ভাষার মূল উপকরণ বাক্য এবং বাক্যের মৌলিক উপাদান শব্দ। যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় তাকে বাক্য বলে। কতগুলো পদের সমষ্টিতে বাক্য গঠিত হলেও যে কোনো পদসমষ্টিই বাক্য নয়। বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদ দ্বারা মিলিতভাবে একটি অখণ্ড ভাব পূর্ণ রূপে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন তবেই তা বাক্য হবে।
বাক্যের প্রকরণ
অংশ অনুসারে বাক্য দুই প্রকার। যেমন :
উদ্দেশ্য ও বিধেয়
প্রতিটি বাক্যে দুটি অংশ থাকে : উদ্দেশ্য ও বিধেয়
বাক্যের যে অংশে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয় তাকে উদ্দেশ্য। আর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যা বলা হয় তাকে বিধেয় বলে। যেমন :
খোকা এখন বই পড়ছে
(উদ্দেশ্য) (বিধেয়)
বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় অন্যান্য পদ বা পদসমষ্টিযোগে গঠিত বাক্যাংশও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন :
সৎ লোকেরাই প্রকৃত সুখী-বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত বিশেষণ
মিথ্যা কথা বলা খুবই অন্যায়-ক্রিয়াজাত বাক্যাংশ
উদ্দেশ্যের প্রকারভেদ
একটিমাত্র পদবিশিষ্ট কর্তৃপদকে সরল উদ্দেশ্য বলে। উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশেষণাদি যুক্ত থাকলে তাকে সম্প্রসারিত উদ্দেশ্য বলে।
উদ্দেশ্যের সম্প্রসারণ : সম্প্রসারণ উদ্দেশ্য বিধেয়
১. বিশেষণ যোগে- কুখ্যাত দস্যুদল ধরা পড়েছে
২. সম্বন্ধ যোগে- হাসিমের ভাই এসেছে।
৩. সমার্থক বাক্যাংশ যোগে- যারা অত্যন্ত পরিশ্রমী তারাই উন্নতি করে।
৪. অসমাপিকা ক্রিয়াবিশেষণ যোগে- চাটুকার পরিবৃত হয়েই বড় সাহেব থাকেন।
৫. বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে- যার কথা তোমরা বলে থাক তিনি এসছেন।
বিধেয়ের সম্প্রসারণ : উদ্দেশ্য সম্প্রসারণ বিধেয়
১. ক্রিয়া বিশেষণ যোগে- ঘোড়া দ্রুত চলে।
২. ক্রিয়া বিশেষণীয় যোগে- জেট বিমান অতিশয় দ্রুত চলে।
৩. কারকাদি যোগে- ভুবনের ঘাটে ঘাটে ভাসিছে।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে- তিনি যে ভাবেই হোক আসবেন।
৫. বিধে বিশেষণ যোগে-ইনি আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু (হোন)।
গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার। যেমন :
সরল বাক্য
যে বাক্যে একটিমাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন : পুকুরে পদ্মফুল জন্মে। এখানে ‘পদ্মফুল’ উদ্দেশ্য এবং ‘জন্মে।
এরূপ : বৃষ্টি হচ্ছে। তোমরা বাড়ি যাও। খোকা আজ সকালে স্কুলে গিয়েছে। স্নেহময়ী জননী (উদ্দেশ্য) স্বীয় সন্তানকে প্রাণাপেক্ষা ভালোবাসেন (বিধেয়)। বিশ্ববিখ্যাত মহাকবিরা (উদ্দেশ্য) ঐন্দ্রজালিক শক্তিসম্পন্ন লেখনী দ্বারা অমরতার সঙ্গীত রচনা করেন। (বিধেয়)।
মিশ্র বা জটিল বাক্য
যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ডবাক্যের এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য পরস্পর সাপেক্ষ ভাবে ব্যবহৃত হয় তাকে মিশ্রবা জটিল বাক্য বলে। যেমন :
আশ্রিত বাক্য প্রধান খণ্ডবাক্য
১. যে পরিশ্রম করে সেই সুখ লাভ করে।
২. সে যে অপরাধ করেছে তা মুখ দেখেই বুঝেছি।
আশ্রিত খণ্ডবাক্য তিন প্রকার। যেমন :
ক) বিশেষ্য স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য
যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্যের যে কোনো পদের আশ্রিত থেকে বিশেষ্যের কাজ করে তাকে বিশেষ্যস্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যেমন : আমি মাঠে গিয়ে দেখলাম, খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। (বিশেষ্য স্থানীয় খণ্ডবাক্য ক্রিয়ার কর্মরূপে ব্যবহৃত)
এরূপ : তিনি বাড়ি আছেন কি না, আমি জানি না। ব্যাপারটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে ফল ভালো হবে না।
খ) বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য
যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্যের অন্তর্গত কোনো বিশেষ্য বা সর্বনামের দোষ, গুণ ও অবস্থা প্রকাশ করে তাকে বিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যেমন : লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই। (আশ্রিত বাক্যটি ‘সেই’ সর্বনামের অবস্থা প্রকাশ করছে)।
এরূপ : খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি, আমার দেশের মাটি। ধনদান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা। যে এ সভায় অনুপস্থিত সে বড় দুর্ভাগ্য।
গ) ক্রিয়াবিশেষণ স্থানীয় খণ্ডবাক্য
যে আশ্রিত খণ্ডবাক্য ক্রিয়াপদের স্থান, কাল ও কারণ নির্দেশক অর্থে ব্যবহৃত হয় তাকে ক্রিয়াবিশেষণ স্থানীয় আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যেমন : যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। তুমি আসবে বলে আমি অপেক্ষা করছি। যেখানে আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে গেছে, সেখানেই দিকচক্রবাল।
যৌগিক বাক্য
পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা মিশ্রবাক্য মিলিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
জ্ঞাতব্য : যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্যগুলো এবং, ও, কিন্তু, অথবা, অথচ, কিংবা, বরং, তথাপি প্রভৃতি অব্যয় যোগে সংযুক্ত বা সমন্বিত থাকে। যেমন : নেতা জনগণকে উৎসাহিত করলেন বটে কিন্তু কোনো পথ দেখাতে পারলেন না। বস্ত্র মলিন কেন, কেহ জিজ্ঞাসা করিলে সে ধোপাকে গালি পাড়ে অথচ ধৌত বস্ত্রে তাহার গৃহ পরিপূর্ণ। উদয়াস্ত পরিশ্রম করব তথাপি অন্যের দ্বারাস্থ হব না।
৩৫তম বিসিএস ২০১৫
১. যেমন কর্ম করবে তেমন ফল পাবে। (সরল)
উত্তর : যেমন কর্ম তেমন ফল।
২. সন্ধ্যা হয়ে এলো কিন্তু ট্রেনের খোঁজ নেই এখনো। (জটিল)
উত্তর : যদিও সন্ধ্যা হয়ে এলো তথাপি ট্রেনের খোঁজ নেই।
৩. পনের মিনিট পর তিনি এলেন। (যৌগিক)
উত্তর : তিনি পনের মিনিট দেরি করলেন কিন্তু এলেন।
৪. পুকুরপাড়ে এখন কেউ নেই। (অস্তিবাচক)
উত্তর : পুকুরপাড় নির্জন।
৫. কোথায়ও কি তিনি আছেন? (নেতিবাচক)
উত্তর : কোথায়ও তিনি নেই।
৬. গোলাপটি অত্যন্ত সুন্দর। (বিস্ময়সূচক)
উত্তর : গোলাপটি কী সুন্দর!
বাক্যের গুণ তিনটি। যেমন :
আকাঙ্ক্ষা
বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা তাই আকাঙ্ক্ষা। যেমন : ‘চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে’-এটুকু বললে বাক্যটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে না, আরও কিছু ইচ্ছা থাকে। বাক্যটি এভাবে পূর্ণাঙ্গ করা যায়; চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। এখানে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয়েছে বলে এটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য।
আসত্তি
মনোভাব প্রকাশের জন্য বাক্যে শব্দগুলো এমনভাবে পর পর সাজাতে হবে যাতে মনোভাব প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদবিন্যাসই আসত্তি। যেমন: কাল বিতরণী হবে উৎসব স্কুলে আমাদের পুরস্কার অনুষ্ঠিত। লেখা হওয়াতে পদ সন্নিবেশ ঠিকভাবে না হওয়ায় শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবটি যথাযথ প্রকাশিত হয়নি। তাই এটি একটি বাক্য হয়নি। মনোভাব পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করার জন্য পদগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করতে যেমন: কাল আমাদের স্কুলে পুরস্কার বিতরণী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বাক্যটি আসত্তিসম্পন্ন।
যোগ্যতা
বাক্যস্থিত পদসমূহের অন্তর্গত এবং ভাগত মিলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। যেমন : বর্ষার বৃষ্টিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এটি একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বাক্য। কারণ বাক্যটিতে পদসমূহের অর্থগত এবং ভাবগত সমন্বয় রয়েছে। কিন্তু ‘বর্ষার রৌদ্র প্লাবনের সৃষ্টি করে।’ বললে বাক্যটি ভাবপ্রকাশের যোগ্যতা হারাবে। কারণ রৌদ্র প্লাবন সৃষ্টি করে না।
শব্দের যোগ্যতার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে-
ক) রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা : প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থে শব্দ সর্বদা ব্যবহৃত হয়। যোগ্যতার প্রতি লক্ষ রেখে কতগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হয়। যেমন :
১. বাধিত অনুগৃহীত বা কৃতজ্ঞ বাধ + ইত বাধাপ্রাপ্ত
২. তৈল তিল জাতীয় তিল+ষ্ণ তিলজাত স্নেহ পদার্থ, বিশেষ কোনো শস্যের রস
খ) দুর্বোধ্যতা
অপ্রচলিত ও দুর্বোধ্য শব্দ বাহার করলে বাক্যের যোগ্যতা বিনষ্ট হয়। যেমন : তুমি আমার সঙ্গে প্রপঞ্চ করেছ। (চাতুরী বা মায়া অর্থে কিন্তু বাংলা ‘প্রপঞ্চ’ শব্দটি অপ্রচলিত)।
গ) উপমার ভুল প্রয়োগ
ঠিকভাবে উপমা অলংকার ব্যবহার না করলে যোগ্যতার হানি ঘটে। যেমন : আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হলো। বীজ ক্ষেত্রে বপন করা হয়, মন্দিরে নয়। কাজেই বাক্যটি হওয়া উচিত : আমার হৃদয়-ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হলো।
ঘ) বাহুলদোষ
প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারে বাহুল্যদোষ বটে এবং এর ফলে শব্দ তার যোগ্যতাগুণ হারিয়ে থাকে। যেমন : দেশের সব আলেমগণই এ ব্যাপারে আমাদের সমর্থন দান করেন। ‘আলেমগণ’ বহু বচনবাচক শব্দ। এর সঙ্গে ‘সব’ শব্দটির অতিরিক্ত ব্যবহার বাহুল্যদোষ সৃষ্টি করেছে।
ঙ) বাগধারার শব্দ পরিবর্তন
বাগধারা ভাষাবিশেষের ঐতিহ্য। এর যথেচ্ছ পরিবর্তন করলে শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। যেমন: অরণ্যে রোদন (অর্থ : নিষ্ফল আবেদন)-এর পরিবর্তে যদি বলা হয়-‘বনে ক্রন্দন’ তবে বাগধারাটি তার যোগ্যতা হারাবে।
চ) গুরুচণ্ডালী দোষ
তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ কখনো কখনো গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে। এ দোষে দুষ্ট শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। ‘গরুর গাড়ি’, ‘শবদাহ’, ‘মড়াপোড়া’ প্রভৃতি স্থলে যথাক্রমে ‘গরুর শকট’, ‘শবপোড়া’, ‘মড়াদাহ’ প্রভৃতির ব্যবহার গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ