা রয়েছে পুকুরটিতে। এর পেছনেই দেখা যায় সেই সময়ের সৈনিক ব্যারাক। এখন এটি
আনসার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। লালবাগ কেল্লা মসজিদটিও দেখলামÑ যেটি নির্মিত হয়েছে শাহজাদা আযমের
সময়। সুবাদার আযম ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র। আয়তাকার তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি মোগল স্থাপত্যের
অনুপম দৃষ্টান্ত। যতই দেখি ততই বিস্মিত হই। এই বিস্ময় নিয়েই দেখলাম শায়েস্তা খাঁয়ের বাসভবন এবং তার দরবার
মহল। আরও আছে সে সময়ে ব্যবহৃত মানচিত্র, তৈজসপত্র, সোরাহি ও শিলা পাথর।
এছাড়াও সতের-আঠার শতকের আরও অনেক নিদর্শন দেখার সুযোগ হলোÑ বর্শাফলক, লোহার জালের বর্ম ছোরা, খাপ,
তীর, বর্শা, পাত্র, ঢাল, তরবারি, বন্দুক, রাইফেল, সৈনিকদের পোশাক, রাজপোশাক ইত্যাদি। সতের শতকে পারস্যে তৈরি
চমৎকার কার্পেট, ঝাড়বাতি, ল্যাম্প, জায়নামাজ, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মসজিদ ও বাগান তৈরির বিবরণসংবলিত
শিলালিপি। রাজার প্রতিকৃতি, শাহজাদা আযম শাহের প্রতিকৃতি, সিংহাসনে আওরঙ্গজেবের প্রতিকৃতি, যুবরাজ ও
রাজকন্যার অশ্বচালনার ছবি আমাদের যেন ইতিহাসের সেই প্রাচীন সময়ে নিয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল
জানি না। আনন্দ আর বিস্ময় নিয়ে ফিরে চললাম বাসায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১। অভিজ্ঞতা বলতে কী বোঝায় ? অভিজ্ঞতা বর্ণনার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২। নিচের বিষয়গুলো নিয়ে তোমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করুন :
জাতীয় যাদুঘর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, সেন্টমার্টিনে এক রাত, রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ