ধ্বনি
কোনো ভাষার বাক্প্রবাহকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা কতগুলো মৌলিক ধ্বনি পাই। বাংলা ভাষাতেও কতগুলো মৌলিক ধ্বনি আছে। বাংলা ভাষার মৌলিক ধ্বনিকে প্রধান দুভাগে ভাগ করা হয়। যেমন :
স্বরধ্বনি : যে সকল ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুসতাড়িত বাতাস বেরিয়ে যেতে মুখবিবরের কোথাও কোনো প্রকার বাধা পায় না তাদের বলা হয় স্বরধ্বনি/Vowel sound। যেমন : অ, আ, ই, উ, ঊ ইত্যাদি।
ব্যঞ্জনধ্বনি : যে সকল ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুসতাড়িত বাতাস বেরিয়ে যেতে মুখবিবরের কোথাও না কোথাও কোনো প্রকার বাধা পায় কিংবা ঘর্ষণ লাগে তাদের বলা হয় ব্যঞ্জনধ্বনি/ Consonant sound। যেমন: ক, চ, ট, ত, প ইত্যাদি।
নাসিকা ধ্বনি
ঙ ঞ ণ ন ম-এ পাঁচটি বর্ণ এবং ং ঃ ঁ যে বর্ণের সঙ্গে লিখিত হয় সে বর্ণে দ্যোতিত ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস নিঃসৃত বায়ু মুখবিবর ছাড়াও নাসারন্ধ্র দিয়ে বের হয়; অর্থাৎ এগুলোর উচ্চারণে নাসিকার সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তাই এগুলোকে বলে অনুনাসিক বা নাসিকা ধ্বনি। আর এগুলোর প্রতীক বা বর্ণকে বলা হয় অনুনাসিক বা নাসিক্য বর্ণ।
২৫টি স্পর্শধ্বনি
বর্ণ |
বর্ণের নাম |
বর্গীয় বর্ণের নাম |
ক খ গ ঘ ঙ |
কণ্ঠ্য বর্ণ |
ক বর্গীয় বর্ণ |
চ ছ জ ঝ ঞ |
তালব্য বর্ণ |
চ বর্গীয় বর্ণ |
ট ঠ ড ঢ ণ |
মূর্ধন্য বর্ণ |
ট বর্গীয় বর্ণ |
ত থ দ ধ ন |
দন্ত্য বর্ণ |
ত বর্গীয় বর্ণ |
প ফ ব ভ ম |
ওষ্ঠ্য বর্ণ |
প বর্গীয় বর্ণ |
২৫টি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ স্থান
উচ্চারণ স্থান |
ব্যঞ্জনধ্বনির বর্ণসমূহ |
উচ্চারণস্থান অনুযায়ী নাম |
জিহবামূল অগ্রতালু পশ্চাৎ দন্তমূল অগ্র দন্তমূল ওষ্ঠ |
ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ শ য ষ ট ঠ ড ঢ ণ ষ র ড় ঢ় ত থ দ ধ ন ল স প ফ ব ভ ম |
কণ্ঠ্য বা জিহবামূলীয় বর্ণ তালব্য বর্ণ মূর্ধন্য বা পশ্চাৎ দন্তমূলীয় বর্ণ দন্ত বর্ণ ওষ্ঠ্য বর্ণ |
ধ্বনি পরিবর্তন
ভাষার পরিবর্তন ধ্বনির পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত। ধ্বনি পরিবর্তন নানা প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। যেমন:
১. স্বরাগম
ক) আদি স্বরাগম/Prothesis: উচ্চারণের সুবিধার জন্য বা অন্য কোনো কারণে শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি এলে তাকে বলে আদি স্বরাগম। যেমন : স্কুল>ইস্কুল, স্টেশন>ইস্টিশন।
খ) মধ্য স্বরাগম, বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি/Anaptyxis : সময় সময় উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসে। একে বলা হয় মধ্য স্বরাগম বা বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি। যেমন:
অ : রত্ন>রতন, ধর্ম>ধরম, স্বপ্ন>স্বপন, হর্ষ>হরষ ইত্যাদি।
ই : প্রীতি>পিরীতি, ক্লিপ>কিলিপ, ফিল্ম>ফিলিম ইত্যাদি।
উ : মুক্তা>মুকুতা, তুর্ক>তুরুক, ভ্রু>ভুরু ইত্যাদি।
এ : গ্রাম>গেরাম, প্রেক>পেরেক, স্রেফ>সেরেফ ইত্যাদি
ও : শ্লোক>শোলোক, মুরগ>মুরোগ>মোরগ ইত্যাদি।
গ) অন্ত্যস্বরাগম/Apothesis : কোনো কোনো সময় শব্দের শেষে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি আসে। এরূপ স্বরাগমকে বলা হয় অন্ত্যস্বরাগম। যেমন : দিশ >দিশা, পোখত্ >পোক্ত, বেঞ্চ >বেঞ্চি, সত্য>সত্যি।
২. অপিনিহিতি/ Apenthesis : পরের ই-কার আগে উচ্চারিত হলে কিংবা যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির আগে ই-কার বা উ-কার উচ্চারিত হলে তাকে অপিনিহিতি বলে। যেমন : আজি>আইজ, সাধু>সাউধ, রাখিয়া>রাইখ্যা, বাক্য>বাইক্য, সত্য>সইত্য, চারি>চাইর, মারি>মাইর।
৩. অসমীকরণ / Dissimilation : একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে যখন স্বরধ্বনি যুক্ত হয় তখন তাকে বলে অসমীকরণ। যেমন : ধপ+ধপ>ধপাধপ, টপ+টপ>টপাটপ
৪. স্বরসঙ্গতি Vowel harmony : একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দে অপর স্বরের পরিবর্তন ঘটলে তাকে স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন: দেশি>দিশি, বিলাতি>বিলিতি, মুলা>মুলো।
ক. প্রগত / Progressive : আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বর পরিবর্তিত হলে প্রগত স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন: মূল্য>মূলো, শিকা>শিকে, তুলা>তুলো।
খ. পরাগত /Regressive : অন্ত্যস্বরের কারণে আদ্যস্বর পরিবর্তিত হলে পরাগত স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন: আখো> আখুয়া> এখো, দেশি, দিশি।
গ. মধ্যগত/Mutual: আদ্যস্তর ও অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে মধ্যগত স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন: বিলাতি>বিলিতি।
ঘ. অন্যোন্য/Reciprocal : আদ্য ও অন্ত্য দুই স্বরই পরস্পর প্রভাবিত হলে অন্যোন্য স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন: মোজা> মুজো।
ঙ. চলিত বাংলার স্বরসঙ্গতি : গিলা>গেলা, মিলামিশা> মেলামেশা, মিঠা>মিঠে, ইচ্ছা>ইচ্ছে ইত্যাদি। পূর্বস্বর উ-কার হলে পরবর্তী স্বর ও-কার হয়। যেমন : মুড়া>মুড়ো, চুলা>চুলো ইত্যাদি। বিশেষ নিয়মে : উড়–নি>উড়নি, এখনি>এখুনি হয়।
৫. সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ : দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদি, অন্ত্য বা মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপকে বলা হয় সম্প্রকর্ষ। যেমন : বসতি>বসইত, জানালা>জান্লা ইত্যাদি।
ক. আদিস্বরলোপ / Aphesis : যেমন : অরাবু>লাবু>লাউ, উদ্ধার>উধার>ধার।
খ. মধ্যস্বর লোপ / Syncope : অগুরু>অগ্রু, সুবর্ণ>স্বর্ণ।
গ. অন্ত্যস্বর লোপ / Apocope : আশা>আশ, আজি>আজ, চারি>চার (বাংলা), সন্ধ্যা> সঞঝা> সাঁঝ। (স্বরলোপ বস্তুত স্বরাগমের বিপরীত প্রক্রিয়া।)
৬. ধ্বনি বিপর্যয় : শব্দের মধ্যে দুটি ব্যঞ্জনের পরস্পর পরিবর্তন ঘটলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে। যেমন: ইংরেজি বাক্স>বাংলা বাস্ক, জাপানি রিকশা>বাংলা রিস্কা, পিশাচ>পিচাশ, লাফ>ফাল।
৭. সমীভবন/ Assimilation: শব্দমধ্যস্থ দুটি ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্প-বিস্তর সমতা লাভ করে। এ ব্যাপারকে বলা হয় সমীভবন। যেমন : জন্ম>জম্ম, কাঁদনা>কান্না ইত্যাদি।
ক. প্রগত সমীভবন/Progressive: পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে।পরবর্তী ধ্বনি পূর্ববর্তী ধ্বনির মতো হয়, একে বলে প্রগত সমীভবন। যেমন: চক্র>চক্ক, পদ্ম>পদ্দ, লগ্ন> লগ্গ।
খ. পরাগত সমীভবন/ Regressive : পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয় একে বলে পরাগত সমীভবন। যেমন : তৎ+জন্য>তজ্জন্য, তৎ+হিত>তদ্ধিত, উৎ+মুখ>উন্মুখ ইত্যাদি।
গ. অন্যোন্য সমীভবন/ Mutual : যখন পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় তখন তাকে বলে অন্যোন্য সমীভবন। যেমন : সংস্কৃত সত্য>প্রাকৃত-সচ্চ, সংস্কৃত-বিদ্যা>প্রাকৃত-বিজ্জা ইত্যাদি।
৮. বিষমীভবন/ Dissimilation : দুটো সমবর্ণের একটির পরিবর্তনকে বিষমীভবন বলে। যেমন: শরীর>শরীল, লাল>নাল।
৯. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বা/Long Consonant : কখনো কখনো জোর দেয়ার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়, একে বলে দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বা। যেমন : পাকা>পাক্কা, সকাল>সক্কাল ইত্যাদি।
১০. ব্যঞ্জন বিকৃতি : শব্দ-মধ্যে কোনো কোনো সময় কোনো ব্যঞ্জন পরিবর্তিত হয়ে নতুন ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয়। একে বলে ব্যঞ্জন বিকৃতি। যেমন : কবাট>কপাট, ধোবা>ধোপা, ধাইমা> লাইমা ইত্যাদি।
১১. ব্যঞ্জনচ্যুতি : পাশাপাশি সমউচ্চারণের দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তার একটি লোপ পায়। এরূপ লোপকে বলা হয় ধ্বনিচ্যুতি বা ব্যঞ্জনচ্যুতি। যেমন : বউদিদি>বউদি, বড় দাদা>বড়দা ইত্যাদি।
১২. অন্তর্হতি : পদের মধ্যে কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে তাকে বলে অন্তর্হতি। যেমন : ফাল্গুন> ফাগুন, ফলাহার> ফলার, আলাহিদা>আলাদা ইত্যাদি।
১৩. অভিশ্রুতি/Umlaut : বিপর্যস্ত স্বরধ্বনি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সাথে মিলে গেলে এবং তদনুসারে পরবর্তী স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে বলে অভিশ্রুতি। যেমন : করিয়া থেকে অপিনিহিতির ফলে ‘কইরিয়া’ কিংবা বিপর্যয়ের ফলে ‘কইরা’ থেকে অভিশ্রুতিজাত ‘করে’। এরূপ : শুনিয়া>শুনে, বলিয়া>বলে, হাটুয়া>হাউটা>হেটো, মাছুয়া>মেছো ইত্যাদি।
১৪. র-কার লোপ: আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র-কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন : তর্ক>তক্ক, করতে>কত্তে, মারল>মাল্ল, করলাম>কল্লাম।
১৫. হ-কার লোপ: আধুনিক চলিত ভাষায় অনেক সময় দুই স্বরের মাঝামাঝি হ-কারের লোপ হয়। যেমন : পুরোহিত>পুরুত, গাহিল>গাইল, চাহে>চায়, সাধু>সাহু>সাউ, আরবি-আল্লাহ>বাংলা-আল্লা, ফারসি : শাহ্>বাংলা-শা ইত্যাদি।
১৬. অ-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি / Euphonic glides: শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটো স্বরধ্বনি থাকলে যদি এ দুটো স্বর মিলে একটি দ্বিস্বর (যৌগিক স্বর) না হয় তবে এ স্বর দুটোর মধ্যে উচ্চারণের সুবিধার জন্য একটি ব্যঞ্জনধ্বনির মতো অন্তঃস্থ ‘য়’ (ণ) বা অন্তঃস্থ ‘ব’ (ড) উচ্চারিত হয়। এই অপ্রধান ব্যঞ্জনধ্বনিটিকে বলা হয় য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি। যেমন : মা+আমার=মা (য়) আমার> মায়ামার। যা+অ=যা (ও) য়া=যাওয়া। এরূপ : নাওয়া, খাওয়া, দেওয়া ইত্যাদি।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ